দুটি প্রবন্ধ – বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দু ধর্ম সংস্কারক দয়ানন্দ সরস্বতী
চন্দন গুহ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সিদ্ধার্থ মাত্র ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেছিলেন শাক্য সঙ্ঘের সাথে বিরোধিতা করে। পরে সংসারের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, পরস্পরের সঙ্গে হানাহানির জন্য সৃষ্ট দুঃখ দুর্দশা দূর করার দীর্ঘস্থায়ী উপায় খুঁজতে সন্যাসধর্ম গ্রহন করে পরিব্রাজক হন।
ভৃগুর আশ্রমে শিক্ষালাভ
পরিব্রাজক হয়ে তিনি প্রথম পরিদর্শন করেন ব্রাহ্মণ ভৃগুর আশ্রম। যখন তিনি আশ্রমে প্রবেশ করছিলেন তখন ভৃগু তার শিষ্যসহ শহর থেকে ভিক্ষা ও ইন্ধন রুপে কুশ নিয়ে সবে আশ্রমে আসেন। সিদ্ধার্থ সবিনয়ে ভৃগুকে অনুরোধ করেন যে তিনি তার আশ্রমে থেকে তাদের তপস্যা দেখে কিছু শিখবেন। ঋষি ভৃগু সানন্দে সিদ্ধার্থকে তার আশ্রমে থেকে তপস্যা করার অনুমতি দিলেন। সিদ্ধার্থ ব্রাহ্মণ ভৃগুর আশ্রমে থেকে বিভিন্ন রকম তপস্যার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করলেন। সেই সব তপস্যা ছিল শরীর ও মনকে সংযত রেখে কি ভাবে জাগতিক সুখ, মোহ, লোভ সংবরন করার শিক্ষা। তাঁরা মনে করতেন যে, মনে স্পৃহা যত কম হবে চাহিদা যত কম থাকবে, জীবনে ততটাই দুঃখ কম হবে, সহজে শান্তি লাভ হবে।
আলারা কলামের (Arada Kalam) আশ্রমে শিক্ষালাভ
ভৃগুর আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে তিনি গেলেন মুনি কলামের আশ্রমে। তিনি ছিলেন যীশুখৃষ্টের জন্মেরও ৭০০বছর আগে একজন ভারতীয় দার্শনিক, সাংখ্য দর্শনের প্রগাঢ় পন্ডিত, যিনি যুক্তি সহকারে কি ভাবে চিন্তা করা যায় তার ব্যাখ্যা করেন। কার্য ও কারনের ব্যাখ্যা তাঁর অন্যতম দান। যেমন মেঘ হলে বৃষ্টি হয়, নদীতে জলচ্ছ্বাস দেখা দিলে উপরের পাহাড়ে বৃষ্টির আধিক্য অবশ্যই থাকবে। প্রমাণ বিনা কোন সত্য তিনি স্বীকার করতেন না। তিনি বর্তমান বৈজ্ঞানিক পন্থার অনুরুপ যে কোন বিষয়ে প্রথমে অনুধাবন করে (perception) পরে সিদ্ধান্তে (inference) উপনিত হতেন। ফলে বেদান্তে বলা বহু মতামত কে তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন, যেমন এই বিশ্বসংসার কোন একজন (ব্রহ্ম, ভগবান) সৃষ্টি করেছিলেন, বা আত্মা অবিনশ্বর ইত্যাদি। তার মতে প্রকৃতির মধ্যেই বিশ্বসংসার সৃষ্টির সব উপাদান ছিল এবং তার থেকে নিজগুণেই সব সৃষ্ট হয়। প্রকৃতিতে সব উপাদান ছিল, হঠাৎ কেন সন্তুলন বিনষ্ট হয়ে বিশ্বসংসার তৈরী হয়ে গেল? তার উত্তরে তিনি বলেন যে, সব বস্তুর মধ্যে সত্ব, রজ ও তম গুণ বিরাজমান থাকে, বিশ্বেও ছিল, দুঃখ (suffering) ই সব সন্তুলন বিনাশ করার জন্য রজ ও তম গুণ সক্রিয় হবার ফলে ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়।
কলামের আশ্রমে তিনি কপিলের দর্শনে জ্ঞান লাভ করলেন। তিনি এই দর্শনে খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন, তবে তার সব সুত্র স্বীকার করেন নি। মাত্র তিনটি সুত্র স্বীকার করলেন
১)প্রমান আধারিত সত্যতাই স্বীকার্য,
২) ভগবান বিশ্ব সংসার সৃষ্টি করেছেন, এই বিশ্বাসের কোন প্রামান্য তথ্য নেই, সুতরাং ভগবান স্বীকার্য নয়,
৩) তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীতে দুঃখ (suffering) আছে। এই দুঃখের নিরাশনেই জগতের মুক্তিলাভ সম্ভব!
সমাধি মার্গ
কলামের আশ্রমে থাকার সময়ে সিদ্ধার্থ ধ্যানমার্গ বিষয়ে আগ্রহী হন। তিনি ধ্যানমার্গের (concentration of mind) বিভিন্ন পদ্ধতি সম্বন্ধে শুনেছিলেন, ভাবলেন সেই পদ্ধতিও পরীক্ষা করা যায়। ধ্যান মার্গের বিভিন্ন পদ্ধতি হল আনাপনাসতি, প্রাণায়াম ও সমাধি। সব পদ্ধতিতেই একটা নিয়ম অনুরুপ ছিল শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা। প্রাণায়াম তিন ধাপে করতে হয়,শ্বাস নেওয়া (পূরক), শ্বাস রুদ্ধ করা (কুম্ভক), প্রশ্বাস ছাড়া (রেচক)। এই ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন করতে করতে মনের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করার পদ্ধতি শিক্ষা লাভ করে সিদ্ধার্থ আলারা কলামের কাছে জানতে চাইলেন তার আর কি শিক্ষনীয় আছে? গুরু বললেন আর কিছু বাকি নেই। গুরুকে প্রণাম জানিয়ে সিদ্ধার্থ তার আশ্রম ত্যাগ করলেন। আলারা কালাম ধ্যান মার্গের অন্যতম গুরু বলেও প্রসিদ্ধ।
কোশলে রাজত্বে কলামের চাইতে বড় ধ্যানী যোগীপুরুষ ছিলেন ঊদ্দকো রামপুত্রা। সিদ্ধার্থ উনার কাছেও ধ্যানমার্গে শিক্ষা নিলেন। তারপর মগধে গিয়ে আরও কঠোর ভাবে ধ্যান শিখলেন। এই ভাবে ধ্যানমার্গে পারদর্শী সিদ্ধার্থ মগধ থেকে গয়া গেলেন।
জাগতিক সুখ ত্যাগ করা (asceticism)
গয়া গিয়ে কোথায় থাকবেন দেখার জন্য নিজে সরোজমিন পর্যবেক্ষণ করে উরুভেলা অঞ্চলে, রাজপুরোহিত নেগারীর আশ্রমের কাছের এক স্থান নির্ণয় করলেন। নিরঞ্জন নদীর তীরে শান্ত, নির্জন পরিবেশ তার ধ্যানের উপযুক্ত মনে হল। উরুভেলায় তিনি সেই পাঁচজন পরিব্রাজক ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন যাদের তিনি রাজগৃহে (রাজগীর) দেখেছিলেন। তারা সিদ্ধার্থকে অনুরোধ করলেন যে তিনি যেন তাদেরও তার জাগতিক সুখ ত্যাগ করার ধ্যানের সঙ্গী করেন। সিদ্ধার্থ রাজি হলেন।
শুরু হল সিদ্ধার্থ গৌতমের অভুতপূর্ব কৃচ্ছসাধন করে জাগতিক সুখ, ভোগ ত্যাগ করার সাধনা! শীতের রাতে গহন জঙ্গলে ধ্যান করা, গ্রীষ্মের তপ্ত মধ্যানে সূর্যের আলোকে ধ্যান করা, মাটি কেটে ভূমি শয্যায় পোড়া হাড়ের উপর নিদ্রা যাপন, ইত্যাদি। যে সকল খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর ও মনে চাঞ্চল্য জাগে তা পরিহাঁর করলেন। প্রথমকালে দিনে একবার আহার করতেন, তারপর পাঁচ দিনে একবার, এই ভাবে পরবর্তীকালে মাসে একবার আহার করতেন। আহার্য বস্তু ছিল জলজ উদ্ভিদ, গাছের ফল মূল, এক মুঠি শস্য, এবং তাও কমতে কমতে একটা মাত্র ফল থেকে কমে এক দানা শস্য পর্যন্ত। এমন কঠোর তপস্যা করে জাগতিক সুখ স্বাচ্ছন্দ পরিহার করতে করতে তার শরীর শক্তিহীন, দুর্বল হয়ে গেল। উদরে হাত দিলে মেরুদন্ডের স্পর্শ পেতেন, আবার মেরুদন্ড স্পর্শ করলে উদর অনুভব করতেন (থাইল্যন্ডে বুদ্ধদেবের এই শীর্ণকায় চেহারার এক মূর্তি আছে)। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে পারতেন না। শরীর ধুলো, ময়লা নোংরায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল, সময়ে সময়ে সেই ময়লার আস্তরন খসেও পড়তো। তথাপি মনে কোন শান্তি অনুভব করলেন না। মনে মনে ভাবলেন ”শরীরের এই অবর্ননীয় কষ্ট করে আমি কোন জ্ঞান অর্জন করলাম? এটা কোন ধর্ম? শরীর তো পরিচালিত হয় মনের দ্বারা, আমি তো মন শক্ত করলে শরীরের দ্বারা যে কোন ভাল কাজ করতে পারি, তবে কেন এমন করছি? উপলব্ধি করেন যে কোন ভাল কাজ করতে বা বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে হলে দুর্বল, রুগ্ন শরীরে, বিক্ষিপ্ত মনে করা সম্ভবপর নয়। শরীরে পুষ্টিকর খাদ্য দরকার। এমন সব চিন্তা করে তিনি কোন রকমে এক বটবৃক্ষের নীচে গিয়ে বসলেন।
এদিকে, উরুভিলা অঞ্চলে সেনানী নামের এক গৃহস্থ বাস করতেন। তাঁর সুজাতা নামে এক যুবতী কন্যা ছিলেন। সেই কন্যা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তার পুত্র জন্মগ্রহন করলে বটবৃক্ষকে পায়েস অন্ন উৎসর্গ করবেন। তার ইচ্ছা পূর্ন হওয়ায় সে তার পুন্না দাসীকে বট বৃক্ষ স্থল পরিস্কার করতে পাঠালেন। পুন্না বটবৃক্ষের নীচে সিদ্ধার্থকে দেখে ভাবলেন ইনিই বোধ হয় বটের দেবতা, নীচে অবতরন করেছেন। দাসী গিয়ে সুজাতাকে খবর দিলে সুজাতা সোনার থালায় সুমিষ্ট পায়েস ও অন্য ব্যঞ্জন নিয়ে উপস্থিত হয়ে সিদ্ধার্থকে ভোজন করতে অনুগ্রহ করেন। সিদ্ধার্থ তখন নিরঞ্জন নদীতে সুপ্তথীত এক স্থানে অবগাহন করে পবিত্র হয়ে এসে সেই পায়েস ও অন্য ভোজন গ্রহন করে তার কৃচ্ছসাধন মার্গ ত্যাগ করলেন। এই কারণে সিদ্ধার্থের সঙ্গে যে পাঁচ ব্রাহ্মণ কৃচ্ছসাধন করছিলেন তারা সিদ্ধার্থের আচরণে হতাশ ও কুপিত হয়ে তার সঙ্গ ত্যাগ করলেন।
সুস্বাদু অন্নব্যাঞ্জন গ্রহন করার পর শক্তি অর্জন করে সিদ্ধার্থ বিগত দিনের অভিজ্ঞতা স্মরন করলেন। উপলব্ধি করলেন যে জ্ঞানলাভ করার সমস্ত মার্গ ব্যর্থ হয়ে গেছে। ব্যর্থতা এত ব্যাপক ছিল যে অন্য কেউ হলে ভেঙ্গে পড়তেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি আবার নতুন উদ্যমে জ্ঞান আরোহনের চেষ্টা শুরু করলেন। যে দিন তিনি সুজাতার হাত থেকে অন্ন গ্রহন করেছিলেন, সে দিন রাতে তিনি পাঁচটি স্বপ্ন দর্শন করেছিলেন। স্বপ্ন ভঙ্গ হবার পর তিনি অনুভব করলেন যে তিনি জ্ঞান লাভ করবেনই।
সিদ্ধার্থ নিজের উপর এক ভবিষ্যবাণী করারও মনস্থির করলেন। যে পাত্রে সুজাতার অন্ন গ্রহন করেছিলেন তা নিরঞ্জা নদীর জলে ছুড়ে বললেন, “যদি এই পাত্র নদীর স্রোতের সঙ্গে ভাসতে থাকে তবে আমি অন্তর্জ্ঞান লাভ করব”। আশার সঞ্চার করে সেই পাত্র জলে ভাসতে ভাসতে বহুদূর গিয়ে জলে নিমজ্জিত হল। এরপর আশায় উজ্জীবিত হয়ে সায়াহ্নে তিনি উরুভিলা ছেড়ে গয়া যাবার প্রশস্ত পথে যাত্রা শুরু করেন। অভীষ্টস্থানে পৌঁছে তিনি এক বটগাছের নীচে আশ্রয় নিয়ে মনে মনে ভাবলেন যে এখানেই তপস্যা করে জ্ঞান অর্জন করবেন যাতে তার সমস্যার সমাধান হয়, এবং মনের অজ্ঞতা দূর হয়। গয়ায় তখন ছিলেন নাগা রাজ কালা। তিনি ও তার পত্নী সুবর্নপ্রাভাসা পরদিন তপস্বী সিদ্ধার্থকে অভিবাদন জানিয়ে তার আরাধনা সার্থক হবে জানিয়ে গেলেন।
সিদ্ধার্থ আগে যেমন কৃচ্ছসাধন করে জ্ঞান লাভের মার্গ অনুসরণ করেছিলেন, এবার আর তা করলেন না। তিনি সুস্থ শরীরে চিত্ত বৈকল্য না ঘটায়, এমন খাদ্যবস্তু সংগ্রহ করলেন যা প্রায় চল্লিশ দিনের খোরাক। তারপর সেই বটবৃক্ষের নীচে পদ্মাসনে পূর্বদিকে মুখ করে, দেহ ঋজু করে বসে মন থেকে সমস্ত অনৈতিক ও কুচিন্তা দূর করে ধ্যানে বসলেন। এই ভাবে ধ্যান করতে করতে ঊনত্রিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। শেষ দিন অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হয়ে তার মানস চেতনায় উদ্ভাসিত হল নতুন জ্ঞান। তিনি খুঁজে পেলেন নতুন পথ।
সাংখ্য দর্শনে (কার্য ও কারন সম্বন্ধ) জ্ঞান লাভ করা সিদ্ধার্থ বুঝলেন;
১)জগতে দুঃখ আছে, সেই দুঃখের উৎস কি এবং
২)কি ভাবে সেই দুঃখ দূর করা যায়।
উভয় প্রশ্নের যে সঠিক উত্তর তিনি খুঁজে পেলেন, তাকে বলা হয় সমবোধি (right enlightenment)। তিনি তখন পরিচিত হন বুদ্ধ নামে। তখন থেকেই সেই বটবৃক্ষ,যার নীচে বসে সিদ্ধার্থ বোধি লাভ করেছিলেন তা বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে।
সেই বটবৃক্ষ আজও বোধগয়াতে আছে বলে দাবী করা হয়। আসল গাছ কালের প্রকোপে, ঝড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান গাছ সাংকেতিক, নতুন করে লাগানো হয়েছিল। গাছের নীচে বাঁধানো চত্তরে বহু দর্শনার্থী এখনও বসেন ও বুদ্ধদেবের তপস্যার কথা স্মরণ করেন।
বৌদ্ধধর্ম কি?
বৌদ্ধধর্ম হিন্দু ধর্মের চরম আধ্যাত্মিক চেতনা ও নিরীশ্বরবাদের এক মধ্যপথ। এই ধর্মে না ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় , না আত্মাকে স্বীকার করা হয়। মনের প্রাধান্য এখানে সব চাইতে বেশী বলেই মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মে যে গতজন্মের কর্মফলকে এই জন্মের পাপ, পূণ্যের কারন মনে করা হয় তাও বৌদ্ধধর্মে স্বীকার্য নয়। এই ধর্মের মূল কথা হল মানুষকে কি ভাবে তার দুঃখ থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। দুঃখ বলতে এখানে আসক্তির কথাই বলা হয়েছে, যেমন ভোগ্য বস্তুর আকাঙ্খা, শারীরিক সুখ, লোভ, ভয়, ক্রোধ ইত্যাদি। পঞ্চশীল নীতি পালন করলে এই দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে বুদ্ধদেবের বিশ্বাস ছিল। পঞ্চশীল নীতি হল:কারও প্রাণ হরণ না করা, চুরি না করা, মিথ্যা কথা না বলা, যৌনব্যাভিচার না করা ও উত্তেজক মাদক গ্রহন না করা। সরল ভাবে বলা যায় যে মানুষের আসক্তি কম হলে দুঃখও কম হবে, জীবন আনন্দময় হবে।
বুদ্ধের ধর্ম প্রচার
সিদ্ধার্থ দীর্ঘ সাত বছর বিভিন্ন মার্গে তপস্যা করে নির্বাণ লাভ করেন। বাংলা বা সংস্কৃত ভাষার নির্বাণ (পালি ভাষার nibbana) কথার অর্থ দীর্ঘ সাধনা দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞান, চরমপ্রাপ্তি। পয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি নির্বাণ লাভ করেন। নির্বাণ লাভ করে বুদ্ধদেব চিন্তিত এবার তিনি কি করবেন? তাঁর নিজের উপলব্ধ করা জ্ঞাণ প্রচার করবেন? না, নিজের চিত্ত পরিশীলিত করবেন? বুদ্ধদেব নিজে সন্দিহান ছিলেন যে, তাঁর সুক্ষ্ম, নিগূঢ় মতবাদ জ্ঞানী ব্যক্তিরাই বুঝবেন না, সাধারণ মানুষ তো নয়ই। সেই মতবাদ কেউ অনুসরনও করবেন না। মানুষের মন থেকে এই বিশ্বাস নির্মূল করা খুব দূরুহ যে আত্মা বলে কিছু হয় না, মৃত্যুর পর মানুষের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
সিদ্ধার্থ ঊনত্রিশ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে সন্যাসী হন। “আমি যদি আমার মতবাদ প্রচার করি ও শ্রোতার তা পছন্দ না হয়, বা পছন্দ হলেও যদি তা অনুসরন না করে, তবে তা হবে অপরের পক্ষে গ্লানির আর আমার পক্ষে নিরাশজনক। বুদ্ধদেব ভাবলেন, তার চাইতে সন্যাসী থেকেই নিজেকে শুদ্ধ করি। বুদ্ধের মনের এই দ্বন্দের কথা ব্রহ্মা সহামপতি (হিন্দু ধর্মের ব্রহ্মা) বুঝতে পেরে মর্তে আবির্ভূত হয়ে বলেন, ”আপনি এখন আর সিদ্ধার্থ গৌতম নন, আপনি এখন বুদ্ধ, নির্বাণ লাভ করে পরম জ্ঞানী। কেন আপনার মতাদর্শ প্রচার করে সকলকে ভ্রম থেকে উদ্ধার করবেন না? বুদ্ধদেব তখন সম্মতি দিলেন।
তারপর পরিতুষ্ট ব্রহ্মা বিশ্বসংসারকে ঘোষনা করে জানালেন যে, ”বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভ করে বুঝেছেন, জগতে দুঃখের কারন কি? আর তার সমাধানের উপায়ও কি? জগত উপকৃত হবে তার মতাবাদ অনুসরন করে।
তারপর শুরু হল দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর ধরে বুদ্ধের ধর্ম প্রচার।
প্রথম ধর্মপ্রচার করেন সারনাথে সেই পাঁচজন ব্রাহ্মণকে যারা তাকে সুজাতার দেওয়া অন্নগ্রহন করতে দেখে পরিত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধদেব তাদের ব্যাখ্য করে বললেন, তার ধর্ম মধ্যমা মার্গ (Majjhima Pratipada), শরীরের প্রয়োজনমত খাদ্য ও পানীয় দরকার যাতে মন সুস্থ ও সতেজ থাকে। অতিরিক্ত রিপুদমন, সংযম বা কৃচ্ছসাধন যেমন ক্ষতিকর তেমনি অতিরিক্ত ভোগবিলাসও কাম্য নয়। দুইয়ের মধ্যপন্থাই উৎকৃষ্ট পন্থা। তিনি আরও বলেন যে, তাঁর এই মতবাদই তাঁর ধর্ম, এখানে ভগবানের কোন স্থান নেই, নেই কোন আত্মার স্থান। তার ধর্ম ইহ জগতের মানুষকে নিয়ে, পরজন্মের মানুষ নিয়ে নয়। এই বিশ্বে মানুষের সাথে মানুষের সম্বন্ধ নিয়েই তার ধর্ম। এই বিচার শুনেই সেই পাঁচ ব্রাহ্মণ পরিব্রাজক বুদ্ধের ধর্ম গ্রহন করেন।
তারপর তাঁর মতাদর্শে প্রভাবিত হলেন্ যশ, জাগতিক সুখে ডুবে থাকা এক ধনী যুবক, বেনারসের শিক্ষিত ব্রাহ্মণ কাশ্যপা ভাইরা, রাজগৃহের (রাজগীর) দুই ব্রাহ্মণ যুবক সরিপুত্রা ও মোগ্গালনা ও তাদের অনুগামী, মঘধের রাজা বিম্বিসার, অনন্তপিন্ডিকা, রাজা প্রসেনজিৎ, জীভিকা, রথপালা, পিতা সুদ্ধধন, মাতা যশোধরা, পুত্র রাহুল, উত্তরাবতীর ব্রাহ্মণগন, ক্ষৌরকার উপালী, মেথর সুনীতা, নীচ জাতির সুমঙ্গলা, চন্ডালিকা প্রাকৃতি, ভবঘুরে, দস্যু অঙ্গুলীমাল, বিভিন্ন অপরাধী, ইত্যাদি অনেকেই। এই ভাবে অবন্তিকা, কোশল, মঘধ, অঙ্গ, শ্রাবস্তী, বৈশালী প্রভৃতি রাজ্যের প্রভূত লোকজন তাঁর ধর্ম গ্রহণ করলেন। বিরোধিতা যে হয় নি তা নয়। অভিযোগ হয়েছে বুদ্ধদেব গৃহীর সংসার ভেঙ্গেছেন। কারো সন্তান, কারো পতি, কারো পিতা সংসার ত্যাগ করে সন্যাস নিয়েছেন। বুদ্ধদেব এই অভিযোগ খন্ডন করে বলেছেন, তিনি কখনও কাউকে জোর করে সন্যাসী বানান নি, সকলেই স্বেচ্ছায় তার ধর্ম গ্রহন করেছেন। পছন্দ না হলে তারা যে কোন সময় সঙ্ঘ পরিত্যাগ করেও সতন্ত্র হতে পারেন।
কোথায় কোথায় প্রচার করেছিলেন?
বুদ্ধদেব কিছু স্থানকে তার প্রধান প্রচারকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। শ্রাবস্তী ও রাজগৃহ (রাজগীর) ছিল অন্যতম দুই স্থান। বলা হয় যে তিনি শ্রাবস্তী গিয়েছিলেন ৭৫ বার ও রাজগৃহতে ২৪বার। এছাড়া কপিলাবস্তু ৬বার, বৈশালী ৬বার, কামস সধম্ম গিয়েছিলেন ৪বার। তিনি প্রায় সমস্ত উত্তর ভারতের বিশাল দূরত্ব পদব্রজেই ভ্রমন করেন। কোনও স্থান গোশকটেও ভ্রমন করেন নি। বিভিন্ন স্থানে রাতের আশ্রয়স্থল হত ভিক্ষুদের জন্য নির্ধারিত বিহার, অন্যথায় গাছের নীচে। পরিধান ছিল তিন খন্ডের বস্ত্র, লজ্জা নিবারন বস্ত্র, অঙ্গ বস্ত্র ও উত্তরীয়। ভোজন ছিল সারা দিনে এক বার,ভিক্ষা অন্ন।
মানব ইতিহাসে বুদ্ধদেবের মত এত সংগ্রামের জীবন অন্য কোন ধর্মপ্রচারক কে ভোগ করতে হয় নি।
অন্তিম কাল
বুদ্ধদেব তার জীবনের শেষ ভাগে যখন কুশীনারা পৌঁছলেন তখন তিনি ৮০ বছর বয়স্ক, শরীর দূর্বল, শক্তিহীন। কারো সাহায্য ছাড়া চলাচল করতে পারতেন না। প্রথমে তাঁকে সাহায্য করতেন তার শিষ্য নন্দ। পরে আসেন বহুদিনের মিত্র আনন্দ। এক দিন আনন্দকে ডেকে জানালেন যে তাঁর জীবনের অন্তিম ক্ষণ উপস্থিত হয়েছে, তিনি কুশীনারার শালবনেই এক রাতের তৃতীয় প্রহরে নশ্বর দেহ ত্যাগ করবেন। বুদ্ধদেবের এই মনোভাবের কথা শুনে আনন্দ নিদারুন দুঃখে স্থান ত্যাগ করলেন। বুদ্ধদেব অন্য শিষ্যদের পাঠিয়ে আনন্দ কোথায় গমন করেছে জানতে চাইলে তারা জানালেন যে আনন্দ গভীর দুঃখে রুদ্ধমান। তিনি আবার আনন্দকে ডেকে আনালেন। আনন্দ এবার বললেন যে তিনি বুদ্ধদেব কে এই অপরিছন্ন নিরানন্দ পরিবেশে দেহত্যাগ করতে দিতে পারেন না। তাঁর দেহত্যাগের উপযুক্ত স্থান হবে রাজগৃহ, চম্পা, সকেতা, বেনারস ইত্যাদি শহর। বুদ্ধদেব জানালেন যে কুশীনারা এক মহান রাজত্বের রাজধানী ছিল। রাজা ছিলেন মহা সুদাসনা। তিনি এখানেই দেহত্যাগ করবেন। তারপর তিনি আনন্দকে দু’টি আদেশ দিলেন। প্রথম আদেশ, চন্দার প্রস্তুত করা অন্ন গ্রহন করে বুদ্ধদেব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এমন প্রচার যেন না হয় (চন্দার প্রস্তুত করা শূকরের মাংস খেয়ে বুদ্ধদেবের রক্তশূল হয়, এমন কাহিনী প্রচলিত আছে)। তাহলে শিষ্য চন্দা বিমর্ষ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় আদেশ ছিল কুশীনারার মাল্লাদের অবহিত করা যে তাদের মহান বুদ্ধদেব কুশীনারাতেই আছেন, মৃত্যুরআগে যেন তারা শেষ দেখা দেখে নেন।
তারপর পরম আদরনীয় শিষ্য আনন্দ ও অনুরুদ্ধ সমস্ত রাত্রি বুদ্ধদেবের উপস্থিতিতে ধর্মালোচনা করলেন। রাতের তৃতীয় যামিনীতে বুদ্ধদেব তার নশ্বর দেহত্যাগ করলেন। সমস্ত জীবন জাগতিক দুঃখের কারন ও তা নিরসনের মার্গ দর্শক বুদ্ধদেব আজ সব মিত্র ও শিষ্যদের সীমাহীন দুঃখে নিমজ্জিত করে এক অনন্ত পথযাত্রা শুরু করলেন। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা রাতের তৃতীয় লগ্নে ৪৮৩ খৃষ্টপূর্বে তার জীবনাবসান হয়। পালি ভাষায় তার মৃত্যুর সুন্দর বিবরন আছে:
সূর্যের আলো পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করে শুধু দিনে,
চাঁদের স্নিগ্ধ আলো পৃথিবীতে উদ্ভাসিত করে শুধু রাতে,
যোদ্ধা উদ্ভাসিত হন তার সমরাস্ত্রে,
ব্রাহ্মণ উজ্জ্বল হন ধ্যানমগ্নে,
কিন্তু বুদ্ধ উদ্ভাসিত হবেন দিন ও রাতে তার আপন গরিমায়।
আনন্দ কুশীনারার মাল্লাদের জানালেন বুদ্ধদেবের তিরোধানের খবর। দলে দলে শোকাতুর মাল্লারা শাল বনে তাঁর শেষ দর্শন করতে এলেন। মাল্লাদলপতি আনন্দের কাছে জানতে চাইলেন যে বুদ্ধেদেবের নশ্বর শরীর নিয়ে তারা কি করবেন? শ্রদ্ধেয় আনন্দ বললেন, রাজাধিরাজের মরদেহ নিয়ে যা করা হয় তাই করতে হবে। মাল্লারা বললেন. রাজাধিরাজাদের মরদেহ নিয়ে কি করা উচিত তারা জানেন না। শ্রদ্ধেয় আনন্দ বললেন, ”প্রথমে রাজাধিরাজার মরদেহ নতুন বস্ত্রে মুড়ে দেওয়া হয়। তার উপর সুতির পশম কাপড়ের পাঁচশো পরত চড়িয়ে সেই দেহ এক তেলের পাত্রে রেখে, আর একটি তেলের পাত্র শয়ন করিয়ে রেখে চিতার আগুনে ভষ্ম করা হয়। এই ভাবে রাজাধিরাজের মরদেহের সম্মাণ জানানো হয়।
মাল্লারা এই ব্যবস্থায় রাজি হলেন।তবে তখন প্রহরের হিসেবে দেরী হয়ে যাওয়াতে সেদিন সব স্থগিত রেখে পরদিন হবে বলে ঘোষনা হল। পরদিন মাল্লারা দেশের যত ফুল, মালা, সুগন্ধী নিয়ে যন্ত্রবাদক সবাইকে আহ্বান করলেন তথাগতকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্ব চলল ষষ্ঠ দিন পর্যন্ত। সপ্তমদিনে আটজন মাল্লা মুন্ডিতমস্তকে নববস্ত্র পরিধান করে তথাগতের মরদেহ বহন করে মুক্ত বন্ধন নামের মন্দিরে নিয়ে গেলেন। তারপর সেই দেহে অগ্নি সংযোগ করে শেষ কৃত্য সম্পন্ন হল। তথাগতর নশ্বর দেহ এক মুঠি ভষ্মে রুপান্তরিত হল।
ছাই ভষ্ম নিয়ে বিবাদ
তথাগতর মৃত্যুর পর তার অস্থি, ভষ্ম একত্রিত করে এক পাত্রে সংগ্রহ করে মাল্লারা এক সভাগৃহে কড়া পাহারা দিয়ে সংরক্ষণ করলেন যাতে কেউ চুরি না করে। কুশীনারা (বর্তমানে গোরক্ষপুরের কুশীনগর) রাজ্যের রাজা অজাতশত্রু যখন শুনলেন যে শ্রদ্ধেয় তথাগতর অস্থি ভষ্ম তার রাজ্যে রাখা আছে, তিনি ভষ্মের এক অংশ দাবী করলেন। অনুরুপ দাবী করলেন বৈশালীর লিচ্ছবিরা, কপিলাবস্তুর শাক্যরা, রামনগরের কলিয়াজরা, পভর মাল্লারা। এক ব্রাহ্মণ ভেথাদ্বীপও অস্থি ভষ্ম দাবী করলেন। অস্থি ভষ্মের এত দাবীদার দেখে মাল্লারা বললেন ” তথাগত আমাদের গ্রামে মৃত্যু বরন করেছেন, সব অস্থি ভষ্ম আমরা রাখব, কাউকে দেব না।
বিবাদ চরম আকার ধারন করলে, দ্রোন নামের এক ব্রাহ্মণ সমাধান সুত্র দিলেন। তিনি বললেন,” পরম জ্ঞাণী তথাগত সমস্ত জীবন শান্তি, মৈত্রী, সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করেছিলেন, আর তার মৃত্যুর পর আমরা তার অস্থি ভষ্ম নিয়ে বিবাদ করছি? আসুন আমরা সবাই তার অস্থি ভষ্ম আট ভাগে ভাগ করে নি। তার অস্থি বিভিন্ন দিকে ভাগ করে স্তুপ বানিয়ে বুদ্ধের জ্ঞানের প্রচার করি। প্রস্তাবে সবাই রাজি হলেন, অস্থি আট ভাগে ভাগ হলে ব্রাহ্মণ দ্রোন, অস্থি রাখার কলস তার বলে দাবী করলেন। তিনি সেই কলসের উপর এক স্তুপ বানাবেন বললেন। এই ভাবে তথাগত বুদ্ধের অস্থি বন্টনের বিবাদ শান্তিপূর্ণ ভাবে শেষ হল।
** The Buddha &His Dharma- Dr.BR Ambedkar বই এর অনুসরনে বাংলা রুপান্তর।
******
বৌদ্ধ ধর্মের অবলুপ্তি
বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মমতের একটি হলো হিন্দু ধর্ম, অন্য দু’টি জুডাইজম ও জোরাস্ট্রিয়ান। জুডাইজম আজও ইজরাইলে প্রচলিত, অন্যদিকে জোরাস্ট্রিয়ান অনেক আগের পারস্যের (বর্তমান ইরান) দেশেরই মুখ্যাত ধর্মমত, যা ষষ্ঠ শতাব্দিতে ইসলামের আবির্ভাবের পর ধীরে ধীরে সাধারণের মধ্যে প্রভাব হারায়। কোন সুদূর অতীতে পারস্য থেকে বিতাড়িত জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মের মানুষজন ভারতের মুম্বাই উপকূলে এসে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন, এবং বংশানুক্রমে এখনও তাঁরা সেখানেই আছেন। তেমনি আছেন কেরলের মালাবার উপকূলে ইহুদি সম্প্রদায় ও তাঁদের মন্দির বা সায়নাগগ। সহজ কথায় জুডাইজম ও হিন্দু এই দুই প্রাচীন ধর্মীয় সম্প্রদায় এখনও বর্তমান। কালের নিয়মে উভয় ধর্মের মূল দর্শন অপরিবর্তিত থাকলেও ধারা বদল হয়ে গেছে। ভারতে প্রচলিত আরও দুই প্রাচীন ধর্ম জৈন ও বৌদ্ধধর্ম। এখানের আলোচ্য বিষয়, ভারতে প্রায় সহস্র বছর প্রচলিত থাকার পরেও বৌদ্ধধর্মর কেন এই আনুপাতিক হ্রাস? অথচ এশিয়ার বহু দেশে আজও বৌদ্ধধর্ম বহুল প্রচারিত? কৌলিন্যের বিচারে হিন্দুধর্ম তুলনামূলক ভাবে প্রাচীন বলে হিন্দুধর্মের কথা আগে বলার দাবী যথাযথ মনে হয়।
হিন্দু ধর্ম
ঠিক কবে হিন্দু ধর্মের সৃষ্টি হয়? এই ধর্মের প্রবক্তা কে ছিলেন? এই সকল প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। মনে করা হয় যে খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে, অন্য মতে (১৫০০ থেকে ৪০০ খৃষ্ট পূর্ব) গৃহপালিত পশু সমেত একদল মধ্য এশিয়ার লোক সিন্ধু নদীর তীরে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন, নাম সংস্কৃত। এনারা মূলত চাষআবাদ করেই জীবন ধারন করতেন। আর্য নামের মধ্য এশিয়ার এই লোকেরা কতদিন ধরে এদেশে এসেছিলেন বা স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল কিনা এসব তথ্য জানা যায় না। ক্রমশ তাঁরা সমগ্র উত্তরভারত ও পরবর্তীকালে মধ্যভারত হয়ে দক্ষিণভারতেও পৌঁছে যান (অগস্ত মুনির অনুগামী)। এই আগন্তুক আর্যদলে এক শ্রেণীর মুনি বা ঋষি ছিলেন যারা তৎকালীন বিশ্বে অন্যসকলের অনুপাতে অসীম জ্ঞানী ছিলেন। তাঁরা যে শুধু ব্রহ্মান্ডের গতিপ্রকৃতির রহস্যই জানতেন তা নয়, মানুষের অন্তরস্থলেও অবলোকন করেছিলেন। ওনাদের জ্ঞানই পরে বেদ নামে লিপিবদ্ধ ও পরিচিত হয়। এটি কোন ব্যক্তিবিশেষের জ্ঞান নয়, এই জ্ঞান অপৌরষেয়। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তির মুখে মুখে শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমে বহু হাজার বছর ধরে বেদ প্রচলিত ছিল। জ্ঞানের এই বিশাল ভান্ডারে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়ের চাইতে জ্ঞানের মাহাত্মই বেশী ছিল বলে বেদকে সত্য ও অভ্রান্ত (infallible) বলা হয়। বেদই হল হিন্দু ধর্মের মূল কথা।
বেদ কি, ও কত রকমের
বেদ মূলত মন্ত্র বা hymns যা বিভিন্ন যজ্ঞে দেবতার উদ্দেশ্যে গাওয়া হত। সর্বপ্রাচীন প্রাচীন বেদ ঋগ বেদে অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্র, পবন, বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও আরও অন্যান্য দেবতার যজ্ঞের আয়োজন করা হত।
সূর্যবন্দনার গায়ত্রী মন্ত্র, ওঁ ভূর ভূবস্য
আজও প্রতিদিন শত সহস্র মানুষ গায়ত্রীমন্ত্র স্তব করেন। সব মিলিয়ে ঋগ বেদে ১০২৮ টি মন্ত্র। ঋগ বেদের পর লেখা হয় সামবেদ। মূলত গান বা সুর নিয়েই তৈরি হয় সামবেদ। ঋগ বেদের বিভিন্ন মন্ত্র কি ভাবে গাওয়া হবে তারই বর্ননা সামবেদের অংশবিষেষ। তৃতীয় বেদ যজু গ্রন্থিত হয় বিভিন্ন উৎসর্গের পদ্ধতির বর্নণায়, এবং চতুর্থ বেদ অর্থাৎ অথর্ব বেদ লেখা হয় চমৎকার বা magical বিষয় নিয়ে, যেটি খুব উচ্চাঙ্গের নয়। চার বেদই আবার চার ভাগে বিভক্ত, যেমন সংহিতা বা মন্ত্র, আরণ্যক বা পূজার পদ্ধতি, ব্রাহ্মনস বা পূজাপদ্ধতির টীপ্পনী, এবং উপনিষদ বা শাস্ত্রের অধ্যয়ন বা ধ্যান
উপনিষদ
বেদ পরবর্তী হিন্দু ধর্মগ্রন্থের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ উপনিষদ। উপনিষদের বুৎপত্তি গত অর্থ উপ অর্থাৎ নিকটে, নি অর্থাৎ নিচে এবং ষদ শব্দের অর্থ উপবিষ্ট হয়ে, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উপনিষদের অর্থ গুরুর সান্নিধ্যে বা পদতলে বসে সরাসরি জ্ঞান সঞ্চয় করা। বেদের শেষ ভাগকেও উপনিষদ বলা হয়। ১০৮ টি উপনিষদ লেখা হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব (BCE) ৪০০ থেকে খৃষ্টাব্দ (ACE) ৪০০ পর্যন্ত। উপনিষদও অপৌরষিয় রচনা, কেউ একজন রচনা করেন নি, গুরুর থেকে শিষ্যের মৌখিক জ্ঞান লাভ করা। ফলে উপনিষদও ভুল ত্রুটিহিন অভ্রান্ত মনে করা হয়। বর্তমানে ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুন্ডক, মাত্তুক্য, তৈত্তিরেয়, ঐতরেয় ও শ্বেতাশ্বতর নামের ন’টি উপনিষদ বহুল প্রচারিত। এছাড়া আরও দু খানা উপনিষদও বহুল প্রচলিত, ছান্দগ্য ও বৃহদারণ্যক ।
হিন্দুদের কর্মফল, পূনর্জন্ম বা বারংবার জন্মগ্রহণ করে অবশেষে মোক্ষলাভ করা, নিরাকার ব্রহ্মই যে একমাত্র সত্য ও আত্মার অবিনশ্বরতা সেই বিষয়ে দার্শনিক আলোচনা উপনিষদে বর্ণিত আছে, যা সাধারণভাবে মানুষের চিন্তার বাইরে। সাধারণ মানুষের উপলব্ধির জন্য পরে উপনিষদের অনেক অধ্যায়ও পুরানে লেখা হয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, আর্যদের ভারতে আগমনের পূর্বে এদেশের ধর্মমত ছিল অজানা। বেদ, উপনিষদের পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা, ঈশ্বরে বিশ্বাস, পূজা, যাগযজ্ঞ এবং সমগ্র মানবসমাজ, জীবজন্তু, পাখি, কীটপতঙ্গ, প্রকৃতি, সব সৃষ্টির মূলে যে পরমব্রহ্ম আছেন এমন ধারনার সৃষ্টি হয়। সেই পরমব্রহ্মই যে ব্যক্তির আত্মা, যার কখনও বিনাশ নেই, এমন মত উপনিষদ পড়লে বোঝা যায়। এই ধর্ম বিশ্বাস (পূজা, যজ্ঞ, উৎসর্গ, ব্রাহ্মণ প্রধান-Brahmanical) অব্যাহত ছিলো, এক সহস্র বছর (১৫০০-৪০০ খৃষ্টপূর্ব BCE, যদি ঐ সময়ে আর্যরা এসেছিলেন মনে করা হয়, ২৫০০সাল ধরলে আরও বেশী হবে), প্রায় বুদ্ধদেবের সময় পর্যন্ত।
হিন্দু শাক্য বংশের সন্তান সিদ্ধার্থ গৌতম (নির্বাণ লাভ করার পর বুদ্ধদেব) প্রায় পঞ্চাশ বছর তার ধর্মপ্রচার করে দেহত্যাগ করেন ৪৮৩ খৃষ্ট পূর্বে (BCE)। তাঁর প্রচারিত ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মৌর্যবংশের রাজা বিম্বিসার, তার পুত্র সম্রাট অশোক শুধু বৌদ্ধধর্মই গ্রহণ করেন নি, তাঁর প্রচার প্রসারে সাহায্য করেছিলেন যা সিংহল (শ্রীলঙ্কা), বর্মা, শ্যামদেশ, সুবর্ণভূমি পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
বৌদ্ধধর্ম
মূলত হিন্দু দার্শনিক কপিলের সাংখ্যদর্শনে (কার্য-কারন সম্বন্ধ) উদ্ভুদ্ধ হয়ে বুদ্ধদেব এই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর ধর্মের মূল কথা ছিল, পৃথিবীতে দুঃখ আছে, তেমনি আছে শারীরিক সুখ, লোভ, ভয়, ক্রোধ জনিত দুঃখ। এই দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় তিনি অর্জন করেছিলেন পঞ্চশীলের মাধ্যমে (হত্যা না করা, চুরি না করা, যৌন ব্যাভিচার না করা, মিথ্যা না বলা ও উত্তেজক পদার্থ সেবন না করা)। তিনি ভগবানের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি, পূজাপার্বন, যাগযজ্ঞে বিশ্বাস করেন নি, ব্রাহ্মণের পৌরহিত্য স্বীকার করেন নি। বিশ্বাস করতেন আত্মা বা পরজন্ম বলে কিছুই নেই। বর্তমান মানুষই তাঁর কাছে ছিল সকলকিছু। তাঁর ধর্মে ধনী দরিদ্রের, উঁচু নিচু জাতের ভেদাভেদ ছিল না। ব্রাহ্মণের পৌরহিত্যের দৌরাত্বে বিরক্ত বহু মানুষ বুদ্ধের এই সহজ সরল ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হন। ক্রমে পূর্বভারত থেকে, কনিষ্কের গান্ধার পেরিয়ে এই ধর্ম চীন, কোরিয়া হয়ে জাপানে পৌঁছয়। ভারতে রাজগীর ও নালান্দা হয়ে ওঠে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে লেখাপড়ার পীঠস্থান। আজ সারা পৃথিবীতে ৩০কোটি মানুষ বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস করেন, যার মধ্যে থাইল্যন্ডের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী।
ভারতে হিন্দুধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধধর্মের প্রসার চলতে থাকে ২০০BCE থেকে ৭০০-৮০০ CE পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় এক সহস্র বছর। ৮০০ শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য ও তার আগে তার গুরু গৌড়পদ নিরলস প্রয়াস করে ভারতবাসীকে আবার হিন্দু ধর্মে, ও ঈশ্বর আস্থায় ফিরিয়ে আনেন। তারপর ১২০০ সালে দিল্লীর সুলতান আমল থেকে বৌদ্ধ বিহার ধংস করা শুরু হলে, ক্রমে বুদ্ধের দেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়।
কেন বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হল?
প্রথমত বলা যায়, সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্য করা বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্ম থেকে পৃথক কিছু ছিল না। বুদ্ধদেব নতুন কিছু বলেন নি যা হিন্দু ধর্মে ছিল না। বেদ ও উপনিষদের বর্ননা করা হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি হিন্দুদের মনে এমন গভীরভাবে প্রথিত ছিল যা বুদ্ধের ধর্মপ্রচারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। মানুষের মনে বিশ্বাস স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল যে এই জন্মের দুঃখকষ্টের কারন বিগত জন্মের কর্মফল, যেখানে বুদ্ধেদেব কর্মফল বলতে বলেছিলেন ভাল কর্মে সুফল, কুকর্মে কুফল সব জন্মেই হবে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস, পূনর্জন্ম হতে হতে এক সময় মানুষ যখন মোক্ষলাভ করে তখন আত্মার আবার পূনর্জন্ম হয় না, তখন স্বর্গ লাভ হয়। বুদ্ধদেব পূনর্জন্ম সম্বন্ধে বলেছিলেন, মানুষের মৃত্যু হলে শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়, আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না, নতুন মানুষ জন্মগ্রহন করলে তার শরীর প্রকৃতি থেকে সেই পঞ্চভূত (ক্ষিতি,মরুৎ,ব্যোম,অপ,অগ্নি ) আহরণ করে (ল অফ কনজারভেশন অফ এনার্জি)। উদাহরণ হিসেবে তিনি গাছের পাতা খসে নতুন পাতার উল্লেখ করেন। নতুন করে জন্ম অবশ্যই হয়, তবে তা আত্মার নয়। এটাই বুদ্ধের পূনর্জন্ম।
আদি শঙ্করাচার্য ৭০০CE তে কেরলে জন্মগ্রহন করেছিলেন। সংস্কৃতে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন শঙ্করাচার্য হিন্দু ধর্মের বিতর্কিত বিষয় পরমব্রহ্ম, আত্মা ও মায়া সম্বন্ধীয় ভ্রান্তি দূর করে অদ্বৈতব্রহ্মের মতবাদ প্রচার করেন। তিনি বলেন, জগতের সৃষ্টিকর্তা পরমব্রহ্ম ও ব্যক্তিগত আত্মা একমেব অদ্বিতীয়ম, কোন পার্থক্য নেই (অদ্বিতীয়, দুই ভিন্ন ব্যাক্তি নয়)। পৃথিবীতে বাকি যা স্থুল চোখে দেখা যায় তা মায়া, প্রপঞ্চ।
তিনি বলেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস মানুষের মনে শান্তি আনে, ঈশ্বরের কাছে সমর্পন মনে শক্তি সঞ্চয় করে, অবিশ্বাস এই সব কিছু করে না। ভারতের চার প্রান্তে, উত্তর দক্ষিন পূর্ব পশ্চিমে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রভাব খর্ব করার জন্য চার মঠ স্থাপন করেন, যথা বদ্রিকাশ্রমে জোশী মঠ, রামেশ্বরমে শৃঙ্গেরী মঠ, পুরীতে গোবর্ধন মঠ ও দ্বারকাশ্রমে শারদামঠ। এখানে তিনি কোথাও ঋগবেদ, কোথাও সামবেদ, কোথাও যজুর্বেদ আবার কোথাও অথর্ববেদ প্রচার করতে বলেন, যাতে সনাতন ধর্ম অব্যাহত থাকে। এই সকল মন্দিরে বিষ্ণু, শিব, কৃষ্ণ, কালী মাতার পূজার প্রচলন করেন। সারা ভারতে তিনি বহু বিদ্বান ব্যক্তিকে যুক্তিপূর্ন তর্কে পরাস্ত করে নিজের অদ্বৈতবাদ মত প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও শোনা যায় তিনি কোন বৌদ্ধ পন্ডিতের সঙ্গে বিতর্ক করেন নি। পরবর্তী কালে রামানুজও অদ্বৈতবাদ মত প্রচার করেন।
ধীরে ধীরে মানুষের মন বৌদ্ধধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে। আরও তিন চারশো বছর পর বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও বিবেকানন্দর ভাষায় বলা যায়, বুদ্ধদেব আমাদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত আছেন, ধর্মে নাই থাকুন।
বুদ্ধং স্মরনম গচ্ছামি।
সুত্র: Buddha and his Dharma
সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দর্শন -স্বামী অভ্দানন্দ
উপনিষদ গ্রন্থাবলী-স্বামী গম্ভীরানন্দ
হিন্দুধর্ম- স্বামী নির্বেদানন্দ
বেদান্তের আলোকে-স্বামী বিবেকানন্দ
২৬ মে, ২০২১
*******
হিন্দু ধর্ম সংস্কারক দয়ানন্দ সরস্বতী
ষষ্ঠ থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত ভারতে যত হিন্দু ধর্মসংস্কারক জন্মেছিলেন, ওনাদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন বাঙ্গালী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজা রামমোহন রায়, কেশব চন্দ্র সেন, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, এবং আরও অনেকে। দক্ষিণ ভারতে প্রাচীনকালে সপ্তম শতকের শেষে ছিলেন আদি শঙ্করাচার্য। আধুনিক কালে উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সুদূর প্রসারী ধর্মসংস্কারক হিসেবে দেখা দেন শ্রী মূলশঙ্কর সম বেদী। তিনি ছিলেন গুজরাতের কাঠিয়াবাদ নিবাসী, যেখানে তাঁর জন্মের পঞ্চাশ বছর পরে গান্ধীজীর জন্ম হয়।
কাঠিয়াবাদ নিবাসী মূলশঙ্কেরের পিতা ছিলেন রাজ কর্মচারী, বিষয় সম্পত্তি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছিলেন এক কঠোর ব্রাহ্মণ, সকাল বিকেল বেদপাঠ, পূজাপার্বন করেন, নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন শিবের উপাসক। এহেন ব্রাহ্মণের ঘরে, বালক মূলশঙ্করও যে গোড়া হিন্দু হবেন তা বলাই বাহুল্য।
মূলশঙ্করের পিতা পূজাপাট ও উপবাসে বিশ্বাসী ছিলেন। একবার শিবরাত্রি উপলক্ষে ধুমধাম সহকারে পূজা করার পর তিনি মূলশঙ্করকে সমস্ত রাত্রি জেগে কাটাতে বলেন। মূলশঙ্কর রাতে দেখেন, ইঁদুর যথেচ্ছ ভাবে এদিক ওদিক ঘুরে প্রসাদ খেয়ে বেড়াচ্ছিল, আবার শিবমূর্তির দেহের উপরও চড়াও হচ্ছিল। মূলশঙ্কর অবাক হয়ে ভাবলেন, শিব যদি সামান্য ইঁদুর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারেন, তিনি কি করে মানুষকে রক্ষা করবেন। তার ধর্মবিশ্বাসে চিড় ধরে গেল। ধর্মবিশ্বাসী পিতা ও অবিশ্বাসী পুত্রের মধ্যে সংহাত শুরু হল। দু’জনেই ছিলেন অনমনীয় মনোভাবাপন্ন, উঁচু জাতের অভিমানী মানুষ। আপোষের কোন সম্ভবনাই রইল না। পুত্র ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। পুত্রের যাতে ঘরে মন বসে সেইজন্য তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করলেন, কন্যাও দেখা হয়ে গেল। কিন্তু পুত্রকে ঘরে রাখা সম্ভব হল না। তিনি যখন গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বাইশ বছর।
তারপর দীর্ঘ বিশ বছর ব্যাপী শুরু হল বিলাস বহির্ভূত কষ্টের জীবন। তীর্থক্ষেত্রে, বনে জঙ্গলে, হিমালয়ের পাদদেশে ঘুরে বিভিন্ন জ্ঞাণীগুণীজনের সান্নিধ্যে এসে প্রকৃত হিন্দু ধর্মের মর্ম বোঝার চেষ্টা করলেন। তার এই প্রচেষ্টার অনুরুপ দেশের পূর্ব প্রান্তের অপর এক যুবক, নরেন, বহুবছর পর একই পথে জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেছিলেন। তফাতের মধ্যে নরেনের এক গুরু ছিলেন রামকৃষ্ণ, যার ফলে দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। নরেন শুধু জ্ঞান আরোহনই করতেন না, রাজা মহারাজা থেকে ধনী দরিদ্র, নীচু জাতের লোকের সঙ্গে মিশে তাদের আশা আকাঙ্খা, দুঃখ, দুর্দশায় ভাগ নিতেন। মূলশঙ্করের একটাই লক্ষ্য ছিল, সঠিক হিন্দুধর্মই বৈদিক মতের হিন্দু ধর্ম কি তাই জানা।
সিংহের মত পরাক্রমী, বজ্রগম্ভীর কন্ঠস্বর, নিত্য যোগাভ্যাস করা সুগঠিত শরীরের অধিকারী মূলশঙ্কর শুধু সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন আর বৈদিক যুগের আচার ব্যবহার, ধর্ম থেকে ভারতীয় সমাজ কি ভাবে বিচ্যুত হয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিতবর্গ নিজের ক্ষমতাবৃদ্ধি করছে ও সাধারন মানুষকে বেদের পঠন থেকে বিরত করার প্রয়াস দেখে প্রতিকার করার কঠোর সঙ্কল্প করলেন। তিনি চারিদিকের কুসংস্কার, প্রকৃত ধর্মের অজ্ঞতা, মূর্তি পূজার বাহুল্য, গঙ্গাস্নান করার প্রবনতা, ইত্যাদি দেখে তীব্র বিরোধীতা শুরু করলেন। এই উদ্যোগে মথুরার এক মহান গুরু ছিলেন তাঁর প্রধান সহায়। তাঁর শিক্ষায় তিনি এতটাই প্রভাবিত হন যে নিজের পৈত্রিক নাম পর্যন্ত ত্যাগ করে গুরুর নামে পরিচিত হন।
এরপর সমগ্র উত্তর ভারতে আর্যধর্মের মূল বক্তব্যের প্রচার শুরু করলেন। দেশের কুসংস্কারমতি ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের তর্কে পরাস্ত করে বৈদিক ধর্ম প্রচার করলেন। তাঁর তর্কের যুক্তি এতই জোরালো ছিল যে তাকে বন্যার জলের সঙ্গে তুলনা করা হত। ক্রমাগত হারে উন্মত্ত হয়ে পন্ডিতরা মূলশঙ্করকে হিন্দুদের চরম পীঠস্থান বেনারসে ডাকলেন। শত শত পন্ডিত চাইতেন যে তিনি পরাস্ত হয়ে হার মানুক, কিন্তু বেনারসের তিনশো গোড়া পন্ডিতদের এক সাথে তর্কে পরাস্ত করে তাদের বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। তিনি প্রমান করেছিলেন তাঁদের অনুসৃত রীতি প্রাচীন বৈদিক রীতির বিরোধী। পরাস্ত পন্ডিতরা সমবেতভাবে মূলশঙ্করকে কটূক্তি করে সমাজ থেকে বহিস্কার করায় কিছুদিনের জন্য তাঁর মনে বিষাদ ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মহাভারতের মত এই তর্কযুদ্ধের খবর সারা ভারতে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে, দলে দলে লোক আর্য সমাজের অনুগামী হন। আদি শঙ্করাচার্যের পর তিনিই ছিলেন বৈদিক ধর্মপ্রচারের আর এক মহানজ্ঞানী ও নির্ভিক সৈনিক।
অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর মনোভাব খুব সদয় ছিল না। মুসলমান ধর্মে বিধর্মীদের কাফের বলে হত্যার আদেশ তিনি মানতে পারেন নি। খৃষ্টধর্মকে ভন্ডামি বলেছেন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন, শিখধর্মকেও ভাল চোখে দেখেন নি, কিন্তু গুরু গোবিন্দ সিংকে তাঁর বিক্রমের জন্য শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এইসকল স্বাধীন মনোভাবের জন্য তাঁর শত্রুর অভাব হয় নি। তাঁর পাঁচবার জীবননাশের চেষ্টা হয়, প্রতিবারই তিনি শারীরিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তার জোরে রেহাই পান। একবার এক ব্যক্তি তার শরীরে কেউটে সাপ ছুড়ে দিয়েছিলেন, মূলশঙ্কর সেই কেউটে সাপকে থেঁতলে মারেন। আর একবার দুজন তাঁকে নদীর জলে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করেন, মূলশঙ্কর হটযোগের সাহায্যে বহুক্ষণ জলে ভেসে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেন।
১৫ই ডিসেম্বর ১৮৭২ থেকে ১৫ই এপ্রিল ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন। রামকৃষ্ণদেবের সাথে সাক্ষাত করেন। কেশব সেনের ব্রাহ্মসমাজ নিজেদের পশ্চিম সভ্যতার শিক্ষিত হওয়া সত্তেও মূলশঙ্করকে আদরপূর্বক গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মূলশঙ্কর তার বৈদিক মত থেকে একটুও নড়েন নি, ফলে তাঁদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয় নি। তবে একটা ধারনা তাঁর মনে উদয় হয়, সাধারন লোকজনকে তার বৈদিক ধর্ম বিষয়ে জাগরুক করতে হলে সহজ সরল হিন্দি ভাষাই ব্যবহার করতে হবে।
১০ই এপ্রিল ১৮৭৫ সালে তিনি বম্বে শহরে প্রথম আর্য সমাজ বা এসোসিএসনের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৭ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত উত্তর ভারত, রাজপুতানা, গুজরাত, ইউনাইটেড প্রভিন্সের আগ্রা, অয়োধ এবং পাঞ্জাবে তাঁর সব শাখা ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় সমস্ত ভারতেই এই প্রভাব পড়ে, একটা রাজ্য বাদে, মাদ্রাজ, সেখানে আশ্চর্যজনক ভাবে কোন প্রভাবই পড়ে নি।
মূলশঙ্কর মাত্র ৫৯বছর বয়সে এক চক্রান্তের শিকার হয়ে মারা যান। যোধপুরের মহারাজার অতিথি হয়ে তিনি যোধপুর গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রাসাদে এক নর্তকীকে দেখে তিরস্কার করেন। প্রতিশোধ নেবার জন্য নর্তকী মহারাজের পাচককে ঘুষ দিয়ে হাত করেন। পাচক রাতে মূলশঙ্করের দুধের সাথে মিহি কাঁচের গুড়ো মিশিয়ে দেন। সেই কাঁচ মিশ্রিত দুধ পান করে মূলশঙ্কর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পাচক অনুতপ্ত হয়ে দোষ স্বীকার করলে মূলশঙ্কর তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না, তাকে টাকা দিয়ে রাজার রোষ থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে যেতে বলেন। এদিকে মূলশঙ্করের অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় তাঁকে প্রথম আবুতে ও পরে আজমেরে পাঠানো হয় ভাল চিকিৎসার জন্য। সব প্রচেষ্টা ব্যার্থ করে তিনি আজমেরেই মারা গেলেন। আজও আজমের শহরের আন্নাসাগর লেকের তার স্মৃতিসৌধ বানানো আছে, যেখানে তার অস্থি আছে। তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।
মূলশঙ্কর (১৮২৪ – ১৮৮৩), ভারতে পরিচিত হন -দয়ানন্দ সরস্বতী নামে
গুরুর নাম: স্বামী ভির্যানন্দ সরস্বতী
সুত্র- Life of Ramkrishna by Romain Rolland first published 1929
Add comment