সাহিত্যিকা

প্রথম চাকরি জীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা

প্রথম চাকরি জীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা
প্রসূন রায় মিত্র, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মজীবনে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা, ব্রিজ কন্সট্রাকশন সাইটে ৮০ফুট জলের তলায় ডুবুরীর কাজের অভিজ্ঞতা। এককথায় এডভেঞ্চার, তাই শেয়ার করছি সবার সাথে।

‘৭৭ সালে শিবপুর থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর কর্মজীবন শুরু হলো ব্রিজ কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে। মা বাবার আশীর্বাদ নিয়ে, বন্ধুদের আড্ডার মায়া কাটিয়ে হাতে বেডিং স্যুটকেস নিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে ধরে সোজা ধানবাদ স্টেশন। স্টেশনের বাইরে মিনিবাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই কানে এল, “চাস-বোকারো-মারাফারি”। তারই একটায় চেপে এলাম তেলমোচু ব্রিজ ক্যাম্পে, আমার নতুন ঠিকানা। রাস্তায় চোখে পড়ল বি.সি.সি.এল কলোনী, পুটকি কোলিয়ারী, ইত্যাদি বিহারের কয়লাখনি অঞ্চল, এখনকার ঝাড়খণ্ড। প্রায় সোয়া একঘন্টা বাস চলার পর পৌঁছলাম দামোদর নদীর পাড়ে তেলমোচু ব্রিজে।

অনেক পুরানো একটা ওয়ান ওয়ে স্টিল গার্ডার ব্রিজ পেরিয়ে মিনিবাস আমাকে একটা জায়গায় নামিয়ে দিল। পরে জেনে ছিলাম ঐ damage ব্রিজটা ৭৫ বছর আগে তৈরি করেছিল জেসপ কোম্পানি। মিনিট পাঁচেক হাঁটা পথে নদীর ধারে উঁচু সমতল জায়গায় অনেকগুলো দর্মা আর টিনের ছাউনি দেয়া ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে ব্রিজ ক্যাম্প। তারই একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। তখন পর্যন্ত ব্রিজের সাইট সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো ধারণাই ছিল না।

প্রথমদিন সাইটে গিয়ে দেখলাম বিশাল দামোদরের রিভার বেডে বালির চড়া পড়ে আছে, শুধু মাঝখানে একটা ছোট্ট চ্যানেলের মতো জলের স্রোত বয়ে চলেছে। ওপর দিয়ে টেম্পোরারি একটা কাঠের ফুটব্রিজ। মোট বারোটা ওয়েল ফাউন্ডেশনের বেশির ভাগেরই কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার প্রথম কাজ নির্দিষ্ট করা হলো, ব্রিজের ওয়েল ফাউন্ডেশন থেকে শুরু করে প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট সুপারস্ট্রাকচার পর্যন্ত সমস্ত ড্রয়িং স্টাডি করে কোয়ান্টিটি এস্টিমেটিং, রিনফোর্সমেন্ট ডিটেইল ড্রয়িং থেকে বারবেন্ডিং সিডিউল তৈরি করা। সকাল বিকেল well sinking এর লেভেল মেজারমেন্ট নেওয়া, ওয়েলের tilt & shift মাপা, ব্রিজের সেন্টারলাইন চেক করা এবং সমস্ত construction activities সুপারভাইজ করা। অর্থাৎ আমার মতন একজন ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ারকে মোটামুটি জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সমস্ত কাজই করতে হবে। একটা সুবিধা ছিল যে, আমার রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার থেকে কোম্পানির ডিরেক্টর, ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার সবাই ছিলেন বি.ই.কলেজের প্রাক্তনী। তাই প্রথম দিন থেকেই কোম্পানির সমস্ত স্টাফেরা আমি শিবপুরের বলে খানিকটা সমীহ করত।

যাইহোক, জয় মা বলে কাজে লেগে পড়লাম। Well Sinking হচ্ছিল বালি, শক্ত মাটি, তারপর ওয়েদারর্ড রক এবং শেষ পর্যন্ত হার্ড রকের ভেতর। ওয়েলের জলের ভেতর নেমে sinking এর কাজ করছিল ডুবুরিরা (Diving team)l ওরা জ্যাক হ্যামার/রক ব্রেকার নিয়ে ওয়েলের নীচে কাটিং এজ থেকে রক কেটে পরিস্কার করত, সেন্টারে রক কেটে সাম্প (SUMP) তৈরি করত। তারপর কাটিং এজ থেকে কিছুটা দূরত্বে ড্রিল হোল করে জিলাটিন স্টিক ও ডিটোনেটরের সাহায্যে সিরিজ কানেকশন করে উপরে ব্যাটারিতে ব্লাস্ট করা হতো। এইভাবে blasting-এর পর ওয়েল রকের ভেতর ধীরে ধীরে বসত। কিন্তু জলের ভেতর ডুবুরিরা কেমন কাজ করছে অর্থাৎ কাজ কতটা এগোচ্ছে সেটা প্রত্যক্ষ করার জন্য সাইটে কোনো উপায়ই ছিল না। অর্থাৎ ঐ রকম একটা রিমোট সাইটে ক্লোজড সার্কিট টিভি বা আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফির কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এতো কিছুর অবতারণা কেন করলাম তা বোঝা যাবে পরবর্তী পর্বে, আমার দারুণ কিছু অভিজ্ঞতার বর্ননা করার সময়।

ওয়েল গুলোর sinking এর দায়িত্বে ছিল তিনটে diver’s team. তার মধ্যে একটা কলকাতার এবং বাকী দুটো কেরালার। কোলকাতার কোম্পানির ডুবুরীরা খুবই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি মেনে কাজ করত -যেমন মুখে মাস্ক, গায়ে ডুবুরির soft skin tight dress (blue), কোমরে ওজন (weight) বেল্ট, নাকে নোজ ক্লিপ ইত্যাদি পরে নামত। কিন্তু কেরালিয়ান ডাইভাররা খালি গায়ে তেল মেখে, মাথায় মাস্কের পরিবর্তে হার্ডক্যাপ বা কপার হেলমেট পরেই নামত। বেশির ভাগ কেরালার ডুবুরীরা সমুদ্রের ধারের মৎস্যজীবি গ্রাম্য পরিবারের ছেলে এবং কনট্রাকটাররা তাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে এই কাজ করাতো। তাদের অনেককেই দেখতাম, হঠাৎ দরকার পড়লে এয়ার পাইপ ছাড়াই ডুব দিয়ে জলের অনেক গভীরে গিয়ে কোনো জিনিস তুলে নিয়ে আসতে পারত। প্রত্যেকটা ওয়েলের পাশে রাখা এয়ার কমপ্রেশার থেকে এয়ার পাইপ লাইন সংযোগ করা থাকত ডুবুরীদের মাস্ক বা হার্ড ক্যাপের সাথে।

কলকাতার টিমটার sinking progress, খুব ভালো ছিল অন্য দুটো টিমের থেকে। আমি একদিন মিঃ কুনাডি (Kunadi), কেরালার ডুবুরীদের কনট্রাকটরের কাছে জানতে চাইলাম, তাদের sinking progress এতো slow হওয়ার কারণ কি? তার উত্তরে সে আমাকে বোঝাতে শুরু করল, “সাব, কাটিং এজ তো চারো তরফ ক্লিয়ার কর দিয়া, বিচমে ইতনা বড়া কুন্ডি বানা দিয়া, ইতনা blasting করনেকা বাদ ভি কোঠি বইঠতা নেহি। বড়িয়া করকে পূজা চড়ানা হোগা”…ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম এই ধড়িবাজ লোকটা আমাকে যা খুশী বোঝাতে চাইছে। ভাষার তারতম্যে আমারও কমিউনিকেট করা খুবই মুস্কিল হোতো। একমাত্র কুনাডিই কিছুটা ইংরাজি এবং ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে পারত। বাকীরা মালয়ালাম ছাড়া কিছুই বলতে পারত না।

এরপর একদিন সকালে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা।
সেদিন সকালে নিয়মমাফিক নদীর বেডে লেভেলিং ইনস্ট্রুমেন্ট সেট করে ওয়েলগুলোর sinking রেকর্ড করছিলাম আর সারকুলার ওয়েলগুলো কোন এক্সিসে কতটা কাত (tilt) হয়েছে তার পরিমাপ করছিলাম। কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে ওয়েলের পাড়ে (Well steining) হাত রাখতে গিয়ে হাতটা কমপ্রেসড এয়ার পাইপে লাগতেই পাইপের ভাইব্রেশন অনুভব করলাম। বুঝলাম জলের নীচে ড্রিল বা জ্যাক হ্যামার চালাচ্ছে ডুবুরি। এইভাবে বাকী তিনটে পাইপে একে একে টাচ করতে দেখলাম দুটোয় ভাইব্রেশন হচ্ছে আর বাকী দুটো পাইপ স্থির হয়ে আছে। ভাবলাম হয়তো দুজন ডাইভার জলের নীচে সাময়িক বিশ্রাম নিচ্ছে। এইটা ভেবে ভালো লাগলো যে অন্তত ওপর থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে লোকগুলো কাজ করছে কিনা। তারপর মিনিট দশ পনেরো পর আমার কাজের ফাঁকে আবার এসে সেই দুটো পাইপে টাচ করে দেখি একইরকম স্থির হয়ে আছে। সন্দেহ একটু হচ্ছিলই। আমি যতক্ষণ এইসব কান্ড করছিলাম ততক্ষণে উপরে বসে থাকা কেরালিয়ান ডুবুরীদের সঙ্গীদের মালয়ালাম ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথোপকথন ও ভাবভঙ্গী আমার মনে আরো সন্দেহের উদ্রেক করলো। আমি পাইপ ধরে আস্তে আস্তে টান দিতে থাকলাম আর পাইপ উপরে উঠে আসতে লাগলো। উপরে উঠে আসার পর আমি হতবাক হয়ে গেলাম ঐ পাইপ দুটোর মুখে শুধু হেলমেট লাগানো আছে, মানুষ নেই।

বুঝলাম কি সাংঘাতিক চুরি করছে ওরা, চারজনের ডিপ মানি নিচ্ছে কোম্পানীর কাছ থেকে আর দুজনকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে। কুনাডির slow progress এর রহস্য এবার আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেলো। আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সাইট অফিসের দিকে রওনা দিলাম বসকে জানাবো বলে, আর ঠিক তখনই আমায় ডেকে নিল ‘সাহা’ নামের এবি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এক বাঙালি ডাইভার ; যারা সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল পাশের ওয়েলে কাজ করতে করতে। বললো “রায়দা, এরকম তো ওরা রোজই করে”।
আমি বললাম, আমায় জানাওনি কেন?
ওরা বললো, আমরা একই প্রফেশনে কাজ করি তো তাই বলিনি ; আজ আপনি নিজে ধরতে পারলেন তাই বলছি। আমাকে আরো বললো, সেন সাহেবকে আপনি রিপোর্ট করবেন ঠিক আছে। কিন্তু sinking progress properly monitoring করতে হলে আপনাকে জলের নীচে যেতে হবে।
আমি বললাম, সেকি আমি তো ডাইভিং জানি না।
“সাহস আছে? আমরাই শিখিয়ে দেব” – আমাকে বলল ডি ‘সুজা বলে ওদেরই দলের এক গোয়ানিজ ডাইভার।
‘সাহা’ আর ‘পেরেরা’ আমাকে বলল, “পারবেন, পারবেন”। রাতে আমাদের ক্যাম্পে চলে আসুন। ওদের গ্রুপে বিভিন্ন জাতের (বাঙালি, গোয়ানিজ, শ্রীলঙ্কান, মারাঠি) ছেলেরা ছিল, অনেকেই নেভিতে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। আমার তখন রক্ত গরম, সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি তাই adventure এর নেশায় রাজি হয়ে গেলাম।

রাত্রে ডাইভারদের ক্যাম্পে হাজির হলাম অনেক উৎসাহ নিয়ে। আমার সম্মতি আছে জেনে আমাকেও উৎসাহিত করল ওরা। আর জানতে চাইল আমার শারীরিক বিষয়ে – যেমন সাইনাসের কোনো সমস্যা আছে কিনা, সর্দি-কাশির কোনো ক্রনিক প্রবলেম আছে কিনা তারসাথে ধূমপান কতদিন করছি এবং দিনে কত প্যাকেট সিগারেট খাই ইত্যাদি। যাইহোক সাইনাসের সে রকম কোনো প্রবলেম নেই শুনে বলল, ঠিক আছে তবে সর্দি কাশি বা বেশি ধূমপান করার জন্য অসুবিধা একটু হতে পারে, হয়তো একটু সময় লাগতে পারে ; অধৈর্য হলে চলবে না। তারপর একটা বই ধরিয়ে দিল আমার হাতে এবং তার যে যে chapter গুলো আমাকে পড়তে হবে সেগুলো মার্ক করে দিল। যেমন যে পদ্ধতীতে ডাইভিং করতে হবে তার methodology, Safety procedure, সিগন্যালিং পদ্ধতী, ডাইভিং এর সময় কি কি করনীয় আর কি কি করা যাবে না ইত্যাদি। বইটা ভালো করে পড়ার পর দুদিন বাদে সকালে পৌঁছলাম ওদের ওয়েলের সারফেস প্ল্যাটফর্মে।বইটা পড়ে কি বুঝেছি তার বিস্তৃত বিবরন আমাকে দিতে হোলো আর তার সাথে চলল প্রশ্নোত্তর পর্ব এবং আলোচনা।পুরোপুরি satisfy হবার পর আমাকে কিভাবে নামতে হবে তা হাতে কলমে করে দেখালো ওদেরই একজন আর আমি সবটা প্রত্যক্ষ করলাম প্ল্যাটফর্মে বসে।

এরপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহুর্ত, আমি পরে নিলাম ডাইভারের পোশাক। আমাকে বলে দেওয়া হলো যে short rope ধরে আমি নীচে নামব সেই রোপটা একদম টান টান অর্থাৎ vertical নয়, নিয়মিত ব্যবহারের ফলে একটু sag হয়ে আছে। তাই আমাকে নামার সময় রোপটাকে উপরের দিকে টান করে ধরে নামতে হবে। রোপ যেমন দু’হাতে চেপে ধরে নামতে বা উঠতে হবে তেমনি পা দুটোকেও রোপে দিয়ে স্লিপ করতে করতে খুব ধীরে ধীরে নামা ওঠা করতে হবে। পা দুটো কখনই Well Steining এর ভিতরের কনক্রিট ওয়ালের গায়ে রেখে ওঠা-নামা করা যাবে না। প্রতি দশফুট নীচে যাবার পর কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত মিনিট স্টপেজ অবশ্যই দিতে হবে অর্থাৎ আমার শরীরটাকেও বিভিন্ন গভীরতায় জলের নীচের প্রেশারের সাথে অভ্যস্ত করে নিতে হবে। এবং প্রথমদিন বিশেষভাবে আমার প্রতি নির্দেশ ছিল, এইভাবে নীচে নামার সময় যেখানে দুই কানে (Ear drum এ) ব্যথা অনুভব করব অথবা sinusitis pain শুরু হলেই আর নীচে যাওয়া চলবে না। তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে পাঁচ ফুট ওপরে উঠে আসতে হবে। তারপর মুখ দিয়ে হাওয়া নিয়ে (নাক নোজ ক্লিপ দিয়ে বন্ধ) কানে চাপ দিতে হবে।তাতেও নাহলে ক্রমাগত দুটো চোয়াল ফাঁক করে হাঁ করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে। চোয়াল হাঁ করে চিৎকার করতে হবে। এই পদ্ধতি চলতে থাকলে কান ক্লিয়ার হয়ে যাবে ; আর তখন আবার নীচে যাওয়া যাবে। নচেৎ তখনকার মতো উপরে উঠে আসতে হবে।

আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল অর্থাৎ প্রথমদিন দশফুট নীচের স্টপেজ অতিক্রম করে আরো ফুট পাঁচেক যাবার পরই শুরু হোলো ear drum এ যন্ত্রণা। কিছুটা ওপরে এসে চোয়ালে নানা কসরত করেও কান ক্লিয়ার করা গেল না। তখনই সিগন্যাল পেলাম ওপরে উঠে আসার। ওপরে আসতেই সাহা জানিয়ে দিল, রায়দা আপনার আজ তো যাওয়া যাবেই না, আগামী সাতদিন ডাইভিং বন্ধ থাকবে। শুনেই তো আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, নীচে যেতে পারবো তো?
“নিশ্চয়ই পারবেন, তবে যা বলবো তা করতে হবে”।এরপর যা জানালো সেটা এইরকম – আমাকে রোজ এক সপ্তাহ কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেতে হবে। কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেতে বিচ্ছিরি গন্ধ লাগবে শুনে বলল, কাঁচা রসুন ডালের মধ্যে ফেলে চিবিয়ে খাবেন। গন্ধ লাগলেও কিছু করার নেই, খেতেই হবে। এইভাবে অপেক্ষার জন্য সাতদিন আমার খুব কষ্টে কাটলো কিন্তু বাধ্য ছাত্রের মতন ওদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম।

এক সপ্তাহ পর শুরু হোলো adventure এর দ্বিতীয় পর্ব। একই নিয়মে নামা শুরু করলাম জলের ভেতর এবং সেই একই ভাবে eardrum এ ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। সাথে sinusitis pain, তবে এবার আরও একটু নীচে যাবার পর। যথারীতি চোয়াল খোলা-বন্ধ করার সাথে সাথে মুখ হাঁ করে এমন চীৎকার শুরু করলাম যেন কেউ জলের তলায় আমার গলা টিপে ধরেছে। হঠাৎ আশ্চর্যজনক ভাবে কান থেকে যেন ছিপির মতো কিছু খুলে গেল। কিছুক্ষণ পর অন্য কানটাও ক্লিয়ার হয়ে গেল। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, মনে হোলো যেন দুটো কানেই অনেক বেশী বেশী শুনতে পাচ্ছি, যা আগে বন্ধ হয়ে ছিল। এবং কানে আর একটুও ব্যাথা নেই। সিগন্যাল দিয়ে আমি নীচে নামতে লাগলাম। আনন্দে মনটা ভরে ছিল আর একটা চাপা উত্তেজনাও অনুভব করছিলাম এইভেবে যে আজ অনেক চেষ্টার পর সফল হতে চলেছি। এইভাবে প্রায় আশি ফুট নীচে পৌঁছে গেলাম। পা রাখলাম ওয়েলের নীচে এবড়ো খেবড়ো পাথরের ওপর যার ওপর silt এর একটা পুরু আস্তরন (layer) পড়ে আছে। রোপটা ছেড়ে দিলাম। Well curb এর নীচে বসে পড়ে কাটিং এজের তলায় হাত দিয়ে দেখতে শুরু করলাম কেমনভাবে রক কেটে কেটে কাটিং এজ ক্লিয়ার করেছে ডুবুরিরা আর কোথায় কতটা কাজ এখনও বাকী আছে। কোথায় কোথায় ড্রিল করেছে, কেমনভাবে sump বানিয়েছে সবকিছু। কোনো জায়গায় কাটিং এজের inside & outside প্লেটের ওয়েল্ডিং ভেঙে বেঁকে গেছে দেখলাম। এটা হার্ড রকের impact এর কারণে আর কিছুটা হয়তো blasting এর effect.

এতক্ষণ আমি সিগনাল পাঠাচ্ছিলাম এবং সারফেস থেকে ওদের সিগন্যালও ঠিকমতোই পাচ্ছিলাম। প্রথমদিন আর বেশি সময় জলের এত গভীরে একা থাকা ঠিক হবে না মনে হতেই উঠতে শুরু করলাম রোপ ধরে। কিন্তু কিছুদূর ওপরে ওঠার পর শুরু হোলো আসল সমস্যা। প্রায় অর্ধেক ওঠার পর আর ওপরে উঠতেই পারছিলাম না। কোনো সিগনালও পাঠানো যাচ্ছিল না। হঠাৎ মাথার ওপরে পাইপে হাত দিয়ে অনুভব করলাম রোপটা এয়ার পাইপের সাথে পাক খেয়ে জড়িয়ে গেছে এবং সমস্ত পাকগুলো এক জায়গায় হয়ে গেছে। একটু নার্ভাস লাগলেও আমি উল্টোদিকে ঘুরে পাক খুলতে লাগলাম এবং কিছুটা খুলে ফেলার পর আবার উঠতে লাগলাম। কিন্তু আরো কিছুদূর ওঠার পর সেই একই অবস্থা। ইতিমধ্যে আমি প্রায় অনেকটাই উঠে এসেছিলাম, উপর থেকে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট নীচে। কিন্তু উল্টো ঘুরেও পাক খোলা যাচ্ছিল না। কোনো সিগনালও কাজ করছে না। এইবার সত্যিই খুব নার্ভাস হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছি না কি করা উচিত, তবু খোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। এইভাবে মিনিট দশেক চলার পর ওপর থেকে একে একে দুজন এসে আমায় rescue করল, পাক খাওয়া রোপ ছুরি দিয়ে কেটে আমায় ওপরে নিয়ে এলো।

তারপর আমাকে ওরা বলল কি হয়েছিল ঘটনাটা। কান ক্লিয়ার হবার পর আমি আনন্দের চোটে ভুলে গিয়ে সঠিকভাবে নির্দেশ না মেনে কনক্রিট ওয়ালের গায়ে পা দিয়ে নেমেছিলাম। এবং শেষ ফুট দশেক stiening wall না থাকায় (অর্থাৎ well curb portion) যেটা slope এ cutting edge এ গিয়ে মিশেছে, সেই জায়গায় আমি ঘুরতে ঘুরতে নেমেছি। তখনই রোপটা পাইপের সাথে পেঁচিয়ে গিয়ে পাক খেয়ে গেছে। এবং নীচে গিয়ে আমি যখন রোপটাকে ছেড়ে দিয়ে periphery বরাবর ঘুরে ঘুরে inspection করেছি তখন কিন্তু রোপটা এয়ার পাইপ থেকে আলাদা হয়ে যায় নি। আমি যত ঘুরেছি রোপটা তত পাকিয়ে গেছে পাইপের সাথে।

এইভাবে এক সাংঘাতিক বিপদের হাত থেকে, বলতে পারা যায় নিশ্চিত প্রাণসংশয়ের পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেয়েছিলাম সেদিন।

এখনও ভাবতে আশ্চর্য লাগে আজ থেকে ৪৩ বছর আগে তারুণ্যের আবেগে ভেসে কি সাহসটাই না দেখিয়ে ছিলাম। তারপরও আরো বেশ কয়েকবার করেছি, এবং সফলভাবেই ডাইভিং করেছি একাধিক ওয়েলে।

Sahityika Admin

1 comment