কঙ্কাবতী
@বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
মেয়ের নাম আদিখ্যেতা করে মা রেখেছিল কঙ্কাবতী। মা ছিল বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রী, শতকরা নিরানব্বই জন বাঙালীর মত বুঝুক না বুঝুক একটা বয়সে আধুনিক কবিতার বই ঘাঁটাঘাঁটি করত। তার তরুণ বয়সে, কলকাতা তখনও বাংলায় কথা বলে, শম্ভু মিত্রের মায়াবী স্বর রেডিওতে বা কোন অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে ভেসে আসত – কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী, কঙ্কাবতী গো – মায়ের বুকে কেমন দাগ কেটে যেত সেই হু হু ডাক ! মেয়ে যখন হল, সেই নাম আবার গুঞ্জরিত হল মনের মন্দিরে। তখন পড়ন্ত বেলায় কলকাতার রোদে কবিতাপ্রেমী বাঙালির ছায়া একেবারে অস্তমিত হয় নি, তাই মেয়ের বাহারী নাম রেখে সাহিত্যবোদ্ধা বন্ধু স্বজনের কাছে একটু হাততালি কুড়োতে চেয়েছিল মা।
“যশোং দেহি” বলে বায়না কে আর না করে! কিন্তু কে জানত আড়ালে বসে ভ্রূ কুঞ্চনে ডাক দিচ্ছেন দর্পহারী মধুসূদন। মেয়ে তার নিজের নাম ভাল করে উচ্চারণ করার বয়সে আসতে না আসতে মায়ের বদলি হল অন্য রাজ্যে, যে দেশে লোকে রাজার ভাষায় কথা বলে, বাংলার মত এমন ম্লেচ্ছ অর্বাচীন ভাষায় বাক্যালাপ করে না কেউ। মা মেয়ে পড়ল মুশকিলে। আমাদের এই পোড়া দেশে লোকে অবলীলাক্রমে মারকেটা ভন্দ্রৌসোভা বা নোভাক জকোভিচকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, আর্নল্ড সোয়াসজনেগার বা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করে, কিন্তু দেশী শব্দে একটু তৎসম ছোঁয়া থাকলেই জিভে জড়িয়ে যায়। কঙ্কাবতী খুব সহজেই শুধুমাত্র নামের জোরে অন্যান্য শিশুদের কাছে কম্বল ধোলাইএর প্রিয় লক্ষ্য হয়ে উঠল। স্কুলে ভর্তি করার সময় শিক্ষিকাদের সরল প্রশ্ন “নাম কেয়া হ্যায়?” এর উত্তরের পর্ব চলত পরের দু প্রহর বেলা ধরে। ক্যানকা, কেনকা, কনকা ইত্যাদি বহু পরিমার্জিত রূপের আড়ালে বাকি প্রশ্নোত্তর কোথায় তলিয়ে যেত! বার কয়েক এমন হওয়ার পর মেয়ে গান্ধিজীর শিষ্যত্ব নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে দিল। অঙ্ক দাও করে দেবে, ইংরেজি দাও পড়ে দেবে কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করো বলবে না। এমনিতেই রাজভাষায় দখল না থাকায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় ডাহা ফেল মারছিল মেয়ে – দোষটা ওর নয়, এমনকি দোষটা কোথায় বোঝার বয়সও হয় নি তার। তার ওপর এই উটকো ঝামেলা। শেষ মেশ কপালগুণে এক সহৃদয়া প্রিন্সিপালের দেখা পাওয়া গেল। তিনি পরীক্ষা নিয়ে বললেন – হিন্দি ও জানে না, সে যাক গে, আমাদের দিদিমণিরা আছেন, তাঁরা শেখাবেন। তবে যেহেতু আপনার মেয়ে বাকি বিষয়ে যথেষ্ট ভাল ফল করেছে, ওকে আমাদের স্কুলে নিতে আপত্তি নেই। পত্রপাঠ ভর্তি হল মেয়ে। নাম বিভ্রাটটা অবশ্য থেকেই গেল।
রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মা দেখে মেয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে আছে। মেয়েকে ছোট্টবেলা থেকে মানুষ করেছে যে মাসি সে নালিশ করে “তোমার মেয়ে বিকেলে কিছু খায় নি কো, অনেক বলছি, শুনছে না। টিফিনও প্রায় সবই ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে। তুমি দেখো, এমন করলে আমি পারব না। ঐটুকু মেয়ে, সারাদিন কিছু খাবে না, শরীর থাকবে নাকি? “
মা মেয়েকে বলে – কি রে কি হল? আজ তো তোর পছন্দের ফ্রেঞ্চ টোস্ট ছিল টিফিনে।
– আমি কাল থেকে স্কুলে যাব না।
– কেন রে? এত ঝামেলা করে একটা স্কুল জোগাড় হল।
– ওখানে বন্ধুরা আমাকে “ক্যাঁও” বলে ডাকে। সবাই হাসে। কি বিচ্ছিরি নাম রেখেছো তুমি। কেউ বলতেই পারে না। বদলে দাও আমার নাম। ঐ নামে আমি আর থাকব না।”
এবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে পাঁচ বছুরে মেয়ে। মা কাছে টেনে আদর করতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের ওপর। আঁচড়ে, কামড়ে, নাস্তানাবুদ করে ফেলে মাকে। শান্ত, বাধ্য মিষ্টি মেয়ের এই রণচন্ডী রূপ দেখে চিন্তায় পড়ে যায় মা। কলকাতায় মা মনের আনন্দে সকাল থেকে সন্ধে অফিসে ব্যস্ত থাকত। মেয়ে তখন স্কুলবাসে বন্ধুদের সঙ্গে বকবক করতে করতে ফিরত দিদুনের কাছে। খাতায় সব বিষয়ে এক্সেলেন্ট পেয়ে বুক ফুলিয়ে দেখাতো দাদুভাইকে। তার জন্য আলাদা প্রাইজ বরাদ্দ ছিল। দুপুরে দিদুন খাওয়াত রূপকথার গল্প বলে। তারপর দাদুভাইএর কাছে দেশ বিদেশের কাহিনী শুনতে শুনতে একটু ঘুমের চটকা – দাদু নাতনী দুজনেরই। বিকেলে আলো পড়লে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে খেলা। সন্ধে গড়ালে দিদুনের কাছে স্কুলের পড়া। সন্ধে আরেকটু গাঢ় হলেই মা ফিরত অফিস থেকে। ব্যাস, মায়ের গলা জড়িয়ে সারাদিনের গল্প শোনাতে শোনাতে বাড়ি ফেরা। মাসী যখন রাতের খাওয়া খাওয়াতে বসত মহারাণী তখন দিনের শেষে ঘুমের দেশে।
নিজের কাজের দাবী মেটাতে মা সেই ছোট্ট মানুষটাকে কলকাতার ইস্কুল ছাড়িয়ে, বন্ধু ভুলিয়ে, ঘরছাড়া করে, দাদু দিদুনের অবাধ আবদার ও প্রশ্রয়ের সম্পর্ক থেকে ছিঁড়ে এনে ছিন্নমূল শরণার্থীর মত এক অচেনা ভূমিতে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে – সেই বিপন্ন অনুভূতি প্রকাশ করার মত ভাষা গড়ে ওঠে নি এখনও তার সীমিত শব্দ ভান্ডারে। তাই সেই একলা শিশুটির যত রাগ, যত অভিমান নিজের নামের ওপর, এবং নামদাত্রী মায়ের ওপর। ও নিজের ছোট্ট বুদ্ধিতে বুঝেছে মা ই যত নষ্টের গোড়া। তাই চারপাশের প্রতিটি ব্যঙ্গ, অপমান, স্ট্রাগল – সে চতুর্গুণ ফিরিয়ে দেয় মায়ের কাছে, বাড়িতে। তাই তার খাবার পছন্দ নয়, পোশাক পছন্দ নয়, পড়তে বসার ইচ্ছে নেই, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে ভাল লাগে না। অচেনা কেউ আলাপ করতে এলে যদি জিজ্ঞেস করে – তোমার নাম কি? মেয়ে হাঁড়িমুখে চুপ করে থাকে। মা ও ব্যস্ত তার নতুন কর্মস্থলে মানিয়ে নিতে, কাজের চাপে তার হাঁসফাঁস অবস্থা। তাই যে মনোযোগ দেওয়া দরকার মেয়ের প্রতি সে আর হয় না।
মাথা ঠান্ডা থাকলে মা বোঝে এখন মেয়েকে রাখা উচিত ডানার ওমে, আদরে ভালবাসায় ঘিরে, ওর আত্মবিশ্বাস ঠেকেছে তলানিতে। নিজে যতই নিরুপায় হোক, দায়ী তো মা ই। কিন্তু কাজের চাপে সবসময় মস্তিস্ক এমন হিম শীতল থাকে না। সারাদিনের টেনশন নিয়ে ক্লান্ত মা বাড়ি ফিরে মেয়ের ট্যান্ট্রামস এর বিবরণ শুনে মাথায় আগ্নেয়গিরি জ্বলে ওঠে। মা আবার খুব চেঁচামিচি করতে পারে না। মারধোর করার অভ্যেসও নেই। এতদিন এসবের দরকারই পড়ে নি। মা বরাবর রাগ হলে একা হয়ে যায়, কথাবার্তা বলে না। একটা বই টেনে পড়তে বসে, যতক্ষণ না রাগ পড়ছে। এদিকে পাঁচ বছুরে মেয়ে চাইছে মা সব ফেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকুক। যে কষ্ট ও কারোকে ঠিকমত বলতেও পারছে না, বোঝাতেও পারছে না, মা সেটা নিজে নিজেই বুঝুক। কিছু করুক। খেলতে গিয়ে কেটে গেলে, ছিঁড়ে গেলে মা যেমন ওষুধ দিয়ে দেয়, ক্ষতে হাত বুলিয়ে দেয়, আদর করে বারবার জিজ্ঞেস করে “ খুব লেগেছে?“ মনের কাটা ছেঁড়াতেও তেমন স্নিগ্ধ প্রলেপ দিক মা, মা ছাড়া তো এখন রাগ দেখানোর কেউ নেই, আদর করারও কেউ নেই, অভয় দেওয়ারও কেউ নেই। তাই কিছুক্ষণ পর পাঁচবছুরে নিজের গর্ব অহংকার বিসর্জন দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে এসে- “আর করবো না মা, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো।“ মা মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে মরমে মরে যায়।
“নিজের মেয়ের কাছেও একবার হার মানতে পারলে না, এ কেমন মা তুমি!”
আক্ষেপে মাথা নেড়ে মায়ের ধড়াচূড়ো খুলে ফেলে মা । সেই পরশমণি খুঁজে ফেরা সাধুর মত প্রাণপণ হাতড়ায় তার বুকের বন্ধ ঘর, আগাছা ঢাকা হৃদয়ভূমি। ত্রস্ত সাফ করে ঝুলকালি, দ্রুত কাটছাঁট করে ডালপালা। খুঁজে বের করে কোন অতলান্ত স্মৃতির জলে ভেসে যাওয়া এক পাঁচ বছুরে বালিকাকে।
সেদিন দুই পাঁচ বছুরের কলবলানীর আড্ডা চলে শোবার ঘরে খাটের ওপর, অনেক রাত অবধি। এক বালিকা নিজের কুয়াশা মাখা ইস্কুলের গল্প বলে। কবে কোন বন্ধুর সুন্দর একটা কমলা লেবুর গন্ধওয়ালা কমলা রঙের ইরেজার – ওর কাকা এনে দিয়েছিল বিদেশ থেকে – বড্ড পছন্দ হয়েছিল। বারবার ক্লাসে ওটা দিয়ে খাতা মুছছিল। সে বন্ধু দিদিমণির কাছে নালিশ করেছিল – আমার ইরেজার ও সমানে নিয়ে নিচ্ছে। দিদিমণি সবার সামনে খুব বকেছিল তাকে, “অন্যের জিনিস নিচ্ছ কেন? বাড়িতে বলো কিনে দিতে।”
সেদিনের সেই বালিকাটি খুব কেঁদেছিল অপমানে – যদিও বাড়িতে বলে নি। জানত, ওসব দামী শৌখিন জিনিস কিনে দেওয়ার নিয়ম নেই বাড়িতে, কাজ চললেই হল। এ গল্প তো সে কারোকে বলে নি এতদিন, আজ পাঁচবছুরের সঙ্গে শেয়ার করল। মেয়ে তার ছোট ছোট হাত মায়ের গালে বুলিয়ে বলল – “কোই না, আমি বড় হয়ে কিনে দেব তোমাকে।”
মেয়ে একটু একটু রাজভাষা শিখছে। স্কুলে দোলনা ঘোড়ায় দোল খেতে খেতে সেই একদা বালিকা নিজেকে ভাবত রুশদেশের রূপকথার ক্ষুদে ইভান, বড় বুদ্ধিমান। ঘন্টার পর ঘন্টা একা একাই ইভানের সব অভিযান পথের যাত্রী হত সে। মেয়ে উত্তেজনায় উঠে বসে – “আমাদের স্কুলেও রকিং হর্স আছে। “
– ইভানের গল্পও তো তুই জানিস, আমি তোকে বলেছি।
– আবার বলো
মা গল্প বলে, বাইরে রাত বাড়ে। মেয়ের চোখে ঘুম নামে , মুখে হাসি ফোটে। ঠিক আছে, অন্য বন্ধু না থাক, খুদে ইভান তো রইল, কাল স্কুলে ওর সঙ্গে বাবা ইয়াগার খোঁজে বেড়োতে হবে, তার ছোট্ট কুঁড়েঘর একটা টাকুর ওপর সমানে ঘোরে, কি তাজ্জব কান্ড।
দিন কয়েক পর মেয়ে জানায়, “আজ বাসের টিফিন খেতে পারিনি।”
– কেন রে? আবার টিফিন খাস নি?
– সম্ভাবীর সঙ্গে গল্প করতে করতে খাওয়া হয় নি।
– সম্ভাবীটা কে?
– আমার বন্ধু। ও আজ আমার সঙ্গে খুদে ইভান খেলছিল। জানো মা, ও আমাকে ”কিং কং” বলে ডাকে।
”কিং কং” – হায় ভগবান!
– তোর নামটা কি বদলে দেব? তুই চাইলে বদলে দেওয়াই যায়। কণা বা কেকা? বা অন্য কোন নাম – তোর পছন্দমত।
মহারাণীর মুখটা ঝলসে ওঠে গর্বে, অহংকারে, আত্মগরিমায়।
– কেন? আমার নাম কঙ্কাবতীই থাকবে, এটা একা আমার নাম, আর কারুর নেই। ওরা ঠিক করে বলতে না পারলে আমি কি করব, আমি আমার নাম কারোকে দেব না।
মা এক হাতে জড়িয়ে নেয় মেয়েকে, যাক এতদিন পর মেয়ে বুঝেছে ঝাঁকের কই না হয়ে অন্য জলে সাঁতার কাটার আনন্দ। অবশ্য নামে কিছু যায় আসে না, তবে ভিড়ে স্বতন্ত্র হওয়ার ইচ্ছেটা … ।
মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। মাও নিশ্চিন্তে ও পাশ ফিরে ডেকে নেন সেই পাঁচ বছুরে বালিকাকে, কাল আবার দুই বন্ধু খেলতে বসবে।
@বন্দনা মিত্র
[…] কঙ্কাবতী @বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল […]
[…] কঙ্কাবতী @বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল […]
মা চিন্তাভাবনার খুব ভালো একটা ছোট গল্প।
পুরনো সাহিত্যিকা ঘাঁটতে ঘাঁটতে এটা পড়লাম, খুব সুন্দর লিখেছেন।
খুব ভালো একটা গল্প পড়লাম।