কল্হনের রাজতরঙ্গিনী (প্রথম তরঙ্গ)
চন্দন গুহ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
তরঙ্গিনী শব্দের অর্থ নদী, রাজতরঙ্গিনী শব্দটির অর্থ রাজাদের প্রবাহ বা River of King, সহজ ভাষায় রাজাদের ইতিহাস।
১১৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৫০ সালের মধ্যে কোন একসময় লেখক কল্হন কাশ্মীরের রাজাদের ইতিহাস রাজতর্ঙ্গিনী রচনা করেন। লেখক সম্বন্ধে খুব বিশেষ জানা যায় না। এখানে কল্হন শব্দের অর্থও খুব স্পষ্ট নয়, সংস্কৃত শব্দ কল্যাণ থেকেও অপভ্রংশ হয়ে আসতে পারে। লেখক নিজের পরিচয়ও ভাল করে দেন নি, কারন সেই যুগে পাঠককুল লেখা ও কাহিনীকেই প্রাধান্য দিতেন, লেখকের পরিচয়ে অতটা নয়। তবে সংস্কৃত ভাষায় কাহিনীর অষ্টম স্বর্গে পাওয়া যায় “এই রুপে কল্হন, যিনি মহান রাজকর্মচারী চম্পকের পুত্র, তাঁর লেখা শেষ করলেন”। এই লেখা থেকে উপলব্ধি হয় যে কলহন এক রাজ কর্মচারী চম্পকের পুত্র ছিলেন। তিনি যে ব্রাহ্মণ কুলের ছিলেন, এই পরিচয়ও তাঁর লেখা থেকেই প্রমাণ হয়।
রাজতরঙ্গিনী এক বিশাল কাব্য ,৩৪৪৯ শ্লোক বিশিষ্ট আট স্বর্গে বিভক্ত। ১৯৩৪ সালে দেরাদুন জেলে জওহরলাল নেহেরু বন্দি থাকার সময় রঞ্জিত সীতারাম পন্ডিত নামের একজন কংগ্রেস বন্দির সান্নিধ্যে আসেন। তিনি নেহরূজীকে বলেছিলেন যে তিনি কল্হনের রাজতরঙ্গিনীর ইংরেজী অনুবাদ করতে আগ্রহী। সাহিত্যনুরাগী জওহরলাল, নিজেও কাশ্মীরী ছিলেন, তাঁকে এই অনুবাদ লিখতে উৎসাহ প্রদান করেন। পরে বইটি লেখা সম্পূর্ন হলে জওহরলাল নেহেরু নিজে সেই বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দেন। সেই বইয়েরই কিছু কিছু চিত্তাকর্ষক অধ্যায়ের বাংলা রুপান্তর এখানে লিখব। ইংরেজী থেকে আমার বাংলা অনুবাদ দূর্বল হবেই, আগেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
রাজা যুধিষ্ঠির, প্রথম।
ইনি মহাভারতের পঞ্চপান্ডবের যুধিষ্ঠির নন, তাঁর পিতার নাম ছিল নরেন্দ্রাদিত্য। ইনি স্বভাবে ছিলেন ধার্মিক, মহৎ রাজা, যার রাজত্বে প্রজাদের কোন অভিযোগ ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সুত্রে রাজা হলেন যুধিষ্ঠির প্রথম, যার চোখ দুটি খুব ছোট ছিল বলে সাধারনে তাঁকে অন্ধ যুধিষ্ঠির বলে অভিহিত করতেন। রাজত্বকালের প্রারম্ভে তিনি পূর্বসূরী রাজাদের প্রদর্শিত পথই অনুসরন করে রাজত্ব করেন। দূর্ভাগ্যবশত, ক্ষমতার গর্বে, কৃতকার্যের দম্ভে তিনি হয়ে উঠলেন খামখেয়ালী। দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্ত ব্যক্তিগন তাঁর বিশ্বস্ত ছিলেন, যারা বুদ্ধিমত্বার সাথে এতদিন রাজকার্যে সহায়তা করেছিলেন, তাঁদের তিনি অনাদরে উপেক্ষা করা শুরু করলেন। সকল ব্যক্তি বা প্রজাকে শাশনকার্যে একই মানদন্ডে তুলনা করা রাজার মহৎ গুণ হতে পারে, কিন্তু রাজকার্য পরিচালনায় এই নীতি অনূকূল নয়। ফলস্বরূপ বুদ্ধিমান লোকজন রাজাকে পরিত্যাগ করলেন।
ক্রমে ক্রমে চাটুকারের দল রাজার দোষগুলিকে গুণ আর সদগুণকে দোষ প্রতিপন্ন করে দিলেন। রাজাও হয়ে উঠলেন নিষ্প্রভ ব্যক্তিত্বহীন। তাঁর সংবেদহীন কথায় সাধারণ প্রজারা দুঃখিত। দীর্ঘ সময় ধরে ঠাট্টা মজা বা ভাঁড়ামি করা, চাটুকারদের সঙ্গে সময় কাটানো, এগুলি রাজগরিমার পরিপন্থী হয়ে উঠলো, হয়ে উঠলো ভয়ের কারন। কাউকে সামনে প্রশংসা করে তার অনুপস্থিতিতে তার দোষের ভৎসনা করার প্রবনতা দেখে মানুষ রাজার উপর ভরসা করা ছেড়ে দিলেন। আর মতিভ্রষ্ট রাজা এইদিকে কোন নজরই দিলেন না, ফলে তাঁর রাজ্য স্থিতিশীলতা হারিয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে গেল।
যে সকল ব্যক্তি আগে রাজার সভাসদ ছিলেন না, গুণী, বুদ্ধিমান ও সৎ সভাসদদের প্রতি ঈষান্বিত ছিলেন, সেই চাটুকারেরাই এখন ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেলেন। রাজার ক্ষমতার দুর্বিনীত অপপ্রয়োগ ও রাজ্যের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজপুত্ররা এই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার জন্য লালায়িত হয়ে উঠলেন।
পাহাড়ের নিচে রাস্তায় কর্মরত শ্রমিক অসহায় ভীত হয়ে দেখে যখন উপর থেকে বড় পাথর স্খলিত হয়ে নিচে পড়ে, রাজা যুধিষ্ঠিরও তেমনি আর কোন উপায় খুঁজে পেলেন না কি ভাবে রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সুগঠিত করে পুনরায় নিজের কতৃত্ব জারি করবেন। দীর্ঘদিনের ভঙ্গুর শাসনপ্রনালীর কারনে এই আপৎকালীন অবস্থায় রাজার কোন আপষসুত্রই স্থায়ী সমাধান বলে মনে হল না। অন্যদিকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সভাসদদের মনে এই আশঙ্কাও ছিল যে রাজা আবার শাসন ফিরে পেলে তাঁদের সকলের মৃত্যুদন্ডর সম্ভাবনা আছে। তাঁরা সকল আপষ সুত্র অস্বীকার করলেন। পরিনামে ক্ষমতালোভী চাটুকাররা সন্মিলিতভাবে নিজেদের এক গোষ্ঠী তৈরী করে সসস্ত্র সৈন্যসহ রাজপ্রাসাদ অবরোধ করলেন। সৈন্যদের রণদামামার গম্ভীর আওয়াজে রাজপরিবারের ভীত আর্তনাদ কোথায় হারিয়ে গেলো! উন্মত্ত রণহস্তীর ইতস্থত চলাচল জমির ধুলো উড়িয়ে রাজপ্রাসাদকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিলো। অবশেষে বিপক্ষের প্রস্তাবে রাজা দেশত্যাগে সম্মত হলেন ও যুদ্ধবিরাম ঘোষিত হলো। পাহাড়ের উপর থেকে বিচ্যুত বিশাল পাথর যেন ফলযুক্ত গাছ, সাথে লতা, গুল্ম নিয়ে জমিতে আশ্রয় নিলো। নির্ধারিত সময়ে রাজা তার শ্রীনগর রাজপ্রাসাদ থেকে যখন বাইরে যাওয়ার পথ ধরলেন, তখন রাস্তায় চিরাচরিত প্রথায় পুষ্প ও শুষ্ক শস্য বৃষ্টির পরিবর্তে ঘোড়ার খুরে ওঠা ধুলায় ধুসর রাজপরিবারের মহিলাদের কোমল দেহ দেখে সব প্রজার অশ্রু বন্যা বহে গেল। যুদ্ধশেষে শত্রুপক্ষ সিংহাসনচ্যুত রাজার সমস্ত ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে পাত্র, মিত্র, দাসদাসী সবাইকে বিতাড়িত করে দিলেন।
পাহাড়ের কোলে সবুজ গাছ পালা শোভিত আঁকা বাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে রাজা অবসাদে ক্লান্ত হয়ে কখনও গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করলেন, আবার কখনো পথে চলতে চলতে নিজের দুঃখ বেদনাও ভুলে গেলেন। দূর হতে বাতাসে ভেসে আসা শত্রুদের পৈশাচিক উল্লাস তার কানে আসলে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত হচ্ছিলেন। পাহাড়ের ঝরনার জল যেমন কোন গভীর খাদে নিমজ্জিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়, তেমনি ছিলো তাঁর মনের অসহায় অবস্থা। ইতিমধ্যে বনের মধ্যে দিয়ে নানা ফুলফলে মঞ্জরিত মনোরম সুঘ্রান রাস্তা অতিক্রম করে, নির্মল জলের স্রোতঃস্বিনী ও শেওলাভরা পাথরের উপর দিয়ে পার হয়ে রানী পরিশ্রান্ত হয়ে তার মৃণাল বাহুদ্বয় রাজার কোলে প্রসারিত করে মূর্ছিত হয়ে পরলেন।
রানী জ্ঞান ফিরে পেলে পুনরায় পথ চলা শুরু করে পাহাড়ের শেষে রাজ্যের সীমান্তে রাজ পরিবারের মহিলারা অঞ্জলীভরে ফুল নিবেদন করে নিজেরদের রাজ্য থেকে যখন বিদায় নিলেন, সমস্ত বিহঙ্গকুল তাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে ডানা বিস্তার করে চঞ্চু মাটির দিকে নির্দেশ করে যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল! রাজপরিবারের মহিলাদের শরীরের উর্ধভাগের অঙ্গবস্ত্র, যা দিয়ে তাদের বক্ষ আবরন করা থাকে, স্খলিত হয়ে পড়ল যখন তারা তাদের মাতৃভূমিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষবারের মত প্রনাম জানালেন। আর রাজ্যের বাইরের উপজাতি প্রধান, রাজাকে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার বিগত দুঃখ কষ্ট লাঘব করতে সাহায্য করল।
******
• সংকৃত কাব্যে আটটি কাব্যরস (sentiment) আছে যেমন, শৃঙ্গার(love), হাস্য (merriment), করুনা (pathos), রুদ্র(wrath), বীর(martial), ভয়ানক(terror), বিভৎস(repulsion) ও অদ্ভূত (marvel).
• কল্হনের রাজতঙ্গিনী কাব্যের প্রথম তরঙ্গের শেষে এই করুণা বা pathos খুব নিপুণ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে শেষ কিছু স্তবকে, যেখানে সিংহাসন চ্যুত রাজা পাহাড়, বনের মধ্যে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন, সুমধুর ঘ্রানযুক্ত অরণ্য পার হচ্ছেন, বা রানীরা শেষ বারের মত মাতৃভূমিকে প্রণাম করছেন। সংকৃত কাব্যে এই করুণা যত নিপুন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, রঞ্জিত সীতারাম পন্ডিতের ইংরেজি অনুবাদে ততটা প্রকাশ পায় নি (লেখকের নিজের স্বীকারোক্তি)। আর আমার নিজের এই লেখার উৎকর্ষতা নিয়ে নিজে নাই বা বললাম।
• আধুনিক যুগের ইতিহাসে এক মুর (Moors) রাজার এইরকম করুণার কাহিনী শোনা যায়। শেষ Moorish রাজা Boabdil কে ১৪৯২ সালে স্পেনের Castilian থেকে যখন বহিস্কার করা হয় তখনও রাজ পরিবার Padul পর্বত থেকে শেষ বারের মত ফিরে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। Granada অঞ্চলে যেখানে Boabdil শেষ বারের মত বিদায় নেন, তা আজও El ultimo sospiro del moro “The last sigh of the Moor“ নামে জানা যায়।
বহু পুরনো ভুলে যাওয়া ইতিহাস।
লেখক ও পত্রিকা পরিচালকদের অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।