ছোটবেলার সেই দিনগুলি
সঞ্জয় চক্রবর্তী, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
বি ই কলেজে পড়তে আসার আগে অবধি আমি আসামে থাকতাম। বাবা নর্থ ফ্রন্টিয়ার রেলওয়েতে চাকরি করতেন বলে আমাদের ওদিকেই থাকতে হয়েছিল। আমার জন্ম হয় লামডিং নামে একটি ছোট শহরে। ওখানে শহরের মধ্যেই একটি টিলা ছিল। সেই টিলার ওপরে দু’জন অফিসারের Bungalow এবং একটি semi under ground water reservoir ছিল। সেই বাড়ি দুটির একটিতে আমরা থাকতাম। এছাড়াও ঐ টিলার ওপরে রামকৃষ্ণ মিশনের একটি ছোট unit এর মতো ছিল।
আমরা চলে আসার পরেই এটি তৈরি হয়।
আজ আমি যখন আমার এই স্মৃতি রোমন্থন করছি, তখন দেশে বিদেশে নানা জায়গায় রামকৃষ্ণ অনুরাগীরা সদ্য প্রয়াত মঠের Vice President, স্বামী প্রভানন্দের স্মৃতিচারণা করে চলেছেন। স্বামী প্রভানন্দ প্রাক সন্ন্যাস জীবনে উপরোক্ত লামডিং শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন। ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে একদিন মিটিং চলাকালীন যখন বরুণ’দা শুনলেন যে আমি লামডিং এর ছেলে, উনি তখন নিজের কথাও আমাকে জানালেন। আমি যখন নরেন্দ্রপুরে পড়তে গিয়েছিলাম, তখন বরুণ’দা Junior Basic School (English Medium) এর Head Master ছিলেন।
আসামে ঐ সময় বেশীর ভাগ বাড়িই বাঁশের তৈরী হতো। কিছু বাড়ি পুরোপুরি বাঁশের তৈরী, আবার কিছু বাড়ির শুধুই নীচের অংশে বাঁশের দেওয়াল, আর তার ওপর সিমেন্ট বালি দিয়ে প্লাস্টার করে বেশি মজবুত ও তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো।
শহরের রেলওয়ে স্কুলটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ফলে ছোটবেলায় আমার আর ঐ স্কুলে যাওয়া হয়নি। আমি ছাত্রজীবন শুরু করলাম ঐ মিশনেরই কর্মাধ্যক্ষ, যিনি আমাদের মাষ্টারমশাইও ছিলেন। মিশনে সকাল বেলায় পড়তে যেতাম। বিকেলে মিশন সংলগ্ন ব্যায়ামাগারে বড়দের ব্যায়াম করা দেখতাম এবং সমবয়সীদের সঙ্গে একটু খেলাধূলো। ব্যস, এইভাবেই কেটে গেছে আমার বাল্যকাল।
১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাবা লামডিং থেকে নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে হেড কোয়ার্টারে মালিগাঁও পান্ডুতে বদলি হয়ে এল। তখনও পর্যন্ত রেলের অফিসারদের জন্য বাংলো বানানোর কাজ চলছিল বলে অনেককেই কিছুদিন অস্থায়ী Accommodation এ থাকতে হয়েছিল। রেলের নিজেদের করা বন্দোবস্ত। তাই প্রথমে গতানুগতিক স্টেশন প্ল্যাটফর্মের কাঠামোটা (স্ট্রাকচার) বানিয়ে তাকে ছ’টা ভাগ করে ছ’জন অফিসারের বাসস্থান বানিয়ে দিল। কিছুটা মজার ব্যাপারই ছিল। যে যার বাড়িতেই রয়েছি। কিন্তু ছাতের দিকে তাকালে মনে হতো যেন কোন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রয়েছি! সেই Corrugated Asbestos শীটের ছাত, আর M. S. Angle এবং M. S, Rod দিয়ে তার supporting structure. “কোথায় থাকেন” বা “আপনাদের বাড়ি কোথায়” জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতাম, “Platform Shelter” এ।
ঐ বছরই আমার High School এ প্রথম পদার্পণ। রেলওয়ে স্কুল তখন বাড়ি থেকে বেশ দূরেই ছিল। তাই পাড়ার এক দিদির সাথে রিক্সায় বাড়ি থেকে স্কুল অবধি যেতে হতো। বাংলা মিডিয়াম স্কুল, কো এডুকেশন নয়। তবে ছেলেদের আর মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা বিল্ডিং। স্কুলের বন্ধুদের টিটকিরি শোনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত মাকে অনেক বলে অনুরোধ করে রিক্সা করে স্কুলে যাওয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম। পাড়ার অন্যান্য বাঙ্গালি ছাত্রদের সাথেই স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। সারাটা রাস্তা যেতে আসতে বন্ধুদের সাথে পথে নানা আকর্ষণীয় জায়গায় থেমে আনন্দ উপভোগ করবার যে সুযোগটা পেয়েছিলাম,রিক্সায় গেলে সেটা হওয়া সম্ভব ছিল না। মনে আছে, পুজোর আগের দিনগুলোতে বাড়ি ফেরার পথে কুমোরপাড়ায় দাঁড়িয়ে মূর্তি গঠনের বিভিন্ন stage দেখবার সুযোগ পেতাম।
কিছুদিন পরেই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা বাংলো তৈরি হয়ে যাওয়ায় “প্ল্যাটফর্ম শেল্টার” থেকে উঠে গিয়ে নতুন বাড়িতে চলে এলাম। লাইনের শেষ বাড়িটা ছিল আমাদের। পাশেই খুব বড় section এর একটা Storm Water Drain এবং তার পরেই সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়।
তখনও শহরের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী অনেক জায়গায় ডেভলপমেন্ট বাকি ছিল। যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম, তারই এক পাশে স্টাফ কোয়ার্টার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অন্য পাশে জলাভূমি। আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই সেই জলাভূমি থেকে উঠে আসা ষাঁড়দের গায়ে ইয়া মোটামোটা ৪-৬ ইঞ্চি লম্বা জোঁক সেঁটে থাকতে দেখতাম। ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাটি কেটে সেই সব নীচু জলাভূমি ভরাট করা শুরু হলো এবং সেখানে পরপর রেল হাসপাতাল, নতুন করে রেলওয়ে স্কুল আর R P F Barrack তৈরি হলো।
আমরা আমাদের নতুন বাড়িতে আসার পরেও দেখতাম যে বাড়ির পাশের পাহাড় কেটে ট্রাক বোঝাই লাল রংয়ের মাটি নানা জায়গায় নীচু জমি ভরাট করবার জন্য নিয়ে যেত। অফিসারদের কলোনি যে জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে একটা “নামঘর” (place of worship) ছিল এবং সেই জন্য কলোনির নাম রাখা হয়েছিল নামবাড়ি অফিসার্স কলোনি। এর একদিকের সীমানায় সেই পাহাড় এবং সেই পাহাড়েরই একটা off shoot টিলায় ছিল N F Rly র জেনারেল ম্যানেজারের Bungalow. আমরা ওখানে থাকাকালীন প্রথম দুয়েকজন জেনারেল ম্যানেজারের একজন ছিলেন আমাদের কলেজেরই প্রাক্তনী, শ্রী বিসি গাঙ্গুলী মহাশয় (সঠিক জানি না, সম্ভবত ১৯৩৫ সিভিল). উনি পরে রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে ওনার সময়েই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এসে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর Double Decker Rail cum Road Bridge উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন।
ঐ ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ চালু হওয়ার আগে পর্য্যন্ত আমাদের কলকাতা আসতে হলে দু’দুবার স্টীমার চড়তে হতো। প্রথমবার নিজের শহরেই। বাড়ি থেকে Willys Station Wagon (Staff car) করে পান্ডু ঘাট অবধি যেতাম। তারপর স্টীমারে ব্রম্মপুত্র পার করে ওপাড়ে আমিনগাঁও (যেখানে এখন আইআইটি, গৌহাটি হয়েছে) পর্য্যন্ত যেতে হতো। এই স্টীমারগুলো self propelled ছিলনা। ওদের আলাদা একটা Tug/Engine টেনে নিয়ে যেত। ব্রহ্মপুত্র নদ পারাপারের সময় স্টীমার থেকে দোতলা ব্রিজ তৈরী হচ্ছে দেখতে পেতাম। প্রথম দিকে Caisson গুলো এবং ধীরে ধীরে স্টীল সুপার স্ট্রাকচার। এই স্টীমারগুলোও ছিল দোতলা, ওপরে আপার ক্লাসের যাত্রীরা, আর তাঁদের জন্য তখনকার সময়ের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ছিল।
ওপারে গিয়ে মিটার গজ ট্রেনে চড়ে এবার আরেক নদী, গঙ্গার পাড়ে মণিহারীঘাট গিয়ে আবার একটা স্টীমার চড়তে হতো। গঙ্গা পারাপারের স্টীমারগুলো self propelled ছিল। ঋতু অনুযায়ী পারাপারের সময়ের কিছু হেরফের হতো। গড়ে দু আড়াই ঘণ্টা লেগেই যেত। ও পাড়ে কখনও সকরিগলি ঘাট অথবা সাহেবগঞ্জ ঘাটে গিয়ে এবার ইস্টার্ণ রেলের ট্রেনে চড়ে যাত্রা শেষ হতো শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশনে। এখন ব্রম্মপুত্র আর ফারাক্কা ব্রিজ হয়ে যাওয়ায় স্টীমারে আর গঙ্গা বা ব্রম্মপুত্র পার হতে হয় না।
এখন পুরনো ব্রিজের পাশেই নতুন রোড ব্রিজ তৈরি হয়েছে।
সেকালের রেলের আপার ক্লাসের কোচগুলোতে আলাদা আলাদা compartment থাকত। একটা কোচে একটা Two-Berth, একটা Six-Berth এবং দুটো বা চারটে Four-Berth compartment থাকত। প্রতিটি compartment এর নিজস্ব দরজা ও টয়লেট থাকত। এখনের মতন টানা লম্বা কোনও corridor ছিল না। রেলের ক্যাটারিং এর লোকজন অনেক সময় বিলের পয়সা নেবার জন্য পরের স্টেশনে ট্রেন থামা অবধি অপেক্ষা না করে এক compartment এর পয়সা নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত অবস্থায় আরেক compartment এ গিয়ে অন্যদের থেকে বিলের পয়সা নিতে যেত। বেশিরভাগ ট্রেনে তখন কোন Pantry car ও থাকত না। পরে যখন কোচের ডিজাইন পালটে মিটার আর ব্রড গজের ট্রেনে corridor এসে গেলো, তখন corridor ও vestibule এর সাহায্যে ট্রেনের এ মাথা থেকে ও মাথা যাওয়াটাই সহজ হয়ে গেল।
গঙ্গা নদীতে বছরের বিভিন্ন ঋতুর সময়ে জলের লেভেল পাড় থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে থাকত। কখনও তীরের কাছে আবার কখনও বা তীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ফলে বিভিন্ন ঋতুতে ট্রেন থেক স্টেশনে নেমে নদীর বালুচরের ওপর দিয়ে হেঁটে স্টিমার পর্য্যন্ত যেতেই এক এক সময় প্রায় ১৫ – ২০ মিনিট লেগে যেত, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বা বয়স্ক হলে আরও বেশি। আর নদী পারাপার হতেই প্রায় দু’তিন ঘন্টা লেগে যেত। বিশেষ করে যেটা মনে আছে যে স্টীমারের খালাসিরা স্টীমারের একতলায় এক ধারে দাঁড়িয়ে দড়িতে একটা ভারী লোহার টুকরো বেঁধে সেটা ছুঁড়ে দিত নদীর মধ্যে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দড়ির এক প্রান্ত এক হাতে ধরে আরেক হাত দিয়ে লোহাটাকে একটু সামনের দিকে ছুঁড়ে দিত। উদ্দেশ্য ছিল যাতে দড়ি vertical হওয়ার আগে লোহাটা river bed ছুঁতে পারে। এটা করা হতো যাতে স্টীমার চলার জন্য যে নূন্যতম water depth (Draft) দরকার, তা পাওয়া যাচ্ছে কি না সেটা পরীক্ষা (check) করা। একবার তো আমাদের স্টীমার মাঝনদীতে বালিতেই আটকে গেল। নদীর জলের তোড়ে সেই বালি না ধুয়ে যাওয়া অবধি স্টীমারের আর কোন গতি নেই। বেলা গড়িয়ে গেল। স্টীমারে যা কিছু খাবার দাবার ছিল, সব ফুরিয়ে গেল। দেখলাম পরের ট্রেনের যাত্রীদের নিয়ে অন্য একটি স্টীমার আমাদের টা টা বাই বাই করতে করতে একটু দূর দিয়ে চলেও গেল। সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় আমাদের স্টীমার নড়ে চড়ে উঠলো। সে এক অদ্ভুত এবং করুণ অভিজ্ঞতা !
এই প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের “গল্পগুচ্ছ” বইয়ের “ছুটি” গল্পের ফটিকের কথা মনে পড়ে যায়। গল্পের শেষের দিকে ফটিক প্রচণ্ড জ্বরের মধ্যেও খালাসিদের জল মাপার সুর গাইছিল।
ধীরে ধীরে ঘাট গুলোর স্থান পরিবর্তন হয়ে গেল। ফারাক্কা বাঁধের তৈরীর সাথে তাল রেখে দুপাড়ে খেজুরিয়া ঘাট ও ফরাক্কা নামে দুটো স্থায়ী স্টেশন তৈরী হল। তারপর থেকেই আগেকার দু আড়াই ঘন্টার স্টীমার যাত্রার সময় কমে গিয়ে মাত্র ২০ – ২৫ মিনিট হয়ে দাঁড়াল। ১৯৭৪ সালে কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসার পর সেই বাঁধের ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলও শুরু হয়ে যায়।
পাশ করার পরে অফিসের কাজে বেশ কয়েকবার পান্ডু / গৌহাটি গিয়েছিলাম, কিন্তু তখন আকাশপথে। এছাড়াও আরও কয়েকবার ৺মা কামাখ্যার টানে কলকাতা থেকে বাড়ির লোকদের সাথে ওদিকে গিয়েছি। আসলে আমাদের ওখানকার বাড়িটার বারান্দা থেকে ৺মা কামাখ্যার মন্দির দেখা যেত। ওখানে যখন ছিলাম তখন তো মাঝেমাঝেই পূজো দিতে যেতাম। তার ওপরে যখনই কোন আত্মীয় স্বজন ওখানে গিয়েছেন, তাঁদের গাইড হয়ে আমাকে যেতে হতো। এছাড়া, প্রতি বছর পরীক্ষার আগে পরে নিজে একাএকাই ৺মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আসতাম।
মন্দিরে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে হাঁটা পথে নীলাচল পাহাড়ের নীচে পোঁছে কাটা পাথরের স্ল্যাব দিয়ে তৈরী সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ে উঠতে হতো। আরেকটা রাস্তা ছিল গৌহাটি দিয়ে। এই দুটো পায়ে-হাঁটা-রাস্তা ছাড়া একটা মোটর চলার রাস্তাও আছে। তবে সেই রাস্তা দিয়ে সে যুগে সাধারণের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না থাকায় দর্শনার্থীরা খুব একটা যাতায়াত করতেন না।
স্কুলজীবনে যখন যেতাম, তখন মন্দিরের ভেতরে (গর্ভগৃহে) প্রদীপের আলো ছাড়া অন্য কোন আলো বাতাসের ব্যবস্থাই ছিল না। পরে ধীরে ধীরে আলো, পাখা, এমন কি ventilation duct এর ব্যবস্থাও করা হয়েছে দেখেছি। তাছাড়া মন্দির প্রাঙ্গণ ও মন্দিরের আশেপাশের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিও ক্রমশঃ হতে দেখেছি। আগে সমস্ত দর্শনার্থীদের জন্য একটাই লাইন ছিল। পরে ভিআইপি দের জন্য আলাদা লাইন করে দেওয়া হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই ৺মায়ের মন্দির আমায় আকর্ষণ করত। পরিবেশ বেশ শান্ত, স্নিগ্ধ। ছুটির দিন না হলে কোন ভিড় নেই। পুরোহিত পাণ্ডাদের কোন উপদ্রব নেই। পারিবারিক পাণ্ডার নাম বলে দিলে অন্য কোন পাণ্ডা বিরক্ত করবে না। এমন কি নিজেদের পারিবারিক পাণ্ডা কোথায় আছেন, সেটাও খুঁজে বের করে দিতে এগিয়ে আসতেন। মনে আছে, আমাদের পাণ্ডা (৺ হরকুমার শর্মা) তো আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রসাদ, প্রসাদী ফুল, রক্তবস্ত্র ইত্যাদি একত্র করে গুছিয়ে দিতেন যাতে ওগুলো সযত্নে আমি বাড়ি পর্য্যন্ত নিয়ে যেতে পারি। মনে পড়ে, প্রথমে পূজোর ডালা, মালা ইত্যাদি কিনতে সাহায্য করে তারপর নিয়ে যেতেন “সৌভাগ্য কুণ্ডে”। “সৌভাগ্য কুণ্ড” পাথরের সোপান দিয়ে তৈরী। বছরের বিভিন্ন ঋতু অনুযায়ী এবং প্রাকৃতিক কারণেই কুন্ডের জলের লেভেল ওঠা নামা করে। সেখানে উনি স্নান করার মন্ত্রপাঠ করিয়ে মাথায় সেই কুন্ডের জল ছিটিয়ে নিতে বলতেন। তারপর লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে ৺মায়ের কাল্পনিক মূর্তির সামনে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্র পাঠ করিয়ে বলতেন, “লাইন ধরে ধরে এগোতে থেকো।” শেষে গর্ভগৃহে নেমে দেবীর উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠ, মালা পরানো, স্পর্শ করা এবং পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী দেবীদের উদ্দেশ্যেও পূজা শেষ করে গর্ভগৃহ থেকে উঠে এসে মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালে খোদাই করা বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি, মন্দির প্রতিষ্ঠাতা রাজবংশের কিছু সদস্যদের মূর্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। সবকিছু শেষ হলে পর মন্দিরের বাইরে এসে মন্ত্রপাঠ করিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে আসতে বলতেন। ওনারা দূর থেকে আসা দর্শনার্থীদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন পর্য্যন্ত করতেন। যখন আশেপাশে থাকবার ব্যবস্থা ছিলনা, তখন ওনারা নিজেদের বাড়িতেও অতিথিদের রাত্রিবাস করতে সুযোগ দিতেন।
এই মন্দিরে পশুবলির ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে অনেকে এখানে এসে পায়রা উৎসর্গ করে উড়িয়ে দিতেন। অম্বুবাচী উৎসবের সময় মন্দির সাধারণের জন্য বন্ধ থাকে। তবে অম্বুবাচী উৎসবের আগে ও পরে সারা ভারতের সাধুদের প্রচুর সংখ্যায় আগমন হয়ে থাকে। ঐ সময়ে দর্শন করতে গেলে সাধুদের ভিড়ে অসুবিধে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে আমরা সংসারীরা ঐ সময়টা সবসময় এড়িয়ে গেছি।
কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে আসার পর যখন যখন ৺মাকে দর্শন করতে গিয়েছি, তখন গৌহাটিতে কোনও একটা হোটেলে থেকেই যাতায়াত করেছি। তবে নভেম্বর, ১৯১৭ তে মন্দির সংলগ্ন OYO হোটেল চেইনের একটা আস্তানায় ছিলাম। গৌহাটী এয়ারপোর্ট থেকে সোজা সেইখানে গিয়ে রাত্রি কাটিয়ে সকাল সকাল দু’ পা গিয়ে মন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে, পূজো দিয়ে, ঐ হোটেলেই দুপুরের খাওয়া সেরে, ওখান থেকেই গাড়ি ভাড়া করে সোজা শিলং।
গল্প করতে করতে লেখাটা অনেক লম্বা হয়ে গেল! নিজের স্মৃতির ওপর খুব একটা ভরসা সবসময় করতেও পারিনা। তাই হয়তো দু’চারটে তথ্যে সময়কাল জনিত ভুল্ভ্রান্তি থাকতে পারে, অনিচ্ছাকৃত অপরাধ মার্জনীয়।
আজ লেখাটা পরলাম। খুবই ভালো লাগল। আমার এক আত্মীয় এই ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণের সংগে যুক্ত ছিলেন।থাকতেন পান্ডুর Rly. Quarters এ ।ছোটবেলায় ওনার কাছে নির্মাণ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা শুনেছি। তাই আরো ভাল ভাবে relate করতে পারলাম ।
একটা ভুল দেখলাম। 1917 র জায়গা মনে হয় 1997 হবে।👍👍👍👍