দুটি গল্প – উত্তম মধুজা, অনেকদিনের পরে ও সুরভিত সুরভি
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
কলকাতা থেকে দেড় দিনের ট্রেন জার্নি করে উত্তম ও তাঁর বৌ শ্যামা দিনকয়েকের জন্য হরিদ্বার, ঋষিকেশ বেড়াতে এসেছে। সেই সুত্রেই আজ সকালবেলায় উত্তম হরিদ্বারের হর কি পউরিতে গঙ্গাস্নান করে পূণ্যর্জন করবে।
উত্তম ছোটবেলা থেকেই ভালো সাঁতারু। পাড়ায় হেদুয়ার জলে সেই পাঁচ না ছ’বছর বয়সে সাঁতারের হাতে খড়ি। তারপর সাঁতারের সাথে প্রেম। হেদুয়ার ক্লাবে সাঁতারের অনেক প্রাইজ পেয়েছে, ওয়াটারপোলো শিখেছে। কলেজেও সাঁতারের রেকর্ড ছিলো। কিন্তু তীব্র স্রোতের নদীতে অভিজ্ঞতা নেই। এখন তাঁর বয়স ৪১, আজ হরিদ্বারে তাঁর এই প্রথম হিমালয়ান গঙ্গায় সাঁতারের অভিজ্ঞতা হবে।
এখানের জল পরিস্কার টলটলে, আর গঙ্গাও বেশ স্রোতস্বিনী। ঘাটে প্রচুর মোটা মোটা চেন লাগানো আছে, আর সাথে নোটিশও টাঙ্গানো আছে, স্নানার্থীরা যেন অবশ্যই সেই চেন ধরেই জলে নামে। আরও বলা আছে, পাড় থেকে জলের মধ্যে মাত্র কয়েক ফুটের বেশি যেন কেউ না যায়। অভিজ্ঞ সাতারুদের জন্যও সেই একই নোটিশ, বেপরোয়া যেন না হয়। কারণ একটু অসাবধান হলেই স্রোত টেনে নিয়ে চলে যাবে। প্রায় হিমশীতল জল। স্নান করে শরীরের সমস্ত ক্লেশ যেন কোথায় উধাও হয়ে যায়।
সবই ঠিক চলছে, এমন সময় চিৎকার, একদম কাছে থেকেই। মুখ ফিরিয়ে উত্তম দেখে স্রোতের প্রবল টানে একজন উপর থেকে তাঁরই দিকে ভেসে আসছে। মুহুর্ত মধ্যেই সে উত্তমের কাছে এসে পৌছাবে। উত্তম অতীতে অনেককে সাঁতার শিখিয়েছে। সে জানে কালক্ষেপ না করে কিভাবে ডুবন্ত কাউকে উদ্ধার করতে হয়। এক লহমায় উত্তম নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। একহাতে চেন, আর অন্য হাতে সেই ডুবন্ত মানুষটিকে সজোরে জাপটে ধরলো। উত্তমর বজ্রআঁটুনির বাঁধন থেকে গঙ্গার প্রবল স্রোত মানুষটিকে কেড়ে নিতে পারলো না।
উত্তম মানুষটিকে ধরে পাড়ে নিয়ে এলো। দেখা গেলো একজন আন্দাজ বছর পয়ত্রিশের মহিলা। সম্পূর্ন জ্ঞান আছে, খুব ঘন ঘন শ্বাস পরছে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। উত্তম জানে তাঁর পরবর্তী কর্তব্য কি কি। চারপাশের জনতার ভীড় বকাঝকা করে সরিয়ে দিয়ে ওঁনার বুকে খানিকটা মাসাজ করে দিতেই উনার স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস ফিরে এলো। খানিক সময়ের মধ্যেই ভদ্রমহিলা উঠেও বসলেন। সেই মুহুর্তে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ওনার স্বামী করজোড়ে উত্তমর হাত ধরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে বললেন, “আপ কি সাহায্য হাম কোনদিন ভুল নেহি পায়েগা”। ঐ হিন্দী শুনেই উত্তম বললো, “আপনি কি বাঙালী?”
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি বাঙালী। আপনিও? আরে, আমার নাম কালীপদ রায়। আপনার এই সেবা দাদা, আমরা কোনদিন ভুলতে পারবো না। আজ সন্ধ্যায় দয়া করে, প্লিজ দয়া করে আমাদের হোটেলে একটু আসুন। আমরা, কুশ গঙ্গা হোটেলে আছি। দয়া করে সন্ধাবেলায় আসুন। আপনার ঋন তো আর জীবনেও শোধ করতে পারবো না, শুধু একসাথে বসে একটু চা খাবো।
– কুশ গঙ্গা? আমরাও তো ওখানেই আছি। ঠিক আছে, অবশ্যই দেখা হবে। সন্ধ্যাবেলায়।
কালীপদ রায়, নামটা উত্তমের বেশ পরিচিত। এই কালীপদই কলেজের কালীপদ, মানে সেই কলেজের ষাঁড় নয়তো? যদি তাই হয়, তাহলে পাশ করে উনিশ বছর পর এতদিনে উত্তম আর কালীর, মানে ষাঁড়ের আবার দেখা হলো?
হোটেলে ফিরে রিসেপশনে খোঁজ নিতেই জানা গেলো যে কালীপদ রায়, সঙ্গে স্ত্রী মধুজা রায় এনারা গতকালই পুণে থেকে এসেছেন। এই মধুজা নামটাও এখন উত্তমের কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। এ আবার ছোটবেলার সেই পাশের বাড়ির তুলি নয় তো? এখন তো মনে হচ্ছে তুলির সাথে মুখের চেহারাতেও মিল ছিলো।
উত্তম গতকালই বিকেলে সস্ত্রীক হাঁটতে বেড়িয়ে একজনকে দেখেছে। পরনে কালো শাড়ি, এলোমেলো চুলে হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। অপূর্ব সুন্দরী। তখনই সেই মহিলাকে খুব চেনা চেনা লাগছিলো। তবে চিনতে পারে নি। সেই কি তুলি? যাই হোক, আজ সন্ধ্যেবেলাতেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
সন্ধাবেলায় উত্তম সস্ত্রীক কালীপদর ঘরে যেতেই, যা ভয় করেছিলো, ঠিক সেটাই হলো। এই সেই মধুজা, মানে তুলি। তুলিই সাদরে দুজনকে আমন্ত্রণ জানালো “এসো, এসো”। সুন্দর অভ্যর্থনা, কোনো ত্রুটি নেই। মধুজা পরেছে একটা হাল্কা হলদে রঙের টি-শার্ট, আর ম্যাচিং সাদা জিনসের ট্রাউজার। মুখে মেকাপ নেই। এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও অসাধারণ ফিগার ধরে রেখেছে। চেহারাতে এবং পোষাকে প্রবল ব্যাক্তিত্ত্বের পরিচয়। শ্যামা প্রথম দেখাতেই মনে মনে স্বীকার করে নিলো, মেকআপ ছাড়াই এই সৌন্দর্য্য সত্যি খুবই কম দেখা যায়।
“যোগীদা, আমাকে তাহলে তুমি চিনতে পারো নি, তাই না?”
উত্তমের মনে কিছুটা হলেও সন্দেহ ছিলো যে এই মহিলা সেই ছোটবেলার তুলি হলেও হতে পারে। তবে সেই মুহুর্তে মুখে “আমি আগে থেকেই বুঝেছি” টাইপের স্মার্ট একখানা হাসি দিয়ে উত্তম বললো, “না, ঠিক তা নয়। এক্কেবারে সিওর না হলেও হোটেলের রেজিস্টারে মধুজা নামটা দেখে একবার কিন্তু চেনা চেনা মনে হয়েছিলো।“
– যোগীদা, তুমি তাহলে এখন এক্কেবারে ডাম্ব হয়ে গেছো। বাট ফর মী, শুরুতেই মনে হয়েছিলো, ইউ মাস্ট বী যোগীদা, যখন তুমি জল থেকে আমাকে তুলে আনলে।
– কি রকম?
– যোগীদা, জলে তুমি আমাকে যখন চেপে ধরলে, আই হ্যাড মাই অল সেন্সেস। তুমি জলের নীচে যেভাবে আমাকে চেপে জাপটে জড়িয়ে ধরেছিলে, সামহাও আই ফেল্ট দ্যাট ইউ আর দ্যা সেম সেই ছোটবেলার যোগীদা।
এবার ঘরে যাকে বলে পিনড্রপ সাইলেন্স। উত্তম, স্ত্রী শ্যামা, আর কালীপদ, সেই মুহূর্তে কারোর মুখেই আর কোন কথা নেই। তবে মধুজা খুব স্মার্ট, চিরটাকাল, সেই অল্প বয়স থেকেই। সহজভাবেই কথা বলে। খুব স্বাভাবিকভাবেই শ্যামার কাছে নিজের পরিচয় দিলো, “বৌদি, আমি তুলি। যদিও ভালো নাম মধুজা, আমাকে কিন্তু তুলি নামেই ডাকবে। আমরা যোগীদার পাশের বাড়িতেই থাকতাম।
এবার নিজের বরের দিকে তাকিয়ে বললে, “কি গো, তখন যে বললে, ইউ নো যোগীদা সিন্স ইয়োর কলেজ ডেজ, তোমার নিজের ইয়ারের। আর এখন যেন চিনতেই পারছো না?”
উত্তম কালীর দিকে ফিরে তাকালো। “তাহলে তুই? তোকে দেখে আমার কিন্তু একবার মনে হয়েছিলো।“
মধুজা পাশ থেকে যোগ করে দিলো, “হ্যাঁ, তোমাদের ষাঁড়।“
“ষাঁড়?” শ্যামা অবাক। “ষাঁড় আবার কারোর নাম হয় নাকি?”
– কেন হবে না? এই তো তোমার সামনেই সোফায় বসে আছেন। স্কুলেও তো সবাই এই নামেই ডাকতো।
উত্তম আর কালীপদ, মানে ষাঁড় কলেজের একই ইয়ারের। ডিপার্টমেন্টটা আলাদা ছিলো। উত্তমের ছিলো সিভিল, কালীপদর মেকানিক্যাল। দুজনে কলেজের দুই প্রান্তের আলাদা আলাদা হোস্টেলে থাকতো। হয়তো সেইজন্যই চেনাজানা থাকলেও অতটা মেলামেশা ছিলো না। তবে কালীপদ ছিলো পুরো কলেজের এক খোরাকি বর্ণময় চরিত্র। কেন যে তাঁর নাম ষাঁড় হয়েছিলো সেটা কেউ জানে না। তবে এই নামটি বা বিশেষণটি সে তাঁর বালীগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকেই বহন করে নিয়ে এসেছিলো।
এদিকে শ্যামার মনে ঝড় চলছে। মানে মধুজার সেই কথাটা ‘জলের নীচে আমায় যেভাবে জাপটে ধরেছিলে, সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো’। এটা শোনার পর থেকেই শ্যামার মনে অস্বস্তি। অনেক প্রশ্নই মনে উঁকি দিচ্ছে। প্রশ্নই করে বসলো, “আপনি উত্তমকে অল্প বয়স থেকেই চেনেন?”
– আরে বৌদি, আমাকে আপনি আপনি করে কেন বলছো, আমাকে তুমি বলে বা তুলি নামে ডাকবে।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই তো। তা তুমি আজ সকালে এত বিপদের মাঝেও কি সহজেই তোমার যোগীদাকে চিনে ফেলেছিলে?
– বাঃ, পারবো না? আমাকে তো যোগীদাই সাঁতার শিখিয়েছিলো, জোর করে।
– জোর করে?
– হ্যাঁ, একদম জোর করেই। মা আমাকে ঠেলে সাঁতারে পাঠিয়ে দিতো, আর মার কথায় যোগীদা রোজ রোজ বাড়ি থেকে আমায় টেনে নিয়ে যেতো। আমি কিছুতেই সাঁতার শিখবো না, আর যোগীদা শেখাবেই। বাট, নাউ আই এডমিট বৌদি, ইট ওয়াজ সো ওয়ান্ডারফুল এন্ড ইন্টারেস্টিং দোজ দেজ, মাই গড।
শ্যামা আরও গভীরে জানতে চায় যে সেই দিনগুলো তুলির জন্য কিরকম ইন্টারেস্টিং ছিলো।
– সত্যি? এই তুলি, আমাকে আরও একটু বলো না প্লিজ।
– বৌদি, ইন্টারেস্টিং মানে, আই মীন আল্টিমেটলি আমি সুইমিং শিখেছিলাম। তাই না যোগীদা?
যোগীদা শুধু শুনেই যাচ্ছে। আর বলবেই বা কি? মধুজার কথা শোনার পর থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে। বুঝতেই পারছে না আলোচনার গতি এর পরে কোন দিকে যাবে। বা কোথায় গিয়ে থামবে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো, “আরে ছাড় না ও কথা। এখন তোরা কোথায় আছিস?”
কিন্তু শ্যামার তো ইন্টারেস্টিং লেগেছে, সে তো ছাড়বে না। পুরনো প্রসঙ্গেই ফিরে এলো, “আরে? ছাড়বে কেন? তুমি বলো তো তুলি, আমি শুনবো। তোমার যোগীদা’র কথা শুনো না। তুমি বলে যাও, আমি শুনছি।“
– হ্যাঁ বৌদি। যা বলছিলাম। মা আমাকে জোর করে সাঁতারে পাঠিয়ে দিতো, আর আমি তো সাঁতারে ভয় পাই। তাই ভয়ে যোগীদাকে জাপটে ধরে রাখতাম।
– জাপটে কেন ধরবে? তোমাদের লাইফ বেল্ট ছিলো না?
– ছিলো তো। বাট আই ওয়াজ মোর কমফর্টেবল ইন যোগীদাজ হ্যান্ডস। অনেক সময় লেগেছিলো, আমার সাঁতার শিখতে। ট্যু লং আ পিরিওড, প্রায় ট্যু এন্ড হাফ ইয়ার হবে।
– মানে আড়াই বছর ধরে তোমার যোগীদা তোমাকে সাঁতার শিখিয়েছে? আর সেইসময় জলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে যোগীদা তোমায় জাপটে ধরে রাখতো?
– আরে জাপটে কেন বলছো? দ্যাট ওয়াজ মাই লার্নিং। আমি ভয় পেতাম, তাই যোগীদা জলের তলায় আমাকে ধরে রাখতো। জোরে দুহাত চেপে।
– জলের তলায়?
– হ্যাঁ, জলের তলায়। বৌদি, সে তো লং হিস্ট্রি, নোবডি উড ফরগেট। দ্যাটস হোয়াই আজ সকালে যখন যোগীদা আমাকে জলের নীচে গ্রিপ করলো, আই ওয়াজ ড্যাম সিওর ইট মাস্ট বী মাই যোগীদা।
– সত্যি ইন্টারেস্টিং তুলি। আড়াই বছর লাগলো তোমার সাঁতার শিখতে? তখন তোমার বয়সও নিশ্চয়ই কম। কত আর হবে?
– মী? আমি বোধহয় তখন স্ট্যান্ডার্ড এইট বা নাইনে, আই মীন আই শ্যুড বী ফোরটিন অর ফিফটিন দেন। কারণ মনে আছে, যোগীদা তার পরেই হি ওয়েন্ট ফর ইঞ্জিনীয়ারিং।
শ্যামা মনে মনে হিসেব করে নিলো, তুলি তখন চোদ্দ পনেরো, আর উত্তম তখন ষোলো সতেরো।
– তারপর তুমি সাঁতার ছেড়ে দিলে?
– সে তোমার যোগীদা আমায় ছাড়লে তো। এভরি উইকএন্ডে হস্টেল থেকে এসে আমাকে আবার জোর করে সুইমিং এ নিয়ে যেতো। বাট আই মাস্ট সে বৌদি, আই হ্যাভ রিয়ালি এঞ্জয়ড মাই সুইমিং ডেজ। শুধু এঞ্জয় না বৌদি, ইট ওয়াজ সো একসাইটিং, কি বলবো?
– বুঝেছি, মানে খুব শিহরণ জাগানো।
– শিহরণ? হোয়াট ইজ শিহরণ?
শ্যামা নিজের বরকে জিজ্ঞেস করলো, ডার্লিং হোয়াট ইজ শিহরণ?
কালীপদ, মানে ষাঁড় বুঝিয়ে দিলো, “শিহরণ মানে এই ধরো তোমার একসাইটমেন্ট, তার সাথে চুলবুলি, সুড়সুড়ি, সব একসাথে মিলেমিশে গেলে যা হয়।“
– ইজ ইট? তাহলে তো আই মাস্ট এডমিট যে আমার খুবই শিহরণ হতো। দ্যাট ওয়াজ মাই গ্রেট শিহরণ।
দরজার পর্দা সরিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে এলো। মধুজা পরিচয় করিয়ে দিলো, “হেয়ার ইজ আমাদের ছোট্ট ষাঁড়। পাঁচ বছর চলছে।”
ছোট্ট ষাঁড়? উত্তম আর শ্যামা একে অন্যকে দেখছে। কালীর বউটা খুব স্মার্ট। “আরে যোগীদা, অত কি ভাবছো? ও আমাদের ছোট ছেলে।”
– তা বলে ছোট ষাঁড় কেন? একটা ভালো নাম তো আছে?
– হ্যাঁ, সে তো আছেই। হিজ ভালো নেম ইজ বেকেনবাওওার। আমরা ওই জীবনকৃষ্ণ, পাঁচকরি, রতিকান্ত এইসব নাম রাখিনি। নাম রাখলে ঘ্যামা ঘ্যামা নামই রাখবো। হায় বেকেন, কাম হেয়ার। তোমার এই নতুন আঙ্কলকে হ্যালো বলো।
বেকেন স্মার্টলি এগিয়ে এসে উত্তমর সাথে হ্যান্ডশেক করলো।
– বা, স্মার্ট বয়। তোমাদের এক ছেলে?
– না, আরও একটা ষাঁড় আছে। পাশের রুমেই আছে, মনে হয় টিভি দেখছে। ওর নাম অ্যালেকজান্ডার।
– বাঃ, দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার। বাঙালীদের ঘরে এই ধরণের নাম আগে কোনোদিন শুনি নি।
– আলেক নয় যোগীদা, অ্যালেক। অ্যালেক।
নতুন ধরণের নাম। শ্যামার বেশ লেগেছে।
– ছোট ষাঁড়, মেজ ষাঁড়। বেশ ফানি। বড় ষাঁড় কে?
– ওঃ বৌদি, ইউ ডোন্ট নো? একটু আগে বললাম না? এঁদের বাবাও তো ষাঁড়। ওরিজিনাল, ফ্রম স্কুল ডেজ, কলেজ টাইমস। তাই ছেলেরাও ষাঁড়।
উত্তম ফোরন কাটলো, “কিন্তু ওরিজিনাল ষাঁড় তো কলেজে কোনোদিন ফুটবল ক্রিকেট খেলেনি, বা মারদাঙ্গা যুদ্ধ জয় এসব করেনি। ওর ছেলের এইরকম নাম কেন?”
– না না যোগীদা। আমার ছেলে লাইক আদার কিডস ঘাসের উপর বসে তোমাদের ঐ ছবি অঙ্কন প্রতিযোগীতা, নজরুলের কবিতা, কালীপুজায় শব্দদূষণের মিছিল, এসব করবে না। ওকে আমি রেসের মাঠে নিয়ে গেছি, সিম্ফনি মিউজিকে, ক্যাসিনোতে নিয়ে গেছি। আমি এখন থেকেই ওকে দুনিয়াটা দেখাবো। নেক্সট ইয়ারে দুজনকেই পিয়ানো ক্লাসে আর টেনিস ক্লাবে দিয়ে দেবো। নো মোর ফুটবল। বাপ তো কিছুই করলো না।
– কেন? বাপ তো রেসের মাঠে অনেকবার গেছে। কলকাতায় ক্যাসিনো ছিলো না, তবে ক্যাবারেতে প্রচুর গেছে।
– সে তো এই এত বছর পরে চাকরি করতে করতে, তাও অফিস পালিয়ে। আবার ধরাও পরে যায়।
– কে বলেছে? কলেজেই কত রেসের মাঠে গেছে। সাট্টায় নম্বর লাগিয়েছে।
– ওঃ, রিয়ালি? সেটা তো ষাঁড় আমায় আগে বলেনি। বাট ইফ ইউ সে সো, দেন আই এম হ্যাপী। বাট হি নেভার টোল্ড মি।
উত্তম শ্যামা দুজনেই যেমন কনফিউজড, তেমনিই ইমপ্রেসড। উত্তম ভাবছে কলেজের সেই মগাটা কি স্মার্ট একটা বৌ পেয়েছে। শ্যামা ভাবছে তুলি কি স্মার্টলি নিজের হাজব্যান্ডকে কালী কালী বলে ডাকছে! আবার ষাঁড় নামেও ডাকছে। বর কলেজ লাইফে রেস খেলেছে, ক্যাবারে গেছে, সাট্টায় নম্বর লাগিয়েছে এসব জেনে বৌ খুশী হয়েছে। মা হয়ে ছেলেকে এই বয়সেই ক্যাসিনোতে নিয়ে গেছে। শ্যামা পারবে নিজের বরকে উত্তম উত্তম বলে ডাকতে? বা দেবে সাট্টায় নম্বর লাগাতে?
কালীও বেশ অপ্রস্তুত। বৌটা কি সব ভুলভাল বকে যাচ্ছে। ঠিক আছে, ছোটবেলা না হয় সাঁতার কাটতে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে জলের তলায় জাপটা জাপটি করেছিস, সেটা এখন ব্যান্ড বাজিয়ে বলার কি দরকার? মাঝে মাঝেই উত্তমকে ইশারা করছে উঠে আয়, অনেকদিন পর বারান্দায় বসে দু’ তিন পেগ মারা যাবে। কিন্তু শ্যালাটা এতদিন বাদে আমার বউকে পেয়ে যেন ফেভিকল লাগিয়ে জমে গেছে। কালীর ইশারা ধরছেই না। আর মধুজাও যেন নিজের পুরনো যোগীদাকে পেয়ে দুনিয়াটাই ভুলে গেছে। হবে না? উত্তম কি আজকের প্লেয়ার? কলেজ লাইফের থেকেই নামী প্লেয়ার। নাম ছিলো পার্টনার ইন ক্রাইম। বি গার্ডেন থেকে এদিকে টালা পার্ক, আর ওদিকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় ব্যাটার ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিস ছিলো। কেউই ওকে কোনোদিন ধরতে পারলো না, আর আজ তুমি ওকে ধরতে চেষ্টা করছো?
উত্তমেরও তখন এক হতবুদ্ধি অবস্থা। অতীতের তুলিকে এতদিন বাদে পেয়ে মনের মধ্যে শিহরণের ঢেউ উঠছে। একদিকে ক্ষণে ক্ষণে যেমন পুলক জেগে উঠছে, অন্যদিকে টেনশনেও আছে কারণ জানে না তুলির স্মৃতি রোমন্থন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে। আর উত্তমর বৌ শ্যামা সুযোগ খুঁজছে যে ওর বরের অতীতের আরও কিছু অজানা খবর পেট থেকে বার করতে হবে। কালী এদিকে ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে কখন উত্তম ওর বউকে ছেড়ে ওয়াইন খেতে উঠে আসবে।
সুতরাং তিনজন একই সময় তিনরকম আলাদা আলাদা চিন্তাভাবনায় মগ্ন।
কালী এবার বলেই দিলো, “আবে যোগী, স্টকে ভালো ওয়াইন আছে। আয়, ব্যালকনিতে বসে দুজনে একটু সুরা পান করি।“
উত্তমও একটা ব্রেক চাইছিলো “হ্যাঁ, তাই চল।“
হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে দুজনে আলাদা গিয়ে বসলো। এই সেই কথা হচ্ছে। দুজনে এখন কোথায়, কি করে? আর অন্যরা কে কোথায়, এইসব নিয়েই আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে উত্তম প্রশ্ন করে বসলো, “একটা কথা বল। তুই কালীপদ। তোর বাবা কাকারা হরিপদ, গঙ্গাপদ। তোর ঠাকুর্দা কৃষ্ণপদ। আর তোর ছেলেরা বেকেনবাওয়ার, আর আলেকজান্ডার?”
– আবে অ্যালেক বল অ্যালেক। বৌ শুনলে আবার কান ধরে শুধরে দেবে।
– কিন্তু তাই বলে কালীপদর ছেলে বেকেনবাওয়ার, আর আলেকজান্ডার?
– যাই বলো গুরু, আমার তো হেব্বি লাগে। ওঁর স্কুলের ছেলেরা কৃষ্ণধন, গণপতি, রামপ্রসাদ। নামে আমার ছেলেদের সাথে কেউ তো টেক্কা দিতে পারলো না। তবে হ্যাঁ, নামের আইডিয়াগুলো আমার বৌয়ের।
এভাবেই দুই বন্ধু এতদিন বাদে একান্তে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তুলির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে উত্তম আর কালী, দুজনেই অনেক রিল্যাক্সড।
ওদিকে মধুজা থেমে নেই। হয়তো শিহরণের এফেক্ট। “বৌদি, ছোটবেলায় উই নেভার হ্যাড আওয়ার প্লে গ্রাউন্ড। হয় বাড়ির ছাদে কুমিরডাঙ্গা, অথবা বাড়িতে ঘরের মধ্যে ডার্করুম খেলতাম। যোগীদা জানবে।“
– কোথায় যে গেলো ওঁরা? একবার মদের গেলাস হাতে নিলে দুনিয়াই ভুলে যায়।
মধুজা হাঁক দিলো, “ডার্লিং, কি হলো? যোগীদা কি আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছো? না মদ খেতে? ওখানে কি এমন আলাদা করে কথা চলছে? আমাদের সামনে বলা যায় না?”
কালী বললো, “চল যোগী, নইলে ঝাড় আছে।“
দুজনে আবার ভেতরে এসে বসলো। শ্যামার মনে পড়েছে, “হ্যাঁ তুলি, কি বলছিলে যেন? কুমিরডাঙ্গা, ডার্করুম। কুমিরডাঙ্গা আমি জানি। ডার্করুমটা কি?”
আবার সেই অতীতের ইতিহাস? উত্তমর কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। উত্তমের এখন সবই মনে পড়ছে। শ্যামা কোনোদিন ডার্করুম খেলেনি, খেলাটা জানেও না, এখন তুলির কথায় জানতে আগ্রহী। “সেকি বৌদি, তুমি ছোটবেলা ডার্করুম খেলনি? কালী তুমি খেলেছ?”
না, কালীও ডার্করুম খেলেনি। বা খেললেও এখানে ভয়ে স্বীকার করবে না।
– ওঃ মা, তোমরা ডার্করুম খেলোনি? নেভার প্লেড দিস গেম? বৌদি, ডার্করুম মানে দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে কানামাছি কানামাছি খেলা। রুম ইজ ব্লাইন্ড ডার্ক। আর আমরা বাচ্চারা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতাম। একজন কানামাছি হবে, সে অন্ধকারে আমাদের খুঁজে বার করবে আর নামও বলতে হবে। কি যোগীদা, ঠিক বলছি না?
ঠিকই তো বলছো তুলি। কিন্তু উত্তম মনে মনে প্রার্থনা করছে তুলি যেন ডার্করুম খেলার এর বেশি আর ব্যাখ্যা না করে। মধুজা বলেই চলেছে “কি মজা যে ছিলো। অন্যেরা ধরতে পারলেও অন্ধকারে চিনতে পারত না। শুধু যোগীদাই আমাকে ধরলে আই নিউ দ্যাট ওয়াজ যোগীদা।“
– অন্ধকারে কিভাবে চিনবে?
– অন্ধকারে? তখন গায়ে, হাতে, মুখে ছুঁয়ে নাম বলতো।
– গায়ে হাত বুলিয়ে বুঝতে হত?
– হ্যাঁ বৌদি, অন্ধকারে গায়ে হাত বুলিয়ে বুঝতাম কে কোনজন। ভীষণ এক্সাইটিং গেম ছিল। কি যেন বললে একটু আগে। আই মীন শিহরণ।
আজ মধুজার পেট থেকে শ্যামা সমস্ত কথা বার করবেই। “শিহরণ কেন?”
– আরে বৌদি, আমি ছিলাম খুব ভিতু। অন্ধকারকে খুব ভয় পেতাম। আর আমি যোগীদাকে জড়িয়ে ধরে একটা টেবিলের পিছনে লুকিয়ে থাকতাম। যোগীদা, হোয়াই ইউ আর মাম? সে সামথিং। তখন থেকে আমি একাই বলে যাচ্ছি। তোমার মনে পড়ছে না?
উত্তম ভাবছে কিই বা জবাব সে দেবে? একবার বাথরুমে যেতে পারলে খুব ভালো হয়। দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। আধঘন্টার আগে বেরোবে না। অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকা যাবে। আর কালী ভাবছে, আবার নতুন কি কেলোর ইতিহাস পড়া হচ্ছে? উত্তম ভাবছে, কি কুক্ষণে যে সকালে স্নান করতে গিয়েছিলাম? “যোগীদা, ড্যু ইউ রিমেমবার তুমি একদিন মিলির বাড়িতে মিলিকে পিছন থেকে কি ভীষণ জোরে জাপটে ধরেছিলে? মনে পড়ছে?”
– বলো কি? তোমার যোগীদার বলা নেই কওয়া নেই। বিনা কারণে একটা মেয়েকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো?
কালী ভাবলো এই আলোচনায় তারও অংশগ্রহন করা উচিৎ। “আচ্ছা, ডার্লিং। একটা কথা বলো তো। ছোটবেলার এত এত খেলা থাকতে বেছে বেছে যোগী কবে কাকে জলের নীচে, কাকে অন্ধকারে জাপটে ধরে রাখতো, তোমার অভিধানে কি সেটাই শুধু মনে আছে?”
– অভিদান? হোয়াট ইহ অভিদান?
– অভিদান নয়, অভিধান। সে যাই হোক, আমি বলছিলাম তোমার মেমরিতে শুধু কি এইসব শিহরণের কথাগুলোই মনে আসছে?
– আরে না, নট দ্যাট। আমার ছোটবেলার আই হ্যাড অনলি ফিউ ফ্রেন্ডস, মাত্র কয়েকজন। তাই। আর ডার্করুম ছিল আমাদের রোজকার খেলা। তুমি তো জানোই না ডার্করুম কিরকম মজার আই মীন শিহরণের খেলা ছিলো। তোমরা তো খেলোই নি।
কালী নিজের মনে তাঁর ভাগ্যকেই দোষ দিচ্ছে। অত সুন্দর একটা শিহরণ জাগানো খেলায় সে জীবনে কোনোদিন চান্সই পেলো না? যোগীটার কি ভাগ্য রে। ছোটবেলায় ওর বৌয়ের সাথে শিহরণ শিহরণ খেলেছে। আর উত্তম ভাবছে কেন যে ভগবান কালীকে তার বন্ধু করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।
– মানে তুলি, রোজ রোজ উত্তম তোমায় জাপটে ধরতো?
– অত মনে নেই। আর জাপটে ধরলেই বা কি? আমরা সবাই তখন তো জাস্ট চাইল্ড। অল ইনোসেন্ট চাইল্ডস। ভাবতেই আমার গায়ে কি রকম কাঁটা দিয়েছে, দ্যাখো।
সত্যি তো। জাস্ট চাইল্ড। তুলি তখন হয়তো বছর দশেক, আর উত্তম তখন বারো তেরো।
উত্তম এবার ভয় পেয়ে গেলো। তাঁকে দেখে কালীর বউয়ের যে গায়ে কাঁটা দেবে, এটা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারলে আজ সন্ধ্যায় এখানে সে আসতোই না। অতশত তাঁর মনে নেই। আর একদম ছোটবেলায় যদি সে মধুজাকে ডার্করুমে জড়িয়ে ধরেই থাকে, বা জড়াজড়ি করে লুকিয়েই থেকেছে, মধুজার সেগুলো মাইক বাজিয়ে এখন কালীর কাছে, শ্যামার কাছে কি না বললেই নয়? তবে এখন মনে পড়ছে, তাঁদের বাড়ীতে টেলিফোন ছিলো। তুলি মাঝেমাঝেই ফোন করতে আসতো, আর উত্তম ওঁকে বিনা কারণেই খেলাচ্ছলে জড়িয়ে ধরতো। কিন্তু সেটা কি ব্যান্ড বাজিয়ে এতদিন পরে বলতে হবে?
মধুজার অভিমান হয়েছে। “ইউ পিপল আর ডার্টি মাইন্ড। দোজ আর ছোটবেলার ইননোসেন্ট ডেজ, আর তোমরা বাজে ভাবছো? ঠিক আছে, আর বলবো না। কালী, যাও, তুমি আর যোগীদা বারান্দায় গিয়ে ড্রিঙ্কস নাও। আমি বরং বৌদির সাথে অন্য গল্প করি।”
সেই ভালো। দুজনেই মুক্তি পেলো। কালীর মনে তখন অনেক প্রশ্ন। বারান্দায় গিয়ে, “হ্যাঁরে, তুই ছোটবেলায় আমার বউকে এতটাই চিনতি?”
– হ্যাঁ, ওঁরা তো আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকতো। আর ডার্করুম যে খেলতাম সেটাও একটু মনে আছে। আরও দু’একটা মেয়ে ছিল। তবে নাম মনে পড়ছে না।
– আর জাপটা জাপটি করতিস?
– মনে পড়ছে না রে। হতেও পারে। তবে আমরা তো তখন একদম ছোট। একদম শিশু।
– আমার বউটা কি খেপেছে দেখেছিস? বলে কিনা এতদিন বাদে তোকে দেখে ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে?
কালীর কথা শুনে এবার উত্তম ভাবছে কোথায় পালাবে? ওদিকে মধুজা, এদিকে কালী।
এদিকে মধুজার সাথে গল্পের ফাঁকে ফাঁকেই শ্যামা ডার্করুমে ফিরে আসছে। উত্তম যখন ডার্করুম খেলতো তখন তার বয়স কত? উত্তম আর কাকে কাকে জড়িয়ে ধরতো? “না না বৌদি, যা ভাবছো তা নয়। ইনোসেন্ট গেমস। আমিই ভয়ে যোগীদাকে জাপটে ধরতাম। অন্ধকার ঘর, ভয় করবে না? তুমিই বলো?”
খানিক পরে দুই পরিবারের ডিনারের অর্ডার মধুজা নিজেদের রুমে দিয়ে দিতে বললো। খাওয়া শেষে নিজেদের রুমে ফিরে এসে উত্তম আর শ্যামা দুজনেই চুপ। উত্তম একটা ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল ভাব নিয়ে বসে আছে। যদি এই সময় একটা শর্ট ব্রেকের সুযোগ থাকতো, তাহলে উত্তম কাল সকালেই অফিসের ট্যুর ম্যানেজ করে এক সপ্তাহের জন্য কোথাও চলে যেতো। শ্যামা নিজেই বললো, “তোমার ছোটবেলার বন্ধু খুব ভালো। নিষ্পাপ মনের। এতদিন পরে তোমার কেমন লাগলো পুরনো ছোটবেলার বন্ধুকে পেয়ে?”
উত্তম ভাবছে চুপ করে থাকাই ভালো। খুঁচিয়ে দিলেই বৌ উল্টে প্রশ্ন করবে। কিন্তু শ্যামা ছাড়বে না। “তুমি ছোটবেলায় কি কি খেলতে মনে আছে?”
– না। আজকে জানলাম কুমীরডাঙ্গা খেলতাম।
– আর অন্যেরা তোমার সাথে ডার্করুম খেলতো। জাপটা জাপটি খেলতো।
– ডার্লিং, তুমি ভুল বুঝছ। আমার বয়স তখন কত? ছয় সাত হবে।
– ছয় সাত? তুলি যে বললো তুমি কলেজ হস্টেল থেকে এসেও ওঁকে সাঁতারে ডেকে নিয়ে যেতে
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা।
– আচ্ছা। চোর পুলিশ, চু কিত কিত, রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস, এইসব তুমি খেলতে না?
– মনে হয় খেলতাম। কিছু কিছু মনে আছে।
– তবে তোমার ছোটবেলার বন্ধু সত্যিই খুব ভালো। তোমায় দেখে তাঁর গায়ে কাঁটা দেয়, শিহরণ জাগে। তোমার তো ছেলেবেলার খেলাগুলো মনেই নেই। তাই কালকেই সকালে ওকে ধরবে, জেনে নেবে আর কোন কোন খেলা তুমি খেলতে।
উত্তমের ছোটবেলার সেই তুলির অনেক কথাই মনে পড়ে গেলো। পাশের বাড়ির মেয়ে, বছর খানেকের ছোট, আর সেই কলেজ হস্টেলে যাওয়া পর্যন্ত তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। সপ্তাহের শেষে হস্টেল থেকে বাড়ি এসে তুলিকে সাঁতারে ডেকে নিতো। একসাথে হেদুয়ার জলে সাঁতার। তুলি ছিলো এককথায় অপরূপ সুন্দরী, ইংরেজিতে যাকে বলে চার্মিং গার্ল। সেই তুলির প্রতি উত্তমর এক অসাধারণ আকর্ষণ ছিলো, যেন চুম্বকের মতন টেনে নিয়ে যেতো। সে পড়তো ক্যালকাটা গার্লস স্কুলে। খুব সুন্দর ইংরেজি বলতো। সত্যি কথায় ব্যাবহারিক দিক দিয়ে উত্তম আর তুলির কোন মিলই ছিলো না, অথচ এই দুজনে একে অন্যকে ছাড়া থাকতেই পারতো না। সেটা ছিলো তাঁদের শৈশবের আর কৈশরের অবুঝ টান। হয়তো তাই আজ এত বছর বাদে উত্তমর মন হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠছে।
ভ্রমণ সেরে উত্তমরা কলকাতা ফিরে এসেছে। কালী আর মধুজা পুণেতে ফিরে গেছে। উত্তমর সেই পুরনো তুলির কথা বারে বারে মনে পড়ছে।
ক’দিন বাদেই কালীর ফোন এলো। “এই তোর নতুন বাড়ির ঠিকানাটা দে।“
– কেন? হঠাৎ ঠিকানা নিয়ে কি করবি?
– তুলি অনেক আগের কিছু ফটো খুঁজে পেয়েছে। তোদের দুজনের সুইমিং এর। ভাবছে ক্যুরিয়ার করে দেবে।
– আমাদের সুইমিং এর ফটো? পাঠাতে চায়?
– হ্যাঁ।
এবার উত্তম কি করে? ভাবলো অন্য কারোর একটা ভুলভাল ঠিকানা দিয়ে দি।
– তাহলে লেখ। ৯ নম্বর কৃপানাথ লেন।
উত্তম বলেই ভাবলো, খেয়েছে, আমি তো সংযনীর ঠিকানা দিয়ে দিলাম। ও যদি ফটোগুলো পেয়ে শ্যামাকে দিয়ে যায়? না না, যেভাবেই হোক, ম্যানেজ করতে হবে।
ওদিকে কালী জানতে চাইছে।
– কৃপানাথ লেন, মানে শ্যামবাজার? কলকাতা পাঁচ?
– না না না না না না। একদমই না, কলকাতা সতেরো।
– শ্যামবাজার কলকাতা সতেরো? কি ভুলভাল বলছিস? আর এতবার না না করছিস কেন? আমি তো জানতাম কৃপানাথ লেন শ্যামবাজারে। কলকাতা পাঁচ।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, আগে পাঁচ ছিলো। দু’মাস আগে শ্যামবাজার ভাগ হয়ে আমাদেরটা কলকাতা উনিশ হয়ে গেছে।
– কি মুস্কিল? এই বলছিস কলকাতা সতেরো, আবার বলছিস কলকাতা উনিশ?
– না মানে, নতুন পিন কোড এসেছে, তাই গোলমাল হয়ে যায়। পিনকোড উনিশটাই ঠিক।
এর কিছুদিন বাদেই কালী আর মধুজা কলকাতায় এসেছে। কালী নিজেই ফোন করলো “কিবে? ফটোগুলো পেয়েছিস?”
– ফটো? কিসের ফটো?
– আবে, তোদের সুইমিং এর ফটো।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, পেয়েছি পেয়েছি।
– গ্রেট। আজ সন্ধ্যেবেলায় তোরা বাড়ি আছিস?
অজানা আতঙ্কে আবার উত্তম টেনশনে। কালী এলে তাঁর সাথে তুলিও নিশ্চয়ই আসবে। না না পালাতে হবে।
– না, মানে হ্যাঁ, মানে না। না না না, নেই। কেন?
– আরে? অতবার না না করছিস কেন? আমরা কলকাতায় এসেছি। কয়েকদিন থাকবো। আজ তোদের দিকেই যাবো। মাসীর বাড়ি।
– আজ? না রে আজ হবে না। আমার ইয়ে, মানে হাসপাতালে, সিরিয়াস, দেখতে যেতে হবে।
– আজকে হবেনা? কালকে থাকছিস?
– না না, কালকেও হবে না। টালিগঞ্জে পিসির বাড়ি।
– সব ফিক্স করে রেখেছিস? পরশু কি করছিস?
– পরশু? পরশু …… আমরা রাণীগঞ্জ যাচ্ছি, রাণীগঞ্জ। তিনদিন থাকবো, তিনদিন। শ্যামার মামার বাড়ি।
– তাহলে ফিরে এলেই জানাবি, মধুজা বলছিলো একদিন তোদের বাড়ি আমরা আসি। ওর খুব ইচ্ছে তোদের নতুন বাড়িতে আসার।
– না রে, এই কয়েকদিন হবে না। ফিরেই আমরা সেদিনই আবার গোবিন্দগঞ্জ যাবো। গোবিন্দগঞ্জ। গোবিন্দগঞ্জ। দু তিনদিন থাকবো।
– গোবিন্দগঞ্জ? সেটা কোথায়?
– ওটা সেই ওখানে, অনেক দূর। ডায়মন্ডহারবার পেরিয়ে।
– ডায়মন্ডহারবার পেরিয়ে? তাহলে তো সমুদ্র?
– হ্যাঁ, ওই সমুদ্রের পাড়েই, আমার জ্যাঠার বাড়ি। আমিও ঠিক জানি না কোথায়।
– তাহলে?
– এবার দেখা বোধহয় হবে না রে। তারপরই আমি জাম্বুরাগ্রামে অফিস ট্যুরে যাচ্ছি।
– জাম্বুরাগ্রাম? সেটা কোথায়?
– ওটা? ভাইজ্যাক থেকে একশ কিলোমিটার দূরে।
– যা শ্যালা। দেখা হবে না? আমরা প্ল্যান করছিলাম এবার তোদের সাথে আবার দেখা হবে। তোদের বাড়ি যাবো। তাহলে ডিসেম্বরে পুণে চলে আয়।
– ডিসেম্বরে? আরে নারে ওই সময় আমরা সিঙ্গাপুর যাবো, নইলে কাঠমান্ডু, না হলে ব্যাংকক। মানে কোথাও না কোথাও একটা যাবোই। কলকাতায় থাকছি না।
– তাহলে এবছর আর হবে না? তুলি তোর কথা কিন্তু খুব বলছিলো।
উফ। বাপরে।
দেখা হলেই আবার তুলির গায়ে কাঁটা দেবে।
কি কুক্ষণে যে উত্তম ছোটবেলা ডার্করুম খেলেছিলো। বা সেদিন হরিদ্বারের গঙ্গায় স্নান করতে গিয়েছিলো।
আবার হিংসেও হলো, এই মগা ষাঁড়টার সাথে তুলি এক্কেবারেই বেমানান।
একবার মনে হলো, যদি এমন হতো ………………… তাহলে
*******
সুরভিত সুরভি
সংযমী জীবনে অনেকবার অনেক সুন্দরী মেয়েদের সাথে, কেমন যেন গোলেমালে গোলেমালে ওঁদের সান্নিধ্যে এসে পড়তো। যেমন সহজেই পরিচয় হয়ে যেতো, আবার গোলেমালেই চটজলদি কাটও হয়ে যেতো। সত্যি বলতে কি, বেশিরভাগ সময়েই সেই পরিচিতি বা আলাপচারিতা, সেটা ওঁর নিজের ক্যালিতে নয়। কিন্তু হয়ে যেতো।
এরকমই একটা ঘটনা, তখন সংযমী গুজরাটের আনন্দ শহরে, এনডিডিবি তে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হয়ে মাস ছয়েক হলো এসছে। তিনজনে মিলে ভালো পরিবেশে একটা বেশ বড় সাইজের রুম ভাড়া করে আছে। তিনজনে মানে সংযমী সহ আরও একজন বাঙালী তন্ময় দাস, কলকাতার যাদবপুর থেকে পাস করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, অন্যজন দিলীপ পশিনে, গোয়ালিয়রের ছেলে সুরাট থেকে পাস করা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনজনেই ঘোর মাংসাশী, কিন্তু নিরামিষ খেয়েই দিন কাটে। নিজেদের রান্নার ব্যাবস্থা নেই। বাড়ির বাইরেই কয়েকটা স্ট্রিকটলি নিরামিষ খাবার জায়গা আছে। সকালের ব্রেকফাস্ট হয় ওখানে, নয়তো একটু তাড়াতাড়ি প্লান্টে গিয়ে ওঁরা ব্রেড ওমলেট খায়। সেটকুই আমিষ। দুপুরে প্লান্টের ক্যান্টিনে, আর রাতে পাড়ায়। এইভাবেই কস্ট করে দিন কাটে। আর রবিবারে ওঁরা সিভিল লাইনের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে মুরগী খায়।
এনডিডিবি’র মাদার ডেয়ারি প্রজেক্টে ওঁদের শিফটে কাজ, তাই তিনজনের প্লান্টে হাজিরার সময় আলাদা। একদিন সংযমী সকালে প্লান্ট যাচ্ছে, রাস্তা ক্রস করবে। হঠাৎ এক মেয়ে সাইকেলের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে সোজা মারলো ওঁর বাঁ হাটুতে। একটা রাস্তার কুকুর দৌড়ে রাস্তা ক্রস করবার সময় মেয়েটার সাইকেলের সামনে এসে যায়। আর মেয়েটা সেই কুকুরটাকে বাঁচাতে গিয়ে টাল রাখতে না পেরে ব্যালেন্স হারিয়ে সংযমীকে একদম সামনে থেকে ধাক্কা মারে। সংযমী মিনিট খানেক সেন্সলেস হয়ে যায়।
সংযমী রাস্তায় শোয়া, উঠে বসার ক্ষমতাই তখন তাঁর নেই। আর বাঁ পাটা সেই যে ৬০ ডিগ্রি এঙ্গেল বানিয়েছে, আর সোজা করতে পারছে না। রাস্তার জনতা ধরাধরি করে সংযমীকে তুলে রাস্তাতেই বসালো। আর মেয়েটা ইতিমধ্যে, কি করে জানি না, একটা এম্বাসাডার গাড়ি জোগাড় করে রাস্তার লোকজনের সাহায্যে সংযমীকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুললো। সংযমীর কথা বলতে কস্ট হচ্ছিলো, তবুও কস্ট করেই মেয়েটিকে বললো যে মাদার ডেয়ারি প্লান্টে নিয়ে চলো। মেয়েটা বাঁ হাতে ওঁকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো। সংযমী তখন বুঝতেই পারছে না, ওঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর সংযমী দেখলো, সে এক নার্সিং হোমের কেবিনে। ঢুকবার আগেই সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পেরেছিলো যে তাঁকে এক নার্সিং হোমে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযমীকে নিয়ে মেয়েটা গুজরাটি ভাষাতেই নার্সিং হোমের লোকেদের সাথে কথা বলছিলো, কিন্তু কি কথা হচ্ছে সেটা পরিস্কার বোঝার ক্ষমতা তখন সংযমীর নেই। সংযমীর কেন জানিনা মনে হছিলো, এই মেয়েটা ওঁর ভালোই চিকিৎসা করাবে, কোনরকম বেইমানি করবে না। মেয়েটাকে মনে হচ্ছিলো আপনার আপনজন।
এক্সরে’তে দেখা গেলো, সৌভাগ্য যে কোনরকম ক্র্যাক বা ফ্রাকচার হয় নি। তবে ঘন্টা দুই পরেও সে দেখলো যে ওঁর পা সোজা হয় নি। এক্সিডেন্ট হয়েছিলো সকাল সাড়ে নটায়। মাসাজ করে পাটা কোনক্রমে সোজা হলো দুপুর দু’টোর সময়। মেয়েটা সারাক্ষন ঠায় ওঁর পাশে ছিলো। তারপর নার্সিং হোমের কেবিনেই সংযমীকে ধরে ধরে হাঁটালো। পাঁচ মিনিট হাঁটিয়ে আবার পাঁচ মিনিট রেস্ট, এইরকম।
ততক্ষনে সংযমীর সেন্স মোটামুটি চলে এসেছে। সংযমী প্রথমেই মেয়েটাকে থাংকস জানালো। মেয়েটা ছিলো খুবই স্মারট। “আপকো মালুম হ্যায় আপকো কেয়া হুয়া থা?”
– রাস্তা মে তুম মেরেকো সাইকেল সে মারা,
– আরে বাঃ, ম্যায়নে জান বুঝকে আপকো থোড়ি মারা, ওহ কুত্তা মেরে সামনে আ গয়া, আউর উসকো বচানে মে ইয়ে সব বিগার যাকে সব গড়বড় হুই গয়া।
মিনিটখানেক সে চুপ। তারপর আবার
– আপ বোলে মা ডেয়ারি মে নোকরি করে?
– হ্যাঁ, মাদার ডেয়ারি মে।
– ও একই হ্যায়, হামলোগ মা ডেয়ারি বোলে।
– আপকা শুভ নাম?
বললাম, “সংযমী সাহা”
– শাহা? হমারে ইধার শাহ হোতা হ্যায়। আপ বঙ্গালী? মেরেকো পহেলেই অন্দাজ হুয়া।
সংযমী শুধরে দিলো, “লেকিন হাম বঙ্গালী নেহি। বাঙালী।“
মেয়েটা বুঝতে পারলো না, বঙ্গালী আর বাঙালীর কি তফাৎ।
– আর তুমারা নাম?
– সুরভি যোশী।
– স্টুডেন্ট?
– জি হাঁ, কলেজ সেকেন্ড ইয়ার।
খানিক পরে একজন ট্রেতে করে কিছু খাবার প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে ঢুকলো। ওঁর খিদে পেয়েছিলো, কিন্তু মেয়েটাকে বলে আর বিব্রত করতে চায় নি। মেয়েটা এমনিতেই তাঁর যথেষ্ট সেবা করছে, তাই খিদের কথা সে আর জানায় নি। সুরিভি মেয়েটা নিশচয়ই বুঝেছিলো যে সংযমীর খিদে পেতে পারে। খুবই সাধারণ খাওয়া, কিন্তু সেই মুহুর্তে সুরভির প্রতি সংযমীর কৃতজ্ঞতার আর সীমা রইলো না।
সুরভি মেয়েটি খুব সপ্রতিভ, সহজ ভাবেই কথা বলে।
– তুম পড়াই কিয়া ?
মেয়েটা বলে কি? সংযমী একজন ইঞ্জিনিয়ার, আগেই বলেছে মাদার ডেয়ারি প্রজেক্টে কাজ করে।
– আরে, ম্যায় এক ইঞ্জিনিয়ার। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কিয়া।
– আরে বাঃ। তুম ইঞ্জিনিয়ার? লাগতা নেহি। কাহাঁসে পাস কিয়া?
– শিবপুর, বঙ্গাল মে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি।
– শিবপুর? হোগা কই কলেজ। লেকিন ম্যায়নে কভি নামই নেহি শুনা।
অদ্ভুত মেয়ে!
– তুম দুধ কি উপর ইঞ্জিনিয়ারিং করতে হো? … উধার তুমহারা কেয়া কাম হ্যায়?
এঁকে কি উত্তর দেওয়া যায়?
– লাইট কা বাল্ব, আর পাঙ্খা রিপেয়ার কা কাম।
– ওঃ, অব সমঝা। তুম মিস্ত্রি হো। বিজলী কা কাম।
সংযমী আর কথা বাড়ালো না। একটু পরেই সুরভি সেই এম্বাসাডার গাড়িতেই সংযমীকে ওঁর মেসে নিয়ে এলো। গাড়িতেই খোঁজ নিয়ে নিয়েছে, সংযমী কোথায় থাকে, ওঁর সাথে কে কে থাকে, কি ফুড হ্যাবিট, বাড়িওয়ালা কে, কিরকম, ইত্যাদি ইত্যাদি। সংযমী সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলো “সুরভি। এক বাত বোলো। নার্সিং হোম, ট্যাক্সি মিলাকে খরচ কত হুয়া?”
– তিন লাখ রুপিয়া।
– আরে ঠিক করকে বোলো না।
– কিউ বলু? বোলা না, তিন লাখ রুপিয়া।
কয়েকবার জোরাজুরি করেও সংযমী সদুত্তর পেলো না। বুঝলো যে ও বলবে না।
বাড়িতে এসে সেই গাড়ির ড্রাইভার আর সুরভি ধরাধরি করে সংযমীকে নামালো, ওঁর ঘরে নিয়ে এলো।
এবার সে আরেক কান্ড করলো। “থোড়া ইন্তেজার করে, প্লিজ” বলে কোথায় যেন চলে গেলো। আর মিনিট খানেকের মধ্যেই বাড়িওয়ালীকে নিয়ে এলো। বাড়িওয়ালা পরিবার সংযমীদের খুব খেয়াল রাখতো। ঐ ভদ্রমহিলা তো এসেই কি ডেঞ্জারাস? ওঁর কি হয়েছে, কেমন করে হয়েছে, কেমন আছে এমন হাজারো প্রশ্ন করে বসলেন। আর সুরভি আরেক ধাপ এগিয়ে ওঁর বিছানা ঠিক করে দিতে লাগলো। সংযমী বললো, “আরে ছোড়ো ছোড়ো, রহনে দো। হাম ব্যাচেলর কা রুম এইসাই হোতা হ্যায়”
– কিউ? ব্যাচেলর লোক ঠিক সে জিনা নেহি শিখা? মনা হ্যায়?
– হাম হস্টেল মে রহেকে এইসেই রহা, পাঁচ সাল।
– লেকিন ইয়ে ঘর হ্যায়, তুমহারা হস্টেল নেহি।
সংযমী আর কথা বাড়ালো না।
তখন বেলা সাড়ে চারটে বাজে। সুরভি উঠে ঘরের কোনে টেবিলের কাছে গেলো। “আপ চায়ে পিতে হো?”
– হ্যাঁ, দিনমে তিন চারবার পিতা হ্যায়।
– তিন চার বার?
– হ্যাঁ, মর্নিং টি, ব্রেকফাস্ট টি, আউর ডিনার কে বাদ একবার।
– ইয়ে তো তিনবার হুয়া।
– হ্যাঁ, আউর ছুট্টি কা দিন লাঞ্চ কে বাদ, চারবার
সুরভি খুব হাসলো, “আপকো এইস্যা হিন্দি কিসনে শিখায়া?”
এই বলে সংযমীকে আর পাত্তাই দিলো না। নিজেই তিনকাপ চা বানালো, ওঁর জন্য, নিজের জন্য, আর বাড়িওয়ালীর জন্য।
আরও খানিক গল্পগুজব করে সুরভি চলে গেলো। যাওয়ার আগে নিজের বাড়ির ফোন নম্বর দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে গেলো যে, যদি এমার্জেন্সি হয় তাহলে সংযমী যেন বিনা দ্বিধায় ফোন করে। বাড়িওয়ালীও চলে গেলেন। সংযমী ঘরে একা শুয়ে রইলো।
সুরভি চলে যেতেই ঘরটা যেন হঠাতই ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেলো। সংযমী এতক্ষন যেন একট অদ্ভুত আনন্দের মধ্যে ছিলো, খুব সহজভাবে সুরভি এত সুন্দর কথা বলছিলো। হঠাৎই যেন কেমন যবনিকা পতন হয়ে গেলো।
খানিক পরেই ওঁর দুই রুমমেট ফিরে এসেছে। তাঁরা তো অবাক। এত কান্ড হয়ে গেলো কিন্তু সংযমী ওদের কিছুই জানায় নি। সংযমী যতই বলে যে সে নিজেই ঠিক ছিলো না, ঐ সুরভিই সব সামলে দিয়েছে, ততই ওরা খোরাক শুরু করে দিয়েছে। সংযমী নাকি বিরাট ভাগ্যবান। ভাগ্যবানদেরই রাস্তায় এরকম এক্সিডেন্ট হয়।
রাত আটটা নাগাদ আলোচনা হচ্ছে, সংযমী তো বাইরে খেতে যেতে পারবো না, ওঁর খাওয়া ঘরেই আনাতে হবে। এমন সময় দরজায় টোকা। দেখা গেল সুরভি। সঙ্গে মনে হলো মা, বাবা আর সম্ভবত দাদা বা ভাইও এসেছেন। ওঁর আন্দাজ ঠিকই ছিলো। আর দেখলো ওনারা শুধু ওঁর খোঁজই নিতে আসেন নি, সঙ্গে টিফিন ক্যারিয়ারে তিনজনের রাতের খাওয়াও এনেছেন।
যদিও সংযমী মুখে বললো যে এসবের দরকার ছিলো না, সে কিন্তু মনে মনে খুব খুশীই হয়েছে। সুরভির মা একটা দারুণ কথা বললেন, “হামারা ঘর মে যো দানা হ্যায়, উসমে আজ তুমহারা তিনো কা নাম লিখা থা। হামনে কুছ নেহি কিয়া বেটা, উসনে উপরসে সারে কুছ কিয়া।“
তিনটে ছেলেকে না খাইয়ে উনারা যাবেন না। ওনারা অনেকক্ষন ছিলেন, অনেকরকমের গল্প করলেন। একদম স্বাভাবিক ঘরোয়া পরিবেশে। এরই মাঝে সুরভি বললো, “পাপা ইনহোনে কলকাত্তা সে ইঞ্জিনিয়ারিং কিয়া, আভি মা ডেয়ারি মে মিস্ত্রি কা কাম করতে হ্যায়।“
শুনে সুরভির বাবা তো হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি যেন থামতেই চায় না। “আরে সুরভি, কিসনে ইয়ে সব বোলা?”
সুরভি কিছু বলার আগেই সংযমী বললো, “আংকল, আপই প্লিজ সুরভি কো সমঝাইয়ে।“
সংযমীদের তিনজনকে খাইয়ে, তারপর সুরভি নিজেই চা বানালো। কাউকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। “ইয়ে হ্যায় তুমহারা ডিনার কে বাদ টী।“
এরপর ওনারা চলে গেলেন। গুজরাটি বাড়ির দিনের খাওয়া, কিন্তু সংযমীর মনে হলো যেন পূজোর প্রসাদ খেলো। যাওয়ার আগে সংযমীকে বলে গেলেন “আগলে দো তিন দিন দফতর মত যাইয়ো, বেটা, অপনা খেয়াল রাখো, ঘরমে আরাম করো।“
সংযমী রাতে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ওর কথাই ভাবছিলো। কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। সুরভি যেন একদিনেই অনেকটা প্লাবন এনে দিয়েছে। বুঝতে পারছে, এখন সে ওর মনের অনেকটাই জুড়ে আছে।
পরের দিন সকাল আটটায় দুই রুমমেট তন্ময় আর দিলীপ প্ল্যান্ট যাওয়ার সময় পাড়ার দোকানে বলে গেছে, সংযমীর ব্রেকফাস্ট ঘরেই পাঠিয়ে দেবে।
সাড়ে আটটায় সুরভি এলো, একাই। সাইকেল চালিয়েই এসেছে। সাথে বাস্কেট ভরা ফুল, আর বিরাট এক ডাব্বা। ফুলগুলো সংযমীর হাতে তুলে দিয়ে বললো, “চলো, প্লেট নিকালো, কাঁহা হ্যায় তুমহারা ক্রকারিজ?”
– ক্রকারিজ?
ক্রকারিজ কি জিনিষ সংযমী জানেই না। আন্দাজ করলো যে থালা বাসন টাইপের কিছু চাইছে। সুরভি নিজেই খুঁজে নিলো। “আরে, তুমহারা বাকি দোস্ত কাঁহা খো গয়া?”
এবার সংযমী অপ্রস্তুত। সুরভি যে আদৌ ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসবে সেটা তো বলেনি, আর এঁরাও সেরকম কিছুই চিন্তাভাবনা করে নি। তাও আবার তিনজনের জন্য? সুরভি খুব রাগারাগি করলো, বকাঝকা করলো। “তুম লোক কো দিমাক নেহি হ্যায়? তুম একেলা ইধার পড়ে রহোগে? আর হামারা কোই ভি দিমাক নেহি হ্যায়, কি স্রিফ তুমহারে লিয়ে ব্রেকফাস্ট লে আয়েঙ্গে?”
ওর বকাঝকা সংযমীর খুব ভালো লাগছিলো। খানিকটা সাহস নিয়েই বললো, “তুম ব্রেকফাস্ট লেকে আওগে ইয়ে তো আগে নেহি বোলা?”
– জি হ্যাঁ, মেরেকো দীওয়ার মে লিখ দেনা চাহিয়ে থা, কি ম্যয় ব্রেকফাস্ট লেকে আ রহি হু।
কি আর বলে? সংযমী চুপ করেই শুনলো।
– তুমহারে পাস ফ্লাওয়ার ভাস হ্যায়? কি ইয়ে ভি নেহি হ্যায়?
সংযমী আবার অপ্রস্তুত। ব্যাচেলরের মেসে ফ্লাওয়ার ভাস কেন থাকবে? কিন্তু সুরভি থামলো না। “তো অব ইস ফুল ক্যা কেয়া হোগা?” এই বলে ফুলের গোছাটা ঘরের টেবিলের এক কোনে দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলো।
এরপর সংযমীকে ব্রেকফাস্ট, আর চা খাইয়ে সে কলেজ চলে গেলো। এবার আরেক চমক। যাওয়ার আগে সেদিনের দুটো নিউজপেপার, আর দুটো ম্যাগাজিন দিয়ে গেলো। “ইয়ে সব পড়াই করো, হাম বাদ মে আঁকে সওয়াল করেঙ্গে।“
সংযমীর কি যে হচ্ছে? ওঁর দুনিয়াটাই কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। নিউজ পেপার পড়ার অভ্যেসটা তো নেই, কিন্তু আজ কেন নিজেই জানে না, পেপার পড়ার খুব ইচ্ছে হলো।
দুপুরে আরেক কান্ড। সুরভির মা ওঁর খাবার নিয়ে এসেছেন। সংযমীকে সামনে বসিয়ে শুধু সংযমী নয়, নিজেও ওঁর সাথে খেলেন। সংযমীর মনে হলো, এই সুদূর গুজরাটে ওঁর অসুস্থতায় ওঁর মা’ই ওঁর পাশে রয়েছেন।
চারটে নাগাদ সুরভি এলো, একলাই, হাতে সন্দেশের প্যাক। “বঙ্গালী মোশাই, হমারে ইধার এইসাই মিঠাই মিলেগা। চলো খাও।“ এই বলে ওঁর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই চা বানিয়ে দিলো। আগের দিনই জেনে গেছে চায়ের সরঞ্জাম কোথায় থাকে। ওঁর সাথে বসে চা খেলো, অনেক গল্প করলো। মেয়েটা খুব বকবক করতে পারে। মোটামুটি সারাক্ষণ নিজের কথাই বলে গেলো। সংযমী গুজরাটি সন্দেশ আর চা খেতে খেতে সব শুনলো।
হঠাৎ সুরভি বলে, “সমোসা খাওগে? ম্যায় লে আউ?” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেলো, আর খানিক বাদেই হাতে ঠোঙ্গা নিয়ে ফিরে এলো। “ইয়ে লো, সমোসা। মেরে কো মালুম হ্যায়, তুমহে আউর এক কাপ চা মাঙ্গতা।“ আবার সে চা বানিয়ে দিলো। সংযমীর হ্যাঁ, না উত্তরের অপেক্ষাই করলো না।
অফিসের পর দুই রুমমেট ফিরে আসতে প্রথমেই নজরে এলো একগুচ্ছ ফুল। কে দিয়ে গেছে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। “গুরু, সাইকেলের ধাক্কা শুধুই ভাগ্যবানদের জন্য।“
রাতে মা আর মেয়ে আবার এলেন। আগেই বলে গিয়েছিলো তিনজনেরই খাবার আসবে। সংযমী বললো, কালকের জন্য ব্রেকফাস্ট আনার দরকার নেই, কারণ ঐ দুজন আগেই বেরিয়ে যায়, আর সংযমী ওঁরটা নিজেরটা ম্যানেজ করে নেবো। শুনেই সুরভি তেড়ে এলো, “ক্যয়া ম্যানেজ করোগে? ফ্যাকট্রি যাওগে? পহলে দো কদম চলকে তো দিখাও। তব কাল ব্রেকফাস্ট নেহি লায়েঙ্গে।“
সংযমী বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু সুরভি শুনতেই চাইলো না। “শুনো, মিস্ত্রি কা কাম এতনা আসান নেহি, পহলে পুরা ফিট হো যাও, উসকে বাদ, যাঁহা মর্জি ফ্যাক্ট্রি উক্ট্রি দৌড়কে যাও। “
পরের দিনও সকালে সুরভি ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলো, সংযমীকে চা খাইয়ে দিলো, ওঁর বিছানা টানটান করে ঠিক করে দিলো। আর নিউজপেপার তো আছেই।
– কাল স্টাডি কিয়া?
– স্টাডি?
– আরে, নিউজপেপার, কালই ম্যায়নে তো তুমকো দিয়া থা। পড়কে দেখা?
কি যে বলে মেয়েটাকে? ও চলে যেতেই ঘরে আবার এক শুন্যতা নেমে এলো। একলা ঘরে সংযমী বারবার সুরভির কথাই ভাবতে লাগলো।
দুপুরে ওর মা একাই এলেন, রাতে মা মেয়ে একসাথে। সংযমী বললো যে কাল থেকে সংযমী প্লান্টে জয়েন করছি।
– ইসকা মতলব তো ইয়ে নেহি হোগা কি হামলোগ কো ভুল যাওগে।
কি যে বলে সংযমী? নিজেকে খুবই ইমোশনাল মনে হলো। ওর মনে হলো চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসবে।
সেই সপ্তাহের রবিবার। ওঁর দুই রুমমেট সংযমীকে জবরদস্তি সুরভির বাড়ি পাঠাবেই। সংযমী বলছে গেলে তিনজনেই যাবে। একা ওঁর ভয়ানক নার্ভাস লাগবে। কিন্তু অন্য দু’জন শুনলোই না। সংযমীকে একাই জোর করে ঠেলে পাঠালো। তবে সংযমীর যে মনে মনে যাওয়ার খুবই ইচ্ছে ছিলো সেটা বলাই বাহুল্য।
এমনি করেই সুরভির বাড়িতে ওঁর যাতায়াত শুরু হলো। মাসে দুবার অন্তত হয়েই যেতো। আর ওদের পরিবার ছিলো যথেস্ট প্রগ্রেসিভ। তাই হয়তো ওঁর অবাধ যাতায়াতে কোন বাধা ছিলো না। এরপর সুরভিও মাঝে মধ্যে সাইকেল নিয়ে হঠাৎই ওঁদের ঘরে চলে এসেছে।
এমনি করেই সাত মাস কেটে গেলো। সুরভি ততদিনে সংযমীর মনের অনেকটাই জুড়ে বসে আছে। কিন্তু উল্টোদিকের মনোভাব সে বুঝতে পারছে না। সুরভির ব্যাবহার, কথাবার্তা এতটাই স্বতঃফুর্ত ছিলো যে, সংযমীকে যেন সে ধরাই দিচ্ছে না।
সংযমীর ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেলো। সুরভিকে জানালো। সুরভি এর জন্য প্রস্তুত ছিলো না। “ট্রান্সফার?”
– হ্যাঁ, সুরভি।
– চলে যাওগে?
ট্রান্সফার হয়ে সংযমী চলে এসেছিলো।
সুরভির কথা অনেকদিন সে ভুলতে পারিনি। মনে হয়েছিলো কি যেন হারিয়ে ফেলেছে।
আর “চলে যাওগে?” এই প্রশ্নটাও সংযমীকে বারবার বিঁধেছিলো।
পারি না অসীমদা
একেবারে জমিয়ে দিয়েছ।