বরেন’দা, বলাই’দা, সুখা’দা স্মরণে
স্নেহাশীষ ঘোষ, অমিত ভাদুড়ী
হোস্টেল-৮ এর বরেন দা, বলাই দা!
স্মৃতিচারণে স্নেহাশীষ ঘোষ
আমাদের সেদিনের আলোচনা আমাকে নষ্টালজিক করে একটা আড্ডার দরজা খুলে দিলো। হোস্টেলের একটা ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ে গেল। সত্যি, এই বরেন’দা, বলাই’দারাও যেন আমাদের হোস্টেল-৮ পরিবারের সদস্য ছিলেন। বরেন’দা কে এখন আশা করা ঠিক হবে না, তবে বলাই’দা নিশ্চয়ই আছেন।
মনে পরে একটা দিনের ঘটনা। বলাই দা একবার বলেছিলেন, “আপনারা তো খুব ক্রিকেট খেলেন, চলুন একদিন আমাদের পাড়ার ক্লাবের সঙ্গে একটা ম্যাচ্ খেলুন, দেখি আপনারা কেমন ক্রিকেট খেলেন। তবে টেনিস বলে খেলতে হবে কিন্তু”।
হ্যাঁ – না করতে করতে কোনও একটা রবিবারে দিন ঠিক হলো, কিছুটা মজার ছলে আর বাকিটা বলাইদা’র চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে। হোস্টেলে আমরা সবাই মিলে একটা দল বানিয়ে বলাইদার পিছন পিছন ক্যাম্পাস থেকে বাইরে এসে দানেশ শেখ লেনের অলি-গলি দিয়ে একটা খোলা মতন জায়গায় এসে পৌঁছুলাম। এটাই নাকি মাঠ! মাঠ তো নয়, একটা বড় উঠোন বলা যায়। তিন দিকে এক-দুই তলা বাড়ি আর সেটাই বাউন্ডারি।
কি উত্তেজনা! পাড়ার সব ছেলে-ছোকড়াই বোধহয় মাঠে এসে হাজির। আমরা মাঠে পৌঁছুতেই হাততালি দিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। মনে হচ্ছিল, ওদের কাছে বোধহয় সেদিনের ম্যাচ’টা ছিল বি ই কলেজের সাথে। পরিস্কার করে পিচ বানানো, দুই দিকের উইকেটে চুণ দিয়ে মার্কিং করা। মাঠের একদিকে একটু বসার ব্যবস্থা। স্কোরার’দের জন্যে একটা ছোট টেবিলও রাখা।
আমরা সেদিন কে কে খেলেছিলাম ঠিক মনে নেই, তবে দাদা (তুষার কান্তি ঘোষ) ছিল ক্যাপটেন। দশ না কুড়ি কতো ওভারের খেলা সেও মনে নেই। টসে জিতে বলাইদা’দের দল ব্যাটিং করতে নামলো। কি মার, কি মার। এক রান দু রান নয়, শুধু চার আর ছয়। কোথায় ফাষ্ট বল, কোথায় স্পিন, বল দেখ আর মারো। আমাদের বোলার’দের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র অবস্থা। বলাই’দা নিজেই বেশ রান করলেন। বুঝলাম ক্রিকেট নয়, ওরা বেসবল খেলছেন। ১০০’র উপরে রান করলো ওরা।
আমাদের মাথায় হাত। আমাদের ব্যাটিং শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেলো। টেনিস বলে যে এত জোরে বল করা যায় আমাদের কারও ধারণাই ছিল না। আর ওদের সবাই ফাষ্ট বোলার। বলাই’দা তো দেখলাম অল-রাউন্ডার, ওই পেট নিয়ে কি জোরে ছোটেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। আমরা ৩০ রান মতো করে ধরাশায়ী হয়েছিলাম।
কি লজ্জা, কি লজ্জা।
তবে বিজয়ী’দের অভিনন্দনের আর আমাদের হার স্বীকারে কৃপণতার কোনও জায়গা ছিল না। শুধু বলে এলাম, আমরা টেনিস বলের ক্রিকেটে ঠিক অভ্যস্থ নই।
হোস্টেলে ফিরে দুপুরে খাবার টেবিলে বলাইদা’র উপসংহার, “বাবুদের কি বলেছিলাম, মিলে গেল তো”?
কেউ বললো, “এবার তোমার দলকে এখানে নিয়ে এসো। কলেজের ওভালে ডিউস বলে ২০ ওভারের ম্যাচ হবে। তোমরা রাজি”?
বলাইদা’র উত্তরে কোনও কথা নয়, শুধু একটা মুচকি হাসিই যথেষ্ট ছিল।
হোস্টেলের খাবার যেমনই হোক না কেন, যতই আমরা ওদের ওপর চিৎকার চেঁচামেচি করি না কেন, এই বরেনদা-বলাইদা’রাই যত্ন করে চার চারটে বেলা শুধু আমাদের খাওয়াতেনই না, দৈনন্দিন ব্যাপারেও খেয়াল রাখতেন।
ওনাদের কাছে আমাদের ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারবো না।
*******
সুখাদা
স্মৃতিচারণে অমিত ভাদুড়ী
সবে বোলপুরের ট্রেনে উঠেছি আর সুবীরের (মিত্র) ফোন। আবদার আর দাবি হচ্ছে, souvenir-এর জন্য একটা লেখা দিতে হবে। ওসব লেখালেখি যে আমার কম্ম নয়, তা তো ও মানতেই চায় না। একটা মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করে আমাকে বলল, তুই কি কোনোদিন কিচ্ছু লিখিসনি? আমি মনে মনে ভাবলাম, গুচ্ছ গুচ্ছ specification, report, review, evaluation ছাড়া আর তো বিশেষ কিছু লিখিনি, স্কুল-কলেজে ছাড়া। তাই ওকে কথা দিতে পারলাম না।
কিন্তু দু-আড়াই ঘণ্টার ট্রেন-সফরে একা একা যেতে যেতে ভাবলাম, কলেজ-জীবনের সম্বন্ধে একেবারে প্রথমে যা মনে আসবে তাই নিয়ে কয়েকটা লাইন লিখে দায় সারব। আমার চিন্তা কোনোদিনই ঠিক শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চলে না।
প্রথম মনে এল সুখাদার কথা।
সুখাদা ছিলেন Downing East-এর একতলার ব্যারাকের কর্মচারী। সকালে বিকেলে আমাদের জন্য টিফিন আর চা বানিয়ে দিতেন। ঘরের খেয়াল রাখতেন। এই রকম সুখাদারা floor-এই ছিল। আমরা হস্টেলে গিয়েছি ’৬৯ সালে। শুনেছি আমাদের কয়েকজন মাস্টারমশাই ছিলেন, মানে এমনকি ‘৪০/’৫০ দশকে অনেকেই যারা আমাদের কলেজেরই ছাত্র ছিলেন, সুখাদা সেইসময় থেকে আছেন। তাঁদেরও খেয়াল রাখতেন।
ধুতি আর খাঁকি শার্ট পরা বাঁকুড়া না পুরুলিয়ার, অত জানিনা, সেই সুখাদা পরম যত্নে আমাদের সকালে আর বিকেলে চা, বাটার চিনি দেওয়া টোস্ট, ডিম, সিঙ্গাড়া, কচুরি এসব খাওয়াত। এই মানুষটা যে বাড়ির অভাব বুঝতেই দিচ্ছে না, তখন তেমন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি। সুখাদারা কিন্তু সরকারি কর্মচারী ছিলেন না, অতি সামান্য রোজগার করতেন, আর এঁদেরকে অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে barrack servant বলা হত। আমি তখন থেকেই ওই servant কথাটা ভীষণ আপত্তিজনক মনে করতাম, আর চাইতাম এটার পরিবর্তন দরকার। ব্রিটিশ মানসিকতার খারাপ দিকগুলো বজায় রাখার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না।
যদিও আমরা সুখাদাদের সংসার কীভাবে চলছে, ওরা কীভাবে থাকে—এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করতাম না; তবুও ওদের সঙ্গে কথায় কথায় ওদের হতদরিদ্র অবস্থার কথা জানতাম। আমরা বছর বছর পাস-টাস করে আমাদের ভবিষ্যত আর স্বপ্নগুলো যখন গুছিয়ে নিচ্ছি, ওদের অবস্থা যে কে সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে, তত ভাবতাম না। পরে কর্মজীবনে যখন প্রায় সবাই কমবেশি সাফল্য অর্জন করেছি, তখনও কি সুখাদার কথা একবারও ভেবেছি?
আজ তো আর সুখাদা বেঁচে নেই, কারণ তখনই ওর বয়স প্রায় ৫৫ ছিল, কিন্তু কেন জানি না আমার মনের মধ্যে সুখাদা আজও বেঁচে আছে। পরে যখন অনেক পয়সা আজেবাজে খরচ করেছি, সুখাদার মতো মানুষদের কিছু দিলে বোধ হয় কিছুটা অপরাধবোধ কমত।
দেখতে দেখতে বোলপুর এসে গেল আর আমি একটু বিষণ্ণ মনেই নেমে পড়ে আমার গন্তব্যের দিকে এগোতে লাগলাম।
Amit’s (Bhadury) short memory on Sukhada touched my heart and I could not resist writing a few words on our barrack assistants . I was in Downing West in the year 1961-1962 and our barrack assistant was Ishwari. However often I used to go to Sukhenda’s room in Downing East. Sukhenda was senior to me and from my school Mitra Institution Bhowanipur. I remember Sukhada used to prepare special tea for me and Sukhenda. Most of our barrack assistants were very helpful . However, their service conditions were very weak. I express my regards to all of them and wish all the best to all their family members.