রবীন্দ্রনাথ ও ময়মনসিংহের মসুয়ার রায় বংশ
@ বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
নতুন করে পঁচিশে বৈশাখে কিছুই কি আর বলার থাকে? এই বিশ্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যেই আমাদের জীবনে আসবে রবিপ্রকাশের সেই দিন। এই বিশেষ রচনাটি রায় পরিবারের কৃতি সন্তানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ-পরম্পরার একটি সূত্রস্থাপনার প্রয়াস।
১২১২ বঙ্গাব্দ। আষাঢ় থেকে মাঘ মাস ‘বালক’ পত্রিকায় ২৬টি অধ্যায়ে একটি অসমাপ্ত ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। হঠাৎই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আরও ১৮টি অধ্যায় যুক্ত করে ১৮৮৭ সালে এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের নাম ‘রাজর্ষি’ এবং ঔপন্যাসিক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসলে ‘বালক’ মাসিকপত্রটি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় এবং তদারকিতে ১৮৮৪ থেকে ৮৫, প্রায় বছরখানেক চলেছিল। এখানে যখন ‘রাজর্ষি’ প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন অনেকেই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সে সময় কলকাতার দুটি সদ্যোজাত শিশুর ডাকনাম রাখা হয়েছিল হাসি এবং তাতা। সেই শিশুকন্যার পোশাকি নাম সুখলতা এবং শিশুপুত্রের সুকুমার। হ্যাঁ, এদের পিতা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর সন্তানদের নামের সঙ্গে রবীন্দ্রসৃষ্ট উপন্যাসের চরিত্রের নাম জড়িয়ে চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভূমিকায় এই কাহিনি অবতীর্ণ যে কারণে করা হল তা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পর্কের একটা ছোট্ট সেতুবন্ধনের খোঁজ।
এর আগের ইতিহাস বলছে, সুদূর ময়মনসিংহ থেকে ১৮৭৯-৮০ সাল নাগাদ উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় চলে এসেছিলেন। স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করে আইএ পড়তে আসেন। কলকাতায় এসে উঠেছিলেন ৫০ নম্বর সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে ব্রাহ্মদের নিজস্ব ডেরা, ব্রাহ্ম কেল্লায়। ১৮৮৪ সালে বিএ পাশ করে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। এরপর কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। সেই সময় ব্রাহ্মসমাজ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পরিচালনায় আদি ব্রাহ্মসমাজ। আর একটি কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ এবং শেষোক্তটি আনন্দমোহন বসু ও দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মসমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বা বলা যেতে পারে ঠাকুরবাড়িতে তাঁর প্রবেশ অবাধ হয়। সে বাড়িতে যাবার সুবাদে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রায় সমবয়সী দুই মননশীল যুবকের মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। আসলে দুজনেরই সাহিত্য, সংগীত এবং চিত্রকলা চর্চায় ছিল গভীর মনোযোগ। মজার ব্যাপার, রবীন্দ্রনাথ এবং উপেন্দ্রকিশোর দু’জনেরই ঝোঁক ছিল ছোটদের জন্য লেখা এবং ছবি গড়ার ব্যাপারে। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ শিশুপাঠ্য গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যে ‘নদী’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন যা কিনা যুক্তাক্ষর বর্জিত সহজ ছন্দে রচিত। ‘নদী’ যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে মনস্থির করেছেন কবি, তখন উপেন্দ্রকিশোরকে দিয়ে তিনি সাতটি সাদা কালো ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা ছবি ছিল এক অভূতপূর্ব যুগলবন্দি।
এছাড়া উপেন্দ্রকিশোর অসাধারণ বেহালা বাজাতেন, যা কিনা বয়সে দু’বছরের বড় রবীন্দ্রনাথের অসম্ভব পছন্দ ছিল। উপেন্দ্রকন্যা পূণ্যলতা চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, “প্রতি বছর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে উৎসবের সময় বাবাকে রবীন্দ্রনাথের নতুন গানের সঙ্গে বেহালা বাজাতে হত।” পরবর্তীকালে উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের ন’টি গানের স্টাফ নোটেশন করেছিলেন। এবং প্রাচীন দণ্ডমাত্রিক পদ্ধতিতে কবির ১২টি গানের স্বরলিপি লিখেছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোরের সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভাব জমেছিল তাঁর পুত্র তাতা অর্থাৎ সুকুমার রায়ের। এই বিশেষ স্নেহভাজনকে ‘আমার যুবক বন্ধু’ বলে অভিহিতও করেছেন কবি নানা অবসরে। নোবেল প্রাপ্তির কালে অর্থাৎ ১৯১২ সাল নাগাদ সুকুমার রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাত্রার সঙ্গী ছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, সে ইতিহাস সুকুমারের চিঠি থেকেই জানা যায়। যেমন, তিনি বাবাকে ১২ জুলাই চিঠিতে জানাচ্ছেন, “মঙ্গলবার রবিবাবুর ওখানে রাত্রে খাবার নেমন্তন্ন ছিল। Rothenstein সেখানে এসেছিলেন। দুজনেই বল্লেন, আমি রবিবাবুর কয়েকটা poetry-র যা translation করেছি তা তাদের খুব ভালো লেগেছে–সেইগুলো এবং আরো কয়েকটি translate করে publish করার জন্য বিশেষ করে বল্লেন।… এখন অবসর আছে- কাজেই অনেকগুলি poetry translate করেছি। যদি সুবিধা হয় publish করব।” দুর্ভাগ্যের বিষয়, সুকুমারের করা রবীন্দ্রকবিতার ইংরেজি অনুবাদগুলি পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কালের অতলে হারিয়ে গিয়েছে। ১৯১৩ সালের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইতালির নেপলস থেকে একই জাহাজে বোম্বাই ফিরে আসেন সুকুমার।
কলকাতায় ফিরেই সুকুমার বিয়ে করবেন ঠিক করেন এবং ১৩ ডিসেম্বর সুকুমার এবং সুপ্রভার বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় আসেন। সুপ্রভাও রবীন্দ্রনাথের পূর্বপরিচিত ছিলেন। সুপ্রভা এবং কনক দাশ, এই দুই সহোদরা রবীন্দ্রসংগীতের দক্ষ শিল্পী ছিলেন। ইতিহাস বলছে, নোবেল প্রাপ্তির পর ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিনে কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে শিবনাথ শাস্ত্রীর পৌরোহিত্যে এক সভায় রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভার শেষে সুপ্রভা গান করেছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজ ছাড়া সুকুমারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘মন্ডে ক্লাব’ বা ‘খামখেয়ালি সভা’র মাধ্যমেও বেশ যোগাযোগ ছিল। শান্তিনিকেতনে কবির কাছে প্রায়ই যেতেন তিনি। আশ্রমিকরা একবার সুকুমারের সৌজন্যে ‘বাঙাল সভা’র আয়োজন করলে, রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে সুকুমার সেই সভার সভাপতি হন। সেখানে সুকুমার রবীন্দ্রনাথকে একটি অনুরোধ করে বসলেন তাঁর মামার বাড়ির ভাষায় কিছু বলতে। কালিদাস নাগের স্মৃতিচারণে রয়েছে, “রবীন্দ্রনাথ অসম্মতি জানাইয়া বলিলেন, খুলনার ভাষার মাত্র দুইটি কথা তিনি জানেন, তাহাতে বক্তৃতা দেওয়া চলেনা। কথা দুইটি হইতেছে ‘কুলির অম্বল’ ও ‘মুগির ডাল’।”
১৯২১ সালে সুকুমার দূরারোগ্য কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। সেই বছরই পুজোর সময় শিশুপুত্র মানিককে নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে কবির সঙ্গে দেখা করতে যান। এরপর ক্রমে কালব্যাধি তাঁর জীবনীশক্তি গ্রাস করতে থাকে। ১৯২৩ সালের ২৯ আগস্ট সুকুমারের শেষ শয্যায় কবি দেখা করতে আসেন। কবির কাছে সুকুমার চেয়েছিলেন পূর্ণতা ও আনন্দের গান শুনতে। সুশোভন সরকার লিখছেন, “এরপর তাতা’দা রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করলেন তাকে একটা গান শোনাতে। গানটাও নির্দেশ করে দিলেন। গীতালির ‘দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো — গভীর শান্তি এ যে!’ বেশ মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গানটা শোনালেন। পরে জানলাম যে ওই কবিতাটির নাকি তখন সুর দেওয়া ছিল না রবীন্দ্রনাথ সেখানে বসে বসেই সুর দিয়েছিলেন।”
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সত্যজিতের প্রথম সাক্ষাৎ দু’বছর বয়সে, যার কথা তাঁর মনে ছিল না। পরের সাক্ষাতের কথা লিখে গিয়েছেন নিজের ছেলেবেলার স্মৃতিকথায়।
উপেন্দ্রকিশোর এবং সুকুমারের পর রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি এলেন সুকুমার-পুত্র সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথ এমনই একজন আধুনিক মানুষ, তিন প্রজন্মের সঙ্গে অনায়াসেই মিশতে পারার মুক্তমন ছিল তাঁর। বাল্যবয়সে বা বলা যেতে পারে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়ে কিংবা স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজে পড়াকালীনও সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের প্রতি খুব যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এমন বলা যায় না। তবে স্কুল জীবনে একবার রবীন্দ্রনাথের একটি গান ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’র একটি চিত্ররূপ তিনি করেছিলেন। এবং এই কারণে স্কুল থেকে তাঁকে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। রবীন্দ্র প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন,
“যে কবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হয়েছে তাকে কি সত্যিই দেখা হওয়া বলে? তাঁর কাছে ভয় সম্ভ্রমে জড়োসড়ো হয়ে কোনক্রমে এগিয়ে গিয়ে তার পা ছুঁয়েছি। কিন্তু যতবারই এটা ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ আমার মায়ের দিকে মুখ তুলে বলেছেন ‘তোমার ছেলেকে আমার আশ্রমে পাঠাচ্ছ না কেন? সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর আশ্রমে যাবার কোন বাসনা আমার ছিল না।”
সত্যজিৎ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে পড়ছেন পিতৃবন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ইচ্ছানুসারে। যদিও অর্থনীতিও তাঁর একেবারেই না-পসন্দ্ ছিল। ফলে মাঝপথে ছেড়ে দিলেন এবং চলে গেলেন শান্তিনিকেতন, কলাভবনের ছাত্র হয়ে ছবি আঁকা শিখতে। যদিও এর আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একাধিকবার তাঁর দেখা হয়েছিল, এবং শৈশবেই। আগেই বলেছি দু’বছর বয়সে সত্যজিৎকে নিয়ে সুকুমার শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন কবির সঙ্গে দেখা করতে। সেই স্মৃতি শিশু সত্যজিতের মনে না থাকাই স্বাভাবিক। তাঁর নিজের ভাষায়, “রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম কখন কাছ থেকে দেখি তা আমার মনে নেই। যখনকার কথা মনে আছে তখন আমার বয়স সাত বছর। মা-এর সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম পৌষের মেলায়। সঙ্গে হোয়াইটআওয়ে লেডল-র দোকান থেকে কেনা নতুন অটোগ্রাফের খাতা। রবিবাবু নাকি খাতা দিলেই তখন তখন কবিতা লিখে দেন, তাই ভারি শখ আমার খাতার প্রথম পাতায় তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেব।”
সেই মতো সেবার উত্তরায়ণে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কবি জানালার দিকে পিঠ করে চেয়ারে বসে ছিলেন, সামনে টেবিলের উপর অনেক বই আর খাতা ছিল। ছিল আরও চিঠিপত্রের বিরাট অগোছালো স্তুপ! ধীর পায়ে সত্যজিৎ তাঁর কাছে গিয়ে অটোগ্রাফের খাতাটা দিলেন এবং সুপ্রভাদেবী কবিকে সেই খাতায় একটা কবিতা লিখে দেবার অনুরোধ করলেন। সত্যজিৎ বলছেন, “আমি ছিলাম বেজায় মুখচোরা, বিশেষ করে রবিবাবুর সামনে তো বটেই।” তিনি সেদিন আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলেন বা বলা যেতে পারে নিরাশ হয়েছিলেন দেখে, যে কবি তখনই কোনও কবিতা লিখে দিলেন না। শুধু বলেছিলেন, ‘কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।’ যথারীতি পরের দিন সকালে খুব সংকোচ নিয়েই কবির সামনে গেলেন। যদিও মনে মনে ভেবেছিলেন এত কাজের মধ্যে তাঁর খাতায় কবিতা লেখার কথা কি আর কবির মনে থাকবে! কিন্তু না! কবির মনে ছিল এবং কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর ছোট্ট বেগুনি খাতাটা অনেক বই খাতার নিচ থেকে বের হল। সত্যজিৎ লিখছেন, “সেই খাতার প্রথম পাতা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এর মানে আরেকটু বড় হলে বুঝবে।”
সেদিন রবীন্দ্রনাথ সাত বছরের সত্যজিতের অটোগ্রাফের খাতায় একটি আট লাইনের কবিতা লিখে উপহার দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীতে সে কবিতা সত্যজিতের ব্যক্তিগত মহল থেকে বেরিয়ে জনগণের দরবারে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি হল-
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
পরবর্তীকালে যুবক সত্যজিৎ যখন কলাভবনের ছাত্র, তখন বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু করেননি। কারণ হিসেবে নিজেই কবুল করেছেন, “তার সামনে গিয়ে কী যে বলব সেটা কোনোসময়ই ভেবে স্থির করতে পারিনি।”
কবি এবং রায় পরিবারের তিন পুরুষের ব্যক্তিগত সাক্ষাতের কাহিনির কথা এমনই। এরপর রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ এবং সত্যজিতের উত্থান। এই বিষয়টি ধীরে ধীরে বিকশিত হতে দেখা যায়। রবীন্দ্র-প্রয়াণের ঠিক পরের বছর ডিসেম্বর মাসে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। ঝুলিতে কলাভবনের নানা অভিজ্ঞতা। নন্দলাল থেকে বিনোদবিহারীর ছায়া। এর প্রভাব থেকে বেরিয়ে তিনি কমার্শিয়াল আর্টের জগতে ঢুকে পড়েন। কলকাতায় গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
সবুজকলি সেনের একটি লেখাতে পাচ্ছি পরিচালক হিসাবে বিখ্যাত হবার পর শান্তিনিকেতনে সত্যজিৎ।
সময়টা ১৯৭১ এর শেষ বা ১৯৭২ এর শুরু। মাটিতে বসে চীনা ভবনে আমরা ক্লাস করছি। হঠাৎ দেখি অধ্যাপক শিশির কুমার ঘোষ হঠাৎ “শিশিরদা” ডাকে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে হাসলেন আর ক্লাস থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইরে দেখি দীর্ঘদেহী সত্যজিৎ রায় হাতে ক্যামেরা, আরো কয়েকজন সঙ্গে। তখনকার কালে এখনকার মতো নামকরা লোক দেখলে ভীড় জমানোর রীতি ছিলনা। দেখলাম উনি চীনা ভবনে হিন্দি ভবনে ছবি তুলছেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এর করা ফ্রেস্কোর। তখন তিনি ” ইনার আই” ডকুমেন্টারি করছিলেন। বহুবার দেখেছি শান্তিনিকেতনের পথে, কোপাইয়ের ধারে ও আরো নানা জায়গাতে।
সুধীর চন্দ্রকরের ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
১৯৪৫ সালে সুধীরচন্দ্র করের ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’ বইটির প্রচ্ছদ এঁকে আবার রবীন্দ্র-সাগরে অবগাহন শুরু করলেন। এরপর ১৯৫৫-তে আঁকলেন অমল হোমের ‘পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ। আরও পরে আশির দশকে সুশোভন সরকারের ‘প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ’-এর প্রচ্ছদও এঁকেছিলেন।
ছ’ বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৬১ সালে দেশজুড়ে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন শুরু হল। ৫৪ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উপর ভারত সরকারের প্রকাশিত ডাকটিকিটের ডিজাইনটিও তিনি করে দিলেন। সম্ভবত এর পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যেন তাঁর অন্তরের আত্মীয়তা বেড়ে উঠতে লাগল। অনেকটা যেন কবির ভাষায়,
কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া,
চলে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া !
সুশোভন সরকারের ‘প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ের প্রচ্ছদ করেন সত্যজিৎ আশির দশকে।
রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষেই মুক্তি পেল তিনটি রবীন্দ্রগল্প, ‘সমাপ্তি’, ‘পোস্টমাস্টার’ এবং ‘মণিহারা’ নিয়ে তৈরি তাঁর ছবি ‘তিনকন্যা।’ ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪। মাঝে মাত্র তিন বছর- মুক্তি পেল ‘নষ্টনীড়’-এর চলচ্চিত্ররূপ চারুলতা। এই ছবিতে সত্যজিৎ যেন পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথকেই ছুঁয়ে দেখলেন। অমলের মধ্যে যুবক রবির ছায়া আনলেন। এই ছবিতে তিনি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেন এবং তা কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ান। গানটিকে ছবিতে যথাযথ প্রয়োগ করলেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, যা কিনা কপিরাইটের থাকাকালীনই হয়েছিল। গানটি কিন্তু স্বরলিপি অনুপুঙ্খভাবে মেনে গাওয়া হয়নি। অথচ বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড মেনে নিয়েছে সেই সময়, যা অন্য বহু ক্ষেত্রেই মানা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন, কী করে সত্যজিৎ-এর জিৎ হল ?
জবাবে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে সুভাষ চৌধুরীকে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারের একটি অংশে নিজেই বলেছিলেন, “কোনও প্রচলিত রীতি যখন রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন তখন তার কথায় বা সুরে বা ছন্দে কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য এনেছেন। ফলে সেগুলিকে অনুকরণ না বলে নবীকরণ বলা যেতে পারে।”
তবে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সত্যজিতের মতো বহুমুখী প্রতিভাও রবীন্দ্রনাথের গানকে এমন নবীকরণ করেছিলেন সজ্ঞানেই! যদিও তিনি তাঁর অন্যান্য ছবিতেও রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের ব্যবহার করেছিলেন সযত্নেই। এ প্রসঙ্গে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অমিয়া ঠাকুরের কন্ঠে ‘এ পরবাসে রবে কে’ গানটির প্রয়োগ চলচ্চিত্র জগতে একটি মাইলস্টোন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত তিনি তাঁর নানা ছবিতে সুচারুভাবে ব্যবহার করেছেন।
সবশেষে একটি প্রসঙ্গ আগামীদিনের গবেষকদের জন্য তুলে ধরতে চাই। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দশকে যখন রং তুলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তখন তাঁর চেতনার মধ্যে আলোছায়ার খেলা শুরু হয়েছে। আমরা সেই সময়ে তাঁর নটীর পূজা, শাপমোচন, শিশুতীর্থ-তে এই আলো-ছায়ার পরশ পাই। ১৯৩০ সালে লন্ডন থেকে ফ্রান্স ও জার্মানি হয়ে মস্কো যাবার সময়েই ‘দ্য চাইল্ড’ নামে একটি অর্নিমিত চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট রচনা করেছিলেন তিনি। মস্কো পৌঁছে তিনি আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ এবং ‘ওল্ড অ্যান্ড নিউ’ ছবি দুটি দেখেন। সেগুলি কবির ভালোও লাগে। এরপর উপস্থিত চলচ্চিত্রবোদ্ধারা রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘দ্য চাইল্ড’-এর চিত্রনাট্য শোনেন। ১৯৩২ সালে নিউ থিয়েটার্স-এর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ নিজে ‘নটীর পূজা’ চলচ্চিত্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
শেষজীবনে এই দেহমুক্ত রূপ থেকেই কায়ামুক্ত ছায়া-আলোর অদৃশ্য হাত ধরতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিতে। সত্যজিৎ কি রবীন্দ্রনাথের এই অসমাপ্ত অধরা মাধুরীকেই নিজের শিল্পবোধের ছন্দোবন্ধনে ধরতে চাইলেন উত্তরসূরি হিসেবে?
তথ্যঋণ:
১। রবীন্দ্রনাথ ও রায় পরিবার – প্রসাদরঞ্জন রায়
২। রবীন্দ্রনাথ ও চলচ্চিত্র – পশ্চিমবঙ্গ, মে ২০০৬
৩। বিষয় রবীন্দ্রসঙ্গীত – সত্যজিৎ রায়, ইন্দিরা সঙ্গীত শিক্ষায়তন
৪। সুকুমার রায় – পার্থ বসু, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ
৫। ছেলেবেলার দিনগুলি – পুণ্যলতা চক্রবর্তী
৬। এক্ষণ বার্ষিক সংখ্যা ১৩৯৩
৭। রবিজীবনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৮। কোরক সাহিত্য পত্রিকা, সুকুমার রায় বিশেষ সংখ্যা, ২০০৩
৯। সত্যজিতের পরিবার ও রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরী
১০। অধ্যাপক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়
১১। যখন ছোট ছিলাম – সত্যজিৎ রায়
[…] ভট্টচার্য, ১৯৮১, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং রবীন্দ্রনাথ ও ময়মনসিংহের মসুয়ার রা… @ বিজিত কুমার রায়, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল […]
লেখক অনেক সময় নিয়ে পড়াশোনা করে এটা লিখেছেন। অনেক ধন্যবাদ, আরও লিখুন