সরস্বতী পূজা, কিছু কথা
উত্তম খান, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রশান্ত চন্দ্র, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সরস্ ও বতী – এই দুই সংস্কৃত শব্দের সন্ধির দ্বারা সরস্বতী নামের উৎপত্তি। সরস্ শব্দের প্রচলিত আক্ষরিক অর্থ হ্রদ বা সরোবর। কিন্তু এটির অপর অর্থ “বাক্য”; আর বতী শব্দের অর্থ যিনি অধিষ্ঠাত্রী। এই নামটির আদিতে এক বা একাধিক নদীর সঙ্গে যুক্ত হলেও এই নামটির উভয় আক্ষরিক অর্থ হয় “যে দেবী পুষ্করিণী, হ্রদ ও সরোবরের অধিকারিণী” বা ক্ষেত্রবিশেষে “যে দেবী বাক্যের অধিকারিণী”। এর উপরেও সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী “সরস্বতী” শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করলে নামের অর্থ হয় “যা প্রচুর জল ধারণ করে”।
হিন্দুশাত্রের ঋগ্বেদে সরস্বতীর দেবী রূপে সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। দেবীর মান্যতা বিদ্যা, জ্ঞান, সংগীত, শিল্প, সংস্কৃতি, কলা, ও বাক্যের অধিষ্টাত্রী দেবী রূপে। আর সরস্বতী, লক্ষী ও পার্বতীর একত্রে হিন্দুশাত্রে ত্রিদেবী নামেও উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক যুগের প্রারম্ভ হতে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত সরস্বতী হিন্দুধর্মের একজন অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্টিতা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তিনি কখনো দ্বিভূজা, আবার কখনো বা চতুর্ভূজা মূর্তিতে পূজিতা হন। দ্বিভূজা মূর্তিতে তাঁর হাতে থাকে পুস্তক ও বীণা, চতুর্ভূজা মূর্তিতে থাকে পুস্তক, বীণা, অক্ষমালা, ও কলস। হিন্দুধর্মে এই প্রতিটি বস্তুরই প্রতীকী অর্থ আছে।
যদিও সরস্বতী বৈদিক দেবী, তথাপি সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালেই প্রচলিত হয়েছে। প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত পুস্তক, বা শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। ইতিহাসে গ্রামাঞ্চলেও এই প্রথার বিবরন পাওয়া যায়। ক্রমে ক্রমে শহরে ধনীরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা আরম্ভ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় আনুমানিক বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
হিন্দুদের, বিশেষত পূর্ব ভারতের একাংশ সরস্বতীর পূজা করেন মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথির দিনটিতে, এই বিশেষ দিনটি বসন্তপঞ্চমী বা শ্রীপঞ্চমী নামেও উল্লেখিত হয়। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে বাঙালীদের ঘরে ঘরে এই পূজা হয়, আর এই বিশেষ দিনটিতে শিশুদের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের (প্রথম অক্ষর শিক্ষার অনুষ্ঠান) আয়োজনও করা হয়। ভারতবর্ষের অনেক জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও সরস্বতীর পূজা করেন। বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবীর আরাধনা পূর্ব ভারতের একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব এবং এই পূজা উপলক্ষে বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। এইদিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। এই পূজার অঙ্গস্বরূপ সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়। পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত।
ঋগ্বেদে সরস্বতী নামের অর্থ নদী ও বিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ এক দেবী, উভয়ই। প্রাথমিক পংক্তিগুলিতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সরস্বতী নদী অর্থে এবং দৃশদ্বতী সহ বিভিন্ন উত্তরপশ্চিম ভারতীয় নদীর নামের সঙ্গে একই সারিতে। তারপর সরস্বতীকে এক নদী দেবতা হিসেবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে সরস্বতীকে শ্রেষ্ঠ মাতা, শ্রেষ্ঠ নদী ও শ্রেষ্ঠ দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে:
অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি— ঋগ্বেদ ২.৪১.১৬
সরস্বতী মাতৃকাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে সরস্বতীকে প্রবহমান জলের আরোগ্যদাত্রী ও পাবনী শক্তির দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে:
অপো অস্মান মাতরঃ শুন্ধয়ন্তু ঘর্তেন নো ঘর্তপ্বঃ পুনন্তু।
বিশ্বং হি রিপ্রং পরবহন্তি দেবিরুদিদাভ্যঃ শুচিরাপুত এমি।। — ঋগ্বেদ ১০.১৭
অর্থাৎ মাতৃস্বরূপা জলসমূহ আমাদের পরিশুদ্ধ করুন, যাঁরা ননীর দ্বারা শোধিত হয়েছে, তাঁরা আমাদের ননীর দ্বারা পরিশুদ্ধ করুন, কারণ এই দেবীগণ কলুষ দূর করেন, আমি এদের থেকে উঠে আসি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়ে। — জন ম্যুয়ারের অনুবাদ অবলম্বনে
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে সরস্বতী “জ্ঞানের অধিকারিণী” নামে পরিচিত। ঋগ্বেদের পরবর্তী যুগে রচিত বেদগুলিতে (বিশেষত ব্রাম্মণ অংশে) সরস্বতীর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এই গ্রন্থগুলিতেই শব্দটির অর্থ “পবিত্রতাদানকারী জল” থেকে “যা পবিত্র করে”, “যে বাক্য পবিত্রতা দান করে”, “যে জ্ঞান পবিত্রতা দান করে” অর্থে বিবর্তিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা এমন এক দেবীর আধ্যাত্মিক ধারণায় রূপ গ্রহণ করে যিনি বিদ্যা, জ্ঞান, শিল্প, কলা, সংগীত, সুর, কাব্য-প্রতিভা, ভাষা, অলংকার, বাগ্মীতা, সৃজনশীল কর্ম এবং যা কিছু একজন মানুষের অন্তঃস্থল বা আত্মাকে পবিত্রতা দান করে তার প্রতিভূ হয়ে ওঠেন।
প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী নানা নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ব্রম্মাণী (ব্রম্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী), ভারতী (ইতিহাসের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) ইত্যাদি নাম। আবার সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), বীণাপাণি (যাঁর হাতে বীণা শোভা পায়), হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাগ্দেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত।
অপর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “সর” শব্দের অর্থ “সার” বা “নির্যাস” এবং “স্ব” শব্দের অর্থ “আত্ম”। সেই অর্থে “সরস্বতী” নামের অর্থ “যিনি আত্মার সার উপলব্ধি করতে সহায়তা করেন” অথবা “যিনি (পরব্রম্মের) সার ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে মিলিত করেন”।
বাংলা ভাষায় দেবী সরস্বতী বিভিন্ন নামে পূজিতা হন। বাগদেবী, বীণাপাণি, পদ্মাসনা, হংসারূঢ়া, সারদা, শতরূপা, বাণী, ভারতী, হংসবাহনা, শুক্লা, শ্বেতভূজা, বাঙ্ময়ী, ইত্যাদি বিভিন্ন নামে। এছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে দেবী বিভিন্ন নামে পূজিতা। তেলেগু ভাষায় চদুবুলা তাল্লি বা শারদা নামে। কোঙ্কণি ভাষায় শারদা, বীণাপাণি, পুস্তকধারিণী ও বিদ্যাদায়িণী নামে। কন্নড় ভাষায় শারদে, শারদাম্বা, বাণী ও বীণাপাণি নামে, তামিল কলৈমগল, নামগল, কলৈবাণী, বাণী ও ভারতী নামে।
প্রতিমা ও পূজা
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত প্রতিমাকল্পে সরস্বতী দেবীকে শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতবর্ণা, পদ্মলোচনা, মুক্তাহারে ভূষিতা ও বীণাপুস্তকধারিণী নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
বিবরণে আছে,
ওঁ তরুণ শকল মিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ সকলবিভবসিদ্ধ্যৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।
অর্থাৎ, “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেতপদ্মাসনে (উত্তমরূপে) আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভিত বাগ্দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”
আবার পদ্মপুরাণে বর্ণিত আছে,
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা॥১
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা॥২
অর্থাৎ, “দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা॥১॥
অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা॥২॥
ক্ষেত্রবিশেষে দেবী সরস্বতী দেবী দ্বিভুজা অথবা চতুর্ভুজা এবং হংসবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা রূপেও পূজিতা হন। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী প্রতিমার পূজা হয়। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভুজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা।
শ্রীবাসন্তীপঞ্চমীর দিন সকালে দেবী সরস্বতীর পূজা হয়। সরস্বতীর পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা: আম্রমুকুল, দোয়াত কলম, অভ্র-আবীর, ও যবের শিষ। এই পূজায় বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল ভক্ষণ করেন না। লোকাচারে পূজার দিন বিদ্যার্থীদের কিছু পড়া বা লেখাও নিষিদ্ধ। কবি, লেখক, গায়ক, যন্ত্রশিল্পী, নাট্যকার বা নৃত্যশিল্পী, প্রত্যেকেই তাদের যন্ত্রের আরাধনা এবং মা সরস্বতীর পূজায় দিন শুরু করেন। আর যথাবিহিত পূজার পর লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় বা পরের দিনে প্রতিমার বিসর্জন হয়।
পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বঙ্গভূমে শ্রী শ্রী সরস্বতী পুষ্পাঞ্জলি-মন্ত্র —
ওঁ জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগশোভিতমুক্তাহারে।
বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে, ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥
ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ॥
এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলিঃ ঐং সরস্বত্যৈ নমঃ॥
প্রণাম-মন্ত্র:
সরস্বতি মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোঽস্তু তে॥
সরস্বতীর স্তবঃ
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা॥
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা॥
বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈরর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।
পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈর্ ঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা॥
স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।
যে স্মরন্তি ত্রিসন্ধ্যায়াং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে॥
দেবীভাগবতপুরাণে পরম কুস্মন্দেরে প্ৰথম অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। তিনি বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী। চতুর্মুখ ব্রম্মা সর্ব প্রথম তাঁর পূজা করেন। এরপরে জগতে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা। যখন তিনি নারায়ণের থেকে সৃষ্ট হন তখন তিনি তাঁকে নারায়ণকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে তিনি গঙ্গার দ্বারা অভিশাপ পান ও তিনি এক অংশে পুনরায় শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্ট হন ও ব্রহ্মাকে পতিরূপে গ্রহণ করেন। তারপর কৃষ্ণ জগতে তাঁর পূজা প্রবর্তন করেন, এবং মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে তাঁর পূজা হয়।
গঙ্গা, লক্ষী ও আসাবারী (সরস্বতীর পূর্ব জন্মের নাম) ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নী। একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে তিন দেবীর মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। এই বিবাদের পরিণামে একে অপরকে অভিশাপ দেন। গঙ্গার অভিশাপে আসবারী নদীতে পরিণত হন। পরে নারায়ণ বিধান দেন যে, তিনি এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও শিবের কন্যা হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছরের অবসানকালে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে। এরপর গঙ্গার অভিশাপে আসাবারি মর্ত্যে নদী হলেন এবং পরবর্তীকালে ব্রহ্মার পত্নী হলেন ও শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হয়ে তার কন্যা হলেন।
শুক্ল যজুর্বেদ
সরস্+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতির্ময়ী। ঋগ্বেদে এবং যজুর্বেদে বহুবার ইড়া, ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় ধারণা হয় যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী ব্রহ্মাপ্রিয়া সরস্বতী তাঁর ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।
তথ্যসংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ উইকিপিডিয়া
সরস্বতীর ধ্যান
তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ
কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাব্জে ।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ
সকলবিভবসিন্ধ্যৈ পাতু বাগদেবতা নঃ ।।
এর অর্থ- চন্দ্রের তরুণ অংশের ন্যায় যাঁর কান্তি শুভ্র, যিনি কুচভরে অবনতাঙ্গী, যিনি শ্বেত পদ্মাস্থনা , যাঁর নিজ কর কমলে উদ্যত লেখনী ও পুস্তক শোভিত , সকল ঐশ্বর্য সিদ্ধির নিমিত্ত সেই বাগদেবী আমাদিগকে রক্ষা করুন।
সরস্বতীর জপ মন্ত্রঃ
ওঁ বদ্ বদ্ বাগ্বাদিনি স্বাহা।
তথ্য সুত্র – https://www.patrika.com/astrology-and-spirituality/
*********
সেকালের সরস্বতী পূজো – যেমন দেখেছি
প্রশান্ত চন্দ্র, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রথম পর্ব – হাতেখড়ি ও পুষ্পাঞ্জলি
সরস্বতী পূজোর কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমার মনে পড়ে হাতেখড়ি আর পুষ্পাঞ্জলির কথা। বাঙ্গালীর ছেলে অথচ ছোটবেলায় সরস্বতী ঠাকুরের কাছে স্লেট পেন্সিল নিয়ে হাতেখড়ি হয়নি, এরকম কাউকে বোধহয় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আর এই একটিমাত্র পূজোতেই দেখা যেত সকল আবালবৃদ্ধবনিতা পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য খুব সকালেই স্নান করে পুজোর প্যান্ডেলে গিয়ে উপস্থিত হন। আমরাও অতি উৎসাহীর দল খুব সকালেই স্নান সেরে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে হাজির হয়ে যেতাম আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে হাসপাতালের মাঠে নবীন সংঘের প্যান্ডেলে। পুষ্পাঞ্জলির সময় বড়দের দেখাদেখি হাতে ফুল বেলপাতা নিয়ে পুরোহিত মশাইয়ের অনুসরণে মন্ত্র আওড়াতাম। কিন্তু, মন্ত্রের কথাটা যে ‘বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ’ নয়, ‘বিদ্যা স্থানেভ্য চ’ হবে এবং কথাটার আসল অর্থ যে কি, সেটা বুঝতে সময় লেগে ছিল আরও বেশ কয়েক বছর।
হাতেখড়ি ও পুস্পাঞ্জলি ছাড়া আরও একটা উদ্দীপনা লক্ষণীয় ছিলো, যা সে সময় শুধুমাত্র সরস্বতী পূজোতেই দেখা যেত আর সেটা হলো রাস্তায় চাঁদা তোলার হিড়িক। সরস্বতী পূজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কিছু ছেলেরা রাস্তায় যাকে পাচ্ছে, সে লোকজন হোক বা গাড়ি বা ট্রাক দাঁড় করিয়েই হোক, সকাতর চাঁদার অনুরোধ করতো। ৭-৮ বছরের ছোট ছোট ছেলেরাও, পড়নে হাফপ্যান্ট, রাস্তা দিয়ে যে কেউ হেঁটে যাচ্ছে, তার পেছনে খালি পায়ে দৌড়চ্ছে, আর বলছে ‘ও কাকু (বা জেঠু বা দাদু) চাঁদাটা দাওনা’। এই ছেলেগুলোই আবার যখন পাড়ায় হারুদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াত, আর বারান্দায় বসে থাকা হারুর জ্যাঠামশাই খবরের কাগজ থেকে চশমা সমেত চোখটা তুলে গম্ভীর গলায় বলতেন ‘সরস্বতী বানানটা বলতো’, ছেলেগুলো যেন পালিয়ে বাঁচে। হারুর জ্যাঠামশাই অবশ্য ওদের অনেক বকা ঝকা করে শেষ পর্যন্ত পাঁচ বা দশ পয়সা চাঁদা দিয়েই দিতেন।
আমি যখন খুবই ছোট, তখন আমরা বাড়ির সকলে সরস্বতী পুজোর দিন চলে যেতাম শিবপুরে আমাদের বড় জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। জ্যাঠামশাই একটা বড় সরস্বতী মূর্তি এনে বাড়িতে বসার ঘরে স্থাপন করতেন। খুব সকাল সকাল পুরোহিত মশাই চলে আসতেন। তারপর পূজো হয়ে গেলে মা ও জ্যাঠাইমা রান্না ঘরে ব্যস্ত হয়ে যেতেন খিচুরি, ভাজা, পায়েশ এইসব রান্না নিয়ে। বাবা জ্যাঠামশাইরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেন। বড়দা বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে চলে যেত। আর আমরা তিন ভাইবোন, বড়দি, মেজদি, মেজদা ও ঠাকুমার সঙ্গে লুডো খেলে আর গল্প করে সারাদিন খুব মজা করে আনন্দে কাটিয়ে দিতাম। পাঁচ বছর বয়সে স্লেট পেন্সিলে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল এই জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতেই।
কখনও কখনও সরস্বতী পুজোর সময় আমরা কাটোয়ায় আমাদের মামার বাড়ি চলে যেতাম। আশেপাশে অনেক ক্লাবের ছোট ছোট পুজো হতো আর ক্লাবের ছেলেরাই নিজেদের মতন করে খুব সুন্দর সাজাতো। সব থেকে মজা হতো বিসর্জনের দিন সন্ধ্যাবেলায় আমরা যখন মামার বাড়ির কাছে বারোয়ারি তলার মাঠে গিয়ে জড়ো হতাম আর সামনের রাস্তা দিয়ে একের পর এক ক্লাবের ঠাকুরগুলো মিছিল করে নিয়ে যেত। মিছিলে থাকতো নানান রঙের আলোর রোশনাই। আরেকটা আকর্ষণ ছিলো রঙ বেরঙের জামাকাপড় পড়া লোকেদের ব্যান্ডের বাজনা। লাইন দিয়ে একটার পর একটা ব্যান্ড পার্টি আসতো। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীপুজোর বিসর্জনের মতই বিখ্যাত ছিল কাটোয়ার সরস্বতীপুজো ও কার্ত্তিকপুজোর বিসর্জন।
দ্বিতীয় পর্ব – পাড়ার পুজো ও স্কুলের পুজো
ক্লাস ফাইভে উঠে আমি যখন প্রাইমারী স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হলাম, তারপর থেকেই সরস্বতী পুজোর সময় জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি বা মামার বাড়ি আর যাওয়া হতো না। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে হাসপাতালের মাঠে নবীন সংঘের প্যান্ডেলেই কাটতো আমাদের সরস্বতী পুজো। এই পুজোর অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত আমাদের মাতামাতি। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যেত ডিসেম্বর মাসের আগেই। পরীক্ষা হয়ে যাবার পর আমাদের রোজকার রুটিন ছিল সকাল থেকেই পাশের আমবাগানের মাঠে ক্রিকেট খেলা, মাঝে মাঝে দুপুরে খাওয়ার পর পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া দু কিমি দূরে পোটোপাড়ায় আর সব পোটোর চালায় ঘুরে ঘুরে দেখা কাদের ঠাকুর তৈরি কতটা এগোল। আর বিকালে বাড়ির উল্টোদিকে হাসপাতালের মাঠে গিজো খেলার কোর্ট কেটে গিজো খেলা। গিজো খেলা বন্ধ হয়ে যেত যখন সরস্বতী পুজোর দিনসাতেক আগে মাঠে প্যান্ডেলের বাঁশ পোঁতা হতো। আমাদের এই এত ব্যাস্ততার মধ্যেই ডিসেম্বরে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার পর জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হতো নতুন বছরের ক্লাস।
মায়ের নির্দেশ ছিলো, সরস্বতী পুজোর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সব থেকে যে বিষয়গুলো শক্ত লাগত (যেমন ভূগোল, ইতিহাস……..) সেই বিষয়ের বইগুলো সোজা গিয়ে জমা দিয়ে আসতাম ঠাকুরের পায়ের সামনে। এর আরও একটা উদ্দেশ্য বা সুবিধে ছিল, যে দুদিন ঠাকুরের কাছে বইগুলো থাকবে, সেই দুদিন আর বাড়িতে কেউ বলবে না ‘ওরে এইবার পড়তে বোস’। আমাদের আশা ছিলো, ঠাকুর নিশ্চয়ই আমার হয়ে বইগুলো দুদিনে মুখস্থ করে রাখবেন এবং আমার পরীক্ষার উত্তর লেখার সময় সেগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেবেন। এই থিওরির উপযুক্ত প্রমান অবশ্য কোনোদিনই পাইনি।
এরপর স্নান করে পরিষ্কার জামাকাপড় পড়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতাম। তারপর প্রসাদ খেয়ে কিছুক্ষণ খেলার পর দুপুরের লাঞ্চের লাইন দিতে স্কুলে চলে যেতাম। প্রায় একঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর কোনোরকমে হলঘরে ঢুকতে পারতাম। সেখানে সমস্ত টেবিল চেয়ার সরিয়ে মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে শালপাতায় ভোগ খাওয়ানো হতো। একসঙ্গে ছটা সারিতে প্রায় ৩০০ জন ছাত্র বসতো। হুড়োহুড়ি করে ঢুকে জায়গা না নিতে পারলে অপেক্ষা করতে হতো আরও একঘণ্টা। শালপাতায় একে একে পাতে পড়ত কয়েকটা শক্ত ঠাণ্ডা লুচি আর আলুরদম। কয়েকবার অতিরিক্ত থাকতো চাটনি আর বোঁদে। এখন ভেবে অবাক হই যে ছেলেবেলার উন্মাদনায় এই খাবারের জন্যই আমরা কত না অপেক্ষা করতাম, হুড়োহুড়ি করতাম আর কত না তৃপ্তি সহকারে খেতাম এই খাবার।
সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার নবীন সংঘের পুজোয় বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো। আমাদের বাড়িওয়ালা্র ছেলে অরুন কাকা খুব ভাল ইলেকট্রিক গীটার বাজাতো। আর পাড়ায় থাকতেন ও গান শেখাতেন অমরেশ লাহিড়ী (পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের বিখ্যাত গায়ক ও সুরকার অপরেশ লাহিড়ীর কেউ হয় কিনা জানি না) ওরফে আমাদের অম্পাদা। উনি অপরেশ লাহিড়ী আর অংশুমান রায়ের গানগুলো বেশ ভালো গাইতেন। প্রথম দিকে পাড়ার এবং আশপাশের অনেকেই গান করতো বা আবৃত্তি করতো। তবলা সঙ্গতে থাকতো খুদেদা। আর অম্পাদা ও অরুন কাকা স্টেজে উঠতেন একেবারে শেষের দিকে। পরের দিন বিসর্জনের পর রাত্রে ক্লাবঘরে পাড়ার সব ছেলেদের জন্য হতো বালকভোজন। মাটিতে শতরঞ্চি পেতে বসিয়ে শালপাতায় দেওয়া হতো গরম খিচুরি ও আলুরদম। আর বাজেটে কুলোলে তার সঙ্গে থাকতো বোঁদে। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে এই সামান্য বালক ভোজনটাই সেই দিনগুলিতে কতই না উপভোগ করতাম।
এইভাবে চলে এলো ১৯৭১ সাল। তখন আমাদের ক্লাস ইলেভেন। আর স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব পড়লো এবার আমাদের ওপর। ছেলেদের আলাদা আলাদা গ্রুপ করে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমি পড়লাম লাঞ্চের ব্যাবস্থাপনার গ্রুপে। আগের দিন সমস্ত বাজার করা হয়ে গেলো। দারোয়ানের ঘরের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় উপরে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে, তিনটে ইটের উনুন বানিয়ে রান্নার ঠাকুরেরা আগের দিনেই সন্ধ্যাবেলায় এসে বোঁদে তৈরির কাজ শুরু করে দিল। পাশাপাশি আলু, টোম্যাটো ইত্যাদি কাটাকাটি চলছে। আমরা নিজেদের মতন মাতব্বরী করে রাত্রি নটা নাগাদ বাড়ি ফিরে গেলাম। পরের দিন সকাল আটটায় স্নান সেরে আবার স্কুলে পৌঁছে যেতে হবে। তাই করলাম। শুরুর দিকে পুষ্পাঞ্জলি ও প্রসাদ বিতরনের পর আবার আমাদের কাজ শুরু করে দিলাম। কাজের কাজ আর মাতব্বরী, দুটোই চলছে। হলঘর থেকে সমস্ত টেবিল, চেয়ার সরিয়ে হল খালি করে হলঘর পরিষ্কার করে শতরঞ্চি পাতা হলো। ১১ টার মধ্যে সব খাবার তৈরি। তারপর শুরু হলো লুচিভাজা। ১২ টায় প্রথম ব্যাচ বসিয়ে দিলাম। এরপর চারটে ব্যাচে ভোগের খাওয়া শেষ করতে প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেলো। আমরা খাওয়া সেরে, যেন যুদ্ধ জয় করে, যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম।
তৃতীয় পর্ব – পাড়ার পুজো – অন্য পাড়া, অন্য ভাবনা
কলেজে আসার পর ১৯৭৩ সালে রথতলার বাড়ি বদল করে আমরা চলে এলাম অন্য পাড়ায়। বাড়িটা একটু বড়, সামান্য দূরেই, মৌরি বাজারের কাছে। আগের বাড়িটা ছিল একদম রাস্তার ওপর, আর এই বাড়িটা একটা গলির ভেতর। ছোট একটা পাড়া, বাড়ির সংখ্যা পনেরোর বেশি নয় আর গলিটাও কোথাও ১০ ফুট আবার কোথাও কুড়ি ফুট চওড়া। আমাদের বাড়িটা প্রায় শেষ প্রান্তে। আমাদের পরের বাড়িটাই পাড়ার শেষ বাড়ি। তারপর রাস্তাটা খুব সরু মাটির রাস্তা হয়ে কয়েকটা বাগানের (জঙ্গল বলাই ভাল) মধ্যে দিয়ে চলে গেছে অন্য একটা পাড়ার দিকে। এই রাস্তা দিয়ে সচরাচর কেউ যাতায়াত করে না। বাগানের মধ্যে কিছুটা দূরে এক দুটো ছোট টালির বাড়ি ও পুকুর। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় আলো আছে, কিন্তু তারপর বাগানের দিকে কোনও ইলেকট্রিক সাপ্লাই নেই।
এই পাড়ায় আমার দেখা প্রথম সরস্বতী পুজো ১৯৭৪ সালে, মানে পরের বছর। তখন আমি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। পাড়ায় ছ’জন ছেলে মিলে পুজোটা করে। সকলের সঙ্গেই মুখচেনা ছিলো। আমার মত ওরাও সবাই সাধারণ পরিবারের ছেলে। কেউ কলেজে, কেউ বা স্কুলে পড়ে, আবার কেউ বাবার ছোটখাটো ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে। আমি খুব তাড়াতাড়িই ওদের দলে ভিড়ে গেলাম। আমাদের কম বাজেটের পুজো, ছোট প্যান্ডেল। রাত্রি জেগে প্যান্ডেল করা হবে। এই প্রথম আমার সরস্বতী পুজোয় রাত্রি জাগা। রাত্রি একটা নাগাদ আমাদের সেই প্যান্ডেল রেডি হয়ে গেলো। এরপর মধু, অধীর আর তপন ঠিক করলো বুড়ির বাড়ির বাগানের ডাব চুরি করা হবে। শীতকালের মাঝরাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে একটা টর্চ নিয়ে আমাদের বাড়ি পেরিয়ে এলাম বাগানের সরু মাটির রাস্তায়। ডানদিকে একটা ছোট পুকুর আর তার পাশেই একটা ছোট টালির বাড়ি। পুকুরের পাড় ঘেঁসে উঠেছে একটা বাঁকা ডাব গাছ, তবে গাছটা খুব বেশি বড় নয়। গাছের মাথাটা রয়েছে পুকুরের ওপর। শুনলাম এই বাড়িতে থাকে এক বুড়ি এবং সে দিনের বেলায় কাউকে নাকি বাগানের কিছু পাড়তে দেয় না। ঠিক হলো অধীর গাছে চড়বে। গাছের নিচে থাকবে মধু আর তপন। স্বপন আর অমল বুড়ির বাড়ির কাছে পাহারা দেবে। আর আমার গুরুদায়িত্ব রাস্তায় টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার। অধীর একটা কাটারি নিয়ে গাছে উঠল। প্রথম ডাবটা কাটতেই সেই ডাবটা পুকুরের মধ্যে গিয়ে পড়লো বিকট একটা শব্দ করে। নিস্তব্ধ রাতের সেই আওয়াজে বুড়ির ঘুম গেলো ভেঙ্গে। বুড়ি একটা হারিকেন নিয়ে ‘কেরে’, ‘কেরে’ করতে করতে বেরিয়ে এল পুকুর ঘাটে। আমরা তখন টর্চ নিভিয়ে যে যার জায়গায় চুপচাপ বসে বা দাঁড়িয়ে আছি। বুড়ি কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখে কিছু না পেয়ে আবার ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লো আর আমরা আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর অধীর ওপর থেকে দড়িতে ডাবের কাঁদি কেটে নামিয়ে দিলো। মধু আর তপন একটা আঁকশি দিয়ে সেটা টেনে নিল নিজেদের কাছে। তারপর অধীর চুপচাপ নিচে নেমে এলে আমরা সকলে ডাবের কাঁদি নিয়ে প্যান্ডেলে ফিরে এলাম।
ডাব চুরির অভিযান পর্ব চলেছিলো প্রায় ঘন্টা তিনেক। প্যান্ডেল আগেই রেডি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গলির মোড়ে রাস্তার ধারে যে একটা গেট তৈরি হবে, তার কাজ শুরুই হয়নি। প্রায় চারটে বাজে, ভোর হয়ে আসছে। অমল, স্বপন আর আমি তরিঘড়ি করে লেগে গেলাম গেট তৈরির কাজে। আর মধু, তপন ও অধীর একটা শাবল আর একটা কাটারি নিয়ে হনহন করে রাস্তা দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো আর বলে গেলো ‘দাঁড়া, আমরা গেটের ব্যবস্থা করছি’। ঘণ্টাখানেক পরে দেখি তিনজন একটা তৈরি গেট কাঁধে নিয়ে ফিরছে। তারপর ঐ গেটটাই আমাদের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, তোদের গেট যদি রেডি না হয়, এই গেটটা লাগিয়ে দিস। যাই হোক, সকাল ছ’টার মধ্যেই আমাদের গেট রেডি হয়ে গেলো। আর ঐ বয়ে নিয়ে আসা গেটটা পাশেই দাঁড় করিয়ে রাখলাম। একটু পরেই ব্যাপারটা পরিস্কার হলো। রায়বাড়ির ছেলেরা দল বেঁধে হইহই করে এসেই চ্যালেঞ্জ করলো, তোরা আমাদের গেট তুলে নিয়ে এসেছিস কেন? মারপিট প্রায় শুরু হয় আর কি। ততক্ষণে পাড়ার বড়রাও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তাঁরাই এসে ব্যাপারটা মেটালেন, আর রায়বাড়ির ছেলেরা ওদের গেট ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। পরে জানলাম, কিছুদিন আগেই রায়বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে এই পাড়ার ছেলেদের কোনও একটা ব্যাপারে ঝামেলা হয়েছিলো। সেই ঝামেলার রেশ ধরেই সেদিন রায়বাড়ির ছেলেরা রাত্রি দুটোর মধ্যেই ওদের রাস্তার ওপর গেট রেডি করে সদর দরজায় তালা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমাদের ছেলেরা গিয়ে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে বাঁশ সমেত গোটা গেটটাই তুলে নিয়ে এসেছিলো।
এই রকমের উত্তেজনাপূর্ণ সরস্বতীপুজোর অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয়নি। আমাদের আগের পাড়াটা ছিল অনেক বড় আর পাড়ায় একটা বড় ফুটবল মাঠ থাকায় আমাদের ক্লাবে আশেপাশের অনেক ছেলে ছিল। ১০ থেকে ৪০ বছরের বয়সের মধ্যে প্রায় ১০০-১৫০ সদস্য। নানা বয়েসের সদস্য থাকায় পাড়ায় একটা ডিসিপ্লিন ছিল। অন্যদিকে আমাদের এই নতুন পাড়ায় মাত্র ছ’টা ছেলে আর এদের ভাবনাচিন্তাটা ছিল একটু অন্য রকমের। এই পাড়ায় না এলে জানতেই পারতাম না যে সরস্বতী পুজোর আরও একটা দিক আছে, আর গ্রামের দিকে সরস্বতী পুজোর আগের রাত্রে পাড়ার ছেলেরা কিরকম রেষারেষি বা বদমাইশি করে। তবে, সেসময় এদের গাঁজা বা মদ বা অন্য কোনও রকম বদ অভ্যাস ছিল না। ছিল শুধু নিছকই রেষারেষি বদমাইশি। যাই হোক, এই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে আমার খুব বেশি অসুবিধা হয়নি। আমার উপরি পাওনা ছিলো, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র হওয়ার সুবাদে বাকিরা আমাকে যথেষ্টই সমীহ করতো।
চতুর্থ পর্ব – পাড়ার পুজো – নতুন কিছু করে দেখানো
পরের বছর আমরা অনেক আগে থেকে ঠিক করলাম যে পুরোটাই সুতোর তৈরি প্যান্ডেল করব। তখন সদ্য কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে বিল্ডিং প্ল্যান শিখেছি। একটা ছোট একতলা পাকা বাড়ির ড্রইং করলাম। শ’মিলে গিয়ে একটা প্ল্যাঙ্ক কিনে চিরে নিয়ে সরু সরু কাঠের বাটাম তৈরি করা হলো। পাড়ায় থাকতো বেচাদা, যে গার্ডেনরিচে জাহাজের কারপেনটার ছিল। সেই কাঠের বাটাম দিয়ে বেচাদা ড্রইং অনুযায়ী কয়েকটা ফ্রেম তৈরি করে দিলো আর ফ্রেমগুলো নিয়ে গিয়ে রাখলাম অধীর / অমলদের বাড়ির একটা ফাঁকা ঘরে। ওদের মা ছিলেন না। ওরা ওদের বাবা ও দাদার সঙ্গে থাকতো ঐ বাড়িতে। মধু বড়বাজার থেকে সাদা সুতোর প্রচুর রিল কিনে নিয়ে এলো। তারপর দুই ভাই অমল আর অধীর একমাস দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রত্যেকটা ফ্রেমের চারদিকে আধ ইঞ্চি অন্তর পেরেক পুতে, সুতোর টানা কাজ করে সব কটা ফ্রেম কমপ্লিট করলো। সরস্বতী পুজোর আগের দিন বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে বেসিক প্যান্ডেল রেডি হওয়ার পর রাত্রি দশটার পর এই ফ্রেমগুলো নিয়ে গিয়ে আটকানো হলো প্যান্ডেলের সামনে। প্যান্ডেল কমপ্লিট হলে দেখা গেলো একটা সুতোর ঘর যার মধ্যে রয়েছে জানলা, দরজা ও বারান্দা। ঘরের ওপরে লাগানো রয়েছে টিভি এন্টেনা, বাঁশের কঞ্চির ওপর সিগারেট প্যাকেটের সিলভার ফয়েল মুড়ে তৈরি। ঐ অঞলে টিভি তখন প্রায় ছিলো না বললেই চলে। পরদিন চারদিকে সাড়া পড়ে গেলো। প্রচুর লোকজন সুতোর ঘরের ভেতর সরস্বতী ঠাকুর আর ঘরের ছাদে টিভি এন্টেনা দেখতে এলো। সারাদিন, বিশেষত সন্ধ্যাবেলায় ঐ সরু গলির ভেতর লোকের ভিড় সামলাতে আমাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিলো।
এরপর থেকেই চিন্তা হয়ে গেলো যে প্রতি বছর নতুন কি করা যায়। পরের বছর ঠিক করলাম বিস্কুটের প্যান্ডেল করব। আর তৈরি হবে একটা টালির চালার আকারে। আবার আগের বছরের মত বেচাদাকে দিয়ে বানানো হলো কয়েকটা সরু কাঠের ফ্রেম। কভারেজ এরিয়া ক্যালকুলেশন করে বের করা হলো হরলিক্স বিস্কুট সাইজের কতগুলো বিস্কুট লাগবে। সেইমত সরস্বতী পুজোর আগে একদিন সকলে বড়বাজারে গিয়ে পাইকারি হারে সবথেকে সস্তার হরলিক্স বিস্কুটের মতন দেখতে চৌকো বিস্কুটের অনেকগুলো প্যাকেট কিনে সেগুলি হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে নিয়ে এলাম। সরস্বতী পুজোর আগের দিন সকাল থেকে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে বেসিক প্যান্ডেল তৈরি করা হলো, আর সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো ধুতি যোগাড় করে এনে কেটে কেটে আটকানো হলো সবকটা ফ্রেমের ওপর। সন্ধ্যাবেলায় ফ্রেমগুলো মধুদের বাড়ির বড় দালানে ও বারান্দায় পেতে দেওয়া হলো, আর অনেকটা পরিমান আটার আঠা তৈরি করে লাগিয়ে দেওয়া হলো সেই ধুতির ওপর। এবার পাড়ার যত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের ডেকে লাগিয়ে দেওয়া হলো ধুতির ওপর একটা একটা করে বিস্কুট ফিক্স করার কাজে। ওরা কিছুক্ষণ কাজ করার পর আমরাও সকলে হাত লাগালাম আর এই বিস্কুট ফিক্স করার কাজ শেষ হোল রাত এগারোটা নাগাদ। রাত্রি বারোটার পর আমরা শুরু করলাম বেসিক প্যান্ডেলের সামনে, পাশে ও ওপরে এই ফ্রেমগুলি আটিকানোর কাজ। প্যান্ডেলের পুরো কাজ শেষ হলো প্রায় ভোর চারটের সময়। এরপর আমরা রাস্তায় গেট তৈরি করে তার ওপর কিছু বিস্কুট দিয়ে আমাদের ক্লাবের নাম লিখে দিলাম, যাতে রাস্তা থেকেই লোকজন দেখতে পায় যে এখানে বিস্কুট দিয়ে প্যান্ডেলের কাজ করা হয়েছে। এবারও বিস্কুটের প্যান্ডেল হিট হয়ে গেলো এবং সারাদিন ও সন্ধ্যাবেলায় অনেক লোকজন ভিড় করে এসে প্রতিমা ও প্যান্ডেল দর্শন করলো।
এইভাবেই আমাদের এই গলির পুজো এই অঞ্চলে একটা বিখ্যাত পুজোর রূপ নিল। সরস্বতী পুজোর দিন খুব ভাল কাটলেও বিপদ হলো পরের দিন সকালে যখন এক পশলা বৃষ্টির জলে বিস্কুটগুলো গলে গলে মাটিতে পড়তে লাগলো আর আশপাশের ছোট ছোট ছেলেরা এসে সেই বিস্কুটগুলো নিয়ে যাবার চেষ্টা করল খাবার জন্য। আমাদের ভয় ছিল যে বড় বাজারের এই সস্তা বিস্কুটগুলো খেয়ে ছেলেগুলো অসুস্থ না হয়ে পড়ে। আমরা কোনওরকমে তাদের আটকে, বিস্কুটগুলো খুলে নিয়ে গিয়ে দূরে এক পুকুরের জলে ফেলে বাঁচলাম।
এইভাবেই প্রত্যেক বছর আমরা নতুন কিছু করার চেষ্টা করতাম। এই বাড়িতে আমরা ছিলাম পাঁচ বছর। ১৯৭৮ সালে আমি চাকরি পাওয়ার পর আমরা এই পাড়া ছেড়ে প্রায় দু কিমি দূরে আন্দুল স্টেশনের কাছে আর একটু বড় বাড়িতে চলে যাই। তারপর থেকে এই পাড়ায় বা অন্য কোনও পাড়ার পুজোয় অংশগ্রহণ করার সুযোগ আর হয়নি।
এখন আমাদের হাউজিং মপ্লেক্সে সরস্বতী পুজো হয়। সেই পুজো দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় সেই পুরনো দিনগুলোর কথা। জানি, কোন দিনই আমরা আর সেই স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে পারব না। আর শুধু আমরা কেন, আমাদের পরের প্রজন্মেও কেউ কোনোদিন হয়ত পারবে না সেই দিনগুলো ফিরে পেতে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিগত পঞ্চাশ বছরে মানব সভ্যতার উন্নতির স্রোতে চিরতরের জন্য হারিয়ে গেছে নির্মল অনাবিল আনন্দমুখর উৎসবের সেই দিনগুলো।।
সরস্বতীপূজা নিয়ে দুটি লেখাই ভালো হয়েছে।