সাহিত্যিকা

অমরনাথের পথে

অমরনাথের পথে
প্রশান্ত চন্দ্র, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রথম পর্ব – যাত্রার প্রস্তুতি, জুন-আগস্ট, ১৯৮১
ফিরে যাচ্ছি আজ থেকে ঠিক চার দশক আগে আমাদের স্বর্ণযুগের সেই পুরনো দিনগুলিতে। এটা সেই যুগ যখন সময়টা ছিল আমাদের নিজস্ব। যখন আমাদের কম্পুটার বা ইন্টারনেট ছিল না। না ছিল টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, মোবাইল বা ডিজিটাল ক্যামেরা। অনলাইন বলে কোন শব্দ আমরা শুনিনি। বরং লাইন দিতে হতো আমাদের ব্যাঙ্ক, রেশন, গ্যাস, ইলেকট্রিক বিল – সবকিছুর জন্যই। সেই সময় যখন এম্বাসাডর, ফিয়াট, কোডাক, ফুজি ফিল্ম এঁরা রমরমিয়ে ব্যাবসা করতো।
১৯৮১ সালের জুন মাসের শেষ। আমি তখন শিবপুর থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে মেটাল বক্সে মেশিন বিল্ডিং ইউনিটে প্যাকেজিং মেশিন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের ডিজাইন ডিপার্টমেন্ট বেশ বড় – ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার, ড্রাফটসম্যান সব মিলিয়ে একটা হলঘরের মধ্যে আমরা প্রায় ষাট জন।
একদিন লাঞ্চের পর দেখি আমার সামনের সারিতে মিত্তিরদার পাশে দাঁড়িয়ে মেশিন শপের সুপারভাইসর রায়দা। আমাদের ডিপার্টমেন্টের দশ-বারো জন কিছু একটা বিষয় নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করছেন। চা এর সময় মিত্তিরদাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে রায়দা হাওড়ার কদমতলায় থাকেন এবং হাওড়া ইয়ুথ হোস্টেলের অ্যাক্টিভ মেম্বার। ওনার তত্বাবধনায় হাওড়া ইয়ুথ হোস্টেল থেকে আটচল্লিশ জনের একটা গ্রুপ অমরনাথ সহ কাশ্মীর বেড়াতে যাছে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। কয়েকটা সিট এখনও খালি রয়েছে এবং সেজন্য উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে কথা বলছেন যদি কেউ যেতে রাজি থাকে।
পরের কয়েকটা দিন আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে এবং আসা যাওয়ার বাসে আলোচনার একটাই বিষয়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো আমাদের ফ্যাক্টরি থেকে রায়দা ছাড়া আমরা আরও পাঁচজন যাচ্ছি। ডিজাইন থেকে মিত্তিরদা, আমি ও আমাদের কলেজের জুনিয়র শঙ্কর, এসেম্বলি থেকে গাঙ্গুলীদা আর প্যাকিং থেকে দাসদা। আমি এবং শঙ্কর তখনও পঁচিশের বেড়া পেরোইনি, আর বাকী সকলেরই বয়স চল্লিশের উপর। আমাদের কারোরই যে আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ছিল তা নয়। বেড়ানোর আনন্দ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আমরা যাচ্ছি। পরে অবশ্য জেনেছিলাম গাঙ্গুলীদার বাড়ি বেলুড় মঠের পাশে এবং ছোট থেকে পড়াশুনা মঠের ভিতরে। সেজন্য উনি ভীষণ কালী ভক্ত ছিলেন। পরে অমরনাথের পথে এই দুর্গম যাত্রায় অনেক সময় ওনার ভক্তিগীতি আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে।
যাত্রার যখন বেশ কিছুদিন সময় আছে, তার মধ্যে আমরা অমরনাথ সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর করে নিলাম। হিমালয় পর্বতমালায় ১৩,৫০০ ফুট উচ্চতায় হিন্দু ধর্মের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এই অমরনাথ গুহা। ৬২ফুট গভীর, ৫২ফুট চওড়া ও ৩৬ফুট উচ্চতার এই গুহার চারিদিকেই পাহাড় আর এই পাহাড়গুলো বছরের প্রায় নয়-দশ মাস সাদা বরফে ঢাকা থাকে। এমনকি এই গুহার প্রবেশপথও। গ্রীষ্মকালে খুব কম সময়ের জন্যই এই দ্বার প্রবেশের উপযোগী হয়।
পৌরাণিক মতে, পার্বতীকে গোপনে অমরত্ব রহস্য বোঝাতে নির্জন পাহাড়ে মহাদেব এই গুহা নির্মাণ করেন  এবং সেজন্যই এই গুহার নাম (অমর+নাথ) অমরনাথ। পহেলগাঁও থেকে মহাদেব পার্বতীকে নিয়ে অমরনাথ গুহার উদ্দেশে যাত্রা করেন চন্দনবাড়ির পথে এবং যাওয়ার সময় রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গের যাবতীয় সম্ভার একে একে ত্যাগ করেন। উদ্দেশ্য ছিল যে তিনি অমরনাথ গুহাতে পার্বতীকে অমরত্ব রহস্য বোঝানোর সময় যেন আর কেউ সেই রহস্য শুনতে না পারে।
অমরনাথে কবে থেকে তীর্থ যাত্রা শুরু হয় তা জানা যায় না। এক তথ্যসূত্র থেকে ধারণা করা হয় কিংবদন্তী আর্যরাজা (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সাল) বরফ নির্মিত শিবলিঙ্গে পূজা দিতেন। কথিত আছে মধ্যযুগে অমরনাথের কথা মানুষ ভুলে গিয়েছিল কিন্তু ১৫ শতকে বুটা মালিক নামে এক মুসলমান রাখাল এই গুহা আবার আবিষ্কার করে।
অমরনাথ গুহা
অমরনাথ গুহার ভিতর বরফের শিবলিঙ্গ
অমরনাথের গুহাতে চুইয়ে পড়া জল জমে শিবলিঙ্গের আকার (৮ ফুট পর্যন্ত উঁচু) ধারণ করে। যেহেতু এই শিবলিঙ্গ আপনা থেকেই তৈরি হয়, একে স্বয়ম্ভূ শিবও বলা হয়। জুন মাসে স্নান পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় অমরনাথ যাত্রা আর শেষ হয় আগস্ট মাসে শ্রাবণী পূর্ণিমার ছড়ি মিছিলে যখন ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার সাধু ও ভক্তবৃন্দ একত্রে অমরনাথ গুহায় যান অমরনাথের পুজো করতে। তবে অধিকাংশ তীর্থযাত্রীই জুলাই মাসে গুরু পূর্ণিমা  আর আগস্ট মাসে শ্রাবণী পূর্ণিমার মাঝের সময়টা পছন্দ করেন।
অমরনাথ যাত্রা
শ্রাবণী পূর্ণিমায় অমরনাথের ছড়ি মিছিল 
এখন জাতিধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অমরনাথে যায়। ২০১১ সালে এ পর্যন্ত সবথেকে বেশী সংখ্যক (৬,৩৪,০০০) তীর্থযাত্রী অমরনাথ গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় প্রায় তিন লক্ষ। এখন যাত্রীদের জন্য রাস্তায় অনেক থাকবার খাওয়ার ব্যাবস্থা হয়েছে, যা আগে ছিলো না। এখন যাত্রার সময় রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু ঘোড়া আর মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ফলে এই যাত্রার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে।
আমাদের ১৯৮১ সাল চিত্রটা ছিল একেবারেই বিপরীত। রাস্তা ছিল দুর্গম এবং পহেলগাঁও থেকে অমরনাথ গুহা পর্যন্ত ৪৮ কিমি রাশ্তায় কোনও থাকবার খাওয়ার জায়গা ছিল না। ছিল না বৃষ্টি হলে পথে কোনও দাঁড়াবার জায়গা। আমরা এই ৪৮ কিমি রাশ্তায় শুধু দুই জায়গায় দুটো চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সেই সময় মাত্র পনেরো-কুড়ি হাজার তীর্থযাত্রী অমরনাথ যাত্রায় যেতেন। যাত্রার পুরো রাস্তাটাই ফাঁকা থাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগও ছিল অনেক বেশি। সেইসময় অনেকেই এই যাত্রায় যেতেন শুধুমাত্র এই রাস্তার স্বর্গীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।
এখন অমরনাথ যাওয়ার দুটো পথ। একটা পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি হয়ে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে, আর অন্যটা বালতাল থেকে। বালতাল থেকে এখন হেলিকপ্টার সহযোগেও পঞ্চতরনী পর্যন্ত যাওয়া যায়, যেখান থেকে আমারনাথ গুহার ৬ কিমি দূরত্ব পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যেতে হয়। ১৯৮১ সালে বালতালের রাশ্তা তীর্থযাত্রীদের আসা যাওয়ার উপযুক্ত ছিল না। পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক জিপ যদিও বা যেত, পর্যাপ্ত পরিমান জিপের সংখ্যা না থাকায় জিপের ভাড়া ছিল সাধারন তীর্থযাত্রীর নাগালের বাইরে। ফলে অধিকাংশ তীর্থযাত্রী পহেলগাঁও থেকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়েই যেতেন।
আমাদের যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। আমরা সকলে আমাদের গ্রুপ লিডার রায়দার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী যেমন জলকাদার উপযুক্ত জুতো, শীতের জামাকাপড়,  রেনকোট, জলের বোতল, জল বিশুদ্ধকরনের জন্য ক্লোরিন ট্যাবলেট, শীতের ক্রিম ইত্যাদি কেনাকাটা করে নিলাম। এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেইসময় হাইটেক সামগ্রী অত সহজে পাওয়া যেত না। বরফের ওপর দিয়ে হাঁটার উপযুক্ত জুতো কলকাতায় তখন কোথায় পাবো? যতদূর মনে পড়ে, রাবারের জুতো কিনেছিলাম। আর রাস্তায় ফটো তোলার জন্য? আমি আছি এক আনাড়ি ফটোগ্রাফার আর সঙ্গে নিলাম ন্যাশনাল ইন্সট্রুমেন্টস এর তৈরি ছোট একটা ক্যামেরা আর কোডাক ফিল্ম। এভাবেই যা পেয়েছি, তাই নিয়েই দুর্গা দুর্গা বলে রওনা দিয়েছিলাম।
৫ই অগাস্ট ভোর সাড়ে চারটেয় হাওড়া থেকে হিমগিরি এক্সপ্রেসের একটা  ৩-টায়ার স্লিপার কম্পার্টমেন্টে চড়ে রওয়ানা দিলাম। কোচের ৪৮টা বার্থই আমাদের। সেখানেই নিজেদের প্রাথমিক পরিচয় সেরে নিলাম।
পরদিন বিকাল চারটে নাগাদ হিমগিরি এক্সপ্রেস জম্মু স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। স্টেশনের বাইরে একটা বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হোটেলে পৌঁছেই সামনের দোকান থেকে আমরা এক একটা হাঁটার ছড়ি আর কিছু ড্রাই ফ্রুটস মিক্স কিনে রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে ৯ টার মধ্যে লাঞ্চ (নো ব্রেকফাস্ট) সেরে  বাসে করে রওনা দিলাম পহেলগাঁও এর উদ্দেশে। যাত্রাপথের রাস্তা প্রায় ২৬০ কিমি, আর রাস্তায় মাঝে মধ্যেই ধস নামে। তাই একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় ধস নামার জন্য পথে কিছুটা দেরিও হয়েছিলো। অবশেষে রাত্ আটটা নাগাদ সকলে পহেলগাঁও হোটেলে পৌঁছলাম।
দ্বিতীয় পর্ব – আমাদের যাত্রা হলো শুরু
আমাদের হোটেলটা লিডার নদীর একটু দূরেই। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের বাইরে এসে চারিদিক দেখে চোখ যেন জুড়িয়ে গেলো। যেদিকে তাকাই, দেখি শুধু সবুজের সমারোহ। পাইন ও দেওদারুর ঘন সবুজের সারি একদিকের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। আর তার পায়ের নিচে কুলুকুলু শব্দে আপন মনে বয়ে চলেছে অপরূপ সুন্দর লিডার নদী। সেই নদীর নীল জল নদীগর্ভে পড়ে থাকা ছোট ছোট পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে ছোট ছোট সাদা ফেনার ঢেউ তৈরি করছে। উপরে নীল আকাশ। সেখানে তুলোর মত ভাসছে ছোট ছোট সাদা মেঘ। সূর্যের আলো লিডার নদীর সাদা ফেনার ওপরে পড়ে চিকচিক করছে। আর একদিকে শ্বেতশুভ্র তুষার-আবৃত পর্বত চুড়ার ওপর সূর্যের সকালের রোদ পড়ে ঝলমল করছে। প্রকৃতির এ যেন এক অপরূপ সৃষ্টি। ভগবান যেন ক্যানভাসের ওপর তুলি দিয়ে এঁকেছেন তাঁর ভূস্বর্গ। বুঝতে পারলাম অনেকে কেন পহেলগাঁওকে ভারতবর্ষের সুইজারল্যান্ড বলেন।
অপরূপ সুন্দর পহেলগাঁও – সবুজের সমারোহ, তুষারাবৃত পর্বতমালা ও লিডার নদী
৭৩কিমি লম্বা এই লিডার নদীই একাধারে পহেলগাঁও এর সৌন্দর্যের মধ্যমনি এবং স্থানীয় জীবন রক্ষার প্রধান মাধ্যম। পহেলগাঁও থেকে ৩০কিমি দূরে কলাহই গ্লেসিয়ার থেকে এই নদীর শুরু। পরে শেষনাগ লেক থেকে একটা শাখা এসে এই নদীর সঙ্গে পহেলগাঁওতে মিশেছে। পহেলগাঁও থেকে আরও ৪৩কিমি যাওয়ার পর এই নদী ঝিলম নদীর (আমরা শ্রীনগরে দেখতে পাই) সাথে গিয়ে মিশেছে।
আজ আমাদের পাঁচদিনের পহেলগাঁও-অমরনাথ-পহেলগাঁও ট্রেকিং এর শুরু। আগামী পাঁচ দিনে আমাদের পাহাড়ের রাস্তায় ৯৬ কিমি পথ অতিক্রম করতে হবে। আর এই পাঁচদিন বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প তৈরি করা, খাবারের ব্যাবস্থা করা, আমাদের জামাকাপড়ের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়া – এ সবেরই দায়িত্ব ছিল মহারাজা ট্রাভেলস এর ওপর। ট্রেকিং এর এই দিনগুলোতে আমরা একদম সকালেই লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়তাম। তাই নো ব্রেকফাস্ট। সকালে ভাত এবং রাত্রে খিচুড়ি বা রুটি। সবটাই নিরামিষ। ক্যাম্পের রান্নাঘরে জল ফুটিয়ে রাখা থাকতো আমাদের পানীয় জলের জন্য। প্রতিদিন সকালে আমরা বোতলে এই জল ভরে সঙ্গে নিতাম আমাদের রাস্তার জন্য। আর এর পরেও যদি রাস্তায় কারো অতিরিক্ত পানীয় জলের দরকার হতো, তাহলে রাস্তার ঝর্ণার জল বোতলে ভরে নিয়ে ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে বিশুদ্ধিকরন করে নিতাম।
আজ আমাদের যাত্রার প্রথম দিনে দুপুরের খাওয়া সেরে বারোটা নাগাদ আমরা পহেলগাঁও থেকে রওনা দিলাম চন্দনবাড়ির পথে। আমাদের ৪৮ জনের গ্রুপের অর্ধেক ঠিক করলাম পায়ে হেঁটে যাবো, আর বাকিরা ঘোড়ায় চড়ে। আমাদের মধ্যে মিত্তিরদা ও শঙ্কর পহেলগাঁও থেকেই ঘোড়া নিলো আর আমি, গাঙ্গুলিদা আর দাসদা পায়ে হেঁটেই শুরু করলাম। আমরা শুধু হাঁটার রাস্তার প্রয়োজনীয় জিনিষ (যেমন জল, ওষুধ, ড্রাই ফ্রুটস মিক্স, রেনকোট ও ক্যামেরা) ভর্তি একটা ছোটো বাগ কাঁধে নিয়ে আর হাতে হাঁটার ছড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আর বাকী লাগেজ পহেলগাঁওতেই রেখে, মহারাজা ট্রাভেলসকে এই পাঁচদিনের জামাকাপড়ের ব্যাগ ওঁদের হাতে দিয়ে দিলাম। প্রসঙ্গত বলি, পৌরাণিক মতে মহাদেব পহেলগাঁও থেকে যখন অমরনাথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, উনি ওনার বাহন নন্দীকে (ষাঁড়) ত্যাগ করে পহেলগাঁওতেই রেখে যান।
রাস্তা চলেছে লিডার নদীর গা ঘেঁষে। আকাশে এখন মেঘের দেখা নেই। সূর্য আমাদের মাথার ওপর। রোদের আলোয় নদী এখন ঝলমল করছে।  আমাদের অমরনাথ যাওয়ার রাস্তায় এই নদীই আমাদের চন্দনবাড়ি হয়ে শেষনাগ পর্যন্ত সঙ্গ দেবে। কিছুদূর যাওয়ার পর পিচঢালা রাস্তা শেষ হয়ে সাধারন পাহাড়ি মাটির রাশ্তার শুরু হলো।
পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি প্রায় ১৬ কিমি। আর পহেলগাঁও এর উচ্চতা যেখানে ৭,৫০০ ফুট, চন্দনবাড়ির উচ্চতা হোল ৯,৫00 ফুট। প্রায় দুই-তিন কিমি নদীর পাশে পাশে যাবার পর আমাদের রাস্তা নদীকে ছেড়ে বাঁদিকে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল আর নদী হারিয়ে গেলো পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আপন মনে তার নিজস্ব পথে চলতে চলতে।
আজ আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি নেই। রোদ ঝলমল করছে। আমরা রৌদ্রছায়ার মাঝে জঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি। আর নদী আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কখনও চলে আসছে একেবারে পাশে আবার কখনও পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে যাচ্ছে হারিয়ে। মাঝেমধ্যে দেখা মিলছে পাহাড়ি ঝর্নার। আমরা চেষ্টা করছি গাড়ীর রাস্তা অনুসরণ না করে গ্রামের লোকেরা যে পায়ে হাঁটা পথে যায়, সেই পথে যাবার, যাতে একটু তাড়াতাড়ি হাঁটা যায়, যদিও এই রাস্তাগুলো একটু বেশী উঁচু এবং পরিশ্রমও একটু বেশীই হয়। এইজন্য দাসদা মাঝে মাঝেই আমাদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়ছিলেন।
প্রায় অর্ধেক রাস্তা যাবার পর আমাদের চোখে পরল একটা সুন্দর ভ্যালি। চারিদিকে উঁচু গাছ দিয়ে ঘেরা সুন্দর সাজানো একটা প্রায় সমতল জায়গা। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন সবুজ কার্পেট দিয়ে মুড়ে রেখেছে। একটু দুরের গাড়ি যাওয়ার রাস্তা দিয়ে এক একটা জিপ মাঝে মাঝে পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ির দিকে চলেছে। শুনেছি এখানে অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে। ১৯৮৩ সালে বেতাব সিনেমার শুটিং এর পরে এখন এই জায়গাটি বেতাব ভ্যালি নামেই  খ্যাত। এখানে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার পথ চলা শুরু করলাম।
আরও প্রায় তিন ঘণ্টা চলার পর আমাদের তাঁবুগুলো চোখে পড়লো এবং ধীরে ধীরে আমরা চন্দনবাড়ি এসে পৌঁছে গেলাম। এখানেই আমাদের প্রথম দিনের যাত্রার নির্বিঘ্ন সমাপ্তি। চারিদিকে ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। খানিক গল্পগুজবের পরে রাত্রের খাওয়া দাওয়ার শেষে আমরা শুয়ে পড়লাম। চন্দনবাড়ির মত নৈসর্গিক পরিবেশে প্রকৃতির কোলে মাটির ওপর তাঁবুর ভেতর ঘুমিয়ে পড়ার সে এক আশ্চর্য অনুভুতি।
তৃতীয় পর্ব – চন্দনবাড়ি থেকে শেষনাগ – এক স্বর্গীয় পরিবেশ
পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙল। আজ আমাদের অমরনাথ যাত্রার দ্বিতীয় দিন। তাঁবুর বাইরে এসে দেখলাম অনেকেই উঠে পড়েছেন। সকলেই একটু দূরে যেখানে লিডার নদী ওপরের পাহাড় পিসু টপ থেকে এসে পড়েছে, সেইখানে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যাস্ত। একদিকে লিডার নদী বয়ে যাছে ঘন সবুজ পাইনের সারির পাশ দিয়ে আর অন্য দিকে ভোরের কুয়াশায় ঢেকে থাকা উঁচু পাহাড় – সত্যিই প্রকৃতি এখানে অপরূপ সাজে সেজেছে।
পাহাড়ের থেকে নেমে আসা নদী এখানে একটু বেশী খরস্রোতা। বাঁদিকে পিসু টপ থেকে পাথরের ধাক্কায় লাফাতে লাফাতে নেমে আসছে লিডার নদী আর ডান দিকে স্রোত হারিয়ে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে গিয়ে একটু পরিধি বিস্তার করেছে। নদীর চারিদিকে ঘন উঁচু পাইন গাছের জঙ্গল আর দূরে তুষারাবৃত পর্বতচূড়া। কয়েকটি ঝর্না পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে নেমে আসছে। মাঝখানে ঘন উঁচু পাইন গাছের জঙ্গলে আর পাহাড়ে ঘেরা কিছুটা প্রায় সমতল জায়গা যেখানে আমাদের তাঁবুগুলি রয়েছে। উঁচু পাহাড় আর পাইন গাছগুলির জন্য রোদ্দুর এখনও এখানে ঢুকতে পারেনি। তাই চারিদিক ঠাণ্ডা, শান্ত ও নীরব। নদীর জলের আওয়াজ ও কিছু পাখীর ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। সব মিলিয়ে এক মনোরম স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পৌরাণিক মতে, মহাদেব অমরনাথ যাওয়ার পথে ওনার জটার থেকে চাঁদ খুলে নিয়ে চন্দনবাড়িতে রেখে যান।
এখানে বলে রাখি, আমি আবার দ্বিতীয় বারের জন্য পহেলগাঁওতে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে এবং নস্টালজিয়ার জন্য গাড়ী নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম চন্দনবাড়িতে। পহেলগাঁও তে খুব বেশী পরিবর্তন যদিও আমার চোখে পড়েনি, শুধু কিছু নতুন বাড়ি আর নতুন হোটেল ছাড়া, কিন্তু আমি হতাশ হলাম চন্দনবাড়ির অবস্থা দেখে। হারিয়ে গেছে সেই নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। চারিদিকে শুধু দোকান আর হোটেল। ফাঁকা জায়গা আর নেই। আগে পহেলগাঁওতে ছিল অমরনাথ যাত্রার বেস ক্যাম্প। এখন চন্দনবাড়িতে। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, কিভাবে আমাদের সভ্যতার উন্নয়ন আমাদেরই অতীব সুন্দর প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। ।
যাই হোক, ফিরে আসি আমাদের যাত্রার সময় ১৯৮১ সালে। নদীর পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে পিসু টপের দিকে। সামনের একেবারে খাড়া পাহাড়টারই নাম পিসু টপ। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু রাস্তা ওপরের দিকে উঠে গেছে এঁকে বেঁকে। পাহাড়টা এতটাই খাঁড়া আর উঁচু যে পাহাড়ের উপরের দিকে তাকালে বেশ ভয়ই হয়। আমরা জানলাম যে এই পাহাড়ের রাস্তাটাই আমাদের অমরনাথ যাওয়ার পথ। এই পাহাড়ের চূড়া পেরিয়েই আজ আমাদের যেতে হবে। আমাদের গ্রুপের যারা পহেলগাঁও থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পাহাড়টা দেখার পর ভয় পেয়ে ঘোড়া নিয়ে নিলো। আমাদের দাসদাও তাদের মধ্যে একজন।
চন্দনবাড়িতে আমাদের ক্যাম্প
রায়দা এসে আমাদের জানিয়ে গেলেন যে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরতে হবে কারণ দুপুরের পর পাহাড়ের ওপর বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা থাকে। রায়দার কথামত আমরা তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে নিয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। চন্দনবাড়ি থেকে পিসু টপের দূরত্ব মাত্র ৩ কিমি। কিন্তু পিসু টপের উচ্চতা ১১,৫০০ ফুট। তাই রাস্তার খাড়াই অনেক বেশী এবং অমরনাথ যাত্রায় এই তিন কিলোমিটার রাস্তাই সবথেকে কষ্টসাধ্য।
অমরনাথের রাশ্তার সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠতে শুরু করলাম। একটু ওঠার পরেই সিঁড়ি শেষ হয়ে গেলো। এবার পাথর ও মাটির সরু এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা। যত ওপরে উঠছি নদী আস্তে আস্তে নীচে নেমে যাচ্ছে। কখনও যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে। একদিকে খাড়াই পাহাড় আর অন্য দিকে খাদের নীচে নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর পিছনে রয়েছে ঘন সবুজ পাইন গাছের সারি। মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঝর্না পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে নদীতে গিয়ে পড়ছে। আমাদের পাহাড়ের ওপর থেকেও কখনও ঝর্না নামছে আমাদের পায়ে চলা পথের ওপর দিয়ে আর আমাদের সেই ঝর্ণার জল পেরিয়ে যেতে হচ্ছে।
রাস্তা উঠেছে পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে। আমরা চেষ্টা করছি ঐ রাস্তা পুরোপুরি অনুসরণ না করে স্থানীয় লোকেরা যে ছোট ছোট পথে হেঁটে ওঠে, যতটা সম্ভব আমাদের হাতের ছড়ির ওপর ভড় দিয়ে সেই পথ অনুসরণ করে চলার, যাতে একটু তাড়াতাড়ি হাঁটা যায়। কিন্তু মুস্কিল এই যে রাস্তাগুলোর খাড়াই বেশি এবং পরিশ্রমও অনেক বেশি হয়। তবে একটা কথা ঠিক যে পাহাড়ের রাস্তায় সকলে একসঙ্গে হাঁটতে পারে না। প্রত্যেকে তার নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী নিজস্ব গতিতে চলে। যাদের বয়স কম ও শরীরের ওজন কম এবং যারা শারীরিক ভাবে ফিট, তাদের পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটতে সাধারনত অনেক সুবিধা হয়।
ওঠার এবং নামার একটাই পথ। রাস্তা এত সরু যে কোনোরকমে একটা ঘোড়া যেতে পারে। ঘোড়াকে পাস দিতে গেলে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে হয় নাহলে অন্যদিকে গভীর খাদ। যত ওপরে উঠছি জঙ্গল হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ধূসর পাহাড় বেরিয়ে আসছে। একটু পরে যে ভয় আমরা সকাল থেকে করছিলাম সেটাই হলো। বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। রেনকোটটা পরে নিলাম। কোথাও কোন দাঁড়াবার জায়গা নেই। একদিকে মাথার ওপরে বৃষ্টি। পাশে পাহাড়ের ওপর থেকে রাস্তার ওপর ঝর্ণার মত নামছে বৃষ্টির জল। আর সামনে পাহাড়ের ওপর থেকে রাস্তা বেয়ে নামছে বৃষ্টির জল। সেই চারিদিক দিয়ে নেমে আসা  বৃষ্টির জলের মধ্য দিয়েই সাবধানে পা টিপে আস্তে আস্তে উঠতে থাকলাম পাহাড়ের গা বেয়ে। পাহাড়ের বৃষ্টি ঠাণ্ডা যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
আরও প্রায় আধঘণ্টা এইভাবে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটার পর পিসু টপ এর ওপরে এসে পৌঁছলাম, যেখানে দেখলাম দুটো ঝুপড়িতে রয়েছে একটা চায়ের দোকান। দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকলাম। এই ফাঁকা জনমানবহীন জায়গায় বৃষ্টি আর ঠাণ্ডার মাঝে চায়ের দোকানটা যেন আমাদের জীবনদান করল। এক কাপ গরম চা খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এদিকে বৃষ্টিও থামার নাম নেই। আরও ৯ কিমি পথ গিয়ে তবেই আমাদের আজকের গন্তব্য স্থল শেষনাগে পোঁছতে পারব। দোকানদার বলল কিছুক্ষণ বসে যান। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি ছেড়ে যাবে। আমাদেরও আর কোনও উপায় নেই দেখে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বসে রইলাম।
পিসু টপের চায়ের দোকান
পিসু টপ থেকে শেষনাগের দিকে যাত্রা
প্রায় একঘণ্টা এইভাবে চায়ের দোকানে বসে থাকার পর দেখলাম বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে। আরও এক কাপ গরম চা খেয়ে আম্ররা পিসু টপ থেকে পায়ে হেঁটে পথ চলা শুরু করলাম। বৃষ্টির পর পাহাড়ের ওপরটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে আমাদের সোয়েটারও কিছুটা ভিজে গেছে। তাই বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। পাহাড়ের ওপর থেকে জলস্রোত মাঝে মাঝেই আমাদের রাস্তার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই জলের ওপর দিয়েই হেঁটে পার হয়ে আমরা চলে এলাম।
পিসু টপ থেকে শেষনাগ লেকের দূরত্ব ৯ কিমি কিন্তু উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়। পিসু টপের উচ্চতা যেখানে ১১,৫০০ ফুট, শেষনাগ লেক রয়েছে প্রায় ১১,৭৩০ ফুট উচ্চতায়। রাস্তা কোথাও উঠেছে আবার কোথাও নেমেছে। কিন্তু খাড়াই কোথাও খুব বেশী নয়। হাঁটতে খুব অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু বৃষ্টি হওয়ার জন্য রাস্তা একটু পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। তাই সাবধানে চলতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু গাছ রয়েছে। আবার অনেক জায়গায় কোনও গাছ দেখা যাছে না।
লিডার নদী একবার দেখা দিল অনেক নীচে। কিছুদূর হাঁটার পর মেঘের ভেতর দিয়ে সূর্যিমামা উঁকি দিলেন। একটু পর রোদ্দুর উঠল। পাহাড়ের উপর দিয়ে উঁচু নিচু রাস্তা। একদিকে মাঝে মধ্যে গাছপালা। অন্যদিকটায় সীমাহীন আকাশ। মেঘের ফাঁকে পশ্চিম আকাশে ঢলে পরা সূর্য। অনেক নীচে লিডার নদী। হঠাৎ আকাশ জুড়ে উঠল রামধনু আর সাত রঙে রাঙিয়ে দিল সেই সীমাহীন আকাশটাকে। পাশে গাঙ্গুলিদা পথ চলেছেন তাঁর উদাত্ত গলায় ভক্তিগীতি গাইতে গাইতে। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত স্বর্গীয় পরিবেশ।
প্রায় তিন ঘন্টা এইভাবে হাঁটার পর শেষনাগ লেকের পাশে আমাদের তাঁবুগুলো দেখা গেলো। আরও বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমাদের তাঁবুতে পৌঁছলাম। চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ শুনি তাঁবুর বাইরে রায়দা সকলকে ডাকাডাকি করছেন। তাঁবুর বাইরে এসে দেখলাম এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সূর্যাস্তের পড়ন্ত সোনালী আলোয় সাদা বরফে ঢাকা সাতটা পাহাড়ের চূড়া সোনার রঙে চকচক করছে। সোনালী আলোয় ঢাকা সেই সাতটা পাহাড়ের শ্বেত শুভ্র  চুড়ার ছায়া পড়েছে পাহাড়ের পাদদেশে শেষনাগের স্বচ্ছ নীল জলে। সেই অপরূপ দৃশ্য আমার পক্ষে লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাঁবুগুলো ছিল লেকের একেবারে পাশেই। সবাই দৌড় দিলাম লেকের দিকে।
শেষনাগ লেকের জল এতটাই স্বচ্ছ যে লেকটা আয়নার মত দেখায় আর এইজন্যই এই লেকের নাম শেষনাগ, কারন কাশ্মীরি ভাষায় ‘শেষ’ কথাটির অর্থ ‘আয়না’ আর ‘নাগ’ কথাটির অর্থ ‘জলাধার’ বা ‘লেক’। আবার পৌরাণিক মতে, মহাদেব অমরনাথ যাওয়ার পথে এখানে ছেড়ে রেখে গিয়েছিলেন তাঁর সাপকে। সাতটা পাহাড়ের চূড়া অনেকটা একটা সাপের সাতটা মাথার মত দেখায়। সেজন্যও অনেকে এটাকে শেষনাগ লেক বলেন।
কথিত আছে কয়েক হাজার বছর আগে পাহাড় চুড়ার মধ্যে মেঘ ফেটে (ক্লাউড বার্স্ট) তৈরি হয়েছিল সাত পাহাড়ের চুড়ার পাদদেশে একটা বড় গহ্বর। আশেপাশের পাহাড়চূড়া থেকে বরফ গলে এবং বর্ষাকালে পাহাড়ের থেকে জল এসে গহ্বর ভর্তি করে তৈরি করে ১ কিমি দীর্ঘ, ৭০০ মি প্রস্থ ও ৮০ মি গভীর এই লেক। এই লেক থেকেই বেরিয়েছে লিডার নদীর একটা শাখা।
শেষনাগ লেকের একটা বিশেষত্ব, এটা একটা অলিগোট্রফিক লেক। সেজন্য এই লেকে কোন শেওলা বা জলজ উদ্ভিজ্জ জন্মাতে পারে না। আর লেকের জল হয় স্বচ্ছ, শুদ্ধ ও পানীয়ের উপযুক্ত। এই লেক শীতকালে বরফে ঢাকা পড়ে যায় এবং বছরের অনেকটা সময় বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু এই লেকে নানা রকমের মাছ পাওয়া যায়। বাদামী ট্রাউট তাদের মধ্যে অন্যতম। 
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় আমরা তাঁবুতে ফিরে এলাম। তাঁবুর ভিতরেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছে কারন নীচের মাটি ভিজে প্রায় কাদা হয়ে রয়েছে। মনে হয় বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরেই মহারাজা ট্রাভেলস এর লোকজন আমাদের তাঁবু বানিয়েছে। তাড়াতাড়ি রাত্রের খাওয়া সেরে সবগুলো সোয়েটার পরে আর দু’দুটো কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত্রে হঠাৎ ভীষণ ঠাণ্ডায় ঘুম ভেঙে গেলো। দেখি দড়ির ওপর থেকে তোশক, কম্বল সব গড়িয়ে মাটিতে। আর দড়ির খাটের নীচের মাটির থেকে ঠাণ্ডা উঠছে। এভাবেই ঠাণ্ডার মধ্যে কোনওরকমে রাতটা কাটল।
চতুর্থ পর্ব – অমরনাথ দর্শন
আজ আমাদের পাঁচদিনের অমরনাথ যাত্রার তৃতীয় দিন। সকালে রায়দা প্রতিটি তাঁবুতে এসে সকলকে সাবধান করে গেলেন যে আজ শেষনাগ থেকে বেড়িয়েই আমাদের সব থেকে উঁচু মহাগুনাশ পাস (১৪,৫০০ ফুট) পেরিয়ে যেতে হবে এবং মহাগুনাশ টপের আগে ও পরে অন্তত ১ কিমি রাস্তায় কেউ যেন না দাঁড়ায় বা না বসে। এই রাস্তা যেন সকলেই তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কারন মাহাগুনাশ টপের ওপর অক্সিজেন লেভেল কম থাকায় কারোর কারোর শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
আজ আকাশে সামান্য মেঘ রয়েছে। মহাগুনাশ পাস এখান থেকে ৪.৬ কিমি দূরে। আর এই দুরত্বের মধ্যে আমাদের উঠতে হবে ২,৭৭০ ফুট। সকাল ৯ টার মধ্যেই লাঞ্চ সেরে আমরা সকলে বেরিয়ে পড়লাম। রায়দা ও আরও তিনজন সকলের পিছনে চললেন যাতে ওপরে কারোর অসুবিধা হলে ওঁরা সাহায়্য করতে পারেন।
রাস্তা কিন্তু এখানে পিসু টপের মত খাড়াই নয় বা পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা নয়। সামনে পাহাড়টাকে মনে হচ্ছে একটা উঁচু টিলার মত। কোনও গাছপালা নেই। পাহাড়ের এই পার থেকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে পেরিয়ে ওই পারে যেতে হবে। পাহাড়ি রাস্তা, কিন্তু খুব বেশি এবড়ো খেবড়ো নয়। রাস্তা চওড়া, কোনও দিকে কোনও খাদ বা পাহাড়ের দেওয়াল নেই।
আমরা ধীরে ধীরে ওপরের দিকে এগোচ্ছি। মহাগুনাশ পাসের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি। সামান্য গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামল। ওই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আমরা ধীরে ধীরে মহাগুনাশ টপ পেরিয়ে গেলাম। না, কারোর কোনও শ্বাসকষ্ট হয় নি। একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেলো, যদিও আকাশ হাল্কা মেঘলা হয়েই রইল। এখানে বলে রাখি, পৌরাণিক মতে মহাদেব অমরনাথ যাওয়ার পথে তাঁর প্রিয় ছেলে গনেশকে মহাগুনাশ টপে রেখে গিয়েছিলেন। এজন্য মহাগুনাশ টপকে গনেশ টপও বলা হয়।
মহাগুনাশ পাস থেকে পঞ্চতরণী ৯ কিমি দূরে। তুষার-আবৃত ভৈরব পর্বতচূড়ার ঠিক নীচে এক বিশাল উপত্যকার নাম পঞ্চতরণী। বিভিন্ন পাহাড়ের পাঁচটা গ্লেসিয়ার থেকে পাঁচটা নদীর শাখা বেরিয়ে এসে মিশেছে এখানে পঞ্চতরণী নদীতে। কথিত আছে, মহাদেবের জটা থেকে বেরিয়েছে এই পাঁচটা নদী। মহাগুনাশ টপের উচ্চতা ১৪,৫০০ ফুট হলেও পঞ্চতরণীর উচ্চতা অনেক কম (১২,০০০ ফুট)। মহাগুনাশ টপ থেকে রাস্তা আস্তে আস্তে নীচের দিকে নেমে গেছে পঞ্চতরণীর দিকে। কোনও দিকে কোনও গাছপালা নেই। সামনে বিস্তৃত খোলা জায়গা। অনেক দূরে কিছু কিছু আবছা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এই পঞ্চতরণীতে এখন হেলিপ্যাড তৈরি হয়েছে এবং বালতাল থেকে পঞ্চতরণী পর্যন্ত হেলিকপটারে যাওয়া যায়। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন অবশ্য ঘোড়ায় বা পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
মহাগুনাশ টপ থেকে নেমে আমরা সমতলের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে পঞ্চতরণী কাম্পের দিকে এগিয়ে চলেছি। আকাশ এখন একটু পরিষ্কার, রোদ্দুরও উঠেছে। কিন্তু চারদিক একদম ফাঁকা হওয়ার জন্য বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মাঝে মাঝে হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছি ছোট ছোট নদীর মত পাহাড়ি অগভীর জলস্রোত।
মহাগুনাশ টপ থেকে নীচে নামার রাস্তায়
আমাদের পঞ্চতরণীর ক্যাম্প
দূর থেকে আমাদের তাঁবুগুলো দেখা যাছে। কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর আমরা বেলা দেড়টা নাগাদ আমাদের আজকের গন্ত্যবস্থল পঞ্চতরণী পৌঁছলাম। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম এই ভেবে যে আমাদের তৃতীয় দিনের যাত্রা শেষ। অমরনাথ দর্শনে যেতে হবে পরের দিন সকালে। একটা চায়ের দোকানের সামনে বসেছি, এমন সময় রায়দা এসে বললেন আজ যেহেতু আমাদের হাতে অনেক সময় রয়েছে এবং আজ আকাশ পরিষ্কার, তাই আজই আমরা অমরনাথ দর্শন করব। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।
তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ করে আমরা তৈরি হয়ে অমরনাথ গুহার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পৌরাণিক মতে, মহাদেব অমরনাথ যাওয়ার পথে পঞ্চতরণীতে ত্যাগ করেছিলেন পঞ্চভুত বা সৃষ্টির পাঁচটি মৌলিক উপাদান – মাটি বা পৃথিবী (ক্ষিতি), জল (বরুণ), বায়ু (মরুত), আগুন (তেজ) ও আকাশ (ব্যোম)। পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথ গুহার দুরত্ব ৬ কিমি। পঞ্চতরণীর উচ্চতা যেখানে ১২,০০০ ফুট, অমরনাথ গুহার উচ্চতা ১৩,৫০০ ফুট। তাই আমাদের আরও ওপরে উঠতে হবে। পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথ গুহা যাওয়ার পথের মাঝখানে তিন কিমি দূরে আমাদের পেরোতে হবে সঙ্গম পয়েন্ট।
এই সঙ্গম পয়েন্টেই এসে মিশেছে বালতাল থেকে এসে আরেকটা রাস্তা। বালতাল থেকে সঙ্গম পয়েন্টের দুরত্ব মাত্র ১১ কিমি। এই রাস্তায় বালতাল থেকেও এখন ঘোড়ায় বা পায়ে হেঁটে অমরনাথ দর্শনে আসা যায়। এখন অনেকে আবার পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি-শেষনাগ-পঞ্চতরণী হয়ে এসে অমরনাথ দর্শনের পর বালতালের রাশ্তায় ফিরে যান। ১৯৮১ সালে কিন্তু বালতালের এই রাস্তা অনেক বেশী দুর্গম ছিল। স্থানীয় কিছু লোকজন এই রাস্তা ব্যাবহার করতো মাল নিয়ে যাতায়াতের জন্য, কিন্তু এই রাস্তা তীর্থযাত্রীদের যাওয়া আসার উপযুক্ত ছিল না।
পঞ্চতরণী থেকে শুরু করে নদীর পাশ দিয়ে প্রথম এক কিমি সাধারন পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে আমরা ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠতে থাকলাম সঙ্গম পয়েন্টের দিকে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তাটা বেশ সরু ও দুর্গম। কোনও রকমে একটা ঘোড়া যেতে পারে। কিন্ত অন্য দিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর। উঁচু নীচু পাহাড়, কোথাও বরফে ঢাকা, আবার কোথাও পাহাড়ি ঝর্না ওপর থেকে নীচে নেমে আসছে। নীচে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী। এইভাবে দুর্গম সরু পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় দুই কিমি চলার পর আমরা সঙ্গম পয়েন্টে পোঁছে গেলাম।
সঙ্গম পয়েন্ট থেকে কিছুটা নামার পরই দূর থেকে অমরনাথ গুহা দেখতে পেলাম আর শুরু হলো আমাদের গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে পথ চলা। গাঙ্গুলিদা তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে চলেছেন ভক্তিগীতি। পাশে আমাদের সঙ্গ দিতে থাকল অমরগঙ্গা বা অমরাবতী নদী। এটি উত্তর ভারতের আর এক বিখ্যাত নদী চেনাব এর একটি শাখা। নদীর গভীরতা ও স্রোত যেখানে খুব কম, অনেক তীর্থযাত্রীকে দেখলাম এই ঠাণ্ডার মধ্যেও চান করতে। আমাদের অবশ্য চান করার সাহস হোল না। আমরা মাথায় একটু অমরগঙ্গার পবিত্র ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে নিলাম।
গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে হাঁটা খুব সহজ হচ্ছে না। ঘোড়ার ও লোকের পায়ের চাপে বরফ গলে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। হাতের ছড়ি দিয়ে বরফের ওপর চাপ দিয়ে পা টিপে চলতে হচ্ছে। কিছুদূরে বাঁদিকে দেখলাম একটা পাঞ্জাবী সর্দারজীদের লঙ্গরখানা। ওরা ডাকাডাকি করছে কিছু খেয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা কোথাও না থেমে সোজা গুহার দিকে এগোতে থাকলাম। নদীর স্রোত বাড়তে থাকল। কিছুদুর যাওয়ার পর অমরনাথ গুহার কাছে এসে অমরগঙ্গা গ্লেসিয়ারের নীচে হারিয়ে গেলো।
সামনেই চলে এলো অমরনাথ গুহার সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু উঁচু। প্রায় ২০০ টা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে গুহাতে। সব যাত্রীরা উচ্চৈঃস্বরে ‘বোম বোম ভোলে’, ‘হর হর মহাদেব’, ‘ওঁ নমোঃ শিবায়’  বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো গুহার দিকে। সব সিঁড়ি পার করে লাইন দিয়ে গুহার ভিতর ঢুকলাম।
বরফের শিবলিঙ্গের সামনে যখন পৌঁছলাম, তখন দেখতে পেলাম পুরোহি্তের সামনে লাল কাপড়ে ঢাকা শিবলিঙ্গকে। যাবার আগে লোকের মুখে শুনেছিলাম, অমরনাথের শিবলিঙ্গ ছাদের ওপর থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বা বরফের তৈরি হয়। কিন্তু আমরা যখন দেখেছি তখন এটা অনেক ছোট। আমাদের যাত্রার কয়েকদিন বা তার আগে কিছুদিন বরফ পড়েনি বলে হয়তো বরফের শিবলিঙ্গ অনেকটা গলে গিয়েছিল। গুহার ভিতর উল্টোদিকে একটা বড় বরফখণ্ড রয়েছে যেখানে পার্বতীর পুজো হয়। গুহার ভেতর ১৫-২০ সিন্ডারেলা ট থাকার পর অমরনাথকে প্রনাম করে আমরা বেরিয়ে এলাম।
দর্শন সেরে সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে আমরা ফেরার রাশ্তায় লঙ্গরখানার দিকে এগিয়ে চললাম। সারাদিন প্রায় ১৭ কিমি হাঁটার পর আমরা সকলেই তখন ক্লান্ত আর খিদেও বেশ পেয়েছিল। লঙ্গরখানার সামনে আসতেই সর্দারজীরা আমাদের আপ্যায়ন করে গ্লেসিয়ারের ওপরে বসিয়ে গরম গরম রুটি, ডাল ও চা খাওয়ালো। সবটাই অতিথিসেবা এবং বিনা পয়সায়। খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম এইরকম জনমানবহীন দুর্গম একটা জায়গায় পাঞ্জাবী সর্দারজীদের এই মানবসেবা দেখে। এর সত্যিই কোনও তুলনা হয় না।
কিছুদুর যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামতে লাগলো। কিন্ত আকাশ পরিষ্কার ছিল আর চারদিন পরেই ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা। তাই আকাশে ছিল প্রায় পূর্ণ চাঁদ। হিমালায়ের কোলে পাহাড়, বরফ, নদী, ঝর্না – সব চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করে দিল। সেই স্বর্গীয় পরিবেশে গাঙ্গুলিদার ভক্তিগীতি শুনতে শুনতে আমরা আমাদের ফেরার রাস্তায় পঞ্চতরণীর দিকে চলতে লাগলাম। প্রায় দুঘণ্টা হাঁটার পর আমরা পঞ্চতরণীতে আমাদের তাঁবুতে পৌঁছলাম। সারাদিন পথ চলার পর আমাদের শরীরে তখন আর কোনও শক্তি নেই। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে তাই সকলে শুয়ে পড়লাম।
পঞ্চম ও শেষ পর্ব – এবার ফেরার পালা 
পরদিন অর্থাৎ আমাদের পাঁচ দিনের অমরনাথ যাত্রার চতুর্থ দিন সকালে আমাদের কোন তাড়া ছিল না। তাই ঘুম থেকে উঠলাম একটু দেরী করেই। গতকাল রাত্রে পঞ্চতরণীতে ঠাণ্ডা ছিল শেষনাগের থেকে বেশি। কিন্তু সারাদিন পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার পর এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে রাত্রে একবারের জন্যও ঘুম ভাঙেনি। এখন দেখছি গত তিন দিনে পাহাড়ি রাশ্তায় টানা ৫৪ কিমি হাঁটার ফলে পায়ের নীচে ফোস্কা পড়েছে এবং মাটিতে পা ফেলতে অসুবিধা হচ্ছে। রায়দার উপদেশ মত পায়ের তলায় মোজার ভেতর কিছুটা তুলোর প্যাড লাগিয়ে একটু আরাম পেলাম।
গতকাল সন্ধ্যায় অমরনাথ দর্শন সেরে ফেলায় আজ হাতে কিছুটা সময় পেয়েছি। সকালে পঞ্চতরণীর আশে পাশে একটু ঘুরে দেখে নিয়ে সকাল এগারটা নাগাদ লাঞ্চ করে শেষনাগের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। আজও আকাশ পরিষ্কার। ধীরে ধীরে পঞ্চতরণীর সমতল উপত্যকা পার হয়ে মহাগুনাশ টপে উঠতে শুরু করলাম। মহাগুনাশ টপ সাবধানে পার হওয়ার পর শেষনাগে নেমে আসাটা অনেক সহজ হোল এবং বিকালের মধ্যে আমরা শেষনাগে আমাদের তাঁবুতে পোঁছে গেলাম।
পরের দিন সকালে তাঁবুর বাইরে রোদ ঝলমল করছে। আজ আমাদের পাঁচ দিনের অমরনাথ যাত্রার শেষ দিনে ২৮ কিমি হেঁটে একদম পহেলগাঁও পর্যন্ত নেমে যেতে হবে। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে লাঞ্চ খেয়ে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শেষনাগ লেককে শেষ বারের মত বিদায় দিয়ে। আজ পায়ের তলায় মোজার ভেতর আরও মোটা করে তুলোর প্যাড লাগিয়ে নিয়েছি। চলেছি লিডার নদীর পাশ দিয়ে আর পাহাড় দেখতে দেখতে। পিসু টপ পর্যন্ত পাহাড়ি রাস্তা। কখনও একটু নীচে নামা আবার কখনও একটু ওপরে। এইভাবে আমরা কিছুক্ষণ পর পিসু টপ পৌঁছালাম।
পিসু টপে আমাদের পুরনো দোকানে এক কাপ চা খেয়ে আমরা পিসু টপ থেকে নামতে শুরু করলাম চন্দনবাড়ির দিকে। এই প্রথম অনুভব করলাম পিসু টপের মত একটা খাড়াই পাহাড়ের রাশ্তায় ওঠার থেকে নামা বেশি কষ্টকর। নামার সময় নিজের ওজন এবং ইনারসিয়া অনেক তাড়াতাড়ি শরীরকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। তার জন্য পায়ের ওপর অনেক চাপ পড়ে নিজের ব্যাল্যান্স ঠিক রাখতে। পাহাড়ের আশে পাশের দৃশ্য, পাহাড়ি ঝর্না, জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে লিডার নদীর আঁকাবাঁকা পথ, পাইন গাছের সারি এইসব দেখতে দেখতে খুব তাড়াতাড়ি নীচে প্রায় চন্দনবাড়ির সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম।
এতক্ষণ একদম ফাঁকা রাস্তায় নিজের মত নামছিলাম। কিন্তু চন্দনবাড়ির সিঁড়ির কাছে এসে হঠাৎ দেখলাম উল্টোদিক থেকে অর্থাৎ নীচ থেকে ওপরে উঠছে একসাথে অনেক লোক আর রাস্তার দুদিকে তীর্থযাত্রীদের জন্য ছোট ছোট অস্থায়ী পানীয় জলের সেবা কেন্দ্র। চন্দনবাড়ির চেহারা যেন এই তিনদিনে একেবারে পাল্টে গেছে। চন্দনবাড়ির সেই ফাঁকা, শান্ত পরিবেশ আর নেই। আমাদের বলা হোল রাস্তা ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াতে। পাশের একটা সেবা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে গেলাম।
জানলাম যে অমরনাথের ছড়ি মিছিলের যাত্রা শুরু হয়েছে। একটু পরেই পাশ দিয়ে ওপরে উঠে গেলো অন্তত পাঁচশো সাধু ও অন্য তীর্থযাত্রীদের অনেক লম্বা একটা মিছিল। শুনলাম, ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্য থেকে সাধুরা জমায়েত হয়ে শ্রীনগর থেকে রূপোর তৈরি ছড়ি (মহাদেবের শাসন দণ্ড) নিয়ে মিছিল করে অমরনাথ গুহায় যান শ্রাবন পূর্ণিমায় মহাদেবের পুজা করতে। এই পুজার পর অমরনাথ গুহা বন্ধ হয়ে যায় আর ছড়ি মিছিল করে সাধুরা নেমে আসেন অমরনাথ থেকে।
প্রায় এক ঘণ্টা লাগল ছড়ি মিছিলের চন্দনবাড়ি পেরোতে। তারপর আমরা আস্তে আস্তে নীচে নামতে শুরু করলাম। পায়ে যথেষ্ট ব্যাথা করছে। এই কদিনে এপর্যন্ত প্রায় ৮০ কিমির বেশী হেঁটেছি উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তায়। মাঝে মাঝে বসে একটু বিশ্রাম নিছি। আবার চলতে শুরু করছি। পাহাড়ি রাস্তা ছেড়ে লিডার নদীর পাশে সমতল রাশ্তায় পোঁছবার পর পা যেন আর চলতে চাইছে না। কোন রকমে পা ঘষে ওইটুকু রাস্তা শেষ করে পহেলগাওঁ তে আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম।
আমাদের ৪৮ জনের গ্রুপের ২৪ জন পহেলগাওঁ থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেও এই পাঁচদিনে ৯৬ কিমির পাহাড়ি রাস্তার যাত্রাপথ পায়ে হেঁটে শেষ করতে পেরেছিলাম গাঙ্গুলিদা, আমি আর রায়দা সহ আমরা মোট ছয় জন। আবহাওয়ার দেবতা আমাদের সহায়ক ছিলেন। এই বর্ষাকালেও পাঁচদিনের যাত্রায় বৃষ্টি পায়েছিলাম শুধু একদিনই, তাও মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য।
আমাদের পাঁচদিনের অমরনাথ যাত্রার এখানেই শেষ। পরের দিন দুপুরের খাওয়া সেরে অপরূপ সুন্দর লিডার নদী, ঘন সবুজ পাইনের সারি ও শ্বেতশুভ্র তুষার-আবৃত পর্বত চুড়া সমৃদ্ধ পহেলগাওঁকে বিদায় জানিয়ে ও সারা জীবনের পাথেয় এক অমুল্য অভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে আমরা শ্রীনগরের বাসে উঠলাম।

Sahityika Admin

2 comments

  • শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো যাত্রাপথের ছবিসহ খুঁটিনাটি বিবরণ খুব সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন