স্ত্রীর পত্র (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প “স্ত্রীর পত্র” অবলম্বনে)
@অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
শ্রীচরণকমলেষু
আমার বিয়ের পনেরো বছর পরে,
তোমায় আজ দিলেম চিঠি প্রথম বারের তরে।
তোমার আর মায়ের বড় সাধ ছিলো
মেজবৌ এর রূপে তোমার ঘরটি হবে আলো।
ন’ইলে কনে দেখতে এত কষ্ট করে
কেউ আসে সাড়ে আট ক্রোশ কাঁচা রাস্তা ধরে?
তোমরা শুধু রূপই চেয়েছিলে, আর কিছু নয়
তাই আমাকে পছন্দ হতেও লাগেনি সময়।
খুব ঘটা করেই বিয়েটা হলো, পরম আদরে
আর, আমি এসে উঠলুম তোমাদের ঐ ঘরে।
তোমরা জানতে না, আমার আর কি ছিলো,
সেই তেজ – সে এক প্রলয় এনে দিলো।
আমার জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণে,
বিধাতা বোধহয় ছিলেন অন্য মনে।
তাইতে অজান্তে ভীষণ ভুল করে
বুদ্ধি আর সাহস, দিলেন অকুণ্ঠভরে।
আমার মায়েরও সেই ভয়টাই ছিল বটে,
এমন তেজী মেয়ে, না জানি কি ঘটে?
সংসারে বিন্দু যেদিন এলো,
তোমাদের ঘরে প্রলয় ঘটে গেলো।
এ আবার কি ভীষণ বিপদ?
উড়ে এসে জুড়ে বসলো কোথাকার এক আপদ?
তোমরা উঠলে ভীষণ রেগে
সকলে মিলে তাড়াতে এলে ঝড়ের বেগে।
কিন্তু আমার স্বভাবটি বড়ই পোড়ো
সবটুকু তেজ করে একসাথে জড়ো
দাঁড়ালুম বিন্দুর পাশে
তোমরা পেলে ভয় ঘোর সর্বনাশে।
বিনুর দিদি, বড়’জা গাইলেন এক সুর
কারণ আমার ভাশুর
কোনো ঝামেলায় না গিয়ে
বললেন “দাও ওকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে।”
ওনার জায়ার ছিল বড়ই স্বামীভক্তি,
আদেশ অমান্য করেন, নেইকো যে সেই শক্তি।
তাই উনি রাজী হলেন যেই,
আমিও বুক বেঁধে ঝামেলা পাকালাম সেই।
বললাম, “ও থাকবে আমারই কাছে।
আমার বরাদ্দ যেটুকু আছে,
তারই কিছুটা ভাগ আমি দেব ওর পাতে।
ও আজ থেকে থাকবে আমারই সাথে।“
এবার আমার বড়’জা
করলেন ঘষামাজা,
যৌথ পরিবারের এত খরচার মাঝে
ওকে লাগিয়ে দিলেন বাড়ির অনেক কাজে।
বিন্দুকে পেলেন অনেক সুবিধে দরে
কারণ, অল্প দামে সে সকলের সেবা করে।
কিন্তু কি করবো বল? মেয়েমানুষ হয়ে
ভাশুরের সাথে ঝগড়া কি করবো গিয়ে?
যবে বসন্ত ধরলে তাঁকে
তোমরা বললে সবাই, এবার তারাও ওঁকে।
তোমাদের ভয় লেগে গেলো ভারী
ছোট বড় সবাই করলে ডাক্তারী।
অবশেষে হাল ছেড়ে রায় দিলে,
ভালো হয়, ওঁকে রেখে এসো হাঁসপাতালে।
কিন্তু আমি যে সহায় ছিলাম ওর
আর ছিল অফুরন্ত মনের জোর।
তাই আবার দাঁড়ালাম রুখে
বুঝবেনা, কি শেল বেজেছিল মোর বুকে।
তোমাদের ব্যাবহারে
আর বিত্তের অহংকারে।
এমন সময় সহসা নীরবে এসে
ধন্নন্তরী যেন দাঁড়ালেন ওর পাশে।
সকলের সকল ইচ্ছেকে তুচ্ছ করে
বিন্দু উঠলো সেরে।
তাইতে গেল ভীষণ গোল লেগে
কারণ, মোর প্রতি ওর দরদ উঠলো জেগে।
কি জানি কি বেজেছিল ওর প্রানে
তাই আমার প্রতি প্রবল স্নেহের টানে
ভালোবেসে আমায় জড়ালো শত’পাকে,
নাড়িয়ে দিলো আমার ছোট্ট দুনিয়াটাকে।
আমি গেলুম ভীষণ ভয় পেয়ে
এইটুকু এক মেয়ে
ছেয়ে গেলো মোর সারাটা বুক জুড়ে।
যদি কখনো যেতো দৃষ্টি থেকে দূরে
সবকাজ ফেলে দিয়ে
বসে থাকতাম মেয়েটির পথ চেয়ে।
তোমরা তখন বড়রা সবাই মিলে
এক হয়ে রায় দিলে
এটা মোর অকারণ বাড়াবাড়ি
আর, তোমাদের সাথে এখানেই আড়াআড়ি।
তোমরা অষ্টপ্রহর ধরে
দ্বিগুন ক্রোধভরে
লাগালে তাঁকে ঝিয়ের সব কাজে
আমি মরি দুঃখে ঘৃণায় লাজে।
কখন যে স্নান আর কখন আহার
কিছুই যে ঠিক রইলো না আর
তা হলেও তোমরা বেজায় খুশী,
কারণ সে যে নেয় কম, দেয় অনেক বেশী।
তবুও মেটেনা জ্বালা, ওকে তাড়াবার তরে
তোমরা সবাই লাগলে উঠে পড়ে।
কোথা থেকে কে যেন আনলে সম্বন্ধ
পাত্রটা নয় যে মন্দ,
দোষের মধ্যে একটু পাগল ছিলো,
বংশ উচ্চ হলে কি এমন খারাপ, বলো?
তোমাদের কাছে মানুষ তো সে বটে,
ভাগ্যে না হলে এমন বর জোটে?
বিয়ের ক’দিন পরে,
শ্বশুরবাড়ি থেকে বিন্দু এলো ফিরে
পাগল বরের সাথে
কেমন করে থাকবে দিনে রাতে?
কিন্তু তোমরা সবাই ওকেই দিলে গালি।
বরকে সেথায় ফেলে একলা চলে এলি?
আজকালকার দিনে,
চারিপাশের জগৎটাকে না চিনে
এমনটি কেউ করে?
আমাদের মতন ভদ্রলোকের ঘরে?
গুঞ্জন গেলো শোনা
এবার হবে পুলিশের আনাগোনা।
ভাশুরঠাকুর কুল পান’না ভেবে
এই কান্ডের পরিণাম কি হবে?
যদি বিন্দুর শ্বশুর বাড়ির লোকে
গিয়ে থানায় নালিশ ঠোকে?
ঠিক তখনই ওর ভাশুরঠাকুর এসে
গোল বাঁধালেন বাড়ির দুয়ারদেশে।
বলছে, এক্ষুনি সে থানায় খবর দেবে।
আমি বললাম “দিক। যা হয়, দেখা যাবে।”
কিন্তু আমাদের সবাইকে মুক্ত করে
বিন্দু নিজেই গেলো ফিরে ওদের ঘরে।
সমাজের যত লোকে
আর সকল নিন্দুকে
বলে “এমন দুর্ঘটনা
আমাদের তো একটিও নেই জানা”
ছোটো ভাই শরৎকে আনলুম ডেকে
“বিন্দুর খবর এনে দিতেই হবে তোকে।”
এমন সময় তুমিই খবর দিলে
বিন্দু ফের পালিয়েছে পাগল স্বামীকে ফেলে।
শরৎকে দেখার পরে
সকলের সন্দেহ গেলো বেড়ে।
তোমরা ধরেই নিলে,
একাজ করেছি আমরা ভাই বোনেতে মিলে।
ওঁকে পাঠালাম তাড়াতাড়ি
সেই অভাগীর শ্বশুরবাড়ি।
শরৎ দ্রুত এসে খবর দিলো তারই
বিন্দু গিয়েছিলো খুড়তুতো ভাইয়ের বাড়ি।
তাঁরাও ক্ষেপেছিল ভীষণ রাগ করে,
বিন্দু আবার গেছে ফিরে পাগল স্বামীর ঘরে।
তখন খুড়িমা যাবেন পুরী
শ্রীক্ষেত্রে তীর্থ হবে, বুধবারে তার গাড়ী।
আমি বললাম এসে,
আমিও যাবো ওনার সাথে জগন্নাথের দেশে।
তোমরা সবাই যারা ছিলে আশেপাশে
কথা শুনে ভীষণ খুশী গোপন উল্লাসে!
কারণ আমি যদি কোলকাতায় থাকি,
সর্বনাশের আর রইবেনা কিছু বাকী।
শরৎকে ডাকলাম কাছে,
বললাম, তোর কাছে একটাই দাবী আছে।
পুরীর গাড়ির পরে
বিন্দুকে এনে দিতেই হবে আসছে বুধবারে।
সাঁঝের সময় শরৎ যখন এলো,
দেখেই আমার মুখটি শুকিয়ে গেলো।
সবকিছু ত্যাগ করে
বিন্দু গেছে চলে জীবনের ওইপারে’।
কাপড়ে আগুন দিয়ে,
তোমাদের সবার আশীষ সাথে নিয়ে।
তখন আবার সকল নিন্দুকে
বললে পাড়ার জনে জনে ডেকে ডেকে
এ এক নতুন ফ্যাশন ভারী
শরীরে জড়িয়ে শাড়ি
আগুন লাগিয়ে মরন
অনেক ভেবেও বাপু পাইনাকো তার কারণ।
আমি বললাম হেসে
“একবার ভাবো বসে
মেয়ে বলেই তো বুদ্ধি এত কম
কত সহজেই দেখো, তাঁকে নিয়ে গেলো যম।
কিন্তু হত যদি ওটা তোমাদের ধুতির কোঁচা,
আর লাগতো তাতে আগুনের এক খোঁচা?
হলে,
ভাবতে পারো লাগতো কেমন জ্বলতে ধূমানলে?”
শুনে সবাই ঢাকলে দু’কান, করলে আমায় ছি ছি,
আর স্বামী হয়ে কতো খোঁটা শুনলে মিছিমিছি!
বৌয়ের এমন দুঃসাহস সহ্য কি আর হয়
ভাবলে, একে এখনই বিদেয় না করলেই নয়।
যাই হোক, সবকিছু পিছে ফেলে,
আমি নিজেই এসেছি চলে,
তোমাদের সকলের থেকে দূরে।
পৃথিবী আমায় নিয়েছে বরণ করে।
বহু বছর ধরে
বন্দী ছিলাম তোমাদের ওই ঘরে।
কতদিন যে আটক ছিলাম চার গন্ডীর মাঝে।
পৃথিবীর কোথায় কি যে ঘটে জানতে পেতাম না যে।
যবে বিন্দু এলো ঘরে,
চিনিয়ে গেলো জগৎটাকে নিজের মতন করে।
তোমাদের কোনো ছলের ছিল না বাকী।
তবু সবকিছু দিয়ে ফাঁকি,
ও চলে গেলো সবার থেকে দূরে
জীবনের পরপারে।
শক্তি নিয়ে তোমরা যতই বড়াই কর,
মৃত্যু তোমাদের থেকে অনেক অনেক বড়।
তখন চারিদিকে মোর
অন্ধকার ঘোর
রাজমিস্ত্রির গড়া
ইট-কাঠ আর চুন সুরকীর বেড়া।
প্রতিদিনকার কাজে
নাড়া দিয়ে যেতো অকুল মনের মাঝে।
এখন আর ডরাইনে আমি, পাইনে কারেও ভয়
স্পষ্ট দেখি কাছে আর দূরে, সারা বিশ্বময়।
সবকিছু দেখি অনেক কাছ থেকে।
বিরাট বিশ্ব দিয়ে গেছে এঁকে
সত্যের ছবিখানি
মানুষের গভীর মর্মবাণী।
ভাবছো কি মনে মনে?
বিন্দুর মত মরতে চলেছি মুক্তি অন্বেষণে?
ওসব ধারনা বাজে।
আমার কাটবে জীবন আমার কাজের মাঝে।
শুধু একটি কথা রেখো মনে করে,
আর আমি ফিরবো না তোমাদের ওই ঘরে।
যেথায় যত জ্ঞ্যাতি,
মেয়েছেলে বলে করেছিলে অখ্যাতি,
তাঁদের সবাইকে বলি।
বিদায় তোমাদের মাখন বড়ালের গলি।
ইতি
তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন
মৃণাল
১২ই ভাদ্র, ১৩৮৮।
কাঁকুড়গাছি, কোলকাতা।
লেখাটা দারুন। আগেও পড়েছি কিন্তু আবার নতুন করে পড়ে মনের ভেতরে নাড়া দিয়ে গেলো। 👏❤
অপূর্ব সুন্দর লেখা। রবীন্দ্রনাথের একটি অতি বিখ্যাত গল্পকে যে এমন ভাবে কবিতায় লেখা যায়, তা ভাবা যায় না। লেখকের সাহিত্য প্রীতি প্রতিটি শব্দে প্রতিফলিত। তাঁর থেকে আরো লেখা আশা করছি ।
লেখাটি অপূর্ব। রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত গল্পকে যে এমন ভাবে কবিতায় লেখা যায় তা ভাবা যায় না। লেখাটির প্রতি শব্দ চয়নে লেখকের সাহিত্য প্রীতি প্রতিফলিত। তাঁর থেকে আরো এই ধরণের লেখা আশা করছি।
লেখাটি অপূর্ব। রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত গল্পকে যে এমন ভাবে কবিতায় লেখা যায় তা ভাবা যায় না। লেখাটির প্রতি শব্দ চয়নে লেখকের সাহিত্য প্রীতি প্রতিফলিত। তাঁর থেকে আরো এই ধরণের লেখা আশা করছি।
খুব ভালো লাগলো। রবিঠাকুরের বিখ্যাত গল্প নিয়ে যে এত সুন্দর কবিতা লেখা যায় তার ধারনা ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের এত বিখ্যাত একটি ছোটগল্পের মিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতার রূপ দেওয়া সহজ নয়। খুবই ভালো হয়েছে, লেখক কবির জন্য আরও শুভেচ্ছা রইলো।