সেদিন সিন্ডারেলা
অমিত পালিত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সময়টা ১৯৯১ সাল, আমি তখন চাকরীসূত্রে মুম্বাইএর বাসিন্দা। অফিসের কাজে আমাকে দু’দিনের জন্য দিল্লীর বিখ্যাত ফরাসী কোম্পানি স্নাইডার ইলেকট্রিক কোম্পানির অফিসে যেতে হয়েছিলো কিছু ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য।
প্রথম দিনের মিটিং এ দুপুরের লাঞ্চ ব্রেকের সময় ওঁদের ফিনান্স ম্যানেজার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস্টার পালিত, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আর ইউ ফ্রম টিটাগড়, নিয়ার ক্যালকাটা?”
এই ফিনান্স ম্যানেজার মহিলাকে আমার প্রথম থেকেই চেনা চেনা লাগছিলো, রাউন্ড টেবিল মিটিং এর শুরুতে ইন্ট্রোডাকশনের সময় ওনার নাম শুনে সেই চিন্তাটাই আমার মাথায় এসেছিলো।
আমি জবাব দিলাম, “ইয়েস, আই হ্যাড মাই গুড ওল্ড চাইল্ডহুড ডেজ এট টিটাগড়।“ তারপর আমার প্রশ্ন “এন্ড ইফ আই এম নট রং, ইউ আর অর্চিশা উপাধ্যায়। এম আই?”
এবার মেয়েটি স্মিতহাস্যে পরিস্কার বাংলায় জবাব দিলো, “হোয়াট এ সারপ্রাইজ, ঠিকই ধরেছো অমিত’দা, আই মীন বাপী’দা। তবে অর্চিশা উপাধ্যায় একটু চেঞ্জ হয়েছে, এখন আমি অর্চিশা উপাধ্যায় সারিন। ১৯৮৪ থেকে আমার নামের সাথে সারিন জুড়ে গেছে।“
আমিও জবাবে বললাম, “ইয়েস, তবে চেঞ্জ শুধু নামে নয়। আই ফাইন্ড মাই সিন্ডারেলা ইজ এ লেডি নাউ।“
আমার উত্তরে সিন্ডারেলার গালে টোল পড়া সেই একই হাসি যা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
লাঞ্চ ওদের অফিসের গেস্ট রুমে সার্ভ করা হয়েছে। অর্চিশাই উদ্যোগ নিয়ে আমার খেয়াল রাখছে। এবং আমার সাথে সে নিজেও খেতে বসেছে। “বাপী’দা, ভেরি সরি, আজ আমাদের মেনুতে কিন্তু তোমার ফেভারিট আলু ভাজা আর সর্ষে মাছ নেই।“
আমি হেসে ফেললাম
– আরি ব্বাস, এসব কথা তোমার এখনও মনে আছে?
– বাঃ, মনে থাকবে না? এই নিয়ে কতসব কান্ড যে তুমি করতে, সে আমি ভুলে যাবো?
সত্যি, আলুভাজা আর মাছ ছিলো আমার সবথেকে প্রিয়। আমি খেতে শুরু করলাম।
– বাপী’দা, তুমি যখন এসেই পড়েছো, আজ তোমাকে আমি আলুভাজা খাওয়াবোই খাওয়াবো। আর মাছও দেখবো পাওয়া যায় কিনা।
– আরে না না, অত ঝামেলায় যেতে হবে না। তোমার বিজনেস মেনুতে স্যুপ, স্যান্ডউইচ, ভেজ কাটলেট, ঠিকই তো আছে। অফিসে এর বেশি আর কি চাই?
– আমি অফিসের এই বিজনেস মেনুর কথা বলছি না বাপী’দা। আমি রাতের ডিনারের কথা বলছি। ইউ শ্যাল বি আওয়ার গেস্ট টুনাইট, এট হোম।
এভাবেই বিগত দিনের কিছু টুকিটাকি কথাবার্তায় আমাদের লাঞ্চ শেষ হলো।
সেদিনের পোস্ট লাঞ্চ মিটিং তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেলো, বিকেল তিনটে নাগাদ। আমার অফিসের সহকর্মীরা হোটেলে ফিরে গেলো, আমি থেকে গেলাম অর্চিশার সাথে ওর বাড়ি যাবো বলে। আমাকে গেস্ট রুমে অপেক্ষা করতে বলে অর্চিশা চলে গেলো, আর আধ ঘন্টা পরে আমায় নিয়ে সে বাড়ি যাবে।
***********
অর্চিশার অফিসের গেস্ট রুমে আমি একা বসে আছি। বেয়ারা চা বিস্কিট দিয়ে গেলো। একা একা বসে ভাবতে ভাবতে অনেকটাই পিছনে চলে গেলাম।
অর্চিশার ডাকনাম ছিলো সিন্ডারেলা ওঁর দশ বছরের জন্মদিনে আমিই ওর নাম দিয়েছিলাম সিন্ডারেলা। আর এখন সবথেকে বেশি আমার যেটা মনে পড়ছে, সেটা ওর দশ সেই বছরের জন্মদিন। ওর মা-বাবা খুব বড় করে সেলিব্রেট করেছিলেন। সেদিন সেই বার্থডে গার্ল একটা সুন্দর ফোর কালারের ফ্রক পরেছিলো। এমনিতেই সিন্ডারেলা ছিলো অপূর্ব সুন্দরী, আর সেদিন ওকে সত্যি গল্পের সিন্ডারেলার মতন দেখতে লাগছিল। … সিন্ডারেলার সেই সাজের দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে ভাসে।
ফিরে গেলাম সেই ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৯ এর সময়টাতে। মানে আমার বয়স তখন ৯ থেকে ২৪। চলে এলাম টিটাগড়ের কিনিসন জুট মিলের কম্পাউন্ডে যেখানে কেটেছে আমার শৈশব থেকে শুরু করে বাল্যকাল, কৈশোর এবং যৌবনের অনেকগুলি বছর। আমার বাবা ছিলেন এই কিনিসন জুট মিলের চিফ মেডিক্যাল অফিসার, আর অর্চিশার বাবা ছিলেন মিলের চিফ ম্যানেজার। আমাদের কম্পাউন্ডে পাশাপাশি দুটো বাংলোতে আমরা থাকতাম।
সিন্ডারেলা ছিলো আমার থেকে দু’বছরের ছোট, আমাদের শৈশবের নির্মল ভাব ভালোবাসা ছিলো খুবই গভীর। দুই বাড়িতেই আমাদের দু’জনের ছিলো অবাধ যাতায়াত। সিন্ডারেলারা ইউপি’র উপাধ্যায়। বাড়িতে ডিম, পেঁয়াজের চল ছিলো, তবে মাছ, মাংস ঢুকতো না। কিন্তু সেই অল্প বয়সেই আমাদের বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে সিন্ডারেলা মাছ-মাংসের স্বাদ তখনই পেয়ে গিয়েছিলো। পুরো ব্যাপারটাই ছিলো সিন্ডারেলা র মা-বাবার অনুমতি নিয়ে। এরপর তো সিন্ডারেলার মাছ মাংসের দাবী মেটাতে প্রতি সপ্তাহের তিন-চার দিন সে দুপুরে আমাদের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করতো।
যেহেতু আমি ছিলাম সিন্ডারেলার থেকে দু’বছরের বড়, তাই বিনা প্রয়োজনেই আমি বহুবার ওকে বকাঝকা করেছি, ওর উপর অভিবাবকত্বের জোর খাটিয়েছি। এই নিয়ে বহু ঝগড়াও হয়েছে, কিন্তু কিছু পরেই আবার ভাবও হয়ে গিয়েছে। আমি যখন প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করি, তখনও তাঁর স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। সে বাড়িতেই থাকতো। আমাদের বাড়িতে আমার ঘরে এসে আমারই রং পেন্সিল নিয়ে আমারই ড্রয়িং খাতায় যা খুশী ছবি আঁকতো। এই নিয়ে কত বকেছি। তারপর যথারীতি মান অভিমান। তারপর আমি ওর নরম নরম গালদুটো টিপে আদর করে দিলেই আবার ভাব হয়ে যেতো। এই ছিলো আমাদের দু’জনের ছোটবেলার সম্পর্ক,এবং আমাদের এই সম্পর্কে আর অন্য কারোর প্রবেশাধিকারই ছিলো না।
আমাদের কম্পাউন্ড ছিলো এক্কেবারে গঙ্গার পাড়ে। দুটো ল্যান্ডমার্ক বিল্ডিং ছিলো, ঝিলকুঠি আর বিহাইভ। ঝিলকুঠি একটা ছড়ানো দোতলা বাডী, চারদিকে ঝিল, আর মাঝে সেই কুঠি। সেই ঝিলকুঠির দোতলায় থাকতো সিন্ডারেলারা। সেই ঝিলকুঠির দোতলার বারান্দা ছিলো আমাদের দু’জনের খেলাঘর। সবথেকে আনন্দ হতো বৃষ্টির দিনে। বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতাম। আর বিহাইভ ছিলো ব্রিটিশ আমলের তৈরী এক রহস্যময় বাড়ি, অনেকটা পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর মতন, গোলাকার আর বেশ বড়। শোনা কথা, এর তলা দিয়ে নাকি সুড়ঙ্গ ছিল, কিন্তু কেউ সেটা খুঁজে পায়নি। রহস্য রহস্যই থেকে গেছে।
ঝিলের জলে আমরা দু’জনে সেই ছোটবেলা থেলেই ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। যত না মাছ ধরতাম, তার চেয়ে সময়ের অপচয় হতো বেশি। কাগজের নৌকা বানিয়ে উপর থেকে ছুঁড়ে দিতাম। এগুলোই ছিলো আমাদের শৈশবের উত্তেজনা। ঝিলের আরও একটা বড় আকর্ষন ছিলো নানান রকমের পাখীর ডাক। আর অন্যসময় আমরা প্রায়ই দুজনে মিলে গঙ্গার জোয়ার ভাঁটা দেখতে যেতাম। গঙ্গার পাড়ে আমাদের সেই সবুজ লনের মাঝে গাছপালায় ঘেরা ঝিলের ছিলো এক অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। আর ছিলো বিশুদ্ধ বায়ু। পরিবেশ মানুষের মনে, বিশেষ করে শিশুদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। হয়তো সেই ছোটবেলার পরিবেশের কারণেই আমাদের দুজনের মনে প্রথম থেকেই সুন্দর জিনিষগুলো বুঝতে শিখেছিলাম।
আমি পড়তাম ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুলে, আর সিন্ডারেলা পড়তো ব্যারাকপুর গার্লস স্কুলে, দু’ক্লাস নীচে। একদম কাছাকাছি স্কুল, আমাদের দু’জনের জন্য একটা বিস্বস্ত সাইকেল রিক্সা ছিলো। সিন্ডারেলার জন্য রিক্সার ডানদিকের সিটটা রিজার্ভ ছিলো, কেন জানি না, বাঁদিকের সিটে ও বসতোই না। স্কুলের যাতায়াতের ঐ সময়টুকু ছিলো শুধু আমাদের দু’জনের। মাঝরাস্তায় মাঝে মাঝে দাঁড়াতে হতো, তখন সিন্ডারেলা বাজারের একটা দোকান থেকে হজমিগুলি কিনতো। আর পকেটে আরেকটু পয়সা থাকলে আইসক্রীম। আমিও ভাগ পেতাম। অসংখ্যবার এমনও হয়েছে, পয়সা কম থাকলে একই আইসক্রীম আমরা দুজনে মিলে খেয়েছি। সেই স্কুলের যাতায়াতের ঐ সময়টুকুও ছিলো শুধুই আমাদের দু’জনের।
অল্প বয়স থেকেই আমি খুব ভালো সাইকেল চালাতাম। আর সিন্ডারেলাকে পিছনের সীটে বসিয়ে কম্পাউন্ডে রোজ কয়েক রাউন্ড না চড়ালে আমার সাথে ওর আড়ি হয়ে যেতো।
ক্লাস এইটে বাবা আমাকে একটা বড় সাইকেল কিনে দিলেন, আমি এখন থেকে সাইকেলেই স্কুলে যাবো। আমার দেখাদেখি সিন্ডারেলাও সাইকেলের বায়না ধরলো। ওর বাবাও ওঁকে একটা সাইকেল কিনে দিলেন। কিন্তু সে তো সাইকেল চালাতেই জানে না। তখন সে বায়না ধরলো, যতদিন সে সাইকেল চালানো শিখবে, ততদিন আমিও সাইকেলে স্কুলে যেতে পারবো না, একসাথেই দু’জনকে রিক্সাতে যেতে হবে। আমার ভীষণ রাগ হয়েছিলো। আমি বিকেলে ঝিলের পাশে গিয়ে একলা চুপচাপ বসে ছিলাম। খেয়াল করিনি, সিন্ডারেলাও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শান্ত গলায় একটা কথা বললো, “বাপী’দা, তুমি কাল থেকে সাইকেলেই স্কুলে যেও, আমি রিক্সাতেই একলা চলে যাবো।“ এরপর আর সে দাঁড়ালো না, সন্ধ্যার অনেক আগেই বাড়ি ফিরে গেলো।
সেদিন আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। সিন্ডারেলা আমাকে যে একলাই স্কুলে যেতে বললো, সেই অভিমান আমি সেই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম। মাও সেদিন খেয়াল করেছিলেন, বিকেলে আমি ঝিলের পাশে একাই বসে আছি। মুখের চেহারা দেখে বুঝলেন কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। মায়ের মন, ছেলের মনের কথা ঠিক বুঝতে পারেন। সাইকেলের ব্যাপারটা জানতেন। আমাকে ডেকে বললেন, “বাপী, কয়েকদিন না হয় রিক্সাতেই গেলি। আর ততদিনে ওকে সাইকেল চালানোটাও শিখিয়ে দে। তারপর না হয়, দুজনে একসাথেই সাইকেলে যাবি।“
মায়ের সেদিনের কথায় তখন আমার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।
পরদিন যখন রিক্সা এলো, আমি আগে থেকেই রিক্সার জায়গায় গিয়ে বাঁদিকের সীটে বসে রইলাম। ডানদিকের সীট তো সিন্ডারেলার জন্য আজীবন রিজার্ভড, সেখানে বসা যাবে না। সিন্ডারেলা এসে আমাকে দেখলো, মুহুর্তের মধ্যেই যত মান অভিমান সব দূর হয়ে গেলো। আমি বললাম, “তোকে বাদ দিয়ে আমি কি করে স্কুলে যাই বল তো?”
এরপর আমরা রিক্সাতেই স্কুলে যেতাম। তবে সিন্ডারেলা বুঝতে পেরেছিলো যে, আমি সাইকেলে যেতে পারছি না বলে আমার মনে একটা চাপা দুঃখ আছে। একদিন সে নিজেই বললো, “বাপী’দা, তুমি আমাকে ক্যারি করে সাইকেলে স্কুলে নিয়ে যেতে পারবে?”
আমি ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো সাইকেল চালাতাম, বললাম, “কেন পারবো না? তুই চাইলেই তোকে নিয়ে যাবো।“
এরপর শুরু হলো আমার সাইকেলে স্কুলে যাওয়া, সামনে সিন্ডারেলাকে বসিয়ে।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় স্কুলে ফুটবল খেলতে গিয়ে আমি পায়ে ভয়ংকর চোট পাই। এতটাই যে পা ভেঙ্গে তিনমাস আমাকে নার্সিং হোমে থাকতে হয়েছিলো। তখন সিন্ডারেলা প্রায় রোজই আমাকে দেখতে আসতো। আর সাথে হজমিগুলি, আইসক্রীম, পয়সা থাকলে ক্যাডবেরিস।
এরপর ৭২ সালে আমি শিবপুরে বিই কলেজের হস্টেলে চলে এলাম। সপ্তাহের শেষে বাড়ি গেলে দেখা হতো। ৭৪ সালে আমার সিন্ডারেলা বোর্ডের পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ইকনমিক্স নিয়ে পড়তে চলে গেলো দিল্লির শ্রীরাম কলেজ অফ কমার্সে। তখন থেকেই আমাদের যোগাযোগ যেন হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেলো। ৭৭ এ আমি চাকরী পেলাম, আর সেই বছরই সিন্ডারেলা ম্যানজমেন্ট পড়তে আমেরিকা চলে গেলো। সিন্ডারেলা অধ্যায়ের উপর হঠাৎই যেন যবনিকা নেমে এলো।
***********
“চলো বাপী’দা, আই এম রেডি।“
অর্চিশার কথায় অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম।
গাড়িতে উঠে অর্চিশা প্রথমেই বলে, “৭৭ সালের পরের তোমার হিস্ট্রি বলো বাপী’দা, শুনি।“
– নো, নো, লেডিজ ফার্স্ট। আগে সিন্ডারেলার হিস্ট্রি শুনবো, তুমি আগে বলবে। ছোটবেলায় এই সিস্টেমই তো আমরা ফলো করে এসেছি।
হে হে করে হেসে উঠলো।
– তোমার দেখছি সব মনে আছে।
– ইয়েস, আমার গোল্ডেন ডেজে’র কথা অনেক কিছুই আজকে আবার মনে পড়লো।
খানিক থেমে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, সিন্ডারেলা, তুমি তো ইউএস গেলে, ম্যানেজমেন্ট পড়তে। তারপর কি হলো?”
– সে তো এইট্টিজ- এ আমি কমপ্লিট করলাম। তারপর ওখানে ডয়েস ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হয়ে দু’বছর ছিলাম। ভালোই ডলার কামাচ্ছিলাম, কিন্তু কাজটা ভালো লাগছিলো না।
আমি অবাক ডয়েস ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি’র কাজ ভালো লাগলো না?
– আরে দুর। কনসালটেন্সির যত্তসব বাজে বাজে কাজ। পুরনো ফাইল থেকে রিপোর্ট খুঁজে নতুন ক্লায়েন্টের জন্য সেই একই লেখা পঞ্চাশ পাতা, একশ’ পাতার কপি করে নতুন রিপোর্ট বানাও, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাও, ডুবন্ত কোম্পানির হয়ে দালালি করো, এসব কাজ কতদিন করবো? ভালো লাগলো না, বাবাকে বলে ইন্ডিয়াতে ফিরে এলাম।
– ইউএস থেকে ফিরে এলে? উইদাউট এনি এসাইনমেন্ট? আর ইউ ক্রেজি? তারপর?
– তারপর এখানে এসে প্রোডাকশন ম্যানুফ্যাকচারিং সেকটরে কাজ খুঁজলাম। কনসালটেন্সিতে আর কাজ করবো না। পুনেতে থারম্যাক্সে কাজ পেলাম, যেরকম চাইছিলাম। কিছুদিন পর সেখান থেকে পুনেতেই মাহিন্দ্র গ্রুপে কিছুদিন থেকে এইটিসেভেন এ স্নাইডারে এসে জয়েন করলাম।
– সো, নাউ ইউ আর হ্যাপী।
– ইয়েস, ইউ ক্যান সে সো। এখন আই এম হেডিং স্নাইডার ইন্ডিয়ার ক্যাশ ফ্লো। ব্রেনওয়ার্কস এর অনেক স্কোপ আছে। এন্ড নো মোর পঞ্চাশ পাতার রিপোর্ট রাইটিং ফর ক্লায়েন্টস।
বলতে বলতে চলে এলাম দিল্লীর বাঙালীটোলায়, চিত্তরঞ্জন পার্কে। মাছের বাজারে।
“বাপী’দা, আজ তো তোমার মাছ আর আলুভাজা খাওয়ার দিন। বলো, কি কি মাছ খাবে? ”
– কি কি মানে? কতরকমের মাছ কিনবে?
– আমি মাছ চিনি না বাপী’দা। আর এদিকে আসাও হয় না। আমার হাবি মাঝেমধ্যে মাছ খেতে চায়। এলাম যখন, কয়েকরকম মাছ নিয়েই যাবো।
– ওকে, তাহলে কেনো।
সে আমার দিকে যেন অবাক হয়ে তাকালো। “তাহলে কেনো, মানে? আমি কি মাছ চিনি নাকি? তুমি আমাকে আগে দেখিয়ে দাও কোন মাছটা ভালো, তারপর তো কেনা।“
আমিও আকাশ থেকে পড়লাম, “আরে আমিও তো মাছ চিনি না। বম্বেতে আমার চেনা দোকান আছে, সে যা গছিয়ে দেয়, তাই বাড়ি নিয়ে আসি।“
তখন দুজনেই সামনের দোকানের মাছওয়ালার কাছে আত্মসমর্পন করে দিলাম। সিন্ডারেলার হাবি কাঁটামাছ খেতে পারে না। তাই সেই দোকানীকে ভরসা করে কাঁটা নেই এমন মাছ, পমফ্রেট আর বোয়াল কিনলাম।
সিন্ডারেলারা থাকে দিল্লীর প্রান্তে ফরিদাবাদ বর্ডারের কাছে ইরোজ গার্ডেনে বেশ সুন্দর ফ্ল্যাটে। বড় ফোর বেডরুম ফ্ল্যাট। বড় লিভিং রুম। সুন্দর সাজানো। খানিক বাদে একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। সিন্ডারেলাই পরিচয় করিয়ে দিলো, সি ইজ মাই ডার্লিং, অর্চনা।
চায়ের আসরে সিন্ডারেলা একটা বড় বোমা ফাটালো। “বাপী’দা। একবার আমাদের একটা বিজনেস কনফারেন্সে জিটিএল গ্রুপের ল্যুজ রায়ের সাথে আলাপ হয়েছিলো। কথায় কথায় মনে হয়েছিলো তোমারই কলেজ মেট। তোমার নাম বলাতে সে চিনতেই পারলো না। অথচ খানিক পরে বলে, তোমার নাম নাকি খোকার বাপ, সেইজন্য অমিত নামে চিনতেই পারে নি। ইজ ইট?“
সিন্ডারেলার কথা শুনে আমার তো মাথায় হাত। শালা ল্যুজকে পেলে তখনই বোমা মেরে উড়িয়ে দি। “আর তুমি যে লাস্ট ইয়ার ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ডে তে সাইক্লিং রেসে ম্যাঞ্চেস্টার গিয়েছিলে, সেটাও বললো।“
আমি কি আর বলি? চুপ করেই রইলাম।
“বাপী’দা। ম্যাঞ্চেস্টারে সাইক্লিং রেসে যাচ্ছো মানে তুমি নিশ্চয়ই তোমার ছোটবেলার সাইকেলের প্র্যাকটিস এখনো ধরে রেখেছো?”
আমি হ্যাঁ, না কিছুই না বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম।
সিন্ডারেলা আমাকে মনে করিয়ে দিলো, “বাপী’দা, কম্পাউন্ডের সরস্বতী পূজোয়, পিকনিকে, ফাংশনে তোমার রবি ঠাকুরের আফ্রিকা রিসাইটেশন মনে আছে?”
আমি অবাক চোখেই ওর দিকে তাকালাম। “তোমার মনে আছে?”
– কবিতাটা? না,না , সে কি করে মনে থাকবে? তুমি রিসাইট করতে, সেটা মনে আছে।“
আমি আবার কিছুক্ষণের জন্য সেই অতীতে চলে গেলাম।
– একবার শোনাবে বাপী’দা? কিছুটা হলেও?
ওর চোখে এক আবদার মেশানো মিনতি। অনেকটা সেই সাইকেল চড়ানোর জন্য যেমন মিনতি করতো, সেই চোখ দুটোই যেন দেখতে পেলাম।
অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। গোটা দশেক লাইন আবৃত্তি করে শোনালাম।
তারপর মিনিট খানেক এক অদ্ভুত নীরবতা।
খানিক পরে সিন্ডারেলার হাবি এলেন, বললেন যে আমাদের টিটাগড়ের বাড়িতে কয়েকবার এসেছেন। “আই স্পেশালি রিমেম্বার দ্যা ফুডস এট ইয়োর হাউস। ফিস, চিকেন, মাটন আনফরগেটবল। দ্যা অনলি টাইম ইন মাই লাইফ আই ক্যুড গেট দ্যা বেংগলী স্পেশাল ডিশেস। দ্যাটস এট ইয়োর প্লেস।“ এরপর একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে বসলেন, “সো? হাউ ইজ সিন্ডারেলা নাউ?”
অস্বস্তিকর প্রশ্ন, তবুও হাল্কা করে জবাব দিতেই হলো, “দ্যা সেম, আন্ডার ইয়োর কেয়ার।“
আরও বেশ কিছু গল্প হলো। তারপর রাতের ডিনারে মাখন পরোটা, আলুভাজা, পমফ্রেট ভাজা। আমিই মেনু ঠিক করে দিয়েছিলাম।
আজ এতদিন পরে ছোটবেলার অনেক কথাই মনে আসছে। মনে পড়ে ওর দশ বছরের জন্মদিন। ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সেই আমি পা ভেঙ্গে তিনমাস নার্সিংহোমে ছিলাম। মায়ের সাথে সিন্ডারেলা নিয়মিত আমাকে দেখতে এসেছিল… ওর ঐ দিশাহারান চোখ দুটিতে এক করুনার আভাষ পেয়েছিলাম।
রাতের খাওয়ার পর ট্যাক্সি করে হোটেলে ফিরে আসছি। মনে কিরকম যেন এক শুন্যতা। ছোটবেলায় আমরা দু’জনে যখন একসাথে থাকতাম, তখন আমাদের সম্পর্কে কোনো তৃতীয়জনের প্রবেশাধিকারই ছিলো না। জগৎটা ছিলো শুধু আমাদের দু’জনের। সেই সময়টাকে খুঁজবার চেষ্টা করলাম …. কিন্তু পেলাম না…. সেই মুক্তোঝরা হাঁসি আজও আছে…. তবে অনেককিছু পাল্টে গেছে… বদলে গেছে…
আজ আঠারো বছর পরে আমাদের দুজনের সেই স্বার্থপরের জগতটায় এখন অনেকেই এসে ভাগ নিয়ে নিয়েছে।
Add comment