সাহিত্যিকা

ফুটবলের আমি

ফুটবলের আমি
শুভঙ্কর দে, ১৯৭৪ ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং

ফটোতে দাঁড়িয়ে
বাঁদিক থেকে সুব্রত চ্যাটার্জি, শেখর বসু, অমিত রায়, দিলীপ রায়, শুভঙ্কর দে, বাদল মোদক, চিত্তরঞ্জন বৈদ্য।
বসে বাঁদিক থেকে দেবব্রত ব্যানার্জী, মানস রায়, মনোজ বর্মন, দীপেশ দাশ, স্বপন ব্যানার্জি।

ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আমার একটা বাড়তি আকর্ষন ছিলো। আর সেই কারনেই অনেক সময় পড়াশুনাকে, ফুটবলের ভাষায় ডজ করে, ফুটবলকেই প্রাধান্য দিয়ে বাড়িতে অনেক কানমলা আর বকুনিও খেতে হয়েছিলো। কিন্তু ঐ কানমলা বা বকুনি আমাকে ফুটবল থেকে আলাদা করতে পারেনি।

ফুটবলে আমার হাতেখড়ি হয় বাড়ীর সামনের মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমের খেলার মাঠে, সেখানের হোস্টেলর ছাত্রদের সাথে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। কিছুদিনের মধ্যে নিজেই নিজের খেলায় আশানুরূপ উন্নতি লক্ষ্য করেছিলাম। চলে গেলাম স্থানীয় ক্লাব সবুজ সঙ্ঘে। এদের মাঠটা তুলনামূলক ভাবে বড়। সেই ১৯৬৫-৬৬ সালে কলকাতার আশেপাশের মফস্বলের ফুটবলের খেলার মান নিঃসন্দেহেই অনেক উন্নত ছিলো। হাওড়া, হুগলী, ব্যারাকপুর ডিস্ট্রিক্টে রীতিমত ডিভিসন, সাব ডিভিসনের খেলা হতো। আমাদের পাড়ায় একটা মস্ত সুবিধা ছিল যে এখানে শ্রীরামপুর সাবডিভিশনের প্রথম বিভাগের কয়েকটি ক্লাবের স্পটাররা মাঝে মধ্যেই হাজির থাকতেন। শুধু তাই নয়, কলকাতার ডিভিশনেরও বেশ কিছু স্পটার এইসব মফস্বলের লীগের খেলা দেখতে আসতেন।

আমি যে ভালো খেলতাম, সেটা স্কুলে আর আমার শ্রীরামপুরের মফস্বল পাড়ায় অনেকেরই নজরে এসেছিলো। আমাকে খেলায় উৎসাহ দিতে পাড়ার এক কাকুর সাথে যোগাযোগ করে বাবা আমাকে কলকাতা থেকে ফুটবলের বুটজোড়া আনিয়ে দিলেন। সেই আমার প্রথম ফুটবলের বুট, বাবা কিনে দিয়েছিলেন। এরপর আমাকে আর কোনদিন বুট কিনতে হয়নি। এর পরে স্কুলে, শ্রীরামপুরের লোকাল ক্লাব, লোকাল ডিভিসন লীগ, কলেজ সব জায়গায় খেলার দৌলতেই আমি বুটজোড়া পেয়েছি।

ফুটবলে কোন্নগর-রিষড়া ছিলো শ্রীরামপুর সাব-ডিভিশনের অধীনে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সেইসময় শ্রীরামপুর, কোন্নগর, রিষড়া থেকে অনেক ফুটবলার কলকাতা ময়দানে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন, সবার আগে আসবে সুধীর কর্মকারের নাম। এছাড়াও শিশির ঘোষ (মোহনবাগান), ভবানী রায় (মোহনবাগান), সমীর চৌধুরী (ইষ্টবেঙ্গল), উৎপল মুখার্জী (বাটা), আরো অনেকে। আমি স্কুলে পড়াকালীন অনেক নামী খেলোয়াড়ের সাথে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম, বা সান্নিধ্যে এসেছিলাম।

আমি যখন ক্লাস নাইনে, ছাত্র সংঘ তখন শ্রীরামপুর এ ডিভিসন লীগের টিম। তাঁরা আমাকে ডাকলো দিল ওদের রাইট ব্যাক পজিশনের জন্য। সেটাই আমার প্রিয় পজিশন। সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলাম। ছাত্র সঙ্ঘে তখন কলকাতা ফুটবল লীগের প্রথম বিভাগের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় নিয়মিত খেলছে। তাঁদের সাথে আমি খেলার সুযোগ পাচ্ছি। এর মধ্যে একজনের নাম উল্লেখ করতেই হয়। আমার নিজের চোখের সামনে দেখা সেরা গোলকিপারদের মধ্যে একজন। সুনীল সাহা, কালীঘাটের নিয়মিত গোলরক্ষক।

তখন আমার বয়স পনেরো বছর, ১৯৬৬ সাল। তিন বছর চুটিয়ে ফুটবল খেললাম, ছাত্র সঙ্ঘের হয়ে। তখন ক্লাব থেকে বুট আর মোজা দিত। টাকা পয়সার ব্যাপার তখনও চালু হয়নি। কয়েকজন খেলা পাগল লোকের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় এইধরনের ক্লাবগুলো চলতো। তাই খেলার পর পেতাম পাউরুটি আর আলুর দম। আর বড় ম্যাচ, ট্রফির ফাইন্যাল, বা চ্যারিটি ম্যাচ থাকলে আলুর দম এর জায়গায় ডিমের কারী। আমরা এতেই খুশী থাকতাম, কোন অভিযোগই ছিল না।

এর মধ্যে স্কুলের ঘটনা না বললেই নয়। ক্লাস নাইনে আমি মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে টিসি নিয়ে উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হই। রিষড়া থেকে উত্তরপাড়া এই আট কিলোমিটার রোজ ট্রেনে করে যেতাম। এখানে দেখলাম ইন্টার ক্লাস ফুটবল লীগ হয় এবং এই লীগ নিয়েও ব্যপক উদ্দীপনা। তখন ইতিমধ্যেই আমি সাবডিভিশন লীগ চুটিয়ে খেলছি। কিন্তু আমার নতুন স্কুলে আমি এসব কিছুই জানাইনি। কারণ একটাই। সন্ধ্যার পর বাড়ীর বাইরে থাকার অনুমতি ছিলনা। স্কুলে ফুটবল খেলে উত্তরপাড়া থেকে বাড়ী পৌঁছতে নির্ঘাত সন্ধ্যা হয়ে যাবে! ক্লাস নাইন এবং টেন এই ভাবে লুকোচুরি করেই কাটল। তরী তীরে এসে ডুবল ক্লাস ইলেভেনে উঠে। একদিন মাঝের একটা পিরিয়ড অফ ছিল। সবাই একটা ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। আমিও লোভ সামলাতে না পেরে ওদের সাথে নেমে পড়লাম। ব্যাস মাল ক্যাচ! পরের দিন ক্লাস টিচার বললেন যে তুই এত ভাল ফুটবল খেলিস বলিসনি তো! আর বন্ধুদের মন্তব্য সহজেই অনুমেয়। সেই বছর ইলেভেন সায়েন্স চাম্পিয়ন এবং আমার স্কুল টীমে খেলার ছাড়পত্র লাভ। ইতিমধ্যে ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় ইন্টার স্কুল সাব-ডিভিসনের সিলেকশন ট্রায়ালে ডাক পেয়ে সেখানেও শ্রীরামপুর সাব-ডিভিসনের স্কুল টিমে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম।

১৯৬৯ সালে স্থানীয় জগন্নাথ স্পোর্টিং ক্লাব ওদের ক্লাবে খেলার জন্য অফার দিল। কিন্তু আমি রাজী হইনি। ছাত্র সঙ্ঘের হয়ে প্রথম দিকের কয়েকটা ম্যাচ খেলেছিলাম। তারপর সেই বছরেই জুলাই এর শেষে স্কুলের পাট চুকিয়ে চলে এলাম বিই কলেজের হোস্টেলে। বিই কলেজ তখন সম্পূর্ণরূপে আবাসিক কলেজ। শ্রীরামপুর সাবডিভিশনের ফুটবল লীগ খেলায় সাময়িক বিরতি।

এরপর ১৯৬৯ সালে বিই কলেজে গিয়ে ভর্তি হই। কলেজের ওভাল মাঠ আমার ছিলো অতিরিক্ত আকর্ষন। পড়াশুনার বাইরে আমি ফুটবল নিয়েই মত্ত থাকতাম। এছাড়া এ্যাথলেটিকসেও খুব উৎসাহ ছিল। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমি ওভাল মাঠে দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছিলাম। যদিও আমার ফুটবলের হাতে খড়ি শ্রীরামপুরের ময়দানে, এবং শৈশবে কৈশোরের সেই দিনগুলিই আমাকে ফুটবল শিখতে সাহায্য করেছে, কিন্তু বলতে কুন্ঠা নেই, এই ওভালের মতন এত ভালো মাঠে আমি এর আগে খেলার সুযোগ পাইনি।
কলেজের প্রথম সপ্তাহেই ফারস্ট লবিতে পোস্টার দেখলাম, ফ্রেশার ও কলেজ টীমের ফ্রেন্ডলি ফুটবল ম্যাচ হবে। যথাসময়ে বুট বগলদাবা করে ওভালে গিয়ে হাজির হলাম।

আমাদের ইয়ারে বেশ কয়েকজন ভালো ফুটবলার ছিল। যেমন সুবীর মিত্র, সলিল দত্ত, দীপক বসাক, প্রদীপ ঘোষ, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, অপু চ্যাটার্জী, অঞ্জন ব্যানার্জী, গোলে সন্দীপ গুহনিয়োগী। আর কলেজ টিমেও আছে অনেক ভালো প্লেয়ার, কিছু নাম মনে আছে যেমন শঙ্কর মিত্র, আশীষ সাহা (ইঞ্জিন), জ্ঞানরঞ্জন ভৌমিক (জনি), মানস রায়, স্বপন ঘোষ (নান্টু), প্রীতিগোপাল সাহা, মনোজ বর্মন, প্রশান্ত ব্যানার্জি, প্রবীর দেব (বালু)।

কলেজের মাঠের খেলায় আমাদের সেই প্রথম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বিই কলেজের টিম তখন বেশ ভালো। সুতরাং আমাদের সেদিনের অত ভালো টিমওয়ার্ক আর মাঠ দখল করে সমানে সমানে খেলে যাওয়া, সেটা বোধহয় কলেজ টীমের পক্ষে খুব একটা প্রত্যাশিত ছিলো না। সেই বিশেষ দিনটি আমার এখনও মনে পড়ে, আমাদের ফ্রেশারদের সাথে সিনিয়রদের চিরাচরিত ওয়েলকাম ম্যাচে আমি সকলের এতই নজরে পড়েছিলাম যে আমার ফার্স্ট ইয়ারের বন্ধুরা আমাকে খেলার শেষে ওভাল থেকে কাঁধে চড়িয়ে ডাউনিং হোস্টেল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। আমি তো সদ্য বিই কলেজে পা রেখেছি। তাই আমার বিই কলেজের পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়াদে সেই দিনটির কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।

সেকেন্ড ইয়ারেই আমি কলেজ ফুটবল টিমের ডিপ ডিফেন্সে নিজের জায়গা করে নি। মনে পরে কলেজের জার্সি পড়ে প্রথম খেলেছিলাম বিদ্যাসাগর কলেজের বিরুদ্ধে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ময়দান মাঠে খেলা হয়েছিল। আমরা ২-১ গোলে জিতে ছিলাম। খেলার শেষে নিজাম রেস্টুরেন্টে খাওয়া। সে এক বাড়তি আকর্ষণ। আরো এক আকর্ষণ -আমাদের বিখ্যাত কলেজ বাস বা সংক্ষেপে মুড়ির টিনে চড়ে যাওয়া।

১৯৭৩ সালের Winter Meet এ লর্ডস মাঠে তারকা খেলোয়াড় সমৃদ্ধ যাদবপুরের সাথে খেলাটা আমাদের ছিলো প্রেস্টিজ লড়াই। তারিখটাও মনে আছে, ২৫ ডিসেম্বর, সকাল দশটায়। যাদবপুর সেদিন কলকাতা সিনিয়র ডিভিশনের তিনজন প্লেয়ার নিয়ে এসেছে। ফরোয়ার্ডে মোহনবাগানের স্ট্রাইকার প্রদীপ দত্ত। আমি শুধুই টিমের ক্যাপ্টেন নই, আমার উপর একটা বড় দ্বায়িত্ব ছিলো প্রদীপ দত্তকে আটকে রাখা। সেটা ছিলো আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু আমি সেদিন পেরেছিলাম। সেদিন আমরা ড্র করি।

১৯৬৯-৭৪, এই পাঁচ বছর কলেজ ওভাল, লর্ডস এবং বাইরের মাঠেও বি ই কলেজের জার্সি গায়ে দিয়ে অনেক ফুটবল খেলেছি। কখনও জিতেছি, কখনও হেরেছি। কলেজ মাঠে আমরা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজকে হারিয়েছি, তেমনি বিপক্ষের মাঠে আই আই টি খড়গপুর, তারাতলা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকেও হারিয়েছি। শ্রীনিকেতনের মাঠে বিশ্বভারতীর কাছে আমরা হেরে যাই। ময়দানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বিশ্ববিদ্যালয় লীগের খেলায় অংশ গ্রহণ করি। পরবর্তী কালে অন্য কলেজের মাঠেও খেলা হয়েছে। ১৯৭১ সালে সিন্দ্রি, বিহারে All India Inter Engineering College Tournament এ আমরা খেলতে যাই। এছাড়া কলেজের Inter Year, Inter Hostel & Inter Department Football Tournament গুলোতেও আমি নিয়মিত খেলতাম।

এরপর ১৯৭৩-৭৪ এ আমি কলেজের ফুটবল ক্যাপ্টেন থাকাকালীন Inter Department Football Tournament চালু হয় এবং এখনও চালু আছে। আমাদের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্ট্মেন্ট সেই বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪, এই পাঁচ বছরের আমার দেখা সেরা এগারোজনকে বেছে নিতে বললে, আমার টিম হবে দীপেশ দত্ত (১৯৭৫), আশীষ সাহা (ইঞ্জিন) (১৯৭২), শুভঙ্কর দে (১৯৭৪), মানস রায় (১৯৭৩), রনেন কুন্ডু (১৯৭৫), স্বপন ঘোষ (নান্টু) (১৯৭২), সুবীর মিত্র (১৯৭৪), দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৭৪), শঙ্কর মিত্র (১৯৭০), জ্ঞান রঞ্জন ভৌমিক (জনি) (১৯৭২), প্রবীর দেব (বালু) (১৯৭২)

আমার দীর্ঘদিনের মাঠের সঙ্গী, সুবীর (মিত্র), পঞ্চাশ বছর বাদে, সেই ওভাল মাঠে। সুবীর বলেছিল, “চল শুভো, আবার মাঠে নেমে পড়ি”

১৯৭৩ সালে বি ই কলেজের “ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার” মনোনীত হয়ে “শঙ্কর মিত্র চ্যালেঞ্জ শীল্ড” অর্জন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে এক অনন্য সম্মান। এই ফুটবল খেলার মাধ্যমে আমি আমার জীবনে অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি। তার জন্য সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

কয়েকজন প্রফেসরের নাম আমাকে উল্লেখ করতেই হবে যারা আমাদের উৎসাহ দিতেন: প্রফেসর কামদা কান্ত মজুমদার, প্রফেসর ভূপাল দত্ত, প্রফেসর শঙ্কর কুমার দত্ত (প্রোক্টর), প্রফেসর পিপি দাশ, আর কে দত্ত, প্রফেসর যাদব লাল চক্রবর্তী, প্রফেসর শোভেন রায়।

আমাদের কলেজের ফুটবল কিটস সাপ্লাই করত চৌরঙ্গীর বিখ্যাত জি কে স্পোর্টস। প্রতি বছর সেই মুড়ির টিনের চড়ে আমরা সবাই যেতাম জি কে স্পোর্টসে। আর কলেজ অন্য কোথাও খেলতে গেলে কলেজের মাইনিং ডিপার্টমেন্টের সেই বাস, আমাদের সেই বিখ্যাত মুড়ির টিন ছিল আমাদের বাহন।

এবার আমার লেখা শেষ করার আগে এমন একটি ঘটনায় আসি যা সহজ কথায় অলৌকিক। যুক্তি দিয়ে সেই ঘটনা আজও বুঝতে পারিনি। তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে, ’৭১ এর অগাস্ট মাসে বিহার ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, সিন্দ্রির (ধানবাদ) আমন্ত্রণে আমরা ওদের ওখানে অল ইন্ডিয়া ইন্টার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নক আউট ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলাম। দিনটাও মনে আছে, ২৫ আগস্ট, ১৯৭১। আমাদের শিবপুর ছাড়া বাকী টিমগুলো ছিলো FET Jadavpur, REC Jamshedpur, BIT Sindri, REC Srinagar, ISM Dhanbad, BIT Mesra, MIT Muzaffarpur. এখন আমরা যে NIT বলি, তখন সেগুলো ছিলো REC (Regional Engineering College).
সেদিনের টিম ছিলোঃ-
· গোলে শেখর রঞ্জন ভদ্র চৌধুরী (সেকেন্ড ইয়ার, ইটিসি),
· চার ডিফেন্সে আমি (সেকেন্ড ইয়ার, ইলেকট্রিক্যাল), আশীষ সাহা (ইঞ্জিন, ফোর্থ ইয়ার, সিভিল), মানস রায় (থার্ড ইয়ার) আর সলিল দত্ত (সেকেন্ড ইয়ার)। রিজার্ভে রনেন কুণ্ডু (ফার্স্ট ইয়ার, মেটালার্জি)।
· হাফ লাইনে সুবীর মিত্র (সেকেন্ড ইয়ার, সিভিল) আর স্বপন ঘোষ (নান্টুদা, ফোর্থ ইয়ার, ইলেক্ট্রিকাল)। রিজার্ভে মনোজ বর্মন (থার্ড ইয়ার)।
· ফরোয়ার্ডে দিলীপ রায় (পাগলা দিলীপ, সেকেন্ড ইয়ার), চিত্ত রঞ্জন বৈদ্য (থার্ড ইয়ার), জ্ঞান রঞ্জন ভৌমিক (ক্যাপ্টেন, জনিদা, ফোর্থ ইয়ার সিভিল), আর প্রবীর দেব (বালুদা, ফোর্থ ইয়ার, মেটালার্জি)। রিজার্ভে ভাস্কর সেন (থার্ড ইয়ার), শান্তনু বসু রায়চৌধুরী (ফোর্থ ইয়ার, সিভিল)।
এথলেটিক ক্লাবের দেবেশদা (সরকার) আমাদের টিমের ম্যানেজার হয়ে সঙ্গে গিয়েছিলেন। আর আমাদের সাথে ছিলো জনা পনেরো কলেজ অন্তপ্রাণ সাপোর্টার।
এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখি, সম্প্রতি গোলকীপার শেখর দীর্ঘ রোগভোগের পর আমাদের সকলকে ছেড়ে অন্যলোকে চলে গেছে। সে যেখানেই থাকুক, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
আমাদের প্রিন্সিপাল প্রফেসর দুর্গাদাস ব্যানার্জি স্যার একটা সার্কুলার দিয়ে দিলেন, ১৬ জনের নাম দিয়ে, যারা সিন্দ্রিতে খেলতে যাবে।

২৮ আগস্ট কোয়ালিফাইং সেমিফাইন্যাল পর্যায়ে আমাদের খেলা আয়োজক কলেজ সিন্দ্রির সাথে। দুটি কথা এখানে বলে রাখতে চাই। আয়োজক কলেজের আতিথেয়তা নিয়ে আমাদের কোন প্রশ্ন করার সুযোগই নেই। আমরা খুবই ভালো ট্রিটমেন্ট পেয়েছি। তেমনি এরকম ঊশৃংখল সাপোর্টারের পরিবেশেও আমি এর আগে কোনদিন খেলিনি। খেলার শুরু থেকেই সাইড লাইনের ধার থেকে একের পর এক কটুক্তি আমাদের খেলায় মনঃসংযোগ নস্ট করে দিচ্ছিলো, এবং সেটাই ছিলো ওদের মূখ্য উদ্দেশ্য। আমি স্কুল থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক টুর্নামেন্টে খেলেছি, কলেজেও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যাদবপুরের বিরুদ্ধেও খেলেছি, কিন্তু সিন্দ্রির মতন উচ্ছৃঙ্খল সাপোর্টারের পরিবেশে সেই আমার প্রথম ও শেষ অভিজ্ঞতা।

সেমিফাইন্যালে হোম টিম বিআইটি সিন্দ্রি কলেজের সাথে সেই খেলারই একটা ঘটনা আজ বলবো যা আমি যুক্তি দিয়ে আজও বুঝতে পারিনি। সেই ম্যাচে প্রথমার্ধেই আমরা একটা গোল খেয়ে একের পর এক আক্রমণ করতে থাকি। আর এটাও লক্ষ্য করি যে ওদের সাপোর্টাররা ক্রমাগত নিজেদের প্লেয়ারদের আমাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে চলেছে। হাফটাইমের পরে খেলার শুরুতেই কর্নার কিক থেকে উড়ে আসা বল হেড করে ক্লিয়ার করার সময় ওদের দলের একজনের সাথে আমার এয়ার কলিশন হয়, সে আমায় ধাক্কা মারে আর আমি মাটিতে পড়ে যাই। ওদের ঐ প্লেয়ারও তখন নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে আমার মাথার উপর এসে পড়ে। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। এরপরের আধঘন্টা মাঠে যা যা ঘটেছিলো, সেগুলো আমার টিমের অন্যদের থেকে শোনা।

আমি যা শুনেছিলাম, আমি মিনিট খানেকের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে আবার খেলায় ফিরে আসি। আমি নাকি এই ঘটনার পরেও খুবই ভালো খেলছিলাম সেদিন। মিনিট কুড়ি পরে আমি নাকি আমার টিমের একজনকে প্রশ্ন করি খেলার রেজাল্ট কি চলছে? সে আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলেও বলে যে আমরা তখন এক গোলে হারছি। আমি কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছিলাম না কি খেলা, কার সাথে খেলা, আমার সেন্স কাজ করছে না। কিন্তু আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম যে মাঠ ভর্তি দর্শকদের মধ্যে আমি খেলছি।

এবং এখানেই শেষ নয়। সিন্দ্রি ক্যাম্পাসে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকার জায়গায় যখন ফিরে আসছিলাম, তখন আমার দলের সতীর্থরা, ম্যানেজার দেবেশদা এসে আমাকে বলেছিলো যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও আমরা এক গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিলেও আমি নাকি অসাধারণ খেলেছিলাম। আমি তখন শুধুই শুনছিলাম, কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। আমি খানিক পরে জ্ঞান ফিরে পাই, সবকিছু ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি। কিন্তু ঐ ৪৫ মিনিট কি হয়েছিলো আমি আজও মনে করতে পারি না। আমার কোন একটা সেন্স নিশ্চয় কাজ করছিলো না, কিন্তু আমি খেলছিলাম ঠিকমতই, সেখানে আমার সেন্স একদম সঠিক কাজ করছিলো। আমি আজও যুক্তি দিয়ে এর ব্যাখ্যা পাইনি, মনে পড়ে সেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকের বিখ্যাত লাইন -There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy”.

আমি বাড়ি এসে বাড়ির লোকদের এই ঘটনা বলাতে তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার আমাকে অনেক পরীক্ষা করেও আমার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পান নি। অলৌকিক এই ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিলো। ৪৫ মিনিট আমার একটা সেন্স কাজ করছিলো না কিন্তু সেদিন আমার খেলার সেন্স পুরোমাত্রায় কাজ করছিলো।

Sahityika Admin

Add comment