স্মৃতিচারণ: আমার প্রথম টিভি কেনা
শৈবাল সরকার, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সালটা ছিল ১৯৮১। আমি তখন Lagan Jute Machinery (ভারত সরকারের অধিকৃত ও পরিচালনাধীন) কোম্পানিতে চাকরি করি। মাইনে পাই সর্বসাকুল্যে মাসে ১১০০ টাকা। এর আগে বাবা ১৯৭৫ সালে যখন রিটায়ার করেছিলেন, তখন আমি ছাত্র। কিছু জমানো আর প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা দিয়ে বাবা ১৯৮০ সাল অবধি সংসারটা চালিয়েছিলেন। তারপর আমার মাইনেতেই কোনরকমে সংসার চলত। বাবা টিভিতে খেলা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। আমরা থাকতাম বাগবাজারে, আমাদের বাড়িতে তখন টিভি ছিলো না। বাবার পিসতুতো বোনেরা থাকতেন প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটে দেশবন্ধু পার্কের কাছে। তাঁদের টিভি ছিলো। বাবা সেই ৭২ বছর বয়সে হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়ি যেতেন শুধুই খেলা দেখার নেশায়। আমার খুব খারাপ লাগতো, কিন্তু কিছু যে করবো সেই সামর্থ্য ছিলো না। মনের কথা মনেই চেপে রেখেছিলাম।
১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে আমাদের অফিসে হঠাৎই একটা পে রিভিশন হয়। জানতে পারলাম পয়লা জানুয়ারি, ১৯৮০ থেকে এই রিভিশন কার্যকরী হবে, অর্থাৎ সেইমত বকেয়া একটা ভালো অঙ্কের টাকা অপ্রত্যাশিতভাবেই আমরা পাবো। বেশ কিছু টাকা তখন পেয়ে গিয়েছিলাম। যেদিনই অফিস থেকে জানতে পারলাম যে টাকাটা ব্যাংকে আমার খাতায় জমা হয়ে গেছে, সেদিনই অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যায় চলে গেলাম বাড়ির কাছে বাপী ট্রেডার্স দোকানে। তারা ছিলো Sonodyne টিভির ডিলার। আমি গিয়ে বেশ কিছু মডেল দেখার পর শাটার দেয়া একটা টিভি পছন্দ করলাম। মডেলটার নাম ছিল Monochrome Delux. আমি দোকানদারকে অনুরোধ করলাম দয়া করে আজকেই টিভিটা আমার বাড়ি পাঠাতে হবে। দোকানদার তো রাজি, তবে বিনিময়ে আমাকে তখনই চেক দিতে হবে। আমার অ্যাকাউন্টে তখন চেক ব্যাবহার করার সুযোগ ছিল না। তাই বললাম, চেক নয়, Withdrawal Slip দিতে পারি। আমার কথায় দোকানদার হেসেই ফেললেন। আমার তখন দোকানদারের প্রায় পায়ে ধরার মতন অবস্থা। তবে আমার প্রতি দোকানদারের কি যে দয়া হল জানিনা, তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে Withdrawal Slip নিয়ে এসে দোকানে জমা দিয়ে, সেদিনেই আমাদের প্রথম টিভি বাড়িতে আনতে পেরেছিলাম। মনে আছে, বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। বাবা বেঁচে ছিলেন ১৯৮৭ সাল অবধি। যেদিন থেকে টিভি বাড়িতে আসে সেদিন থেকে শেষ সময়ে নার্সিং হোম যাওয়ার আগে পযর্ন্ত বাবা রোজ নিজের হাতে টিভি পরিস্কার করতেন। রাতে শোবার আগে শাটার বন্ধ করতেন। ১৯৯০ সালে আমি কালার টিভি কিনি। কিন্তু এই সাদাকালো টিভিটা অনেকদিন আমাদের কাছে ছিলো। যখন আর একদমই চলে না তখন বাতিল (scrap) করে ফেলতে হয়েছিলো। জীবনে পরে আরও কালার টিভি কিনেছি কিন্তু প্রথম টিভি কেনার আনন্দ আর তৃপ্তি কখনও পাই নি।
৯ জুন, ২০২১
অসীম সাহা, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
এন্টেনা ঘুরে যেতো, কাক বা অন্য পাখি এদিক ওদিক করে দিতো, মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টিতেও এন্টেনা ঘুরে যাবার পরে সেটাকে আবার সেট করতে তো। ছাদের ওপর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম ছবি ঠিকঠাক আসছে কিনা, সেই অনুযায়ী এন্টানার অ্যাঙ্গেল সেটিং করতে হতো.
হিমাংশু নাথ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সাদাকালো টিভি, এন্টেনা, কাকের গল্প আমাদের পরের প্রজন্ম বুঝবে না। তারা আবার যখন তাদের ছেলেমেয়েদের ছোটোবেলার গল্প শোনাবে তখন বলবে, কি মুশকিল যে হতো যখন মাঝেমাঝে ‘নেট’ চলে যেতো। তখন সেই জেনারেশন অবাক হয়ে জানতে চাইবে ‘নেট’ চলে যেতো? সেটা কি ব্যাপার?
খুবই ইমোশনাল বিষয়বস্তু।
এই যে পারিবারিক সুখদুখমাখা জীবন, ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
সুন্দর পরিস্কার লেখা