সাহিত্যিকা

একই অঙ্গে কত রূপ

একই অঙ্গে কত রূপ
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
৫ এপ্রিল, ১৯৮১
বম্বে পোর্ট ট্রাস্টের ইন্টারভিউ কল লেটার পেলাম। খবরের কাগজ দেখে অনেক আগে এপ্লাই করেছিলাম। কবে করেছিলাম মনে পড়ছে না, মাস ছয়েক তো হবেই। ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন এতদিন বাদে ওরা ১০ তারিখ ইন্টারভিউ কল করেছে।
আমার অফিসের কাজের জায়গায় আমি ভালোই আছি। কোম্পানির নামটাই শুধু একটু বদখদ, মায়ের্ভোগে ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেড। ভালো জার্মান কোম্পানি, মাত্র তিন বছর হলো ভারতে এসেছে। তবে পাবলিক অতশত বোঝে না। কিন্তু কোম্পানির নাম মায়ের্ভোগে ইঞ্জিনিয়ারস শুনলেই লোকে হাসাহাসি করে।
আমাদের অফিসে সব মিলিয়ে ১৩৪ জন কাজ করে। আমি জুনিওর ইঞ্জিনিয়ার, আমার বস একজন গোয়ানিজ মেয়ে, নাম সোফিয়া রিকার্ডো। পিলানীর ইঞ্জিনিয়ার, স্মার্ট, এই বছর আঠাশ তিরিশেক বয়স। মাস দুয়েক হলো এসেছেন, শোনা যায় ডিভোর্সী, দু’দুবার। উনি বেশ মিশুকে, আমার সাথে খুব ভালো টার্মস। আমায় খুব পছন্দ করেন, এই দু’মাসেই আমাকে পার্ক স্ট্রীটে তিনবার লাঞ্চে নিয়ে গেছেন, পাঁচবার অফিসের পরে ট্রিঙ্কাস নিয়ে গেছেন। বলে রেখেছেন, আমাকে নিয়ে এবার উইকএন্ড আউটিং এ যাবেন। এই আউটিং মানে কি ত্রি নাইটস ট্রিপ? জানি না। দেখা যাক কি হয়।
৬ এপ্রিল, ১৯৮১
ট্রেনে এত কম সময়ে রিজার্ভেশন পাবো না। তাই আমার সকল পার্টনার ইন ক্রাইম, উত্তম খানকে ফোনে জানালাম, টিকিট চাই। দুনিয়ার যত দু’নম্বরী কাজের ব্যাপারে ও সিদ্ধহস্ত। সকালে বলেছিলাম, বিকেলেই জানিয়ে দিলো, টিকিট হয়ে গেছে, ৮ তারিখ গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস, ফার্স্ট ক্লাস।  মানে হাতে দু’দিন সময় আছে। উত্তম এটাও জানিয়ে দিলো, বম্বে ভিটি ষ্টেশনের কাছেই বাঙালীদের একটা বাজেট হোটেল আছে, সুকান্ত লজ, সেখানে ঘরের ব্যাবস্থাও করে দিয়েছে।
৮ এপ্রিল, ১৯৮১
আমার ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্ট্মেন্টে চারজন। আমি ছাড়া এক পঞ্চাশোর্ধ বাঙালি পরিবার, আর একটি বছর কুড়ি একুশের মেয়ে। প্রথম দর্শনেই খুব ইপম্প্রেসিভ। মেয়েটির সাথে আলাপ করলাম। নাম দেবারতি রায়। প্রথম পরিচয়ে আমার মতন একজন অচেনা লোকের সাথে আলাপে কোনরকম জড়তা নেই। লেডি ব্রেবোনে সাইকোলজি অনার্স নিয়ে পড়ছে, ফাইন্যাল ইয়ার। জানালো যে সে ক্লাসের টপার। উল্টোদিকে সে আমার কাছে জানতেই চাইলো না যে আমি কি, কি করি। তাই আমি নিজে থেকেই কায়দা করে জানিয়ে দিলাম, আমি শিবপুরের ইলেকট্রক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তবে কোম্পানির বদখদ নামটা আর বললাম না।
সময়টা ভালোই কাটছে। আমি এবার ওঁর সাবজেক্টে একটু উৎসাহ দেখালাম, আর আমার সেই সামান্য উৎসাহটাই আমাকে মারাত্মক এক অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম যে সাইকোলজি কি জিনিষ? উত্তরে আমাকেই সে উল্টে প্রশ্ন করলো, সাইকোলজি সম্বন্ধে আমার কি ধারণা? আমি কিছুই বলতে পারি না। আমার প্রশ্নটা সহজ করার জন্য বললাম, আপনি আপনার ফাইন্যাল ইয়ারে কি স্পেশাল পেপার বা প্রজেক্ট নিয়েছেন।
মেয়েটা একটু চুপ করে তারপর জানতে চাইলো, “ফাইন্যাল ইয়ারের স্পেশাল প্রজেক্ট বলে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”
– ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমার যেমন ছিলো ইলেকট্রিক্যাল মেশিনের স্পীড কন্ট্রোল। তেমনি আপনারও নিশ্চয়ই কিছু আছে।
– ওহ, এই ব্যাপার?
মেয়েটি আবার চুপ। আর আমি ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার এত সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে এত সময় লাগে?
একটু কাছে এগিয়ে এসে নীচু গলায় বললো, “আপনি সেক্সুয়াল ডিজায়ার, আর ডিসস্যাটিসফ্যাকশন বোঝেন?”
আমার মাথায় যেন কেউ আনবিক বোমা মারলো।
“তাহলে শর্টে বলি। আপনি যখন ছোট ছিলেন, মানে পনের বছর বয়স, তখন থেকেই আপনার সেক্স্যুয়াল ফিলিংস গুলোর শুরু। শুধু আপনার নয়, সেই বয়সের সব ছেলেদেরই। আপনি মেয়েদের তখন অন্যরকম ভাবতে শুরু করেছেন। যদি মেয়েটাকে হাতের কাছে পাই? কি ঠিক বলছি?”
আমি কি আর বলি? মাথা নেড়ে, চুপ করে রইলাম।
“আচ্ছা, বাইরে চলুন।“
মেয়েটি বাইরে এলো, আমিও যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতন ওঁর পিছনে পিছনে এসে, দরজার কাছে এসে দুজনে দাঁড়ালাম। মেয়েটি ব্যাগ থেকে ডানহিল সিগারেট বার করলো। “চলে?”
– না না, আমি সিগারেট খাই না।
মেয়েটি লাইটার দিয়ে নিজের সিগারেট ধরালো।
– আসলে কেবিনে সামনেই বয়স্ক দুজন বসে আছেন, তাই ওনাদের সামনে আলোচনা করতে চাইছিলাম না। হ্যাঁ আমি যা বলছিলাম। আপনার যখন পনেরো বছর বয়স, তখন আপনার অনেক ইচ্ছে আছে, সাধ আছে, কিন্তু হিম্মত নেই, সাধ্য নেই। সুতরাং একটা ফ্রাস্ট্রেশন আসে।
আমি কথাটা ঠিক বুঝলাম না। বললাম, “একটু বুঝিয়ে বলবেন?”
মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠলো। “কি লোক আপনি? এটাও বুঝিয়ে বলতে হয়? আচ্ছা, বলুন তো, আপনার সেক্স্যুয়াল ফিলিংস হয় না?”
ওহ, এই কথা? এবার বুঝলাম সে কি বলতে চাইছে। কিন্তু সে অন্যরকম জবাব দিলো। “আমি জানি, হয়। কিন্তু আমি এ নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করবোই না, যদি না আপনি ইন্টারেস্টেড থাকেন।“
একটু থেমে আবার শুরু করলো, “এই যে মানুষের কৈশোর থেকেই সেক্স্যুয়াল ডিম্যান্ডগুলো শুরু হয়, তার অনেক কিছু চাই, কিন্তু পারি না, কারণ মনের সেই জোর সেই ক্ষমতাটাই নেই। এর ফলে অনেকের মনেই একটা অতৃপ্তি থেকেই যায়।“
আমি ওঁর দিকে চেয়েই আছি। এভাবে কোনদিন কোন মেয়ের সাথে এরকম আলোচনায় ফেঁসে যাবো, ভাবতেই পারিনি। কি কারণে যে প্রশ্ন করেছিলাম, সাইকোলজি কি জিনিষ?
– আর আপনি জানতে চাইছিলেন; তাই বলছি, এটাই আমার সাইকোলজির ফাইন্যাল ইয়ারের প্রজেক্ট। সেক্স্যুয়াল বিহেভিওর অফ হিউম্যান বিং।
সে নিজের আধখাওয়া সিগারেটটা আমাকে দিয়ে বললো, নিন আঙুলে ধরুন।
– এবার একটা টান দিন।
আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। তখন প্যাকেট থেকে অন্য একটা ফ্রেশ সিগারেট দিয়ে বললো, “নিন, এটা ধরান।“
– আপনার নাম অসীম সাহা না হয়ে, অসীম সংযমী সাহা হওয়া উচিৎ ছিলো। দ্যা গ্রেট সেলফ রেস্ট্রিক্ট সাহা।
– আরে? কি আশ্চর্য্য?
– কি হলো?
– আমার হস্টেলের বন্ধুরা তো আমাকে এই নামেই ডাকে, সংযমী।
মেয়েটা মুচকি হেসে বললো, চলুন, ট্রেনে একটু হেঁটে আসি।
আমি ততক্ষণে মেয়েটির প্রতি মন্ত্রমুগ্ধ। আমরা দুজনে ট্রেনের করিডর দিয়ে কয়েকটা কোচে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এমনিই ঘুরে এলাম।
৯ এপ্রিল, ১৯৮১
দিনটা খোশগল্পে বেশ কেটে গেলো। পরিবর্তনের মধ্যে আমি বেশ কয়েকটা বিলিতি সিগারেটের ধোঁয়া নিলাম। বম্বে পৌঁছে আমি আমার সুকান্ত লজে চলে গেলাম। ও জানালো সে শালিমার হোটেলে থাকবে।
১০ এপ্রিল, ১৯৮১
আজ ইন্টারভিউ। বুঝলাম না। কেন জানিনা গতকাল রাতে ঘুমই হয় নি। সারাটা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছি। সকালে গরম জলে স্নান করে একটু আরাম হলো, তবে মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করছে।
সকাল এগারোটায় আমার ইন্টারভিউ, তার একটু আগেই গিয়ে পৌছালাম। ঠিক সময়েই আমার ডাক এলো। দু’একটা মামুলী প্রশ্নের পর জানতে চাইলো আমার মায়ের ভোগের কোম্পানী কি প্রোডাক্ট বানায়। আমি প্রথমেই বললাম যে, আমার কোম্পানী নাম মায়ের ভোগে নয়, নাম মায়ের্ভোগে। জার্মান কোম্পানি। তারপর নিজের কাজের ব্যপারে বলা শুরু করলাম। যদিও এদিকে মাথাটা আমার ধরে আছে।
– আর ইউ নট কমফর্টেবল মিস্টার সাহা?
– নো, নো, ইটস ওকে, জাস্ট ফিলিং টায়ার্ড।
ইন্টারভিউ একদমই ভালো হলো না। এত খারাপ ইন্টারভিউ কিভাবে হলো নিজেই বুঝতে পারছি না। তিনটে নাগাদ হোটেলে ফিরে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। সন্ধ্যায় ভাবলাম কোথাও একটু ঘুরে আসি। দেবারতি বলেছিলো, ও শালিমার হোটেলে উঠবে। একটা বড় ক্যাডবেরি চকোলেট কিনে শালিমার হোটেল গিয়ে জানলাম দেবারতি রায় নামের কেউ এসে ওঠেনি। মেরিন ড্রাইভে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। তাহলে দেবারতি কি আমাকে মিথ্যা কথা বললো? ক্যাডবেরির পয়সাটাই জলে গেলো।
১১ এপ্রিল, ১৯৮১
ভোরবেলায় গীতাঞ্জলী ধরলাম। ক্রাইম পার্টনার উত্তমই রিটার্ন টিকিটের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলো। ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছি। গত দুদিন রাতে ঘুম হয় নি।
১২ এপ্রিল, ১৯৮১
বিকেলে বাড়ি এসেই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম, বললাম ট্রেন জার্নি করে এসে খুব টায়ার্ড লাগছে।
১৩ এপ্রিল, ১৯৮১
ঠিক করেছি, দেবারতি রায়কে খুঁজে বার করতে হবে।
আমার মামাতো বোন ঝুমা লেডি ব্র্যাবোন কলেজেই পড়ে। ফোনে বললাম, “হ্যারে, তুই সাইকোলজি ফাইন্যাল ইয়ারের টপার দেবারতি রায়কে চিনিস?” সে তৎক্ষণাৎ জানালো, হ্যাঁ, চেনে। টপার,আর খুব ভালো মেয়ে, কলেজে সবাই ওঁকে চেনে। বললাম, কালকে সকালেই আমি তোদের কলেজে যাচ্ছি, দেবারতির সাথে দরকার আছে।
১৪ এপ্রিল, ১৯৮১
ঝুমা কলেজের গেট থেকে আমাকে নিয়ে গিয়ে ভিজিটর্স রুমে বসিয়েছে। খানিক পরেই একটি মেয়েকে নিয়ে এলো, “দাদা, এই যে দেবারতি।“
আমি বললাম যে না এই দেবারতি নয়। সাইকোলজির ফাইন্যাল ইয়ারের টপার দেবারতি রায়ের সাথে আমার দরকার।
আমার কথা শুনে ঝুমা আর মেয়েটা একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে চাইলো।
– দাদা, জানি না তুই কার কথা ভাবছিস। যদি তোর কথা ঠিক হয়, তাহলে এই মেয়েটিই দেবারতি, সাইকোলজির টপার।
বললাম, না না, অন্য কেউ হবে, এই এক সপ্তাহ আগেই, গত আট তারিখ আমরা গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে কো-প্যাসেঞ্জার ছিলাম। এই নতুন দেবারতি আবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো। “এ আবার নতুন কোন দেবারতি রায়?”
বুঝলামই না, ব্যাপারটা তাহলে কি হলো?
১৬ এপ্রিল, ১৯৮১
দু’দিন ব্যাস্ততার মধ্যেই কেটে গেলো। আজ অফিসের পর সন্ধ্যাবেলা সোফিয়ার সাথে ট্রিঙ্কাসে গেলাম। ওঁকেও দেবারতির কথাটা বললাম।
১৭ এপ্রিল, ১৯৮১
অফিসে ঝুমার ফোন পেলাম। জানতে চাইছে, সেই দেবারতির কপালের ডানদিকে দুটো কালো আঁচিল আছে কি না? আমি বললাম আছে, আছে। ঝুমা জানালো, তাহলে মেয়েটার নাম কমলা গণপতি। দেবারতি, মানে সত্যিকারের দেবারতির প্রতিবেশী বন্ধু। দেবারতির তিনটে বাড়ি পরেই থাকে।
আমি অবাক। নিজের পরিচয় গোপন করে সে অন্যের নাম পরিচয় দিয়ে আলাপ করবে? ঝুমাকে ফোন করলাম, এই কমলা গণপতি কোথায় থাকে? আমার দরকার। দেবারতির ঠিকানা পেলে কমলার ঠিকানাও পেয়ে যাবো।
১৮ এপ্রিল, ১৯৮১
ঝুমা খুব চটপটে মেয়ে। একদিনেই ঠিকানা দিয়ে দিলো, দেবারতির ঠিকানা ১২১ মানিকতলা স্ট্রীট। মানিকতলা স্ট্রীট মানে তো আমার ক্রাইম পার্টনার উত্তমের বাড়ির কাছাকাছিই হবে। উত্তমের ফোন আমার কাছেই ছিলো, ৩৫৪২১৪। ফোন করলাম। ব্যাপারটা বললাম।
শুনে উত্তমের ফার্স্ট রিএকশন, গুরু করেছো কি? সামলাতে পারবি?
আমি বললাম, যে করেই হোক, আমাকে এই কমলা গণপতির সাথে দেখা করতেই হবে। আর যেহেতু সে উত্তমের পাড়ার মেয়ে, ওঁর সাহায্য আমার চাই।
আমি ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমি ইঞ্জিনিয়ার, মায়ের্ভোগে কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের ইম্পর্ট্যান্ট অফিসার। আমি স্কুল লাইফ থেকে দিদির কলেজের গেটের বাইরে মেয়েদের লাইন মারি। গোয়ানীজ ভিভোর্সীর সাথে ট্রিঙ্কাস যাই। আর কোথাকার এক কমলা গণপতি আমাকে বোকা বানিয়ে দেবে? এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না।
২১ এপ্রিল, ১৯৮১
উত্তম আমায় শর্ত দিয়েছে, আমি যদি কফি হাউসে ওকে মোগলাই, কবিরাজি, ফিস ফ্রাই খাওয়াই, তবেই সে আমাকে আগে ব্রিফ দেবে। তারপরে আমি যদি চাই, তাহলে ওদের পাড়াতেও নিয়ে যাবে।
এই উত্তমটা চিরকালই ভোগী। চিরটাকাল অন্যের ঘাড় ভেঙ্গে খায়। যাই হোক, আমারই দরকার, দু’চারটে মোগলাই আমি না হয় খাইয়েই দেবো। ঠিক হয়েছে, আগামী শনিবার, ২৩ এপ্রিল সকাল এগারোটায় কফি হাউসে আমাদের দেখা হবে।
২৩ এপ্রিল, ১৯৮১
কফি হাউসে আমরা দুজনে। উত্তম নিজের জন্য অর্ডার দিয়েছে একটা করে মোগলাই, চিকেন বার্গার, কবিরাজি, ফিস ফ্রাই, আর এক ফুল প্লেট কষা মাংস। শালা এত বড় সাইজের বার্গার যে দুই হাতে ধরে খেতে হচ্ছে। আরও বলেছে লাস্টে আইসক্রীমও নেবে। সবই আমার ঘাড় ভেঙ্গে। আমার ট্যাঁকের পয়সা, তাই নিজের জন্য নিয়েছি শুধু একটা কবিরাজি, আর হাফ প্লেট মাংস।
কিছু খেতে পারে বটে উত্তম! খেতে খেতেই জানালো, আমার এই গর্তে পা না দেওয়াই ভালো। মেয়েটা উত্তমের পাড়াতেই থাকে। উত্তম খুব ভালো করে চেনে। তামিল পরিবারের মেয়ে, প্রচন্ড স্মার্ট, পড়াশুনাতে খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলো। দারুণ ইংরেজি বলে। দেশ বিদেশের প্রচুর বই পড়ে। এখন সে এয়ার হস্টেস। ওর অনেক বয়ফ্রেন্ড, নিয়মিত পার্টি করে, দামী দামী মদ আর সিগারেট খায়। এয়ারলাইন্সের ফ্রি টিকিটে সিঙ্গাপুর, দুবাই, লাস ভেগাসে ঘুরে এসেছে। আমাকে সাবধান করে দিলো, আমি ওকে সামলাতেই পারবো না। পা পিছলে হয়তো ফেঁসেই যাবো।
আমি হেব্বি খচে গেলাম, এই যে এত গান্ডে পিন্ডে খাওয়াচ্ছি, সেটা কি লেকচার শুনতে? আমি জানি না, কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই হবে। ব্যাস, আমার এক কথা।
উত্তম বললো, ঠিক আছে। পকেটে যেন পয়সা থাকে।
পয়সা? আরে আমি মায়ের্ভোগের ইঞ্জিনিয়ার, ভালো মাইনে পাই, আমাকে পয়সার ভয় দেখানো? আর সোফিয়া আমাকে নিয়ে ট্রিঙ্কাস যায়। নিজের গ্যাঁটের পয়সায় আমাকে এন্টারটেইন করে। আর আমি এই তামিল মেয়েকে ম্যানেজ করতে পারবো না?
খেয়েদেয়ে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আসছি।
একি? দেবারতি রায়, ওরফে কমলা গণপতি এদিকেই আসছে। সিঁড়িতে আমার একদম সামনা সামনি। আমি ধরলাম, “কি আমাকে চিনতে পারছেন?”
আমার দিকে সে অবাকনেত্রে তাকিয়ে রইলো। পাশেই উত্তমকে দেখে হ্যালো বললো। “কেমন আছো উত্তমদা?” উত্তমের ছোট্ট উত্তর “ভালো, এই একটু কফি খেতে এসেছিলাম।“
আমি ওকে ছাড়বো না। ঐ সিঁড়িতেই ধরেছি “আপনি সেদিন আমাকে নিজের নাম না বলে কেন অন্য নাম বললেন?”
মেয়েটি খুব ঠান্ডা মাথায় জবাব দিলো, “জেন্টলম্যান। সামথিং মাইট বি রঙ উইথ ইউ। আই ডোন্ট নো হু আর ইউ। আই ডাউট ইফ আই হ্যাভ মেট ইউ বিফোর। প্লিজ ডোন্ট ট্রাই ট্যু ক্যাচ এনি লেডি ইন সাচ ম্যানার।“
– তার মানে? আপনি আমার সাথে কিছুদিন আগে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে কোপ্যাসেঞ্জার ছিলেন না? আপনি আমায় বলেন নি, বম্বেতে শালিমার হোটেলে থাকবেন?
এবার সেই কফি হাউসের সিঁড়িতেই মেয়েটি বেশ জোরেই হেসে উঠলো। ওহ, নাউ আই  আন্ডারস্ট্যান্ড। দ্যাটস দ্যা ম্যাটার? হাউ ফানি। জেন্টলম্যান, ইউ আর ট্যু সুইট।
– তার মানে?
– ভেরি সিম্পল। ইউ মেট মাই সিস্টার, বিমলা। উই আর ট্যুইনস। এন্ড শী হ্যাড বীন ট্যু বম্বে রিসেন্টলি। শী ওয়াজ অন হার ওয়ে ট্যু বেইরুট। আই থিংক ইউ মেট মাই সিস্টার।
আমি তো অবাক। কই, উত্তম তো এরকম কিছু আমাকে বলেনি। এঁরা যে জমজ বোন, সেটাও বলেনি।
আমি বললাম, আমি কি আপনার সিস্টার বিমলাকে মিট করতে পারি?
– হোয়াই নট? শী ইজ এয়ার হস্টেস, টুডে শী ইজ অন ফ্লাইট, শী উইল বি ব্যাক অন মান ডে।
দেখি আমাদের ব্যাচের সোহম ক্যামেরা নিয়ে আসছে। “হ্যায়, হানি!” মেয়েটি সোহমকে সম্বোধন করলো। সোহম আমাদের সেখানে দেখে অবাক। আমরাও অবাক যে সোহম যেন আমাদের চিনতেই পারলো না। মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলো?
২৪ এপ্রিল, ১৯৮১
উত্তমের সাথে কথা বললাম, গতকালের বিমলাকে চেনে কিনা। ও বলে, মাত্র কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকে। বাপের জন্মে শোনে নি বা জানে না, যে ওঁরা যমজ বোন। মানে পুরো ঢপের কেস।
সোহমের সাথে একবার কথা বলতে হবে। ওঁর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। সুকান্তর থেকে নিলাম। ৭২৪৭২৯।
সোহমকে ফোন করলাম, এই বিমলাকে তুই কতদিন চিনিস? সোহম অবাক, কে বিমলা?
– কেন? গতকালের মেয়েটা?
– বিমলা? না না, ওঁর নাম আমিরা। আমিরা সইফি। আই আই এমে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে।
– আই আই এমে ম্যানেজমেন্ট?
– হ্যাঁ। ম্যানেজমেন্ট, সেকেন্ড ইয়ার।
– তোর সাথে কিভাবে আলাপ?
– আরে বলিস না, অরিজিনাল বালুচিস্তানের মেয়ে। মডেলিং করতে চায়। ফটোগ্রাফি ক্লাবে আমার সাথে পরিচয়। আমাকে ধরেছে, কিছু মডেলিং এর শ্যুট করে দিতে। তাই ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম।
– তারপর?
– তারপর আমরা রিতজ হোটেলে কিছু ফটোশ্যুট করি। কি ব্যাপার বলতো? কিসের কনফিউশন?
*************
সংযোজন – ১৯৮১ সালে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে ফার্স্ট ক্লাস ছিলো না, এবং ২৩ এপ্রিল ১৯৮১ শনিবার ছিলো না। কিন্তু গল্পের খাতিরে গরু…… 

Sahityika Admin

Add comment