সাহিত্যিকা

চুপির চড়ে ঘুড়ে এলাম

চুপির চড়ে ঘুড়ে এলাম
প্রসূন রায় মিত্র, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সুহাস বসু, ১৯৭৭ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমরা বি.ই কলেজের ব্যাচের চারবন্ধু মিলে ঘুরে এলাম ‘চুপির চর’।
বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীতে অশ্বখুরাকৃতি এই হ্রদে শীতের মরশুমে জমে ওঠে পরিযায়ী পাখিদের মেলা। দু’দিনের এই ট্যুরে আমরা গিয়ে উঠলাম ‘চুপি কাষ্ঠশালী পাখিরালয় কটেজ’এ।

পরের দিন ভোরবেলা ক্যামেরা, বাইনাকুলার সব গুছিয়ে নিয়ে সোহম, হাসু, হিমু আর আমি উঠে বসলাম জয়ন্তের নৌকায়। নৌকা যতই এগোতে লাগলো চোখের সামনে ছবির মত শুধু পাখিদের আনাগোনা দেখতে থাকলাম। নানা জাতের কিংফিশার বা মাছরাঙা, করমোরেন্ট বা পানকৌড়ি, ফিঙে, ইগ্রেট, হেরণ, গ্রে হেডেড /পারপেল সোয়ামপেন, মূরহেন, জাকানা, স্যান্ডপাইপার, লিটল গ্রিব প্রভৃতি বিদেশি পাখিদের দেখা মিলতে লাগলো। কেউ এসেছে সূদুর সাইবেরিয়া থেকে, কেউবা ইউরোপের কোনো দেশ অথবা হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চল থেকে। আরো এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল ‘লেসার হুইসলিং ডাক’ – প্রায় শতাধিক পাখির একটা বিশাল ঝাঁক। তাদের একটি দল কচুরিপানা সংলগ্ন জলে খেলা করছে আর অন্যেরা কচুরিপানার মধ্যে থেকে পোকা মাকড় খেতে ব্যস্ত। তাদের সাথেই দেখা মিলল ইগ্রেট আর কচুরিপানার মধ্যে গ্রে-হেডেড সোয়ামপেন।

কাছে যেতেই কলরব করতে করতে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে শুরু করল হাঁসগুলো। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আরও এগিয়ে দেখা মিলল শীতের এখানকার অন্যতম আকর্ষণ ‘রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড’। প্রায় ত্রিশ চল্লিশটা অপূর্ব লাল মাথা হাঁসের দল সাঁতার দিচ্ছে চুপির জলে। কাছে যেতেই ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাচ্ছে, আবার কিছুদূর উড়ে জলে নেমে পড়ছে। সে এক অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। মনভরে ছবি তুললাম পাখিদের।

এইভাবে নৌকাবিহার সাথে পাখিদের ছবিতোলা সেরে যখন কটেজে ফিরলাম ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো বাজে। সাত ঘন্টা সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি। সেই দিনটা কটেজে থেকে পরের দিন সকালে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। মনে ইচ্ছে রয়ে গেল আবার যদি কোনদিন সুযোগ পাই ক্যামেরা নিয়ে নিশ্চয়ই ছুটে যাব ‘চুপির চরে’।

৩১ জানুয়ারি, ২০২১

*******

সংযোজন –  সুহাস বসু, ১৯৭৭ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

গত ১২ই জানুয়ারি আমরা ৪ বন্ধু (আমি, সোহম, হিমু আর প্রসূণ) বর্ধমান জেলার কাস্থশালি পাখিরালয় দেখতে বেরিয়ে পড়ি। এই জায়গাটা চূপীর চর বলেই বেশী বিখ্যাত।

১২ তারিখ সকালে সোহম গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে রুবির মোড় থেকে হিমুকে, তেঘরিয়া থেকে আমাকে আর বালি ব্রীজ পেরিয়ে প্রসুনকে তুলে নেয়। তারপর আমরা NH-2 ধরে চলতে শুরু করি। বেশ কিছুক্ষন চলার পর গাড়ি গুড়াপের কাছে হিন্দুস্তান ধাবায় থেমে যায়। সেখানে প্রসূণ পরিবেশিত এগ চিকেন স্যান্ডউইচ আর তার সঙ্গে ধাবার সুস্বাদু চা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আবার চলতে শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে আমরা NH-2 ছেড়ে, তারপর মেমারি হয়ে গুগল আন্টির সাহায্য নিয়ে আমরা চুপির চড়ের পথে এগিয়ে চললাম। শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে দুটো দিন বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে পারবো, এই কথা ভেবে বেশ উত্তেজিত লাগছিল।

প্রায় ৫ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম, তখন দেখি চারিদিক লোকে লোকারণ্য আর অজস্র গাড়ীর ভিড়। স্থানীয় ছেলেদের সাহায্যে গেস্ট হাউস থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে একটা মাঠে গাড়ী পার্ক করা গেল। পার্কিং ফি খুবই কম, মাত্র ৫০ টাকা।

এবার গেস্ট হাউসের কথায় আসি। মোট ৪টে ঘর নিয়ে তৈরী এই কাষ্ঠশালি পাখিরালয় গেস্ট হাউস। প্রত্যেক ঘরেই ২ বা ৩ জন থাকতে পারে। সাইজে একটু ছোট হলেও সবরকম আধুনিক সুবিধাযুক্ত ঘর। প্রসূণ অনেকদিন আগেই দুটো ঘর বুক করে রেখেছিল। দুদিন থাকা খাওয়া সমেত ভাড়া জনপ্রতি ২৯৩০ টাকা। খাবারের মান বেশ ভালো, খাবার জল aquaguard থেকে। ঘরের দরজা খুললেই সামনে বিস্তীর্ণ লন, নানারকম ফুলগাছে সাজানো। লন পেরিয়ে যেদিকেই চোখ যায়, শুধু জল আর জল।

দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা চর দেখতে বেরোলাম। পরদিন নৌকো বিহার করার জন্য আগেভাগেই একজন মাঝিকে বলা ছিল। চরে গিয়ে নৌকোর চেহারা দেখে আমি একটু দমে গেলাম। এতটাই নিঁচু পাটাতন যে পা ঝুলিয়ে বসার কোন সুযোগই নেই। কি করে হাঁটু মুড়ে এতক্ষন বসে থাকবো, সেটা ভেবেই আমার টেনশন হচ্ছিল।

যায় হোক, সব ঘুরে চর থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা চা, তেলেভাজা সহযোগে আড্ডা শুরু হল। সোহম আর হিমুর মতো বলিয়ে বন্ধু থাকায় আড্ডাটা দারুণ জমেও উঠল। এরই ফাঁকে আমাদের সিলেক্টেড মাঝি এসে দেখা করে গেল। প্রায় এক বছর পর সবার সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দে আড্ডা আর হাসিঠাট্টা যেন শেষ হচ্ছিল না। রাত ১০টায় গেস্ট হাউস কর্মীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ডিনার করতে গেলাম। পরদিন সকালে পাখি দেখতে যাবার তাড়া ছিল, তাই ডিনার সেরে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম।

পরদিন অর্থাৎ ১৩ই জানুয়ারি ভোরে ঘুম ভাঙলো পাখিদের কোলাহলে। দরজা খুলেই দেখি, অজস্র শালিক, গাংশালিক পুরো লন জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন, তাই লন পেরিয়ে চরের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। নৌকোবিহারে যাবার তাড়া ছিল, তাই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে সকাল ৭টায় চরে পৌঁছে গেলাম। সেখানে জয়ন্ত মাঝি আমাদের অপেক্ষায় ছিল, আমরা নৌকোয় উঠতেই আমাদের যাত্রা শুরু হল।

কুয়াশায় ভরা সকাল, তাই আমাদের বিখ্যাত দুই ফটোগ্রাফার বন্ধু ( সোহম ও প্রসূণ ) একটু অসুবিধেয় পড়ল। চুপির চরের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার, গভীরতা মেরেকেটে ৪-৫ ফুট। ভীষন স্বচ্ছ জল, তাই জলার তলদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। জলের মধ্যে জায়গায় জায়গায় কচুরিপানা জড়ো করা আছে যার মধ্যে অজস্র পোকামাকড় ভর্তি হয়ে আছে। শীতের শুরুতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে কয়েক লাখ পাখি এই চরে এসে জমা হয় আর মোটামুটি ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এখানে কাটিয়ে আবার নিজেদের দেশে ফিরে যায়। সোহম, প্রসূণ আর জয়ন্ত মাঝির সৌজন্যে বেশ কিছু পাখির নাম জানলাম, যেমন Moorhen, Red crested pochard, Bronze winged jacana, Cottle Egret, Lesser whistling duck, আরও কত কি। অধিকাংশ পাখিই পোকামাকড়ের টানে কচুরিপানায় এসে বসে। মাঝে মাঝেই তারা ডানা ঝাপটিয়ে কচুরিপানায় ভরা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় উড়ে যায়। পাখিদের এই ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাবার অনির্বচনীয় দৃশ্য আমাদের মন ভরিয়ে দিল, সেইসঙ্গে সোহম আর প্রসূণকেও সুযোগ করে দিল এই দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করার। জলার বিভিন্ন জায়গায় জেলেরা তাদের জাল বিছোনোর জন্য ছোট ছোট বাঁশ পুঁতে রেখেছে। সেই বাঁশের ওপর মাছরাঙা পাখিরা বসে থাকে। মাছরাঙা, যার পোষাকি নাম King Fisher, তারও যে এত variety আছে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস হত না।

চরের শেষ প্রান্ত হঠাৎই খুব সরু হয়ে গেছে। সেখানে চরের দুপাশ ঘন জঙ্গলে ভরা, এইজন্য এই জায়গাটাকে গরীবের আমাজন বলেই লোকে চেনে। এরপর চর যেখানে গঙ্গায় এসে মিশেছে, সেখান থেকে আবার ফেরার পথ ধরলাম। ততক্ষণে সূর্যদেব প্রায় মধ্যগগনে, নৌকো থেকেই গঙ্গার ওপারে ইসকন মন্দির দর্শন করলাম। অবশেষে ৭ ঘণ্টা নৌকোবিহার করে বেলা ২টায় আমরা ক্লান্ত, অবসন্ন কিন্তু পরিতৃপ্ত চিত্তে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।

গেস্ট হাউসে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা লাঞ্চ করতে গেলাম ডাইনিং রুমে। ডাইনিং রুমটা ছোট, ৪ জন করে বসার মত দুটো টেবিল আছে। এবারে খাবারের কথা বলি, দুপুরের মেনু ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড় ও মিষ্টি। বিকেলে চায়ের সঙ্গে একদিন সিঙ্গারা, একদিন তেলেভাজা। রাতে ভাত/রুটি, ডাল, তরকারি, মুরগির মাংসের ঝোল ও মিষ্টি। রান্নার মানও যথেষ্ট ভালো।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা চুপি থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে নতুন গ্রাম বলে একটা জায়গায় গেলাম। গ্রাম থেকে একটু দূরে গাড়ী পার্ক করে সর্ষে ক্ষেত পেরিয়ে আমরা নতুন গ্রামে পৌঁছলাম। এই গ্রামে ঘরে ঘরে কাঠের পুতুল তৈরী করা হয়। বিভিন্ন ধরনের পুতুল যেমন প্যাঁচা, গণেশ, দুর্গা ঠাকুর, রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি তৈরী হয়। কলকাতার বিভিন্ন মেলায় এখানকার অধিবাসীরা এই পুতুল বিক্রী করে, আমাদের অনেকের ড্রয়িংরুমেই এই পুতুল শোভা পেয়ে থাকে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লকডাউনের জেরে ওদের আয় প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমত কিছু পুতুল কিনে ওদের পাশে থাকার চেষ্টা করলাম। গ্রাম থেকে ফেরার পথে সর্ষেক্ষেতের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সর্ষে ক্ষেত দেখলেই আমাদের অসীমের কথা মনে পড়ে, ওদের যুগলের ছবি সবসময় আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। সে কথা মনে রেখে আমরাও সর্ষেক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর আবার গেস্টহাউসে ফিরে এলাম।

সন্ধ্যবেলা আবার চা, তেলেভাজা সহযোগে আড্ডা শুরু হল। সোহম আর হিমুর মতো বলিয়ে কইয়ে বন্ধুরা থাকায় আড্ডাটা জমে উঠতে বেশী সময়ও লাগল না। সারাদিনের অভিজ্ঞতা ও নানা রকমের গল্পে আমরা মশগুল হয়ে রইলাম। ঘণ্টা চারেক আড্ডা দেবার পর গেস্টহাউসের কর্মীর ডাকে ডিনার করতে গেলাম। ডিনার সেরে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে আবার ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

পরদিন সকালে ফেরার তাড়া ছিল, তাই সাড়ে আটটার মধ্যে আমরা স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিলাম। পৌষ সংক্রান্তি থাকায় গেস্টহাউসের মহিলা কর্মীদের আসতে দেরী হল, তাই আমাদের জলখাবার তৈরী হতে একটু বেশী সময় লাগল। লুচি, আলুর তরকারি আর মিষ্টি দিয়ে প্রাতরাশ সারলাম।

অবশেষে গেস্ট হাউস কর্মীদের কিছু টিপস্ দিয়ে আমরা কলকাতার পথ ধরলাম। পথে গাড়ীর টায়ার বদলানোর জন্য মিনিট ২০ থামতে হল। তারপর গুড়াপে হিন্দুস্তান ধাবায় চা খাওয়ার জন্য একটু থামা, চায়ের সঙ্গেই অবশিষ্ট খাবার শেষ করাও হল। এরপর প্রসূণকে বালি ব্রীজের কাছে নামিয়ে বেলা দুটো নাগাদ তেঘরিয়া পৌঁছে গেলাম।

আজ থেকে কত আগে আমাদের সফর হয়েছে, কিন্তু এই সফরের প্রতিটি মুহূর্ত আমার মনের মনিকোঠায় রয়ে গেছে। এজন্য আমি আমার তিন বন্ধুর (সোহম, হিমু, প্রসূণ) কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব আমাকে ওদের সফরসঙ্গী করার জন্য। আমার ৩৫ বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম আমি শুধু বন্ধুদের সঙ্গে কোন সফর করি নি। সেদিক থেকেও চুপির চর ভ্রমণ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

২৮ জানুয়ারি, ২০২১

Sahityika Admin

1 comment

  • সূচীপত্র April 2024 (সাহিত্যিকা ৩৪ সংখ্যা) – সাহিত্যিকা says:

    […] ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং চুপির চড়ে ঘুড়ে এলাম প্রসূন জ্যোতি রায় মিত্র, ১৯৭৭ সিভিল […]