সাহিত্যিকা

সৃষ্টির বিড়ম্বনা

সৃষ্টির বিড়ম্বনা
@সৌরীশ সরকার, ১৯৯৫ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

~ ১ ~
রবি বাবু বজরা করে চলেছেন শিলাইদহর ওদিকে। অনেকদিন হয়ে গেলো এরকম জলে জলে ঘুরে। বেশ বোরিং, কিন্তু লেখাটেখার জন্য ফার্স্ট ক্লাস জায়গা – তাই নিয়ে কোনো কথা হবে না। এমনিতেই ঊনবিংশ শতকে একটু বড়োলোকের ঘরে ব্যাটাছেলে হয়ে জন্মালে কাজকম্মো বিশেষ করতে হয় না। তায় আবার এরকম ফাঁকা মাঠ। নৌকোয় চারটি মাঝি আর কর্মচারী – তারা মোটেও বিরক্ত করে না। আর মাঝে মাঝে গ্রামে নৌকো ভিড়িয়ে একটু গপ্পো সপ্পো মানুষজনের সাথে – সৃষ্টির কাঁচামালের কোনো অভাব নেই।

মনে তাও সুখ নেই রবিদার। এই বিউটিফুল ভোরবেলা, মৃদুমন্দ বসন্তের হাওয়া, খুচখাচ পাখির কলতান আর অল্প ঢেউয়ের ওপর রোদের ঝিকিমিকির মাঝে রবীন্দ্রনাথ লেখার খাতাটা কোল থেকে নামিয়ে রেখে একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফুড়ুৎ করে সেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে নাকের ফুটো দিয়ে সাদা জিন বেরিয়ে এলো। একটু আবছা স্বচ্ছ মতো চেহারা, সাধারণ মানুষের তুলনায় ঢ্যাঙ্গাও বটে – কিন্তু সেরকম ভয় পাবার মতো কিছু না। রবিবাবু পেলেনও না ভয়। আস্তে করে বললেন, ‘আমার মাথার মধ্যে কি করছিলে হে?’

সাদা জিন বিরাট গদগদ খোদ রবীন্দ্রনাথকে সামনে পেয়ে। ‘স্যার, বিরাট ফ্যান আপনার। এতো কিছু তো অলরেডি নামিয়েছেন, আপনার মাথার মধ্যে দেখে এলাম আরো হাজার দশেক কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস টুপন্যাস গজগজ করছে ! ওগুলোও খাতায় কলমে নামিয়ে ফেললে নোবেল আটকায় কে আপনার? এরকম ট্যালেন্ট বাংলায় আগে কেউ দেখেনি স্যার। সুকুমারের ছেলেটাকে বাদ দিলে পরেও দেখবে কিনা সন্দেহ। প্রণাম নিন।’

রবীন্দ্রনাথ ফোঁস করে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবার ফুস করে বেরিয়ে এলো কালো জিন। গায়ে লেগে থাকা সর্দি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, ‘এতো ফোঁস ফোঁস করছেন কেন দাদা ? প্রব্লেমটা কি?’
উদাস গলায় রবীন্দ্রনাথ বললেন , ‘লিখছি তো দিস্তে দিস্তে। পড়ছে কে? সেই কবে কোন ম্যাগাজিনে ছাপাবে তার জন্য বসে থাকা। পাঠকের ইনস্ট্যান্ট ফিডব্যাক ছাড়া কি লেখক হয়?’
‘ওহ এই ব্যাপার?’ সাদা জিন গা ঝাড়া দিয়ে বলে। ‘এ আর কি আছে, এক্ষুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনাকে ৪-৫ বছর পরে নিয়ে গিয়ে ফেলছি – যখন আপনার বৌ আপনার সাথেই বজরায় ঘুরবেন। চব্বিশ ঘন্টা ফিডব্যাক সাইকেল। কতো ইনস্ট্যান্ট ফিডব্যাক চাই আপনার!’

~ ২ ~
পাঁচ বছর পর গ্রীষ্মকাল। সেই সেম বজরা। জম্পেশ কয়েক পিস কবিতা নামিয়ে বৌকে মোলায়েম করে ডাকছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘ওগো শুনছো, একটু পড়ে দেখো না কেমন লিখলাম?’
মৃণালিনী দেবী কেবিনের ভেতর মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে। স্বামীর সৃষ্টির খুশখবর শুনে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। কপালে জলপটি। দিনের পর দিন ডেকে বসে চড়া রোদ লেগে মাথা ধরেছে। তার ওপর স্বামীর ক্রমবর্ধমান রচনাবলীর তলায় নিজের শখ আহ্লাদ ক্রমাগত চাপা পড়তে দেখে মেজাজ তুঙ্গে। একে তো এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে এসে নৌকোতে কাটাতে হচ্ছে দিনের পর দিন। শপিংয়ের সুযোগ নেই, সইদের দেখা নেই, খাওয়া দাওয়াও বিশেষ ভালো না – শুধু সকাল বিকেল গল্প আর কবিতা। তাও ঠিক ছিলো,ইদানিং উনি আবার উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন – যেগুলো একেবারেই পাতে দেয়া যায় না। ‘মরণ’ বলাটা একটু সেকেলে হয়ে গেছে ব্রাহ্ম সমাজে, কাজেই যুৎসই কোনো জবাবও দিতে পারছেন না স্বামীকে।
স্বামী খাতা হাতে কেবিনের দরজা থেকে নড়ছেন না দেখে অবশেষে বললেন, ‘আমাকে এখন রুটি করতে হবে, সময় নেই, রেখে দাও, পরে পড়বো।’

রবীন্দ্রনাথের চোখ ছলছল। দেখে বড়োই কষ্ট হলো সাদা জিনের। পালের ওপর বসে পুরো ব্যাপারটা নজর করছিলো এতক্ষণ, এবার বললো, ‘স্যার দু:খ করবেন না। কাজের অছিলায় স্বামী/স্ত্রীর নতুন লেখা না পড়ে কাটিয়ে দেয়া যুগ যুগ ধরে অব্যাহত থাকবে। আপনি একা না।’
‘আগেও ছিলো।’ হালের ওপর থেকে বললো কালো জিন। ‘বঙ্কিম শরতের একটা লেখাও ওনাদের বৌরা পড়েননি। আর শুধু বৌদের দোষ দেব কেন। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা পড়তে হবে সেই ভয়ে ওনার স্বামীই জুটলো না সারা জীবন। সব প্রসপেক্টিভ ছেলে ভেগে গেলো দু কলি শুনেই।’

রবীন্দ্রনাথের মন তাও খারাপ। বললেন, ‘আমার এই অ্যাহেড অফ মাই টাইম জন্মানোটাই কাল হয়েছে হে! টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতে জন্মালে এরকম প্রব্লেমটা হতো না।’
কালো জিন তাই শুনে থাকতে না পেরে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসতে শুরু করলো। ‘দাদা, কে যেন লিখেছিলেন না, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস /ওপারেতে সর্বসুখ ইত্যাদি ইত্যাদি? চলুন আপনাকে ২০২৪ এ ঢুকিয়ে দিচ্ছি। দেখে নিন কতো ধানে কতো চাল।’

~ ৩ ~
‘এই যে, তোমাকে বলছি, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি – ওই যে স্ক্রল করে বেরিয়ে যাচ্ছিলে, দেখতে পাইনি ভেবেছো?’ রবীন্দ্রনাথের মাথা অসম্ভব গরম, যত্ন করে আঁচড়ানো দাড়ি উস্কো খুস্কো, রাগের চোটে ফর্সা মুখ লাল। ‘কত হ্যাঙ্গামা করে এই লেখাগুলো নামাতে হয় লেখকদের, ভেবে দেখেছো কি ওরকম হুড়ুমতাল স্পীডে স্ক্রল করে বেরিয়ে যাবার আগে? এই লেখককে পার্সোনালি চিনলে চলে যেতে পারতে এরকম?’

লোকাল ট্রেনে কোনোরকমে বসতে পেয়ে নিশ্চিন্তে একটু ফোনটা বার করে স্ক্রল-রত অল্পবয়সী ছেলেটির ঘাড়ের ওপর দিয়ে স্ক্রিনে কড়া নজর রাখছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সৃষ্টির এই হেলাফেলা দেখে আর না থাকতে পেরে শেষে বোমার মতো ফেটে পড়েছেন।
‘লেখক হবার যন্ত্রণা জানো ছোকরা? একবার ভেতরে লেখা এসে গেলে তাকে না নামিয়ে নিস্তার নেই – বড়ো বাথরুমের মতো – চেপে রাখা যায় হয়তো খানিকক্ষণ, কিন্তু খালি উশখুশ।’
ব্যোমকে যাওয়া ছেলেটিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালিয়ে গেলেন,
‘আবার ভয় ভয়ও করে সব সময় – আহা এরকম একটা কালজয়ী আইডিয়া এলো, যদি জাপ্টে ধরে খাতায় ভরে না ফেলি, বাজে মিস! সেই স্টিভ ওয়ার ক্যাচ কে যেন ফেলে দিয়েছিলো ওয়ার্ল্ড কাপে – স্টিভ গিয়ে তাকে বলেছিলো কাপটাই ফেলে দিলে হে – সেই রকম।’
‘ঠিক বলেছেন দাদু’। ছেলেটি অবশেষে মুখ খোলে, ‘আমিও লিখি টিখি তো, তাই ভাবি ঠিক সময়ে ধরতে পারিনি বলে – মানে হয়তো প্রেম করছি, ফোনটা বার করে ভরে ফেলা একেবারে অসম্ভব – হয়তো পড়ে গেলো আমার রবীন্দ্র পুরস্কার?’

প্রেম করাকে লেখার আগে রাখাটা রবীন্দ্রনাথের বিশেষ পছন্দ হলো না। ‘প্রাইওরিটির কথাই যখন এলো, তাহলে বলি, কতো আইডিয়া এসে হত্যে দিয়ে বসে থাকে। যখন প্রথম এসেছিলো তখন ভেবেছিলাম আহা শরতের শ্রীকান্তর পর এরকম আইডিয়া আর আসেনি – এক হপ্তার মধ্যে দেখি হাওয়া বদলে গেছে, পৃথিবী আর সোশ্যাল মিডিয়া অন্য দিকে চলে গেছে – আর লিখে লাভ নেই। ১৯০০ সালে ভাই এই চ্যালেঞ্জ ছিলো না।’

ছেলেটিকে মুখ খুলতে না দিয়ে রবিবাবু চালিয়ে গেলেন, ‘আজকাল আর এক আপদ হলো বেমক্কা সমালোচনা। এই তো সেদিন দেখি ফেসবুকে একজন খুব ডার্ক একটা লিখেছেন – নোয়ার টাইপের – অমনি তার তলায় একজন কমেন্ট করেছেন কি করে যে এসব লেখে কে জানে, লেখকের নিশ্চয় চরিত্র খুব খারাপ! রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম – আমাদের নিহার, শরদিন্দুরা কি কম খুন করিয়েছে? সেগুলো পড়লে তাহলে ইনি কি বলবেন?’
বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথ দেখা গেলো মনস্থির করে ফেলেছেন এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। হাঁক দিলেন, ‘সাদা জিন। কালো জিন। কে আছিস বাবা। আমাকে আবার ফেরত নিয়ে চল, ১৯১১ নাগাদ। ওটাই ভালো সময়।’

অনেক বার ডেকেও কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। আতঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ অবশেষে বুঝলেন দুই জিন তাঁকে ২০২৪ এ ফেলে পালিয়েছে। এই তেত্রিশ কোটি লেখক আর পাঁচটি পাঠকের যুগেই লেখালেখি করে তাঁকে নাম করতে হবে। যা কিনা শিবের অসাধ্য। পারবেন কি রবীন্দ্রনাথ?

Sahityika Admin

1 comment

  • সূচিপত্র সাহিত্যিকা ৩৫তম সংখ্যা (মে ২০২৪) – সাহিত্যিকা says:

    […] ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সৃষ্টির বিড়ম্বনা @সৌরীশ সরকার, ১৯৯৫ সিভিল […]