আমার ফুটবল, আমার ক্রিকেট
সুব্রত চ্যাটার্জি (চাটু), ১৯৭৭, মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমাকে কেউ যদি ছোটবেলা প্রশ্ন করতো আমি বড় হয়ে কি হতে চাই, আমার উত্তর ছিলো ফুটবল খেলে নাম করবো। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি রাস্তায়, স্কুলে, মাঠে, ময়দানে ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছি। এই ক্লাব থেকে ঐ ক্লাব আমাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। বড়ই আনন্দের ও স্বপ্নময় ছিলো সেই ছোটবেলার দিন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় অন্যরকম। হায়ার সেকেন্ডারির পর আমার রাস্তায় মাত্র দুটো পথই খোলা ছিলো, হয় ফুটবল খেলো, নয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। সেই ৭২ সালে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ফুটবল খেলে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অত সহজ ছিলো না। বড় ক্লাবের প্লেয়াররা নিজেদের দক্ষতা আর ক্লাবের সুপারিশে রেল, ব্যাংক, বা অন্য কিছু একটা সরকারী চাকরী পেয়েই যেতো। কিন্তু সে ছিলো হাতে গোনা। বাকি অধিকাংশই তারপর নিরুপায় হয়ে বেকার জীবনের স্রোতে ভেসে যেতো।
আমি যে পরিবার থেকে আসছি, সেখানেও রিস্ক নেওয়ার উপায়ই ছিলো না। তাই ফুটবল ছেড়ে আমি শিবপুর বিই কলেজে এসে ভর্তি হলাম। তারপর বিই কলেজের লোকজন আমাকে চিনলো চাটু নামে। পরিচিতরা সবাই জানে, চাটু একজন প্লেয়ার, রোজ বিকেলে ওভালের মাঠে তাঁকে দেখা যায়। আজকের দিনে আমাকে সুব্রত চ্যটার্জি নামে কলেজের কতজন চিনবে সন্দেহ আছে। সেই যে ৭২ সালে চাটু নামটা চালু হয়ে গিয়েছিলো, আজ আমার ৬৬ বছর বয়সেও আমার বন্ধুরা আমাকে চাটু নামেই ডাকে, আমার বাড়ির লোকজন, গিন্নী, ছেলেমেয়েরাও সেকথা জানে।
স্পোর্টস আর আমি, একসূত্রে বাঁধা। আমার একদম ছোটবেলা কেটেছে নর্থ বেঙ্গলের ইসলামপুর শহরে। তখন আমি এতই ছোট যে আমার সেখানের কিছুই মনে নেই। বাবার ছিলো সরকারী বদলীর চাকরি। ছয় বছর বয়সে আমরা কলকাতায় চলে আসি, টালিগঞ্জ মুদিয়ালী অঞ্চলের প্রতাপাদিত্য রোডে। এসে বালীগঞ্জ জগবন্ধু ইন্সটিটিউশনে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলাম।
আমাদের স্কুলে ছিলো খেলার মাঠ, আর পাড়ায় ছিলো কর্পোরেশনের রাস্তা। রাস্তাটা মন্দ ছিলো না। প্রায় তিরিশ ফুট চওড়া, পিচঢালা, মোটামুটি খানাখন্দ নেই, গর্ত কম। রাস্তা খারাপ হলে কর্পোরেশন এসে ঠিক করে দিয়ে যেতো। এতে পথচারীদের যেমন সুবিধে, তেমনি আমাদের খেলারও সুবিধে। কর্পোরেশনের রোড রোলার এলে বলতাম প্লিজ আমাদের রাস্তার ক্রিকেটের পিচটাও সমান করে দিয়ে যাও। আমাদের ধারণা ছিলো, রোলার চালালেই ভালো পিচ তৈরি করা যায়, সে ইডেন গার্ডেনই হোক, বা টালিগঞ্জের পিচের রাস্তাই হোক। আমাদের গর্ব হতো, ইডেনের মাঠে রোলার চলে, আর আমাদের পাড়ার রাস্তার পিচেও রোলার চলে। তবে ফুটবল খেলার জন্য অত পিচের বালাই ছিলো না। টানা ৬০ মিটার মতন লম্বালম্বি একটা রাস্তা জুড়ে রোজ বিকেলে আমাদের সাতজন সাতজনের টিমের ফুটবল খেলা হয়ে যেতো।
এই পাড়ার রাস্তাতেই আমার খেলার শুরু। রাবারের বল দিয়ে, সে ফুটবল হোক, বা ক্রিকেট। পাড়ায় তিন-চারটে গ্রুপ ছিলো; একদম ছোট (স্কুলের থ্রি থেকে ফোর বা ফাইভে পড়ে, সেই বয়সী) যাদের সবে রাস্তায় নেমে খেলার হাতেখড়ি হয়েছে, এরপরের দলে তাঁর উপরের বয়সী (স্কুলের ক্লাস ফাভ সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত) আর একটু সিনিয়র (ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেন)। পাড়ার দাদারা কলেজে উঠে গেলে, বা চাকরী পেয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেললেও ফুটবলের আসরে আর নামতো না। আমাদের কোন গ্রুপেই এত সমবয়সী ছেলে ছিলো না, যে রোজ বিকেলে দুটো টিম তৈরি হয়। তাই দুই গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে রোজকার খেলা হতো। অনেক সময় আমাদের দুই গ্রুপের মধ্যে ম্যাচ হতো। যখন আমাদের পাড়ার সাথে আশেপাশের অন্য পাড়া বা ক্লাবের ম্যাচ হতো তখনও মিলিয়ে মিশিয়ে টিম তৈরি হতো।
ক্রিকেটের একদম শুরুতে আমরা সবাই ছিলাম অল-রাউন্ডার। তবে আমার ভালো লাগতো ব্যাটিং। বোলিং করেছি, কিন্তু ব্যাটসম্যান হলে স্ট্যাটাসটা বেড়ে যেতো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাড়ার স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান হয়ে গেলাম। মোটামুটি ওপেনার জায়গাটা আমার পাকা ছিলো। তবে টিমের প্রয়োজনে কখনও ওয়ান ডাউন, বা ট্যু ডাউনও নেমেছি।
অন্যদিকে পাড়ার ফুটবলে আমি ছোটবেলায় শুরু করি ফরোয়ার্ডের প্লেয়ার হয়ে। ভালোই খেলতাম, টুকটাক গোলও করতাম। ধীরে ধীরে নিজেই বুঝতে পারতাম যে ক্রিকেটের থেকে ফুটবলেই আমি বেশি উৎসাহ পাচ্ছি। বলের উপর আমার ভালোই কন্ট্রোল তৈরি হচ্ছে। আমি নিজেও সেরকম মন দিয়ে খেলছি।
আমার বয়স যখন ১২-১৩, ক্লাস বা ফাইভ সিক্সে পড়ি, এক যোগসূত্রে লেকের মাঠে খেলা শুরু করলাম। ওখানে কলকাতার তখনকার সময়ের ফুটবলার তৈরির বিখ্যাত ক্লাব মিত্র সম্মিলনীর প্রাকটিস ম্যাচ হতো। আর কলকাতা ময়দানের বড় ক্লাবের অনেক নামী প্লেয়ার সেই মিত্র সম্মিলনী থেকে উঠে এসেছে। সেই মিত্র সম্মিলনীর অন্যতম “রিক্রূটার” খোকনদা আমার খেলা কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছিলেন। আমি সেকথা জানতাম না। একদিন খেলার পরে আমায় ডেকে ওনার ক্লাবে নিয়ে গেলেন। আগেই বলেছি, তখন আমার বয়স ১২-১৩। সুনীল ভট্টাচার্য তখন কলকাতার ইস্টবেঙ্গলের নিয়মিত ডিফেন্ডার। আমি সেই যুগের কথা বলছি যখন কলকাতা ময়দানের ডিফেন্সের নামগুলো জার্নেল সিং, নইম, চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ, শান্ত মিত্র, এনারা। সেইসময় খোকনদা আমাকে বললেন যে আমাকে আরেক সুনীল ভট্টাচার্য বানাতে চান। আমার বয়স ১২-১৩, সেদিন খোকনদার সেই কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারিনি, কেমন যেন স্বপ্নের মতন মনে হয়েছিলো। আমি হবো সুনীল ভট্টাচার্য? আমি কাউকে একথা বলতেও পারছি না। আর, এখানেই শেষ নয়, উনি ক্লাবের সব্বাইকে বলতেনও যে আমাকে সুনীল ভট্টাচার্য বানিয়ে দেবেন। মিত্র সম্মিলনীর সেই খোকনদা গ্রাসরুট বা উঠতি প্লেয়ারদের জন্য খুব ভালো কোচ ছিলেন। তবে একটা বড় দোষ ছিলো। কথায় কথায় আমাদের অনেকেরই “ইয়ে”টা টিপে দিতেন। কেন করতেন জানি না, তবে করতেন।
অবশেষে বাড়িতে এসে বললাম, কারণ ভালো খেলতে হলে, খেলা শিখতে হলে সেখানে সময় দিয়ে প্র্যাকটিস করতে হবে। অর্থাৎ তখন আমি ছাত্র, ছোটবেলাতেই আমাকে ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে না জানিয়ে এটা সম্ভব নয়। কারণ আমার পড়াশোনার জন্য ধার্য্য করা সময় থেকে বেশ কিছুটা সময় খেলার জন্য খরচ হবে। কিন্তু আমি ভাগ্যবান, বাড়ি থেকে একটুও আপত্তি করে নি। তবে শর্ত ছিলো যে যতই খেলি, যেখানেই খেলি, সন্ধ্যার আঁধারের আগেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সুতরাং বলতে পারি, আমি বাড়ির পুরো সাপোর্ট পেয়েছিলাম।
ফুটবল খেলতে হলে আমার বুট চাই। বাবাই পয়সা দিলেন। ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমার মোড়ে দুটো দোকান ছিলো, সামুর আর ক্যালকাটা স্পোর্টস। আমি সামুর থেকে আমার প্রথম বুটজোড়া কিনেছিলাম।
এবার আমার নানান জায়গায় টুর্নামেন্টে খেলা শুরু হয়ে গেলো। বেশিরভাগই ৪’১০” আর ৫’২” আন্ডার হাইটের টুর্নামেন্ট। দক্ষিন কলকাতার নেতাজীনগর, আজাদগড়, বাঁশদ্রোনী, ভবানীপুর হরিশ পার্ক ও আরও অনেক জায়গায় সেইসময় প্রচুর চার-দশ আর পাচ-দুই এর টুর্নামেন্ট হতো। আমি চার-দশে আটকে যেতাম, তাই পাচ-দুই এর টুর্নামেন্টে আমার জায়গা পাকা করে নিয়েছিলাম। ছোট মাঠে সাতজন বা ন’জনের টিমের টুর্নামেন্টের খেলা হতো। আমার কাজ ছিলো গোল করা। আর সেইজন্যই বিভিন্ন ক্লাব আমাকে নিয়ে যেতো। অনেক গোল করেছি। অনেক টুর্নামেন্টের বেস্ট প্লেয়ারের প্রাইজও পেয়েছি।
বছর তিনেক আমি মিত্র সম্মিলনীতে খেলে দক্ষিন কলকাতার নবারুণ সংঘে ট্রান্সফার নিলাম। তখন আমার বয়স ১৫-১৬ মতন হবে। এই ক্লাবও তখন ময়দানের ভবিষ্যতের প্লেয়ার তৈরি করে। আর ময়দানে বড় বা মাঝারি ক্লাবের অনেক প্লেয়ার তখন এখান থেকে উঠে আসছে। একজনের নাম মনে আসছে, বিশ্বজিৎ দাস, নামী গোলকিপার ছিলেন। কলকাতা ময়দানের ক্লাব ফুটবলে আমার খেলা এখান থেকেই শুরু।
সেইসময়ের একদিনের কথা বলি। ৭১-৭২ সালের কোন একসময় আমি ক্যালকাটা ইউনাইটেডের হয়ে খেলি, আর সেদিন আমি ক্যাপ্টেনও। ময়দানের কালীঘাট মাঠে সোনালী শিবিরের সাথে খেলা। সেদিন অসম্ভব বৃষ্টি হয়ে মাঠ কাদায় ভরে গিয়েছিলো। কলকাতা ময়দানে এটা ছিলো খুবই সাধারণ ব্যাপার, হামেশাই হচ্ছে। আমরা সেদিন ৪-১ গোলে সোনালী শিবিরকে হারিয়েছিলাম, আর আমি নিজে হ্যাটট্রিক করেছিলাম। খেলার শেষে দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোক সেখানেই আমাকে ডাকলেন। একজন খিদিরপুরের শ্রী ভুতনাথ বিশ্বাস, অন্যজন কালীঘাটের শ্রী এন সি কোলে। দুজনেই তাঁদের নিজের নিজের ক্লাবের কর্নধার। আমি দুজনেরই পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। ভুতনাথবাবু সেখানেই আমাদের টিমের কোচকে বলে দিলেন যে আমাকে পরের বছরে খিদিরপুরে নিয়ে নেবেন। আর আমাকে বললেন, আমি যেন তখন থেকেই খিদিরপুরের বড়দের সাথে নিয়মিত প্র্যাকটিস শুরু করে দি।
আমি কয়েকদিন পরেই আমার ফুটবল কিট নিয়ে খিদিরপুরের প্র্যাকটিসে চলে গেলাম। স্যার অচ্যুৎ ব্যানার্জী তখন খিদিরপুরের কোচ। উনি আমার কিছু প্রিলিমিনারি টেস্ট নিলেন, এবং আমি পাশও করলাম। উনি বললেন যে আমাকে আরও কিছু স্টামিনা আর স্কিল বাড়াতে হবে, আর আমাকে টিমের বড়দের সাথে প্রাকটিস করার অনুমতি দিলেন। আমার বেশ কিছু ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন পরে আমার প্র্যাকটিস দেখে উনি আমাকে ডেকে একান্তে বলেছিলেন যে, আমার উন্নতি হচ্ছে। আমি যেন প্র্যাকটিস আর খেলাটা চালিয়ে যাই। তাহলে একদিন আমি খুব বড় প্লেয়ার হবো। অচ্যুত স্যারের সেই কথাটা আমার আজও কানে বাজে। আমি খিদিরপুরের বড়দের সাথে মন দিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম।
আগেই বলেছি। মানুষ ভাবে এক, আর হয় অন্যরকম। হায়ার সেকেন্ডারির পর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে সেই হাওড়া শিবপুর থেকে রোজ খিদিরপুর মাঠে গিয়ে প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে পারিনি। তবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অচ্যুত ব্যানার্জির সেদিনের কথাগুলো আমার খেলার সেরা সার্টিফিকেট হয়ে রয়েছে। ১৯৭২ সালে শিবপুর বিই কলেজে চলে এলাম, এবার আমাকে হস্টেলে থাকতে হবে। আর সেই সঙ্গে আমার কলকাতা ময়দানের সাথে যোগটাই কেটে গেলো। সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস, সকাল ৭ টা থেকে। পাঁচদিন বিকেল চারটে পর্যন্ত, এই রুটিন মানতে হলে কলকাতার ময়দানে গিয়ে কখন আর প্র্যাকটিস করবো?
বিই কলেজে তখন খেলাধুলার প্রচুর সুযোগ, সেখানেই নিজেকে সঁপে দিলাম। প্রথম থেকেই ওভাল মাঠে নিয়মিত খেলতে শুরু করে দিলাম। আমাদের সেশন শুরু হয়েছিলো ডিসেম্বরে, তাই এথলেটিক্স আর ক্রিকেট দিয়েই সেখানে আমার খেলাধূলার শুরু। একদিন বিকেলে ওভালে গিয়ে দেখি এন্যুয়াল স্পোর্টসের লং জাম্পের ফাইন্যাল চলছে। আমিও নাম দিয়ে দিলাম, আর মেডেলটাও পেয়ে গেলাম।
এরপর নোটিশ এলো কিছুদিন পরেই ফ্রেশার’স ওয়েলকাম ক্রিকেট ম্যাচ হবে, ফ্রেশারস বনাম রেস্ট অফ দ্যা কলেজ। আমরা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরা নেট প্র্যাকটিসে নেমে পড়লাম। প্রাকটিস শুরু হতো বিকেল চারটে থেকে, মধুসূদন বিল্ডিং এর সামনে। আমি, সোমনাথ চ্যাটার্জি, রঞ্জন চ্যাটার্জি, সিদ্ধার্থ চৌধুরী, তপন ঘোষ, দীপঙ্কর সরকার, সুকান্ত রায়, সুহাস বসু, শেখর বসু, শরদিন্দু দে, দীননাথ সান্যাল, অমৃতাভ রায়, অলক বিশ্বাস, আর আরও অনেকেই নেটে নামলাম। আজ পঞ্চাশ বছর বাদে সবার নাম মনে করতে পারছি না। মোটামুটি দিনকয়েক পরেই টিম তৈরি হয়ে গেলো, আমি হলাম টিমের ক্যাপ্টেন।
আর ওদিকে তখন হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট লীগের ফুটবল টিম সহযাত্রী আমাদের বিই কলেজের মাঠের এক কোনায় নিয়মিত প্র্যাকটিস করতো। আমাদের সাথে সহযাত্রীর ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ওরা সবসময় আমাদের কলেজের কিছু ছেলেকে ওঁদের টিমে খেলার জন্য অনুরোধ করতো। সেই সূত্রে আমি সহযাত্রীর সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম। পরে সেই টিমের হয়ে হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট লীগের অনেক ম্যাচও খেলেছি।
সুতরাং আমার ফুটবল, আর ক্রিকেট দুটোই সমান তালে চলতে শুরু করলো। হবে না কেন? খেলাধূলার এমন সুযোগ ক’টা কলেজ দিতে পারে? আর মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর হস্টেলে ব্রিজ খেলতাম।
আমি প্রথম বছর থেকেই কলেজ টিমে খেলার সুযোগ করে নিয়েছিলাম। তখন বিই কলেজের ক্রিকেট আর ফুটবল দুটোই বেশ শক্তিশালী টিম। সেখানে নিজের জায়গা করে নেওয়া অত সহজ ছিলো না, কিন্তু আমি পেরেছিলাম। এরপর তো পাশ করে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত রাইট মিডফিল্ডে আমার জায়গায় আর কেউ আসতেই পারেনি। কলেজ টিমের হয়ে ফুটবলের বেশ কিছু ম্যাচের স্মৃতি আমার মনিকোঠায় এই পয়তাল্লিশ বছর পরেও উজ্জ্বল হয়ে আছে। আইআইটি খড়গপুর, মেরিন, যাদবপুর, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল, শান্তিনিকেতন এইসব ম্যাচগুলো আজও মনে পড়ে। শান্তিনিকেতনে আমরা হেরে গিয়েছিলাম। আর সেইসময়ের যাদবপুরের সাথে হাড্ডাহাডি লড়ে ড্র করেছিলাম। যাদবপুর সেদিন কলকাতা সিনিয়র ডিভিশনের তিনজন প্লেয়ার মাঠে নামিয়েছিলো।
৭৭ সালে যাদবপুরে গোপাল সেন ট্রফির আগে তখনের কলেজ ক্যাপ্টেন বাদল কয়েকদিনের জন্য অচ্যুত স্যারকে ডেকে আনে। উনি প্রায় সপ্তাহখানেক লর্ডস মাঠে আমাদের প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন। মনে আছে, ফিজিক্যাল ফিটনেসের সময় সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। আমাকে রাখতেন সবার সামনে।
কলেজ ফুটবলের কয়েকজনের কথা মনে পড়ে। যেমন মানস রায় (১৯৭৩), জনি’দা (জ্ঞানরঞ্জন ভৌমিক, ১৯৭৩), আর আমাদের ব্যাচের তপন ঘোষ, সোমনাথ চ্যাটার্জী, বাদল মোদক, দেবব্রত গুহ, অরূপ মিত্র, আর স্বপন ব্যানার্জী (গোলকিপার)।
ফুটবলে আমি কয়েকজনের প্রশংসা পেয়েছি। সহযাত্রীর সাথে প্রাকটিসের সময় মোহনবাগানের সুব্রত চ্যাটার্জী বলেছিলো, আমার নাকি স্কিল লগ্নে জন্ম হয়েছে। যাদবপুরে খেলতে গিয়ে তখনের মোহনবাগানের কোচ অরুণ সিনহাও আমার খেলার প্রশংসা করেছিলেন।
বিই কলেজের পাশেই দানেশ শেখ লেনের টুর্নামেন্ট হবে। ওরা কলেজে এসে আমাদের সেরা প্লেয়ারদের নিয়ে একটা টিম তৈরি করে নিলো। তখন আমি ব্যাক্তিগত কারণে বাড়িতে। ফিরে আসতেই অন্য একটা টিম আমার সাথে যোগাযোগ করে, আর আমিও রাজি হয়ে যাই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, ফাইন্যালে আমরাই আমাদের কলেজের অন্য টিমটাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
এবার ক্রিকেটে আসি। কলেজের ক্রিকেটে দু’জনের নাম খুব মনে পড়ে, মলয়’দা আর পার্থ’দা। আমাদের থার্ড ইয়ারেই পার্থ’দা (১৯৭৬ ব্যাচ) তখন ক্রিকেট ক্যাপ্টেন। কলকাতার একটা কম্বাইন্ড টিমের সাথে খেলা হচ্ছিলো। আমি সেই ম্যাচে ওপেনার নেমে ৪৯ নট আউট ছিলাম। প্রতিপক্ষের ইস্টার্ন রেলওয়ের পেস বোলার খেলার শেষে বলেছিলো, আমরা আমাদের টিমের জন্য একজন ব্যাটসম্যান পেয়ে গেছি।
আমি কলকাতা সিএবি ক্রিকেট লীগে ইউনিয়ন স্পোর্টিং এর হয়ে খেলেছিলাম। কোয়ার্টার ফাইন্যালের একটা খেলা হয়েছিলো ইডেন ময়দানে। ফিল্ডিং করছিলাম কভারে। সেদিন ব্যাটসম্যানের একটা কভার ড্রাইভের দুর্ধষ ক্যাচ নিয়েছিলাম, আজও মনে আছে।
ফুটবল ক্রিকেট ছাড়াও আমি কলেজের এথলেটিক্স ক্লাবের বিভিন্ন এডমিনিস্ট্রেটিভ দায়িত্বেও ছিলাম। আমার থার্ড ইয়ারেই আমি এথলেটিক্স ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলাম, আর কলেজ মিট করেছিলাম। পরে ফুটবল আর ক্রিকেটের ক্যাপ্টেনও হয়েছিলাম। ইয়ার মনে নেই, এন্যুয়াল স্পোর্টসে স্টাফ-স্টুডেন্ট ডিপার্টমেন্টাল রীলে রেসে আমরা জিতেছিলাম। আমাদের টিমে সোমনাথ ছিলো স্টার্টার, আমি, আর ফিনিশিং এ ছিলেন আমাদের হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট প্রফেসর অরুণ শীল।
বিই কলেজের কয়েকজন প্রফেসরের কথা উল্লেখ না করলে আমার পাপ হবে। প্রথমেই বলি প্রফেসর ভুপাল দত্তের কথা, যিনি আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আর বলবো প্রফেসর যাদবলাল চক্রবর্তী, প্রফেসর পিপি দাস, আর প্রফেসর শোভেন রয়ের কথা। আমাদের প্রতিটি ম্যাচে দেখতাম ওনারা ওভালের মাঠে ঢুকতেই ডানদিকের সেই গাছের নীচে চেয়ারে বসে আছেন। ওনাদের উপস্থিতি আমাদের বাড়তি অক্সিজেন জোগাতো। আর বলবো আমার ডিপার্ট্মেন্টের হেড প্রফেসর অরুণ শীলের কথা। আমি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলাম না। আর খেলার জন্য অনেক ক্লাস মিস হয়ে যেতো। উনি আমাকে আর সোমনাথকে ডেকে বলেছিলেন যে, খেলাধুলার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। খেলার প্রয়োজনে আমরা নিঃসংকোচে ক্লাস অফ দিতে পারি, কিন্তু শুধু ওনাকে যেন জানিয়ে রাখি। এতটাই উৎসাহ উনি আমাদের দুজনকে দিয়েছিলেন।
পাশ করে আমি যাদবপুরে মাস্টার্স এ ভর্তি হলাম। সেখানেও খেলার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেই চাকরী করতে করতে খেলা আর চালানো গেলো না।
এবার একদম শেষে খেলার বাইরের কিছু কথা বলি। এখানে সোমনাথ চ্যাটার্জীর প্রসঙ্গ এসে যাবে। আমরা দুজনেই মেটালার্জির। ফার্স্ট ইয়ারের শুরু থেকে একসাথে পাশ করা পর্যন্ত আমাদের দুটো নাম একসাথে উচ্চারিত হতো “চাটু সোমনাথ।“ সেই ৭২ এর চাটু সোমনাথ নাম আমার ব্যাচের প্রত্যেকে তো বটেই, অন্য ব্যাচের ছেলেরাও বলে। আজ পঞ্চাশ বছর পরে এখনও পরিচিতজনরা এই নামেই আমাদের জুটির উদাহরণ দেয়। এর সম্ভবত দ্বিতীয় উদাহরণ নেই।
আমি স্টাইল ভালোবাসতাম। অমিতাভ বচ্চন আমার আইডল। আমার চুলের স্টাইল পালটে গেলো। আমি বাঁদিকের কাঁধ সামান্য ঝুঁকিয়ে আগে বাঁ পা এগিয়ে হাঁটতাম। একদিন অসীম তার দাদার আমেরিকা থেকে আনা দারুণ একটা টিশার্ট খুঁজে পাচ্ছে না। পরদিন দেখে আমি সেটা পরে ঘুড়ছি। এরকম আরও কিছু কেস আছে, সব মনে পড়ে না। আর আমার বন্ধুরা ক্যাম্পাসের কিছু মেয়ের নাম নিয়ে আমায় খেপানোর চেষ্টা করতো। আমি কিন্তু মজাই পেতাম।
এবার শেষ করি। জীবনে ময়দানের বড় ক্লাবে আমার খেলা হয় নি। কিন্তু যা পেয়েছি, সেটাও কম নয়।
চাটু’র হাত থেকে লেখা বার করা???
সম্পাদকের ক্যালি আছে। মানতেই হবে।
তবে চাটুর লেখাটাও ভালো লাগলো, কলেজের অনেককিছু মনে পড়ে গেলো।