আমি ও আমার বিই কলেজের ফিল্ড ইভেন্টস
সঞ্জয় কুমার চক্রবর্তী, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
উপরের ফটোতে আমি পিছনে দাঁড়িয়ে, ডানদিক থেকে দ্বিতীয়, ক্যমেরার দিক থেকে।
এটি বিই কলেজ এথলেটিক ক্লাব কমিটি, ১৯৬৯-৭০ (ফটো সৌজন্যে অজয় দেবনাথ, ‘৭০ ইলেকট্রিক্যাল)
আমার স্কুলজীবন শুরু হয় পূর্বোত্তর সীমান্ত রেলওয়ের (নর্থ ইষ্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে) প্রধান কার্যালয় পাণ্ডু, শহরের রেলওয়ে স্কুলে। রেলওয়ে স্টেডিয়ামের ভেতরে যে বাস্কেটবল কোর্টটা ছিল সেটা আমাদের স্কুল থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। কিন্তু স্কুল ছুটির পর আমাদের সবাইকেই বাড়ি চলে যেতে হতো। আর বাস্কেটবল খেলা হত ঐ কোর্টেই, রাত্রে। বাস্কেটবল নিয়ে আমার ভালোবাসার শুরু সেইসময়, সেই ছোটবেলার স্কুলের দিনগুলো থেকেই। কিন্তু আমার খেলার সুযোগ থাকলেও বাড়ির নিয়মকানুনের জন্য খেলতে পারতাম না। সাধারণত রেলওয়ে কর্মচারীরা তাদের অফিস ছুটির পর সেখানে রাত্রেই খেলতে আসতেন। কিন্তু আমাদের মতন স্কুলের ছাত্রদের সে যুগে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকা এবং খেলাধূলা করার অনুমতি ছিলো না। আমরা ছিলাম নিয়মের বেড়ায় আবদ্ধ, খেলতে পারবো, তবে পারিবারিক নিয়মকানুন বজায় রেখে। যা কিছু খেলাধুলা, সূর্য্য অস্ত যাওয়ার আগেই সেরে ফেলতে হবে। বাবা নিয়ম করে দিয়েছিলেন, সন্ধ্যের অন্ধকার হওয়ার আগেই খেলা শেষ করে বাড়ি ঢুকে পড়তে বসো। তবু তারই ফাঁকে মাঝেমাঝেই সেই কোর্টে গিয়ে বড়দের খেলা দেখে একটু এট্রাকটেড হয়ে পড়েছিলাম। অবশেষে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ১৯৬৭ এবং তার রেজাল্ট আউট হওয়ার আগের সেই দুই আড়াই মাসের যে সময়টুকু ছুটি পেয়েছিলাম, তখনই রোজ ওই কোর্টে গিয়ে খেলাটাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করি।
বিই কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি কলেজে একটা বাস্কেটবল কোর্ট আছে। সুন্দর কোর্ট, রাতে ফ্লাড লাইটে খেলারও ব্যাবস্থা আছে। সেদিই মনে একটা কৌতূহল খোঁচা মারলো যে এই কলেজের এত বড় আবাসিক ক্যাম্পাসে দু’হাজারের মতন ছাত্রছাত্রী, এবং একটিই মাত্র কোর্ট, সেখানে নিশ্চয়ই অনেক প্লেয়ার খেলে। আর যথেষ্ট ভীড় হয়। এই অবস্থায় সেখানে আমার খেলার সুযোগ পাওয়ার আদৌ কি কোন সম্ভাবনা আছে? আর আমিও কলেজে নতুন, তাই এও জানি না সিনিয়রদের মধ্যে কে কিরকম ভালোমন্দ খেলেন। আরও একটা প্রশ্ন আমি নিজেকেই করতাম। আমার হাইট তো মাত্র ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এই হাইট নিয়ে আমি কি চান্স পাবো?
কলেজে ভর্তি হয়েছি গরমকালে, আর আউটডর বাস্কেটবল খেলার সীজন শীতকাল, সুতরাং অপেক্ষা করে রইলাম। তবে নিজের সাধ্যমতন গোয়েন্দাগিরি করে খোঁজ নিলাম কারা কারা খেলে।
অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এলো। পুজোর ছুটির পর একদিন মাঠের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখলাম যে কোর্টে খেলা হচ্ছে। একজন আমার মতোই বেঁটেখাটো দাদাকে দেখে মনে হলো উনিই বোধহয় মাঠের কর্তা। সাহস করে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আমি কি এখানে খেলতে পারি?”
উনি জানতে চাইলেন আমি কি এই কলেজের ছাত্র? বললাম “হ্যাঁ”
– আগে কখনো বাস্কেটবল খেলেছো?
– হ্যাঁ, স্কুলে ক্রিকেট আর ক্লাবে বাস্কেটবল খেলেছি।
– খেলবার জন্য উপযুক্ত শর্টস আর কেডস আছে?
– আছে।
– তাহলে কাল ওগুলো পরে চলে এসো।
সেদিনের সেই প্রশ্নটি যথার্থ ছিলো, কারণ আমার ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির কচি কচি চেহারাটা মেপে নিয়ে উনি আমাকে বিই কলেজ মডেল স্কুলের ছাত্র ভেবে ভুল করে থাকতেই পারেন।
পরের দিন শর্টস আর কেডসে সজ্জিত হয়ে কোর্টে গেলাম। মানে বিই কলেজ কোর্টে সেই আমার প্রথম দিন। প্রথম দিন খেলেই বুঝলাম যে আমার থেকে ভাল খেলে, এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র গোটা বারোজনের বেশী হবে না। যার অর্থ, আমি হয়তো রিজার্ভে তেরো নম্বর হতে পারি। মানে কলেজ টিমের প্রথম বারোজনে আমার চান্স হতেও পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু হয়ে গেলো!
সেই বেঁটেখাটো সাইজের সুজয় গাঙ্গুলি, ফাইন্যাল ইয়ার সিভিল, কলেজ টিমের ক্যাপ্টেন, দিলদার হাসিখুশি জমাটি মানুষ। কলেজের দুর্বল টিমকে সবল করে তোলার জন্য চেষ্টা করছেন। আজ অর্ধশতক পরে সঠিক বলতে পারবো না তবে যতদূর মনে হয়, ওনার সময়েই আমরা একজন পেশাদার বাস্কেটবল কোচের থেকে ঠিকমতন কোচিং পেয়েছিলাম, যদিও সময়ের অভাবে সে বছর কোচিং বেশী দিন চালানো যায়নি। তবুও সুজয়’দা চেতলার ‘রাখী সঙ্ঘ’ এবং আরও দু’একটা বাইরের টিমের সাথে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ করতে পেরেছিলেন।
১৯৬৯ সালে আমাদের কলেজে All West Bengal Inter Engineering Colleges Games and Athletic Meet এর আয়োজন হয়। প্রচুর পরিশ্রম করেও দুর্ভাগ্যবশতঃ কলেজের পয়েন্টের ভাণ্ডারে কিছু অবদান রাখতে পারলাম না, যদিও আমার পাঁচ বছরের কলেজ জীবনের সব থেকে ভাল টিম ঐ সময়েই ছিল। বাস্কেটবলে ১২ জনের টিম হয়, আর আমাদের সেই টিমে ছিলো প্রদীপ’দা (দাশ, পপ,’৭০ সিভিল), নেপালের প্রকাশ’দা (শ্রেষ্ঠা, ’৭৩), নেপালের শ্রীরাম’দা (ভগত মাথে, ‘৭৩) রমেশ’দা (ডালমিয়া, ডালি, ’৭০), কল্যাণ’দা (রায়, ‘৭১ মেকানিকাল), কুমারকান্তি’দা (মজুমদার, ‘৭১ আর্কিটেকচার), (ঐ ব্যাচে আরেকজন কল্যাণ রায় ছিল। সে অবশ্য লম্বা ছিলো আর এনাকে মাঠে অন্য একটা নামে পুটে বলেই সবাই সম্বোধন করতো), অরিজিৎ’দা (রায়, চার্লি’দা), উদিত’দা (ধর,‘৭২ ইটিসি) প্রশান্ত’দা (ঘটক, ৭২ ইটিসি উরফ্ ঘটু’দা), তপন’দা (মুখার্জি, ‘৭২-৭৩ মেকানিকাল, আরেক হ্যান্ডু ছেলে), পিটার লী (‘৭৩), আর আমি। এর মধ্যে পিটার লী দারুণ হকিও খেলতো, কলকাতা ইউনিভার্সিটি ট্রায়ালে সিলেক্ট হয়েছিলো।
১৯৬৯ উইন্টার মিটে, দুর্ভাগ্যবশত আমরা একটা খেলাতেও জিততে পারিনি, যদিও আমাদের সময়ে বিই কলেজের বাস্কেটবল টিম সত্যি খুবই ভালো ছিলো। মেরিনের টিম এমন কিছু সাংঘাতিক নয়, কিন্তু অসাধারণ ওঁদের পালোয়ানের মতন বডি। বডির ধাক্কাতেই তো আমি ছিটকে যাই। যাদবপুরে প্লেয়ার্স কোটায় বেশ কিছু ভালো প্লেয়ার ছিলো। আর দুর্গাপুরের ছেলে ‘চিকেন” (নাম জানিনা, এই নামেই সবাই ডাকছিলো) একাই আমাদের হারিয়ে দিলো। আর যাঁদের বিরুদ্ধে ভেবেছিলাম নিশ্চিত জিতবো, সেই জলপাইগুড়ির কাছেও হেরে গেলাম। তখন অনেকবার ভেবেছি, আমাদের এত ভালো টিম, কিন্তু একটা ম্যাচও জিততে পারলাম না কেন? না কি, আমরা আমাদের সেরা খেলাটা সেইসময় বার করে আনতে পারিনি? এর উত্তর আমি পাইনি।
পরের বছর ৭০-৭১ সালে প্রদীপ কুমার দাস (১৯৭০ সিভিল, পপ দাস) আমাদের ক্যাপ্টেন। পপ’দা সীজনের শুরু থেকেই পেশাদার কোচ সুভাষ মিত্রকে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করে দিলেন। সুভাষ’দার আরেকটা পরিচয়, উনি আমাদের Architecture and Town & Regional Planning Department এর Head, প্রফেসর অবনী কুমার দে’র শ্যালক। দেখতে ভারী হ্যান্ডু, মানে হ্যান্ডস্যাম ছিলেন। সুভাষ’দা বাড়ী থেকে ক্যাম্পাসে এসে প্রথমেই নিজের দিদির বাড়ী গিয়ে ড্রেস করে, চা খেয়ে, তারপর মাঠে আসতেন। ওনার এবং প্রদীপ’দার আন্তরিক ও অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের কলেজ টিম একটা বেশ ভালো স্ট্যান্ডার্ডে এসে দাঁড়ালো। ফলস্বরূপ, আমরা সে বছর কলকাতার ময়দানে রেড রোডের পাশে West Bengal Basketball Association এর মাঠে ডিভিশন লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলাম। এরজন্য কলেজ এথলেটিক্স ক্লাব আর কর্ত্পক্ষেরও অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। আমাদের Civil Engineering Department এর Prof. R. K. Datta (রাধু’দা) ও আমাদের সঙ্গে খেলে যথেষ্ট উৎসাহ যোগাতেন। উনি ফ্যাকাল্টি টিচার, কিন্তু আমরা রাধু’দাই বলতাম।
কোচ সুভাষ’দা, মুখে বাশি নিয়ে
কলেজের খেলার দিনগুলোতে আমাদের কলেজের বাস আমরা পেয়ে যেতাম। বাসের ড্রাইভার পরী’দার কথা হঠাৎই এখন মনে পড়ে গেলো। আমরা বাসে হৈচৈ চ্যাঁচামেচি করতে করতে যেতাম, আর ড্রাইভার পরী’দা আর উনার এসিস্ট্যন্ট হাসিমুখে চুপচাপ সব শুনতেন। খেলায় হারি, বা জিতি, lost energy regain করবার জন্য ধর্মতলার লাহোর বা আমিনিয়ায় গিয়ে এই একটু সময় কাটিয়ে Room-এর ভালো ছেলেরা Room-এই ফিরে আসতাম। একটা কথা, আমাদের সেই সমস্ত ম্যাচগুলোর Scorer হিসেবে আশীষ ওদেদার (ইংরেজিতে Ohdedar হবে) ‘দার নামটা ভুলতে পারবো না। আমরা যে মুড়ির টিন করে যাতায়াত করতাম, সেটা Full size এর Bus ছিল না। অনেকটা পুলিশ ভ্যানের মতন, তবে একটু ছোট ছিল। বড়টা বোধহয় Mining Department এর ছিল !
পরবর্তী বছরগুলোতে যে কোন কারণেই হোক না কেন, কলেজ টিমের খেলার মান পড়তে আরম্ভ করে। স্কুলে প্রচুর বাস্কেটবল খেলেছে, অথচ কলেজে এত ভালো সুযোগ পেয়েও কোর্টে এলো না। ফলে নতুন নতুন উৎসাহী ছেলেদের শুরু থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে টিম তৈরী করতে হচ্ছিল। ৭৩ সালে বেশ কিছু ছেলে পাওয়া গেলো। এঁরা সব ৭২-৭৭ ব্যাচের। তাদের মধ্যে সবার আগে মনে পড়ে বাদল মোদকের কথা। আর ওর ভাই, বিমলও ছিল। মনে আছে, ইন্টার ইয়ারের ম্যাচ শিডিউল হয়ে গেছে, কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের টিম হচ্ছে না। তখন বাদল ওঁর ১২ নম্বর হস্টেলের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে এলো। এর মধ্যে বাদল, বিমল আর তপন ঘোষ দেখলাম বেশ ভালো খেলে। বাদল দুটো লম্বা ছেলেকে নিয়ে এলো, দেবপ্রসাদ ঘোষ (পটকা, মেটালার্জি) আর (সেনা, ভালো নাম তপন ঘটক, সিভিল)। পটকাকে যদিও মাঝেমধ্যে ওভাল মাঠে দেখা গেছে, এই সেনা কিভাবে টিমে এলো? ও তো নড়তেই পারে না!!! এটা বাদলের স্ট্রাটেজি, লম্বা ছেলে চাই, ডিফেন্স করবে। এর সাথে এলো লম্বা ঢ্যাঙা সঞ্জীব মিত্র (ইলেকট্রিক্যাল, খুব ভালো হকি খেলতো), দেবব্রত গুহ (ইলেক্ট্রিক্যাল, পাঁচ বছরের কলেজের ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন) আর উৎপল সরকার (ইলেকট্রিক্যাল, খুব ভালো ভলিবলও খেলতো)। দেখলাম সেই ফার্স্ট ইয়ার কয়েকদিন ভালোমতন প্র্যাকটিস করেই ভালো টিম তৈরি করে নিলো, আর ফাইন্যালেও উঠে গেলো। ফাইন্যালে ওঁরা হেরে গিয়েছিলো। ফাইন্যালে এডওয়ার্ড’দা (রাই থাথা, ’৭২-৭৩ ইলেকট্রিক্যাল) ছিলো। লম্বা, দূর দূর থেকে বাস্কেট করতো। সেই ফাইন্যালে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো, ফার্স্ট ইয়ারের তপন ঘোষ ব্যালেন্স রাখতে না পেরে লোহার বারপোস্টে মাথা ঠুকে যায়, রক্তারক্তি ব্যাপার। তখনই ওঁকে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হয়তো এই কারনেই তপন এর পরে কলেজে আর বাস্কেটবল খেলেনি।
বাদল’রা, মানে ৭২-৭৭ ব্যাচ আমাদের কাছে হেরেছে কি না মনে নেই, তবে আমি কলেজের বাস্কেটবল খেলায় কোন প্রাইজ ঘরে ঢোকাতে পেরেছি বলে মনে হয় না! হয়তো ওরাই জিতেছে! এবং সেটা ফাইন্যালও হতে পারে না। কারণ তাহলে আমাদের তো রানার্স আপ হতে হয়। তাহলেও তো ঘরে প্রাইজ আসত। আসেনি।
একটা কথা, প্রাপ্ত সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করে বাদলের সব খেলাতেই পারদর্শিতা অর্জনের জন্য চেষ্টা ও অধ্যাবসায় আমার নজর কেড়েছিল। ১৯৭৩ উইন্টার মিটে সকালে যাদবপুরের সাথে টানা ৯০ মিনিট খেলার পরেই দৌড়ে বাস্কেটবল কোর্টে চলে এসেছিলো দুর্গাপুরের বিরুদ্ধে খেলার জন্য। এই ছিলো বাদল মোদক।
১৯৭৩ উইন্টার মিটেও আমরা বাস্কেটবলে খুব একটা ভালো ফল করতে পারিনি। গত বছর পর্যন্ত আগের ১২ জনের টিমের কেউই আর বিশেষ নেই। মনে আছে, যাদবপুরের চন্দন ভট্টাচার্য্য ইন্ডিয়া জুনিয়র টিমের প্লেয়ার, একাই প্রায় আমাদের হারিয়ে দিলো।
যে কলেজে বাস্কেটবল খেলার এত সুযোগ, মাত্র কয়েক বছর আগেই যে কলেজ কলকাতা লীগে খেলেছে, সেখানে কেন যে বাস্কেটবলের প্রতি ছেলেদের উৎসাহ কমে যায়, সেটা কোনদিনই বোধগম্য হয় নি। প্রতি বছরই ইন্টার ইয়ার টুর্নামেন্টের আগে প্রতিটি ইয়ার টিম বানাতে কি নাজেহালই না হতে হতো। ইয়ারের ক্যাপ্টেনরা বন্ধুদের থেকে একে ওকে ধরে কোনরকমে একটা টীম বানিয়ে মাঠে এনে দাঁড় করিয়ে দিত।
৭৩ উইন্টার মিটের কথা খুব একটা মনে নেই। তবে দুর্গাপুরের পান্ডেকে মনে আছে। সকালে উঠে গাঁজায় দম দিয়ে ফুটবল, হকি, ভলি খেলতে নামতো।
*******
এবার আমার কিছু ফিল্ড ইভেন্টের কথা বলি।
কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় আমার জ্যাঠার বাড়ি ছিলো দমদম পার্কে। তার তিন ছেলেই স্কটিশ চার্চে পড়তো, আর নানান রকমের খেলাধুলায় খুবই ভালো ছিলো। মেজ ভাই ডিস্ট্রিক্ট স্কুল চ্যাম্পিয়ন। ওঁদের স্কটিশ চার্চে চিরকাল খেলাধূলার সুনাম, সেখানে তাঁরা প্র্যাকটিস করতো। এছাড়াও দমদম পার্কের বিরাট মাঠের ক্লাবে পোলভল্ট, জ্যাভলীন, ডিসকাস, শটপাট এসবের প্র্যাকটিসের ব্যাবস্থা ছিলো। এসব দেখে আমারও পোলভল্টে উৎসাহ এসে গেলো। একবার ছুটিতে পাণ্ডু গেছি, সেখানের রেলওয়ে কলোনিতে পোলভল্টের ব্যাবস্থা আছে। বাবাকে বললাম পোলভল্টের জন্য কাঠের ভালো পোল চাই। বাবা সেই পাণ্ডু বাঃ গৌহাটিতে ভালো পোল কোথায় পাবেন। আমাকে খুব ভালো বেতের পোল বানিয়ে দিলেন। আমার হাইট পাঁচ চার, আমার পোলের সাইজই তাই। বাড়িতে জায়গা ছিলো। জাম্পিং পিট বানিয়ে পোলভল্ট, লং আর ট্রিপল জাম্প প্র্যাকটিস করতাম। তারপর কলেজে এসেও মন দিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। সমস্যা হলো আমার হাইট পাঁচ চার, আর আমার সবথেকে ছোট পোল, যা হাতে নিয়ে দৌড়াতে হবে, সেটা দশ ফুট লম্বা। সেই দশ ফুট লম্বা পোল হাতে করে দৌড় লাগানো (টেকনিক্যাল টার্ম ‘গ্রিপ’ করা) অত সহজ মনে হলো না। ভাবি অলিম্পিকে ১৫ ফুটের পোল হাতে গ্রিপ করে কি অনায়াসেই যে এরা দৌড়ায়। বড় ইভেন্টে ফাইবার গ্লাস পোল ব্যবহার করে। তারপর উপরে উঠে বডি ফ্লোট করিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়া। কি সাংঘাতিক!! আমাদের জমানায় খুব সম্ভবত পিট বলা হতো, বালি ছড়িয়ে দিয়ে। এখন সফট গদি ব্যাবহার করা হয়।
স্কটিশ চার্চ স্কুল প্রসঙ্গে বলি। আমার সময়ে আমার স্কুল থেকে বিই কলেজে আরও দু’জন ভালো প্লেয়ার এসেছিলো। একজন কৈলাস মল্লিক (’৭৫ ব্যাচের), খুব ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতো, কলেজ ক্যাপ্টেন ছিলো। আর হকিতে ইউনিভার্সিটি ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিলো। অন্যজন উত্তম খান (’৭৭ ব্যাচের), ওর সুইমিং এর রেকর্ড এখনও অম্লান আছে। কলেজ সুইমিং এর ক্যাপ্টেন আর এথলেটিক ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারিও হয়েছিলো।
যাই হোক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে হবে। প্র্যাকটিস চালিয়ে গেলাম। আর এন্যুয়াল স্পোর্টসে দীপঙ্কর’দা (চ্যাটার্জি, ’ভেঙ্কু, সেইসময়ের গোলমালে কলেজ ছেড়ে চলে যায়) ফার্স্ট হলো, আমি সেকেন্ড। কিন্তু প্রতিযোগীর সংখ্যা কম। উৎসাহ বেড়ে গেলো। ১৯৭১ সালে ময়দানে এলো শিশির অধিকারী। আমি হয়ে গেলাম সেকেন্ড।
হপ স্টেপ জাম্পেও আমি ছিলাম। থার্ড হয়েছিলাম। প্রশান্ত’দা (ব্যানার্জি, ‘৭১/৭২) ফার্স্ট, তাপস’দা (রায়) সেকেন্ড। জ্যাভলীনেও একবার থার্ড হয়েছিলাম। আরেকবার, বেস্ট অফ থ্রিতে আমি থার্ড। মানে থার্ড প্রাইজ আমি পাবোই। দীপঙ্কর’দা (মুখার্জি) আউট। সে কি করলো, আমাদের এথলেটিক ক্লাবের দেবেশ’দাকে কি সব বুঝিয়ে রাজি করালো যে বেস্ট অফ সিক্সে সিলেকশন হবে। দেবেশ’দা রাজি হয়ে গেলেন। ইভেন্টের মাঝখানে এরকম যে নিয়ম পরিবর্তন হয় সেটা আমার জ্ঞানের বাইরে। এবার ছ’জনের মধ্যে কম্পিটিশন। যাই হোক, এবার আমাদেরকে আরও তিনটে করে থ্রো করতে হবে। এবং দীপঙ্কর’দাই থার্ড হলো। কলেজের নিয়ম ছিলো তিনটে ইভেন্টে প্রাইজ পেলে, অথবা ইন্ডিভিজ্যুয়াল পাঁচ পয়েন্ট পেলে কলেজ থেকে ক্রেস্ট পাবে। দীপঙ্কর’দা ক্রেস্ট পেলো। যতদূর মনে পড়ে, আশীষ সাহা (ইঞ্জিন) ফার্স্ট হয়েছিলো।
আমি কিন্তু কলেজে বাস্কেটবলে কলেজ টিমের মেম্বার হয়ে প্রতিবছরই ক্রেস্ট পেয়েছি।
এই আমার বিই কলেজের খেলাধূলা। আমি বাস্কেটবল বাদ দিলে ইন্ডিভিজ্যুয়াল ইভেন্টেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলাম। নিজেকে মাঝে মাঝে বাঁশবনের শিয়ালরাজা মনে হতো। এই ছোট্ট স্মৃতি চারণায় সবার নাম যদিও মনে আসেনি (বার্ধক্যজনিত মেমোরি লস), উল্লেখ করা নামগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু নাম মনে এসেছে। তবে, বিভিন্ন কারণে তা থেকে নিজেকে বিরতই রাখলাম।
আমাদের সময় টিভিতে বাস্কেটবল দেখার সুযোগ ছিলোই না। এখন আমি টিভিতে আমেরিকার এনবিএ খেলাগুলো দেখি, আর ভাবি আমরা কি খেলতাম, আর এঁরা কোথায়? আমাদের সময়ে Freshers রা কলেজে ভর্তির কিছুদিন পর ইন্সটিটিউট হলে ৫০ পয়সার টিকিটে কিছু পুরনো দিনের সিনেমা দেখানো হতো। ম্যাটিনিতে স্টাফদের, তারপর ইভনিং,নাইট আর লেট নাইট শো ছিলো আমাদের জন্য। ভালো এবং “মন্দ” মিলিয়ে মিশিয়ে সিনেমাগুলো আনা হতো। (আর স্টাফদের জন্য শুধুই “ভালো” সিনেমা)। সেই ফিচার ফিল্ম শুরু হওয়ার আগে নানা বিষয়ের ১০-১২ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারিও দেখানো হতো। e.g. PAN AM Goes to ———— PAN AM Airlines এর প্রমোশনাল শর্ট ফিল্ম। মনে হয় একদিন Boston Celtics vs Cincinnati র বাস্কেটবল খেলাটাও তখন দেখেছিলাম।
Add comment