সাহিত্যিকা

বাংলা নববর্ষ

বাংলা নববর্ষ
দেবপ্রসাদ দে, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
নববর্ষ আমাদের দুই বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে জাগায় নতুন আশার আলো। পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে আবার নতুন করে নতুন উৎসাহে নতুন পথ চলার শুরু হয় আমাদের সকল স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায়। এই নববর্ষ আমাদের জীবনের চিরকালীন সামাজিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক বাহক।
পৃথিবীর সব প্রজাতিই নিজ নিজ বছরের প্রথম দিনটিকে নিজেদের প্রথায় বরণ করে নেয়। সকল জাতির সঙ্গেই তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রথায় বছরের শুভ প্রথম দিনটিকে বরণ করে নেওয়া এক আবহমান ইতিহাস। প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী মিসরীয়, ফিনিশীয় ও ইরানিরা যেমন বহুকাল আগে থেকেই নিজেদের নববর্ষ পালন করে আসছেন, তেমনি তাদেরও আগে গ্রিক ও রোমানরা যীশুখ্রিস্টের জন্মের পঞ্চম শতাব্দী আগে থেকেই এরূপ উৎসব পালন করতো বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। প্রাচীন আরবীয়রা ‘ওকাজ’ মেলা, ইরানীয়রা ‘নওরোজ’ উৎসব ও প্রাচীন ভারতীয়রা ‘দোল’ পূর্ণিমার দিনে নববর্ষ উদযাপন করতো।
আজকের সমগ্র পৃথিবীতে বাঙালী প্রজাতির সংখ্যা পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বাধিক। সুতরাং আমাদের বসন্ত ঋতুর অন্তিম সময়ে চৈত্রের অবসানে বৈশাখের সূচনার মধ্যে দিয়ে দিকে দিকে বাঙালি নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। বাঙালী তাঁর পুরাতন বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি ভুলে নতুন করে বাঁচার আশায় বুক বাঁধে। তাই কবি লিখেছেন-
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক
পৃথিবীর সকল প্রজাতির কাছেই নতুন বছরের সূচনা পরম পবিত্র দিন বলে গণ্য হয়। বাঙালিও ব্যতিক্রম নয়। নববর্ষ আমাদের আপামর বাঙালীর মনে নবআনন্দের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে।
“নিশি অবসান, ওই পুরাতন বর্ষ হলো গত
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত
বন্ধু হওশত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বছরের সাথে
পুরাতন অপরাধ যতো।”
বাংলা সনের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক মতবাদ প্রচলিত আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন সৌর পঞ্জিকা অনুসারে সৌর বছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, কেরালা, মনিপুর, নেপাল ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালিত হতো।
অন্যদিকে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু রূপ দেওয়ার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর সৌরপঞ্জিকা ও হিজরি সনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক আবার এই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে হিন্দু ঐতিহ্যের বিক্রমী দিনপঞ্জীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আকবরের শাসনকালের বহু আগেই বাংলা বর্ষপঞ্জিকা এবং নববর্ষ উদযাপনের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সেজন্য আকবরকে বাংলা বর্ষপঞ্জির উদ্ভাবক বলে ধরে নেওয়া যুক্তিসম্মত হবে না। আধুনিক গবেষণার ফলে মনে করা হয় গুপ্তযুগীয় বঙ্গসম্রাট শশাঙ্কের শাসনকালেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস : 
পয়লা বৈশাখ:
পয়লা বৈশাখ, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। এই দিনে দেশ ধর্ম নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের কিছু অংশে বাংলা নববর্ষ মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উদযাপন করে।
সাধারণভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। হালখাতা, নৃত্যগীতের শোভাযাত্রা, নানা ধরনের মেলা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয়। একে অন্যকে শুভ নববর্ষের প্রণাম, প্রীতি, শুভেচ্ছা, জানিয়ে সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে বাঙালি নূতন বছরের সূচনা করে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিশেষ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন এই দিনে বাঙালি পুরুষেরা সাধারনত পাঞ্জাবি ও ধুতি এবং মহিলারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শাড়িতে সেজে ওঠেন। এছাড়াও এই দিনে বহু বাঙালির ঘরে পান্তা-ইলিশ বিভিন্ন রকমের ভাজা খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে।
বৈশাখী মেলা:
বাংলা লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে বাংলার বিভিন্ন উৎসব। সেই সকল উৎসবের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৈশাখী মেলা অন্যতম একটি। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীরা তাদের আঞ্চলিক শিল্পকে এই মেলায় নিয়ে আসেন। বাংলার গ্রামীণ পটচিত্র, লোকগান, লোকনৃত্য ইত্যাদি এই মেলাতে স্বকীয় মর্যাদা লাভ করে। নববর্ষের আনন্দ উদযাপনের মাধ্যমে বাংলার লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির মর্যাদা দান এবং পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস এই মেলার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায়। এই উপলক্ষে পালিত হয় চড়কের মেলা, লোকগানের আসর, বাউল মেলা ইত্যাদি। আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান কলকাতায় নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব। আর নববর্ষ উপলক্ষে পয়লা বৈশাখের আগে থেকেই বাজারে চলতে থাকে চৈত্র সেল।
হালখাতা:
বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাঙালির হালখাতা পালনের কথাও উল্লেখযোগ্য। নববর্ষের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবটির তাৎপর্য হলো বর্ষবরণ-এর শুরুতে ব্যবসায়িক হিসাবগত খাতার হাল-হকিকত যাচাই করে নেওয়া। তবে এই উৎসবটি সকল ব্যবসায়ী মহলেই পরম রসনার সঙ্গে পালন করা হয়। সকল আমন্ত্রিত ক্রেতাকে করানো হয় মিষ্টিমুখ। ক্রেতারাও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কাছে নিজেদের ধার বাকি মিটিয়ে পরস্পর এক শুভ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
আদিবাসীদের নববর্ষ:
সাধারণ বাঙালিদের পাশাপাশি উভয় বাংলা সংলগ্ন বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যেও বাংলা নববর্ষ পালনের প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত রয়েছে। নববর্ষের সূচনালগ্নে এই সকল আদিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে থাকেন। প্রান্তিক অঞ্চলের এই সকল নৃগোষ্ঠী গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর, পুরুলিয়া, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি গুলির নববর্ষ উদযাপনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নববর্ষ উদযাপনের তাৎপর্য:
বাঙালি তাঁর উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে পুরনো বছরের সকল ক্লেদ, গ্লানি এবং জীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন জীবনের আশ্বাসকে বরণ করে নেয়। এই উৎসবের মাধ্যমে সকল বাঙালির মধ্যে গড়ে ওঠে স্বাজাত্যবোধ, বেঁচে থাকে বাঙালিয়ানা। বিভিন্ন উৎসবের পালনের মধ্যে দিয়ে বাংলার অগণিত মূল্যবান লোকসংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায়। পৃথিবীজুড়ে সকল বাঙ্গালীর মধ্যে ঐক্যগত মেলবন্ধনের সেতু রচিত হয়।
আধুনিক নগরজীবনে নববর্ষ:
বর্তমান যুগের বিদেশী সংস্কৃতির আধিপত্যজনিত সমস্যায় বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি তাঁর অস্তিত্ব সংকটে আক্রান্ত। বাঙালির জাতীয় সত্তার এই সংকটকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে আজকাল বিভিন্ন স্থানে বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের মধ্যেও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা গেছে। এই অপসংস্কৃতি থেকে বাঙালির স্বাজাত্যবোধ এবং নিজস্ব জাতীয় চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অনতিবিলম্বে আত্মসংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বর্তমান নগরজীবনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দ্বারা আয়োজিত সাংস্কৃতিক উৎসব, মিলন মেলা, গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা প্রভৃতি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করতেই হয়।
উপসংহার:
বাংলা নববর্ষ হল বাঙালির বাঙালিত্বকে উদযাপন করার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মধ্যে যাতে কোনোভাবেই অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি স্তরে সকল বাঙালিকে সচেতন হতে হবে। এই নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির বাঙালিত্ব বিশ্বায়িত হোক, বাঙালি সংস্কৃতি মর্যাদা পাক বিশ্বের দরবারে, আধুনিক ভোগবিলাসমূলক জীবন দর্শন ত্যাগ করে আপন আত্মা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দিকে বাঙালি যত্নবান হয়ে উঠুক এটুকুই বাঞ্ছনীয়। নববর্ষে বাঙালিত্ব এবং বাঙালি সংস্কৃতির পবিত্র উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবনের সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়ে নতুন বছর ভরে উঠুক নতুন জীবনের আশার আলোয়-
“অসতো মা সৎ গময়, 
তমসো মা জ্যোতির্গময়, 
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়, 
ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।।”
তথ্য ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ উইকিপিডিয়া
ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠলো জেগে দিব্য পরশ পেয়ে,
নাই গগণে মেঘের ছায়া যেন স্বচ্ছ স্বর্গকায়া
ভুবন ভরা মুক্ত মায়া মুগ্ধ-হৃদয় চেয়ে।
অতীত নিশি গেছে চ’লে চিরবিদায় বার্তা ব’লে
কোন আঁধারের গভীর তলে রেখে স্মৃতিলেখা,
এসো-এসো ওগো নবীন চ’লে গেছে জীর্ণ মলিন-
আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন মুক্ত সীমারেখা।
#অগ্রন্থিত কবিতা – জীবনানন্দ দাশ

Sahityika Admin

1 comment

  • নববর্ষের উপর একটা ভালো প্রতিবেদন পড়লাম।
    এই পত্রিকাটি পড়ি আর ভাবি যে প্রযুক্তিবিদরাও কত ভালো লিখতে পারেন!!