সাহিত্যিকা

ইলিশ যজ্ঞ ও বিরিঞ্চিবাবা

ইলিশ যজ্ঞ ও বিরিঞ্চিবাবা
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

মহারাজ লেটোকুমারের ভবনে আজ বাৎসরিক ইলিশ যজ্ঞ। প্রতি বর্ষাকালে এই উৎসব পালিত হয়। বিরিঞ্চিবাবার স্বপ্নাদেশের অদ্য তৃতীয় বৎসর উদযাপন। মহারাজ বলেন ইলিশ যজ্ঞ, প্রজারা বলে উৎসব।

মহারাজের অতীব প্রিয় বিরিঞ্চিবাবা ত্রিকাল পূর্বে অনিরুদ্ধ নামে জন্মগ্রহণ করেন, সম্পর্ক সূত্রে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রপৌত্রের প্রপৌত্র। জন্মাবধি যুদ্ধে বা কোন বিষয়ের বাকবিতণ্ডায় কেহই কোনোদিন তাঁহার গতিরোধ করিতে পারেন নাই, তাই বাল্যকালেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর উপযুক্ত নামকরণ করেন ‘অনিরুদ্ধ’। ‘অনিরুদ্ধ’ অর্থাৎ কেহই গতিরোধ (‘রুদ্ধ’) করিতে সক্ষম হইবে না।

অনিরুদ্ধ আকর্ষর্ণীয ব্যক্তিত্ব। জন্মাবধি তির্যকভাবে হাঁটেন। ভোজকটের রাজকন্যা রোচনার সহিত প্রথম বিবাহ হয়। পরে শোণিতপুরের রাজা বাণদৈত্যের পরম রূপবতী কন্যা ঊষার পাণিগ্রহণ করেন। এরপর সত্য, ত্রেতা, ও দ্বাপরকালের বহু নারী উনার সান্নিধ্যে আসিলেও তাঁহাদের সকলকে নিরাশ করিয়া তিনি বিংশ শতকে এক বাঙালী নারীর পাণিগ্রহণ করেন। বিভিন্নকালে জগৎজোড়া খ্যাতিলাভ করিয়া বহু উপাধি অর্জন করিলে সমগ্র বিশ্বের ভক্তকুল এখন বিভিন্ন নামে উনাকে সম্বোধন করেন। কিন্তু এই ইলিশ যজ্ঞের উপস্থিত ভক্তকুলে ইনি বিরিঞ্চিবাবা নামেই শ্রদ্ধার সহিত পরিচিত। জনশ্রুতি যে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় কাপুরুষ মহাপুরুষ সিনেমাটি নির্মানের সময় অনিরুদ্ধকে এই বিরিঞ্চিবাবা নামে প্রথম সম্বোধন করেন।

সপ্তাহান্তে রবিবারের সকালে বিরিঞ্চিবাবা কলিকাতার সরোবর তীরে চারি-পাঁচজনের বিশাল সমাবেশে জ্ঞান বিতরন করেন, ও কথিত আছে, সেই বিশাল সমাবেশে বিরিঞ্চিবাবার কৃপায় ভক্তগণ বিনামূল্যে, সুলভ মূল্যে, বা অর্ধমূল্যেও সুরাপানের আশীর্বাদধন্য। কিন্তু আজ বিরিঞ্চিবাবার কৃপালাভের মোহে ইলিশ যজ্ঞে শতাধিক ভক্ত আসিয়াছেন। ভক্তগনের শকটের সারথিরাও আছেন। সারথিরা যজ্ঞস্থলে আসিবেন না, লেটো মহারাজ তাঁহাদের জন্য অন্যত্র প্যাকেটের ব্যাবস্থা করিয়াছেন।

আজিকার শতাধিক ভক্তের সমাবেশে ভক্তরা ইলিশ যজ্ঞের পৌরাণিক তাৎপর্য্য জানিতে ইচ্ছুক। বিরিঞ্চিবাবা তখন বলিতেছেন, “আরে পাগলের দল। ইলিশ যজ্ঞ জানতে হলে তো রামচন্দ্রের সেই অশ্বমেধ দিয়ে শুরু করতে হয় রে।“
“তাই হোক বিরিঞ্চিবাবা, আপনি বলুন।“
– তবে শোন, অযোধ্যায় মিটিং চলছে। রাম আছে, আমি আছি। আমাকে কমিটির চেয়ারম্যান করে দিয়েছে। সেখানে ব্রম্মা, নারায়ণ, বিশ্বকর্মা, বরুণ, অগ্নি, কুবের, নারদ সবাই এসেছে। আমি রামকে বুঝিয়ে যীশু, আব্রাহাম, গ্রীস থেকে যীয়ুসকে, রোম থেকে জুপিটার, ডায়ানা আর এপোলোকেও ডেকে এনেছি।
“ডায়ানা?”
– হ্যাঁ, ডায়ানা। তোর অরণ্যদেবের ডায়ানা নয়। সব এসেছে, শুধু শংকর আর ইন্দ্র আসেনি। ইন্দ্র তখন অহল্যার সাথে ইন্টুমিন্টু করে গৌতম মুনির অভিশাপে ফেঁসে গেছে, সমাজে মুখ দেখানোর জো নেই। আর শংকর, মানে তোদের মহাদেবকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। দিব্যচোখে দেখলাম নন্দী তখন বেদুইনদের দেশে, মানে তোদের আজকের দুবাই। হনুমান দুবাই গিয়ে নন্দীকে ধরে তারপর শংকরকে ধরে আনলো।

ভক্তদের মাঝে হিমাই স্বতন্ত্র, তিনি ধার্মিক স্বভাবের। তিনি বলেন, “প্রভুজী, রামায়ণে তো এসবের উল্লেখ নেই?”
– ঠিক ধরেছিস। নেই, কারণ আমাদের সেই মিটিং এ বাল্মী ছিলো না। পরে বাল্মী’কে আমি বলেছিলাম দ্বিতীয় খন্ডে এটা দিতে, সে বলে যে সে নাকি ভুলেই গিয়েছিলো। শুনেছি কাশীরাম নিজের রামায়ণে এটা লিখে গেছে।
ভক্ত হিমাই আবার চঞ্চল। “প্রভুজী, আপনি বোধ হয় তুলসীদাসের কথা বলতে চাইছেন। কারণ কাশীরাম দাস তো রামায়ণ নয়, মহাভারত লিখেছেন?”
এবার বিরিঞ্চিবাবার গম্ভীর স্বর ধ্বনিত হইলো, “তো? কাশী মহাভারত লিখেছে বলে কি রামায়ণ লেখায় বারণ আছে? ভুলে গেলি? স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আমার নাম রেখেছিলো অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ নামের অর্থ কি? কোন বিষয়ের আলোচনায় কেউ কোনোদিন আমাকে হারাতে পারে না। আর তুই আজকে আমার ভুল ধরতে এসেছিস?”

বিরিঞ্চিবাবা অসন্তুষ্ট। পরিবেশ গম্ভীর হইয়া গেলো। ভক্তগণ বিহ্বল। কি করিবে, কি বলিবে স্থিরতা নাই। পাতিবাবু করজোড়ে অনুরোধ করিলেন, “গুরুদেব, আপনি বলেন। মূর্খদের প্রলাপে কান দিবেন না।“
বিরিঞ্চিবাবা মৌন। ইন্সপেক্টর ঈগলও উঠিয়া করজোড়ে অনুরোধ করিলো, “বাবা, আমাদের মুখপানে চেয়ে আপনি বলুন।“
– কি বলবো? কি বলবো আমি? ওরে, চন্দ্রগুপ্তের সভায় চাণক্য আমার সাথে তর্ক করতে সাহস পায় নি। নালন্দায় হিউয়েন আমার ছাত্র ছিলো। আর আজকের দু’পাতার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে আমার সাথে তর্ক করে?
পরিবেশ গম্ভীর। সামান্য বিরতির পরে বিরিঞ্চিবাবা শুরু করিলেন, “সেই অশ্বমেধ দিয়ে শুরু। তবে রাক্ষসেরাও তখন যজ্ঞ করতো।“
হিমাই আবার কৌতুহলী, “রাক্ষসের যজ্ঞ?”
– কেন? এইমাত্র যে তুই কাশী আর তুলসী নিয়ে বড় বড় ডায়লগ দিলি? ইন্দ্রজিতের যজ্ঞ তোর রামায়ণে লেখা নেই?
হিমাই চুপ করিয়া গেলো। এই সহজ সাধারণ তথ্যটি সে ভুলিয়া গিয়াছিলো।
– আমি ইন্দ্রজিতের সেই যজ্ঞে ছিলাম। শুধু কয়েক সেকেন্ডের জন্য টয়লেট গেছি, এসে দেখি ইন্দ্র মরে পড়ে আছে। লক্ষণ নাকি এসে মেরে দিয়েছে। তারপরেও তো ব্যস লিখেছে যে যুধিষ্টির যজ্ঞ করেছিলো। তাই আমি লেটোকে বললাম, রাম যজ্ঞ করেছে, যুধিষ্ঠির করেছে, এবার তুইও একটা যজ্ঞ কর। সেই থেকেই আজকের এই ইলিশ যজ্ঞের শুরু।
ভক্তগণের প্রণামের ধূম পড়িয়া গেলো।

হিমাইবাবুর মনের কোণে সংশয়। বলেন, “প্রভুজী, আপনার ঐ টয়লেটে যাওয়ার ব্যাপারটা তো রামায়ণে পড়িনি।”
– আরে বোকা, সেটা কি করে লিখবে? রাম সীতা রাবণ তো রোজ দিনে কতবার করে টয়লেট গেছে। তাহলে বাল্মী বসে বসে কি খালি টয়লেটের ডায়েরি লিখবে?
হিমাইবাবু বুঝিলেন, প্রশ্নটি সঠিক হয় নাই। কিন্তু মনে হাজারো প্রশ্ন। ক্ষণেক চুপ থাকিয়া বলেন, “তাহলে সীতাদেবী, উর্মিলা, শ্রুতকীর্তি, এঁনারা কোথায় যেতেন?”
– জিও মেরে শাগির্দ। দ্যাটস দ্যা কোশ্চেন, ইউ মেড মাই ডে। সীতাদেবী বেগ পেলেই আমাকে স্মরণ করতেন। আমি তাঁকে এসকর্ট করে যমুনার তীরে এক জায়গায় নিয়ে যেতাম। তিনি রিলিফড হলে, আবার ওনাকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসতাম।
হিমাইবাবুর মনে আবার প্রশ্ন। “প্রভু, অযোধ্যায় সেই সময় যমুনা নদী? না সরযূ?
বিরিঞ্চিবাবা বিরক্ত হইলেন, “তখন দুটো নদীই অযোধ্যায় ছিলো। সীতাদেবী কখনও যমুনায়, কখনও সরযূ গিয়ে …… মানে ……”
– বুঝেছি গুরুদেব। বেগের রিলিফ। যেটা সামনে পেতেন।

অনন্ত বিরিঞ্চিবাবার অনুগত। তিনি সীতাদেবীর বেগ পাওয়ার ব্যাপারটা জানিতেন, কিন্তু গুরুদেবের এত সত্য বলিবার কি প্রয়োজন? এবং অনন্তর আশংকাই প্রমাণিত হইলো। হিমাইবাবু ঠিক সেই প্রশ্নটিই করিলেন, “তাহলে কি শুধুমাত্র বেগ পেলেই সীতাদেবী আপনাকে স্মরণ করতেন? অন্য কোন সময় নয়?”

বিরিঞ্চিবাবা এক্ষণে হিমাইবাবুর প্রশ্নে দিশাহারা। অনন্ত তখন গুরুর সন্মান রক্ষার্থে আসরে নামিলেন, “আসলে হনুমান বিরিঞ্চিবাবাকে সীতাদেবীর কাছে যেতেই দিতো না। শুধু সীতাদেবীর বেগ এলে যখন উনি সরযূপাড়ে যাবেন, হনুমান শুধুমাত্র সেই সময়ের জন্য আমাদের বাবাকে সীতাদেবীর কাছে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলো।“

হিমাইবাবু দিশাহারা। এ কেমনে সম্ভব? সীতাদেবী শুধুমাত্র বেগ অনুভব করিলেই বিরিঞ্চিবাবাকে স্মরণ করিবেন? অন্যসময় নয়?
পুনরায় কৌতুহলী প্রশ্ন, “বাবা, সীতাদেবীর সাথে আপনার কিরকম কথা হতো?”
দূর হইতে অনন্ত ঈশারা করিতেছে। বিরিঞ্চিবাবা সঙ্কেত বুঝিয়া বিরক্তস্বরে কহিলেন, “তোদের এ ছাড়া কি আর কোন প্রশ্ন নেই?”
– আচ্ছা, একটাই শেষ প্রশ্ন। রামায়ণের কোন নারীচরিত্রের সাথে আপনি সবথেকে ঘনিষ্ঠ ছিলেন?
বিরিঞ্চিবাবার তৎক্ষণাৎ উত্তর, “মন্থরা। মন্থরা। মন্থরা। সেই আমার জীবনের প্রথম ইনসপিরেশন, আমার প্রথম চুল্লুর পার্টনার ছিলো ঐ মন্থরা।
উপস্থিত সকলেই বাকরুদ্ধ। সমস্বরে বলিলেন, “মন্থরা?”

অনন্তর চোখে জল। বিরিঞ্চিবাবা এসব ঐতিহাসিক সত্য কেন বলিতেছেন?
বিরিঞ্চিবাবাও বুঝিয়াছেন, সকল সত্য ভক্তসমক্ষে বলিবার প্রয়োজনই ছিলো না। পরিবেশ গম্ভীর হইয়া গেলো। বিরিঞ্চিবাবার অনুপ্রেরনা মন্থরা? ভক্তগণ বিহ্বল। কি করিবে, কি বলিবে স্থিরতা নাই। পাতিবাবু করজোড়ে অনুরোধ করিলেন, “গুরুদেব, আপনি বলেন। মূর্খদের প্রলাপে কান দিবেন না।“

বৈচিগ্রাম হইতে মিঃ মল্লিক আসিয়াছেন। কহিলেন, “গুরুদেব। প্রতি রবিবারে সরোবর তীরে আপনার আশ্রমে যে ভক্তরা আসে, তাঁরা কি সকলেই ইঞ্জিনিয়ার?”
– কে বলে রে ওরা সকলেই ইঞ্জিনিয়ার? একজন চিকিৎসক তো নিয়মিত আসেন। আমি বছর খানেক আগে আমার ভক্তদের সাথে সামান্য কয়েক ঘন্টার জন্য একসাথে পড়াশোনা করেছি। তখন থেকেই ওঁরা আমার ভক্ত।
উপস্থিত প্রশান্তবাবু গণিতশাস্ত্রের সেরা ছাত্র ছিলেন। তাঁহার অঙ্কে তো ইহা মিলে না! “বিরিঞ্চিবাবা। এঁরা তো বছর খানেক আগে নয়, একান্ন বছর আগে একসাথে পড়াশোনা করেছে। আর কয়েক ঘন্টা নয়, পুরো পাঁচ পাঁচটি বছর।“
– আরে, তোদের একান্ন বছর মানে আমার সাড়ে এগারো মাস। আর তোর পাঁচ বছর মানে আমার আড়াই ঘন্টা। আমার ঘড়ি তোর ঘড়ির সাথে মিলবে না।

বানুবাবুর মনে এখন বদ্ধমূল ধারণা যে, সেই একান্ন বছর আগে তিনিও ছিলেন। “গুরুদেব। যদি দয়া করে বলেন, কোথায় একসাথে পড়াশোনা করেছিলেন?”
– তুই কে? বানু? আমি তো তোকে দেখেই চিনেছি। আরে সে এক কাহিনী। খড়গপুর আইআইটি আমাকে ডাকছে, আর আমি সেই ডাক উপেক্ষা করে গঙ্গার পাড়ে তেরো নম্বর বাড়িতে এসে উঠলাম। সেখানেই পরিচয়। সেখানে কামদেবের বরপুত্র প্রফেসর সমকামীর সাথে আমার পরিচয় হলো। সে নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেখানেই অর্শ চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করলাম। তারপরেই তো নারদ আমাকে চিকিৎসক লোধ উপাধি দেয়।
– সেটা কি ডিবির আমলে?
– কে ডিবি?
– বিরিঞ্চিবাবা, ডিবি মানে তখন উনি আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন।
– ওহো, ডিবি। ডিবি। ওনার আসল নামটাই আমার মনে নেই। আমি তো পড়েছি কনফুসিয়াসের কলেজে। কিছুদিন গ্যালিলিওর কাছেও ছিলাম। সে তো পিসায় গিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হলো। আমিই বুঝিয়ে সুজিয়ে তাঁকে গ্রহনক্ষত্রের ব্যাপারে উৎসাহ দিলাম। সেই আমার বন্ধু, আমার প্রিন্সিপালও বলতে পারিস। আমি মহাকাশ গবেষণায় যা কিছু জেনেছি সবই তাঁর জন্য।

কাজাবাবু মিনতি করিলেন, “আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে আমরা যে আপনার বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলাম, সেই সৌভাগ্য কি আর হবে না?”
– আরে আমার তো সবই এক একটি বিশ্বরূপ। কোনটার কথা বলছিস?
– বিরিঞ্চিবাবা, সেই যে ভাস্কর ভৌমিক যখন প্রথমদিনে আশ্রমে এসেছিলো।
– ও হো, সেই ব্যাপার? আরে আমার ভক্তদের প্রবল অনুরোধে সেদিন আমি ধরায় অবতীর্ন হয়ে আমার সৌম্যরূপ দেখিয়েছিলাম।
– সেটা আপনার সৌম্যরূপ ছিলো?
– অবশ্যই। তাহলে আমার পরম বন্ধু আর্কিমিডিস, হর্ষবর্ধন এঁদের কি বলবি? এরাও তো রাস্তায় সেইভাবেই অবতীর্ন হয়েছিলো।

উপস্থিত অনেকেই অনুরোধ করিলেন, “বিরিঞ্চিবাবা, আরেকটিবার কি আপনি ধরায় নেমে আসতে পারেন না? একেবারেই অসম্ভব?”
– তাহলে এক কাজ কর। সরোবর তীরে একদিন চুল্লু খেতে আয়। আমি তো তোদেরকে কাব্য লিখে আমন্ত্রণ করেছিলাম, তোরা কেউ এলি না।
হিমাইবাবু’র কৌতুহল, “কোন কবিতা, আই মীন কাব্য?”
বিরিঞ্চিবাবা অনন্তকে আদেশ দিলেন, “কবিতাটা শুনিয়ে দে।“
অনন্ত উঠিয়া একবার বিরিঞ্চিবাবাকে নমস্কার করিয়া পাঠ করিলেন।
“অনেকেরই গাত্র জ্বালা,
চুল্লুতে যে বঞ্চিত হালা!
লেকের পাড়ের মিষ্টি হাওয়া,
তার সাথে ফিসফ্রাই খাওয়া!
ফিরবে না যে সেদিন আর;
দূর থেকে তাই গালি পাড়!”
পাঠশেষে বিরিঞ্চিবাবা বলিলেন, “ এটা একদম তিন মিনিটে নামানো অরিজনাল মাল। আমিই এডিট করেছি। এরকম চার পাঁচটা আছে। আমাদের ম্যাগাজিনেও একটা বেরিয়েছিল।

সংযমীবাবু অনেকক্ষণ যাবৎ কিছুই বলেন না। উনার চরিত্রের স্বভাববিরুদ্ধ। বলিলেন, “বিরিঞ্চিবাবা, আমি সকালে উঠেই হোয়াটসএপে আপনার মহাকাশ গবেষনার পোস্টার দেখি, কিন্তু কিছুই বুঝি না। আপনি যদি সহজ করে কিছু বলেন।“
– সহজ করে? মহাকাশ গবেষণা? আরে তোদের হোমি ভাবা, সারাভাই, কালাম এরাই আমার কথা বোঝে না, তুই কোথাকার কে রে?
– না বিরিঞ্চিবাবা, আপনি কিছু বিশেষ লাইন যেমন বোল্ড ক্যাপিটাল অক্ষরে দিয়ে থাকেন, সেরকম উল্লেখ থাকলে আমার বুঝতে সুবিধা হয়।

মিচকে চরিত্রের সুকান্তবাবু এখন নিশ্চিত যে বিরিঞ্চিবাবা ছাত্রবস্থায় উনার সহপাঠী ছিলেন। প্রশ্ন করিলেন, “বিরিঞ্চিবাবা, আপনার প্রিয় নারী কে?”
– ভুল প্রশ্ন করলি, ভুল। আমার প্রিয় কেউ নেই। আমিই ওদের প্রিয়। আর সে তো সংখ্যায় অনেক রে। গুণে শেষ করতে পারবি না। তখন তোদের যীশুও জন্মায় নি। ট্রয়ের হেলেন আমাকে খাতির করতো। ক্লিয়োপেট্রার বেডরুমে আমি যাতায়াত করতাম। সেই থেকে শুরু করে ডায়ানা স্পেনসর, আর এখনের টালিগঞ্জের তোদের নায়িকারা। যদি ছবি দেখাই, তাহলে তোরা তো শুধু দেখবি, জ্বলবি, আর লুচির মতন ফুলবি।

সুকান্তবাবু অন্য প্রসঙ্গে কহিঁলেন, “বিরিঞ্চিবাবা, আপনি তো সীতাদেবীকে…”
কথা শেষ হইলো না। বিরিঞ্চিবাবা রুদ্রমুর্তি ধারণ করিলেন। “আবার সেই সীতাদেবী? অনেক পুণ্যের ফলে আমি সেই অধিকার অর্জন করেছিলাম। আর তোরা সে নিয়ে তামাশা করছিস?”
অনন্ত উঠিয়া গিয়া বিরিঞ্চিবাবাকে শান্ত করিলো।
সুকান্তবাবু কহিলেন, “আমাকে ভুল বুঝবেন না। আসলে আপনি সীতাদেবী, হেলেন, ক্লিওপেট্রা, মন্থরা, ডায়ানা স্পেনসর এরকম সকল মহীয়সী……”
বিরিঞ্চিবাবা ইশারায় সুকান্তবাবুকে নিরস্ত করিলেন, “আরও দুজন ছিলেন, কুন্তী আর মাদ্রী। ওঁরা যখন আমাকে ডাক দিলো, আমি তখন সরযূর তীরে মন্থরার সাথে চুল্লুপান করছি। ওঁদের কল শুনতেই পারি নি। তারপর হস্তিনাপুরে গিয়ে শুনলাম, যে কারণে যে কাজে আমায় ডেকেছিলো, আমাকে না পেয়ে ধর্মরাজ, পবনদেব, ইন্দ্র, আর অশ্বিনী দুই ভাই সেই কাজটা করে চলে গেছে। আমি বললাম, এখন তো আমি এসে গেছি। তখন ভীষ্ম বলে, আমাকে ওয়েটিং লিস্টে রেখে দিয়েছে। যদি ভবিষ্যতে দরকার পরে, তাহলেই আমাকে ডাকবে।“
সুকন্তবাবু বিস্মিত, “আপনি ওয়েটিং লিস্টে? এও কি সম্ভব?”
– হ্যাঁ রে, ওয়েটিং লিস্ট। তবে ভেবে দ্যাখ, কুন্তী মাদ্রির ওয়েটিং লিস্টে আমি, সেটাই বা কতজনের হয়?
– বাবা, আপনি কি এখনও সেই ওয়েটিং লিস্টেই আছেন?
বিরিঞ্চিবাবা মৌণ। মুখমন্ডলে হতাশার ছাপ সুস্পষ্ট। সম্ভবত ওয়েটিং লিস্টের কারণে।

উত্তর সুকান্তবাবুর মনঃপুত হইলো না, মুখে স্মিত হাস্য। “তাহলে বিরিঞ্চিবাবা, আপনি হেলেন, ক্লিওপেট্রা, ডায়ানা স্পেনসর, কুন্তী, মাদ্রিকে ছেড়ে মিস্টার কোহলির সাথে ইডেন গার্ডেনের ঘাসে বসে হাওড়া গার্লস কলেজের মেয়েদেরকে দেবানন্দের গান শোনাতেন? এত অধঃপতন? আবার গানগুলোও আপনার নিজের সুরে।”
– দাঁড়া, মনে করতে দে, জীবনে এত এত ঘটনা সব মনে থাকে না।

বিরিঞ্চিবাবা চক্ষু মুদিলেন, সম্ভবত ইতিহাসের পাতায় চলিয়া গিয়াছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মুখে হাস্য, “ওটা ইডেন নয় রে, ওটা ছিলো বোটানিক্যাল গার্ডেন। সেইজন্যই ধরতে পারছিলাম না। হ্যাঁ, গাছের নীচে বসে কোহলি রবীন্দ্রসংগীত গাইতো, আর আমি দেবানন্দের গান গাইতাম।“
মিচকে সুকান্তবাবু হাল ছাড়িবেন না। “কিন্তু বাবা, সেই জনপ্রিয় গানগুলো আপনি নিজের সুরে কেন গাইতেন?”
– জিও মেরে শাগির্দ, ইউ মেড মাই ডে।
সুকান্তবাবু কিছুই বুঝিলেন না, ইহা প্রশংসা, না ধিক্কার?
– বাবা, শুনেছি, গান গাইবার সাথে সাথে আপনি বসে বসে প্রচুর ঘাসও ছিঁড়তেন?
– জিও মেরে শাগির্দ, ইউ মেড মাই ডে।
– শকুন্তলাও তো আপনার সাথে যমুনা তীরে নৌকায় কি সব যেন করতো।
– জিও মেরে শাগির্দ, ইউ মেড মাই ডে। তবে এরকম কিছু নয়। ভুল শুনেছিস। শকুন্তলার সাথে আমার একেবারেই অন্যরকম সম্পর্ক ছিলো। একবার বিক্রমের সভায় কালীকে বললাম
– কালী? মানে মা কালী?
– বিক্রমের নবরত্ন সভায় মা কালী? তোর কি মাথাটা গেছে?
– মাফ করবেন বিরিঞ্চিবাবা বুঝতেই পারিনি।
ক্ষণেক মৌন থাকিয়া বিরিঞ্চিবাবা কহিলেন, “সেই কালীকে বললাম, যে শকুন্তলার কথা কিছু লেখ। তারপরই তো সে অভিজ্ঞানশকুন্তলম লিখলো। কিন্তু ব্যাটা লিখলো সংস্কৃত ভাষায়। তারপর সেই কালীই আমাকে সংস্কৃত শেখালো।“

আসানসোলের হারাধনবাবুর মনে এক প্রশ্ন, “বাবা, আপনার এখনের বয়স কত?”
– কেন রে? আমার বয়স নিয়ে কি করবি?
– তবুও বাবা, যদি বলেন।
বিরিঞ্চিবাবা কয়েক মুহুর্তের জন্য ধ্যানমগ্ন হইলেন। “সময় নিলাম রে। শ্রীকৃষ্ণকে বললাম, ভক্তরা আমার বয়স জানতে চাইছে। সে বললো, বলে দাও। তাহলে শোন, আমার বয়স এখন উনসত্তর চলছে।“
গণিতের সেরা ছাত্র প্রশান্তবাবুর এবারও হিসাব মিলে না। “প্রভুজী, আপনার একান্ন বছর মানে সাড়ে এগারো মাস। আর আপনি যদি বাল্মিকীর সময়ের হোন, তবে তো আমার অঙ্ক মিলছে না।“
– বাব্বা, এই বিদ্যে নিয়ে তুই ইয়ারের ফার্স্ট বয়? টিএম তোদের এই অঙ্ক শিখিয়েছে? লিপ ইয়ারটা ধরলিই না? তোদের পঞ্চাশ বছর মানে আমার সাড়ে এগারো মাসের কিছু কম। লিপ ইয়ার ধরে এবার হিসেব করে নে।“
প্রশান্তবাবু ব্যাথিত হইলেন। সত্য তো! জীবনে কত কঠিন কঠিন অঙ্কের সমাধান করিলেন, অথচ এই সামান্য লিপ ইয়ারটি খেয়াল করেন নাই?

মিস্টার গার্ডারানন্দর প্রবল জানিবার ইচ্ছা, “বিরিঞ্চিবাবা, আপনার প্রপিতামহ নামটা কখন হলো?”
– প্রপিতা নয়। পোপিতা, পোপিতা, পোপিতামহ। তোদের ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা’রা আমার নাতির নাতিকে প্রপিতামহ বলতো। বাংলায় তোর পঞ্চাশ পুরুষ আগের গুরুজনকে কি নামে ডাকবি? অভিধানে আছে? নেই। তাই প্রিয়জনেরা বয়স আন্দাজ করতে না পেরে পোপিতামহ নামেই ডাকে।

হিমাইবাবু যোগ করিলেন, “কিন্তু বিরিঞ্চিবাবা, পশ্চিমবঙ্গের বিগত নির্বাচনের আগেই আপনি যে পলিটিকাল এনালাইসিস ও প্রেডিকশান করেছিলেন, বা মন্ত্রীসভা গঠনের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, সেটা তো হলো না।“
শরদিন্দুবাবুও ভক্তমন্ডলীতে ছিলেন। তিনি যথেষ্টই মনঃক্ষুণ্ণ। “বিরিঞ্চিবাবা, আপনার কথায় আমি সব ঘটিবাটি বেচে দিয়ে এলআইসি’তে ইনভেস্ট করে আমার তো অনেক লোকসান হয়ে গেলো।“
সুকান্তবাবু কহিলেন, “আমি তো আগেই বলেছিলাম, তোকে সাঁইবাবা মন্দিরের বাইরে গিয়ে থালা নিয়ে বসতে হবে, তখন আমার কথা শুনলি না।“

পিছনে নারদ খান অনেকক্ষণ ঝিমাইতেছিলেন। হটাৎ বলিয়া উঠিলেন, “তোর কতগুলো জুতো আছে রে?”
উপস্থিত জনতা হতভম্ব। চাপা গুঞ্জন। বিরিঞ্চিবাবা বরাভয় দিয়া কহিলেন, “শান্ত, শান্ত। আশ্চর্য হোস না। অযোধ্যার সেদিনের মিটিং এ এই লোকটাও ছিলো। নারদ। আমি সেই সভায় ওঁকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলাম। সেই যে জুতো ছূড়েছিলাম, সে অভ্যাসটাই এখনও রয়ে গেছে।“
এখন ভক্তগন বুঝিলেন কেন বিরিঞ্চিবাবা এত জুতো ছোঁড়াছুড়ি করেন।

ম্যাডাম অপর্ণা (পুং) বলিলেন, “বাবা, লোকে কেন আপনাকে ডন বলে?”
বিরিঞ্চিবাবা মৃদু হাসিলেন, “এটা ঐ ম্যাগুয়েলের কাজ। সাত কি সাড়ে সাত বছর আগে বলে সে আমাকে নিয়ে গল্প লিখবে। আমি বললাম, তাহলে লেখ। সেই থেকে ইউরোপের ভক্তরা আমাকে ডন নামেই ডাকে।“
ম্যাডাম অপর্ণা (পুং) কিছুই বুঝিলেন না। “বুঝলি না? সারভানটেসের বই পড়িস নি? উইন্ডমিল, কুইক্সোট আর স্যাঙ্কো? সেই স্যাঙ্কোই তো তোর রুমমেট ছিলো রে?”
ম্যাডাম (পুং) এতক্ষণে বুঝিলেন। ডন কুইক্সোট।
আর প্রশান্তবাবু হিসাব করিলেন, বিরিঞ্চিবাবার সাড়ে সাত মাস, অর্থাৎ প্রায় চার’শ বছর আগে।
মিস্টার কাজা বলিলেন, “আর বিস্বম্ভর নামটা?”
– হ্যাঁ, গত এক ঘন্টা ধরে এটাও শুনছি। কে যে এই নামটা দিলো বুঝতেই পারছি না।
প্রশান্তবাবু হিসাব করিলেন, এক ঘন্টা, অর্থাৎ প্রায় সপ্তাহখানেক আগে বিরিঞ্চিবাবা নতুন উপাধি অর্জন করিয়াছেন, বিশ্বম্ভর।

তকাবাবু বহুক্ষণ শুনিতেছেন, কিছুই বোধগম্য হয় না। বলিলেন, “তোরা কিসের আলোচনা করছিস?”
সোহমবাবু কহিলেন, “ওরে, এসব তোর ডমেইন নয়। বিরিঞ্চিবাবার অগাধ জ্ঞান। শেয়ার, ফাইনান্সিয়াল, মহাকাশ, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, মেডিক্যাল সায়েন্সের আবিস্কার, ফুসফুসের কর্মদক্ষতা, সুরা বিবর্তন, যৌন বিজ্ঞান, টালীগঞ্জের নায়িকা, এসব বিষয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের দিকনির্দেশ করেন।“

তকাবাবু একজন খ্যাতিমান তৈলবিশারদ, বিরিঞ্চিবাবার এই মূল্যহীন বিষয়ে উনার কোন উৎসাহ নাই।

বিরিঞ্চিবাবার ধারণা হইলো, সোহমবাবু তির্যক মন্তব্য করিয়াছে। অসহিষ্ণু হইয়া উত্তর দিলেন, “ওরে মূর্খ। আমি ক্লাস না করেও তোদের টিএম এর সেরা ছাত্র ছিলাম। তোদের ক্রিকেটার অম্বরের সাথে বাড়ির ছাদে টেনিস বলে ফুটবল খেলেছি। ইডেন ক্লাব হাউসে পঙ্কজ আমার পাশে বসে ক্রিকেট দেখতো।“

এমন সময় লেটো মহারাজ নিজের মোবাইল ফোনটি দিয়া বলিলেন, “প্রভু, আমেরিকা থেকে বিশু বলছে চুল্লু পার্টি করতে চায়। আপনার আশীর্বাদ চাইছে।“
– কে? আমেরিকার বিশু? মানে সিভিলের বিশু চক্রবর্তী। দশ নম্বর বাড়ির? না না না না, বলে দে, বলে দে, আমি এখন ব্যাস্ত। ভীষণ ব্যাস্ত। এখন আমি কথা বলতেই পারবো না।
মনে হইলো বিরিঞ্চিবাবা অস্বস্তি বোধ করিতেছেন।

আলোচনা আরও চলিত। বিরিঞ্চিবাবা দেখিলেন দূর হইতে একজন আসিতেছেন। “মরেছে। এবার তো এই ব্যাটা এসে জানতে চাইবে কবে বকেয়া ডিএ পাবে? ওরে লেটো, তোর ইলিশ কতদূর? ভাজাগুলো তাড়াতাড়ি কর রে লেটো। আমাকে অন্য ভক্তদের কাছেও যেতে হবে। চল রে স্যাঙ্কো, তৈরি হয়ে নে।“
ভক্তদের বলিলেন, “আজ আর নয়, আবার পরে একদিন। তোরা রবিবারে সরোবর তীরে আসিস না কেন? চলে আয়, হাফ দামে চুল্লু পাবি।“

সমবেত ভক্তগণ জয়ধ্বনি দিলো, “জয় বিরিঞ্চিবাবার জয়, জয় বিশ্বম্ভরের জয়।”

 

Sahityika Admin

1 comment

  • এটা বিরিঞ্চিবাবা দুই।
    আদি গল্পের আদলে সুন্দর উপস্থাপনা, এবং গল্পের মৌলিকত্ব বজায় রয়েছে।
    দুটি ছবিই সুন্দর সংযোজন হয়েছে।