যাত্রা ও অযাত্রা, শুভ ও অশুভ – মানি বা না মানি!
স্নেহাশীষ ঘোষ, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
বেশ মজার, হ্যাঁ মজাই বলব, বেশ ক’দিন আগে একটা বিষয়ের উপস্থাপনা হয়েছিল আমাদের স্কুলের দেওয়ালে। আমাদের যাত্রা-অযাত্রা, শুভ-অশুভ, আচার-বিচার, লক্ষণ-অলক্ষণ এইসব নিয়ে। যেমন কারও যাত্রায় সাথে আচার বা বড়ি জাতীয় কোনো জিনিস থাকলে সেই যাত্রাটা শুভ হবে না, কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে, এইরকম আর কী! সেটাই হল মজা। কুসংস্কার কম-বেশি চলছে, চলবে। মনের মধ্যে যেটা কাজ করে সেটা আসলে হয়তো একটা ভয়, কারও একটু কম আর কারও একটু বেশি, কেউ মানে আবার কেউ মানে না।
যাইহোক, এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটা বড়-সড় দুর্ঘটনার কথা আর তার সঙ্গে আচার-বড়ির মজার যোগাযোগ, যার থেকে আমি এই বিষয় নিয়ে একটু লেখার উৎসাহ পেয়ে গেলাম। তবে মজার ব্যাপার, কাকতালীয়ভাবে এর সঙ্গে জুড়ে গেল আরও একটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অলৌকিক ব্যাপার। গল্প হলেও সত্যি, তাই ঘটনাক্রম বোঝানোর জন্য একটু বিস্তারিত লিখতে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে হলে একটু ধৈর্য লাগবে এবং বর্ণনায় কিছু পুনরাবৃত্তি হলে, সেটাও মার্জনা করতে হবে।
আমরা যারা কর্মসূত্রে নিজেদের বাড়ি থেকে দূরে প্রবাসে দীর্ঘদিন কাটিয়েছি, ছুটিতে আসার সময় যেমন সেখান থেকে সকলের জন্যে কিছু উপহার নিয়ে আসতাম, ঠিক সেরকমই ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে ব্যাগ-ভর্তি আরও বেশি জিনিস সঙ্গে নিয়ে ফিরতাম, কিছুটা প্রয়োজনে আর বাকিটুকু ভালবাসার টানে। মায়ের হাতের বানানো নাড়কেলের নাড়ু ও আচার থেকে শুরু করে নতুন জামা, জুতো, কলকাতার মিষ্টি সেই জলভরা, কিছুই বাদ যেত না, সবটা অবশ্য অনুমোদিত ওজনের কথাটা মাথায় রেখেই।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে জায়গায় আমি সে-সময় কর্মরত ছিলাম, এখন থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগের সেই সময়কালটা ছোট্ট করে বোঝাতে গেলে বলতে হয়, তখন শুরুতে (৭০ দশকে) দেখেছিলাম সেখানে চার-ছয় পাতার একটা মাত্র স্থানীয় ভাষার (আরবী) খবরের কাগজ পাওয়া যেত আর বড় রাস্তার চৌমাথায় বা বাজারের কোনো এক নির্দিষ্ট জায়গায় সব রকম বিজ্ঞাপনের পোস্টার লাগানো হত। সেই বিজ্ঞাপন দেখেই আমরা সপ্তাহের শেষে সিনেমা দেখতে যেতাম। আরবদের মজলিশি সংস্কৃতি তখনও বেশ প্রকট। তার পরের দিকে নতুন শতকে, সেখানে আপাতদৃষ্টিতে বিনাপয়সায় ২৫-৩০ পাতার অন্তত ৫-৬ রকমের খবরের কাগজ প্রকাশ করা হত, স্থানীয় এবং ইংরেজি ভাষায়। সাথে থাকত Classified এবং অন্যান্য Supplements। এই তথ্য’টা জানিয়ে আমি শুধু সেই দেশের ক্রমাগত উন্নতির ধারাবাহিকতাটা বোঝাতে চাইলাম। এই সুযোগে গর্ব করে এখানে এটাও বলে রাখি যে একটা ছোট্ট রাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী বা UAE, চোখের সামনে কি ভাবে ছোট্ট থেকে একটু একটু করে বড়ো হল, আমরা তার সাক্ষী রয়ে গেলাম।
দুবাই এয়ারপোর্ট, ১৯৬০
দুবাই এয়ারপোর্ট, ১৯৭১
সেখানেই আমার প্রথম দশকের কিছু পরে ১৯৯১ সালের একটা সময়ের এই ঘটনাটা। এত কথা লিখলাম শুধু সমকালীন পারিপার্শিক পরিস্থিতিটা বোঝানোর জন্যে। অথচ সত্যি বলতে কি, আসল ঘটনাটার সময়কাল ছিল সব মিলিয়ে বড়ো জোর হয়তো দশ সেকেন্ড, তার বেশি নয়। পড়ার সময় গল্প মনে হলেও ঘটনাটা কিন্তু একদম অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
প্রতি বছরে এক মাসের ছুটি কাটাতে বাড়ি আসাটা আমাদের কাছে একটা উৎসবের মতো ছিল। সেইভাবে কিন্তু ছুটির শেষে বাড়ি ছেড়ে কর্মক্ষেত্রে ফেরা’টা ছিল বিসর্জনের মতো কিছুটা দুঃখের রেশ আর ‘আসছে বছর আবার হবে’র মতো আশার আনন্দে মেশানো কিছু মুহূর্ত। আমরা বন্ধুরা যখনই ছুটিতে আসতাম বা ছুটি কাটিয়ে ফিরতাম, কেউ না কেউ আমাদের এয়ারপোর্টে ছাড়তে বা নিতে আসত। বলা যায় প্রবাসে এটা আমাদের একটা অলিখিত সামাজিক আইন ছিল, বন্ধুত্বের আইন, ভালোবাসার আইন।
ছুটি কাটিয়ে সেদিন আমরা ফিরেছিলাম বিকেল নাগাদ, দুবাই এয়ারপোর্টে। আমাদের সাথে এক বছরের ছেলে আর চার বছরের মেয়ে। সাথে বেশ কিছু মালপত্র। কথামত আমাদের কোম্পানির সুদানী PRO সঙ্গে ওর এক বন্ধুকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে আমার কর্মস্থলে আমাদের নিয়ে যেতে। ওদিকে আবার দুবাইয়ের এক বন্ধু, নসরতও এসেছে তার স্ত্রী আর তাদের তিন বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে, আমাদের সাথে দেখা করতে। আমি তখন আল-এইন বলে একটা জায়গায় কাজ করি দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ১৩০ কিমি দূরে।
কোম্পানির গাড়িতে (Nissan Altimma, তখন একটু স্পোর্টই টাইপ ছিল আর যেটা তখন আমিই চালাতাম) এত সব জিনিসপত্র তুলতে গিয়ে দেখলাম সব আঁটছে না। একটা ট্যাক্সি নেওয়ার কথা ভাবছি, সেই সময় আমার বন্ধু বলল, “চলো, কাল তো Friday হ্যায় (Weekend, ছুটির দিন), আপ লোগোকো ছোড়কে আতা হুঁ”। ওখানে এটা খুব নর্ম্যাল ব্যাপার। দেড় ঘন্টার পথ, সব মিলে আরাম করে আসা-যাওয়া ঘন্টা চার-পাঁচের ব্যাপার। সেটাই ঠিক হলো। বন্ধু নসরত বোন্বের ছেলে, সপ্তাহখানেক হলো, UAE’র ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে, একটা “হোলসেল কাম রিটেল” ইলেকট্রনিক্স স্টোরের ম্যানেজার, “আ্যকাউন্টস কাম মার্কেটিং” এর লোক। কোম্পানি ওকে সবে একটা নতুন গাড়িও দিয়েছে। তাই লং ড্রাইভের একটা উত্তেজনাও হয়তো তার মনেও ছিল। গাড়িটা Toyota Corolla Station Wagon, বুটে অনেক জায়গা, মালপত্র তোলা হল। আমার কোম্পানির সহকর্মীকে বললাম ওর ইচ্ছে মতো ফিরে যেতে। এত কথা একটু ডিটেলে লিখতে হচ্ছে, কারণ যে ঘটনার কথা লিখতে যাচ্ছি, সেই সময়ের পরিস্থিতিটা বোঝানো খুবই প্রয়োজন। আমাদের নিয়তি সেদিন কি ভাবে কাজ করেছিল সেটা পাঠকদের কেউ মানতে চাইলে মেনে নিতে সুবিধা হবে।
এয়ারপোর্ট থেকে বেড়োলাম। বন্ধু নসরত ড্রাইভারের সীটে, আমি তার ডানদিকে সামনের সীটে আর পিছনে আমাদের দুজনের দুই বউ, তাদের কোলে দুই শিশু, আমাদের মেয়ে তাদের মাঝে। দুবাই তখন এত বড়ো শহর নয়। আমাদের গন্তব্যের দিকে একটু যেতেই শহর ছাড়লেই একটা পরিচিত পেট্রোল স্টেশন ও তার সাথেই সংলগ্ন একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। গাড়িতে তেল ভরে ছেলেমেয়েদের কিছু খাইয়ে আমরাও চা খেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে। বাকি তখনও প্রায় ১২০ কিমি মতো রাস্তা। সন্ধ্যে তখন প্রায় হয়ে আসছে। সেই সময় ওই দেশ এখনকার মতো এত আলো ঝলমলে হয়নি। Highway যথেষ্ট ভালো হলেও, ওতে পুরোটায় তখন আলো ছিল না। শুধু মাঝে মাঝে লোকালয়ের কাছাকাছি কিছু street light ছিল। আল-এইন শহরটা আবুধাবি আমিরশাহীর মধ্যে পড়ে, রাজধানী আবুধাবি শহর থেকে ১৫০ কিমি মতো পূর্বদিকে ওমানের সংলগ্ন একটা ছোটো শহর, যাকে বলে মরুদ্যান (Oasis), UAE’র একটা জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট।
দুবাই-আল’এইন এর রাস্তা (Highway) ধরে যত এগিয়ে যাওয়া যায়, দুধারের চওড়া গাছের সারি (Green Zone) ততই বাড়তে থাকে। দুবাই-আবুধাবির বর্ডার পেড়োলে তখন দুই-দুই চার লেনের বেশ মসৃণ রাস্তা হয়ে গেছে, দু’দিকে একটানা Chain Link Fence, রাস্তার নীচে দিয়ে U-turn, আর সে সময়, শুনলে হাসি পেতো, জায়গা বিশেষে ওই রাস্তার নিচে দিয়ে বানানো হয়েছিল উটেদের যাওয়ার জন্যে Underpass। কোনও পথভ্রষ্ট মরুভূমির জাহাজ, উটেদের সঙ্গে গাড়ির রাস্তায় যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কথা হল, ওই বন্ধু আমাদের আল-এইন’এ ছেড়ে দুবাই ফিরে আসবে। আমরা আগে বেশ কয়েক বছর একই কোম্পানিতে কাজ করতাম। পরে তখন কোম্পানি বদলে গেছে, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব তখনও অটুট, এমনকি এখনও চলছে। রওনা দিলাম, শুরু হল আমাদের সেদিনের যাত্রার শেষ পর্যায়। গাড়ি চলার সাথেই শুরু হল গল্পগুজব। ছুটি থেকে ফিরলে দেশের কী অবস্থা সেটাই প্রবাসীরা প্রথমে জানতে চায় আর যারা দেশ থেকে কাজে ফেরে, তারা জানতে চায় কর্মক্ষেত্রে নতুন নিয়ম-কানুন কিছু চালু হল কিনা। পিছনের মহিলা মহলে নিশ্চয় গত এক মাসে কে কি করেছিল, সপ্তাহান্তে কার কার বাড়িতে আড্ডার বৈঠক বসেছিল, নতুন রেসিপির কি কি খাবার রান্না হয়েছিল, এইসব আলোচনাই হচ্ছিল হয়তো। বন্ধুবর সবে ওখানে গাড়ি চালানো শুরু করেছে, নতুন লাইসেন্স, নতুন গাড়ি। ও দেশে সে সময় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়াটা বেশ কঠিন কাজ ছিল, আমরা বলতাম PhD করার মতো একটা লেগে থাকার ব্যাপার। ড্রাইভিং টেস্টও হত বেশ কঠিন, পাঁচ-ছ’বার ফেল করাটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নেওয়া হতো। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পেতে এক-দেড় বছর তো লেগেই যেত, কারও আবার তারও বেশি। স্কিলের সাথে ধৈর্যের পরীক্ষা হতো বেশি। আমি এখানে এটাই বোঝাতে চাইছি যে, হাত শক্তপোক্ত না হওয়া পর্যন্ত চট্ করে ওখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যেত না। যাইহোক, কথায় কথা উঠলো ড্রাইভিং টেস্টে পাস করার গল্প, গাড়ি চালানো, গাড়ির মেন্টেন্যান্স, সার্ভিসিং, পার্কিংয়ের ঝামেলা, এইসব গাড়ি সন্বন্ধীয় কথাবার্তা আর কি!
সন্ধ্যে তখন পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। যেমন লিখেছিলাম, তখনও হাইওয়েতে স্ট্রীট লাইট হয়নি। বৃহস্পতিবার সেখানে সপ্তাহান্ত। আমাদের যাওয়ার পথে, অর্থাৎ দুবাই থেকে আল-এইন যাওয়ার দিকে গাড়ি বেশ কম। সামনে বেশ দূরে দূরে একটা-দুটো গাড়ির লাল ব্যাকলাইট বা সামনের আয়নায় পিছনের গাড়ির হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। কেউ আবার বেশ স্পিডে আমাদের ওভারটেক করেও চলে যাচ্ছে। অবশ্য উল্টোদিকে আল-এইন থেকে দুবাই যাওয়ার গাড়ির সংখ্যা কিন্তু সেদিন অনেক বেশি। অনেকটা মফঃস্বল থেকে শহরে বেড়াতে যাওয়ার ভীরের মতো। রাস্তার এই আসা-যাওয়ার চার লেনের মাঝখানে চওড়া ডিভাইডারে নতুন লাগানো সব খেজুরগাছ।
গল্প করতে করতে আমরা দুবাইয়ের সীমানা ছাড়িয়ে তখন আবুধাবি আমিরাতে ঢুকে পড়েছি, বলা যায় প্রায় মাঝরাস্তায়। জায়গাটার স্থানীয় নাম ‘আল ফাক্কা’। সেখানে রাস্তার দু’ধারে আর মাঝের মিডিয়ানে তখন গাছপালার সারিতে ভরে গেছে আর রাস্তা অন্ধকারই বলব। গাড়ির হেডলাইটে রাস্তার সামনেটা আর দু’দিকের গাছ ছাড়া বিশেষ কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। পিছনের সিটে বাচ্চারা বোধহয় তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মহিলা’দের গলার আওয়াজও ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হয়েছে। আমরা দুজনে শুধু নিচু আওয়াজে কথা বলে চলেছি আর মোটামুটি ফাঁকা রাস্তায় গাড়িটাও বেশ গতিতে ছুটে চলেছে।
আমাদের সুখদায়ক যাত্রায় হঠাৎ তাল কাটল, কানে এল বন্ধুর মুখ থেকে একটা আওয়াজ, “ওহঃ-হোঃ”। গাড়ির হেডলাইটে সামনে বেশ কাছেই দশ-বারো মিটারের মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল একটা মোটাসোটা লোমশ সাদা ছাগল (বা ভেড়াও হতে পারে) এসে হাজির। দেখলাম গাড়ির দিকে ঘুড়ে তাকানো তার জ্বলজ্বলে দুটো চোখ, যেন কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। হাইস্পিডের মধ্যেই প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষায় রাস্তা আর টায়ারের ঘর্ষণের তীক্ষ আওয়াজ আর তার সাথে সহজাত প্রবৃত্তির জেরে ছাগলটাকে বাঁচানোর তাগিদে ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘোরানো। পিছন থেকে মহিলাদের ভীত-সন্তস্ত্র চিৎকার। বুঝলাম গাড়িটা আর কন্ট্রোলে নেই, অসহায়ের মতো হেলেদুলে দিশাহারা হয়ে কোন দিকে যাচ্ছে সেটা আর বোঝার সুযোগ পেলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কিছু একটা ঘটে গেল। আমরা সবাই নির্বাক, হতভম্ব আর সবার চোখ যে নিশ্চয়ই তখন বন্ধ হয়ে গেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হৃদয়ের স্পন্দন সেই মুহূর্তে ছিল কিনা বলতে পারব না, তবে পরে সেটা দ্বিগুণ হলো তেমনটা অবশ্যই অনুভব করলাম। কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে আমরা কেউ আমাদের মধ্যে ছিলাম না, টোটাল ব্ল্যাক-আউট তাকে বলে।
সম্বিত ফিরে পেলে বুঝতে পারলাম, আমাদের গাড়ি রাস্তা ছেড়ে মিটার দশেক দূরে রাস্তার পাশে বালির সমতল জমিতে এসে থেমে গেছে, গাড়ির মুখ উল্টো হয়ে দুবাইয়ের দিকে আর গাড়ির ভিতরে ও বাইরে চারিদিকে বালি উড়ছে। গাড়ির ভিতরে চট্ করে একনজরে দেখতে পেলাম সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে আছে। পাসে বসে ড্রাইভার বন্ধু বাস্তবিকভাবেই কাঁপছে। আমারই মুখ থেকে প্রথম কথা বেরোল, “আপ সবলোগ ঠিক হো?” মৃদু আওয়াজে সকলের সায় পেলাম। বললাম “জলদি সব বাহার নিকলো”। আমরা নিজেরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে দিলাম। কেউ কিছু বোঝার আগে সকলে বাইরে এসে ছেলেমেয়েদের কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাচ্চাদের দেখে নিলাম কারও কোথাও চোট লেগেছে কিনা। তারা হয়তো জানতেই পারল না, তাদের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেল। তাদের মায়েদের সঙ্গে তারাও সবাই ঠিক ছিল। একটু ধাতস্থ হলে অনুভব করলাম উপরওয়ালার অশেষ কৃপায় আমাদের দুই পরিবারের সকলের নতুন জীবন লাভ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সবাই আপাতদৃষ্টিতে অক্ষত।
বুঝলাম, রাস্তায় হাইস্পিডে থাকাকালীন ব্রেক আর স্টিয়ারিং দুটোই একসাথে প্রয়োগ করায় আমাদের গাড়িটা ডানদিকে ঘুরে এসে পুরো একটা ডিগবাজি খেয়ে আবার সোজা হয়ে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সারা গাড়ি ধুলোয় ভর্তি, বনেট আর ওপরের ছাদ বেশ ভালো রকম তোবড়ানো, সামনের ও পিছনের উইন্ডস্ক্রীন ভাঙা, গাড়ির তিনটে টায়ার, সামনের দুটো এবং বাঁ দিকের পিছনেরটা, ফেটে গেছে। পিছনে রাখা সব মালপত্র কিন্তু যেমন ছিল তেমনই আছে, শুধু আমাদের মেয়ের স্কুলের ব্যাগটা গাড়ি থেকে ছিটকে গিয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে, তুলে রাখলাম। আমাদের বউরা দুজনেই বলল, তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের নিজেদের কোলের ছোটো ছেলে ও মেয়ে কোল থেকে কয়েক মুহুর্তের জন্যে যেন ছিটকে গিয়ে আবার কোলের মধ্যে এসে পড়ল। কথাটা শুনে বুক পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম পাসপোর্টটা নেই। ডিগবাজির সময়ে পকেট থেকে বেড়িয়ে গাড়ির মধ্যেই পড়েছিল, তুলে নিলাম। সবাই নিজের নিজের পার্স, ওয়ালেট, পাসপোর্ট চেক করে নিলাম। সব ব্যাপারটা যখন অনুধাবন করতে পারলাম, বুঝলাম কপাল খুব ভালো থাকায় আমরা সবাই প্রাণে বেঁচে গেছি আর আমাদের কারও গায়ে একটা আঁচড় পর্যস্ত লাগেনি। সব মিলিয়ে হয়তো আট-দশ সেকেন্ডের এই ঘটনা, তবে এটা একটা, যাকে বলে “অবিশ্বাস্য চমৎকারি” ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। রাখে হরি তো মারে কে! বিশ্বাস করতেই হল।
এর পরের ঘটনা না লিখলেও আন্দাজ করা যায়। এই কাণ্ডের পরের মুহূর্তগুলোয় আমাদের শারীরিক অবস্থা ছিল ঠিক ঝড়োকাকের মতো আর মনের দিক থেকে যাকে বলে হতবুদ্ধি (dumbstruck) হয়ে যাওয়া। কয়েক মিনিটের মধ্যে লোকে লোকারণ্য। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে কেউ জলের বোতল, কেউ তাদের গাড়ির fire extinguisher, কেউ তাদের first aid kit, কেউ মাদুর এমনকি কেউ তাদের গাড়ির কুশান পর্যন্ত নিয়ে এল। আমরা সবাই ঠিক আছি কিনা, কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, জল খাব কিনা, সকলের একই চিন্তা, একই প্রশ্ন। আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে, হাতে হাত মিলিয়ে আশ্বস্ত করা, বিশেষত বাচ্চারা ও মহিলারা সকলে ঠিক আছে কিনা তার তদারকি করা। আমাদের কারও কিছু হয়নি জেনে প্রায় সকলেরই সেই পরিচিত আরবি আশ্বস্তি “আল হামদুলুল্লাহ” আর “আল্লাহ্ হো আকবর”। ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, তাঁকে ধন্যবাদ। একটু পরেই দেখলাম আমাদের PRO ও পৌঁছে গেল। আমাদেরকে এই অবস্থায় দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। “ওয়াল্লাহ্! কুল্লু তামাম”? হায় আল্লাহ্, তোমরা সবাই ভালো আছো তো? সবাই ঠিক আছি দেখে সে শান্ত হল। তারপর আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল, গাড়িটার অবস্থা দেখার জন্য।
উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো স্থানীয় ভালো মানুষ নিশ্চয়ই ট্রাফিক পুলিশকে খবর দিয়ে থাকবেন। কাছেই তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যেই “আল ফাক্কা” নামের লোকালয়ে একটা হাইওয়ের ট্রাফিক পুলিশ পোস্ট ও ছোটো একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ ও আ্যম্বুলেন্স এসে হাজির। তাঁরা এসেই প্রথমে জমে যাওয়া ভিড় আর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোকে চলে যেতে বললেন। ড্রাইভার আর প্যাসেঞ্জারদের একদিকে আসতে বলে, মেডিক্যাল স্টাফ আমাদের, বিশষত ছোটদের পালস ও স্টেথো দিয়ে হার্টবিট চেক করে জিজ্ঞাসা করলেন কারও কোথাও চোট লেগেছে কিনা বা কোনো ব্যথা? আমরা সবাই ঠিক আছি জেনে ওরা আবার আ্যম্বুলেন্সে ফিরে গেলেন। ওদিকে নিয়ম মাফিক ট্রাফিক পুলিশ আমার ড্রাইভার-বন্ধুর ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির স্মার্ট-কার্ড চেয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সংক্ষেপে জেনে নিলেন ঠিক কি ঘটেছিল। ফিতে দিয়ে মাপজোপ করে দুর্ঘটনার রিপোর্ট তৈরি করলেন আর শেষে ড্রাইভার ও আমাদের সকলকে পুলিশ স্টেশনে আসতে বললেন। আমাদের PRO ইতিমধ্যে ওর স্থানীয় বন্ধুবান্ধবদের গাড়িতে আমাদের জিনিষপত্রগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলো। সেই কোম্পানির গাড়িতেই আমরা সবাই মিলে পুলিশ স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। মাঝখানে আমাদের নিয়তি আমাদের সঙ্গে যেন একটা খেলা খেলে গেলো, সেটাই বলতে হচ্ছে।
পুলিশ স্টেশনে মেজরের সাথে বসে বন্ধু নসরতের আবার কথা হলো, সব ঘটনার বিবরণের পুনরাবৃত্তি করতে হলো। আমরা পিছনে বসে সবই শুনছিলাম। দিনের আসল চমক তখনও বাকি ছিল। সব শুনে মেজর আমাদের অবাক করে নির্লিপ্ত ভাবে ভাবে আরবীতে যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায়, “ওটা তো একটা জিন ছিল। এরকম ছোট-বড় আ্যক্সিডেন্ট ওই একই জায়গার এক-দুই কিলোমিটারে ব্যবধানে মাঝেমধ্যে হয়েই থাকে”। ওঁর কথা শুনে বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও শরীরের মধ্যে হঠাৎ যেন একটা শিহরণ খেলে গেল।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সব রকমের রিপোর্ট তৈরি হয়ে গেল। বন্ধুকে বেশ কয়েকটা সই-সাবুদ করতে হলো। আমাদের সকলের মেডিকেল টেস্ট হলো ও হেল্থ রিপোর্টও তৈরি হল। প্রধানত ইনসিওরেন্স-ক্লেম এর জন্যে এই রিপোর্টটা খুব প্রয়োজনীয় ছিল। ওঁদের মতে গাড়ির গতি এই রাস্তার ১২০ কিমি এর উর্ধ্ব সীমার বেশ উপরেই ছিল, প্রায় ১৪০-১৫০ কিমি মতো হবে, তবে হয়তো আমাদের দুরবস্থা দেখে মেজর তাঁর রিপোর্টে গাড়ির গতি বিধিবদ্ধ সীমার মধ্যেই লিখে দিয়েছিলেন যাতে ইনসিওরেন্স-ক্লেম এ কোনো অসুবিধা না হয়। সব কাগজী কারবার শেষ করে সকলে আমার ওই কোম্পানির গাড়িতে চড়েই আরও মিনিট ৪৫ পরে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। দেখলাম আমাদের PROর এক বন্ধু আমাদের সব জিনিষপত্রগুলো নিয়ে, বাড়ির নীচে অপেক্ষা করছে। ওকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা খুঁজে পেলাম না, শুধু তার হাত দুটো ধরে বললাম “সুকরন” (ধন্যবাদ)। PRO আমার গাড়িটা আমাকে দিয়ে ওর বন্ধুর সাথে চলে গেল। রাত্রি তখন প্রায় ১০টা হবে।
মরূদ্যান হলেও মাসখানেকের গরমের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরলে, প্রথমে বাড়িটা পরিস্কার করাটা যেমন জরুরী হয়ে পরতো, তেমনই কিছু বাজারও করতে হতো খাওয়ার ব্যবস্থার জন্যে, বিশেষত সাথে খুব ছোট ছেলে-মেয়ে থাকলে। আমার বন্ধু নসরত তার পরিবারকে নিয়ে আমাদের সাথেই রাত্রে থেকে গেল। হাতে হাতে ঝটপট সব হয়ে গেল। আমাদের তিনজন ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আমরা নিজেরা একটু বসলাম, কী ঘটল, তার বিশ্লেষণ করব বলে। আলোচনা বেশি দূর গড়ালো না। আমরা সকলেই শারীরিক ও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ ছিলাম। ঘুমের প্রয়োজন ছিল। সে রাত্রে আমাদের আলোচনা বেশি দূর গড়ালো না। আমার বন্ধুবর তো স্বভাবতই একদমই মনমরা হয়ে পড়েছিল।
পরের দিন শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালে জলখাবার খেয়ে বন্ধুকে নিয়ে রওনা দিলাম অকুস্থানের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। আগে যখন কোনও গুরুতর দুর্ঘটনাগ্রস্থ গাড়ি এই রকম অবস্থায় দেখতাম, তখন ভাবতাম এরকম কি ভাবে হলো? আর এখন আমাদের গাড়িটার এই অবস্থা দেখে ভাবলাম আমরা বেঁচে গেলাম কীভাবে? আবার একবার মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম। বন্ধুকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলতে শুনলাম “আল্লাহ্ হো আকবর”। তখন ঈশ্বরের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোয় কোনো কার্পণ্য ছিল না। যত রকমভাবে দেখা যায়, ততরকম ভাবে গাড়িটাকে দেখলাম – সামনে, পিছনে, পাশে, সবটাই। দেখলাম ধুলোয় ভরা, চারিদিক থেকে তোবড়ানো, মোচড়ানো, সামনের আর পিছনের কাঁচ ভাঙা, গাড়ির ছাদ তোবড়ানো, বনেড ও অক্ষত নেই। তিনটে টায়ার ফেটে গেছে। একা দাঁড়িয়ে একটা করুণ চেহারা করে যেন গাড়িটা কারও কাছে সাহায্য চাইছে, “আমাকে বাঁচাও”। ভাবছিলাম কি ভাবে এই কান্ডটা ঘটলো। সবটুকু দেখে বুঝলাম গাড়িটা fully loaded থাকার কারণে যেমন দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, ঠিক তেমনই আবার এই বেশি ওজনের জন্যেই হয়তো গাড়িটা একটা ডিগবাজি খেয়েই দাঁড়িয়ে গেছিলো। আশ্চর্যের বিষয়, এত কাণ্ডের পরেও গাড়িটা কিন্তু একবারের চেষ্টায় স্টার্ট হয়ে গেল। হার্ট চলছে কিন্তু চলে ফিরে বেড়ানোর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই।
পরের ঘটনাগুলো ওখানকার নিয়মমতো এক এক করে ঘটে গেল। গতকালই বন্ধু নসরত তার ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে এই আ্যক্সিডেন্টের কথা জানিয়ে Inspection এর জন্যে লোক পাঠাতে বলেছিল। ওখানে দিনের কাজ শুরু হতো সকাল ৭টায় বা ৮টায়। কথামতো ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোক এল সময়মতোই আর তার পিছনে এল একটা Recovery Vehicle! ইনসিওরেন্স কোম্পানির জন্যে দেওয়া পুলিশ রিপোর্টের কপি ওঁকে দেওয়া হল। কম কথায় জেনে নিলেন দুর্ঘটনার বিবরণ। গাড়ির অবস্থা দেখে, আমাদের দুজনকে ও আমাদের পরিবারের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন আমাদের রক্ষা করেছেন বলে। উনি এদিক-ওদিক থেকে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন আর একটু মাপজোপও করে নিলেন। বন্ধুকে নির্দেশ দিলেন পরের দিন গাড়ি সংক্রান্ত সব Original Document নিয়ে কোম্পানির Authorised Signatory (PRO)র সাথে ওদের অফিসে আসতে (গাড়িটা ওর কোম্পানির নামে registered বলে), Claim এর দরখাস্তের প্রক্রিয়া শেষ করার জন্যে। উনি চলে গেলেন আর তার পিছনে আমাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটাকে তুলে সেই Recovery Vehicle। হাইওয়েতে কোনো গাড়ি তখন tow করে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম ছিল না। আমরা সবাই যেমন সেদিন নতুন জীবন পেয়েছিলাম, ঠিক সেরকমই বন্ধুর কোম্পানিও মৃতপ্রায় গাড়িটার বদলে একটা নতুন গাড়ি পেয়েছিল। সব ভালো যার শেষ ভালো।
ওরা সব চলে গেল, কিন্তু আমরা দুজন সেখানে একটু থেকে গেলাম, শুধু একটু বুঝে নিতে, যে গতকাল এখানে ঠিক হলো টা কি? হাইস্পিডে ব্রেক করার দরুন রাস্তায় টায়ারের কালো দাগগুলো আর গাড়িটার আঁকা-বাঁকা যাওয়ার পথটা তখনও স্পষ্ট। রাস্তার ধারে যেখানে আমাদের গাড়ি’টা উল্টেছিল, সেই জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটু আগে সেখানে কোনো আখাড়ায় কুস্তির প্রতিযোগিতা চলছিল। ছাগলটা কোত্থেকে এসেছিলেন সেটা দেখার জন্যে রাস্তার ডানদিক বরাবর Chain Link Fence এর বেশ কিছুটা দৈর্ঘ ঘুরে ফিরে দেখে এলাম। কাছাকাছি ১০০-১৫০ মিটারের মধ্যে fence’এ সেরকম কোনো খোলা জায়গা দেখলাম না, যেখান থেকে ছাগলটা বাইরে থেকে রাস্তায় ঢুকে পরতে পারে বা রাস্তার দিক থেকে বাইরে চলে যেতে পারে। গত সন্ধ্যায় এত কাণ্ডের মধ্যে সেই ছাগলটা দেখার বা খোঁজার ইচ্ছা যদিও আমাদের ছিল না, তবুও অনেকেই তাকে খোঁজার চেষ্টা করেও পায়নি।
মেজরের “জিন” এর কথা মনে পড়ে গেল। সেই দুপুরেও সন্দেহ গেল না, এদিক-ওদিক চোখ চলে গেল, যদি তাঁকে দেখা যায়। তাঁর দেখা তো আমরা পেলাম না, তবে আমরা পরিষ্কার দেখতে পেলাম, ঈশ্বর যেন আমাদের এই Roller Coaster এর স্টেজটা আগে থেকেই ডিজাইন করে রেখেছিলেন, যাতে আমাদের কোনো ক্ষতি না হয়। ঠিক ওইখানেই রাস্তার সংলগ্ন একই লেভেলে বেশ বড়-সড় ১৫ মিটার x ৩০ মিটার মতো একটা বালি-মাটির চাতাল (lay by type), হয়তো রাস্তা তৈরির সময় অতীতে এখানে কোনো সাইট-অফিস বা কোনো স্টোরেজ-ইয়ার্ড ছিল। গাড়ি উল্টে ডিগবাজি খাওয়ার জন্যে সুন্দর প্রশস্ত একটা নরম জায়গা যেন আগে থেকেই বানানো হয়েছিল। এখানে হাইওয়েতে হাইস্পিডে আ্যকসিডেন্ট মানেই অনেক খারাপ জিনিষ মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু রাখে হরি তো মারে কে? আমরা সেদিন মাথা নত না করে পারিনি।
আমরা চারিদিকে সব দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কত কিছুই না ঘটতে পারত, যেগুলো সচরাচর ঘটে থাকে, কিন্তু কোনোটাই সেদিন ঘটেনি। যদি ১০০ মিটার পিছনে এই ঘটনাটা ঘটতো, তা’হলে ডানদিকে নীচে সংলগ্ন ঢালু জমিতে পড়ে গাড়িটা ফেন্স এ গিয়ে আটকে যেত। অবস্থাটা আরও খারাপ হতে পারত, যদি ১০০ মিটার সামনে এগিয়ে ঘটনাটা ঘটতো। তা’হলে তো কথাই ছিল না, ডানদিকে মাত্র ২ ফুট উঁচু Metal Barrier আর তার মিটার ছয়েক নীচে Camel Underpass। সেই বেরিয়ার ভেঙে বা টপকে গাড়ি যদি নীচে পড়তো, বোঝাই যাচ্ছে কী হতে পারতো। মিডিয়ানের কোনো খেজুরগাছে ধাক্কা খেয়ে নয়তো ফাঁক গলে যদি গাড়িটা ওপারের উল্টোদিকের লেনে চলে গিয়ে রাস্তার ওপরেই কাত হয়ে বা উল্টে পরে থাকত, আমরা চট্ করে গাড়ি থেকে বেরোতেও পারতাম না। যদি সেই অবস্থায় পিছন থেকে অন্য কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা মারতো, চট্ করে আগুন লেগে যাওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। সম্ভাব্য ঘটনাগুলো অনুমান করতে করতে সারা শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল। ভাবলে এখনও দেয়। এসব অনেক কিছুরই সেদিন সম্ভাবনা ছিল, কিন্ত আমাদের নিয়তি কোনোটাই হতে দেয়নি। উল্টে আমাদের সকলকে সেদিন অক্ষত রেখে, দিয়েছিলেন দ্বিতীয় জীবনের ছাড়পত্র। তাঁর দেওয়া এই দ্বিতীয় সুযোগ নিয়ে আমরা তাঁরই কৃপায় সকলে এখনও ব্যাটিং করে যাচ্ছি। এখনো জানি না তাঁর কি উদ্দেশ্য।
সেদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে অমি আমার বন্ধু ও তার পরিবারকে দুবাইয়ে ছেড়ে এলাম। ফিরতি পথে সেই অকুস্থলে গাড়িটার স্পীড কম করে আর একবার সব জায়গাটা দেখে নিলাম। জানতাম না ওই জায়গাটা আমাদের কাছে একটা তীর্থস্থানের মতো হয়ে যাবে। এই ঘটনার পরে যতবারই ওই রাস্তায় যাতায়াত করেছি, ঠিক ওই স্পটটার কাছে এলেই গাড়ির গতিটা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কমে যেত। এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে দেখে সেদিনের কথা ভেবে নিয়ে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে আবার গাড়ির গতি বাড়াতাম। স্ত্রী সাথে থাকলে বলতো, “চলো, চলো, দাঁড়াচ্ছো কেন?” উত্তরে আমি বলতাম, বোঝানোর চেষ্টা করতাম, “এটা আমাদের একটা তীর্থস্থান, ভয় পাচ্ছো কেন, ধন্যবাদ জানাও।”
এবার উপসংহারে আসা যাক্। ওই সব দেশে তখন কন্স্ট্রাকশন কোম্পানীতে সপ্তাহে শুধু শুক্রবারে একদিন ছুটি থাকত আর শনিবারে সপ্তাহের শুরু। তাই বছরের ছুটি কাটিয়ে সপরিবারে বৃহস্পতিবারে ফেরাটা নতুন কিছু ছিল না। এই দুর্ঘটনার আগেও গেছি আবার পরেও গেছি। বৃহস্পতিবারে পৌঁছে পরের দিন সারা শুক্রবার ধরে বাড়িঘর পরিষ্কার করা, বাজার করা, মেয়ের স্কুলের বইপত্র ঠিক করে দেওয়া, এইসব চলত। পরের দিন শনিবার থেকে বড়দের আবার কাজ আর ছোটদের আবার স্কুল দিয়ে সপ্তাহের শুরু। বলতে চাইছি সেদিন আমরা সেই সংস্কারগ্রস্ত অলক্ষণে বৃহস্পতিবারের বারবেলাতেই ওখানে পৌঁছেছিলাম। সঙ্গে আচার, বড়ি ইত্যাদি। কোম্পানির গাড়ি এলো আমাদের নিতে, প্রয়োজনে সেই গাড়ি বদল হল, জিনের (আরবী ভূতের) কবলে পড়লাম, দূর্ঘটনাগ্রস্থ হলাম আবার সেই কোম্পানির গাড়িতে চড়েই বাড়ি ফিরলাম, অক্ষত অবস্থায়, বলা যায় দ্বিতীয় জীবন নিয়ে। বড়সড় দুর্ঘটনাও ঘটলো, বেঁচেও গেলাম, যা হবার ছিল হলো, যাকে বলে নিয়তি। আচার, বড়ি না থাকলেও এটা হতো।
গিন্নিকে শত বুঝিয়েও সেটা মানাতে পারলাম না যে এই আচার নয়, বড়ি নয়, অযাত্রা নয়, অশুভ নয়, দুর্ভাগ্য নয় বরং সেদিনে এগুলো ছিল আমাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। আমরা খুব জোর সেদিন বেঁচে গেছিলাম, হয়তো এদেরই জন্যে। কে কার কথা শোনে। এরপর থেকে আচার বা বড়ি ভবিষ্যতে আমাদের আর কোনো যাত্রায় সহযাত্রী হতে পারেনি।
এটা ছিল আমাদের একটা “গল্প হলেও সত্যি ঘটনা”। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এটা আমাদের কোনো দুর্ঘটনা ছিল না বরং ছিল একটা শুভমুহূর্ত, যখন আমাদের পুনর্জন্ম হয়েছিল। এখন আমার পাঠকরা কি বলবেন, কি বিশেষণ দেবেন আমাদের এই যাত্রার, এই ঘটনার বা এই মুহূর্তের – অযাত্রা, অশুভ, অলক্ষনে, অলৌকিক, নিয়তি নাকি চমৎকার? সত্য ঘটনাটা যতটা সম্ভব সবিস্তারেই লিখলাম, সকলের বোধগম্য হওয়ার জন্য। বিরক্তির কারণ হলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
পুন: আরব্য রজনী নয়, তবে ওদিকের গুটিকয়েক এরকম ছোটো ছোটো অলৌকিক ঘটনার সত্যি গল্প আছে। সুযোগমতো সকলের সাথে পরে ভাগ করে নেব।
Add comment