সাহিত্যিকা

গুপী গাইন বাঘা বাইন গল্পটির চলচ্চিত্রায়নের গল্প

গুপী গাইন বাঘা বাইন গল্পটির চলচ্চিত্রায়নের গল্প
অজয় দেবনাথ, ১৯৭০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১২ মে ১৮৬৩ – ২০ ডিসেম্বর ১৯১৫) ছিলেন বিখ্যাত বাঙালী শিশু সাহিত্যিক, ও বাংলা ছাপাখানা প্রবর্তনের অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন তাঁর উত্তরপুরুষদের মতোই বহুবিধ বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী যেমন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। সন্দেশ পত্রিকার প্রকাশ তিনিই প্রথম শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সেই গুরু দায়িত্ব বহন করেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর তার কর্মব্যস্ত জীবনে অনেক সাহিত্য সৃষ্টিও করেছেন, যেমন গুপী-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই, ছোটদের মহাভারত, ইত্যাদি তাঁরই অমর সৃষ্টি।

পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রচিত গুপী গাইন বাঘা বাইন গল্পটি সত্যজিৎ বেছে নিয়েছিলেন একই নামের এই ছায়াছবিটি তৈরী করতে। ছবিটি তৈরি নিয়ে চিন্তাভাবনা ছিলো অনেক আগে থেকেই। বিজয়া রায়ের স্মৃতিচারণা ‘আমাদের কথা’ থেকে জানা যায় যে পুত্র সন্দীপ রায়ের অনুরোধে সত্যজিৎ এই ছায়াছবিটি তৈরী করেন। ১৯৬৭ সালেই সত্যজিৎ রায় এই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। ছবিটি তৈরীর ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি যেহেতু অনেক আগে থেকেই ছিল, তাই ছবিটি নিয়ে সত্যজিতের প্রত্যাশাও ছিলো অনেক বেশি। তিনি চেয়েছিলেন গুপী গাইন বাঘা বাইন একটি সাদাকালো ছবি না হয়ে রঙিন ছবি হোক। ফলে ছবি তৈরির আনুমানিক প্রারম্ভিক খরচ দাঁড়িয়েছিল পর্বত প্রমান। ইতিমধ্যে সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন কান-বার্লিনের মতো প্রতিষ্ঠিত ও সেরা চলচিত্র উৎসবগুলির সেরার সম্মান। তবুও কোনো প্রযোজক সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন করতে রাজি ছিলেন না। তার অন্যতম প্রধান কারন তারা মনে করতেন শিশুদের জন্য তৈরী ছবি তেমন ব্যবসায়িক সাফল্য পাবে না। বিশাল খরচের আশঙ্কায় তাঁরা এই প্রচেষ্টার প্রতি বিমুখ হয়েই ছিলেন।

এই বাস্তবটি উপলব্ধি করে সত্যজিৎ অনেকটাই নিরাশ হন এবং ছবিটি না করার সিন্ধান্তও নিয়ে ফেলেন। কিন্তু ভাল সৃষ্টির পথে কোন বাধাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনা; সেই সময়ে এগিয়ে আসেন পূর্ণিমা পিকচার্সের কর্নধার নেপাল দত্ত ও অসীম দত্ত। অবশেষে বহু বাধা পেরিয়ে পূর্ণিমা ফিল্মের প্রযোজনায় আনুমানিক ছয় লক্ষ টাকায় রঙিন নয় সাদাকালো ছবি হিসাবেই নির্মিত হয় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমা; আর এর পরেরটা ইতিহাস..। ছবিটি মুক্তি পায় ৮ঐ মে ১৯৬৯ সালে এবং পরিগণিত হয় সত্যজিৎ রায়ের সবথকে বাণিজ্যিক সফল ছায়াছবি হিসাবে। এই ছবিতে গুপী গাইনের ভূমিকায় ছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায় এবং বাঘা বাইনের চরিত্রে রবি ঘোষ। শেষ দৃশ্যটিও রঙিন হয়ে দর্শকদের প্রভূত আনন্দ বর্ধন করে।

টানা ৫১ সপ্তাহ ধরে সিনেমাটি বিভিন্ন হলে চলেছিল, যা তৎকালীন বাংলা সিনেমার একটি বড় রেকর্ড। সিনেমাটির এতো সফলতার কারন হিসেবে বলা হয় মূলত ছোটদের জন্য নির্মিত হলেও গুপী গাইন বাঘা বাইন ছিলো সব বয়সী দর্শকেরই উপভোগ্য। কিন্তু এই গুপী গাইন বাঘা বাইন কেবল মাত্র রূপকথার কাল্পনিক গল্প নয়। ছোটদের উদ্দেশ্যে তৈরি এবং হাস্যরসে ভরা হলেও এই সিনেমাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের নানান রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক ও অন্যান্য ইতিহাস।

এই ছবির নানান দৃষ্টিকোন আলোচনায় প্রথমে মজার দিকটা দেখা যেতে পারে। প্রায় ছয় সাড়ে ছয় মিনিট ধরে চলা চার রকম ভূতের দলের নাচ যা আমাদের বাঙালীদের মধ্যে ভূতের যে চিরাচরিত ধারনা ছিল সেটি বীভৎস রস বা আতংক থেকে হাস্যরসে পর্যবসিত হয়। এখানে ভূতের রাজা আমাদের কাছে ভয়াল মূর্তির আড়ালে এক আশ্চর্য বরাভয় যা অসম্ভবকে সম্ভব করে। ‘ভুতের রাজা দিল বর – জবর জবর তিন বর’ কথাটি এখন প্রায় প্রবাদবাক্য পরিণত হয়েছে। এই দৃশ্যে ভূতের রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রসাদ মুখার্জী এবং ভূতের রাজার কন্ঠে স্বর মিলিয়েছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।

নাচের দৃশ্যে ভূতের অস্বাভাবিক আকৃতি ও প্রকৃতি বোঝানোর জন্য ফিল্মের নেগেটিভকে কম্পনের মাধ্যমে ব্যবহার করা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ ষাটের দশকে ভারতের প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না, তাই এটি নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ কাজ। নাচের দৃশ্যের কোরিওগ্রাফি করেছিলেন শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য, আর্ট ডিরেকশনে ছিলেন কিংবদন্তী বংশী চন্দ্র গুপ্ত।

গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমাটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েও অনেকে বিশ্লেষণ করেন। সেই সময় বা কিছুদিন আগেই অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে পাকিস্থান যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের বিরুদ্ধে যা হাল্লার সুন্ডির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণাকে সূচিত করে। যদি সেই সময়ের (অবশ্য এখন ও সমান ভাবেই প্রযোজ্য)পাকিস্থানের অর্থনীতির দিকে তাকানো যায় তাহলে লক্ষ্য করা যায় যে সময়ে পাকিস্থানের মানুষ অর্থাভাবে একদিকে খাদ্য পাচ্ছে না, অথচ অন্যদিকে পাকিস্থানী সরকার মিত্র দেশগুলির থেকে একের পর এক যুদ্ধ অস্ত্র কিনেছে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।

অপরদিকে সুন্ডি মনে করিয়ে দেয় ভারতবর্ষকে যেখানে মানুষ মোটামুটি শান্তিতে আছে; যথেষ্ট খাদ্যশস্য দেশে মজুত আছে। কিন্তু এখানে কথা বলার ক্ষমতা আছে শুধু রাজারই। প্রজারা থাকলেও তাদের কথা বলার কোন অধিকার ছিল না বা তাদের কোনো সুযোগ ও দেওয়া হত না। দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধের ভয়ঙ্কর সর্বনাশী আবহকে রূপকের আড়ালে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন যা দর্শককে চুম্বকের মতই আকর্ষণ করেছিল।

গুপী গাইন বাঘা বাইন একটি আদ্যন্ত মিউজিক্যাল সিনেমাও বটে; এখানে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের কথা ও সুরে দশটি অনবদ্য গান। যার মধ্যে ভুতের রাজা দিল বর গানটায় কন্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা তপেন চট্টোপধ্যায় এবং রবি ঘোষ স্বয়ং। তপেন চট্টোপধ্যায়ের কন্ঠে বাকি গানগুলি গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল। এবং রবি ঘোষের কন্ঠে স্বয়ং রবি ঘোষ। গায়ক রবি ঘোষকে এই সিনেমাতে আমরা পেয়েছি অভিনেতা রবি ঘোষকে।

ছায়াছবিটি মুক্তির পর শুধু ছোটদেরই নয় বরং বড়দেরও অসম্ভব পছন্দ হয়েছিলো। এবং সাথে অর্জন করেছিলো অসংখ্য পুরষ্কার। গুপী গাইন ও বাঘা বাইন শুধুমাত্র একটি ছায়াছবি নয় এটা আপামর বাঙালীদের কাছে একটা নস্টালজিয়া। মানুষের মনে আজীবন গুপী, বাঘা অমর হয়ে থাকবে..

স্কেচ – অজয় দেবনাথ 

 

 

Sahityika Admin

Add comment