আমার কর্মজীবনের দুই গুরু
শৈবাল সরকার, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
শিক্ষক, বা গুরু। প্রয়োগক্ষেত্রে সমার্থক শব্দ।
আজ আমি যেখানে, আজ ৬৬ বছর বয়সের সারাজীবনে যেটুকু জ্ঞান আমি অর্জন করেছি, পিছুপানে তাকিয়ে দেখি, কয়েকজন ছিলেন আমার আর্কিটেক্ট, তারাই আমার ভিত বানিয়ে দিয়েছিলেন।
ছাত্রাবস্থায়, মানে একদম শিশুকালের সেই স্লেট পেন্সিলে এবিসিডি, বা অআকখ শেখা থেকে নিয়ে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা পর্যন্ত ধাপে ধাপে নানান জনের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যায়ন করে আমি আমার নিজের ভিত তৈরি করার চেস্টা করেছি। পরে বুঝেছিলাম যে আমার ইঞ্জিনিয়ারিঙের ডিগ্রীটাই কিন্তু আমার শেখার জীবনের শেষ অধ্যায় নয়। বরং এখান থেকেই আমার আরও নতুন অনেক কিছুরই শেখার শুরু।
কর্মজীবনে এসে দেখি এখানে ডিগ্রির বালাই নেই। ধরাবাঁধা রুটিনের ক্লাস নেই। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে যেদিকে তাকাই, পুরোটাই স্কুলের বা কলেজের ল্যাবরেটরির মতন। ফ্যাক্টরির শপ ফ্লোরের চারিদিকে নানান রকমের মেশিন। যেমনটি আমার স্কুল কলেজের ল্যাবরেটরিতে ছিলো। এতদিন যা শিখেছি, এবার এই ল্যাবরেটরিতে এসে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে আমাকে সেটাই হাতেকলমে প্রয়োগ করে দেখাতে হবে। এই ল্যাবে আমার কোন প্রফেসর নেই। কোন একজন্ সুপারভাইজার, সহজ কথায় আমরা বলি বস, উনি আমাকে কিছু একটা কাজ বুঝিয়ে দেবেন। স্কুল কলেজের ল্যাবের মতনই কিছুদিন পরে পরে আমাকে নতুন নতুন টাস্ক দেবেন। বস আমাকে আমার কাজের খানিকটা সূত্র দেবেন। তারপর বাকী সবটুকুই আমার নিজের দায়িত্বে।
প্রায় চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে আমি বিভিন্ন সময়ে অনেক সিনিয়রদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি । তাঁর মধ্যে তিনজনকে আমি আমার আদর্শ হিসেবে মানি, শ্রদ্ধা করি। তাঁরা আমাকে শুধুই টাস্ক দিয়েই নিজেকে দায়িত্বমুক্ত করেন নি, আমি যাতে আমার সেরাটুকু দিতে পারি, সেভাবেই আমাকে জ্ঞান, প্রেরণা দিয়েছেন ও দায়িত্বশীল বানিয়েছেন। এর সাথে আমার যাতে সর্বাঙ্গীন সেলফ ডেভেলপমেন্ট হয়, সেজন্যও সচেতন থাকতেন।
আমার কর্মজীবনের দেখা আদর্শ কয়েকজনের মধ্যে S R Chowdhury (শান্তি রঞ্জন চৌধুরী) হলেন প্রথম। আমি ১৯৭৯ সালের জুন মাসে ভদ্রেশ্বর Lagan Jute Machinery কোম্পানিতে শিফট ইনজিনিয়ার হয়ে ফ্যাক্টরিতে জয়েন করেছিলাম। কোম্পানি সম্বন্ধে দু’কথা বলি। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত লগন জুট মেশিনারি ছিলো আইরিশ কোম্পানি, আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টের James Mackie কোম্পানির পরিচালনায় ছিল। তাই আমাদের শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট ছিলো আইরিশদের হাতে। ভারত সরকারের FERA কার্যকরি হওয়ার পরে এই কোম্পানি Government of India Undertaking হয়ে যায়।
ফ্যাক্টরিতে আমার আট ঘন্টা শিফট ডিউটি ছিল, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২’টো। আর পরের সপ্তাহে অন্য শিফটে ২টা থেকে ১০টা। সেইসময় আমি পার্ট-টাইমে ম্যানেজমেন্ট পড়তে চেয়েছিলাম। তখন কলকাতা ইউনিভার্সিটির The Indian Institute of Social Welfare & Business Management (IISWBM) এ ইভনিং কোর্সে MBA পড়ার সুযোগ ছিলো। এর এডমিশন টেস্টে বসার জন্য কোম্পানির অনুমতি লাগতো। আমি proper channel এ অনুমতি চাইলাম। কিন্তু তখন আমাদের ওয়ার্কস ম্যানেজার ছুটিতে ছিলেন। আর এসিস্টেন্ট ওয়ার্কস ম্যানেজার কিছুতেই আমার এপ্লিকেশন এপুভ করছিলেন না। উনার যুক্তি ছিলো যে আমার যখন বি শিফটে ডিউটি পড়বে তখন আমার পক্ষে ক্লাস এটেন্ড করা মুশকিল হবে। ঐ অবস্থায় আমাকে লিখিত আন্ডারটেকিং দিতে হয়েছিলো যে কোম্পানির ডিউটি আমি নিয়মিত এটেন্ড করব। তাঁর পরেই আমি এডমিশন টেস্টে বসার অনুমতি পেয়েছিলাম।
যখন এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট পাবলিশ হল, দেখলাম আমি ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছি, তখন ওয়ার্কশ ম্যানেজার সদ্য ছুটি থেকে ফিরে এসেছেন। আমি উনাকে খুবই অনুরোধ করলাম কোন একটা ব্যবস্থা করতে যাতে বি শিফটেও আমি ক্লাস এটেন্ড করতে পারি। কিন্তু আমার শিফট পার্টনার কিছুতেই আমাদের নিজেদের মধ্যে ডিউটি এডজাস্ট করতে রাজি হলো না। এই ঝামেলা হেড অফিস অবধি গড়িয়েছিল।
S R Chowdhury তখন সদ্য BHEL থেকে এসে Lagan এর চিফ একজিউকিটিভ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। উনি প্রতি শনিবার কলকাতা থেকে গাড়িতে ভদ্রেশ্বর ফ্যাক্টরিতে আসতেন। একদিন ওনার ফ্যাক্টরি ভিজিটের দিনে আমার সুপারভাইজার ছুটিতে ছিলেন। তাই শপ ফ্লোরের আপাত দায়িত্বে আমিই ছিলাম। উনি ফ্লোরে আসতেই আমি সামনে এগিয়ে গিয়েছিলাম কারণ যদি কোন প্রশ্ন করেন, আমাকেই উত্তর দিতে হবে। সেই সময় হঠাৎই আমাকে দেখেই উনি বেশ রেগেই বললেন “How will you attend classes during your B shift?”
আচম্বিতে এই প্রশ্নে হতবম্ভ হয়ে আমি তাকিয়ে ছিলাম। সেই সময় কোন সদুত্তরই আমি দিতে পারিনি। ভাবলাম আমি তো সাধারণ একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, মাত্র দুবছর হলো কাজ করছি। উনি এসব কি করে জানলেন? কি জানি কি হলো, বুঝলাম না। কয়েকদিন বাদেই আমাকে হেড অফিসে পারচেজ ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করে দেওয়া হলো। আমাদের পার্ক স্ট্রিটের হেড অফিসে ডিউটি ছিল সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা অবধি। এবার ক্লাস করার আমার কোন সমস্যাই রইল না।
শনিবার আমাদের হেড অফিস বন্ধ থাকত। আর উনি প্রত্যেক শনিবার ফ্যাক্টরি যেতেন। ফ্যাক্টরির প্রডাকশন ডিপার্ট্মেন্ট প্রায়শই অভিযোগ করতো যে মেটিরিয়াল (কাঁচা মাল) নেই। সেটা নিজের চোখে দেখার জন্য প্রতি শনিবার উনি আমাকে সঙ্গে করে ফ্যাক্টরি নিয়ে যেতেন যাতে অকারণে মেটিরিয়াল নেই বলে প্রোডাকশনের অসুবিধা হয়েছে কেউ বলতে না পারে।
আরেকটি প্রসঙ্গে আসি। অফিসের ডিসিপ্লিন। আইরিশদের সময় থেকেই আমাদের পার্ক স্ট্রীট হেড অফিসে অফিসার গ্রেডে এটেনডেন্স রেকর্ড করার চলই ছিল না। ধরেই নেওয়া হত যে অফিসারদের দায়িত্ব জ্ঞান যথেষ্ট। তাঁরা ছুটি নিলে নিজেই চিঠি দিয়ে জানাবে। কিন্তু অনেকেই এই ব্যবস্থার অপব্যবহার শুরু করল। একদিন দু’দিন ছুটি নিলে অনেকে লীভ এপ্লিকেশনই জমা দিতো না। উনি জানতে পেরে অফিসারদের এটেনডেন্স রেজিস্টার চালু করলেন। সবার ওপরে ওনার নাম। সুতরাং এরপর সিনিয়র অফিসাররাও আর কিছুই বলতে পারল না।
অফিস শুরুর সময় ছিল সকাল সাড়ে নটায়। অনেকেই অফিসে এসে রেজিস্টারে আসার সময়টা ঠিকমতন লিখত না। উনি তখন ওনার সেক্রেটারিকে বললেন নটা চল্লিশ হলে রেজিস্টার ওনার ঘরে দিয়ে দিতে। উনি নিজের হাতে লাল কালিতে লেট মার্ক করতেন। সমস্ত অফিসারদের এইভাবেই উনি নিয়ম মানতে বাধ্য করেছিলেন।
এইরকম সব কড়া নিয়ম অনেকেই পছন্দ করত না। বছর দুয়েক বাদে উনি Jessop এর চিফ একজিকিউটিভ হয়ে চলে যান। তখন অনেকেই বলেছিল Lagan এর হেড অফিসে অফিসারদের সংখ্যা মাত্র জনা কুড়ি। তাই অনেক খেল দেখিয়েছে। Jessop এ অফিসারদের সংখ্যা দেড়শর বেশি। লেট মার্ক করতে গেলে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। Jessop এর হেড অফিসে দোতলায় ওঠার একটাই চওড়া সিঁড়ি ছিল। শুনেছিলাম প্রথম দিকে উনি সকাল সাড়ে নটা থেকে সাড়ে দশটা অবধি সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সবাই তখন ঠিক সময় আসতে বাধ্য হয়েছিল।
এইরকম আরও অনেক ঘটনা আছে। সবার আগে তিনি অফিসে আর ফ্যাক্টরিতে দৈনন্দিন শৃংখলা ফিরিয়ে আনেন। তারপর কোম্পানির প্রতিটি খুঁটিনাটি খবর রাখতেন, এমনকি সকলের ব্যাক্তিগত সুবিধা অসুবিধেগুলো পর্যন্ত।
কেউ কেউ আমার লেখা পড়ে বলবেন যে, উনি কি এমন করেছেন? অফিসে স্কুলের মতন ডিসিপ্লিন আনার চেস্টা করেছেন মাত্র। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, সময়টা ৭০ এর দশকের শেষভাগে। তখন পশ্চিমবঙ্গে বিরাট রাজনৈতিক পালাবদল হয়ে গেছে। অফিসে ফ্যাকট্রিতে সব জায়গায় লাল ঝান্ডার দৌলতে কর্মসংস্কৃতির অবনতি হয়েই চলেছে। চারিদিক থেকে খবর আসছে শীর্ষ ম্যানেজমেন্টের লোকজন অপমানিত হচ্ছেন। সেই পরিস্থিতিতে আমাদের কোম্পানি তখন একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, এবং কাজকর্ম খোদ কলকাতা শহরের বুকে, আর ভদ্রেশ্বর শিল্পাঞ্চলে। যারা সেইসময় ব্যারাকপুর, টিটাগড়, ভদ্রেশ্বরে কাজ করতেন, তাঁরাই জানবেন কি আতঙ্কের ছিলো সেই দিনগুলি। আর যেহেতু আমাদের আধা সরকারি কোম্পানি, তাই আমাদের চাকরী আর মাইনে কেউ ছুঁতেও পারবে না। কিছু হলেই পোস্টার, ঝান্ডা, ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও শুরু হয়ে যাবে। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে S R Chowdhury তাঁর ব্যাক্তিত্ব, সাহস ও কর্মদক্ষতা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। শুধু নিয়মানুবর্তিতাই নয়, কোম্পানির সর্বাঙ্গীন উন্নতিও করতে পেরেছিলেন। সেসব আমি নিজের চোখের সামনে দেখেছি।
যদিও আমার প্রথম সাক্ষাৎ তাঁর সঙ্গে খুব ভালো ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি নিজগুণে আমার চোখে একজন শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছেন।
অনেক ঘটনা লিখতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। আমি শুধু আমার জন্য উনি কি করেছিলেন, কতটুকু কাজ শিখিয়েছিলেন, সেটাই বললাম।
নিজের চোখের সামনে থেকে দেখা। শান্তি রঞ্জন চৌধুরী (S R Chowdhury )। আমার কর্মজীবনে উনিই আমার প্রথম গুরু।
আমার কর্মজীবনের আরও এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রী বিজন নাগ।
এনার সম্বন্ধে বলতে গেলে Fine Blanking process নিয়ে কিছু ভূমিকা দিতে হয়।
Fine Blanking is a process that uses triple action hydraulic press and high precision tooling to manufacture parts with high dimensional accuracy; and special features. Before the development of Fine blanking Technology, a number of process steps were involved to manufacture many parts. In Fine Blanking those can be manufactured in one single process with much more precision and at a higher production rate. In conventional blanking when a part is blanked beyond two millimeters of thickness then one-third of the blanked area is sheared, and the balance remains torn. In Fine Blanking process, 100% sheared edge can be achieved. I don’t want to lengthen the subject now. If anyone is interested, I shall share with him through a personal message on this advanced specialised technology. Fine Blanking বোধহয় আজও এদেশের কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের Mechanical Engineering এর curriculum এর মধ্যে নেই। আর আমার এও ধারণা যে এখনো অনেক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এই বিষয়টি সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।
These parts have both external and internal gears. These gears also have block flat ends. Such parts can be produced only by Fine blanking. It’s not possible by any other mechanical process. Sintering process may be tried but difficult to produce accurate gear teeth. Sintered parts cannot take compressive shock load. This part is fitted in rotary seat recliner mechanism in automobile where it has to pass through critical crash test. Though the Fine Blanking process is very complicated, but it ensures precision. Special triple action hydraulic press is required to produce such parts. Even it’s complicated and precision but mass production is commercially possible in Fine blanking to meet huge requirements in automobile and other engineered products
শ্রদ্ধেয় বিজন নাগের আলোচনায় ফিরে আসি। মানুষটি সম্বন্ধে অনেকেই হয়তো কিছু কিছু জানেন। তবুও বলি, আজকের IFB Industries Ltd কোম্পানিটির স্থাপন হয়েছিল ১৯৭৪ সালে Indian Fine Blank Ltd. নামে, সুইজারল্যান্ডের Heinrich Schmid AG কোম্পানির সাথে কারিগরি সহযোগিতায়।
আমি IFB জয়েন করার আগে Fine Blanking Process নামটাও শুনিনি। এই টেকনোলজি প্রথম patented হয় ১৯২৩ সালে জার্মানিতে, আর এর প্রয়োগ প্রথম শুরু হয় সুইজারল্যান্ডে। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বেশিরভাগ Fine Blanking প্রেস মেশিন তৈরি হয় সুইজারল্যান্ডে। আর খুবই অল্প কিছু প্রেস মেশিন বানানো হয় জাপানে।
ওপরের কথা গুলো লিখতে হল কারণ ১৯৭৪ সালে বিজন নাগ ভারতে এই প্রসেস প্রথম শুরু করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। দুঃসাহস কারণ দেশে শুধু টেকনোলজি আনলেই হবে না, ফ্যাক্টরি বানিয়ে তার প্রয়োগ করে সফলতা অর্জন করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। সেই সময় Fine Blanking এক্সপার্ট আমাদের দেশে ছিলোই না, সুতরাং তিনি একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিলেন।
বিজন নাগ ছিলেন দূরদর্শী ও দৃঢ়চেতা। এই কোম্পানি তিনি শুরু করেন খুবই অল্প পুঁজির একটি ৯০ টন প্রেস মেশিন নিয়ে। কিছু সময় পরে খুবই প্রতিকূল পরিস্থিতির অবস্থায় আরও একটি ১৬০ টন এবং তারপর একটি ৪০০ টন প্রেস মেশিন কেনেন। তখন আশীর দশকে পশ্চিমবঙ্গে চরম বিদ্যুৎসংকট শুরু হয়েছিল। এই সংকটের মোকাবিলার জন্য নিয়ম করে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের কলকারখানা বন্ধ রাখা শুরু হয়েছিল সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে। সেই পরিস্থিতিতে জেনারেটর কেনা এই কোম্পানির কাছে সামর্থ্যের বাইরে ছিলো। কিন্তু উনি হাল ছাড়েননি। তখন ভারত রাশিয়ার সাথে ভারতীয় মুদ্রায় (টাকা) বৈদেশিক বানিজ্য করতো। সেই সুযোগে উনি জার্মানির National Machinery কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) রাশিয়াতে ৪৯টা Bolt and Nut Former মেশিন এক্সপোর্টের অর্ডার জোগাড় করেন। মেশিন পাঠানো হত জার্মানি থেকে। আর Tooling আর অন্য পারিপার্শিক যান্ত্রিক সরঞ্জাম তৈরি করত ওনার কোম্পানি ভারতে জার্মানির কোম্পানির দেওয়া ড্রইং থেকে। মিঃ নাগের এই প্রচেষ্টাতেই তাঁর কোম্পানি অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে পারে।
আমি ১৯৮৫ সালে এই কোম্পানিতে জয়েন করি ঐ জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজ করার জন্য। ঐ চুক্তি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে ১৯৮৮ সালে আমাকে Fine Blanking প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করা হয়। তারপর থেকে আমার কর্মজীবন Fine Blanking নিয়েই। প্রোডাকশনে কাজ করার সময় কোন একটা কারণে একদিন একটু ডিসটার্ব ছিলাম। হঠাৎ টেবিলের ফোনটা বেজে ওঠায় আমি বেশ রুক্ষতার সঙ্গে হ্যালো বলেছিলাম। জানতাম না যে ফোনটা করেছিলেন স্বয়ং মিঃ নাগ। উনি খুব শান্ত গলায় বলেছিলেন “Saibal, is this the way to say hello?”. আমি চমকে গিয়ে বলেছিলাম “সরি নাগ সাহেব”। উনি তারপর কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। সেদিনের সেই শিক্ষা পাওয়ার পর আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল যে আমার মানসিক অবস্থা যাই হোক, শান্ত গলায় অন্যের সাথে কথা বলতে হবে।
Fine Blanking Tooling এর ওপর মিঃ নাগের খুবই ভালো ধারণা ছিল। অনেক সময় দেখেছি উনি হঠাৎই ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে এসে ভালো ডিজাইন করার জন্য ড্রইং বোর্ডে গিয়ে জটিল Tooling এর ওপর নানান রকমের আইডিয়া দিতেন। ভালো Tool এবং Product বানানোর জন্য উনি সবসময়ই সর্বাধুনিক High End যন্ত্রপাতি বা মেশিন বিদেশ থেকে আমদানী করতেন।
আশীর দশকে ঐ তথাকথিত বৈপ্লবিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়েও কোম্পানিতে কোন শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল না। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী শ্রমিকদের উপযুক্ত এবং যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেওয়া হত। এর সাথে প্রত্যেক শ্রমিককে পরিবারসহ প্রতি বছর কোম্পানির খরচায় পুরী বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হত। প্রতি বছর শ্রমিকদের পরিবারসহ তাজ বেঙ্গল ধরণের পাঁচতারা হোটেলে ড্রিঙ্কস সহ ডিনার পার্টি দেয়া হত। তবুও একজনের প্ররোচনায় খুবই অল্প সংখ্যক শ্রমিক ১৯৮৯ সালে ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেছিল। ঠিক ঐ সময়েই কোম্পানি একটা ২৫০ টন প্রেস মেশিন বিদেশ থেকে আমদানী করে। মেশিন কলকাতা বন্দরে এসেও গিয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের এতভাবে খেয়াল রাখার পরেও তাঁদের ইউনিয়ন করার চেষ্টায় মিঃ নাগ মানসিকভাবে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। উনি ঠিক করেন ঐ প্রেস মেশিন তিনি কলকাতার ফ্যাক্টরিতে আনবেন না। মেশিন খালাস না করায় কলকাতা বন্দরের ইয়ার্ডে ডেমারেজ হচ্ছিল। তবুও সেই মেশিন কলকাতার ফ্যাক্টরিতে আসেনি। উনি তখন ব্যাঙ্গালোরে এক বিশাল জমি নিয়ে সেই নতুন প্রেস মেশিন নিয়ে গিয়ে সেইখানে ফ্যাক্টরি স্থাপন করলেন। যদিও তখন ইউনিয়ন ফর্ম করেনি। কিন্তু উনি সিধান্ত নিয়েছিলেন যে কলকাতায় আর কোন বিনিয়োগ করবেন না। পরে অবশ্য শ্রমিকরা ক্ষমা চাওয়ায় একটা ৪০০ টন প্রেস মেশিন কলকাতায় এসেছিল। কিন্তু তাঁর পরেও কলকাতার শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠন করায় এর পরের সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার বিনিয়োগ উনি বাংলার বাইরে ব্যাঙ্গালোরে, গোয়ায় আর ইন্দোরে করেছিলেন।
যেহেতু উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতের যাবতীয় Fine Blanking manufacturing এর বিনিয়োগ ব্যাঙ্গালোরেই করবেন তাই ১৯৯৭ সালেই উনি চাইছিলেন আমাকে ব্যাঙ্গালোর ফ্যাক্টরির দায়িত্ব দিতে। কিন্তু আমার মা তখন খুবই অসুস্থ ছিলেন, এবং সেটা উনি জানতেন। তাই আমাকে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার জন্য কখনও বলেননি। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে আমার মা মারা যাওয়ার পরেই উনি আমাকে ব্যাঙ্গালোরে ট্রান্সফার করেন। এই মানবিকতাবোধ ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
আমি ২০০৩ সালে এই কোম্পানি ছেড়ে অন্যত্র যাই। তখনও পর্যন্ত বাংলার বাইরের IFB Industries এর কোন ফ্যাক্টরিতেই শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল না। তাঁর কর্মীদের কঠিন সমস্যায় উনি সবসময়েই পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। আমাকে একবার কলকাতার ইউনিয়ন সকাল সাড়ে নটা থেকে রাত দশটা অবধি একটা ঘরে ঘেরাও করে রেখেছিল। মিঃ নাগ তখন পাশের বিল্ডিংয়েই ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে ওঁরা ঘেরাও করে রেখেছিল।
আমি যেটুকু দেখেছি, বা নানান সময় ওনার কথায় বুঝেছি, উনি সবসময়েই চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর সেরা টেকনোলজি নিয়ে বা পৃথিবীর সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রস্তুতকারকের সাথে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করার। ১৯৮৯ সালে Bosch-Siemens Hausgerate কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৯৯০-৯১ সালে গোয়া আর ব্যাঙ্গালোরে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং মেশিন ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। আর অটোমোটিভ পার্টস তৈরির জন্য পৃথিবীবিখ্যাত Autoliv কোম্পানির সাথে কারিগিরী সহযোগীতায় স্থাপন Autoliv IFB Pvt. Ltd.। এই কোম্পানি ভারতে প্রথম গাড়ির সীট বেল্ট তৈরি করা শুরু করে। তখনও কিন্তু ভারতে গাড়িতে সীটবেল্ট বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু উনি দূরদর্শী ছিলেন বলেই জানতেন একসময় ভারতেও সীটবেল্ট বাধ্যতামূলক হবে। উনি এটাও বুঝেছিলেন যে ভারতের গাড়ি প্রস্তুতকারকরা ভবিষ্যতে আলাদা পার্টস কেনার বদলে টোটাল সিস্টেম কিনতে বেশি আগ্রহী হবে। তাই উনি IFB Automotive Pvt. Ltd. তৈরি করলেন Complete Seating System, আর Window Regulators বানানোর জন্য। এই কোম্পানির চারটে ফ্যাক্টরি ছিলো চেন্নাই, পুনে, বিনোলা আর রুদ্রপুরে।
শ্রী বিজন নাগ আমাদের দেশে কিছু, ইংরেজিতে যাকে বলে আধুনিক State of the Art Technology নিয়ে আসেন। কর্মজীবনের সেই গুরুর প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে আমার এই লেখা শেষ করলাম।
শ্রদ্ধেয় বিজন নাগের কর্মদ্যোগ সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানতাম না।
লেখককে ধন্যবাদ।