ধন্য মাতা
সমীর কুমার সরকার, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
কেউ এত কাঁদলে কীভাবে বসে থাকা যায়? ওকে শান্ত করব কী করে? কী যে হয়েছে সেটাও বুঝতে তো পারছি না? নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক কিছু হয়েছে। এতদিন ধরে আছি, কাউকে তো কোনোদিন এইভাবে কাঁদতে দেখি নি। তাহলে কে আজকে কার জন্য সে এমন করে কাঁদছে? আমার তো দেখা উচিত? আমরা যদি না দেখি তাহলে কে ওকে দেখবে? কিন্তু, কিন্তু কী করে যাবো? অন্য বাড়ির লোকেরাও তো বেরোচ্ছে না। করুণ, তীব্র আওয়াজ। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। সেই গতকাল বিকেল থেকেই শুনছি। কিছুই করতে পারছি না। কি যে করি?
সকালবেলায় খবরের কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে আওয়াজটা কোন দিক থেক আসছে বোঝার চেষ্টা করছি, কখনও মনে হচ্ছে বাড়ির কাছাকাছিই কোন জায়গা থেকে আসছে, আবার কখনও মনে হচ্ছে দূর থেকে। আমি হয়তো কিছুই করতে পারব না, তবুও যদি পাড়ার লোকজন বের হতো, তাহলে আমিও বের হয়ে দেখতাম কী হয়েছে। কিছু পারি না পারি, সান্ত্বনা তো দিতে পারতাম? নিজের মনকে তো বোঝাতে পারতাম যে আমার মনেও দয়া মায়া আছে।
আমি যেখানে কিছু করতে পারি না, সেই ব্যাপারে কোন খবর রাখি না। কিন্তু আজকের কান্নাটা মনকে এতটাই চঞ্চল করে দিল যে ঘরে কিছুতেই বসতে পারছি না, বারবার ইচ্ছে করছে এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করার। গৃহিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি সেও এই চীৎকারে, আর্তনাদে মর্মাহত হয়ে আছে, কিন্তু কিছু বলছে না, আমি যদিও মুখে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করছি, সে কিন্তু কিছু বলছে না, অসহায়ের মতো চারদিকে দেখছে।
সন্ধ্যেয় রাস্তার লাইট সব জ্বলে গেলে বাগানের ঝোপঝাড় বা রাস্তার পাশে ছোট ছোট জংলি গাছগুলোর দিকে যেতে ভয় লাগে। এই ঝোপের চারদিকের অন্ধকারে বড় বড় সাপের ঢিপি আছে। এই ঢিপিগুলো কেউ ভাঙে না, ঝোপগুলোকেও নির্মূলও করে না। এভাবেই বছরের পর বছর আমরা সাপেদের নিয়েই থাকি। এখন গরমকাল বলে সাপদের বাগানে ঘুরতে দেখা যায়। অনেক সময় বাড়িতেও ঢুকে পড়ে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের এখানে কাউকেই সাপে কামড়িয়েছে বলে শোনা যায় নি। তাই এত সাপ থাকা সত্ত্বেও সাপের ঢিপিগুলোকে কেউ ভাঙতে সাহস করে না। মাঝে মাঝে সাপুড়ের দল এসে কিছু সাপ ধরে নিয়ে যায়।
এখন যেন কান্নার আওয়াজটা আরও বেড়ে গেল। কান্নাটা কিছুতেই কমছে না দেখে আমি যখন টর্চ নিয়ে বেরোবার চিন্তা করছি তখন দেখি আমার সামনের বাড়ির ভদ্রলোক ঘরে ঢুকছেন। আমি গলায় জোর এনে উনাকে এই কান্নার কথা বললেও তিনি অবজ্ঞা করলেন। গৃহিনী বলল, কেউ যখন আগ্রহ দেখাচ্ছে না তখন তুমি কেন এত বিচলিত হচ্ছো? আমার ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়েও মায়ের সাথে আমার হাত টেনে রেখে বলছে, তুমি যাবে না। ওদের কথাটাও ঠিক, কিন্তু মনটাও মানছে না। কান্নাটা মাঝে মাঝে থেমে গেলেও বন্ধ হচ্ছে না, কিছুক্ষণ পরে পরেই সেই কান্না।
আমার সাথে সাথে আমার মেয়েও নিজের গান বাজনা, পড়াশুনা ছেড়ে একবার বাইরের বারান্দায় যাচ্ছে আর তারপরেই এসে বলছে, এখনও কাঁদছে। আমার আর ভালো লাগছে না। রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। ছোট্ট মেয়েটাও সমস্ত রাত ধরে আমাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লো। সে ঘুমালেও আমি চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছি না, এখন কান্নার আওয়াজটা আরও বেড়ে গেছে।
ভোরবেলাতে কান্নার আওয়াজটা পাচ্ছি না বলে খানিক স্বস্তি পেলাম। পাড়ার কোনো লোকের চোখেমুখেও এই ঘটনার কোনো ছাপই দেখতে পাচ্ছি না। তারা সকলেই প্রাত্যহিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। শরীর চর্চা করছে, বাগান থেকে পুজোর ফুল তুলছে, দুধের ছেলেটা সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি প্যাকেট দিতে এসেছে, আমিও অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে শুরু করলাম। মেয়ে স্কুলে চলে যাওয়ার পরে আমিও কারখানায় চলে গেলাম।
বিকেলবেলায় বাড়ি আসতেই মেয়ে বলল, তুমি মেনিকে চেনো?
আমি বললাম, না।
– চেনো না? কোনোদিন দেখো নি? এদিকে এসো, তোমাকে দেখাচ্ছি।
এই বলে আমাকে বাড়ীর ভেতর ঘরে জানলা দিয়ে একটা ঝোপের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে “ওখানে থাকে।“
– কালকে মেনিই কাঁদছিলো।
– সেটা তো বুঝতেই পারছিলাম বিড়ালের কান্না, তবে কোন বিড়াল কাঁদছে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। তোমার মায়ের জন্য আমাদের বাড়িতে এত বিড়াল আসে যে তাদের সবাইকে আমি চিনতেও পারি না, নামও জানি না। তোমরা তো বিড়াল, পাখিদের আবার কতরকমের নাম দিয়েছো। তোমাদের জন্য আমার দুধের খরচ ও চাল, গমের খরচ বেড়ে গেছে।
আমার শ্রীমতি আমার দিকে বিরক্তি চোখে দেখলো, “হ্যাঁ, তুমি তো খরচই দেখবে, ঐ অবলাদের ভালবাসতে তো শিখলে না।“
বললাম, “আরে? খাওয়ালেই ভালবাসা হয়? কালকে তো দেখলাম না একবারও গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে? আমাকেও যেতে দিলে না।“
– তুমি বুঝতেও পারবে না যে আমার মনটা কেমন করছিল, কিন্তু সাপের জন্য যেতে পারি নি। ঐ আওয়াজটা মেনিরই ছিলো। সোনুও বলছিল যে মেনিই কাঁদছে। এ’নিয়ে আমি একদম কথা বলি নি কারণ তাহলে আমাদের মেয়েটাও খুব দুঃখ পাবে। সেও ওদেরকে ভালবাসতে শিখে গেছে। সারা দুপুর ওদের নিয়েই থাকে, নিজের হাতে খাওয়ায়, তাদের সাথে খেলে। ওর জন্যই আমি চুপ করে ছিলাম। সত্যি বলছি, এই অবলাদের বাইরে রাখতে ভালো লাগে না। কিন্তু এই ফ্ল্যাট বাড়িতে ওদের কী করে রাখব? গ্রামের বাড়ির মতো যদি খোলামেলা জায়গা থাকত, তাহলে আমি ঘরেই রাখতাম, খাঁচা বন্দী করতাম না। আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেই দিতাম।
দেখলাম মায়ের ভালবাসা। এক সন্তানের জন্য মন খারাপ হলেও অন্য সন্তানের ভালোর জন্য নিজের মধ্যেই সব কষ্ট চেপে রাখে। ধন্য। ধন্য এই ‘মহান মাতা’।
আমার মেয়ে পশুপাখি খুব ভালবাসে। পাখি, আর বেড়াল অন্ত প্রাণ। সকাল থেকে পালা করে করে ছাদে গিয়ে চাল, গম খাওয়ায়। আর আমাদের ছাদে জায়গায় জায়গায় মাটির গামলায় জল রেখে দিয়েছে, রোজ সেই জল পাল্টে দেয়। আবার গরমের সময় পাখীদের কষ্ট হবে বলে ছাদে না দিয়ে বারান্দায় জলের ব্যাবস্থা করে দেয়। মেয়ে অপেক্ষা করে কখন পাখীগুলো সেই গামলার জলে নেমে ডানা ঝাপটিয়ে স্নান করবে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য সে হাঁ করে বসে থাকে।
দু’একটা পাখি দেখেছি বারান্দায় এসে ডাকে “টুনি” “টুনি” বলে। আমার মেয়ের ডাকনাম টুনি। কে শেখালো ওদেরকে এইভাবে নাম ধরে ডাকতে? এই ডাক শুনলে মেয়ে জবাব দেয় “আসছি, আসছি।“ কিন্তু পাখিগুলো ডেকেই যায় যতক্ষণ না মেয়ে সশরীরে গিয়ে দেখা দেয়। তারপর পাখীগুলোর কি আনন্দ, চ্যাঁচামিচি। এসে মেয়ের গায়ে মাথায় বসে, এমনকি যে টিয়া পাখিকে ধরতে গেলে মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যায়, সেই পাখিকেও দেখি তার কাঁধে চড়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন করছে। মনে হয় আমার মেয়ের কানে কানে কিছু বলছে। আর তখন মেয়ের কি হাসি! পাখীগুলো মেয়ের হাত থেকে খাবার খায়। মেয়ে পাখীগুলোর নামও দিয়েছে। রেশমী, টুসকি, বুলবুলি, ঝুমুর এইরকম আরও কয়েকটা। এগুলো সব ওর স্কুলের ক্লাসের মেয়েদের ডাকনাম। আর মা মেয়ে দুজনেই এই নাম ধরে ধরে ওদের পাখীদের ডাকে। আবার যদি কোনোদিন কোনো পাখি না আসে তাহলে মেয়েকে দেখেছি অন্য পাখিদেরকে তার কথা জিজ্ঞেস করে। তারাও আমার মেয়ের কথা বুঝে উড়ে গিয়ে তাদের সেই সাথীকে নিয়ে আসে, কিন্তু আমি যদি খাওয়াতে যাই, তাহলে ওরা উড়ে যায়।
এরপর মা মেয়ে মিলে বারান্দার পিলারের এক কোনে পাখির বাসা করে দিলো। পাখিরা এখানে এসে বাচ্চা দেয়। জানে এরকম নিরাপদ জায়গা আর পাবে না। আর মা মেয়ে মিলে পাখীর ছানার ঠাকু’মা দিদিমার ভূমিকা পালন করে। পাখীর মা ঠাম্মা দিম্মার জিম্মায় ছানাদের রেখে নিজের নিজের কাজে চলে যায়।
এ তো গেল পাখিদের কথা। বিড়ালদের সে ছাদে উঠতেই দেয় না। ছাদ কেবল পাখির জন্য। বিড়ালদের জন্য বাড়ির সামনের দিকে খোলা বারান্দায় সময় করে দুধ ও খাবার দেয়। কিন্তু আমার স্ত্রী তাদের কাউকেই ঘরে ঢুকে ঘর নোংরা করতে দেয় না, তাদের খাঁচাবন্দী করতেও চায় না। বলে, বন্যেরা বনেই সুন্দর। আমাদের মেয়েটাও মায়ের সাথে থেকে বিড়াল, পাখিদের ভালবাসতে শিখে গেছে, সকালের দিকে স্কুলে যায় বলে তাদের সাথে খেলতে ও খাওয়াতে পারে না, কিন্তু দুপুর থেকেই মা মেয়ে ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আমি আবার এ’সব একদম পছন্দ করি না। প্রথমদিকে আমার বউয়ের সাথে ঝগড়াও করেছি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় নি। তখন দেখতাম একটা দুটো পাখি আসত, তারপরে রোজই পাখির সংখ্যা বাড়তে লাগল তার সঙ্গে দুনিয়ার বিড়ালও এসে হাজির। আমি আর এখন কিছু বলি না। মাসের খরচের একটা অংশ বরাদ্দ করে রেখে দিয়েছি এই বেড়াল আর পাখিদের জন্য।
এতক্ষণ আমার বউয়ের গুণগান করতে গিয়ে আসল ঘটনা থেকে সরে গেছি। কালকের কান্নাটা মেনির ছিল। দুদিন ধরে মেনি আসছিল না বলে মা মেয়ে নিজেদের মধ্যে অনেকবার আলোচনা করছিল। মেনি সন্তানসম্ভবা। ওর বাচ্চা হয়ে গেল কিনা সেই চিন্তাই করছিল। বাচ্চাগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা, মেনির শরীর কেমন আছে এইসব নিয়ে মা মেয়ে বেশ উদগ্রীব ছিল।
Add comment