রবীন্দ্রসঙ্গীতে ঈশ্বরচিন্তা
@সুজন ভট্টচার্য, ১৯৮১, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হ্রদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?
১৮৮৫ সালে কবির যখন বয়স মাত্র ২৩ রচনা করেছিলেন এই গান। স্থান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি – ব্রাহ্মসমাজের এক সম্মেলন উপলক্ষে।
এই গানটির মধ্যে তরুণ কবির মনের গভীরে যে দুর্নিবার ঈশ্বরানুভূতি ছিল, তা তার এই গানের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতের বহু গানে এই প্রগাঢ় ভক্তি এবং প্ৰেম বারবার প্রকাশিত হয়েছে। সুদীর্ঘ আশি বছৱেৱ জীবনে পূজা , প্রেম ও প্রকৃতি পর্বের বিভিন্ন গানে তিনি পরমপিতাকে আবিষ্কার করেছেন নানারূপে। এই ঈশ্বরচেতনার শুরু কবে থেকে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন, তবে এটা বলা যেতে পারে যে একেবারে শৈশবের প্রাক্কালে এই প্রগাঢ় রহস্যানুভূতি র প্রকাশ্ পেয়েছিল বালক রবির মনে।
জল পরে পাতা নরে, পাগলা হাতির মাথা নড়ে।
কোনো এক বাদল দিনে, জোড়াসাঁকোর বাড়ীর জানালা দিয়ে গাছের পাতার ওপর বৃষ্টির জল পড়া দেখ্তে দেখ্তে, মাত্র সাত্ বছর বয়সে লিখছিলেন ঐই ছড়াটি। সারাজীবন এই জীব ও জগতের যে গভীর গোপন সর্ম্পক তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন, তার উন্মোচন করে চলেছিলেন সারা জীবন। এই অদ্ভুত রহস্যানুভূতি রবীন্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা, নিসর্গ, জীব এবং জগতের প্রতি দুর্নিবার ভালবাসার একেবারে কেন্দ্ৰবিন্দুতে ছিল বলে মনে হয়। এই অনুভূতির একটি সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে কবির ৭৫ বছর বয়েসে (১৯৩৬) লেখা কবিতায় (আমি)
আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে
আমি চোখ মেললাম আকাশে
জ্বলে উঠল আলো
পূবে পশ্চিমে।
এই কবিতাটির মধ্যে কবির আত্মার যোগাযোগ প্রকাশ পেয়েছে পরম ব্রহ্মের সাথে। আমি কে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় মান্ডুক্য উপনিষদের মধ্যে (2)। যখন এই দুর্ণিবার যোগা যোগ স্থাপিত হয় তখন সুন্দরের অনুভূতি চোখের দৃষ্টিত নিয়ে আসে সৌন্দর্য। এই ঐশ্বরিক অনুভূতি বোধ হয় রহস্যানুভূতি বা Mysticism যা ইংলিশ কবি John Keats এর মধ্যেও ভীষণ ভাবে ছিল; তাইতো উ্নি বলে ছিলেন “beauty is truth, truth is beauty” (৩)। রবীন্দ্রনাথের এবং আরো অনেক কবিদের এই Mysticism এর প্রধান কারণ হল তাঁদের প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ। রবীন্দ্রনাথের অসাধারন গান এবং কবিতায় এই প্রকৃতি বন্দনা প্রকাশ পেয়েছে।
দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায়
প্রভাতের কিনারায়।
ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে –
আয় আয় আয়।”
ও যে কার লাগি
জ্বালে দীপ,
কার ললাটে পরায় টিপ।
১৯২৫ সনে ৬৪ বছর বয়সে কবি রচনা করে ছিলেন এই গানটি সবুজ পত্রের শেষ বর্ষণ (১) সঙ্কলনে। বর্ষার প্রত্যাগমনে শরতের অভিষেক; শরতের প্রথম প্রত্যুষে অন্ধকার আকাশের শুকতারা দেখে রোমাঞ্ছিত হয়ে পড়েন কবির নটরাজ (8)। সুদুর আকাশে ছোট্ট একটি শুকতারা মনে করিয়ে দেয় শরতের আগমন, দীপ জ্বালিয়ে কপালে টিপ পরে কোনো এক সুন্দরীর আবাহন করেন সেই আগমন। এ যেন কোন মায়াবী শিল্পী তাঁর ক্যানভাসে এক পলকে মুছে ফেলেন বর্ষার সমস্ত প্লাবন, নিয়ে আসেন অনির্বচনীয়র আনন্দ।
এই আনন্দের শোভা তিনি বার বার প্রত্যক্ষ করেছেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে অপূর্ব একটি গান রচনা করেছিলেন এই অনিন্দ্য সুন্দরের উচ্ছ্বাসে;
এ কি সুন্দর শোভা, কী মুখ হেরি এ
আজি মোর ঘরে আইল হৃদয় নাথ,
প্রেম উৎস উথলিল আজি।
নিজের গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতামত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট রেখেছিলেন। বিশ বছর বয়সে একটি লেখায় তিনি লিখেছিলেন “ওস্তাদেরা গানের কথার উপর সুর দাঁড় করাইতে চান, আমি গানের কথাগুলিকে সুরের উপর দাঁড় করাইতে চাই। তাহারা কথা বসাইয়া যান সুর বাহির করিবার জন্য, আমি সুর বসাইয়া যাই কথা বাহির করিবার জন্য (৫)।
যে কবি শরতের আগমনে দেখেন আকাশে শুকতারার আগমন, সেই কবিই বসন্তের মধ্যে খুঁজে পান লাবণ্যময় প্ৰাণেশকে –
এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্ৰাণেশ হে,
আনন্দ বসন্ত সমাগমে।।
বিকশিত প্রীতিকুসুম হে
পুলকিত চিতকাননে।
৩১ বছর বয়সে রচনা করেছিলেন এই গানটি মহীশুরের পূৰ্ণ ষড়জ রাগিণী এবং একতাল ব্যবহার করে। কবির ভগিনী সরলা দেবী চৌধুরাণীর মহীশূর থেকে আনা স্বরলিপি এই গানটির বৈশিষ্ট্য।
যিনি পুলকিত হন প্রীতি কুসুমের বিকাশে, তিনিই আবার শঙ্কিত হয়ে পরেন নটরাজের প্রলয় জয় ডঙ্কারে,
পিনাকেতে লাগে টঙ্কার
বসুন্ধরার পঞ্জরতলে কম্পন জাগে শঙ্কার,
আকাশেতে ঘোরে ঘূর্ণি সৃষ্টির বাঁধ চূর্ণি
বজ্র ভীষণ গর্জনরব প্রলয়ের জয়ডঙ্কার।
প্রকৃতির এই নানা রূপ কবির কাছে পরমাত্মার ই নানা রূপের প্ৰকাশ। তিনি বাইরে এবং ভিতরে তাকেই খুঁজে বেড়াতেন। তাই পূজা পর্যায়ের বিভিন্ন গানে সেই আর্তি প্রকাশ পায়;
আছ অন্তরে চিরদিন, তবু কেন কাঁদি ?
তবু কেন হেরি না তোমার জ্যোতি,
কেন দিশাহারা অন্ধকারে ?
অকূলের কূল তুমি আমার,
তবু কেন ভেসে যাই মরনের পারাবারে?
এই গানিটির রচনাকাল ১৮৮৮ যখন কবির বয়স মাত্র ২৬। নবীন কবির মনে এই গভীর ঈশ্বরানুভূতি এসেছিল খুব সম্ভবত পরিবার সুত্রে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষা এবং ব্রাহ্ম্য ধর্মের রীতি এবং আচার রবীন্দ্রনাথের পূজার গানে বিপুল ভাবে প্ৰভাব বিস্তার করেছিল। এ ছাড়া ও mystic কবি রবীন্দ্রনাথ আলো – আঁধার, পার-পারাবার, ধরা -অধরা – সমস্ত কিছুর মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারতেন। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের শিক্ষায় অনুপ্ৰাণীত কবি বিশ্বাস করতেন একটি মাত্র আত্মা বিরাজ করছে এই অসীম ব্রহ্মান্ডে। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই universal Soul; তাই তো তাঁর পূজা, প্ৰেম, প্রকৃতির গান মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,
গভীর কি আশায় নিবিড় পুলকে
তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে।
এই গানটিতে কবি পরমাত্মাকে খুঁজে না পাওয়ার যে আকুতি প্ৰকাশ করেছেন তা মূর্ত হয়ে উঠেছে ভারাক্রান্ত বেহাগ রাগের মধ্যে দিয়ে। এই দুর্নিবার পরমাত্মার অন্বেষণ করতে করতে তিনি হটাৎ পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন এক বিশাল শক্তির উন্মোচন – একটি ছোট্ট জোনাকির অপরূপ আলোর বিকিরণ। সূর্য বা চন্দ্র না হলেও জোনাকির বিকিরণ নিয়ে আসে আলো, ঘোঁচায় অন্ধকার, আমাদের দেয় এক অনাবিল আনন্দ কিন্তু কি করে এ সম্ভব? এর একমাত্র সূত্র ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জীবটির অন্তরের শক্তি –
তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো
ঋণী কারোর কাছে
তোমার অন্তরের যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।
এই সর্বব্যাপী শক্তির বিভিন্ন রূপ পরমাত্মারই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। কবি অদ্বৈতবাদ বা non – dualism দর্শনে প্রবল ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশ্ব সংসারের সমস্ত আলোর চ্ছটাতে তিনি প্রত্যক্ষ করে ছিলেন জোনাকির ঝিঁকিমিকি। বাউল গানের ছন্দে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে দাদরার তালে সৃষ্টি করেছিলেন এই অসামান্য গানটি। ঠিক একই রকম ভাবে ৫২ বছর বয়সে রচনা করেছিলেন একটি ভীষণ জনপ্রিয় গান-
আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।
এই গানটির রচনার ইতিহাস জানতে পারলে বোঝা যায় কতটা অপার্থিব ভিন্ন একটি সুর এবং ছন্দের জগতে বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ। লেখক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ( ১) কোনো এক উৎসব উপলক্ষে বহু লোক শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বসন্তকাল, জ্যোৎস্না রাত্রি, সব অতিথিরা পারুলডাঙ্গা বনে বেড়াতে চলে গেছেন। শুধু তিনি রয়ে গিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে। হটাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে শুনতে পেলেন কে যেন নীচের তলার সামনের মাঠে গুণ গুণ করে গান গাইছেন। লেখক ছাদে উঠে গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখেন কবি আপন মনে জ্যোৎস্না প্লাবিত একটি খোলা জায়গায় গুন গুন করে গান গাইছেন –
“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।
…
আমার এ ঘর বহু যতন করে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।
এই গানটিতে কোন ঘরের কথা বলেছেন? এই ঘর ছিল কবির আর তাঁর অন্তরাত্মার মিলন কেন্দ্র। এই ঘরকেই তিনি ধুয়ে মুছে পবিত্র করে রাখতে চাইতেন ; যেখানে তিনি উপাসনা করেন সৃষ্টিকর্তার। এই ঘর শব্দটি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানে ব্যবহ্রত হয়েছে; বার বার তিনি বিভিন্ন ভাবে তাঁর অন্তরের অন্তস্থলে চলে যেতেন, নিভৃতে নীরবে যেতে চাইতেন তাঁর ঈশ্বরের কাছে।
এই রকমই একটি উপাসনা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন যখন বয়স মাত্র ৩৯। কাফি তালে রচিত এই গানটির প্রথমে বলছেন “প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী, দাঁড়াব তোমারি সন্মুখে,
আবার গানটির শেষে বলেছেন,
তোমার এ ভবে মম কৰ্ম যবে সমাপন হবে হে,
ওগো রাজাধীরাজ একাকী নীরবে দাঁড়াব তোমারি সন্মুখে।
জীবনে মরনে সঙ্গী শুধু এক জন – আমাদের পরমাত্মা। তাঁর কোনো বিনাশ নেই, তাঁর কোনো মাত্রা নেই, তিনি অ অসীম, অনন্ত, অপার।
এই উপলব্ধির ফল কবির ব্যক্তিগত জীবনে এনে দিয়েছিল এক অত্যাশ্চর্য বিনয়। ১৯১৩ সালে যখন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্যে ইংল্যান্ডের গুণী সমাজ কবির গলায় পরিয়ে দিয়েছিল সম্মানিক স্বীকৃতির বরমাল্য, সেই অনুভুতি কবি প্রকাশ করলেন একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গানের মধ্যে দিয়ে –
এ মনিহার আমায় নাহি সাজে
এৱে পড়তে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।
যিনি ১৯১৩ সালে প্রথম এশিয়া মহাদেশ থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন একটি পরাধীন দেশের বাঙালি কবি হিসাবে, তিনি বলছেন, এই পুরস্কার তাকে মানায় না – ইমন কল্যাণ রাগ এবং এক তালের বুননে, ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হল একটি অপূর্ব রবীন্দ্রসঙ্গীত।
গানটির শেষ দিকে কবি বলেছেন,
এ হার তোমায় পরাই যদি তবেই আমি বাঁচি।
ফুলমালার ডোরে বরিয়া লও মোরে –
তোমার কাছে দেখাই নে মুখ মনিমালার লাজে।
এই বহু জন প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটির মধ্যে শুধু বিনয় নয়, কবির এক বিরল অন্তর্মুখী অন্বেষণ প্রকাশ পায়। তাই তিনি বলেছেন এই লজ্জা বা বিরম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তিনি তাঁর পরমাত্মার গলায় এই হার পরিয়ে দিয়ে এই আড়ম্বর থেকে মুক্তি পেতে চান। এই প্রসঙ্গে শ্রী অজিত কুমার চক্রবর্তী যিনি একজন খ্যাতিমান রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন এবং শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করেছেন, বলেছিলেন এ মনিহার আমায় নাহি সাজে গীতিমাল্যের অন্যান্য গানের মতই কবির একটি বিশিষ্ট আবেগ প্রকাশ করেছে (১): বাইরের মত্ততা থেকে নিজের কেন্দ্রকে বাঁচিয়ে রাখার এক সতর্ক বোধে। এ মনিহার আমায় নাহি সাজে লেখার ঠিক ছয় মাস পরে লেখা – “ সভায় তোমার থাকি সবার শাসনে” ঠিক একই আবেগ প্ৰকাশ পায়।
যে বালক কবি শুরু করেছিলেন “জল পরে পাতা নরে” দিয়ে, দীর্ঘ ৮০ বছর অনন্য সাধারণ সাহিত্য এবং সঙ্গীতের রত্ন ভান্ডার আমাদের জন্যে সৃষ্টি করার পর বুঝতে পেরেছিলেন শরীর ভেঙে পরছে। কিন্তু এই জীবন যে ঈশ্বরের ই সৃষ্টি। তাই তিনি মৃত্যু শয্যা থেকে বন্দনা করলেন সৃষ্টি কর্তার, করলেন জীবনের জয়গান অন্তিম শয্যা থেকে। ১৯৪১ এর ১৪ই এপ্রিল রচনা করলেন আরেকটি অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত –
ঐ মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত ধূলির ঘাসে ঘাসে।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক
এল মহাজন্মের লগ্ন।
এই গানটিতে জীবনের জয়গান করা হয়েছে। তাই এই গানটির শেষ পঙতিতে কবি বলছেন, “– জয় জয় জয় রে মানব অভ্যুদয়”। রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুরের নাতি শ্রী সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর যিনি ভারতীয় কম্যুনিস্ট আন্দোলোনের একজন কর্ণধার ছিলেন, কবিকে বলেন “ রবি দা তুমি নমাে যন্ত্র নমাে যন্ত্র” গান লিখে যন্ত্রের বন্দনা করেছ, এ কি ভালো? এবার মানুষের কথা কিছু লেখ। কবি তখন দিনের বেশীর ভাগ সময়ই কোমার ঘোরে থাকতেন (১)। মৃত্যুর ৪ মাস আগে, ঠিক সেই দিনই, মৃত্যু শয্যা থেকে শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দেবীকে গানটির ডিকটেশন দেন। পরের দিনই গানটির সুর করেন ভৈরবী রাগে আর কাহারবা তালে। ঠিক একই সময় শেষ করেছিলেন সভ্যতার সংকট লেখাটি।
২৩শে বৈশাখ ১৩৪৮, ৬ ই মে, ১৯8১ – ঐ মহামানব আসে গানটির রচনার এক মাসের মধ্যে কবি সৃষ্টি করলেন তাঁর জীবনের শেষ গান,
হে নূতন
দেখা দিক আর বার, জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।
তোমার প্রকাশ হোক, কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন।
পরম প্রিয় শিষ্য শ্রী শান্তিদেব ঘোষের পীড়াপীড়ি তে জীবনের শেষ জন্মদিনটি উদযাপন উপলক্ষ্যে রচিত হয়েছিল এই অপূর্ব গানটি। পূরবীর “পচিশে বৈশাখ” কবিতাটিতে কিছু পরিবর্তন করে, ভৈরবী রাগে ও কাহারবার তালে সুর দিয়েছিলেন এই গানটিতে। লক্ষ করার মত, জীবনের শেষ দু দু র্টি গানে ব্যবহার করেছেন ভৈরবী রাগ, কাহারবা তাল, জীবনের জয় গান করার জন্যে। দুর্টি গানেই প্ৰাৰ্থন৷ করেছেন জীবনের সমস্ত রিক্ততা র মাঝেও যেন ঈশ্বর আমাদের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করে চলেন।
কবিগুরু ইহলোক ত্যাগ করেছেন প্রায় ৭৮ বছর আগে। জীবনের একেবারে শেষ দিকে কোনো এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন (১) তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর উত্তরসুরীরা তাঁকে ভুলে গেলেও, তাঁর গান বেঁচে থাকবে। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে কবি কোনো দিন নিজের সৃষ্টির ব্যাপারে মন্তব্য করেন নি, তিনি কি করে এই বলিষ্ঠ মন্তব্যটি করেছিলেন। সম্ভবত, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কথা, সুর ও তাল তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসবে এক অনির্বচনীয়ের মূর্ছনা। বেশ কিছু মৌলিক তাল-ই শুধু তিনি সৃষ্টি করেন নি, তাঁর গানের মধ্যে প্রকৃতি, জীব ও জগৎ এবং ঈশ্বর মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। আমাদের জীবনের সমস্ত অনুভূতির মধ্যে, সমস্ত হাসি, কান্না, বিরহ., প্রেম এবং জীবন মৃত্যুর মোহ জালের একেবারে কেন্দ্র বিন্দুতে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা। এই ঈশ্বরচিন্তার সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িযে রয়েছে কবির রহস্যানুভূতি। বেদ এবং উপনিষদের মৌলিক ভাবধারায় যে কবি বড় হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর সৃষ্টি তে এই মৌলিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, তা বলাই বাহুল্য।
আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যখন বাস্তবের খরতাপে মনে হয় জীবন দুর্বিসহ, আমরা ফিরে তাকাই কবিগুরুর দিকে, গেয়ে উঠি –
যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই গো তুমি এলে আমার ঘরে।
আমাদের জীবনের যে কোনো ভাব বা emotion প্ৰকাশ করতে হলে আমরা ফিরে তাকাই কবিগুরুর দিকে, বেছে নেই একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে। কবি নিজেই বলেছেন (১),
“সঙ্গীত শুনলে মনের ভিতরে যে অনির্বচনীয় ভাবের উদ্রেক করে তার ঠিক তাৎপর্যতা-টা যে কি। অথচ প্রত্যেক বারই মন আপনার এই ভাবটাকে বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করে। আমি দেখেছি গানের সুর ভালো করে বেজে উঠলেই নেশাটি ঠিক ব্রহ্মরন্ধের কাছে ধরে ওঠা মাত্রই, এই জন্ম – মৃত্যুর সংসার, এই আনাগোনার দেশ, এই কাজকর্মের আলো – আঁধারের পৃথিবীটি বহু দুরে – যেন একটি প্রকান্ড পদ্মা নদীর পরপারে গিয়ে দাঁড়ায় – সেখান থেকে সমস্তই যেন ছবির মতো বোধ হতে থাকে।”
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আসে সেই সুর; যেই সুরের তরী বেয়ে আমরা পার হয়ে যাই সেই প্রকান্ড পদ্মা নদীর পরপারে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১. www.gitabitan.net
২. স্বামী সর্ব প্রিয়নন্দর উপস্থাপনা, IIT-Kanpur, 3-day Workshop on Spirituality, March, 2014 – Youtube video recording
৩. Ode on a Grecian Urn, John Keats, 1819
৪. নটরাজের গান, ১৩৩২ ভাদ্র, শান্তিনিকেতনে বিচিত্রা ভবনে শেষ বর্ষণ প্রযোজিত হয়: www.gitabitan.net
৫. “ ররীন্রসঙ্গীতে ভাববতার কথা”, এক্ষণ, পঞ্চম বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা, শ্রী সত্যজিৎ রায়, ১৩৭8
[…] প্রফেসর শঙ্কু ফ্যান-ফিকশন অমিত ঘোষ রবীন্দ্রসঙ্গীতে ঈশ্বরচিন্তা @সুজন ভট্টচার্য, ১৯৮১, সিভিল […]