সাহিত্যিকা

দুটি গল্প – রেশমী আলোর ছটা, প্রজেক্ট সাইটে অপরূপা

দুটি গল্প – রেশমী আলোর ছটা, প্রজেক্ট সাইটে অপরূপা
অসীম সাহা, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

রেশমী আলোর ছটা

স্ত্রীর সাথে নিউমার্কেটে এসেছি, পারফিউম কিনতে হবে। স্ত্রী পারফিউম কিনছেন। আমি দেয়ালে সাজানো প্যাকগুলো দেখছি। এমন সময় এক সুন্দরী মহিলা, সম্ভবত আমারই মতন বয়সী হবেন, একটু ভারিক্কি চেহারা, পোষাকে বেশ আধুনিকা, এসে হঠাতই আমার সামনে দাঁড়িয়ে খানিক তীক্ষ্ণ নজরে দেখে খুব সপ্রতিভ হয়েই প্রশ্ন করলেন, “আমি সরি, একটা প্রশ্ন করছি। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি কি মিঃ সাহা? এয়ারলাইন্সে কাজ করতেন?”
না, প্রশ্নে কোন জড়তা নেই। স্মার্ট, স্পষ্ট একটা প্রশ্ন। আমি ক্ষনিকের জন্য অবাক হলেও ভাবছি কে ইনি? ভারতীয় না বিদেশিনী, সেটাও বোঝা মুস্কিল। অথচ স্পষ্ট বাঙলায় জিজ্ঞেস করলেন। আমি ওনাকে চিনতে পারছি না, অথচ উনি আমাকে ঠিকই চিনেছেন। অফিসের নামটা অবশ্য গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি চুপ করে আছি, ভাবছি এক অচেনা মহিলার প্রশ্নের কি জবাব দেবো। উনি অপ্রস্তুত হয়েই আবার বললেন, “ওঃ, আই এম সরি। আই থট ইউ আর মিঃ সাহা।“
এই অবস্থায় আমাকে বলতেই হলো যে, আমার নামটি সঠিক। কিন্তু আমি এয়ারলাইন্সে কাজ করতাম না, এয়ারপোর্ট অথরিটিতে কাজ করতাম, আর এখনও করি।
– ওঃ, তাহলে আপনি কি তেজপুরের মিঃ শর্মাকে চেনেন? আই মীন, একসময় কি চিনতেন? ওনার বাড়ি বা টি গার্ডেনে কি কোনদিন গিয়েছিলেন?
স্মৃতি হঠাতই একটা ঝিলিক দিলো। আমি সংক্ষেপে জানালাম, “হ্যাঁ, একদিন সন্ধ্যায় ওনার বাড়ি গিয়েছিলাম, আর টি গার্ডেনেও গিয়েছিলাম।“ নিজেকে যতটা সম্ভব সেফ রাখার জন্য আরও জানালাম, “হ্যাঁ, মনে আছে। উনিই আমাকে ইনভাইট করেছিলেন, তাই গিয়েছিলাম।“
ভদ্রমহিলা একটু হেসে জবাব দিলেন, মিঃ সাহা, আই এম রেশমী।
রেশমী? রেশমী? তেজপুরের রেশমী?
আমার বয়স এখন পঞ্চান্ন। ফ্ল্যাসব্যাক এক মূহুর্তে আমাকে অনেক পিছনে নিয়ে চলে গেলো।

সেটা সাল ১৯৮০, পোস্টিং কলকাতায়। আর এয়ারপোর্ট অথরিটির গুয়াহাটি রিজিওনাল হেড অফিসের তেজপুর প্রজেক্টের কাজে আছি। আমাকে ঐ রিজিওনের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে নিয়মিত ট্যুর করতে হতো। তেজপুরে রিপোর্ট করতাম এয়ারপোর্ট ইনচার্জ মিঃ সিকদারকে। আর কাজ করতে হতো ওখানের ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে।

একদিন আমাদের প্রজেক্টের ভেন্ডর, ইঞ্জিনিয়ার এবং কিছু সাপোর্ট স্টাফদের নিয়ে মিটিং চলছে। এমনসময় হটাৎই না জানিয়ে দরজা ঠেলে এক অপরূপা সুন্দরী প্রবেশ করলেন। পোষাক দেখেই বুঝলাম যে তিনি Jet Airways এর এয়ার হোস্টেস। প্রথম দর্শনেই মনে হলো মেয়েটি স্মার্ট, ধনী ঘরের মেয়ে। বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি একুশ হয়তো হবে, গায়ের রং যাকে আমরা বলি কাঁচা হলুদ। স্কিন দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি যথেষ্ট চর্চা করেন, ফলস্বরূপ স্কিনে যেন মাখন গলে গড়িয়ে পড়ছে। সুন্দর ফিগার, বেশ লম্বা, সাধারণ মেয়েদের মতো নয়।

সুন্দরী প্রথমেই করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেন বিনা অনুমতিতে আমাদের মিটিং এ ঢুকে পড়ার জন্য। ঘরের বাইরে ছিলো চৌকিদার, সেও এসে হাজির এবং বলতে লাগলো যে বারণ করা সত্বেও উনি জোর করে এই ঘরে ঢুকে পড়েছেন। কোন ভূমিকা না করেই সুন্দরী এয়ারপোর্ট ইনচার্জ মিঃ সিকদারকে আবার করজোড়ে আবেদন জানালেন যে ওনার শরীর হটাৎই খুব খারাপ লাগছে। সেদিন আর ফ্লাইটে সার্ভিস দিতে পারবেন না, তাই এমারজেন্সি ডিউটি ব্রেক চাইছেন। সেই ফ্লাইট ছিলো যতদূর মনে পড়ে, Jet Airways এর কলকাতা – তেজপুর – ইমফল এবং ফেরত। সুতরাং লম্বা সময়ের সফর। এই পরিস্থিতিতে এয়ার হস্টেসকে একজন সরকারি ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে অসুস্থতার কারণ সার্টিফাই করাতে হয়, এবং ফ্লাইট সার্ভিসে আনফিট ডিক্লেয়ার করাতে হয় যাতে সেই এয়ারহোস্টেসকে সেই মুহুর্তে ডিউটি থেকে বিশেষ কারণে অব্যাহতি দেওয়া যায়।

এর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই এক সুদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এলেন, সঙ্গে একজন ডাক্তার। ডাক্তার এসে এয়ারপোর্ট ইনচার্জের ঘরের পাশেই আরেকটা ঘরে (যেখানটা সাধারণত খালি থাকে) এই সুন্দরীকে নিয়ে গেলেন, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা “unfit for fly” বলে একটা সার্টিফিকেটও ইস্যু করে দিলেন। বুঝলাম সুন্দরীই ওনাদের খবর দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে মিঃ সিকদার আমাকে কানে কানে জানিয়ে দিলেন যে এই সুন্দরী তেজপুরেরই কন্যা এবং আমরা যে চা খেলাম, সেটা ওদেরই বাগানের চা। এটা ওঁদের পারিবারিক ব্যাবসা, এবং যে ভদ্রলোক এসেছেন, তিনিই মেয়েটির বাবা। শহরের সন্মাণীয় ব্যাক্তি, শিক্ষিত প্রকৃতি ভদ্রলোক এবং নামী ও ধনী ব্যাবসায়ী। যাওয়ার আগে ভদ্রলোক, আমাদেরকে করজোড়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন নিজের মেয়ের বিপদের সময় সহযোগীতা করার জন্য। আমাদের সকলকে একটা করে বড় চায়ের প্যাক উপহার দিয়ে অনুরোধ করলেন আমরা যেন সেদিন সন্ধ্যায় অতি অবশ্যই উনার বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণে আসি। জানালেন, সেই প্যাকেটের চা ওনাদের টি গার্ডেনের সেরা চা, বেশিরভাগই বিদেশে রপ্তানী হয়। আমরা ভদ্রতার খাতিরেই যাওয়ার চেস্টা করবো বলে জানালাম।

ভদ্রলোক চলে গেলে মিঃ সিকদার আমাকে জানালেন যে চাইলে আমি যেতে পারি, কিন্তু উনার সন্ধ্যায় জরুরী কাজ আছে, যেতে পারবেন না। এও জানালেন, যে এই ভদ্রলোক শিক্ষিত, আচার ব্যাবহারে খুবই ভালো, এখানের লোকজন ওনার সুনামই করে। আর যেহেতু উনি এই এয়ারপোর্ট প্রজেক্টের ভেন্ডর নন বা কোনভাবেই যুক্ত নন, তাই আমি চাইলে স্বচ্ছন্দে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে পারি। আর জানালেন মেয়েটিকেও যেটুকু দেখেছেন, সেও খুবই ভদ্র, শিক্ষিত, মার্জিত।

এরপর সারাদিনের কাজের শেষে আমি আমার গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম। কেয়ার টেকার জানালো একটি লোক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওর কথায় একজন মাঝবয়সী লোক এসে আমাকে একটা চিরকুট দিলো। দেখি একটা ছোট ডেস্ক প্যাডের কাগজে খুব সুন্দর হাতের লেখা, Thanks for your cooperation, when my daughter was feeling sick. We shall be obliged if you please visit our home for a cup of tea. With regards – Jagadish Sharma. অর্থাৎ এই চিঠির প্রেরক সকালের সেই সুন্দরীর বাবা। প্যাডের কাগজে শুধুই নামটাই ছাপা, আর কিছু নয়। উনি যে সফল ব্যাবসায়ী, গণ্যমান্য লোক, সেটা এই প্যাডের কাগজে কোথাও লেখা নেই। সকালের মিঃ সিকদারের কথা মনে পড়ে গেলো, উনি শিক্ষিত মার্জিত ভদ্রলোক, তাই নিজের অনাবশ্যক প্রচার হয়তো পছন্দ করেন না। আরও মনে হলো যে ওনার পরিস্কার সুন্দর হাতের লেখাও ওনার একটা পরিচয়।

লোকটি গাড়ি নিয়ে এসেছে, আমাকে নিয়ে যাবে। আমি সেই মুহুর্তে দ্বিধাগ্রস্ত যে আমার যাওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না। আবার স্বীকার করতেও বাধা নেই যে আমি সকালের প্রথম দর্শন থেকেই এই সুন্দরীর আকর্ষন অনুভব করছি। ঠিক করলাম, যাবো। সেই সুন্দরীর জন্যই যাবো। মিঃ সিকদার যাবেন না, আমি একাই যাবো। একটু সাজগোজ করেই নিলাম। যতই হোক, আমার বয়স তেইশ। অচেনা সুন্দরীর বাড়ি প্রথমবার যাচ্ছি। ট্যুরে সাধারণত কেউই সাজগোজের পোষাক আনে না, তবু স্যুটকেসের সেরা বস্তুগুলোই বেছে নিয়েছিলাম।

ড্রাইভার পূর্ণ মর্যাদা সহকারে আমাকে নিয়ে এলো। বিশাল বাড়িটা শহরের কিছুটা বাইরে। প্রধান ফটকে উর্দি পরা দ্বাররক্ষী, গাড়ি দেখেই দরজা খুলে দিলো। বাড়ির সামনেটায় সবুজ ঘাসের লন, নিয়নের হাল্কা আলোয় উজ্জ্বল। লনে বেতের সৌখীন চেয়ারে বাবা আর মেয়ে বসে আছেন। মাঝে সেন্টার টেবিল। আমাকে দেখে দু’জনেই করজোড়ে এগিয়ে এলেন। ভালো লাগলো, এত ধনী ক্ষমতাবান একজন বয়স্ক লোক আমার মত অল্পবয়সী অপরিচিত একজন সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারকে এভাবে আপ্যায়ন করবেন আমি ভাবতেই পারি না। সুন্দরীও নমস্কার করলেন। আমিও দু’জনকেই প্রতি নমস্কার জানালাম।

প্রাথমিক পরিচয়ে মিঃ শর্মা অমায়িক ভাবেই নিজের পরিচয় দিলেন। আর মেয়ে, নাম রেশমী, গত বছর কলকাতা গোখেল কলেজ থেকে ইংলিশে অনার্স পাশ করে এখন জেট এয়ারলাইন্সে এয়ার হস্টেসের কাজ নিয়েছে। তেজপুরেই বাবার সাথে থাকতে চায়। কথা প্রসঙ্গে জানালেন যে রেশমী যখন খুব ছোট তখন ওর মা মারা যান। তারপর থেকে রেশমী বাবার সঙ্গ ছাড়তেই চায় না। আর আমি মনে মনে হিসেব করে নিলাম, রেশমী গত বছর গ্র্যাজুয়েশন করেছে মানে এখন বয়স উনিশ কুড়ি হবে। সকালে প্রথম দেখায় এক ঝলকে কুড়ি একুশ ভেবেছিলাম সেটা ভুল ছিলো। আমিও কিছুটা সাহসে ভর করে ভাবলাম, এঁকে এখন থেকে আর আপনি সম্বোধন না করে, তুমি সম্বোধন করবো।

আপনি একটু বসুন, বাবার সাথে গল্প করুন, এই বলে রেশমী উঠে চলে গেলো। আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলাম। যার জন্য আসা সেই চলে গেলো। মিনিট খানেক পরেই দেখি রেশমী ফিরে আসছে, হাতে ট্রে। কাছে এলে দেখলাম, ট্রেতে কাঁচের গ্লাসে কিছু একটা সরবত হবে। আমি খানিকটা আশ্চর্যই হলাম। সামান্য দূরেই উর্দি পরা বেয়ারা, আদেশ পালন করার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সেই জায়গায় রেশমী নিজেই অতিথির জন্য পানীয় নিয়ে আসছে। মনে মনে বাবা আর মেয়ে, দুজনেরই আতিথেয়তা ও রুচিবোধের তারিফ করলাম।

রেশমী নিজেই পানীয় পরিবেশন করে দিলো। মিঃ শর্মা জানালেন, আসামে খুব ভালো কমলালেবু হয়। এটা তারই রস, বাড়িতেই মিক্সড। একটু পরেই চা আসবে, তাই বিশেষভাবে মিস্টি মিশিয়ে এই ফলের রস বানানো হয়েছে। রেশমী আমাকে বললো, মিঃ সাহা, একটু পরেই চা দেবো। কখন লাগবে বলবেন, সংকোচ করবেন না।

একটা প্রশ্ন বারবার আমার মনে উঁকি দিচ্ছিলো। জিজ্ঞাসা করলাম, এত ভালো বাংলা কি ভাবে শিখলেন? মিঃ শর্মা হাসলেন। আমার নাম শর্মা, অথচ পরিস্কার বাঙলা বলছি, আপনার আশ্চর্য্য লাগছে। তাই তো? আসলে আমার জন্ম কলকাতায়, রেশমীরও জন্ম কলকাতায়। আমরা কলকাতার চায়ের বড় ডিস্ট্রিবিউটর। রেশমীর মা যখন মারা যান, রেশমীর বয়স তখন সাত। তারপর আমার কলকাতা আর ভালো লাগছিলো না। বাবার কথায় এই তেজপুরে চলে আসি। তেজপুর তখন পাড়াগাঁ। সুযোগ বুঝে এই টি গার্ডেন কিনে ফেলি,যেটা দিয়ে আমার নিজের ব্যাবসার শুরু। কিছুদিন পরে রেশমীও আমার কাছে চলে আসে। তারপর থেকে আমরা এখানেই আছি। কিন্তু ছোটবেলার বাংলাটা এখনও ধরে রাখতে পেরেছি। আর বাংলা ভাষাটাকে কদর করি, মেয়েকেও সেরকমই শিখিয়েছি।

কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার বললেন, সকালে আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম আপনি বাঙালী, তাই শুধুমাত্র কিছুটা ভালো সময় কাটানোর জন্যই আপনাকে আসতে অনুরোধ করি। সন্ধ্যাবেলায় চায়ের সাথে পরিস্কার বাঙ্লায় গল্প করবো, আর অন্য কিছু নয়।

আমি আর না বলে থাকতে পারলাম না। আপনি জন্মসূত্রে বাঙালী না হয়েও যেভাবে ছোটবেলার বাংলা ভাষাটাকে ধরে রেখেছেন, আমি কিন্তু আপনার তারিফ না করে পারছি না।
– মিঃ সাহা। আমি রবীন্দ্রনাথ, শরৎবাবু, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ, নজরুল মোটামুটি পড়েছি। আমার মেয়ে ইংলিশে গ্র্যাজুয়েট, সেও প্রচুর বাংলা পড়ে। সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, বা উত্তম, সুচিত্রা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাসদের নিয়ে আমরা দু’জন যে কোন বাঙালীর সাথে আড্ডা মারতে পারি।

রেশমী জানালো, সে চা নিয়ে আসছে। মিনিট পাঁচেক পরে দেখি নিজেই একটা ট্রে নিয়ে আসছে, আর তার ঠিক পিছনে একজন উর্দিপরা বেয়ারাও ট্রেতে করে কিছু নিয়ে আসছে। আমাদের সামনে চেয়ারে না বসে লনের ঘাসে হাঁটু মুড়ে বসে টি পট থেকে চা ঢেলে দিলো। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।

“চিনি দুধ কতটা দেবো?” এই প্রশ্নে হুঁশ ফিরে এলো যে আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। “সামান্য দেবেন”, সংক্ষেপেই উত্তর দিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে মেয়েটিকে আমি তুমি সম্বোধন করবো।
– আমি কিন্তু আপনার থেকে বয়সে ছোট, আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন, আপনার থেকে আপনি শোনার মত বড় আমি কিন্তু এখনও হই নি।
কথাগুলো শুনে ভালোই লাগলো। রেশমী চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। দেখলাম বাটিতে কিছু একটা সার্ভ করছে, মনে হলো পায়েস। জানতে চাইলাম, “এটা কি, পায়েস?”
– হ্যাঁ। আমিই বানিয়েছি। তবে বাঙালী পায়েসের থেকে একটু অন্যরকম। আসামের কমলালেবু দেওয়া আছে। খেয়ে বলবেন কেমন লাগলো?
– আপনি পায়েস বানিয়েছেন? সরি, তুমি পায়েস বানিয়েছো?
– কেন? আমি কি পায়েস বানাতে পারি না? না কি আমার করা বারণ?
– না না, সেরকম আমি মিন করি নি।
– তাহলে বললেন কেন? আমি আরও একটা ডিস বানিয়েছি, মাছের চপ। খেয়ে বলবেন।

চা, সাথে পায়েস, কিছু ফল, আর মাছের চপ খেতে খেতে আমরা গল্প শুরু করলাম। যেমন ভালো চা, তেমনি মিস্টি পায়েস আর মাছের চপ। আমি প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না, “রেশমী, তুমি যে এত ভালো ডিস বানাতে পারো, সেটা যেমন ভাবা যায় না। তেমনি এটাও আমার মনে হয় যে তোমার বয়সের কেউ আজকের দিনে কিচেনেই ঢুকবে না। ডিস তৈরি করা তো পরের ব্যাপার।“
– এইটাই তো আপনাদের প্রবলেম। কেন? আমার বা আমাদের সম্বন্ধে আপনার এই ধারণা কেন?
– আমি যেটুকু দেখেছি রেশমী, তাই বলেছি। আমি যেটুকু বুঝতে পারছি যেভাবে তোমার গ্রুমিং হয়েছে, সেটা অন্যদের থেকে আলাদা।
– না, মিঃ সাহা। আপনি তাহলে জগৎটাকে অল্পই দেখেছেন।
আমি হেসে ফেললাম। “তাই? হবে হয়তো। তবে যে কথাটা বলি রেশমী। হয়তো আমি কম জানি বা দেখেছি। কিন্তু আমার এরকম দেখায় তুমিই প্রথম।“
– বুঝলাম না।
– আমি যা বলতে চাইছি, এখনের দিনে তোমাদের মতন ফিনান্সিয়াল স্টেটাসের ঘরে এটা খুব একটা দেখা যায় না।
মিঃ শর্মা সম্ভবত প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলেন। কলকাতা নিয়ে, তার সাথে তেজপুরের সামাজিক পার্থক্যের বিষয়ে কয়েকটা কথা বললেন। আমার চা বাগান সম্বন্ধে কোন সম্যক ধারণাই ছিলো না, মিঃ শর্মাকে কয়েকটা টুকটাক প্রশ্ন করলাম। উনি উল্টে আমায় প্রশ্ন করলেন “এই ট্রিপে তেজপুরে কতদিন থাকবেন?”
– এই দিন সাতেক।
– তাহলে একদিন সময় নিয়ে, মানে চার পাঁচ ঘন্টার সময় নিয়ে আমাদের গার্ডেনে আসুন। সেখানেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
– সেটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং হবে, আমি অফিসের কাজে এসেছি। কিন্তু একদিন হাফ ডে সময় নিশ্চয়ই বার করে নিতে পারবো।
কথায় কথায় জানালেন এখান থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরেই নিজেদের বড় চা বাগান আছে, আর শিলচরের কাছেও আরও দু’টো চা বাগান আছে।

বাইরে হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। এখানে এইসময়ে প্রায়ই হাল্কা হাল্কা বৃষ্টি হয়। উনি আমাকে ভেতরে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। ঘরটি বেশ বড়, এবং গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় সর্বত্র। সবই বনেদী আসবাব, আধুনিক ফার্নিচার একটাও নেই। মাথার উপরে উজ্জ্বল ঝাড়বাতি। দেয়ালে যামিনী রায়ের পেইন্টিং, দেওয়ালে প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা পুরোন আমলের লম্বা পেন্ডুলামের দেওয়াল ঘড়ি। অন্যদিকে লম্বা একটা কাঁচের আলমারীতে বেশ কিছু ক্রিস্টাল আর হাতীর দাঁতের শো’পিস। কোনায় সাদা মার্বেলের স্ট্যাচু, বোধহয় ইতালিয়ান হবে। ঘরের তিনদিকে বসার ব্যাবস্থা, আর একদিকে একটা বড় পিয়ানো।

গানবাজনা আমার ভালো লাগে, সুতরাং স্বভাবতই নজর গিয়ে পড়লো পিয়ানোর উপর। বললাম, “বাঃ, আপনাদের গানবাজনারও শখ আছে মনে হয়।“
– আপনি বাজাবেন?
আমি আঁতকে উঠলাম। “না, না। আমি গান শুনি, ভালো গান, ভালো মিউজিক শুনতে ভালো লাগে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই।“
– তবে, আজ আমি একটু বাজাই, শুনুন তাহলে। অনেকদিন বাজানোও হয় নি। আজ একটু চেস্টা করে দেখি, আপনার ভালো লাগে কিনা।

মিঃ শর্মা পিয়ানোয় গিয়ে বসলেন। রেশমী ঘরের উজ্জ্বল হলুদ আলো নিভিয়ে হাল্কা সাদা আলো জ্বালিয়ে দিলো। মিঃ শর্মা ধরলেন রবীন্দ্রসংগীতের সুর, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। এরপর রেশমী এসে বাজালো তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। আমার স্বতস্ফুর্ত প্রশংসা বেরিয়ে এলো, “অসাধারণ।” অনুরোধ করলাম আরেকটা বাজানোর জন্য। একটু হেসে রেশমী বাজালো দু’টো গান, একটি রবীন্দ্রসংগীত না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, আর অন্যটা আধুনিক গান বাদল কালো ঘিরলো গো, সব নাও তীরে এসে ভিড়লো গো। ঐ হাল্কা আলোর স্বর্নালী সন্ধ্যায় সেই ক্ষণিকের সুরের আবেশ আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলো।

আমাদের ডিনার রাত আটটা নাগাদ হয়ে যাওয়ার পর রেশমী কফি নিয়ে এলো। আমি ওনাদের চা বাগান দেখার ইচ্ছেটা আবার বললাম। ঠিক হলো যে আগামী শুক্রবার, মানে আর দু’দিন পরে সকালে আটটা নাগাদ উনারা গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে ওনাদের চা বাগানে নিয়ে যাবেন। এরপর রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ ড্রাইভার আমাকে গাড়ি করে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিলো। সত্য স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেদিনের সেই সন্ধ্যাটা যেন ঘোরের মধ্য দিয়েই কেটে গেলো। স্বপনচারিনী বলে যদি সত্য কিছু থাকে, সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম।

তিনদিনের মাথায়, যেদিন যাবো, সকাল থেকেই ঝিরঝির করে হাল্কা বৃষ্টি। আমি ভাবছি আজকে হয়তো আর যাওয়াই হবে না। মিঃ শর্মা রোজ সাতটায় বাগানে চলে যান। তাই আটটার নির্দিষ্ট সময়ে রেশমী একাই গাড়ি নিয়ে এসেছে। পড়েছে সাদা শাড়ির সাথে কালো ফুলহাতা ব্লাউজ। চুলে গামছার মতন কি একটা জড়ানো, নাম জানিনা, কিন্তু খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আর চুলের সামনের দিকের খানিকটা দু’দিকের গাল বেয়ে নেমে আসছে। কপালে, দুই ভুরুর মাঝে খুব ছোট্ট একটা কালো টিপ। রেশমীর কথা বলার স্বরে মাদকতা আছে। হাসিটুকুও খুব সুন্দর। গালে টোল পড়ে। চঞ্চল মন সকাল থেকে ওর কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।

আমি সেজেগুজে প্রস্তুত ছিলাম। ইচ্ছে ছিলো গ্রামের মেঠো রাস্তায় খোলা জিপের গাড়ি চড়ে যাবো। কিন্তু এই বৃষ্টিতে সেটা আর হলো না। আমাদের নিয়ে গাড়ি চা বাগানের দিকে রওয়ানা দিলো। সতেরো কিলোমিটার পথ, হাইওয়ে থেকে বাঁক নিয়ে এগারো কিলোমিটার গ্রামের পথ দিয়ে যেতে হবে, প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা।
রেশমীর ব্যাপারে আমার কৌতুহলের কথা আগেই বলেছি। এবার একটু ভূমিকা করে ওকে বলেই দিলাম, রেশমী, আমার একটা বিরাট কৌতুহল হচ্ছে। তুমি আধুনিকা, তুমি শহরের নামী কলেজে ইংলিশে গ্রাজুয়েশন করেছো। তুমি বড়লোক বাড়ির মেয়ে। তুমি ইচ্ছে করলেই অনেক ভালো কেরিয়ার তৈরি করতে পারো। এই তেজপুর শহরেই নিজের ব্যাবসায়ে উদ্যোগী হতে পারো। অথচ কাজ করছো এয়ার হস্টেসের। ভালো বাংলা শিখেছো, পিয়ানো শিখেছো, নিজের হাতেই বাড়ির এত কাজ করছো। আমি তোমার মতন এই প্রফাইল আজকের দিনে খুব একটা খুঁজে পাবো না। আমার একটু আশ্চর্য্ই লাগছে।

আমার কথা শুনে রেশমী অনেকটাই হেসে নিলো। দেখলাম, গালে টোল পড়েছে।
– সে আমার অনেক বড় গল্প। আমি নিজেও জানি না কোথা থেকে কি হয়ে গেছে। ছোটবেলায় মা’কে হারিয়েছি। তাই বাবার সাথেই থাকতে চাই। নইলে বাবা যে একলা হয়ে যাবে। আর কলকাতায় কলেজে পড়ার সময়ই এয়ার হস্টেস হবার ভূত মাথায় চাপে। এয়ার হস্টেস হলে একটু এদিক ওদিক যাওয়া যায়, তাই। অথচ বাবার কাছে তেজপুরেই থাকার ইচ্ছে। এইসব মিলিয়ে সব গোলমাল হয়ে গেছে।

আমি বুঝতে পারছি না, এরপর আমি কি বলবো। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে এটাই আমার বড় সমস্যা হয়ে যায়। অনেক প্ল্যান করে, ভাবনাচিন্তা করেই শুরু করি, তারপর আর টানতেই পারি না। রেশমী বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছিলো। স্মার্ট মেয়ে, ফ্লাইটে কতরকমের লোককে ম্যানেজ করার ট্রেনিং নেওয়া আছে, আমি তো কোন ছাড়। আমার অবস্থা, সম্ভবত বুঝতে পেরেই বললো, “কিন্তু জানেন, মাঝে মাঝে আমার খুবই বোর লাগে, কাজের বৈচিত্র নেই। বেশিদিন এই কাজ আমি করতে পারবো না, সেটাও জানি। তখন যা হবে দেখা যাবে।“
রেশমীর কথার ভঙ্গীতে মোহ আছে, মনে হয় নিজের ব্যাক্তিত্বর জন্য কথার যুক্তি দিয়ে সকলকে খুব ভালো প্রভাবিত করতে পারে। আমাকে তো করেই ফেলেছে।

গাড়ি ইতিমধ্যে হাইওয়ে ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় এসে পড়েছে। আকাশ পরিস্কার নীল, মাঝেসাঝে সাদা তুলোর মতো কিছু মেঘ দেখা যায়। এর মাঝেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তার দু’দিকেই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানে সারা বছর হাল্কা বৃষ্টি হয়, তাই দু’দিকের গাছপালা সব সতেজ, সবুজ। কত রকমের কত রঙের নাম না জানা ফুল রাস্তার ধারে অনাদরে ফুটে রয়েছে। আর রয়েছে ছোট ছোট টিলা। একটু দূরে দূরেই লোকজনের ছোট ছোট বসতি। গাড়ি চলছে, আর রেশমী ধারাবিবরনীর মতন এখানের পরিবেশের বৈশিষ্টগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমরা নাকি রুপসা নদীর সামান্য দূর দিয়েই যাচ্ছি। সারাবছরের বৃষ্টির দৌলতে এই নদীতে বছরভর বেশি না হলেও পা ভিজে যাওয়ার মত জল থাকে।

ঝিরঝির বৃষ্টি থেমেছে। ড্রাইভার গ্রামের মাঝে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালো। রেশমী আর ড্রাইভার ফ্লাস্ক নিয়ে নেমে গেলো। আমাকেও সঙ্গে ডেকে নিলো। গেলাম গ্রামের মাঝে এক কুয়োর কাছে। রেশমী ফ্লাস্ক ভরে জল নিলো। রেশমী নিজেও গ্রামের এক মহিলার সাথে অহমিয়া ভাষায় কিছু কথা বলে, তারপর ঘটি থেকে দু’হাতে আঁজলা ভরে জল খেলো। এবার আমাকেও জল খেতে ডাকলো। আমি ইতস্তত করছি। কলকাতায় ফিল্টার ছাড়া জল খাই না। রাস্তায় হটাত দরকার পড়লে দোকান থেকে বিসলেরি কিনে খাই। এই অজ গ্রামের জল কতটা স্বাস্থ্যকর হবে সন্দেহ আছে। রেশমী আমার মনের দোনামনা বুঝতে পেরেছে। “আসুন তো”, বলে নিজেই ঐ মহিলার থেকে জলের ঘটি নিয়ে বললো “নিন, একবার খেয়ে দেখুন, টেস্ট করুন। আমি খেয়েছি, মরব না। আপনিও মরবেন না। খেয়ে নিন।“
অত অনুরোধে নিরুপায় হয়েই আমি রেশমীর হাতের ঘটি থেকে আঁজলা ভরে কিছুটা জল খেলাম। কি মিষ্টি!! ভাষায় বোঝানো যাবে না। রেশমী মিটি মিটি হাসছে। আবার গালে টোল। হেসে হেসেই জিজ্ঞেস করলো, “কি? কেমন লাগলো? আরও একটু টেস্ট করবেন?”
আমি তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতন। এত মিস্টি জল হয়? মুখে নয়, মাথা নেড়ে জানালাম, আরও একটু খাবো।
– আমি জানতাম। আপনার আরও একটু চাই। আরে, আপনারা শহরের বাবু, এই আসামের গাঁয়ের কূয়োর জলের স্বাদ কি আপনাদের খবরের কাগজে পাবেন? নিন হাত পাতুন।
অকাট্য কথা। খণ্ডন করার কোন উপায় নেই। আবার রেশমীর হাতের ঘটি থেকে আঁজলা ভরে জল খেলাম। এখানের কুয়োর জল এত মিস্টি, জলের এরকম স্বাদ ভাবতেই পারি না।

খানিক পরেই দু’ধারে চায়ের বাগান শুরু হয়ে গেলো। পিচের রাস্তা, কখনো উপরে উঠছে, আবার নীচে নেমে আসছে। রেশমী জানালো ওরাই নিজেদের কোম্পানির খরচে এই রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে। রাস্তার পাশেই একচালা বাচ্চাদের স্কুল, স্কুলের সামনের মাঠেই ছেলেমেয়েরা খেলছে, সবাই ইউনিফর্ম পড়া। আশ্চর্য লাগলো এই অজ গাঁয়ে প্রাথমিক স্কুলে ইউনিফর্ম দেখে। রেশমীকে জিজ্ঞেস করাতে জানালো, ওরাই ফ্রিতে সকলকে দেয়। আরেকটু এগিয়ে প্রাথমিক সাস্থ্যকেন্দ্র। রেশমী জানালো এটাও ফ্রি, তেজপুরের সরকারী হাসপাতালের একজন রিটায়ার্ড ডাক্তার, বাবার খুব বন্ধু, এখানে রোজ এসে বসেন। আরেকটু এগিয়ে একটা বাঁধানো চাতাল। নিজের থেকেই বুঝলাম এখানে পূজাপার্বন, নাটক, যাত্রাগান এসব হয়। সবথেকে অবাক হলাম দেখে যে এখানে একটা ক্লাব হাউসও আছে। রেশমী জানালো, এখানে মহিলাদের একটা কোঅপারেটিভও আছে। নানান রকমের হাতের কাজ, মধু, আচার এসব তেজপুর শহরে বিক্রির জন্য যায়।

রেশমী আরও জানালো, বাবা বছরের শেষে নিজের থেকেই কোম্পানির প্রফিটের অনেকটাই বোনাস হিসেবে কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ করে দেন। আর কর্মচারীদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে থাকলে বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখাশোনা করেন। বেশির ভাগ সময় রেশমীও সঙ্গে থাকে।
– জানেন, এখানে বাগানটা কেনার পর আজ পর্যন্ত একটাও লেবার স্ট্রাইক, গন্ডগোল এসব কিচ্ছু হয়নি।
শুনে বললাম, “তুমি যা বলছো, তারপর তো এখানে লেবারদের কোন অসন্তোষ থাকারই কথা নয়।“

খানিক পরে গাড়ি এসে থামলো বাগানের প্রান্তে বাঁশবাগানের কাছে একটা ব্রিটিশ ডিজাইনের বাড়ির সামনে। রেশমী বললো, এটা ওদের গেস্ট হাউস। সাহেবদের আমলের বাড়ি। সামনে সুন্দর ঘাস বিছানো লন। একদিকে বেতের চেয়ার। আমরা ওখানে গিয়ে বসলাম। মিঃ শর্মা খবর পেয়ে এলেন। উর্দি পড়া বেয়ারা চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে এলো। এলাহী পরিমান। চিপস, ড্রাই ফ্রূট, পেস্ট্রি আছে। বুঝলাম মিঃ শর্মা নিজের ব্র্যান্ড নিয়ে খুবই সচেতন। মেনুতে কলকাতার মতন তেলেভাজাও আছে, আমি তো অবাক। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে রেশমী জানালো, মিঃ শর্মা আর রেশমী দুজনে এখানে এলেই তেলেভাজা খেয়ে যান।

বেয়ারা এলো কাপে চা ঢেলে দেবে, রেশমীই বারণ করলো। নিজেই আমাদের কাপে চা ঢেলে দিলো। চায়ের সাথে কিছু গল্প। চায়ের পর মিঃ শর্মা নিজের অফিসে ফিরে গেলেন। আমি রেশমীর সাথে বাগান দেখতে বেরোলাম। বাগান মানে সবুজ টি প্লান্ট। আর একটু পরে পরেই লম্বা লম্বা গাছের সারি। এই গাছের ছায়ায় আর সূর্যের আলোআঁধারিতে চায়ের ছোটছোট গাছগুলো বেড়ে ওঠে। বোঝা যায়, প্ল্যান করেই এরকম প্ল্যানটেশন করা হয়েছে। চারিদিকে সুন্দর সারিবদ্ধ কোমড় সমান চা গাছের সারি। তার মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার রাস্তা, মেয়েরা পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পিঠের ঝুড়িতে রাখছে। ওরা জানে যখন তখন বৃষ্টি নামে, তাই প্রত্যেকের মাথায় বেতের টুপি। বর্ষার সময়, বা রোদের তাপ থেকে এই বেতের টুপিই ওঁদের রক্ষা করে।

আমরা বাগানের মধ্যে ঘুরছি। রেশমী দেখলাম প্রায় প্রত্যেককেই চেনে। কাউকে দিদি, কাউকে মাসী কাউকে কাকু নামে ডেকে নানান রকম খবরাখবর নিচ্ছে। ওরাও খুশী হয়ে মনের কথা, ঘরের কথা মন খুলে বলছে। খুব ভালো লাগলো, মালিকের মেয়ে হয়েও এভাবে সাধারণ কর্মচারীদের সাথে মন খুলে মেলামেশার এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। আমি তো দেখিনি।

হঠাত আবার ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আমরা দুজনে একটা গাছের নীচে এসে দাঁড়ালাম। কেন জানিনা, তখন আমার নিজেকে খুব রোমান্টিক মনে হতে লাগলো। এভাবে বৃষ্টির মাঝে একজন সুন্দরীর সাথে চা বাগানে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছি, এই ভাগ্য জীবনে আর আসবে কিনা জানি না। রেশমী অহমীয়া ভাষায় কাছের একজনকে কি বললো। সে দু’টো বেতের টুপি নিয়ে এলো। রেশমী নিজে একটা মাথায় দিয়ে, অন্যটা রেশমিই আমার মাথায় পড়িয়ে দিলো। ভালোই লাগছিলো। রেশমী ফুট কাটলো, ইস, যদি একটা ক্যামেরা থাকতো, আপনার দুর্লভ একটা শট তুলে রাখতাম।

হাল্কা বৃষ্টির মাঝে ঘুরতে ঘুরতে আমরা ফ্যাক্টরির কাছে চলে এলাম। “আপনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, অথচ ইন্টারেস্টিং হবে, তেমন ইঞ্জিনিয়ারিং কিছু এখানে নেই। কিছু মেশিন আছে, চলুন সেগুলোই দেখাই।“ রেশমী প্রতিটি মেশিনের সামনে গিয়ে নিজেই মেশিনের যান্ত্রিক ব্যাপারগুলো আমাকে বুঝিয়ে দিলো। আমাকে নিয়ে গেলো পাওয়ার প্ল্যান্টে। আমি নিজে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমাকে অবলীলায় প্ল্যান্টের পাওয়ার সাপ্লাই বুঝিয়ে দিলো। আমি অবাক। একজন কুড়ি একুশ বছর বয়সী ইংলিশে অনার্স গ্র্যাজুয়েট মেয়ে, ফুল টাইম এয়ার হস্টেস। অথচ প্রতিটি মেশিনের ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। রেশমীকে যতই দেখছি, যেন নতুন করে জানতে পারছি, চিনতে পারছি।

এরপরই আমরা গেস্ট হাউস ফিরে গেলাম। মিঃ শর্মা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের জন্য হাল্কা বিজনেস লাঞ্চের ব্যাবস্থা করে রেখেছিলেন। স্যান্ডউইচ, চিকেন রোস্ট, কফি। তার একটু পরেই আইসক্রিম। একদম সাধারণ মেনু, কিন্তু ঐ প্রাকৃতিক পরিবেশের সবুজ লনে বসে সেই লাঞ্চের আনন্দটাই অন্যরকম।

আমি সব মিলিয়ে বাগানে ছিলাম প্রায় ঘন্টা তিনেক। ফেরার আগে মিঃ শর্মা আমাকে জানালেন, আমি যদি আবার ট্যুরে এসে এই বাগানে বা বাড়িতে সন্ধার সময় ডিনারে আসতে চাই, জানাতে যেন দ্বিধা না করি।

আমি রেশমীর সাথে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম। মাঝরাস্তায় আবার সেই কুয়োর জল খেলাম। রাস্তায় ফিরতে ফিরতে অনেক গল্প হলো। সোয়া ঘন্টার পথ। আমাকে গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিয়ে রেশমী বাড়ি ফিরে গেলো।

এরপর কতগুলো বছর কেটে গেছে। অফিসের কাজে তেজপুরে আরও অন্তত পচিশ ত্রিশ বার গিয়েছি। খুব ইচ্ছে হতো আবার রেশমীর সাথে দেখা করি, ওঁর বাবাকে জানাই যে আমি এসেছি। কিন্তু পারিনি। নিজের মানসিক জড়তায় বারবার আটকে গিয়েছি। তখন আমার বয়স বাইশ তেইশ হবে। এখন পঞ্চান্ন। কিন্তু সেই কথাগুলি, সেই হাসির সাথে গালে টোল, সুন্দর সন্ধ্যায় পিয়ানোর সুর, নিজের হাতে কাপে চা ঢেলে দেওায়া, চা বাগানে একসাথে মাথায় টুপি পড়ে পাশাপাশি পথ চলা, আঁজলা ভরে কুয়োর জল খাওয়া। প্রতিটি মুহূর্ত স্মৃতির মনিকোঠায় সযত্নে সঞ্চিত রেখেছি।

আজ প্রায় তিরিশ বছর পরে সেই কিশোরী রেশমীকে আর পাবো না। তবে পিয়ানোর সেই ধুন, না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, মনে পড়ে গেলো।

*********

প্রজেক্ট সাইটে অপরূপা

১৯৮০ সাল। কাজ করি National Dairy Development Board (NDDB) এ আমাদের সিকিম জোরথাং চিলিং প্লান্ট প্রজেক্টে।

আমাদের পাহাড়ি সাইটকে প্রকৃতি যেন ঢেলে সাজিয়েছে। একদিকে পাহাড়ি রঙ্গিত নদী। চারিদিকের জঙ্গলে নানান রকমের নাম না জানা গাছ আর ফুল। সকালে ঘুম ভাঙে পাখীদের কিচির মিচির আওয়াজে। আবার সন্ধ্যায় পাখীরা বাসায় ফিরে এসে গানের আসর বসায়।

সেই সাইটে আমরা কয়েকজন বাঙালি মিলে সরস্বতী পুজো করলাম। সারা রাত জেগে প্যান্ডেল হলো। রঙ্গিন কাগজ, কাপড়, ফুল, পাতা দিয়ে। শিলিগুড়ি থেকে ছোট ট্রাকে করে সরস্বতী মূর্তি আনিয়ে বসানো হলো আমাদের নিজেদের হাতে বানানো প্যান্ডেলে। স্থানীয় রান্নার ঠাকুরকে অনেক কষ্টে বোঝানো হলো কি কি রান্না করতে হবে এবং কি ভাবে করতে হবে। পূজোর দিন খুব সকালে উঠে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে যথাসাধ্য মাঞ্জা দিয়ে পুজোর প্যান্ডেলে পৌঁছেও গেলাম। আমি একজন প্রধান উদ্যোক্তা, তাই পূজোর ভালোমন্দের দায় অনেকটাই আমার উপরে।

আমাদের ওখানে ডক্টর প্যাটেল নামে একজন ভেটেনারি ডাক্তার ছিলেন। অল্পবয়সী গুজরাটি ছেলে, দেখতে শুনতে বেশ ভালো। সম্প্রতি বিয়ে করেছে। কিন্তু তখন সে ফোর্সড ব্যাচেলর কারণ তখনও ঐ সাইটে ফ্যামিলি নিয়ে থাকার মতন খুব ভালো ব্যাবস্থা ছিলো না। হটাৎই দেখি আমাদের সেই ডক্টর প্যাটেল প্যান্ডেলে আসছে আর ওঁর সঙ্গে এক সুসজ্জিত এবং সুন্দরী মহিলা। পড়েছেন গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়ি, সুন্দর একটা সাদা সোয়েটার, আর গলায় স্ট্রাইপ করা মাফলার। কানের দুল, হাতের চুড়ি, এমনকি হাতের ঘড়ির ব্যান্ড সবই ম্যাচিং করা। পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের সবুজ, ফুল, নদী সবই যেন এই সুন্দরীর সাথে একাকার হয়ে গেলো।
শুধুই সৌন্দর্য নয়, যা আমাকে আকর্ষণ করেছিলো সেটা ওঁনার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর স্মার্টনেস। চলাফেরাতে সুন্দর একটা ছন্দ আছে। শুরুর আবেশ কাটতেই স্বভাবতই আমি উঠে দাঁড়ালাম আর হাত জোর করে অভ্যর্থনা জানালাম আমাদের এই উৎসবে যোগদানের জন্য। আমি জানতাম না যে ডক্টর প্যাটেল নিজের স্ত্রীকে সাইটের অস্থায়ী কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছেন।

পূজোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। লোকজন আসছে। লাউড স্পিকারে গান চলছে। ভাবতেই পারিনি এইরকম একটা নির্জন জায়গায়, পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে এত সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারবো। লোকজন নিজেদের মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। আর আমি ব্যস্ত। সবাই যাতে বসার জায়গা পায়, অঞ্জলি দিতে পারে, প্রসাদ পায়, ভোগের খাওয়া পায়, সবদিকেই আমাকে খেয়াল রাখতে হবে।

আমার তখন এক জটিল মানসিক অবস্থা। ভেবেছিলাম, আজ সরস্বতী পুজোর দিনে আমার প্রিয়া বাসন্তী রঙের শাড়ী পড়ে কলকাতার কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, তা আর হলো না। আর অন্যদিকে আমার চোখের সামনে এক অপরূপা সুন্দরী। মনটা বারবার চঞ্চল হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে আমি নিজের হাতে সুন্দরীকে প্রসাদ দিয়ে এসেছি। পূজোয় অঞ্জলি দিতে গাইড করেছি। যেটুকু মন্ত্র জানি বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমস্তুতে, জোড়াতাপ্পি দিয়ে এসব মন্ত্রগুলোর মানেও বুঝিয়ে দিয়েছি।

দুপুর বেলায় সবার শেষে আমরা কয়েকজন যখন খেতে বসেছি তখন দেখলাম মিসেস প্যাটেল আমার পাশেই এসে বসলেন আর ওনার অন্যপাশে ডক্টর প্যাটেল। মনে হলো ডক্টর প্যাটেল আমার সম্বন্ধে নিজের স্ত্রীকে নিজেদের ভাষায় কিছু বলছে। দু’একটা কথায় বুঝলাম যে প্যাটেল বলছে, আমি এই প্রজেক্টের একজন সাইট ইঞ্জিনিয়ার। শুনে ভালো লাগলো, প্যাটেল আমার পরিচয়টা তৈরি করে দিচ্ছে। মন্দ কি? এরপর প্যাটেল উঠে অন্য জায়গায় গিয়ে নিজের ইয়ার দোস্তদের সাথে আড্ডায় জমে গেলো।

এদিকে আমি বুঝতে পারছি না আমার পাশেই বসা এই সুন্দরী তরুণীর সাথে আমি কি কথা বলবো? কিভাবে শুরু করবো? ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু শুরু করতে পারছি না। সুন্দরীর গায়ের মিস্টি পারফিউমের গন্ধটাও পাচ্ছি। বাংলায় একেই বোধহয় বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেই সংকট মূহূর্তে সেই সুন্দরীই আমাকে বাঁচিয়ে দিলো। বললেন, খুব সুন্দর পুজোর আয়োজন হয়েছে। আর আমি যদি একটু ফ্রি থাকি, তাহলে সে কি আমার সাথে একটু কথা বলতে পারে?

পরিচয়ে সুন্দরীর নাম জানলাম। বাড়ির নাম, মানে আমরা যেটাকে ডাকনাম বলি, তা হলো মেঘা। নিজের ভালো নাম আমাকে বললো না, বললো আমি স্বচ্ছন্দে মেঘা নামে ডাকতে পারি। সে একজন আৰ্কিটেক্ট, এখন আপাতত পুনাতে বাবার বিজনেস দেখে। আর কন্সালটেন্সিও করে। আমি ইঞ্জিনিয়ার, আর সে আর্কিটেক্ট, মোটামুটি একই ধরনের কাজ করি। তাই আমার সাথে আলাপচারিতা শুরু করতে সময় লাগলো না।

ভদ্রমহিলা (জানি না, কি বলবো? ভদ্রমহিলা? না তরুণী? না সুন্দরী?) আমাকে বললেন যে এর আগে গুজরাটে, আর পুণেতে সরস্বতী পূজো দু’একবার দেখেছেন। কিন্তু প্যান্ডেলে গিয়ে সামান্য কিছু সময়ের জন্য। এই প্রথম সামনে থেকে অনেকটা সময় নিয়ে দেখলেন। আর আমার খুবই প্রশংসা করলেন। জানালেন বাতাসা খুব ভালো লেগেছে। শুনে আমি উঠে গিয়ে আরও কিছু বাতাসা নিয়ে এলাম। উঃ, এতনা লায়া মেরে লিয়ে? Ok, no problem, let’s share. আমাকে জোর করে কিছু বাতাসা গছিয়ে দিলেন। মিথ্যা বলবো না, ওনার এই জোর করে বাতাসা গছিয়ে দেওয়া আমার খুব ভালো লাগলো। দুজনে ভাগাভাগি করে পুজোর বাতাসা খেলাম। মনে পড়ে গেলো, আমি ভিক্টোরিয়ার বেঞ্চে বসে আমার প্রিয়ার সাথে কতদিন আইসক্রীম, ঝালমুড়ি ভাগাভাগি করে খেয়েছি। সে ছিলো একরকম, আর সুদূর সিকিমে সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক অপরূপার সাথে বাতাসা খাওয়া আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই পাহাড়ি পরিবেশে, আশেপাশে কেউ নেই, শুধু আমরা দু’জনে। বাতাসা আমার খুব একটা পছন্দ নয়, পুজোর প্রসাদ ছাড়া। কিন্তু সেদিন খুব তৃপ্তি করে বেশ কয়েকটা বাতাসা খেয়েই নিলাম।

ইতিমধ্যে সুন্দরী আমাকে “তুমি” সম্বোধন শুরু করে দিয়েছে। শুনো না, মেরে লিয়ে থোড়া চায় জুগার হোগা? প্লিজ। তখন আমার অগ্নিপরীক্ষা, যে করেই হোক চায়ের ব্যবস্থা করতেই হবে। যেখানে রান্না হচ্ছে, সেখান থেকে দু’গ্লাস চা নিয়ে এলাম। তার সাথে একটু বেসন দেওয়া বেগুন ভাজা। চা তো জীবনে কত খেয়েছি, কিন্তু সেদিনের চা যেন অন্যরকম ছিলো। আমরা দুজনে একসাথে আরও অনেক ধরণের গল্প করলাম। মাঝে আরও এক রাউন্ড চা হয়ে গেলো। আমরা কে কোথায় পড়াশোনা করেছি, হবি কি, গান বা কবিতা কেমন লাগে, কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছি, পাহাড়ে ট্রেকিং করার শখ আছে কিনা, বন্ধু বান্ধব, বাড়ির লোকজন সমন্ধে বিভিন্ন কথা। ইতিমধ্যে সুন্দরী আমাকে ওসীম নামে সম্বোধন শুরু করে দিয়েছে। আমার নামের সঠিক উচ্চারণ করতে পারছে না, ওসীম বলছে। আর আমি ম্যাডাম বলতেই ধমক খেলাম। বোলা না? মেরা নাম মেঘা। মেঘা বলনেমে কুছ প্রব্লেম হ্যায় ক্যায়া?

এইসব আলোচনা আর ছোটখাটো হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়েই দুপুর থেকে বিকাল হয়ে গেলো। অধিকাংশই আমাদের চালু ভাষায় “ভাট” বকা। ইতিমধ্যে আমি একবার ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছিলাম যে কলেজে আমার জ্যোতিষচর্চায় উৎসাহ ছিলো। আর যাই কোথায়? সে নিজের হাতখানা বাড়িয়ে দিলো, ওর হাত গুনে বলতে হবে। আমি যতই ঢপের চপ দি যে আমি এই বিষয়ে সামান্য কিছু বই পড়েছি মাত্র, সেরকম জ্ঞান কিছুই নেই, কিন্তু সে শুনবে না। ওর চাপে ওর ফর্সা নরম হাতটা আমার হাতের মুঠোয় নিতেই হলো। মিনিট কয়েক ওর কোমল হাতটি আমার হাতেই ছিলো। জ্যোতিষচর্চা তখন আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আটভাট কিছু বলে নিস্তার পেলাম। আর ভুল করে বলেছিলাম, আমি খানিকটা রান্না জানি। সে আমাকে ছাড়বেই না। শুনেছে বাঙালী লুচি আলুর দম নাকি স্পেশাল, সেটা শেখাতেই হবে। আচ্ছা, হো যায়েগা বলে সেযাত্রায় ছাড়া পেলাম।

সুন্দরী জানে বাঙালী মেয়েরা উৎসবে পার্বণে মাথার খোঁপায় সাদা ফুলের মালা পড়ে। সে দেখেছে যে সেদিন আমাদের পুজায় সাদা ফুলের মালা এসেছে। আমার কাছে সেরকমই একটা চেয়ে বসলো, “ওসীম, প্লিজ, মেরে লিয়ে এক লে আও না”। আমি তো অনুরোধ শুনে ধন্য হয়ে গেলাম, কিন্তু সাদা ফুলের মালা আমি পাই কোথায়? কিন্তু, এই অনুরোধটাই বা ফেরাই কি করে? যা হবার হবে, মন্ডপে গিয়ে দেখলাম পুজোর থালায় কয়েকটা ছোট্ট সাদা ফুলের মালা পড়ে ছিলো। সম্ভবত স্থানীয় মহিলারা পুজোর জন্য এনেছিলো। তার থেকে বেছে দু’টো এনে দিতেই, Osim, Oh my God, such a beautiful garland, for me? You are so nice, Osim. So nice. আমি তো ধন্য আমি ধন্য হে পাগল তোমার জন্য যে হয়ে গেলাম।

আমরা দু’জনেই ইংরেজি আর হিন্দী মিশিয়ে কথা বলছি। আমার হিন্দী একদমই আসে না, বুঝতে পারি, বলতে পারি না। অথচ সুন্দরী অনর্গল হিন্দী বলে যাচ্ছে। আমার হিন্দী ও যাহোক করে বুঝে নিচ্ছে। বলেছিলাম দুপুরমে খিচুড়ির সাথ বাঁধাকপি কা শুকনো ডালনা হোগা। বেচারা “বাঁধাকপি কা শুকনো ডালনা” কিছুই বুঝলো না। আমি বললাম, আইয়ে মেরে সাথ। যেখানে দুপুরের ভোগের রান্না হচ্ছে, সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখালাম কি রান্না হচ্ছে। আমাদের রান্নার ঠাকুর তো প্রবল উৎসাহ নিয়ে সুন্দরীকে বোঝাতে শুরু করলো। আমি প্রথমে রান্নার ঠাকুরের সিকিমিজ ভাষা বুঝে নিয়ে সেটাই আবার সুন্দরীর জন্য হিন্দী ইংরেজি মিশিয়ে বোঝালাম। সুন্দরী আমার হিন্দী শুনে বলে, ওসীম, তুম যব হিন্দী বলোগে, সাথ মে এক interpreter ভী রাখ দেনা। যদিও সুন্দরী আমাকে “আপনি” থেকে “তুমি”তে নামিয়ে এনেছে, আমি কিন্তু তখনও ‘আপনি” চালিয়ে যাচ্ছি। সুন্দরী হাল্কা চিমটি কেটে আমাকে বলেই দিলো “ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার? হাম দোনো দোস্ত বন গয়ে, আর তুম আপ আপ চালা রহে হো? বোলা না মেরা নাম মেঘা? ভুল গয়ে? আউর তুম বারবার ক্যায়া ম্যাডাম ম্যাডাম বোল রহে হো। Come on Osim, be OK with me.” কথাটা শুনে যতটাই না ভালো লাগলো, মনে মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম, ততটাই অপ্রস্তুত। আর সত্যি বলতে, সেই মধুর চিমটিও ভোলার নয়। বলার জন্যই বললাম কিউ চিমটি কাটতে হো? সে তো চিমটি মানেই বুঝতে পারে না। চিমটি ক্যায়া হ্যায়? উত্তরে আমিও ওঁর হাতে একটা চিমটি কেটে বললাম, ইয়ে হামারা বঙ্গালী কা চিমটি হ্যায়।

বিকেলের চা আমরা দুজনে একসাথেই খেলাম। ডক্টর প্যাটেল ওদিকে তখনও নিজের ইয়ার বন্ধুদের সাথে মশগুল। আমাদের দুজনের কানেই খবর এসে গেছে যে প্যাটেল তাঁর ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে কলচি নামের স্থানীয় মদসেবন করছে। এই কলচি সেখানের লোকাল ব্র্যান্ড, গাঁয়ের লোকেরা ঘরেই বানায়, আর পালাপার্বনে সেবন করে।

চা-পর্ব শেষ হতেই সুন্দরী প্রস্তাব দিলো আমাদের সাইটের পাশেই নদীর দিক থেকে ঘুরে আসি। আমি তো একবাক্যে রাজী। তবে ইচ্ছে না থাকলেও প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। সুন্দরী হেসেই উড়িয়ে দিলো। “ওসীম, তুম ক্যায়া সোচতে হো? ও তুমহারা প্যাটেল আভি দারু ছোড়কে হামারে সাথ নদী কে কিনারে টহল মারে? Come on Osim, leave him with his daru.”

তখন সন্ধ্যা হবে। আঁধার নেমে আসছে। আমরা দুজনে নদীর দিকে পাশাপাশি হেঁটে চলেছি। হিন্দী ইংরেজি মেশানো কথাবার্তা চলছে। ইতিমধ্যে সুন্দরী গায়ের সোয়েটার খুলে ফেলেছে। এখন গায়ে সকালের সেই বেগুনি শাড়ি, আর সজ্জা বলতে চুলে দু’টো সাদা ফুলের মালা জোড়া দিয়ে একটা সুন্দর খোঁপা। সেই মালা যা আমি সকালে জোগাড় করে দিয়েছি। চারিদিকে গাছপালা। সন্ধ্যায় পাখীরা বাসায় ফিরে আসছে। কানে শুধুই কিচির মিচির শব্দ। একসময় সুন্দরী রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলো। সামনের গাছের দিকে আঙ্গুল তুলে একটা পাখীর নাম জিজ্ঞেস করলো। আমার খেয়াল নেই, নিজের অজান্তেই আমি ওঁর কাধে হাত রেখে দিয়েছি। কিন্তু সুন্দরীর কোনো জড়তা নেই। সুন্দরীর প্রশ্ন শুনেছি, কিন্তু আমি তো গাছ ছাড়া কোন পাখীই দেখতে পাচ্ছি না। নাম কি বলবো? কি যে মনে হলো, কিছু না দেখেই বলে দিলাম, সায়দ ইস পঞ্ছিকে নাম মেঘা হোগা। বলে একটু হেসে দিলাম। সুন্দরী শুনলো। আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তরও দিলো, চলো, ইস বাহানামে তুম মেরা মেঘা নাম তো লে লিয়া।

নদীর পাড়ে একটা পাথরের ওপর গিয়ে একদম পাশাপাশি আমরা বসে পড়লাম। তখনো কিছুটা আলো আছে। আকাশের নীল রঙ একটু একটু করে আঁধারে মিলিয়ে আমাদের কাছে নেমে আসছে। চতুর্দিকে পাহাড়ি জঙ্গল। একফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। সামনেই নদীর হাল্কা স্রোতের আওয়াজ। পৃথিবী এখন সারাদিনের ক্লান্তির পরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তাঁর সামগ্রিক নিস্তব্ধতা আমাদের দু’জনকে সেই মূহুর্তে এক অপূর্ব পরিবেশ উপহার দিয়ে চলেছে। সুন্দরীও যে খুশী বুঝতে পারছি। সেই আঁধারের ছুটে গিয়ে সে পাহাড়ি নদীর বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট নুড়ি কুড়োতে লাগলো। আমি ভাবছি আমাদের রুপকথার পরী আকাশ থেকে মাটিতে নেমে নদীর তীরে ছুটে বেড়াচ্ছে, পাথরের নুড়ি নিয়ে খেলা করছে, আবার কিছু কিছু নুড়ি শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখছে। আমি মনে মনে ওর কথাটাই ভাবছি, ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার?

সুন্দরী এখন আবার আমার একদম পাশে। ওর শরীরের মিস্টি পারফিউমের গন্ধটাও আমি অনুভব করতে পারছি। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছি, প্রায় মিনিট পাঁচেক হবে। সুন্দরী একবার আমার দিকে ফিরে বললো, ওসীম, ক্যায়া সাচ উসি পঞ্ছি কা নাম মেঘা হ্যায়? আমি আর কি বলি! সত্যি কথাটা বলতেই হলো। শুনো মেঘা। হামনে তো উস পঞ্ছিকো দেখাই নেহি যো তুমনে দিখানেকা চেষ্টা কিয়া। ম্যায়নে তো স্রিফ তুমহারা নাম সোচকে বোল দিয়া উস পঞ্ছি কা নাম মেঘা হ্যায়। সুন্দরী আবার আমার দিকে কপট ক্রোধে তাকিয়ে আমার হাতে একটা চিমটি কেটে দিলো। আর প্রশ্ন করলো, ইয়ে তুমনে বোলা চেস্টা কিয়া। ইয়ে চেস্টা কেয়া চিজ হ্যায়?
– ইয়ে চেষ্টা মানে, পঞ্ছি দিখানেকা try কিয়া।
– বাপরে, ইয়ে হিন্দী তুম কাহাঁ শিখা? তুমহারা বংগালী চেস্টা হিন্দীমে কৌশিশ হোগা।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, মেঘা। ইস নামকা এক হিন্দী ফিল্ম দেখা। সঞ্জীবকুমার।
– সঞ্জীব নেহি, সঞ্জীভ। ভ ভ। ভ বোলো।

এবার সুন্দরী নিজের ইচ্ছেতেই একটা গান ধরলো। কথা কিছু কিছু বুঝতে পারছি, সুরে আমাদের রবীন্দ্রসংগীতের সাথে কিছুটা মিল আছে। কথাগুলো মোটামুটি এইরকম – হে ঈশ্বর, এত সুন্দর মুহুর্তটি চিরকাল ধরে রাখো, শেষ হতে দিয়ো না। আরও একটা গান করলো। অপূর্ব, অপূর্ব। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুধু শুনছি আর ওর দিকে চেয়ে আছি। বললাম, মেঘা। তুমাহারা গান হামারা টেগোর সং কে সাথ মিলতা হ্যায়। সুন্দরী অবাক হয়ে তাকালো। Really? ওসীম, ম্যায়নে টেগোর সং কভি শুনা নেহি। মেরেকো এক দো টেগোর সং শিখাও না, প্লিজ।
আমি তো থ। আমি গান শেখাবো? “মেঘা, আগর হাম গানা গায়েগা, তো ইয়ে চারিদিককা সব পঞ্ছি কা ঘুম টুট জায়েগা?”
– কেয়া টুট জায়েগা?
– ঘুম, ঘুম টুট জায়েগা। ঘুম মতলব sleeping, at night.
একদম খিলখিল করে ও হেসে উঠলো। তুমনে ক্যা বোলা, ঘুম? আরে ইয়ার বোলো নিঁদ টুট যায়েগা। ওসীম, তুম really so funny. And your Hindi, উফ বাপরে।

রাত প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমরা ওখানে ছিলাম। অর্থাৎ প্রায় দেড় ঘন্টা। আমরা ফেরার রাস্তা ধরলাম। ইচ্ছে হলো ফেরার পথে ওর হাতটা নিজের হাতে নি, কিন্তু সাহস হলো না। প্যান্ডেলে ফিরে দেখি তখনো কিছু লোকজন আছে, তবে অধিকাংশই এবার তাঁদের নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত। দেখলাম প্যাটেল দুপুরে যেখানে ছিলো, বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে ওখানেই একইভাবে জমাটি আড্ডায় বসে আছে। ধীরে ধীরে সবাই প্রায় চলে গেলো। রয়ে গেলাম শুধুমাত্র আমাদের ঘনিষ্ট কয়েকজন বাঙালী, অফিসের কয়েকজন। প্যাটেল আর সুন্দরীও থেকে গেলো। সব মিলিয়ে জনা কুড়ি।

আমাদের অফিসের সবার অনুরোধে. আমি প্যান্ডেলেই রাতের খাবার ব্যবস্থা করলাম। আবার একটু গপ্পো হলো, সঙ্গে চা আর কিছু ভাজা ভুজি নিয়ে। আর এই পরিবেশকে আনন্দ মুখর করার জন্য সিনহা’দা একটা গান ধরলেন। সুন্দরীও একটা গান গাইলো, নিজের গুজরাটি ভাষায়। সবাই মিলে সুন্দর একটা সন্ধ্যা উপভোগ করলাম। রাতের খাবার খেয়ে চলে যাওয়ার সময় সুন্দরী বলে গেলো যে সে এক সপ্তাহের মতো এখানে থাকবে। মনে হলো এটা একটা ইঙ্গিত যে আমাদের আবার দেখা হবে।

বাড়ি ফিরে ঘুম আসতে চায় না। সারাটা দিন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে। সুন্দরী ইঙ্গিত দিয়ে গেছে, আবার দেখা হবে। এবার দেখা হলে কি কথা বলবো তাই নিয়েই ভাবতে থাকলাম। রাত বারোটা বেজে গেছে। তবু ঘুম আসে না। বারান্দায় গিয়ে একবার বসলাম। নদীর পাড়ের গানগুলো মনে পড়তে লাগলো। মনে পড়ছে, ওর হাতখানি আমার হাতে ধরা ছিলো। মনে পড়ছে, ওর হাসি মেশানো অভিযোগ, ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার? আর বলছে, মেরা নাম মেঘা হ্যায়, মেঘা।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেলো। প্যান্ডেলে গেলাম। উদ্যোক্তারা, অধিকাংশই অফিসের, সবাই এসে গেছে। দধিকর্মা আর ভাসানের ব্যাবস্থা করতে হবে। আমার চোখ বিশেষ একজনকে খুঁজছে, কিন্তু সেই নেই। খবর পেলাম, প্যাটেল অফিসের জিপ নিয়ে ছুটে গেছে শিলিগুড়িতে। কারণ ওর বৌ খুব ভোরের বাস ধরে শিলিগুড়ি চলে গেছে আজই কোন ট্রেন ধরে পুনে বা কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য। ওর পাশের কোয়ার্টারের বিহারি ভদ্রলোক ডক্টর ওঝা, যিনি আমাদের পুজোর অন্যতম সক্রিয় উদ্যোক্তা, জানালেন যে কালকে প্যান্ডেল থেকে কোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত দুজনের ঝগড়া শুনেছেন। হয়তো তারই ফল স্বরূপ আজ ভোরে সুন্দরী গৃহত্যাগ করেছেন।

দুপুরের দিকে প্যাটেল একাই ফিরে এলো। অনেক চেষ্টা করেও বৌকে শিলিগুড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে নি। সন্ধ্যাবেলায় আমার কাছে এসে স্বীকার করলো যে গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে মদের নেশায় সুন্দরীকে অনেক আজেবাজে কথা বলেছে। এখন তাঁর শত অনুতাপেও সুন্দরীকে ফেরাতে পারলো না। আমাকে সুন্দরীর ফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ করলো আমি যদি একবার ওঁকে বুঝিয়ে বলি। প্যাটেলের বিশ্বাস যে সুন্দরী আমার কথা শুনবে। বললাম, এখন নয়। দু’দিন পরে অভিমান কমলে তখন বুঝিয়ে বলবো।

আমার নিজেকেও কিছুটা অপরাধী মনে হলো, যদিও আমার মনে কোনরকম কুচিন্তাই ছিলো না। আমি ভেবে দেখলাম, যদি আমার একটা ফোনে দু’জনের জীবনে শান্তি ফিরে আসে, আমি নিশ্চয়ই চেস্টা করবো। আমাদের সাইটে একটা হটলাইন ফোন ছিলো, আমারই তত্ত্বাবধানে। প্রয়োজনে আমরা সাইটের লোকজন হেডঅফিস, ঠিকাদার বা কখনো সখনো বাড়িতেও ফোন করতাম।

প্যাটেলের থেকে নম্বর নিয়ে দু’দিন পরে ফোন করলাম। সুন্দরীই ফোন ধরলো। আমি গলা শুনেই বুঝলাম, সেই ফোন ধরেছে। একদম পরিস্কার বাংলায় বললাম, মেঘা, আমি তোমার বন্ধু ওসীম বলছি।
– আরে, আরে, ওসীম, ক্যায়সে হো?
– নেহি, ঠিক নেহি হ্যায়। তুম হঠাত কিউ চলা গয়া?
– হথাট? ইয়ে হথাট ক্যায়া? আচানক?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, without notice. That’s bad. আর প্যাটেল এতনা দুখী হো গয়া। ইয়ে তুম অচ্ছা নেহি কিয়া মেঘা। তুমকো ফেরত, মতলব return আনা চাহিয়ে।
সুন্দরী একটু চুপ করে রইলো। ওসীম, he was drunk, and we had a bad argument. লেকিন তুমনে আজ ফোন কিয়ে, প্যাটেল কিউ নেহি?
– মেঘা, প্যাটেল মেরেকো রিকুএস্ট কিয়া। that’s why I am talking.
সুন্দরী আবার চুপ। বললাম, ক্যায়া মেঘা, কুছ তো বোলো।
ফোনে বুঝতে পারছি, সুন্দরী কাঁদছে। Osim, I would like to return, please forgive me, and help me to meet him again.
– Don’t cry Megha, let me try.
একটু থেমে বললাম, লেকিন এক কন্ডিশন হ্যায়। অব তুম আকে কম সে কম one month রহোগে।
– সিওর ওসীম, I would. মেরেকো তুমহারা গাঁও বহুত অচ্ছা লগা।

প্যাটেলকে সব বললাম, সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে দিয়ে ফোন করালাম। আমি ফোনের থেকে দূরে চলে গেলাম। ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলুক। প্যাটেল অনেকক্ষণ কথা বলেছিলো। প্রায় আধ ঘন্টা। আমি সামনে ছিলাম না, তাই কি কথা হয়েছে জানি না। ফোনের পর প্যাটেল দেখলাম কাঁদছে। বললো, মেঘা আসতে রাজি হয়েছে, তবে আমাকে পুণে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমি বললাম, আভি মেরা জীপ লো, and rush for Siliguri, then Pune, immediately. Don’t bother for you leave, just rush.

ঠিক ছ’দিনের মাথায় দুজনে ফিরে এলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ওদের বাড়িতে আমার তলব পরলো। তখন অফিস টাইম, তবুও আমি গেলাম। গিয়ে শুধু বললাম, now it’s your own time, your private time. Please don’t invite me or any third person now, প্যাটেল বললো, সাহা (আমাকে এই নামেই ডাকতো), প্লিজ আজ ইভনিং টি প্লাস ডিনার কে লিয়া আ যাও।

সন্ধ্যাবেলা গেলাম। খুব সুন্দর অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম। অনেকদিন পরে আবার সুন্দরীর সেই হাসি দেখলাম। প্যাটেল নিজেই বললো, Saha, I know Megha for last 9 years, from her school days. I don’t know উস রাতমে মেরেকো ক্যায়া হো গয়া, I was just a mad that night.
সুন্দরী জানালো, প্যাটেল প্রমিস কিয়া, জিন্দেগী মে আউর কভি দারু নেহি পিয়েগা।

রাতে খেয়ে বাড়ি ফিরবার সময় একটা সুন্দর উপহার পেলাম। একটা মূর্তি, মাঝখানে একটি মেয়ে, দু’পাশে দুটি ছেলে। ক্যাপশন দেওয়া, ফ্রেন্ডশিপ।

এরপর সুন্দরী সাইটে একমাস ছিলো। নিজের কন্সালটেন্সির কাজ আটকে আছে, তাই আর থাকতে পারলো না। মাঝে মাঝে রবিবার আমি জিপ নিয়ে শিলিগুড়ি যেতাম, টুকটাক কেনাকাটার জন্য, আর সাইটের দিনের পর দিন একঘেয়েমি থেকে দূরে একটু ঘুরে আসাও হয়ে যেতো। প্যাটেল আমাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলো যে মেঘাও যেতে চায়, শপিং করবে। সেইমতন প্যাটেলকে খবর দিলাম। কিন্তু সেদিন প্যাটেল গ্রামের ইন্সপেকশনে যাবে। সে গেলো না। আমরা সাইটের চার-পাঁচজন গেলাম, সুন্দরীও দলে ছিলো। সুন্দরী টুকটাক কেনাকাটা করলো, আমি সারাক্ষণ তাঁর ছায়াসঙ্গী। ইংরেজি আর দুর্বোধ্য হিন্দী মিশিয়ে কথাবার্তা চলছে। একসময় বললো, সোয়েটার কিনতে হবে। আমিও বললাম, ইধার অচ্ছা ভুটানী সোয়েটার মিলেগা। সোয়েটারের দোকানে গিয়ে ডীপ হলুদ লাল রঙের খুব সুন্দর একটা সোয়েটার কিনলো। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করলো, ইয়ে প্যাটেলকা পসন্দ হোগা? আমি মজা করে বললাম, তুম প্যারসে জিসকো gift করোগে, ওহ ধন্য হো জায়েগা।
– ক্যা হো জায়েগা?
– ধন্য হো জায়েগা। মানে difficult to explain মেঘা, মতলব বহুত খুশ হোগা।
আরও কিছু কেনাকাটা করে, আমরা সবাই জীপে করে সাইটে ফিরে এলাম। জিপ থেকে যেই নেমেছি, সুন্দরী আমাকে সোয়েটারের প্যাকটটা দিয়ে বললো, ইয়ে তুমহারে লিয়ে। আমি তো অবাক! কিছুতেই রাজি নই। সুন্দরী বললো, ওসীম, listen. প্যাটেল খুদ নে বোলা তুমহারে লিয়ে এক সোয়েটার খরিদ নে কে লিয়ে। So, it’s our joint gift, আউর তুমকো লেনে হি পড়েগা।

মেঘা (এতক্ষন সুন্দরী বলেছি) যেদিন চলে গেলো, আমারও চোখে জল প্রায় এসে গিয়েছিলো। সাইটের ঐ ক’দিনে সে আমার জীবনে এক তুফান তুলে গিয়েছিলো। আমার ক্ষুদ্র জীবনে এটি একটা অকল্পনীয় ঘটনা। সেই দিনগুলি আজও ভুলতে পারছি না। ওসীম, তুম ক্যায়া ইয়ার? মেরা নাম মেঘা হ্যায়, মেঘা। সেদিনের সেই গান, সেই চিমটি, সেই কথাগুলো আজও মনে বাজে।

Sahityika Admin

Add comment