সাহিত্যিকা

পথের পাঁচালীর কিছু কথা, ও অপরাজিত অনীক

পথের পাঁচালীর কিছু কথা, ও অপরাজিত অনীক
সোহম দাশগুপ্ত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

পথের পাঁচালীর কিছু কথা

পথের পাঁচালীর অজস্র দৃশ্যই সারা জীবনের জন্য মনে গেঁথে গেছে। মাদুর বগলে ইন্দির ঠাকুরণ, মিষ্টিওয়ালার পেছন পেছন অপু দুর্গার পথ চলা, সর্বজয়ার সিঁথি কেটে অপুর চুল আঁচরে দেওয়া, মাথায় শোলার মুকুট পরে কাশবনের মাঝে অপুর ট্রেন দেখা, অঝোর বৃষ্টিতে দুর্গার খোলাচুলে স্নান, দুর্গার মৃত্যুর পর হরিহরের বাড়ি ফেরার মুহুর্ত, নিশ্চিন্দিপুর ছাড়ার পর ভিটেতে সাপের প্রবেশ, হরিহরের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ আর কাশীর ঘাটে অজস্র পায়রা উড়ে যাওয়ার সীনের মত প্রায় প্রতিটা সিকোয়েন্সই স্মৃতিতে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। তবু সমস্ত কিছুর পরেও আরেকটা বিশেষ সিকোয়েন্স আজও মনে সব চেয়ে বেশী নাড়া দেয়। এই সিকোয়েন্সের প্রথম দৃশ্য- দুর্গা মারা যাওয়া পর অপু যখন হঠাতই একদিন ঘরের ঘুলঘুলি থেকে প্রতিবেশী মেয়েটির চুরি যাওয়া পুঁতির মালাটা খুঁজে পেলো, সেই মুহুর্তে ওর অভিব্যাক্তি! দ্বিতীয় দৃশ্য- তারপর নিঃশব্দে মালাখানা নিয়ে বাড়ির পেছনের পানাপুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। তৃতীয় দৃশ্য- মালাটা জলে একটা বৃত্ত রচনা করে ডুবে যাবার পর ধীরে ধীরে আবার পানা দিয়ে জলটা ঢেকে যাওয়া! বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে অপু পুরো ঘটনাটা অনুমান করেই সেই মালাটার সাথে ঐ ঘটনাটাকেও চিরতরে বিস্মৃতির গর্ভে বিসর্জন দিয়েছিল! সেটা বোঝাতে এই পানা পুকুরের প্রতিকী দৃশ্যটা সত্যজিতের ব্রিলিয়ান্ট শৈল্পিক ভাবনার নিদর্শন।

******

অপরাজিত অনীক

অপরাজিত দেখে এলাম। ছোটোবেলা থেকে সত্যজিৎএর পরম গুণমুগ্ধ হিসেবেই বলি ওনার প্রতি এর চেয়ে ভাল ট্রিবিউট আর হতে পারেনা! যেহেতু মুলত পথের পাঁচালীর মেকিং নিয়ে এই সিনেমা, তাই কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, এতো গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। আমি বলি, ঘটি ঘটি গঙ্গা জল ঢাললেই পুজো হয়না। এ পুজোয় আচার উপাচারের থেকে অনেক বড় হ’ল গভীর অনুধাবনের মাধ্যমে আরাধ্য মানুষটির সাথে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। আর সেটা সম্পূর্ণ হলেই একমাত্র সত্যজিৎকে নিয়ে এমন একটা সিনেমা তৈরী করা সম্ভব! নাহ’লে এমন চরিত্রায়ন, চিত্রায়ন, আবহ সঙ্গীত, সর্বোপরি ভয়েসওভার সম্ভব হ’তনা। পরিচালককে বাহবা দেবার ভাষা নেই!

পথের পাঁচালী সিনেমাটি তৈরীর সময়ে ক্যামেরার সামনে ও আড়ালে ঘটা নানা অজানা ঘটনাবলীর সাথে সাথে অপরাজিততে উপরিও পাওয়া হল। বিজ্ঞাপন কম্পানীর একজন ইলাস্ট্রেটার হিসেবে “আম আঁটির ভেঁপু”র মলাট আঁকা থেকে যাত্রা শুরু করে সর্বোপরি বিভূতিভূষনের কল্পিত চরিত্রগুলোকে বাঙ্ময় এবং চলমান করে তুলতে পারার এক রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চার! বাংলার মাটি, বাংলার জলের সাথে সম্পৃক্ত সত্যজিৎ অ্যান্ড হিজ টিমের সেই রোমান্টিসিজম অপরাজিততে আমাদের উপরি পাওয়া। সেই অ্যাডভেঞ্চারের কিছু টুকরো কাহিনী আগে শুনে থাকলেও পরিচালক অনীক দত্ত যে মুন্সীয়ানার সাথে সেগুলোকে এক সূত্রে গেঁথেছেন তার জবাব নেই! সর্বোপরি ওনার নিজের টিম সিলেকশন! ক্যামেরার সামনে বা পেছনে যেখানে যারা কাজ করেছেন প্রত্যেকেই নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। অভিনয়ে জিতু কমল শুধু সবার নজরই কাড়েননি, দর্শকদের মনে একটা দীর্ঘস্থায়ী সিগনেচার রেখে গেছেন। এছাড়া অনীক দত্তর টিমে দৃশ্যায়নে সুপ্রতিম ভোল, আবহ সঙ্গীতে দেবজ্যোতি মিশ্র আর এডিটিংএ অর্ঘ্যকমল মিত্র একেবারে প্রাণ ঢেলে কাজ করেছেন। তার পরেও দু’জনের নাম আলাদা করে উল্লেখ করব। এঁরা দু’জন যে যার যাদুর ছোঁয়ায় ব্যাক্তি সত্যজিৎএর উপস্থিতির দু’টো অনন্য বৈশিষ্টকে প্রায় হুবহু রিক্রিয়েট করেছেন! তাদের একজন হচ্ছেন, সোমনাথ কুন্ডু, আর অন্যজন হচ্ছেন চন্দ্রাশিষ রায়।

সোমনাথের মেকআপ আর চন্দ্রাশিষের ভয়েস ওভার ছাড়া জিতুর অপরাজিত হয়ে ওঠা বোধহয় কঠিন হতো। তাই এমন একটা টিম গড়ে তোলার জন্য অনীক দত্তকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। পরিচালকের কাছে শুধু একটাই অনুযোগ। তাই এবার শুধোই, আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলে অন্য কথা, এতো নতুন নতুন নামকরণের প্রয়োজন ছিল কি?

অবশেষে বলি, তুলনার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা তবে একটা ঐতিহাসিক মিল পাই। আজ থেকে সাতষট্টি বছর আগে সত্যজিৎ যে ভাবে বাংলা সিনেমার সমস্ত প্রথা ভেঙেছিলেন, সম্ভবতঃ আজকের অপরাজিতর মূল অনুপ্রেরণা সেখানেই!

 

Sahityika Admin

Add comment