সাহিত্যিকা

আসমানি (ধারাবাহিক)

আসমানি (ধারাবাহিক)
©গণেশ ঢোল, ১৯৮৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

আসমানি [এক]
শিল কাটাবে গো,’ বলে হাঁকতে হাঁকতে একটা লোক মাথায় একটা গামলা নিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে। কদিন আগেই মা বলছিল, “শিল কাটাতে হবে, মশলা বাটতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। আমি জানলা দিয়ে ডাকি, “শিল কাকা, আমাদের বাড়ি এসো।”
লোকটা তখন বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছে। ফিরে আসে, আমি সদর দরজা খুলে দিই, লোকটা ঢোকে, বারান্দায় নিজের ঝাঁকা নামায়, তারপর চেঁচিয়ে বলে, “কই মা, শিল-নোড়া বার করো। তার আগে এক গ্লাস জল দাও।”
আমি বলি, “দাঁড়াও জল দিচ্ছি।”
মা বলে, “কাচের গ্লাসে বাইরের লোককে জল দিবি। কাঁসার গ্লাসগুলো শুধু বাড়ির লোকজনের জন্যে। আর বাইরে থেকে এলে কাউকে শুধু জল দিতে নেই। বাতাসা কিংবা মুড়কি একটা রেকাবিতে দিয়ে জল দিবি। আমি কাচের গ্লাসে জল দিই কিন্তু কোন্ প্লেটে মুড়কি দেব, ভেবে পাই না। আমাদের বাসনে দেওয়া যাবে না, শেষে ছোড়দির খেলনাপাতি থেকে দু’টো ছোট পেতলের প্লেটে মুড়কি দিয়ে জল দিই।”
লোকটা মুড়কি মুখে ফেলে ঢক ঢক করে জল খেয়ে নেয়। তারপর বলে, “তোমার মা কই?”
– “আমার মা তারকেশ্বর গেছে পুজো দিতে মেজদার সাথে।”
– “তা, ঘরে আর কে আছে?”
– “কেউ নেই। আমি বাড়ি পাহারা দিচ্ছি।”
– ” তারমানে এখন তুমিই এ বাড়ির মালিক?”
আমি খুব ব্যক্তিত্ব নিয়ে বলি, “হ্যাঁ। কত নেবে শিল কুটতে? আমি আট আনার বেশি দিতে পারব না।”
লোকটা বলে, “তাই দিও।”

লোকটা ছেনি, হাতুরি দিয়ে শিল কুটতে থাকে। এমন সময় পাশের বাড়ির রীনার মাসী ঘরে ঢুকে বলে, “অ্যাই টিটু তুই যাকে তাকে দরজা খুলে দিয়েছিস কেন? আর তুমি কী করছো এখানে? কে বলেছে তোমায় শিল কুটতে? অত ভারী শিল বার করে কে দিল তোমায়?”
আমি বলি, “আমি বার করে দিয়েছি।”
– “তুই বার করেছিস? অত ভারী শিল পায়ে পড়লে পা একেবারে থেঁতো হয়ে যেত। মা নেই, আর খুব দস্যিপানা হচ্ছে! কত নেবে বলেছে?”
– “আট আনা।”
– “বাচ্চা ছেলে পেয়ে ঠকাচ্ছ? চার আনার এক পয়সা বেশি নেবে না। আর তুই আট আনা পেলি কোথা থেকে?”
– “মা দিয়ে গেছে যাওয়ার সময়।”
-“আর ওই পয়সা দিয়ে উনি শিল কোটাচ্ছেন!”

রীনার মাসী বকে ধমকে চলে গেল। লোকটা বলল, “কে হয় তোমার? এক ধাক্কায় চার আনা কমিয়ে দিল।”
– “আমাদের পাশের বাড়ির মাসীমা। তুমি ভালো করে শিল কুটে দাও। মা’র যেন কষ্ট না হয় হলুদ বাটতে। আমি আট আনাই দেব। ভদ্রলোকের এক কথা। তুমি মাসীমাকে বলবে না। আমাদের আরও একটা শিল আছে ওটাতে পেঁয়াজ, রসুন বাটা হয়।”
লোকটা একেবারে বিগলিত হয়ে যায়। বলে, “বাবা তুমি বনেদি ঘরের ছেলে, বড় মনের মানুষ। এর পরের বার এসে অন্য শিলটা কুটে দিয়ে যাব।”
লোকটা ছোট ছোট ছেনি হাতুরি দিয়ে খুব যত্ন করে শিলের বুঁজে যাওয়া ছোট ছোট গর্তগুলিকে ফুটিয়ে তোলে। শিলের ওপর ফুল-পাতার নকশা ফুটিয়ে তোলে। করতে করতেই বলে, “অন্য আমিষ শিলটায় মাছের ছবি ছেনে দেব। কাজ শেষ হলে তোমায় একটা জিনিস দেব। আমার তরফ থেকে তোমায় উপহার।”

আমি মন দিয়ে দেখতে থাকি ওর শিল্পকর্ম। কাজ শেষ হলে ওই নিজের কাপড় দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দেয়। শিল-নোড়াটা আগের জায়গায় রেখে, বলে, “সোনাবাবু, তুমি খুব ভালো ছেলে। তোমার মধ্যে সংস্কার আছে। তুমি এই বইটা পড়ো, এখন না পারলে বড় হয়ে পোড়ো। আমি তো মুখ্যুসুখ্যু মানুষ এত উঁচুদরের লেখা পড়তে পারি না। আমি এক মারোয়াড়ির বাড়িতে শিল কুটতে গিয়েছিলাম, সেখানে কাজ হয়ে যাওয়ার পর এই বইটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইএ লে লেও, ইএই তেরা মজুরি হ্যায়।’ ওই মারোয়াড়িরা পুরনো বই-খাতা, কাগজপত্রের ব্যবসা করে। আমি আর কী বলব, গরিব মানুষ, ওটাই নিয়ে নিলাম।”
আমি বইটা নিয়ে দেখি, লেখা আছে ‘পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’। বইয়ের ভেতরে কালো কালিতে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা – অভিজ্ঞান শীল, শৈল ভিলা, বলরামপুর।
বেশ মোটা বই। পাতা ওল্টাতে থাকি, কঠিন কঠিন শব্দ। একেবারে শেষ পাতায় চোখ আটকে যায়, দেখি লেখা:

“পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন — মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়! তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্য্যোদয় ছেড়ে সূর্য্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশ্যে… দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন স্বপ্ন শ্যাওলা-ছাতা দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না… চলে… চলে… চলে… এগিয়েই চলে…
অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ…
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমাকে ঘরছাড়া করে এনেছি!…
চল এগিয়ে যাই।”

ওই অংশটুকুই বারবার পড়তে থাকি। কিছু বুঝতে পারি, কিছু পারি না। কেমন ঘোরের মতো লাগে। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করতে থাকি, “পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন – মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি …”
পড়তে গিয়ে প্রচণ্ড কষ্ট হয়, মায়ের কথা ভেবে খুব মনখারাপ হয়। ফাঁকা ঘরে বুকটা হু হু করে ওঠে। আমি বড় ঘর, কামার ঘর, ছোট ঘর, কাঠের ঘর, ঠাকুর ঘরে একলা ঘুরতে থাকি। আলনা থেকে মায়ের শাড়ি টেনে এনে গন্ধ শুঁকি। খুব অভিমান হয় মায়ের ওপর। খাতার থেকে পাতা ছিঁড়ে মাকে চিঠি লিখতে বসি।
‘তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না। আর কোনোদিন মা বলে ডাকব না তোমায়।’
কান্না পায়। ড্রয়ার থেকে একটা কাঁচি বার করি। মায়ের শাড়ি লম্বা লম্বা করে কাটি। রেডিও খুলি, রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত বেজে ওঠে – ‘গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ, হোথা যাস নে -‘
ধীর লয়ে ওই গান শুনে আমার মন আরও খারাপ হয়ে যায়। রেডিও বন্ধ করে দিই।

০৮ ০১-২০২৪

আসমানি [দুই]
উড়িয়া ঠাকুরমশাই পুজো করতে আসে। ঠাকুর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বলে, “কীরে আজ সব শুনা শুনা লাগছে। মাইজী কোথা?”
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলি, “মা তারকেশ্বর গেছে।”
– “তুই ফুল তুলিসনি?”
– “না, তুলব না।”
– “ফলটা কে কেটে দিবে?”
-“জানিনা। মা বলেছে প্রসাদে খেজুর আর বাতাসা দিতে।”
– “ঠিক আছে মন খারাপ করিস না। চলে আসবে মাজী। তোদের রান্নাটা কে করে দিবে?”
– “বিজয়দার বৌ আসবে দশটার সময়। থাকবে আমাদের বাড়ি।”
– “তোর কাপড় ছাড়া আছে তো বোস ঠাকুরঘরে, আমি ঠাকুর সাজাই।”
– “মা বলেছে ছোটদের অত নিয়ম মানতে নেই। ধাঁই কিরি কিরি মানে কী?”
– “ওটা খারাপ কথা বলতে নেই।”
– “ওটাও খারাপ কথা? পুরীতে পাণ্ডারা বলে।”
– “বলুক, তুই বলবি না।”
– “তুমি এই দশ পয়সা দিয়ে মায়ের নামে পুজো দাও। যেন মা ঠিক আজ বিকেলেই ফিরে আসে। যেন ওখান থেকে নবদ্বীপে চলে না যায়। তুমি বাণ মেরে দাও।”
– “মাজীকে বাণ মেরে দিব? তোর মা’র নাম কী? তুই গেলি না কেন মাজীর সাথে।”
– “মা বলেছে শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বরে খুব ভিড় হয়, বাচ্চা ছেলেরা হারিয়ে যায় মন্দিরে। চোর ডাকাতেরা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হাত পা ভেঙে নুলো করে দিয়ে, ভিক্ষে করতে বসিয়ে দেয়। আমার মায়ের নাম আশারানি দেবী, বাত্‍স্য গোত্র। মায়ের বাবার নাম ভূপেন্দ্র নারায়ণ রায়, মায়ের মার নাম অসীমাসুন্দরী দেবী, মায়ের ঠাকুর্দার নাম মতিলাল রায়, মায়ের ঠাকুমার নাম জ্ঞানদাসুন্দরী দেবী, মায়ের জন্ম পোড়ামাতলা, নবদ্বীপে। আমার মা মাংস-ডিম কিচ্ছু খায় না। মতিলাল রায় বিখ্যাত পালাকার ছিল। নবদ্বীপে মতিলাল রায় বাঁধ আছে। আমার ছোড়দা খালি মায়ের পেছনে লাগে, ছড়া কাটে – ‘নবদ্বীপের গঙ্গাঘাটে শ্রীচৈতন্য মুরগি কাটে, ধনীরাম নাচিয়া বেড়ায় রে।’ মা তাই শুনে কানে আঙুল দেয়। আমার মা খুব ভালো, আমার মা দ্বিজেন্দ্র গীতি জানে।”
-“বাপ রে, তুইতো রামকথা বলে দিলি রে। এইবার চুপ কর, আমি পূজা করে লি।”

ঠাকুরমশাই পুজো শুরু করে, “নমঃ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রাহ্মণ হিতায় চ। জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।“
পুজো শেষ করে আমার হাতে একটা বড় হলুদ প্যাড়া ধরিয়ে দিয়ে বলে, “কান্না করবে না, মাজী জলদি চলে আসবে।”
আমি অবাক হয়ে যাই, প্যাড়া কোথা থেকে এল!

বিজয়দা মেজদার বন্ধু ছিল। এখন আমাদের বাড়ির ছেলের মতো। মা-বাবাও ওকে খুব ভালোবাসে। বিজয়দা খড়্গপুর মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে চাকরি করে। ওর হাতের লেখা খুব সুন্দর, ছোটোখাটো জিনিস ভেঙে গেলে সারিয়ে দিতে পারে, আমাদের বই-খাতায় মলাট দিয়ে নাম লিখে দেয়, আমায় বুড়োবাবু বলে ডাকে, কারণ, আমি পাকা পাকা কথা বলি, মেজদি, ছোড়দির হোম সায়েন্সের প্র্যাকটিকাল খাতায় বিজয়দা ছবি এঁকে দেয়, আমায় ক্যারম খেলা শেখায়। বাবার সমস্ত চিঠিপত্র বিজয়দা লেখে, বাবা ডিকটেশন দেয়। তবে খুব বানান ভুল হয়। তখন বাবা রেগে যায়। বাবা পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার ছিঁড়ে ফেলে দেয়। বিজয়দা আবার নতুন করে লেখে। বাবা বিজয়দাকে এ টি দেবের ডিক্সনারি থেকে রোজ এক পাতা মুখস্থ করতে বলেছে। আরও বলেছে, মিলন মন্দির লাইব্রেরি থেকে রোজ একটা করে আমার জন্য ছোটদের বই এনে দিতে। আজ দশটার সময় বিজয়দা বৌদিকে নিয়ে আসবে। বৌদি রান্না করবে, বিজয়দা আমার সাথে ক্যারম খেলবে। এখন কদিন ওরা আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আজ সকাল ছ’টার ট্রেনে মা মেজদার সাথে তারকেশ্বর গেছে। বাবার একটুও ইচ্ছে ছিল না, তবু মা’র এই ঘর-সংসার ছেড়ে কোথাও যাওয়া হয় না, তাই বাবা মত দিয়েছে।

পালাম্মা, গুরুমূর্তি আর ওদের মেয়ে পার্বতী সকাল, বিকেল বাসন মেজে দিয়ে যায়। ওরা আসে রাত ভোর থাকতে। মা অত ভোরে উঠে ওদের চা করে দেয়, আমিও উঠে যাই ঘুম থেকে। একেকদিন গুরুমূর্তি মদ খেয়ে আসে, খুব গন্ধ ছাড়ে। মা সেদিন ওকে ঘরে ঢুকতে দেয় না। ও সেদিন ঘরের বাইরে সিমেন্টের বেদিটায় বসে তেলুগু ভাষায় বিলাপ করে, আর কোনোদিন নেশা করবে না প্রতিজ্ঞা করে। ওর এই দুর্দশার জন্য যে পার্বতী আর পালাম্মাই দায়ী সেই কথা বারবার বলে। ওদের জন্যই আজ ওকে দশটা বাড়িতে কাজ করতে হয়, মণি হোটেলে জল দিতে হয়। ওর কাঁধ-পিঠ ব্যথা করে, মদ না খেলে কাজ করবে কী করে! সেইসব দিনে পালাম্মা কুয়ো থেকে জল তোলে, পার্বতী বাসন মাজে। পালাম্মা অত জল তুলতে পারে না। তাই আধ চৌবাচ্চা ভরে। বাকিটা ছোড়দা কিংবা মেজদা ঘুম থেকে উঠে ভরে। মেজদা কিছু বলে না, কিন্তু ছোড়দা গজগজ করে। বলে, “উনি দয়া দেখাবেন আর জল ভরতে হবে আমায়। বড়বাবু তো লাটসাহেব, উনি কখনও ভরতে পারেন না।” এই প্রথম উনিটা হচ্ছে মা, আর দ্বিতীয় উনিটা বড়দা। সেদিনও মা গুরুমূর্তিকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। এদিকে বৌদি মানে বিজয়দার বৌ রান্না করতে গিয়ে দেখে জল নেই। শুধু মাটির হাঁড়িতে খাওয়ার জল আছে। বৌদি বিজয়দাকে জল ভরতে বলে। আমি বলি, “না তুমি জল ভরবে না। আমি গুরুমূর্তিকে ডেকে আনছি।”

এগারোটার সময় ছোড়দি, মেজদি ইস্কুল থেকে ফেরে। মেজদির স্বভাবই হচ্ছে রাস্তা থেকে চেঁচাবে, “মা খেতে দাও শিগগির, খুব খিদে পেয়েছে।” মা রেগে গিয়ে বলে, “এবার থেকে রাস্তায় ভাতের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।”

আজ ওরা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল। জামাকাপড় ছেড়ে রান্নাঘর আর বারান্দার মধ্যিখানের খালি জায়গায় ঘুরঘুর করছে। বৌদি বলল, “মেজদি বোসো আমি জলখাবার দিচ্ছি।” বৌদি ওদের মুড়ি, বাদামভাজা বাটিতে করে দেয়। ছোড়দি বলে, “এমা আমরা এখন ফেনা ভাত ঘি দিয়ে, আলুভাজা দিয়ে খাই।” মেজদি বলে, “চুপ ক’রে মুড়ি চিবো। বৌদি অত জানবে কী করে!”

একটু পরেই বড়দা আসে এক ঠোঙা গরম জিলিপি নিয়ে। সাইকেলটাকে উঠোনে স্ট্যান্ড করিয়ে বিজয়দাকে বলল, “ছেদিলালের দোকানে গরম গরম ভাজছিল, নিয়ে এলাম ডিউটি থেকে ফেরার পথে। রাউরকেল্লা থেকে ট্রেন নিয়ে এসেছি। বেরিয়েছি সেই রাত থাকতে। টাটার কাছে আউটারে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সিগনাল ছিল না। মা, কোথায়?”
আমি গম্ভীরভাবে বলি, “মা মেজদার সঙ্গে তারকেশ্বর গেছে শিবঠাকুরের মাথায় জল দিতে।”
বড়দা হাঁ হয়ে যায়, “তার মানে? তারকেশ্বর? কোথাও কিছু নেই তারকেশ্বর? গোলবাজার দুর্গামন্দিরে শিব নেই, ওখানে জল দেওয়া যেত না? তুই যেতে দিলি মা’কে? মা জিলিপি খেতে ভালোবাসে, তাই গরম গরম জিলিপি নিয়ে এলাম …”

বড়দার মুখ দিয়ে কথা সরে না, আমি গম্ভীর হয়ে জবাব দিই, “মা, কাল রাতে আমায় অনেক বুঝিয়েছে। তারপর যেতে দিয়েছি। মা বলেছে যে শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল দিলে সবার মঙ্গল হয়। আর মা কিছু জিলিপি খেতে ভালোবাসে না। নিজে ভালোবাসে এখন মা’র ওপর দিয়ে চালাচ্ছে। মা ভালোবাসে নবদ্বীপের সরভাজা।”
– “ওরে আমি তোর থেকে প্রায় কুড়ি বছরের বড়। কী পাকা পাকা কথা!” এই কথা বলেই বড়দা আমায় দু’হাতে তুলে নিয়ে আলমারির ওপর বসিয়ে দিয়ে বলে, “তুই মাকে খুব ভালোবাসিস না?”
আমি উত্তর দিই, “তোমাদের সবার থেকে বেশি।”
ছোড়দি বলে, “দিনরাত মা’র মাথা বকায়, তিনটে বাজতে না বাজতেই মা’কে চা করার জন্য বিরক্ত করে, দুপুরে ঘুমোতে দেয় না। ঘরের মধ্যে আওয়াজ ক’রে বল খেলে, আবার মাকে ভালোবাসে! ছাই করে! বরং আমি আর ছোড়দিই মা’কে কখনও জ্বালাই না, হাতে হাতে কাজ করে দিই।”

সাড়ে এগারোটা বাজে, বাবা অফিস থেকে খুব গম্ভীর মুখে ফিরে আসে। বিজয়দার বৌ বলে, “মেসোমশাই, আপনি বসুন, আমি জল দিচ্ছি।” বাবা কোনো কথা বলে না। সাইকেল রেখে, জুতো মোজা খুলে নিজের টেবল চেয়ারে গিয়ে বসে। কারেন্ট নেই। আমি লম্বা ডাঁটের তালপাতার পাখা দিয়ে বাবাকে হাওয়া করতে থাকি। এটা মায়ের ট্রেনিং। কারেন্ট না থাকলে বাবাকে হাওয়া করতে হবে। আমি বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে হাওয়া করতে থাকি। অন্য সময় হলে, বাবা বলত, “ম্যান উইথ ফ্যান।” আজ আর কিছু বলল না। দু’ এক মিনিট পরেই বলল,”থাক আর হাওয়া করতে হবে না। হাত ব্যথা করবে।” আমি বড় বড় চোখ করে তাকাই বাবার দিকে। ঠিক সেই সময় কারেন্ট চলে আসে। বাবা বলে, “বাপিকেও একটু চা দিও।”
বৌদি বলে, “সবার জন্যেই করছি। মেজদি, ছোড়দি তোমরাও খাবে তো?”
বাবা আমায় আদর করে ‘বাপি’ বলে ডাকত কখনও কখনও। আমি বললাম, “আমি ওই গড়ের চা খাই না। আর দার্জিলিং চা মা ছাড়া আর কেউ বানাতে পারে না।”
বিজয়দা বলল, “আমি জানি মাসীমা কীভাবে করে। চা-টা আমিই করছি।

০৯-০১-২০২৪

আসমানি [তিন]
‘বেলা বয়ে যায়, ছোট্ট মোদের পানসি তরী, সঙ্গে কে কে যাবি আয়’ গানটা শুনলেই আমার মার কথা মনে পড়ে।

আমার তখন ছ’- সাত বছর বয়স, মা একদিন ওই গানটা খুব ধীর লয়ে করতে করতে গান থামিয়ে গোপন কথা বলার মতো ক’রে বলল, “দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেক বড় কবি। রবীন্দ্রনাথ জোর করে নোবেল প্রাইজটা নিয়ে নিয়েছিল। নইলে সাহেবরা ওটা দ্বিজেন্দ্রলালকেই দিত। আর এই কথাটা কাউকে বলবি না।”
– “বাবাকেও না?”
-“না, কাউকে না। বাবা জানতে পারলে খুব রাগারাগি করবে।”
– “কেন এটা কি কোনো খারাপ কথা?”
– ” না, বিশ্বাসের কথা।”
– “তুমি বাবাকে এত ভয় করো কেন?”
– “তোর বাবা যে খুব রাগী।”
– “কিচ্ছু রাগী না। আমি তো ভয় পাই না।”
– “তুই তো ছোট, ভয় কী তাই বুঝিস না। বড় হ, তখন বুঝবি কত লোককে ভয় পেতে হয়, এমনকী নিজের পেটের ছেলেমেয়েকেও ভয় পেতে হয়।”
-“তাই বড়দাকে ভয় পাও তুমি? আমি বড় হয়ে গেলে আমাকেও ভয় পাবে?”
– “তোকে ভয় পাওয়ার সময় আমি আর থাকব না।”
– “কোথায় যাবে?”
– “তখন তারা হয়ে যাব আকাশে।”
– “মানে মরে যাবে? সেদিন তো বললে মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায়। আকাশের তারা হওয়ার থেকে আমার মা হয়ে থাকা অনেক বেশি ভালো। আমি তোমার সব কথা শুনব, রোজ হাতের লেখা করব, এক থেকে পঁচিশ ঘরের নামতা মুখস্থ করব, আমি বড় হয়ে একটা ঘর বানাব কৌশল্যায়, সেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকব, আর কাউকে নেব না, বাবাকেও না, তোমায় একটা স্টীলের ফ্রেমের চশমা কিনে দেব, ওই অশোক চৌধুরীর মা যেমন পরে, তোমায় উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাব মিলনী-অরোরা-শীতলা যেখানে হবে, রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার জন্যে খোয়ার লাড্ডু, বাদামভাজা কিনে আনব, রোজ দুপুরে তোমায় রামায়ণ পড়ে শোনাব, তোমার ওই রামায়ণের বর্ণপরিচয়টা পুরো মুখস্থ করব, যেটায় লেখা আছে —
অ – অকালে করেন রাম বোধন দেবীর,
আ – আকাশ পথেতে ফুল আনে হনুবীর, ই – ইন্দুমতী নাম তার অজের ঘরণী, ঈ – ঈষৎ লাগিল ফুল মরিল তখনই।

আমাদের ঘরে একটা ছেঁড়া বই ছিল, ‘রামায়ণে বর্ণপরিচয়’ বা ওই ধরনের কোনো নাম। সেই বইটা আমার মা বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের সময় নিয়ে এসেছিল। ছোটবেলায় হাতেখড়িরও আগে মুখে মুখে শেখাত আমায় মা —
উ – উইয়ের ঢিপিতে ঢাকা মুনি রত্নাকর
ঊ – ঊর্মিলা জনককন্যা লক্ষ্মণ তার বর …

এরপর আর মনে নেই। তখন অবশ্য মুখস্থ ছিল। মাকে খুশি করতে আমি মুখস্থ করেছিলাম ওই বই, আমার অন্য ভাইবোনেরা আর কেউ করেনি। আমি তো কোলপোঁছা, খুব ন্যাওটা ছিলাম মায়ের। মা’কে কেউ কিছু বললে আমার খুব রাগ হয়ে যেত।

একদিন ঘরে কেউ নেই, শুধু আমি আর মা। শীতের বেলা, বারান্দার রোদ্দুরে মা শীতের চাদর রোদে দিতে দিতে গেয়ে উঠেছে, “সন্ধ্যার মেঘে করিব দুকূল,/ ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার /তারায় করিবো কর্ণের দুল / জড়াবো গায়েতে অন্ধকার,” বাবা সাইকেল করে অফিস থেকে ঘরে এসেছে দুপুরের খাবার খেতে। সাইকেলের আওয়াজ পেতেই মা গান বন্ধ করে দিয়েছে। আমি বললাম, “বন্ধ করলে কেন, গাও না ‘কর্ণের দুল’।”
বাবা বলল, “তোর মা আবার গান গায় নাকি?”
– ” হ্যাঁ খুব ভালো গায় দ্বিজেন্দ্রগীতি।”
– “দ্বিজেন্দ্রগীতি আবার গান! খালি ‘আজি এসেছি, আজি এসেছি’ করে।”
মা’র মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, আমায় বলে, “তুই চুপ কর।”

আমার নরম-সরম মা, কাউকে ঝাঁঝিয়ে কথা বলতে পারে না। কারুর ওপর রাগ দেখাতে পারে না, কেউ অপমান করলে একলাই কাঁদে। মাকে কাঁদতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। মা একদিন বড়দাকে বলল, “টুলের ওপর উঠে বড় ঘরের ফ্যানটা একটু পরিষ্কার করে দাও না, আমার তো হাত যায় না অত উঁচুতে।”
বড়দা তখন খুব গম্ভীরভাবে মাকে বলল, “এসব কাজ আমাকে কখনও বলবে না।”
মার মুখটা কেমন কাঁচুমাচু হয়ে গেল।

বড়দা তখন লায়েক হয়ে গেছে, রেলে চাকরি করে, কোণের ঘরে জানলার সামনে বসে সিগারেট খায়। মা সামনে এসে গেলেও লুকোবার চেষ্টা করে না। সেই বড়দা আমায় এক টাকার নোট দিয়ে বলল, “হরিয়ার দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে আয় তো, বাকি পয়সায় চকলেট কিনে নিস।”
আমিও বড়দার ভঙ্গি নকল করে আঙুল নেড়ে বললাম, “এসব কাজ আমাকে কখনও বলবে না।”
বড়দা আমায় এক চড় মেরে মাকে ডেকে বলল, “দেখো তোমার আস্কারায় কীরকম বড়দের মুখে মুখে কথা বলছে।”
বড়দা কী বলেছে মা কিছুই জানে না, তবু আমায় বলল, “ছিঃ! বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে নেই।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “তুমিও তো বড়, তবে তোমায় কেন সেদিন ওরকম বলল ফ্যান পরিষ্কার করার কথায়? আজ বাবা আসুক, না মার খাইয়েছি, সব বলে দেব, কোণের ঘরে বসে সিগারেট খাওয়া বেরিয়ে যাবে।”

আমার ওই কথা শুনে বড়দার তো হয়ে গেছে, আমায় আদর করে বলল, “তোকে জিলিপি খাওয়াব, বাবাকে যেন কিছু বলিস না।” তারপর নিজেই টুল টেনে এনে ছেঁড়া গেঞ্জি দিয়ে বড় ঘরের সিলিং ফ্যান পরিষ্কার করতে লাগল। আর তখন মা’র মুখটা দেখার মতো! আহ্লাদে গদগদ, মাটিতে পড়ে না পদ। এই প্রবাদটাও মার কাছে শুনেছিলাম, কিন্তু পরে কোথাও পড়িনি বা শুনিনি।

এরকম আরও অনেক প্রবাদ বলত মা। গরমকালে দুপুরবেলা আমাদের খাওয়া দাওয়া সারতে বেশ দেরি হত। দু’টো-আড়াইটে বেজে যেত। সবকিছু সেরে মা কোনো বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত। মা গরমকালে মেঝেতে মাদুর পেতে শুত। আমিও মায়ের পাশে শুয়ে মায়ের পাকা চুল বেছে দিতাম। পাঁচটা পাকা চুল তুললে পাঁচ পয়সা, দশটা তুললে দশ পয়সা পাওয়া যেত। মা বলত, “যা খাটে গিয়ে শো, আমার গায়ের ওপর পড়বি না।” আমি তবু কোল ঘেঁষে শুতাম। মা বলত, কবে যে তুই আমায় রামায়ণ পড়ে শোনাতে পারবি। অত ভারী বই আমি শুয়ে শুয়ে আর পড়তে পারি না।”
– “তুমি রোজ রামায়ণ পড় কেন?”
– “ওই ছন্দ খুব ভালো লাগে। কানে কেমন গুনগুন করে। খুব তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে যায়।”

মা পড়তে থাকে, “চ্যবন মুনির পুত্র নাম রত্নাকর / দস্যুবৃত্তি করে সেই বনের ভিতর …।” মা ঘুমিয়ে পড়ে, এদিকে আমার ঘুম আসে না। কিছুক্ষণ উসখুস করার পর মা’কে বলি, “চা করো না বিকেল হয়ে গেছে।” মা জড়ানো গলায় বলত, “সাড়ে তিনটে বাজেনি এখনও, ঘুমোতে দে একটু।”
– “ওইতো একটা ঘন্টা পড়ল, বেজে গেছে সাড়ে তিনটে।”
-“চারটের সময় করব।”

মা খালি কথা ঘোরাতে চাইত, বলত, “ষোলোর ঘরের নামতা মুখস্ত কর্। সন্ধেবেলায় না পারলে বাবা মারবে, তখন কিন্তু আমি বাঁচাতে পারব না।”
“আমার মুখস্থ ষোলোর ঘরের নামতা, ষোলো নয়ে একশো চুয়াল্লিশ, ষোলো দশে একশো ষাট। নাও এবার চা করো। বিকেল হয়ে গেছে, আর কবে খেলতে যাব?”
মা বলত, “হাতের লেখা কর্।”
আমি বলতাম, “হয়ে গেছে, চা করো। আমি খেলতে যাব।”

বাবা নিয়ম করে দিয়েছিল বিকেল না হলে খেলতে যাওয়া যাবে না। তাই আমি চায়ের জন্য জিদ করতাম। চা হওয়া মানে বিকেল হয়ে যাওয়া। মা গজগজ করতে করতে উঠত, “একথা সেকথা দে বুড়ি দোক্তা পাতা। ভবী ভোলার নয়। তোর বয়সে আমি কোনোদিন চা খাইনি।”
মা পেতলের প্রাইমাস স্টোভে চা করত বিকেলবেলায়। সেই স্টোভে পাম্প দিতে হত, নীচের ট্যাঙ্কে থাকত কেরোসিন তেল, পাম্প দিলে বার্নারের একটা সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে তেল বেরোত। তখন সেখানে দেশলাই কাঠি ধরলে, খুব সুন্দর নীল শিখার আগুন জ্বলে উঠত, সোঁ সোঁ করে কেমন একটা আওয়াজ হত। যদি পাম্প দেওয়ার পরেও, ওই ছিদ্র দিয়ে তেল না উঠে আসে তবে পিন দিয়ে খোঁচাতে হত। তার মানে ফুটোটা ময়লা পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। একটা সরু পাঁচ- ছয় ইঞ্চি লম্বা পাতলা টিনের পাতের আগায় সমকোণে খুব সরু একটা তার আঁটা থাকত, সেটাই পিন। আমার মায়ের চা করা দেখতেই খুব ভালো লাগত। প্রথমে একটা ন্যাকড়া দিয়ে মা স্টোভটাকে ভালো করে মুছত, তারপর হাত ধুয়ে সসপ্যানে দু’ কাপ মেপে জল চাপাত, জল ফুটে গেলে তাতে দু’চামচ চা দিয়ে একটা পাতলা স্টীলের প্লেট দিয়ে ঢেকে দিত। ঠিক তিন মিনিট পরে সেই ঢাকা খুলে তাতে এক চামচেরও কম দুধ পাউডার দিয়ে গুলে দিত। তারপর খুব সামান্য চিনি দিয়ে একটা পাতলা চামচ দিয়ে নেড়ে দিত। মা বলত, “এই চা খুব শৌখিন, ভারী বড় চামচ দিয়ে নাড়লে চা নষ্ট হয়ে যায়। এই চায়ে কখনও দুধও দিতে নেই। গরুর দুধের গন্ধ চা পাতার আসল সুগন্ধকে নষ্ট করে দেয়। অল্প দুধ পাউডার দিতে হয়। এটা সুবোধের দার্জিলিং চা।” আমি জিজ্ঞেস করতাম, “সুবোধ কে?”
মা বলত, “কলকাতার বিখ্যাত চায়ের দোকান। তোর বাবা প্রতিমাসে আমার জন্যে এই চা পাতা এক ডেলি প্যাসেঞ্জারকে দিয়ে আনায়। নিজেরা তো খোট্টা চা খায়।”
– “খোট্টা চা মানে কী?”
– ” ওই গড়ের চা। যেটা তোর বাবা খায়। চিনি, দুধ, জল একসঙ্গে দিয়ে ফুটিয়ে, তাতেই গুঁড়ো চা দিয়ে আবার ফুটিয়ে ছেঁকে যে চা বানাই আমি সবার জন্যে সেটা হল খোট্টা চা।”
– “তুমি বাবাকে খোট্টা বলো কেন?”
– “ওই তোর বাবা তো একটু হিন্দি ঘেঁষা, রহন-সহন, খান-পান, কথা-বার্তা সবই একটু বিহারী ধরনের তাই খোট্টা বলি আড়ালে আবডালে। তা তুই জানলি কী করে?”
আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলি, “আমি সব জানি।”

মা’র সেই স্পেশাল চা খেয়ে আমার একটুও ভালো লাগত না। তবু খুশি করার জন্য বলতাম, “খুব ভালো হয়েছে।” কিন্তু একটু পরেই বায়না ধরতাম, “আমার ওই ফিকে চা একদম ভালো লাগেনি। আমি খোট্টা চা খাব। নইলে সদর দরজার খিল খুলে দাও, আমি খেলতে যাব।”
মা বলত, “পালাম্মারা আসুক বাসন মাজতে, তখন বানাব আবার চা। আমায় একটু রেহাই দে। তোদের সংসারে আমি আর খাটতে পারছি না।” মায়ের মুখ কান্না কান্না হয়ে যেত। সেই দেখে আমি চুপ করে যেতাম। আর কোনো বায়না করতাম না। হঠাত্‍ কোথাও কিছু নেই মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নিতাম। মা বলত, “থাক, আর প্রণাম করতে হবে না। অতি ভক্তি … ”
মায়ের কথা শেষ করতে দিতাম না, আমি বলে উঠতাম, “চোরের লক্ষণ।”

এরকম প্রায় রোজই চলত, আর তার কিছুক্ষণ পরেই পালাম্মা আর গুরুমূর্তি চলে আসত। পালাম্মা, ওর মেয়ে পার্বতী বাসন মাজত, আর গুরুমূর্তি দুই চৌবাচ্চা জল ভরত। মা ওদের চা করে দিত, সঙ্গে লেড়ো বিস্কুট। আমিও সেই লেড়ো বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খেতাম। জিজ্ঞেস করতাম, “এগুলোকে লেড়ো বিস্কূট বলে কেন?”
– “ওই সস্তার বিস্কুট বলে। গরিবেরা খায়।”
– “আমরা কি গরিব?”
– “না।”
– “তবে আমরা বড়লোক?”
– ” না, তাও না। আমরা মধ্যবিত্ত। গরিব আর বড়লোকের মাঝামাঝি।”
– “ওই বাবা যাদের ‘ধোবী কা কুত্তা’ বলে, না ঘরকা না ঘাটকা।”
– ” আবার অসভ্য কথা।”
– ” বাবা বলে যে?”
– “বাবা বলুক তুমি বলবে না। বড়দের মুখে যা শোভা পায়, তোমার মুখে তা পায় না।”
-” তাহলে এটা বলব – ‘সর্দার কা শর বড়া, গাঁওয়ার কা টাং বড়া’ ?
– “না।”
-” এটাও বলব না তাহলে – ‘উড়িয়া কপোটি, তেলুগু চোর, মার মারাঠা হারামখোর’?”
– “না।”
-” এটা, ‘লকীর কে ফকির’?”
– ” না।”
-” এটা, ‘বুড়ী ঘোড়ি মেঁ লাল লাগাম’?”
– “না।”
আসলে মা দেখতে চাইত আমার জ্ঞানের বহর কতটা। বেশ কয়েকটা বলার পর বলত, “তুমি কোনো হিন্দি কথা বলবে না। বড় হয়েও কখনও হিন্দি গালাগালি দেবে না। ওই যে শ-কার, ব-কার, ম-কার দেওয়া গালাগালি হিন্দুস্তানি ছেলেরা দেয়, সেগুলো কখনও মুখেও উচ্চারণ করবে না। কখনও হিন্দি গান শুনবে না, হিন্দি সিনেমা দেখবে না।”
-“লাল ঝান্ডা করে পুকার, ইনক্লাব জিন্দাবাদ – বলব? চৌবেদা সেদিন শিখিয়েছে আমাকে আর টুটুলকে।”
– “না বলবে না। ওই পার্টি অফিসে কখনও যাবে না। ওখানে সব বাজে লোকেরা আসে।”
-” চৌবেদা বাজে লোক? তাহলে বাবা সেদিন তোমায় চৌবেদার জন্য চা করতে বলল কেন?”
– “চৌবেদা বাজে লোক নয়, ওদের পার্টিটা বাজে।”
– “ওদের পার্টিটা বাজে কেন?”
– ” কেননা ওদের পার্টিটা নেতাজীকে তোজোর কুকুর বলেছিল, ক্যুইসলিং বলেছিল।”
– “তোজো কে? ক্যুইসলিং মানে কী?”
– ” খুব খারাপ কিছু হবে। বাবাকে জিজ্ঞেস কোরো। আর মাথা বকিও না আমার। আমি তোমার অত খতেনের জবাব দিতে পারি না। যাও খেলতে যাও, সন্ধের আগে ঘরে ফিরবে।”

 

(ক্রমশ)
© গণেশ ঢোল
১০-০১-২০২৪

Sahityika Admin

Add comment