কয়েকটি নানানরকমের লেখা
সোহম দাশগুপ্ত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
* বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে কয়েকটা কথা
* এলেবেলে বেলার গল্প
* জন্মদিনের ভাবনা
* ছাদবাগানের গল্প
* ঘুষখোরের সততা
বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে কয়েকটা কথা
নবজাগরণের সূচনা কখনোই হঠাৎ করে হয়না। এর পেছনে এমন একটা মৌলিক ভাবনা থাকে যার দর্শন সমাজের অন্তরকে স্পর্শ করে। তারপর কালে কালে সেই দর্শন থেকেই জন্ম নেয় সমাজকল্যাণের নানা রকমের আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের পরিবেশে থেকে জন্ম নেন একাধিক মনীষী যারা শিশুকাল থেকেই সেই মৌলিক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে সংস্কারের নানা পন্থা খুঁজে বের করেন। এরা সবাই যে সমকালীন হবেন সেটা জরুরী নয় বরং বিভিন্ন ধাপে ধাপে মনীষীদের সমাজ বোধের বিকাশের এ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমার মতে বাংলার রেনেসাঁর পুরোধা ছিলেন রাজা রামমোহন (১৭৭২), লালন ফকির (১৭৭২), রানিরাসমনি (১৭৯৩), দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪)। এদের সবারই জন্ম অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে। এনাদের পরেই নিঃসন্দেহে ডিরোজিওর (১৮০৯) নাম করতে হয়। পরবর্তী কালে সমাজ সংস্কারের আন্দোলনে যে তরুণ সমাজ বিদ্যাসাগরের অনুগামী হন, তাদের অধিকাংশই হেনরী লুই ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনে অনুপ্রাণিত। ডিরোজিওর পরই জন্ম নেন বিদ্যাসাগর (১৮২০) এবং মাইকেল মধুসূদন (১৮২৪)। ভাবতে অবাক লাগে বিদ্যাসাগর যখন বর্ণপরিচয় রচনার মাধ্যমে সমাজে বাংলা শিক্ষার বীজ বপন করছেন, তখন ডিরোজিওর অনুগামী মধুসূদন সনেট রচনা করছেন! এবার ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের (১৮৩৩) নাম নিতেই হয়। তিনি বাঙালীকে বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করতে
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সাইন্স এর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩৬ সালে আবির্ভাব হলো বাঙালীর ধর্মীয় ভাবনায় অভিনব মুক্তচিন্তার প্রবর্তক শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের। এরপর এলেন দুই সম্রাট, সাহিত্য জগতে এলেন বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮) আর নাট্য জগতে গিরিশচন্দ্র (১৮৪৪)। ১৮৫৮ সালে ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের পতাকা বহন করতে এলেন জগদীশ চন্দ্র বোস। ১৮৬১ সেই রামমোহন থেকে শুরু করে জগদীশ চন্দ্র পর্যন্ত অজস্র তারকা খচিত আকাশে ঘটলো রবির আগমন। আর সে বছরই জন্মেছিলেন বাংলার আরও দুই কৃতি সন্তান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। বিজ্ঞান চর্চার সাথে সাথে বেঙ্গল কেমিকালের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালীকে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য প্রফুল্লচন্দ্রর অবদান অপরিমেয়। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী মেয়ে হিসেবে কাদম্বিনী দেবীর জীবন সংগ্রাম আমরা সবাই জানি। অবশেষে ১৮৬৩তে এলেন বাংলার তরুণ প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক স্বামী বিবেকানন্দ।
হয়তো অক্ষয় কুমার দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন বহু নাম বাদ গেলো তবু পঞ্চদশ শতাব্দীর একজনের নাম না করলে আমাদের রেনেসাঁর আদর্শর একটা মৌলিক উৎস ও বিভে্দহীন মানবতার এক যুগান্তকারী দর্শনের প্রবর্তককে উপেক্ষা করা হবে। তিনি হলেন শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। আমরা বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে কাদম্বিনীর কঠিন লড়াইয়ের কথা জানি। কিন্তু তারও দু’শো বছর আগে, আরও প্রতিকুল অবস্থায় এক অবিশ্বাস্য সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব। ধর্ম, বর্ণ, জাত সমস্ত সামাজিক নির্বিশেষে মানুষকে বুকে নিয়ে সমান মর্যাদা দেবার ভাবনা ও প্রচারের তিনিই ছিলেন প্রথম অকুতোভয় যোদ্ধা। আমার ধারণা অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নব জাগরণের রূপকারদের প্রত্যেকের ভাবনাতেই চৈতন্যদেবের দর্শনের প্রভাব পড়েছিলো।
স্কুলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে আমাদের সবাইকেই সামান্য পড়তে হয়েছিলো। সেই বয়েসে চর্যাপদ থেকে শুরু করে ভাষা, ছন্দ নিয়ে অমন শুষ্কং কাষ্ঠং তথ্য আর ব্যাখ্যা আদৌ মাথায় ঢুকতো না। অনেক পরে বড় হতে হতে, নানা গল্প, কবিতার বই পড়ে একটা নিজস্ব ধারণা তৈরী হয়েছিলো। বঙ্কিমচন্দ্রের সংস্কৃত নির্ভর, বারো-চোদ্দ অক্ষরের দীর্ঘ শব্দবন্ধ ব্যবহারের আমল থেকে রবীন্দ্রোত্তর আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষার পরিবর্তনের ধারা আমরা খেয়াল করেছি। বঙ্কিমের অনেক পরে লেখা হলেও, মাইকেলের ভাষাও বেশ খটমট লাগতো। কিন্তু আশ্চর্যজনক আমাদের অজান্তেই অতীতকাল থেকে এই ধারার ব্যাতিক্রম ঘটে এসেছে। বঙ্কিমচন্দ্রেরই বড় দাদা সঞ্জীবচন্দ্রর লেখায় তার সহজ সাবলীল বাংলা ভাষা পড়লে অবাক হতে হয়! এক পূর্ণিমার রাতে পালামৌ এর সাঁওতাল পল্লীতে ওদের অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিতে গিয়ে সঞ্জীবচন্দ্র লিখেছেন- “যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল; যদি দেহের কোলাহল থাকে, তবে যুবতীদের দেহে সেই কোলাহল পড়িয়া গেল.. দাঁড়াইয়া তালে তালে পা ফেলিতে লাগিল, তাহাদের মাথার ফুলগুলি নাচিতে লাগিল, বুকের ধুক্ধুকি দুলিতে লাগিল।” আমার ছাত্রজীবনে সাঁওতাল পল্লীর জীবনযাত্রার এমন রোমান্টিক বর্ণনা সেই প্রথম পড়ি। অথচ, বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসে সঞ্জীবচন্দ্রের নাম পড়েছি বলে মনে পড়েনা! আজকের এই লেখাটা কিন্তু সঞ্জীবচন্দ্রকে নিয়ে নয়। সম্প্রতি রানি রাসমনি সিরিয়ালে (ঐ একটা সিরিয়ালই দেখি) রামকৃষ্ণদেবকে রামপ্রসাদী শ্যামাসঙ্গীত গাইতে শুনে মাথায় একটা প্রশ্ন জাগলো। ছোটোবেলা থেকে রামপ্রসাদের গান বহুবার শুনেছি। গানের সাবলীল ভাষা, সহজ অথচ চমৎকার উপমা চিরকালই ভালো লাগতো, কিন্তু ওনার জন্মকাল সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলোনা। রামকৃষ্ণদেবের মুখে গানগুলো শুনে কৌতূহল হলো। খোঁজ করে জানলাম, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃততে উল্লেখ আছে যে “তিনি (রামকৃষ্ণ) ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত করতেন কমলাকান্ত ও রামপ্রসাদের লেখা দিব্যজননীর লীলাসঙ্গীত গেয়ে।” এবার গুগল খুঁজে দেখি রামপ্রসাদের জন্ম সুদূর ১৭১৮তে আর কমলাকান্ত জন্মেছিলেন ১৭৬৯ সালে। ভেবে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম যে মাইকেলের থেকে ১০৬ বছর আর বঙ্কিমের থেকে ১২০ বছর আগে কেউ এমন সহজ বাংলায় লিখে গেছেন-
মন রে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।।
অথবা
হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে, মনের আঁধার যাবে ছুটে,
তখন ধরাতলে পড়বো লুটে, তারা বলে হব সারা॥
ত্যজিব সব ভেদাভেদ, ঘুচে যাবে মনের খেদ,
ওরে শত শত সত্য বেদ, তারা আমার নিরাকারা॥
অনেক ভেবেও বোধগম্য হলোনা যে বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসে রামপ্রসাদ সেনের মত প্রতিভাধরের নাম পড়িনি কেন!
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
*****
এলেবেলে বেলার গল্প
আজ অনেকেই শুনলে অবাক হবে, এই অধম সাত বছর বয়েসে প্রথম ইস্কুলে যায়! বছর তিনেক বয়েসে মা আমাকে প্রথম শ্যামবাজারে “আনন্দম” কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। স্মার্ট টিচার, ঝকঝকে ক্লাসরুম, সুন্দর বাগান। নানারকম খেলার সরঞ্জাম। কিন্তু কিছুতেই আমার মন বসতোনা। প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে পাড়া মাথায় তুলে মরাকান্না জুড়ে দিতাম। শেষে মা ও একদিন হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর আমরা শ্যামবাজার ছেড়ে চলে এলাম দমদমে। বছর চারেক মাঠে ঘাটে খেলে আর মায়ের কাছে রামায়ন, মহাভারত, সহজ পাঠ, ক্ষীরের পুতুল, আবোল তাবোল পড়েই মনের আনন্দে দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত, মা ঘোষণা করলেন- “এবার কিন্তু স্কুলে ভর্তি হতে হবে”। সেই চমকের রেশ কাটার আগেই আরেক চমক।
আমার ঠাকুরদা, ঠাকুমা, কাকা-পিসীরা থাকতেন পার্কসার্কাসে। পরদিন দেখি একটা সুটকেস নিয়ে ঠাকুরদা এসে হাজির। মা জানালেন, “শোনো, দাদু এখানেই থাকবেন আর উনিই তোমাকে পড়াবেন” (মায়ের বাবাকে দেখিনি তাই আমি ঠাকুরদাকেই দাদু ডাকতাম)! দাদু রিটায়ার্ড শিক্ষক। আমাকে অপরিসীম স্নেহ করতেন, ভাই বলে ডাকতেন। ভাবলাম ভালই হল, মা বড্ড কড়া, তার থেকে দাদুর কাছে পড়াশোনা করাই ভাল।
প্রথম ক’দিন নো বইপত্র, নো পড়াশোনা! সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা! শিক্ষা শুরু হল সকালে দাঁতমাজার আদর্শ পদ্ধতি থেকে। তারপর যোগ ব্যায়ামের নানা কসরত। সেটা অবশ্য মন্দ ছিলনা। দুপুরে স্বাস্থ্য সম্মত পদ্ধতিতে স্নান। সময়টা ছিল শীতকাল। দাদু জানিয়ে দিলেন গরম জলে স্নান করা অস্বাস্থ্যকর তাই ঠান্ডা জলেই স্নান করতে হবে। গামছা, সাবান, তেলের বাটি সহ দাদু আমাকে উঠোনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। প্রথমে স্নানের আগে সর্বাঙ্গে সুচারু ভাবে তৈল মর্দনের পাঠ। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখে তেল লাগিয়ে পাঠের শুরু। তারপর প্রায় কুস্তির কায়দায় সারা শরীরে ডলাইমলাই। বাড়ির উঠোনে একটা চৌবাচ্চায় টাইম কলের জল জমানো থাকতো। সেখান থেকে দাদু বালতি ভরে জল তুলে দিয়ে বললেন, ভাই এবার গায়ে মাথায় জল ঢালো। খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমি মগ নিয়ে মাথায় জল ঢালতে লাগলাম। স্নান শিক্ষার এখানেই শেষ নয়। এক বালতি জল ঢালা হলে লাল গামছা ভিজিয়ে “গা ডলা”র পর্ব। অতঃপর সর্বাঙ্গে সাবান মেখে গায়ে মাথায় আরও গোটা দুই বালতি জল ঢেলে, তবে স্নানের সমাপ্তি। কোনক্রমে স্নান সেরে চুল আঁচড়ে ভাবলাম, এতো মহা বিপদে পড়া গেল! ইতিমধ্যে দাদুও স্নান করে নিয়েছেন। খেতে বসে ডাল-ভাত মেখে প্রথম গরাসটা মুখে দিতেই দাদু সস্নেহে বললেন, “ভাই, প্রত্যেকটা গরাস অন্ততঃ ষোলোবার চেবাবে”! সেই পদ্ধতিতে ডাল, তরকারী, মাছের ঝোল সহকারে খাওয়া শেষ করতে চোয়ালে ব্যথা ধরে গেলেও দাদুর কথা অমান্য করার উপায় ছিলনা।
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আদৌ সুখকর ছিলনা তবু বইপত্রের উপদ্রব নেই বলে এটাও এক নতুন রকমের খেলা বলে নিজেকে মনে মনে প্রবোধ দিচ্ছিলাম। দিন সাতেকের মাথায় একদিন বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি দাদু ঘরে নেই। মনের আনন্দে বন্ধুদের সাথে খেলতে বেড়িয়ে গেলাম। খেলার শেষ বাড়ি ফিরে দেখি দাদু একটা প্যাকেট নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই বললেন, “ভাই তোমার জন্য কী এনেছি দেখো”! প্যাকেট খুলে দেখি তিনটে বই – প্রথমটা অঙ্কের, দ্বিতীয়টা নেসফিল্ডের গ্রামার, তৃতীয়টা র্যা পিড রিডিং। গ্রামার বইটা দেখেই ঘাবড়ে গেলাম। অমন গম্ভীর চেহারার বই জন্মে দেখিনি! লাল-হলুদ রংএর মলাটের ওপর লেখা নেসফিল্ড গ্রামার। তারপর পৃষ্ঠা উলটে ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে গিজগিজ লেখা দেখে মনটা একেবারে ফিউজ! অবশ্য অঙ্কের বইটা খুলতে বড় বড় হরফে মায়ের শেখানো কিছু চেনা অংক দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম। এবার র্যা পিড রিডিং। তখন বানান করে ইংরেজী পড়ি তবু চেহারা দেখে এক ঝলকে আন্দাজ করলাম ছবির সাথে গপ্পো!
দাদু আদর ভরে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, কোনটা দিয়ে শুরু করি বলো?” আমি নির্দ্বিধায় র্যা পিড রিডিং এর বইটাই বেছে নিয়েছিলাম। দাদু বললেন, আজ তাহলে প্রথম গল্পটা দিয়ে শুরু করি। আমি একবাক্যে ঘাড় নেড়ে, পাতা উলটে প্রথম গল্পটা বের করে দেখি, গল্পের নাম “Spare the rod spoil the child”!
৩০ জানুয়ারি, ২০২১
******
জন্মদিনের ভাবনা
আমাদের বয়েসে জন্মদিন মানেই অতীতের দিকে ফিরে চাওয়া। বয়েসের কারণে না হলেও অজস্র সুখস্মৃতির হাতছানিই আমাদের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আজকের সময়কাল আর সেই সুদূর শৈশবের মাঝখানে যেন এক দুর্লঙ্ঘ প্রান্তর। আমি ও প্রান্তে আর পৌঁছতে পারবোনা কিন্তু ঐ পার থেকে স্মৃতিরা আকাশ ভেঙ্গে অযুত অক্ষৌহিনী বৃষ্টির ফোঁটার মত ছুটে আসছে। বৃষ্টি আসছে।
আজ যখন সমুখে শুধু ধুসর প্রান্তর আর পশ্চিম দিগন্তে ঝঞ্ঝাবাতাস রুদ্ধশ্বাস, একটা সুপ্ত ব্যর্থতা বোধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আপনা থেকেই লজ্জায় মাথা হেঁট করে দেয়! ঠিক তখনই উপলব্ধি করি, যে মানুষরা জীবনে কখনো হতাশার কাছে আত্মসমর্পন করেননি তাদের যন্ত্রণা অনেক অনেক বেশী। ঠিক তখনই অজান্তে বারবার পিছন ফিরে তাকাই। ামার শৈশব, কৈশোর মানে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের বাংলার সেই আলোকিত প্রান্তর, জীবনের প্লাবন, চেতনার উচ্ছাস যে সমস্বরে পিছু ডাকে! এই ভাবনা কি আমার ষাটোর্ধ বয়েসের অনিবার্যতা? নাকি সেই ফেলে আসা বৃষ্টিতে পূণ্যস্নান করে আবার নতুন আশায় বুক বাঁধা? যেহেতু প্রতিটি শোনিতকণায় আমি একজন নিরন্তর আশাবাদী মানুষ তাই দ্বিতীয় ভাবনাটাই যেন রবিঠাকুরের গান হয়ে ফিরে ফিরে আসে- “আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে…”।
১৯৫৯ সালের এলেবেলে বেলার কিছু স্নিগ্ধ স্মৃতি নিয়ে আমার চলার শুরু। তখন আমরা থাকতাম উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে একটা নিরালা দোতালায়। সে বাড়ির তিনটে ঘর- একটা শোবার, একটা রান্নার আর অন্যটা স্নানের। আর তার সাথে ছিল ঘরের লাগোয়া একটা দিলদরিয়া ছাদ। সারাদিন রোদ খেলতো ঘরের দরজা থেকে জানালায় আর ছাদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। ছাদের পাঁচিল ঘিরে ফুল গাছের টব। মা নিজের হাতে ফুল ফোটাতেন- জবা, বেলি, গোলাপ এমনকি রজনীগন্ধাও। তখনো ভাই হয়নি, তাই সারা বাড়িটাই ছিল আমার একচ্ছত্র রাজত্ব আর তার সাথে ছিল আমার পঙ্খীরাজ ঘোড়া- একটা তিন চাকার সাইকেল। রুপোলী রাঙতায় মোড়া একটা কাঠের তলোয়ার কোমরে ঝুলিয়ে আমি পঙ্খীরাজের পিঠে চেপে বীরদর্পে সারা রাজত্ব ঘুরে বেড়াতাম।
সেকালে উত্তর কলকাতার বেশ কিছু বাড়িতে পায়রা পোষার শখ ছিল। কিছু দূরে দূরেই বাড়ির ছাদে বাঁশের তৈরী পায়রার মাচা সদর্পে আকাশ ছুঁইয়ে থাকতো। আমাদের সে শখ না থাকলেও বাবা ভোর বেলা এক মুঠো ডাল নিয়ে ছাদে ছড়াতেই সারা পাড়ার পায়রারা আমাদের ছাদে এসে নামতো। তাদের বকম বকম আওয়াজে সাতসকালেই সারা বড়ি গমগমিয়ে উঠতো। আমি কাছে গেলেই ব্যস্তবাগীশ পায়রার দল আমাকে বকাবকি করতে করতে বাবার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতো। ভাবটা যেন ওরাই বাবার বেশী আপন!
আড়াই জনের সংসার কিন্তু সারাদিনই প্রায় বাড়িতে মানুষের সমাগম। বাবা, পীযুষ দাশগুপ্ত, তখন মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। বাড়ির কাছেই কলেজ, তাই ছাত্ররা দুবেলাই আসতেন। ওরা বাবাকে ডাকতেন “পিজি” নামে। আরেকদল মানুষ আসতেন যারা ডাকতেন “কমরেড” বলে। বুঝতে পারতাম দু’পক্ষই বাবার খুব আপন আর তাদের কাছে বাবাও খুবই প্রিয় মানুষ। একটা নীরব দুপুরে মায়ের কাছে জেনেছিলাম, বাবা পার্টি করেন আর সেটা হলো দেশের কাজ। পার্টির লোকেরা একে অন্যকে “কমরেড” নামে ডাকে। মা’কে জড়িয়ে ধরে বায়নার সুরেই বললাম, “আমিও কমরেড হবো।” মা হেঁসে বললেন, “কিন্তু তার জন্য তো তোমায় অনেক বড় হতে হবে।”
যত বেলা গড়িয়েছে তত একটা বিশ্বাস আমার মনে ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হল আমাদের জন্মস্থান, জন্মকাল আর পরিবেশ। গ্রামেই হোক বা শহরে, বিগত পঞ্চাশ, ষাটের দশকে আমরা যে আকাশ, বাতাস, প্রকৃতি আর মানুষদের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি তা এক পরম সৌভাগ্য! আরও সৌভাগ্য হচ্ছে, যে আদর-অনাদর, সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায়, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি তা আমাদের জীবনের দীর্ঘ যাত্রার সমস্ত রসদ উজাড় করে দিয়েছে। সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাকে প্রচলিত বা অপ্রলিত, দুই অর্থেই যারা ভাগ্যবান আর যারা নয় সেই দু’পক্ষর মানুষকেই সচ্ছন্দে আপন করে নিতে শিখিয়েছে। আজ এই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যখন নতুন প্রজন্মের সমুখে দাঁড়াই তখন একান্তেই নিজের কাছে একটা প্রশ্ন জাগে, এতো কিছু পাওয়ার পর আমরা তাদের কোন স্থান, কাল আর পরিবেশ দিয়ে যাচ্ছি? নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতে করতে অজান্তেই আবার সেই সময়টায় ফিরে যাই যখন সেই বড় হবার পালা।
ছোটোবেলার এই ঘটনাটা আগেও একবার লিখেছিলাম, তবু এই প্রসঙ্গে আরেকবার না লিখলে জন্মদিনের ভাবনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কমরেড হতে গেলে অনেক বড় হতে হবে। তাই বছর চারেক বয়েসে মা আমাকে পাড়ার একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। কলকাতার প্রক্তন মেয়র কমল বসুর স্ত্রী শান্তা বসুর স্কুল, নাম “আনন্দম”। একটা ছোটো বাগান বাড়িতে খুবই পরিপাটি করে সাজানো স্কুল। সুন্দর ক্লাসঘর, লাগোয়া বাগানে দোলনা, নাগরদোলার মত নানা খেলার সরঞ্জাম। অবাক হয়েছিলাম স্মার্ট টিপটপ সাজ পোশাকে, অনর্গল ইংরেজী বলা মিসদের দেখে। একজন মেমসাহেব মিস আবার গাউন পরে আসতেন! আমার আটপৌরে শাড়ি পড়া, বাংলা বলা মায়ের সাথে কী বিস্তর ফারাক! কিন্তু দিন দুয়েকের মধ্যেই সেই চমক কেটে গেল। ব্যবস্থা যতই চমৎকার হোক না কেন, আমার ঐ চেয়ার টেবিলে সোজা হয়ে বসে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে পড়াশোনা করতে কিছুতেই ভাল লাগছিলোনা। এতোদিন বর্ণ পরিচয় থেকে এ-বি-সি-ডি, ছড়া থেকে রাইমস সবই পড়েছি মায়ের কাছে। তাও আবার কখনো রান্না ঘরে, কখনো মায়ের কাজের ফাঁকে, আবার কখনো খেলার ছলে বা দুপুরে বিছানায় শুয়ে। মিসরা যতোই স্মার্ট হোক না কেন আমার মাকেই বেশী পছন্দ ছিল। তাই একদিন পাড়া মাথায় তুলে কেঁদে ভাসিয়ে মাকে পাগল করে স্কুল যাওয়া থেকে নিস্তার পেলাম। এই ঘটনায় মা খুব চিন্তায় পড়লেও বাবা মোটেই উতলা হননি। পরে বড় হয়ে জেনেছিলাম, বাবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে দেশে সমাজতন্ত্রর প্রতিষ্ঠা আসন্ন। নতুন ভারতবর্ষে অনেক কিছুর সাথে বদলে যাবে এই শিক্ষা ব্যবস্থাও। বদ্ধ ক্লাস ঘরে নয়, শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা হবে মুক্তাঙ্গনে, অনেকটা শান্তিনিকেতনের মত পরিবেশে। আর সেই পাঠ্যক্রমও হবে ভিন্ন। যাক আজ সে প্রসঙ্গ ছেড়ে আবার জন্মদিনের ভাবনায় ফিরি।
কোনোমতে স্কুলের ফাঁড়া কাটিয়ে আবার পরিচিত জীবনে ফিরলাম। মায়ের পাঠশালায় ছড়া কবিতার সাথে শুরু হল গল্প পড়া- ছবিতে রামায়ণ, মহাভারত। কাহিনীগুলো গোগ্রাসে গিলতাম আর প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাসও করতাম। ধীরে ধীরে ক্ষীরের পুতুল দিয়ে গল্পের বইয়ের জগতে প্রবেশ। সে এক চরম উত্তেজনা! বাবা তখন কমিউনিষ্ট পার্টির প্রকাশনা সংস্থা “ন্যাশনাল বুক এজেন্সী”র সাথেও জড়িত। সেই সুবাদে আমার জন্য আসতো নানাচাকা, রুপোলী খুড়ের হরিণ, কোরোক ও কোরোকির মত ছোটোদের জন্য নানা রাশিয়ান গল্পের বই। ঝকঝকে পাতায় চোখ জুড়োনো রঙীন ছবি আর মন ভোলানো গল্প। পড়তে পড়তে মনে মনে পৌঁছে যেতাম সুদূর সোভিয়েতের কোনো নদীর পারে, সোনালী ফসলের প্রান্তরে বা বরফে ঢাকা স্তেপের দুনিয়ায়। মনে পড়ে, নতুন বই খোলার সাথে সাথে নাকে যে গন্ধটা আসতো সেটাও ছিল একটা বিরাট আকর্ষণ!
সেকালে দুপুর হলে সারা পাড়া যেন শুনশান হয়ে যেতো। পাড়ার পায়রারা সারা সকাল আকাশে চক্কর কেটে অনেক আগেই যে যার মাচায় ফিরে গেছে। কাকেরাও তাদের জন্য বরাদ্দ এঁটোকাঁটা খেয়ে গাছের ছায়ায় জিরোতে গেছে। সেই নিঃশব্দ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে মা সঞ্চয়িতা থেকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। আমার রোজকার বায়না ছিলো, প্রিয় কবিতা “বীরপুরুষ”। কেন জানিনা, আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল যে রবিঠাকুর আমার কথা ভেবেই কবিতাটা লিখেছিলেন। অবাক হয়ে শুনি আর ভাবি, রবিঠাকুর আমার কথা জানলো কি করে? কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে একদিন মা’কে জিগেসই করে ফেললাম। মা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বললেন, আহা উনিতো ঠাকুর, তাই সবার কথা জানেন। কৌতূহল আরও বেড়ে গেল, সবাইকে নিয়ে লিখেছেন? মা বললেন, হ্যাঁ সবাইকে নিয়েই লিখেছেন। বড় হয়ে যখন ওনার আরও লেখা পড়বে, তখন সবার কথা জানতে পারবে। বুঝলাম, কমরেড গেলে বা রবি ঠাকুরকে জানতে গেলে আগে বড় হতে হবে। এক সময়ে মা ঘুমিয়ে পড়তেন। ঠিক তখনই সারা বাড়িটাতে যেন একটা অন্য পরিবেশ তৈরী হতো। বেশ টের পেতাম, খাটের তলায়, পর্দার আড়ালে, স্নানঘরের ভেতরে, ছাদে সাজানো গাছের টবের আনাচে কানাচে এক ঝাঁক দত্যিদানো এসে লুকিয়েছে। কিন্তু ভয় পেলে চলবেনা, তাই একটা লাল গামছা মাথায় বেঁধে সেই কাঠের তলোয়ারটা কোমরে ঝুলিয়ে আমি আমার পঙ্খীরাজে চড়ে বসতাম। মনে মনে কতো দত্যিদানো আর ডাকাতের সাথে যুদ্ধ হতো তা বলে বোঝাতে পারবো না।
আমার আরেকটা প্রিয় কবিতা ছিল- “লুকোচুরি”। ফুল সেজে মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলার আইডিয়াটা বেশ লেগেছিল। কিন্তু মা কিছুতেই ঐ কবিতাটা পড়তে চাইতেন না। তখন কারণটা বুঝিনি, বার বার বায়না ধরেছি, কিন্তু কিছুটা বড় হয়ে যখন নিজে লুকোচুরি কবিতাটা পড়েছিলাম তখন এক ঝলক আশঙ্কায় নিজের বুকটাই কেঁপে উঠেছিল। আর উপলব্ধি করেছিলাম, বড় হওয়াটা কতোটা জরুরী।
সেকালে খোদ কলকাতা শহরেও সন্ধ্যা নামতো নিঝুম পায়ে। ব্যাতিক্রমহীন ভাবে মা তিনবার সাঁঝের শাঁখ বাজাতেই বাসায় ফেরা পাখীদের ডাকাডাকিও থেমে যেতো। আঁধার আরেকটু ঘনালে পাড়ার মন্দিরে্র সন্ধ্যারতির রেশ কেটে যাওয়ার সাথে সাথে নেমে আসতো এক অমোঘ নীরবতা। কখনো সখনো টানা রিক্সার ক্ষীণ টুং টাং শব্দ যেন সেই নীরবতাকেই আরও গভীর করে তুলতো। প্রতি ঘন্টায় শ্যামপুকুর থানার ঘন্টা বাজিয়ে সময় জানান দেওয়া ছাড়া অন্ধকারের সাথে সাথে নৈশব্দও ক্রমশঃ জাঁকিয়ে বসতো। এমনই এক সন্ধ্যায় কোনো একটা কারণে বাবার সাথে বেরিয়েছিলাম। কর্নোয়ালিস স্ট্রীট থেকে বলরাম ঘোষ স্ট্রীট ধরে বাড়ির ফেরার পথে ডান হাতে একটা পলেস্তারা খসা পুরোনো দোতালা বাড়ি পড়তো। সন্ধ্যে হলে দু একটা লন্ঠন ছাড়া সে বাড়িতে কোনোদিন ইলেক্ট্রিকের আলো জ্বলতে দেখিনি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম অনেকে মিলে গাইছে, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…”। আমি অবাক হয়ে বাবাকে জিগেস করলাম, ওরা আলো জ্বালায় না কেন? বাবা বললেন, ওদের প্রয়োজন হয়না। আমি আবার অবাক। বাড়ি ফেরার পথে জানতে পারলাম ওটা অন্ধ ছেলেমেয়েদের সান্ধ্যস্কুল, আর ঐ গানটা ওদের প্রার্থনা সঙ্গীত। সেই প্রথম অনুভব করলাম, অন্ধ কথাটার মধ্যে যে কী চরম অসহায়তা লুকিয়ে আছে! উপলব্ধি করলাম, ওদের কাছে আলো আর অন্ধকার যেন সমার্থক। এবার কৌতূহল জাগলো, ওরা তবে গাইছে কেন, “নিশিদিন আলোক শিখা জ্বলুক প্রাণে…”। বাবা সহজ কথায় বুঝিয়ে দিলেন এই আলোটা চোখে দেখার আলো নয়। এটা অন্য আলো, যেটা মানুষের মনের মধ্যে জ্বলে। আর সেই আলোর নাম চেতনা। বাবার সেই কথাগুলো কতোটুকু বুঝেছিলাম জানিনা। চেতনা সম্পর্কে কোনো ধারণাও নেই, তাই মনে মনে ভাবলাম হয়তো বড় হলে বুঝতে পারবো। তবে ঐ দিন সন্ধ্যার সেই গানটা এখনো কানে ভাসে!
১৯৬১ সালটা আমাদের পরিবারে সুখ দুঃখের পসরা সাজিয়ে। কেন জানিনা আজও সুখস্মৃতিগুলোই আমাকে বেশী আবিষ্ট করে রাখে। তাই আমার পাঁচবছর বয়েসের জন্মদিনের কথাটাই বলি। ওটাই আমার জন্মদিনের প্রথম স্মৃতি। তখন বাংলা তারিখ ধরেই জন্মদিনের অনুষ্ঠান হতো। তাই ৫ই জৈষ্ঠ ভোরবেলা থেকেই মা নানা আয়োজন শুরু করে দিয়েছিলেন। আমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই মায়ের রান্না বান্না শেষ। জেগে উঠতেই আমাকে স্নান করিয়ে পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবী পাজামা পরিয়ে দিলেন। এই অব্দি ঠিকই ছিল, কিন্তু ঘাবড়ে গেলাম যখন শালপাতার ঠোঙা থেকে মা একটা রজনীগন্ধার মুকুট আর মালা বের করলেন! জিগেস করলাম, এগুলো কি হবে? মা শান্ত গলায় বললেন, আজ এগুলো পরতে হয়। “পরতে হয়” মানে আর প্রশ্ন করা চলেনা। মা এবার মালা মুকুট পরিয়ে আলমারি থেকে একটা সোনার আংটি বের করে আঙুলে পরিয়ে দিলেন। এখনো অবাক হবার পালা বাকি। কপালে চন্দনের আল্পনা দিয়ে আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন দেখ, তোমায় কেমন সাজিয়েছি! নিজেকে ঐ সাজে দেখে যেমন লজ্জা লাগছিল তেমনি মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনাও ছড়াচ্ছিল। মা নিজেও পরিপাটি হয়ে নিয়ে আমাকে একটা কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলেন। সেদিনই তোলা মায়ের একটা ছবি আমার কাছে আছে তাই বর্ণনাটা সেখান থেকেই দিই। পরনে একটা ডুরে শাড়ী, হাতে বালা, গলায় মটরমালা আর কানে মটর দুল… আমার মা! আজও চোখ বুঁজলে যেন দৃশ্যটা দেখতে পাই। এবার একটা প্রদীপ আর কয়েকটা ধূপ জ্বেলে, এক বাটি পায়েস আমার সামনে সাজিয়ে মা চোখ বুঁজে মনে মনে কি যেন বলতে লাগলেন। এবার তুমুল উত্তেজনায় আমার ধৈর্যর বাঁ ভাঙ্গলো। চেঁচিয়ে জিগেস করলাম, একি, আমায় পুজো করছো কেন? মা ধীরে সুস্থে নিজের কাজ সেরে বললেন, ওটা তোমার পুজো নয় বাবা। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই ভগবান থাকেন। সেটাই মানুষের আত্মা। আমি তোমার মধ্যের সেই আত্মাটাকে পুজো করছিলাম। কথাগুলো শুনে আমার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো, আমার মধ্যে ভগবান! কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতেও ভাল লাগছিল। এক লহমায় যেন নিজেকে পাঁচ বছরের চেয়ে অনেক, অনেক বড় মনে হতে লাগলো! মা তিনবার শাঁখ বাজিয়ে বললেন, এবার পায়েসটা খেয়ে নাও।
পরবর্তী কালে চেতনার উন্মেষের মধ্য দিয়ে সেই বিশ্বাসটার নানা রূপান্তর ঘটলেও আজ উপলব্ধি করি, ঐ কটা কথা যে কোনো শিশুর মনে এক অসীম বোধের বীজ বপন করে! আবার একটা কথা ভেবেও বড় আশ্চর্য হই, আমরা কত সহজেই সবকিছু বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম। আর বিশ্বাস করতে ভালও বাসতাম।
******
ছাদবাগানের গল্প
নিজের হাতে চারা বানিয়ে, দিনের পর দিন পরিচর্যা করে অবশেষে একদিন গাছে ফুল ফল ধরতে দেখলে যে তৃপ্তি হয় তা সবাই অনুভব করতে পারে। এর পরেও আবার এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয় যা না চাইতেই একেবারে উপরি পাওয়া। টবে টবে গাছেরা ডালপালা মেলে সবুজ পাতায় ভরে উঠলেই শুরু হয় পাখিদের ব্যস্ততা। ভোর থেকে সকাল ন’টা অব্দি আবার বিকেলের শেষ ঘন্টা দুয়েক চড়ুই আর শালিকেরা দল বেঁধে টব থেকে টবে ছানবিন করে বেড়ায়। তখন গোটা ছাদটাই যেন ওদের দখলে! একটা প্লাস্টিকের টুল নিয়ে আমি চুপটি করে বসে থাকি। ওরা পাত্তাও দেয়না। শালিকেরা তো আবার টব লেভেলে্র তদন্ত সারার পর ঘাড় দোলাতে দোলাতে সারা ছাদ পরিদর্শন করে বেড়ায়। বয়স্ক মানুষ বলেই হোক বা এই গরমে উদোম গায়ে থাকার জন্যই হোক, আমাকে তোয়াক্কাই করেনা! তবু ঐ ছাদের বাগানটাই যে তাদের দু’বেলার আকর্ষণ, সেটা ভেবেই বেশ আনন্দ হয়।
এবার ফুল ফোটার পালা। আর সাথে সাথে অজস্র মৌমাছির আগমন। এদের আবার এবেলা ওবেলা নেই, সারাদিন নিরলস ভাবে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু কি মৌমাছি? পিঠে হলদে ছোপওয়ালা মোটা কালো ভোমরার দলও এসে হাজির! অবাক হয়ে ভাবি এই কংক্রিটে মোড়া শহরে সারা বছর এরা কোথায় থাকে? আর কোন বাড়ির ছাদে ফুল ফুটেছে, সেই খবরই বা পায় কি করে? ভেবে কুল পাইনা, শুধু একটা ব্যাপক আত্মীয়তা বোধ আর গভীর পরিতৃপ্তি জেগে ওঠে।
বড় সূর্যমুখী ফুলগুলো শুকিয়ে এসেছে। ঠিক করেছিলাম পুরো শুকিয়ে গেলে বীজগুলো বের করে রেখে দেবো। গতকাল সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ছাদে উঠে চোখে পড়লো, তার মধ্যে দুটো ফুল কে যেন চারপাশ থেকে ছেঁটে ছোট্টো বানিয়ে দিয়েছে। গাছের পাতায় কয়েকটা বিচিও পড়ে আছে। নিশ্চয় কোনো পাখির কীর্তি! কিন্তু কোন পাখির? ছাদ বাগানে চড়ুই, শালিকের রোজকার দৌরাত্ম। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে একদল বুলবুলিও আসে। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে হঠাতই উড়ে যায়। রঙ্গন ফুটলে মধু খেতে কখনোসখনো টুনটুনিদেরও আসতে দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিনা যে এই কর্মটা কার? তুলু সকাল সাড়েপাঁচটা নাগাদ ফুল তুলতে ওঠে। নামে প্রায় সোয়া ছটা নাগাদ। জিগেস করতে বললো, চড়ুই ছাড়া আর কোনো পাখি দেখেনি। আন্দাজ করলাম, ঘটনাটা ঘটেছে সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে।
আজ সকাল ছ’টা থেকেই জেগে বসে আছি। তুলু ছাদ থেকে নামার মিনিট দশেক বাদে ক্যামেরাটা নিয়ে ছাদে পৌঁছলাম। সন্তর্পনে ছাদের দরজাটা খুলে একটু ফাঁক করতেই এক অভাবনীয় দৃশ্য! একটা বিশাল সাইজের টিয়া পাখি সূর্যমুখী ফুলের ওপর নিশ্চিন্তে বসে খুঁটে খুঁটে বিচিগুলো খেয়ে চলেছে! ক্যামেরার কথা ভুলে মুগ্ধ হয়ে ওর অঙ্গভঙ্গী দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বাদে সম্বিত ফিরতে কয়েকটা ছবি তুলতেই হঠাত হাওয়ায় দরজাটা খুলে গেলো, আর সেও উড়ে পালালো।
সূর্যমুখীর বীজগুলোর জন্যও আর কোনো দুঃখ রইলোনা। আজ আমার বাগান করা সার্থক হলো!
৪ জুন, ২০২১
*****
ঘুষখোরের সততা
কথায় আছে ঘুষখোর লোকেরা নিজেদের কর্তব্যর প্রতি সচেতন হয়। ঘুষ নিয়ে বেইমানি করেছে এরকম উদাহরণ পাওয়া মুস্কিল।
ঘটনাটা ঘটে ১৯৮৬ সালের মে মাসে, দিল্লী রেলস্টেশনে। আমরা তখন ইলেক্ট্রনিক্সের একটা ছোটখাটো ব্যবসা করি। থাইরেস্টার ড্রাইভ তৈরীর সাথে সাথে Siemens, Flakt Indiaর মতো কম্পানীর জন্য কিছু ছোটোখাটো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসও বানাই। ঠিক সেই সময়েই Flakt জানালো রাজস্থানের শ্রীরাম ফার্টিলাইজারে (SFC, Kota) আমাদের বানানো কিছু যন্ত্র বেগড়বাই করছে। Very very urgent, অর্থাৎ পারলে আজকেই সাইটে গিয়ে পৌঁছোতে হবে। পত্রপাঠ এরোপ্লেনে চড়ে দিল্লী গিয়ে, সোজা রেলস্টেশনে পৌঁছোলাম। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানলাম, দুপুর নাগাদ ট্রেন কিন্তু একটাও সীট খালি নেই। অগত্যা আনরিজার্ভড কম্পার্টমেন্টের টিকিট কাটলাম। কাউন্টারের পাশেই একটা ছুঁচোলো গোঁফওয়ালা ষন্ডা মার্কা লোক দাঁড়িয়েছিলো। ওরা চোখমুখের চেহারা দেখেই বুঝে ফেলে কার কি চাই। জিগেস করলো, সীট চাহিয়ে? আমি ঘাড় নাড়তে জানালো, পঁচিশ টাকা দিলে আনরিজার্ভড কামরায় সীটের ব্যবস্থা করে দেবে। দিল্লীতে একরাত কাটানোর খরচা অনেক বেশী তাই ওর প্রস্তাবে রাজি হতেই হলো। “আইয়ে” বলে সে হাঁটা লাগালো। পেছনে চলতে চলতে বুঝলাম আমি একা নই, আরও দশ বারোজন আমার দলে আছে। কারশেড থেকে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে তখনো অনেক দেরী। আমাদের প্ল্যাটফর্মের একটা নির্দিস্ট জায়গায় দাঁড়াতে বলে লোকটা উধাও হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে আরও জনা বিশেক খদ্দের জোগার করে আনলো। বুঝলাম ও একা নয়, ওর দলে আরও গোটা পাঁচেক ষন্ডা আছে।
ইতিমধ্যে প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ঠ্যালাঠেলি লেগে গেছে। আনরিজার্ভড কম্পার্টমেন্ট যেখানে দাঁড়ায় সেখানে বাক্সপ্যাঁট্রা, ঝোলাঝুলি সহ লোকে লোকারণ্য। ট্রেন ঢোকার ঠিক আগেই ষন্ডাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। তখন আমাদের সবাইকে প্ল্যাটফর্ম থেকে নামিয়ে লাইনের ওপারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। মানে দু’টো লাইনের মাঝখানে। নির্দেশ মতন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমরা সবাই সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন তখন ধীরে ধীরে প্ল্যটফর্মে ঢুকছে। ট্রেন ঢুকতেই বুঝলাম ষন্ডাদের চেলারা কারশেড থেকেই প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে। আর উল্টোদিকের দরজা দিয়েই আমাদের ঢুকতে হবে। ট্রেন থামতেই ষন্ডারা লাফ দিয়ে দু’লাইনের মাঝখানের এক একটা দরজায় চড়ে আমাদের, মানে খদ্দেরদের হাত ধরে ধরে গাড়িতে তুলতে লাগলো। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ব্রিফকেস নিয়ে লাইন থেকে আমার উঠতে অসুবিধে হচ্ছে দেখে ওদেরই একজন হাতবাড়িয়ে আমার ব্রিফকেসটা নিয়ে নিলো।
ট্রেনে উঠে একটা সীট দখল করে হাঁপ ছাড়লাম। কাঁধের ব্যাগটা সীটের তলায় রেখে খেয়াল হলো আরে, ব্রিফকেসের লোকটাকে আর দেখতে পাচ্ছিনা! ঐ ব্রিফকেসেই আমার নতুন মাল্টিমিটার, স্পেয়ার কম্পোনেন্ট আর দরকারী কাগজপত্র! সবচেয়ে বড় কথা, যে যন্ত্রটা সারাতে যাচ্ছি তার সার্কিট ডায়াগ্রামও ঐ ব্যাগে! এখন আমি কি করি? সীট ছেড়ে উঠে খোঁজ করারও উপায় নেই কারণ নিজেদের খদ্দেরদের বসিয়ে ষন্ডাবাহিনী প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজাগুলো খুলে দিয়েছে। হুড়মুড়িয়ে লোক ঢুকে সারা কামরায় এক ধুন্ধুমার কান্ড! একে মে মাসের চামড়া জ্বালানো গরম, তার ওপরে আনরিজার্ভড কম্পার্টমেন্টের মার্কামারা গন্ধ! কী করি ভাবছি, হঠাতই ছুঁচোলো গোঁফ ষন্ডা এসে হাজির, “জলদি পঁচ্চিশ রুপেয়া দে দিজিয়ে।” আমি কাতর গলায় বললাম, “লেকিন হামারা ব্রিফকেস কাঁহা হ্যায়?” সে অবাক হয়ে শুধলো, “নেহি মিলা?” আমি ঘাড় নাড়তেই আবার উধাও হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই আমার ব্রিফকেসটা নিয়ে এসে বললো, “অন্দর কা সামান দেখ লিজিয়ে।”
ব্যাগটা খুলে সব ঠিকঠাক আছে দেখে ধরে প্রাণ ফিরে পেলাম। এই অপ্রত্যাশিত সার্ভিসের জন্য ওকে আমি পঁচিশের বদলে তিরিশটা টাকা দিলাম। সলজ্য হেঁসে, একটা পাঁচটাকার নোট ফেরত দিয়ে বললো, “আপ কাস্টমার হ্যায়, আউর কাস্টমার কে লিয়ে হামারা ভি কুছ ফর্জ বনতা হ্যায়।”
সেদিন বুঝেছিলাম, যে ঘুষখোর লোকেরা কর্তব্যপরায়ণ হয়। কাস্টমারকে তাঁরা ঠকাবে না।
Add comment