সাহিত্যিকা

“দ্য লক আরড্ গর্জ”, ভিক্টোরিয়া স্টেট, অস্ট্রেলিয়া

“দ্য লক আরড্ গর্জ”, ভিক্টোরিয়া স্টেট, অস্ট্রেলিয়া
স্নেহাশীষ ঘোষ, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু ভূমিকা।
সম্প্রতি আমি সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এলাম, আমাদের ছেলের ওখানে থাকার সুবাদে। আর স্বভাবতই সেখানে কিছু জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের সেই বেড়ানো ঘিরে বেশ কিছু দ্রষ্টব্যের বিষয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। তারমধ্যে মেলবোর্ন সমেত ভিক্টোরিয়া স্টেট বেশ প্রাণবন্ত মনে হলো। মেলবোর্নে একদিন ‘কনডাক্টেড সাইটসীইং’ এর একটা ডে-আউটে ‘দ্য গ্রেট ওশ্যন রোড ট্যুর’ করেছিলাম। ২৪০ কিমি লম্বা এই রাস্তাটা তৈরী করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ফিরে আসা সৈনিক’দের কর্মসংস্থানের জন্য, বেশিরভাগ বিস্তার’টা ভিক্টোরিয়া স্টেটের দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় তট ধরে। পরবর্তী কালে এই রাস্তাটার সফর পর্য্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বৃষ্টিস্নাত সকালে রওনা দিয়ে, সারা দিন ধরে সেই দিনের বাস-ভ্রমণে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া স্টেটের বেশ কয়েকটা দ্রষ্টব্য দেখার সুযোগ হয়েছিল, যেমন একটা ‘সুইস্ চকোলেট ফ্যাক্টরি’, বিশ্বযুদ্ধের শহীদ’দের উদ্দেশ্যে তৈরী একটা ‘মেমোরিয়াল গেট’, একটা রিজার্ভ ফরেস্টে ‘কোয়ালা ওয়াচিং’, একটা ‘রেইন ফরেষ্ট’, ‘আ্যপোলো বে’, ‘দ্য টুয়েলভ আ্যপস্টলস্’ আর সব শেষে সেদিনের মূল আকর্ষণ, ‘দ্য লক আরড্ গর্জ’। আজ এখানে সেদিনের সেই বিশেষ দ্রষ্টব্যের কথা লিখবো, যাকে সবাই “দ্য লক আরড্ গর্জ” বলে জানে, আর যে স্থান’টা অতীতের একটা করুণ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। অবশ্য এই দ্রষ্টব্যেরই সংলগ্ন আরও একটা দ্রষ্টব্য, “দ্য টুয়েলভ আ্যপোষ্টলস্” এর কথাও এখানে অঙ্গাঙ্গী ভাবে এসে যাবে, সেটাও জানাবো। মূল ভ্রমনের এটাও একটা অংশ।

আমাদের সেদিনের ট্যুরের গাইড কাম ড্রাইভার ছিলেন, ক্রেইগ নামে একজন অস্ট্রেলীয় নাগরিক, যেমন ভালো চালক ঠিক ততটাই ভালো ভ্রমণ প্রদর্শক। এই দিকের ঐতিহাসিক ঘটনার, ভৌগলিক চরিত্রের আর রাজনীতির তার জ্ঞান ভালোই। ওর বয়েস কতই বা হবে, চল্লিশের ঘরে। ভিক্টোরিয়ার ছেলে, ফর্সা রঙ রোদে পুড়ে এখন তামাটে, মাথাভরা কোঁকরা বাদামী চুল, ছিপছিপে মাঝারি চেহারা আর বেশ চটপটে হাসিখুশি মিশুকে স্বভাব। কথাও খুব সুন্দর বলে। সেদিন আমাদের লাঞ্চের পরে বাসটা ওশ্যন রোডে উঠে আসতেই, ক্রেইগ সবাইকে জিজ্ঞেস করলো, “আর ইউ এনজয়িং ইওর ট্যুর”? সকলে হ্যাঁ বলতেই আবার শুরু করলো, “গ্রেট। নাও উই’ল বি হেডিং টুওয়ার্ডস দ্য হাইলাইটস অফ দ্য ডে, ‘টুয়েলভ অ্যাপস্টলস্’ ফলোড্ বাই ‘দ্য লক আরড গর্জ’। উই’ল টেক অ্যারাউন্ড ফিফটি মিনিটস ফ্রম হেয়ার”।

সত্যিই তাই, আমরাও এরই জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম, সকলে একটু উত্তেজিত হয়ে নড়েচড়ে বসলাম। দেখতে দেখতেই বাঁ দিকে এসে গেল মহাসাগরের সেই তট। ক্রেইগ এবার বলতে শুরু করলো, “আমাদের রাস্তা এখন প্যাসিফিকের সাদার্ন ওশ্যন এর খুব কাছে এসে গেছে। এভাবেই আমরা অন্তত ঘন্টাখানেক ড্রাইভ করবো। বাঁদিকে দেখছো নীল মহাসাগর আর তার সৈকতে ছড়িয়ে থাকা পাথর। তোমরা দেখতে পাবে, আমরা যত এগোবো, এই সৈকতের মাটি ততো শক্ত হতে থাকবে আর আমরা সাগরের জলের স্তর থেকে একটু একটু করে উপড়ের দিকে উঠে যাব। এই পাহাড়ী এলাকার বিস্তার অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বের সৈকত অবধি। এগুলি লাইম-স্টোনের পাহাড়, খুব শক্ত নয়। মহাসাগরের এই এলাকা’টা দক্ষিণ মেরুর নিরন্তর প্রবল বাতাসের জন্য সাড়া বছর খুবই অশান্ত থাকে। সেই মিলিয়ন বছর ধরে এই ভুখন্ডে তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আর এই নরম পাহাড়ের শরীরের অবক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এবং মহাসাগরের জল একটু একটু করে ভুখন্ডের এলাকা দখল করে নিচ্ছে, যদিও খুবই ধীর গতিতে। বছরের পর বছর ধরে এই জলের ধাক্কায় মহাসাগরের তটে পাথরের দেওয়াল তৈরী হয়ে গেছে। এক নাগাড়ে এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু জায়গায় জলের ধাক্কায় পাহাড়ের শরীরে ফাটলও ধরেছে এবং কালক্রমে কিছু কিছু অংশ ভুখন্ডের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। তারও পরে এক নাগাড়ে একই জায়গাতে ঢেউ এবং ঘুর্ণীর ফলে কোথাও সুরঙ্গর বা গুহার মত চেহারা নিয়েছে আর কিছু অংশ আলাদা হয়ে জলের মধ্যেই এই রকম এপোস্টলস (খুঁটির মত দেখতে পাহাড়ের অংশ) এর গঠন তৈরী করেছে। কথিত আছে বহু বছর আগে নাকি এরকম এপোস্টলস এখানে অনেক ছিল। কিন্তু কালক্রমে তাদের অবক্ষয়ের জন্যে, অনেকেই জলের তলায় চলে গেছে। নবীন শতাব্দীতে কেবল বারোটা এপোস্টলস এর কথাই লেখা আছে, তবে আমরা জলের ওপরে কেবল আটটা’ই দেখে আসছি। তাদের মধ্যে একটা একটু দূরে আলাদা জায়গায় গঠিত হয়েছে। পথে বাস থেকেই সেটা তোমরা দেখতে পারবে। জলের ভিতরে গেলে বাকিদের এখনও নাকি দেখা পাওয়া যায়। আমরা তার থেকে এখনও প্রায় মিনিট কুড়ি দূরে আছি”।
এই বলে ক্রেইগ একটু থামলো।

আমরা তো প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি। আকাশে মেঘ আর নিচে বেশ জোরদার ঠান্ডা বাতাস থাকলেও বৃষ্টি’টা এখন আর নেই। সুন্দর সুনীল মহাসাগর আমাদের সাথে সাথেই চলেছেন। কখনো তিনি একদম আমাদের পাশে এসে যাচ্ছেন আবার কখনও একটু দূরে গাছ-গাছালির আড়ালে। দ্য গ্রেট ওশ্যন রোডে আমাদের বাস-ভ্রমণ আমরা খুব সুন্দর ভাবে উপভোগ করছিলাম।

ক্রেইগ একজন সম্পূর্ণ গাইড। কোথায় কখন কি বলতে হয় সে খুব ভালো ভাবে জানে। তাই আবার বলতে শুরু করলো, “তোমাদের এতক্ষণ ‘টুয়েলভ এপোস্টলস’ গঠনের ব্যাপারে বললাম। এবার ‘লক আরড গর্জ ‘ সম্বন্ধে তোমাদের কিছু কথা জানিয়ে রাখি। এর পিছনে একটা দুর্ভাগ্য-পূর্ণ ইতিহাস আছে, একটা জাহাজের দুর্ঘটনা। তথ্য থেকে যেটুকু জানা গেছিলো, সেটা হলো এই রকম। ‘লক আরড্’ নামে সেই সময়ের একটা দ্রুতগতির জাহাজ ১৮৭৮ সালের ২রা মার্চ ইংল্যান্ডের গ্রেভসেন্ড থেকে রওনা দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের উদ্দেশ্যে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন জর্জ গিব। ৩৬ জন নাবিক ও ১৮ জন সাধারণ যাত্রী (মোট ৫৪ জন) সমেত সেই জাহাজ দু’হাজার টনের কিছু বেশী পণ্যসম্ভারে বোঝাই ছিল। প্রায় তিন মাস পরে ৩১শে মে সেই জাহাজ অস্ট্রেলিয়ার প্রধান ভুখন্ড এবং তাসমানিয়ার মাঝের ‘বাস প্রণালী’, যেটা তাদের গন্তব্য ফিলিপ বন্দরের প্রবেশদ্বার, সেখানে এসে পৌঁছায়। সেই এলাকার যাত্রাপথে কেপ ওটওয়ে ও ছোট্ট কিং আইল্যান্ডের মধ্যের জায়গাটার একটা বদনাম ছিল, কারণ সেটা ছিল খুবই সংকীর্ণ এবং বিপজ্জনক। এই যাত্রাকে বলা হতো, থ্রেডিং দ্য নীডল্’। খুব সতর্কতার সাথে জাহাজ সামনে এগোচ্ছিল। তিন মাস পরে প্রথম ভুখন্ডের দেখা পাওয়ার এবং খুব শিগগিরই গন্তব্যে পৌঁছানোর আশায়, সেই রাত্রে সকলে একটা পার্টির আনন্দে এবং নিজেদের জিনিষপত্র গোছাতে ব্যাস্ত ছিল। জাহাজটা গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গেলেও কিন্তু রাত্রি গভীর হওয়ার সাথে সাথে সারা এলাকা সে রাত্রে ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছিলো। চারিদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, এমন কি বন্দর ওটওয়ে লাইট হাউসের সিগন্যালও না। ক্যাপ্টেন জর্জ গিব সারারাত্রি অতন্দ্র পাহারায় থেকে সতর্ক ভাবে জাহাজ’টাকে চালনা করছিলেন। কিন্তু ভোরের দিকে কুয়াশার ঘনত্ব কমতেই আবছা নজরে পড়ে, কাছেই একটা পাহাড়। ওদিকে প্রহরীর উচ্চকন্ঠে সতর্ক বার্তা শোনা যায় ‘সাবধান, সামনেই ব্রেকার’। কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই ১লা জুন, ১৮৭৮ ভোর চারটে নাগাদ সেই জাহাজ সামনের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে পরে। শোনা যায় ১০ মিনিটের মধ্যেই জাহাজ’টা ডুবে যায়। মাত্র দু’জন কোনও রকমে রক্ষা পায় আর বাকিদের সলিল সমাধি হয় এই মহাসাগরে। ভাগ্যক্রমে টম পিয়ার্স নামে এক শিক্ষানবিস নাবিক একটা উল্টে যাওয়া ভাঙা লাইফ বোটে অজ্ঞান অবস্থায় এই জায়গাতেই তীরে ভেসে আসে। সকালে তার জ্ঞান ফিরলে, জলের মধ্যে কোনও এক মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনে, ঘন্টা-তিনেকের চেষ্টায় তাকেও জল থেকে উদ্ধার করে ডাঙায় নিয়ে আসে। সে ছিল ১৮ বছর বয়সী ইভা কারমিশেল, ওই জাহাজে আটজনের প্রবাসী আইরিশ পরিবারের এক সদস্যা। টমের প্রচেষ্টায় এবং কাছের স্টেশনের কর্মীদের সাহায্যে তাকে সমুদ্রতট থেকে উপরে নিয়ে আসা হয় এবং সকলে তার সেবা-শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। পরে ওই দুর্ভাগ্য-পূর্ণ জাহাজের মালিক হিউজ গিবসন তাদেরকে হোমস্টেডে নিয়ে যান। পরে অবশ্য ইভা আয়ারল্যান্ড ফিরে যায় এবং টম জাহাজের কাজেই তার কর্ম্মজীবন অতিবাহিত করতে থাকে।

লক্ আরডের এটাই ছিল পঞ্চম এবং শেষ যাত্রা। এর আগে এই জাহাজ তিনবার ইংল্যান্ড থেকে মেলবোর্ন এসেছিল আর একবার এসেছিল কোলকাতার বন্দরে। এই হলো সেই লক আরড্ আর তার ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার বিবরণ। এখানকার ‘পোর্ট ক্যাম্পবেল ন্যাশনাল পার্ক’এর তত্ত্বাবধানে এই সব এলাকা এখন পর্য্যটনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। ‘মাটন বার্ড আইল্যান্ডে’ ওই জাহাজের ধংসাবশেষ এখনও দ্রষ্টব্য হিসাবে সংরক্ষণ করা আছে। স্পটে পৌঁছালে আমি তোমাদের বাকি’টা গাইড করে দেব। এখন আমরা টুয়েলভ এপোস্টলস এর কাছে এসে গেছি। বাঁ দিকে তাকালে জলের মধ্যে সেই আলাদা একটা এপোস্টল দেখতে পাবে”। এই বলে ক্রেইগ তার কথা তখনকার মত শেষ করলো। আমরাও চলন্ত বাস থেকেই বাঁদিকে সেই একলা এপোস্টল’টা দেখে নিলাম। তার একটু পরেই আমাদের বাস এসে দাঁড়ালো ‘টুয়েলভ এপোস্টলস’ এর নির্দিষ্ট পার্কিংএ। দেখলাম অনেক ধরনের যানবাহনের এবং পর্য্যটকদের ভীড়, বেশ একটা পরিচিত জনবহুল পর্য্যটনের বাতাবরণ।

বাস থেকে নামতেই একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া আমাদের অভ্যর্থনা জনালো। আকাশ হালকা মেঘে ঢাকা, তাই বাতাসও জলীয় বাষ্পে সমৃদ্ধ। শরীরে গরম জামা-কাপড়, গলায় মাফলার, মাথায় টুপি আর বগলে ছাতা নিয়ে আমরা সকলে সেই তেজ হাওয়ার সম্মুখীন হলাম। দেখলাম পরিস্কার বাঁধানো একটা হাঁটা পথ একটা পাহাড়ী সমতল চাতাল ধরে মহাসাগরের দিকে চলে গেছে। দুই পাশে লাইন করে বন্য ফুল গাছের ঝোপ-ঝার, আর তার মাঝে উৎসাহিত পর্য্যটকদের আসা-যাওয়া। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যেই সেই ভিউইং পয়েন্টে, (অস্ট্রেলিয়ায় এসে শিখলাম, জায়গা বিশেষে যাদের ‘লুক আপ’ বা ‘লুক ডাউন’ বা ‘লুক আউট’ বলে), পৌঁছে গেলাম।

সামনে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর আর তার তীরে ডানদিকে একদম উলম্ব হলদে লাইমস্টোনের পাহাড়ের দেওয়াল, যাকে বলা যায় চাট্টান। উচ্চতায় জলের সূত্র থেকে মিটার ৪০ এর কম নয়, আর তার মাঝখানে কয়েক’শো মিটারের মধ্যেই ছড়ানো ছিটানো কয়েক’টা সেই খুঁটির মত দেখতে বড় বড় পাহাড়ের অংশ, যাকে বলা হচ্ছে ‘এপোস্টলস’। যদিও তারা একে অপরকে কিছুটা আড়াল করছিল, তবুও সাতটা তো খুঁজে পেলাম। আর একটু সামনে এগিয়ে যেতে একদম রেলিং এর একটু দূরে আর একটা, যেটাতে দেখলাম লম্বা-লম্বি ভাবে একটা ফাটলও ধরে গেছে। যদিও ক্রেইগ এই স্পটের জন্যে ২০ মিনিট বরাদ্দ করেছিল, থাকার ইচ্ছা থাকলেও ঠান্ডা হাওয়ার জন্য বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। আকাশে সাদা-কালোয় ছাড়ানো মেঘ, নীচে সেই আকাশের রঙে রঙ্গীন নীল-ধুসর, প্রশান্ত নয়, অশান্ত মহাসাগরের জল রাশি আর তীরে পাহাড়ের দেওয়ালে একের পর এক আছড়ে-পড়া ঢেউ এর গর্জন।

‘টুয়েলভ এপোস্টলস’ তো আমার কাছে শুধু একটা উপলক্ষ্য মনে হলো, আসলে আমার মন কেড়ে নিল সেদিনের প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা তার অশান্ত রূপ। তারই মধ্যে বেশ কিছু ছবি আর দু-একটা ভিডিও তুলে নিলাম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর-কদমে পা চালিয়ে বাসে ফিরে এসে বসলাম। আমাদের মুখমন্ডল এবং হস্তদ্বয় যেন ঠান্ডায় প্রায় অবশ। ক্রেইগ যেরকম বিবরণ দিয়েছিল, সেরকমই দেখে এসে তাকে একটা ধন্যবাদ জানালাম।

সবাই ফিরে এলে, ক্রেইগ এর নিয়মানুগ হেড-কাউন্ট এবং দিনের শেষ দ্রষ্টব্য সেই অভিশপ্ত ‘লক আরড্ গর্জ’এর দিকে রওয়ানা। খুব দূরে নয়, একই তীরে তার অবস্থান। একটা বাঁক পেরিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। ক্রেইগ বাস থেকে নেমে তার স্বভাবসুলভ ইঙ্গিতে আমাদের সকলকে এক জায়গায় ডেকে বললো, “এই সেই ঐতিহাসিক জায়গা – ‘লক আরড গর্জ’। এখানে পাঁচ-ছ’টা লুক-আউট স্পট আছে, সব মিলিয়ে প্রায় তিন-সাড়ে-তিন কিলোমিটার হাঁটা পথ। সব ঠিক মতো দেখতে হলে কম করে ঘন্টা-তিনেক সময়ের প্রয়োজন। তবে আমাদের হাতে অত সময় নেই। এখানে ৪৫ মিনিট সময় নাও। এই সামনের বোর্ডের ইনফরমেশন দেখে, যার যেখানে ইন্টারেস্ট, এই সময়ের মধ্যে তারা সেটা দেখে নিয়ে বাসে ফিরে এসো। এখন সাড়ে-চারটে বাজে। এর পরে রিটার্ন জার্নির আগে একটা ফাইন্যাল স্টপ লাগবে। তাই এখানে বেশী দেরী করা যাবে না। তোমরা এবার রওনা দাও। আমরা ঠিক এখানেই ৬.১৫ মিনিটে মিট করবো। গুড্ লাক্”।

লক আরডের দুর্ঘটনার কথা শোনার পর, সকলেরই বেশ একটা উৎসাহ ও উত্তেজনা ছিল। আমরা উপরের ম্যাপ’টা দেখে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে তিনটে লুক আউট পয়েন্ট বেছে নিলাম। লক আরডের ধংসাবশেষ অন্যদিকে একটূ দূরে ছিল বলে, ওদিক’টা আমরা বাদ দিলাম। পুরো জায়গা’টার মধ্যে একটা ভয়ঙ্করের অনুভূতি ছিল। মহাসাগরের জলের ঢেউ গর্জন করে একের পর এক এই পাহাড়ের দেওয়ালের প্রায় ৪০ মিটার নীচের অংশে আছড়ে পড়ছে আর এক এক জায়গার এক এক রকমের ফাঁক-ফোঁকর, গুহা ও বালির তীরে সেই জল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঢুকে পড়ছে আবার বেরিয়েও যাচ্ছে। দেখেই বুঝলাম শতাব্দী আগে সেই কুয়াশার রাতে এই অঞ্চলে সেই জাহাজের কি অবস্থা হয়েছিল। ভাবলেই শরীরে শিহরণ জাগছিল। মনে হচ্ছিল এখানেই কিছুক্ষণ বসে সেই রাত্রের দূর্য্যোগের যারা শিকার ছিলেন, তাদের সমব্যাথী হই। কিন্তু উপায় নেই, সময় সীমিত। পা চালিয়ে তিনটে পাহাড়ী চাট্টান ঘুরে নিলাম। উপর থেকে মহাসাগরের সেই অশান্ত কিন্তু মনোরম দৃশ্য ভোলা যায় না। মনের মেঘের সাথে প্রকৃতির মেঘলা আকাশ, ঠান্ডা ভেজা বাতাস আর নীল জলরাশি আমাদের দিনটাকে বেশ রোমাঞ্চকরও বানিয়ে দিয়েছিল। লক আরডের ধংসাবশেষ’টা দেখা হলো না ঠিকই, কিন্তু আমাদের সেদিনের ভ্রমণ সার্থক হল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে রূপকথার গল্পের মত যদি এই দুর্ঘটনার দুই উত্তরজীবী টম এবং ইভা দুটো আলাদা পথ না বেছে একসাথে সুখের জীবন যাপন করতো, তা’হলে হয়তো এতটা দুঃখের ভার বহন করে আমাদের এই জায়গাটা ছেড়ে যেতে হতো না। আমরা ও আমাদের সহযাত্রীরা সকলে সময়মতই বাসে ফিরে নিজের নিজের জায়গায় বসে পড়লাম আমাদের ফেরার পথচলার শেষ পর্য্যায়ের জন্যে। সন্ধ্যের তখনও ঘন্টা-খানেক বাকি। বাইরে আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা, ইলশেগুড়ি বৃষ্টি আর ঠান্ডা বাতাসের তেজ আমাদের প্রত্যাবর্তন বেশ রোমাঞ্চকর করে তুললো।

ওশ্যন রোডে উঠে এসে বাস একটু গড়াতেই, ক্রেইগ বলতে শুরু করলো, “হ্যালো ফ্রেন্ডস, গুড আফটারনুন। হ্যাভ ইউ এনজয়েড ইওর ট্যুর, ডিড ইউ লাইক ইট”? সকলে এক বাক্যে সায় দিতেই ক্রেইগ আবার জিজ্ঞেস করলো, “আই হ্যাভ এ কোশ্চেন ফর অল অফ ইউ। হুইচ্ ওয়ান উড ইউ কিপ্ অন টপ্ বিট্যুইন দীজ টু প্লেসেস? রেইজ ইওর হ্যান্ড ইফ্ ইউ প্রেফার্ড টুয়েলভ এপোস্টলস”। মাত্র কয়েকজন হাত তুললো। “ওকে। নাও রেইজ ইওর হ্যান্ড ইফ্ ইউ প্রেফার্ড লক আরড”। আমাদের সাথে বাসের বেশীরভাগ যাত্রীদেরই এর পক্ষে হাত উঠলো। সামনের আয়না’তে এই ভোটাভুটি দেখে ক্রেইগ বললো, “দিস ইজ ন্যাচারাল। লক আরড ইজ দ্য পপুলার স্পট্ ওভার এপোস্টলস। থ্যাংক ইউ ফর শেয়ারিং ইয়োর ওপিনিয়নস”।

তখন প্রায় সাতটা বাজতে চললো। এখান থেকে নন্-স্টপ গেলে আড়াই ঘন্টার মত লাগবে মেলবোর্ন পৌঁছাতে। সেদিনের ট্যুরে সারাদিন কেমন কেটেছিল সেটা ক্রেইগ এর মুখে শুনে নিয়ে এখনকার মত আমার লেখা শেষ করবো।

বাইরে বৃষ্টির সাথে কিছুক্ষণ আগে একটু তুষারপাতও হয়ে গেছে। ক্রেইগ বললো, “প্লীজ ক্লিন ইওর রেসপেক্টিভ উইন্ডোপেনস উইথ দ্য উইন্ডো-ক্লীনারস আই গেভ ইউ। বাই দ্য ওয়ে, দেয়ার ইজ এ সেইং হেয়ার, ‘অ্যা ডে ইজ নট্ অ্যা ডে ইন মেলবোর্ন, ইফ ইউ ডোন্ট গেট অল দ্য ডিফারেন্ট ফ্লেভারস অফ ফোর সীজনস্ অন দ্যাট ডে’। ইউ গাইজ আর লাকি, টু’ডে ইউ এক্সপিরিয়েসড্ ‘অ্যা পারফেক্ট মেলবোর্ন ডে’। দেয়ার ওয়াজ মিস্ট ইন দ্য আরলি মর্নিং, রেইন অ্যাট সেভারেল স্প্লিট টাইমস, থান্ডার স্টর্ম অ্যাট কোয়ালা সাইটিং, সান-শাইন অ্যাট ডিফারেন্ট টাইমস, ওয়ার্ম নুন, কোল্ড ওয়েট উইন্ডি আফটারনুন, অ্যান্ড নাও স্নো-ফল। ইট ওয়াজ অ্যা গ্রেট ডে। হোপ, ইউ অল আর এনজয়িং দ্য ডে”। আমরা যাত্রীরা সকলেই একবাক্যে সম্মতি জানালাম।

একনাগাড়ে ঘন্টা-দুয়েক চলার পর রাত্রি সাড়ে ন’টা নাগাদ বাস ঢুকে পড়লো মেলবোর্ন শহরে। ক্রেইগ সেটা সকলকে জানিয়েও দিল বাসের লাউডস্পীকারে। আর বললো, আমাদের যদি এই ট্যুর ভাল লেগে থাকে, তা’হলে কোম্পানীর ওয়েব-সাইটে আমাদের নিজস্ব মতামত জানাতে। ক্রেইগ এবার বাসের রুট ও স্টপের নাম বলতে থাকলো। স্টপের নাম তো সব মনে নেই, তবে ক্রেইগ যাত্রীদের সুবিধা মত সকলকে একে একে নামিয়ে দিল। প্রয়োজনে একা কোনও মহিলাকে গলির মধ্যের কোনও ঠিকানাতেও ড্রপ করে দিল, কোনও বিরক্তি ছাড়াই। আমাদের যখন হোটেলের সামনে নামালো তখন প্রায় দশটা বাজে। সকলের মত আমরাও ক্রেইগ’কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। বাইরে তখন বেশ ঠান্ডা। ঠিক হোটেলের সামনেই আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল, তাই কোনও অসুবিধা হলো না। ডিনার তো সকলে রাস্তায় সেরে নিয়েছিলাম। রুমে পৌঁছে দেরী না করে স্নান’টা সেরে ফ্রেশ হয়ে সবাই নিজের নিজের কম্বলের নীচে শরীর গলিয়ে দিলাম, গভীর একটা ঘুমের প্রয়োজনে।

 

Sahityika Admin

2 comments

  • লক আর্ড গরজ আমি গিয়েছি।
    স্নেহাশীষ’দা লেখা আর ছবি দিয়ে দুর্দান্ত প্রেজেন্ট করেছে।
    সাহিত্যিকা এভাবেই এগিয়ে চলুক

    • লেখা আর কয়েকটা ছবি আমার নিজের হলেও, কিছু বাড়তি ছবি সহযোগে এটাকে প্রানবন্ত করেছে অসীম।
      সাহিত্যিকার সম্পাদক মন্ডলীর তুলনা হয় না।