বলিউডের সেযুগের তিন দিকপাল
সুহাস বাসু, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
• বুদ্ধিজীবী চরিত্রভিনেতা বলরাজ সাহনী
• গুরু দত্ত, কিছু কথা
• মজরুহ সুলতানপুরি, হিন্দি ফিল্মদুনিয়ার কমিউনিস্ট কবি
বুদ্ধিজীবী চরিত্রভিনেতা বলরাজ সাহনী
হিন্দী ফিল্ম ইতিহাসে যে ক’জন হাতে গোনা শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী চরিত্রভিনেতা স্মরনীয় হয়ে আছেন, বলরাজ সাহনী নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সিনেমা জগতে কথিত ছিলো an over educated man and not fit to dance around trees.
১৯১৩ সালের ১লা মে পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বলরাজ সাহনীর জন্ম। উনার পিতৃদত্ত নাম Yudhishthir. স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় নাম পরিবর্তন কারে রাখা হয় বলরাজ।
উনি পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, লাহোর থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স এবং হিন্দী সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেন। এরপর উনি রাওয়ালপিন্ডি ফিরে গিয়ে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে দময়ন্তীর সাথে বিবাহ হয় এবং তার পরেই দুজনে শান্তিনিকেতন আসেন, সেখানে বলরাজ ইংরেজী ও হিন্দী, দুটো বিষয়ই পড়াতে থাকেন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন ১৯৩৮ সালে ওনার সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর যোগাযোগ হয় এবং তিনি গান্ধীজির সাথে যুক্ত থাকার অভিপ্রায়ে ওনার সবরমতী আশ্রমে চলে আসেন।
এক বছর পরে ১৯৩৯ সালে উনি সস্ত্রীক BBC, London এর হিন্দী সার্ভিসে রেডিও ভাষ্যকার পদে যোগ দেন। এইসময় সহকর্মী Marie Saton এর সাথে যোগাযোগ হয়। উনি ছিলেন এককথায় daughter of wealthy parents and a bohemian, roaming the world becoming a failed actress, but a well-respected film editor. এনার সান্নিধ্যে এসেই বলরাজ সাহনীর সিনেমা জগৎ নিয়ে উৎসাহ জন্মায়। এনার সাহায্যে বলরাজ সাহনী সোভিয়েত সিনেমা ও বিখ্যাত পরিচালক S. Eizenstein এর বিভিন্ন কাজের সাথে পরিচিত হন। বলরাজ সাহনী ধীরে ধীরে সোভিয়েত ও ইউরোপীয় সিনেমায় প্রভাবিত হয়ে যান। ক্রমে ক্রমে কার্ল মার্কস ও ফ্রেড্রিক এঙ্গেলস বিষয়েও বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়ে পড়াশোনা করেন, সেইরকম চিন্তাধারার লোকজনের সাথেও পরিচয় হয়। এইভাবেই ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩, এই সময়ে তিনি মনেপ্রানে কম্যুনিস্ট চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েন এবং ১৯৪৩ সালে ভারতে ফিরে এসে Indian People Theatre Association (IPTA) এ যোগদান করেন। এর সাথে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি CPI এর নিয়মিত সদস্যপদেও যোগ দেন। IPTA তেই বলরাজ সাহানী তৎকালীন বিনোদন জগতের বহু বামপন্থী চিন্তাধারার গুণীজন যেমন বিমল রায়, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, পৃথ্বীরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, রবিশঙ্কর, সফদর মীর, হাসান প্রেমানী, উৎপল দত্ত খাজা আহমেদ, রাজেন্দ্র রঘুবংশী এবং আরও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে পরিচিত হয়। এনাদের সংস্পর্শে তিনি ও তাঁর স্ত্রী একের পর এক নাটক ও পথনাটকে অংশ নেন। এইখানেই বলরাজ সাহনীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডেরও শুরু।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পরে বলরাজ সাহনী রাওয়ালপিন্ডির বাসস্থান পিছনে ফেলে উদ্বাস্তু হয়ে দিল্লী চলে আসেন। এবং কঠিন জীবনের সম্মুখীন হন। অবস্থা আরও জটিল হয় যখন উনার স্ত্রী বস্তিবাসীদের সাথে রাজনৈতিক কাজের সময় amoebic dysentery রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন, ১৯৪৭ সালে, তাঁর স্ত্রী দময়ন্তীর বয়স মাত্র ২৬।
ফিল্মি ক্যারিয়ার
IPTA ইতিমধ্যে সিনেমা পরিচালনা ও প্রযোজনায় চলে আসে। প্রথম প্রযোজনা ১৯৪৬ সালে, ইন্সাফ, যেখানে বলরাজ সাহানী অভিনয় করেন। সিনেমাটি বক্স অফিস সাফল্য লাভ করতে পারে নি। এ্ররপর ১৯৪৬ সালে খাজা আহমেদ আব্বাস কলকাতায় এসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ইতিহাস অবলম্বনে ধরতী কে লাল সিনেমাটি তৈরি করেন। এই সিনেমায় বলরাজ সাহনী এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান, সহশিল্পী ছিলেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র। সঙ্গীতে ছিলেন রবিশঙ্কর। এই ধরতি কে লাল সিনেমাটি ওনাকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়।
১৯৪৭ সালে পত্নীবিয়োগ আর রাজনৈতিক কারণে তাঁর ফিল্মি ক্যারিয়ারে সাময়িক বিরতি হয়। ১৯৫১ সালে নির্মিত গুরু দত্তের বাজি ছবির স্ক্রীন রাইটার ছিলেন বলরাজ। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের জেলবন্দী থাকাকালীন উনিও গ্রেফতার হম। অবশ্য ১৯৫১ সালে কে আসিফের হালচল সিনেমায় কাজের জন্য ওনাকে কয়েকদিনের মুক্তি দেওয়া হয়। বলরাজ সাহনীর প্রথম বানিজ্যিক সফল সিনেমা ১৯৫১ সালের হামলোগ। পুত্র পরীক্ষিৎ সাহনীর লেখায় পাওয়া যায় He rode on a motorcycle from Mumbai to my boarding in Pune, to celebrate his success and have lunch with me. অভিনয়ের পাশাপাশি গুরু দত্ত পরিচালিত ১৯৫১ সালের বাজি সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৫৩ সালে বিমল রায়ের দো বিঘা জমীন ছবির অভিনয় তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এই ছবিকে বিশেষ ভাবে পুরস্কৃত করে। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত নায়িকাদের (নুতন, পদ্মিনী, নার্গিস, মীনা কুমারী, বৈজয়ন্তিমালা) সঙ্গে একের পর এক ছবি করেছেন। যেমন, বিন্দিয়া, সীমা (১৯৫৫), কাঠ পুতলি (১৯৫৭), সোনে কি চিড়িয়া, লাজবন্তি, ঘর সংসার (১৯৫৮), সাট্টা বাজার (১৯৫৯), ইত্যাদি। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা তাঁর জীবনের আরও একটা সেরা ছবি। সব মিলিয়ে তিনি ৯৩ টি সিনেমায় অভিনয় করেন।
চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি
নীলকমল, ঘর ঘর কি কাহানি দো রাস্তে, এক ফুল দো মালী। ১৯৬৫ সালে নির্মিত বি আর চোপড়ার ওয়াক্ত আর এম এস সথ্যুর গরম হাওয়া (১৯৭৩) বলরাজের জীবনের সেরা ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেখা যায়, বলরাজ সাহনী বিভিন্ন ধরনের পেশা ও অভিজ্ঞতার পরে নিজের প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে এসে সিনেমাজগতে নিজের স্থান অর্জন করেন।
পরীক্ষিৎ সাহনী এক জায়গায় বলেছেন Once I had accompanied him for the shooting of Aulad (1954). The scene had dad holding the gates of his master’s house and begging for his child, “Malik mujhe mera bachcha toh de do!” The scene done, everyone clapped and pack-up was announced. On the way back in the car, dad said he wasn’t happy with the shot. He drove back and told director Mohan Segal that he wanted a retake. Mohanji felt it wasn’t required. Dad issued an ultimatum that if he didn’t allow him to do so, he wouldn’t report for shooting. The studio was reopened. The lights were set up again. Dad gave the retake. But this time no one clapped. Because they were all crying. It was that brilliant a shot. Later, dad explained, “I wanted to feel the shot. I wanted to relive what I felt when your mother died.”
রাজনৈতিক জীবন
১৯৪৯ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ভারত সরকার বলরাজ সাহনি সহ অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু সরকারের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই তিনি সারা জীবন পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির যুব শাখা All India Youth Federation গঠন করেন। তিনি AIYF এর প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হয়েছিলেন।
ভারত চীন যুদ্ধের সময় বলরাজ সাহনী এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৩-৬৪ সালে চেতন আনন্দের হকীকৎ সিনেমায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর রণজিৎ সিং চরিত্রে চীনের বিরুদ্ধে অভিনয়ে রাজী হলে তাঁর বামপন্থী বন্ধুরা তাঁকে অতীব নিন্দা করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর সময় ওনাকে ভারত গঠনের রুপকার বলায় IPTA এর সহকর্মীরা বলরাজ সাহনীর তীব্র নিন্দা করেন, কার্যত তিনি IPTA তে একঘরে হয়ে যান। তবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিলো।
১৯৭০ সালে পি কে বাসুদেভন নায়ারের সান্নিধ্যে এসে বলরাজ সাহনী কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থী ছাত্র সংগঠন All-India Youth Federation স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন ফেডারেশনের প্রথম সভাপতি। সহকর্মী হিসেবে পাশে ছিলেন কমরেড গুরু রাধা কিষাণ। এই সংগঠনের প্রথম সর্বভারতীয় অধিবেশন হয় দিল্লীতে যেখানে ২৫০+ প্রতিনিধি যোগদান করেন। এই অধিবেশনের পরেই বলরাজ সাহনী বহু রাজনৈতিক নেতার নজরে চলে আসেন। ১৯৭২ সালে দিল্লীর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের বার্ষিক সন্মেলনে তিনি বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন।
এরপর ১৯৭২ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় বলরাজ সাহনী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আবার কমিউনিস্ট পার্টির বিরাগভাজন হন। কমিউনিস্ট পার্টি বলরাজ সাহনীকে দল থেকে বহিস্কার করে। সেই সময় বলরাজ সাহনীর কন্যা শবনম মারা যান। ১২ই এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে গরম হাওয়ার ডাবিং থেকে বাড়ি ফিরে এসে, উপর্যুপরি মানসিক আঘাতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। স্ত্রীকে ডেকে দাস ক্যাপিটাল বই এনে পড়ার চেষ্টা করেন। পারেন নি, পরদিন রাতেই ১৩ই এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে মাত্র ৬০ বছর বয়সে বলরাজ সাহনী মারা যান। “Those were the last words he dubbed,” পরীক্ষিতের নিজের কথায়।
লেখক সত্ত্বা
ছোটবেলা থেকেই বলরাজ সাহনি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। উনি বাস্তবিকই একজন স্বভাব সাহিত্যিক ছিলেন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সফর করে এসে “মেরা পাকিস্তানি সফরনামা” নামে বই লেখেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর শেষে তিনি “মেরা রুশী সফরনামা” বইটি লেখেন, এই বই তাঁকে সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু অ্যাওয়ার্ড এনে দেয়।
জীবনের প্রথম দিকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে চর্চা করলেও পরবর্তী জীবনে তিনি পাঞ্জাবী ভাষায় লিখতে শুরু করেন, খ্যাতিও লাভ করেন। অসংখ্য কবিতা আর ছোট গল্পের রচয়িতা ছিলেন বলরাজ সাহনি। তাঁর আত্মজীবনী মেরি ফিল্মি আত্মকথা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
উপসংহার
১৯৬৯ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত বলরাজ সাহনি ছিলেন এক অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষ। সাহিত্যচর্চা, অভিনয়, রাজনীতি- জীবনের সব ক্ষেত্রেই তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে দুঃখজনক, তিনি কোন ভারতীয় পুরস্কার পান নি।
পুত্র পরীক্ষিতের তিনি ছিলেন শিক্ষক, তাঁকে মানসিক ভাবে সর্বদা সচেতন রাখতেন। পরীক্ষিতের ভাষায় One day, when the sea was stormy, Balraj “challenged” his then pre-teen son for a swim in the sea. As panic gripped Balraj asked to “keep his head”. “The tide always turns. And when it does, the sea will push us back to the shore on its own accord. Now, let’s sing,” and belted out some revolutionary songs. Eventually, the tide turned and were pushed back towards the shore. The episode tought “not to panic and give up”.
পরীক্ষিৎ সাহনি একটি বই লিখেছেন The Non-Conformist: Memories of My Father Balraj
Sahni. সেখানে গরম হাওয়া সিনেমা সম্বন্ধে লেখা আছে – were momentous in the late Balraj Sahni’s life. Playing Salim Mirza, an alienated Muslim in post-Partition India, the film gave a sense of déjà vu to the actor, who was a refugee’ in India, having moved out of Pakistan after Independence. The film also underlined a father’s grief when his daughter (Geeta Kak) commits suicide, deserted by the man she loves. It resonated a similar trauma in Balraj’s life as his young daughter Shabnam had died of brain haemorrhage following a disastrous marriage. While his performance is considered the crowning glory of the classic, a heartbroken Balraj Sahni passed away a day after he finished dubbing for Garm Hava and a year after the demise of his daughter. Several such insights are offered in the book,
তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া
The Non-Conformist: Memories of My Father Balraj Sahni, written by Parikshat Sahni.
An article by Parikshat Sahni ‘A Son Remembers’)
দ্যা ট্রিবিউন ম্যাগাজিন
********
গুরু দত্ত, কিছু কথা
বসন্ত কুমার শিবশঙ্কর পাডুকোন, ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। নামটা অনেকেরই অপরিচিত কারণ উনি বৃহত্তর জগতে গুরু দত্ত নামেই পরিচিত।
গুরু দত্তর জন্ম ১৯২৫ সালে ব্যাঙ্গালোর শহরে। ছোট বয়সেই উনি বাবা- মার সাথে কলকাতায় চলে আসেন। এবং তখন থেকেই নাচের প্রতি ওনার বিশেষ আকর্ষণ তৈরী হয় এবং ১৬ বছর বয়সে উদয়শংকর ড্যান্স একাডেমীতে যোগ দেন।
১৯৪৩ সালে ১৮ বছর বয়সে উনি Lever Brothers Factory তে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু কাজ পছন্দ না হওয়ায় এক বছর পরেই ১৯৪৪ সালে পুনেতে গিয়ে প্রভাত ফিলম কোম্পানিতে ৩ বছরের চুক্তিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে দেব আনন্দের দেখা এবং হয় বন্ধুত্বের সূচনা। আমৃত্যু তাঁদের এই বন্ধুত্ব অটুট ছিল। নিজেদের দেওয়া কথা অনুযায়ী দেব আনন্দের প্রথম প্রযোজিত ছবিতে গুরু দত্ত প্রথম চিত্র পরিচালনা করেন। ১৯৫১ সালে তৈরী হওয়া বিখ্যাত ছবিটির নাম বাজি। এই ছবির সেটেই ওনার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তকদির সে বিগরী হুয়ি গানটির গায়িকা গীতা রায়ের, যিনি পরবর্তী কালে ওনার ঘরণী হন।
বাজি ছবির শ্যুটিং চলাকালীন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। অভিনেতা বলরাজ সাহনি একদিন বাসে উঠে এক বাস কন্ডাক্টরের চলনে বলনে আকৃষ্ট হয়ে সেই ভদ্রলোককে পরের দিন গুরু দত্তর অফিসে এসে দেখা করতে বলেন। পরদিন গুরু দত্ত আর দেব আনন্দ অফিসে বসে শুনতে পেলেন, এক মাতাল খুব চেঁচামেচি করছে। ঠিক সেইসময়ই বলরাজ সাহনি সেখানে এসে পড়েন আর সেই মাতালকে গুরু দত্তর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বদরুদ্দীন জামাল উদ্দিন কাজী নামের সেই ভদ্রলোককে এক পলকেই মনে ধরে যায় গুরুজীর। নিজের পছন্দের পানীয়ের নামে ওনার নাম দেন জনি ওয়াকার। বাকিটা ইতিহাস। হিন্দী ফিল্ম জগৎ একজন অসাধারণ কৌতুকাভিনেতা পেয়ে যায়।
গুরু দত্তর অভিনয় জীবনের শুরু ১৯৪৪ সালে চাঁদ ছবিতে। ১৯৪৬ সালে হাম এক হ্যায় ছবিতে উনি ড্যান্স কোরিওগ্রাফারেরও কাজ করেন। এরপর বাজি ছবি পরিচালনার পরবর্তী সময়ে উনাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। Aar Paar (1954), Mr & Mrs’55 (1955), C.I.D (1956), Pyaasa (1957), Kaagaz ke Phool (1959), একের পর এক হিট ছবি উপহার দেন। এর পর আর কোন ছবি পরিচালনা করেন নি গুরু দত্ত। এছাড়াও নায়ক বা প্রধান চরিত্র হিসেবে ১৯৬০ সালে Chaudhvin ka Chand, আর ১৯৬২ সালে Sahib Bibi Aur Ghulam ছবিতে বিশেষ সাফল্য পান।
১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত Kaagaz ke Phool ছবিটি ছিল ফিল্মী ভাষায় গুরু দত্তের ড্রিম প্রজেক্ট। দুর্ভাগ্যবশত ছবিটা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং এর পরে গুরু দত্ত আর কোন ছবি পরিচালনা করেন নি। পরবর্তী সময়ে ‘৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘৮০ দশকের প্রথম দিকে এশিয়া ও ইউরোপের ১৩টি দেশে Kaagaz ke Phool রিলিজ করে আর অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। সেই সময়ে ছবিটা ভারতেও আবার নতুন করে রিলিজ করে, এবং বলাই বাহুল্য, খুবই সাফল্য অর্জন করে। আজ বিশ্বের অনেক ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ছাত্র ছাত্রীরা ফিল্ম মেকিং সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করার জন্য এই ছবিটা অনুসরন করে।
১৯৬৪ সালে পানীয়ের মধ্যে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এই মহান প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে গুরু দত্তের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
২৯-মে, ২০২১
******
মজরুহ সুলতানপুরি, হিন্দি ফিল্মদুনিয়ার কমিউনিস্ট কবি
সাল ১৯১৯। হিন্দি ফিল্ম ইতিহাসের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বছর। সেই বছরেই জন্মগ্রহণ করেন গায়ক মান্না দে, গায়িকা শামশাদ বেগম, সুরকার নৌশাদ ও সুধীর ফারকে, গীতিকার কাইফি আজমী, রাজেন্দ্র কিষান এবং মজরুহ সুলতানপুরি। এনারা প্রত্যেকেই পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ শিল্পকর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। আজকের পর্বে যাঁর কথা বলবো, আদ্যন্ত কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন সেই মহান ব্যক্তির নাম মজরুহ সুলতানপুরি ।
১৯১৯ সালের ১লা অক্টোবর উত্তর প্রদেশের সুলতানপুরে রাজপুত মুসলিম পরিবারে আসরার উল হাসান খানের জন্ম হয়। বাবা ছিলেন পুলিশ বিভাগের কর্মচারী। হাসান খানের খুব ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। নাসেহ ছদ্মনামে উনি লেখাও শুরু করেন। এই সময়ই এক কিশোরীর সাথে তাঁর ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়, যদিও সেই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রেমে আঘাত পাওয়ায় তাঁর বন্ধুরা তাঁকে মজরুহ (আহত) নামে লিখতে পরামর্শ দেয়। তারপর থেকেই উনি মজরুহ সুলতানপুরি নামে পরিচিতি পান এবং হিন্দি ও উর্দু, দুই ভাষাতেই শের আর কবিতা লেখা শুরু করেন। এই সময়ে উনি কাব্যচর্চার পাশাপাশি লখনৌ শহরের Takmeel-ut Tib Unani Medicine কলেজে ভর্তি হয়ে ইউনানী চিকিৎসা নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন। শিক্ষান্তে উনি লখনউ শহরে ইউনানী হাকিম হিসেবে নিজের পেশা শুরু করেন, পাশাপাশি লখনৌ মিউজিক কলেজে হিন্দুস্তানি রাগসঙ্গীত শেখাও শুরু করেন।
এর কিছুদিন পরেই মজরুহজীর জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আসে যখন তাঁর পরিচয় হয় তৎকালীন সুবিখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদী’র সাথে। ওনার লেখা কবিতায় মুগ্ধ হয়ে জিগরজী ১৯৪৫ সালে মজরুহজীকে একটা মুশায়রায় অংশ নিতে বোম্বে নিয়ে আসেন। সেই মুশায়রায় অসামান্য সাফল্য তাঁকে সুযোগ এনে দেয় এ আর করদারের শাহজাহান ছবির জন্য গান লেখার। তৎকালীন অন্যতম সেরা সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদ আলি সাহেব মজরুহজীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে নির্মিত এই ছবিতে তিনি ছোটবেলায় প্রেমে আঘাত পাওয়ায় যে কবিতাটি লিখেছিলেন, সেই কবিতাই তিনি গান হিসেবে বেছে নেন। কুন্দন লাল সেহগালের গাওয়া সেই যুগের জব দিল হি টুট গয়ে গানটি ৭৫ বছর পর আজও উৎকর্ষতায় ও জনপ্রিয়তার অন্যতম শীর্ষস্থান অধিকার করে হয়ে আছে।
এরপর মজরুহজীকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক ছবিতে তিনি গীতকার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। আবার পাশাপাশি সরকারের তথাকথিত প্রতিষ্ঠান বিরোধী কার্যকলাপের জন্য রাজরোষে অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে মজরুহজীও কারাবরণ করেন। সরকারের নির্দেশ মতো ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করায় না চাওয়ায় তাঁর ২ বছর কারাবাস হয়। ১৯৬২ সালে নেহরুজীর চীন সম্বন্ধীয় কূটনৈতিক নীতির বিরোধিতা করায় মজরূহজীর ২ বছরের কারাবাস হয়। কিন্তু শত সরকারী রোষানলের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সারাজীবন নিজের নিজের কমিউনিস্ট সত্তা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন আর সিনেমার গান লেখার পাশাপাশি অসংখ্য কবিতা, গজল ও নজমও লিখেছেন।
মজরুহ সুলতানপুরি তাঁর সুদীর্ঘ ফিল্মি জীবনে ৩০০ র বেশি সিনেমার জন্য প্রায় ২০০০ গান লিখেছেন। এরই মধ্যে আমার বিচারে, বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটা গান:
১) এয় দিল হ্যায় মুস্কিল (সি আই ডি, ১৯৫৬)
২) চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে (দোস্তি, ১৯৬৫)
৩) তুমনে মুঝে দেখা (তিসরি মঞ্জিল, ১৯৬৬)
৪) ও শাম, কুছ আজীব থী (খামোশী, ১৯৬৯)
৫) পিয়া তু অব তো আ যা (কারাভান, ১৯৭১)
৬) পহেলা নশা (যো জিতা ওহি সিকান্দার, ১৯৯২)
৭) ও মেরে দিলকি চ্যায়ন (মেরে জীবন সাথী)
দোস্তি ছবির জন্য লেখা চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে গানটি তাঁকে ১৯৬৫ সালের শ্রেষ্ঠ গীতকার হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারে সন্মানিত করে এনে দেয়। তাঁর সফল কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৩ সালে তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম গীতকার যাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়।
২০০০ সালের ২৪শে মে মজরুহ সুলতানপুরির জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর ১৩ বছর পর ২০১৩ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ তাঁর সম্মানে ডাকটিকিট বের করে। হিন্দি ফিল্ম ইতিহাসে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার মজরুহ সুলতানপুরির নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
খুব ভালো একটা লেখা, স্বর্ণযুগের গুণীজনদের নিয়ে, অনেক কিছু জানাও গেলো। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভালো লেখা।
তবে গুরু দত্ত আর মজরুহ সাহেবকে নিয়ে আরও অজানা কিছু আশা করছিলাম।
লেখককে অনুরোধ অতীতের আরও কিছু দিকপাল যেমন বিমল রায়, পঙ্কজ মল্লিকদের নিয়েও কিছু লিখুন।