সেই শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত কত বিচিত্র রূপে দেখলাম নারীকে। দৃষ্টিভঙ্গিরও সম্যক পরিবর্তন হল বয়সের সাথে সাথে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীভাবনায় ঠিক কোন সময়টাকে ধরব! বেশ, যদি ধরি আমার জীবনের পঁচিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সটাকে।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবন জুড়ে। পঁচিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, এই বয়সকালে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কোন্ চোখে দেখেছিলেন নারীকে। তাঁর চোখ দিয়ে নারীকে আমরা দেখেছি চলচ্চিত্রে, নৃত্যে, নাটকে। কিন্তু তাঁর কবিতার সম্ভার সেভাবে কি চিত্রিত হয়েছে তাঁর নিজের তুলি-কলমের আঁচড়ে? এ প্রসঙ্গে বলি, আমরা অনেকেই হয়ত খেয়াল রাখি না তাঁর অঙ্কিত চিত্রসম্ভারের। কারণ, তিনি সে ভাবে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন একটু বেশি বয়সে মানে বয়স তখন তাঁর ষাট পেরিয়েছে। আর্জেন্টিনার স্বনামখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ‘চিত্রী রবীন্দ্রনাথ’ এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভার স্ফুরণ। তাঁরই উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি প্রথম প্রদর্শিত হয় প্যারিসে উনিশ শো তিরিশে। পরবর্তীকালে বারমিংহাম, লন্ডন, বার্লিন, ম্যুনিখ, দ্রেসদেন, কপেনহাগেন, জেনিভা, মস্কো, ন্যুইওরক, প্রায় সারা বিশ্বে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনী। তাঁর আঁকা চিত্র সংগৃহীত হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রদর্শনীশালায়।
এসব ভাবতে ভাবতে ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা ওলটাচ্ছি। কবির পঁচিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে লেখা কয়েকটি কবিতা আমাকে খুব বেশী টানছিল। আমার নিজের ওই বয়সের উপলব্ধির সাথে কেমন জানি মিলে যাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা। মনে হচ্ছিল এই কবিতাগুলো কবি যখন লিখেছিলেন, ঠিক কি ছবি ভেসে উঠেছিল তাঁর চোখের সামনে? অনেক খুঁজেও তার কোন হদিশ পেলাম না। ভাবলাম, দেখি না একবার চেষ্টা করে, আঁকতে পারি কিনা তাঁর ঐ সব কবিতার চিত্রকল্প।
কখনো বা চাঁদের আলোতে
কখনো বসন্তসমীরণে
সেই ত্রিভুবনজয়ী অপাররহস্যময়ী
আনন্দমুরতিখানি জেগে ওঠে মনে ।।
এরপরে আসি তাঁর সাতাশ বছর বয়সে লেখা ‘অপেক্ষা’ কবিতায়। প্রেম এখানে উদাসীঃ
সলিলতলে সোপান-’পরে উদাস বেশবাস ।
আধেক কায়া আধেক ছায়া জলের ’পরে রচিছে মায়া,
দেহেরে যেন দেহের ছায়া করিছে পরিহাস ।।
কবির বয়স বেড়েছে। পরিবর্তন এসেছে তাঁর মনে, নারী’র সংজ্ঞারও ধীরে ধীরে রূপান্তর ঘটেছে। প্রেম কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছে। ঘটেছে মিলন আর বিরহের সমাপতন। উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি লিখলেন “মেঘদূত”। তাঁর মনে এসেছিল এক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, এই বয়সেই কি কালিদাস লিখেছিলেন তাঁর ‘মেঘদূত’ –
কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত বরষে
কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত ! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত ক’রে ।।
কবির বয়স তখন উনচল্লিশ। লিখলেন ‘কল্যাণী’। প্রেম পরিনতি পেল নারীর কল্যাণী রূপে। বিশ্বপ্রেম ছাপিয়ে গেল ব্যক্তিপ্রেম কেঃ
বিরল তোমার ভবনখানি পুস্পকানন-মাঝে,
হে কল্যানী, নিত্য আছ আপন গৃহকাজে ।
বাইরে তোমার আম্রশাখে স্নিগ্ধরবে কোকিল ডাকে,
ঘরে শিশুর কলধ্বনি আকুল হর্ষভরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার আছে তোমার তরে ।।
কবির বয়েস চল্লিশ পেরল। তিনি নারীর মধ্যে খুঁজে পেলেন মাতৃরূপ। বয়েস তখন তাঁর বিয়াল্লিশ। লিখলেন ‘জন্মকথা’-
‘ছিলি আমার পুতুল-খেলায়, ভোরে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি ।
তুই আমার ঠাকুরের সনে ছিলি পূজার সিংহাসনে,
তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি ।।
আমার চিত্রানুবাদ
ইচ্ছে রইল ভবিষ্যতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরও কিছু কবিতার চিত্রানুবাদ করার। যদিও জানি, এ প্রচেষ্টা হবে সাগর তীরে নুড়ি কুড়নোর।
চিত্রাঙ্কন – লেখক নিজে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – টাইটেল চিত্রটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
সাহিত্যিকা পত্রিকা এক সুন্দর প্রয়াস। এর দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
অসাধারণ একটা ভাবনার ফসল। লেখক শিল্পীর শিল্পবোধের তারিফ করি
অসাধারণ একটা চিত্রগল্প।