অমৃতকাহিনী
উত্তম খান, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
এর আগে কাশ্মীর ফাইলস লিখে কামদেবের কাছে হেবি ধ্যাতানি খেয়েছিলাম। ভ্রমণকাহিনীতে নাকি আরেকটু ডিটেইলিং করতে হয়। আমার লেখায় কামদেব আমাকে একশ’তে মাত্র পাঁচ নম্বর দিয়েছিলো। ওর ধ্যাতানি খেয়ে আবার লিখতে বসলাম।
অনেককাল হয়ে গেলো, কয়েকদিনের জন্য দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারি না। এককথায় কিছুদিনের জন্য শহর থেকে দূরে গিয়ে ছুটি কাটানো। আমার স্ত্রী শ্যামলীর হাঁটু ও শারীরিক সমস্যা, খুব একটা বেড়াতে চায় না। সুতরাং, ঠিক হলো, এবার আমি একাই কয়েকদিনের জন্য কোথাও যাবো।
কুন্ডু তীর্থ ও ভ্রমণ প্যাকেজের খবর পেয়ে সময় নষ্ট না করে হাইকোর্টের পাশে ওঁদের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিলাম দিনকয়েকের মধ্যে কোথাও একটা যাবো, কি কি প্রোগ্রাম আছে? জানলাম অমৃতসর প্যাকেজ আছে। সঙ্গে সঙ্গে টিকিটও হয়ে গেলো, তিনদিন বাদেই আগামী ২২শে এপ্রিল শিয়ালদহ থেকে একটি দল জালিয়ানওয়ালানবাগ এক্সপ্রেসে রওয়ানা দেবো। সঙ্গে কে কে যাবে, তাঁরা কিরকম জনতা হবে, এসবের কিছুই তখন আমি জানি না।
জালিয়ানওয়ালাবাগ এক্সপ্রেস শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে সকাল সাড়ে এগারোটায়। এসে দেখি আমাদের দলটা বেশ ছোট, আমাকে নিয়ে মাত্র তেরো জন। পরের দিন বিকেল চারটে নাগাদ আমরা অমৃতসর পৌছাবো। ষ্টেশনে আমার নিজের দলের বলতে আমি একাই। আশেপাশে অনেক লোকজন, অল্পবয়সী, মাঝবয়সী, প্রৌড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নানান রকমের লোকের ভীড়। বেশ কিছু পরিবার একত্রে যাচ্ছে। আমি একটু দূরে দূরেই। চেনা মুখ একটিও চোখে পড়ে না।
অনেক পরে দুজন এলেন। মা ও মেয়ে। মুখে মাস্ক, ভালো করে যে মুখখানি দেখবো, সেই সুযোগই নেই। ৬৭ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে বয়সটা মাপলাম। মেয়ের বয়স আন্দাজ ২৩-২৪ হবে, মার বলতে পারছি না, ৬৭ বছরের অভিজ্ঞতা কোন কাজেই এলো না। ওনারা মা মেয়ে একা একা যাবেন, অনভিজ্ঞতার একটু ভয় আছে। ভ্রমণ সংস্থার একজন এসব বোঝেন। ট্রাভেল এজেন্সির এক বাচ্চা ছেলে সামনে আমাকে পেয়ে জোর করে ওনাদের সাথে মৌখিক আলাপ করিয়ে দিলো, “কাকিমা, আরে এত লোকজন আছে, একদম চিন্তা করবেন না। এনার সাথে সাথে থাকুন। “
ট্রেনে আমার সীট পড়েছিলো সাইডে যে দুটি বার্থ থাকে তারই একটায়। দেখে সেই মা ও মেয়ে কুন্ডূ ট্রাভেলসের ছেলেটিকে ধরে আমার পাশের সীটে চলে এলো। মেয়েটি আমার মুখোমুখি, আর মা ঠিক পাশেই। আলাপ পরিচয়ে মেয়েটি জানালো ওর নাম কাবেরী। সে দু’বছর আগে বেথুন কলেজ থেকে সায়েন্স অনার্স নিয়ে পাশ করে এখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের লাইব্রেরীতে চাকরী করছে। মা একশ শতাংশ হাউসওয়াইফ। কাবেরী বলেছিলো চাকরী পেয়ে মাকে তীর্থদর্শন করাবে, তাই সে চলেছে মাকে নিয়ে। মা দেখলাম শান্ত চুপচাপ মানুষ।
ইতিমধ্যে কুন্ডুর ছেলেটি চা নিয়ে এসে চায়ের সাথে দু’মিনিটের একটা লেকচার দিয়ে সকলের সাথে দাদা, বৌদি, কাকা, কাকিমা, এরকম সম্পর্ক পাতিয়ে নিলো। আমি হয়ে গেলাম জেঠু। ছেলেটি কৈফিয়ত চাইলো জেঠিমা সঙ্গে নেই কেন? বললাম, কেন আসেনি। এবার আমি ওঁকে প্রশ্ন করলাম, আমি তোমার কাকু না হয়ে জেঠু কেন? সে আমাকে বুঝিয়ে দিলো, সত্তর বছর বয়স হলে দাদু, আর ষাট-সত্তরের মাঝখানে সবাই জেঠু। সেই যে সে আমাকে জেঠু বানিয়ে দিলো, এরপর সারা ট্রিপে আমি দলের সকলেরই জেঠু হয়ে গেলাম।
ছেলেটি চা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো, কাবেরী আরেকবার চা চাইলো। সুযোগ বুঝে আমিও আরেকবার নিলাম। “ভাই কিছু মনে করবে না, আমি কিন্তু ঘন ঘন চা খাই।“ ছেলেটি বলে, “আরে না দিদি, এই নিন” বলে আরেকবার চা দিয়ে চলে গেলো।
– জেঠু, আমার না, ঘন ঘন চা খাওয়ার নেশা হয়ে গেছে। কলেজে বিশ্বাস করবে না জেঠু, আমি দিনে সাত আট কাপ চা খাই।
এইটুকু সময়ের মধ্যেই কাবেরী তাঁর নতুন জেঠুর সাথে “তুমি” সম্পর্কে চলে এসেছে।
মেয়েটি সুন্দর কথা বলে, নানান বিষয়ে উৎসাহ আছে। “আসলে আমার লাইব্রেরিতে সায়েন্স ছাড়াও অনেক রকমের ম্যাগাজিন আসে, আমি সবগুলো পড়ি। ছোটবেলা থেকেই আমি স্কুল আর তারপর কলেজেও কুইজ চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। সেই জেনারেল নলেজের উৎসাহটা আজও ধরে রাখতে পেরেছি।“ আমি বললাম, “তাহলে তুমি কৌন বনেগা ক্রোড়পতিতে যাও না কেন?”
– না, কৌন বনেগায় আমার বিন্দুমাত্র যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ওটায় লোকেরা নিজেদের শো করতে যায়, বচ্চনজীকে সামনে থেকে দেখতে যায়, সেটাই উদ্দেশ্য। আমার সেটা ভালো লাগে না। আর বিশেষ করে প্রথম চার পাঁচটা প্রশ্ন তো এক্কেবারেই সাব স্ট্যান্ডার্ড। তবে বিবিসি মাষ্টার মাইন্ডে আমি সিরিয়াসলি যেতে চাই, কিন্তু ওঁদের এলিমিনেশন স্ট্যান্ডার্ডটাই অনেক উপরে।
বিবিসি মাস্টারমাইন্ড কুইজের ব্যাপারটা মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমি কিসুই জানি না। তবে আমি যে জানি না, সেটাও বুঝতে দিলাম না।
ট্রেন চলছে। দুপুর দেড়টা নাগাদ আমরা সবাই হাল্কা স্ন্যাক্স পেলাম। আসলে সবাই বাড়ি থেকে ভালো করে খাওয়াদাওয়া করেই বেড়িয়েছি, তাই কারোরই খুব একটা খিদে ছিলো না। আর দিলো চা। বলাই বাহুল্য, কাবেরী এবারও দুবার চা নিলো। আমি হাসছি দেখে কপট রাগে বলে উঠলো, “ওরকম হাসবে না তো জেঠু”।
বাব্বা, এ যে এক্কেবারে ধমক!!
চারটে নাগাদ ধানবাদ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই “জেঠু, একবার এসো, এসো” বলে প্রায় টানতে টানতে আমাকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে আনলো। কি ব্যাপার?
– আরে জেঠু, ধানবাদের চা ভারত বিখ্যাত। দু’এক ভাঁড় খেতেই হবে। রাস্তায় যদি চাই না খাই, তবে কিসের ট্রেন জার্নি জেঠু?
সামনের স্টল থেকে নিজের জন্য চা কিনলো, আমাকেও দিলো। আমি পয়সা দিতে গেলে হাঁ হাঁ করে উঠলো।
– জেঠু, তুমি কি এখন চাকরী করো?
– না, রিটায়ার্ড। কেন?
– তাহলে? আমি যখন চাকরী করি, চায়ের পয়সা আমাকেই দিতে দাও। ঠিক আছে? এগ্রিড?
আমার আর কিছুই বলার নেই। ট্রেনে উঠে মাকে বেশ মজা করেই সে বললো, জানো মা, এই রিটায়ার্ড জেঠু আমাদের চায়ের দাম দিতে গিয়েছিলো। মার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে উনি কিছুই বুঝলেন না।
আমার রাগ হলো, “খুব মজা পেয়েছিস, না?”
নিজের অজান্তেই আমার “তুই” সম্বোধনটা বেরিয়ে এলো।
এরপর রাত আটটা পর্যন্ত গয়ায় একবার, আরেকবার গোমো স্টেশনে নেমে সে চা খেলো। আর দু’বারই আমাকেও নামতে হলো। আমার জীবনে এইরকম চা-খোর ট্রেনযাত্রীর সাথে মোলাকাত এই প্রথম।
তবে স্বীকার করতেই হবে, মেয়েটির জেনারেল নলেজ খুব ভালো। শোন নদী পেরোবার সময় আমাকে প্রশ্ন করে বসলো, “জেঠু, তুমি তো নিশ্চয়ই জানো, এই শোন নদীর ব্রিজ পৃথিবীর সবথেকে লম্বা রেল ব্রিজ?’
আমি যেন সব জানি, সেরকমই জবাব দিলাম, “সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। “
আমার উত্তর শুনে খানিক নাটকীয় ভাবে জবাব দিলো, “তাহলে জেঠু, তুমি যেমন কিস্যুই জানো না, তোমার বাচ্চা ছেলেও কিসসু জানে না।“
– মানে?
কাবেরী কিছুই বললো না, চুপ করে মুচকি মুচকি হেসে মজা নিতে থাকলো।
– আচ্ছা জেঠু, ধরে নিলাম এটা বাচ্চা ছেলেরাও জানে। তুমি তো বললে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বলো তো এই রেলব্রিজটা, যার উপর দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি, সেটা কত লম্বা?মানে আন্দাজেও বলতে পারো, চান্স দিচ্ছি।
আমি চুপ করে আছি, কারণ আন্দাজেও এর উত্তর আমি দিতে পারবো না।
– সুতরাং, এক, তুমি ভুল জানো, আর দুই, যেটুকুই বা জানো, সেটাও আদ্ধেক জানো।
– মানে?
– মানে, এক, এই ব্রিজ তিন কিলোমিটার লম্বা। সেটা তুমি জানো না, শুধু জানো বিশাল লম্বা একটা ব্রিজ। তাই বলছি আদ্ধেক জানো। আর দুই, যেটা ভুল জানো, সেটা এই যে ভারতের সবথেকে লম্বা ব্রিজ এখন ভেম্বানন্দ রেল ব্রিজ।
কেন জানি না, মনে হলো, কোথায় যেন পড়েছিলাম, সাউথ ইন্ডিয়ায় একটা নতুন ব্রিজ হয়েছে, এখন সবথেকে লম্বা। ভাইঝির কাছে জেনারেল নলেজে হেরে গিয়ে চুপ করে গেলাম।
– কি জেঠু? এবার বলো, এই ব্রিজটা কোথায়?
আমি হাত তুলে দিলাম। “তুইই বল।“
– এটা ভাল্লাপাড়ম থেকে এড়াপ্পল্লী। ভাল্লাপাড়ম একটা দ্বীপ। সেটা ২০১১ সালে কানেক্ট হয়েছে। ব্রিজটা সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা। সুতরাং শোন ব্রিজ এখন ভারতে দুই নম্বরে।
মাথা নেড়ে সায় দিলাম, সেরকমই কিছু একটা শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় ভাল্লাপাড়া, আর কোথায় এড়াপল্লী? কিছুই তো জানি না।
আবার কাবেরী হাসতে শুরু করে দিলো।
– জেঠু, তুমি কি নিউজ পড় না?
– কেন আবার কি হলো?
– কারণ, এটাও ভুল। ২০১৮ সালের ডিব্রুগরের রেল ব্রিজ এখন সবথেকে লম্বা, পাঁচ কিলোমিটারের সামান্য কম।
আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। এই হাঁটুর বয়সী মেয়ে তো আমাকে নিয়ে তো রীতিমতো ছেলেখেলা করছে!!
– ব্রম্মপুত্রের উপর দিয়ে অরুনাচল পর্যন্ত ব্রিজটা হয়ে গেলে সেটাই হবে আমাদের সবথেকে লম্বা ব্রিজ। প্রায় ন’ কিলোমিটার মতন হবে। কিন্তু সেটা রেল ব্রিজ নয়, রোড ব্রিজ হবে।
আবার সে মুচকি মুচকি হাসছে। নতুন কিছু ফান্ডা দেবে নাকি?
“শোনো জেঠু, বিহারের কাচ্চি দরগা ব্রিজটা, প্রায় দশ কিলোমিটার, যখন হবে, কবে হবে ভগবানই জানেন, তখন সেটাই হবে আমাদের ……”
এতটুকু বলে কাবেরী থেমে গেলো। বাকীটুকু আমাকে বুঝে নিতে হবে। আর আমার অবস্থা তথৈবচ। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আর আমার হাঁটুর সমান সায়েন্স গ্রাজুয়েট একটা মেয়ে আমাকে ব্রিজ নিয়ে কমন সব জেনারেল ফান্ডা দিয়ে যাচ্ছে। আর তাঁর কথায় চ্যালেঞ্জও করতে পারছি না, কারণ আমার ফান্ডা নীল।
– আচ্ছা জেঠু, তুমি সবথেকে লম্বা কোন ব্রিজটা বানিয়েছো?
– আরে, আমি চাকরি করেছি ইন্ডিয়ান অয়েলে। তাই ব্রিজ বানাই নি।
– তুমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার? আর ব্রিজ বানাও নি? সেকি?
কাবেরীর খুব মজা লাগলো।
– মা, শোনো, এই জেঠু বলছে সে নাকি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, অথচ সারাজীবনে একটাও ব্রিজ বানায় নি।
– এই শোন, যা বুঝিস না, বলবি না।
– ভালোই হয়েছে, তুমি ব্রিজ বানালে সেই ব্রিজ দু’দিনেই ধ্বসে যেতো। আমরা বেঁচে গেলাম।
কথা বাড়ালাম না, কি জানি আবার কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করে বসবে। চেপে গেলাম।
রাতের খাবার এলো ন’টা নাগাদ। বেশিরভাগ লোকেরই চিকেন রাইস। আর কাবেরীর জন্য না বলতেই দু’কাপ চা এসে গেলো। আমি হাসছি দেখে “জেঠু, খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু…” আমাকে শাসিয়ে দিলো।
পরের দিন সকালে দিল্লী। এখানে কিন্তু শ্রীমতি ট্রেন থেকে নামলেন না।
– কি রে? নামবি না, ট্রেন তো মিনিট পনেরো থামবে। চা খাবি না?
– না জেঠু, দিল্লীকে ঠিক ভরসা পাই না।
ব্রেকফাস্ট এলো ডাবল ওমলেট, ব্রেড স্লাইস, মাখন, আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ, সহজ কথায় সাহেবী কায়দায় লম্বা লম্বা করে কাটা কুড়কুড়ে আলুভাজা। এরপর ট্রেন চলছে, আর শ্রীমতী কুরুক্ষেত্র, আম্বালা, লুধিয়ানা, জলন্ধর সবকটি স্টেশনে নেমে, সঙ্গে আমাকেও টেনে নামিয়ে চা খেলেন। বাকি রাস্তাতেও মেয়েটি অনেক কিছু বললো। বুঝলাম, মেয়েটির জেনারেল নলেজ নিয়ে যেমন উৎসাহ, তেমনি আমাকে ছাত্র পেয়ে নিজে মাষ্টারনীর ভূমিকা নিয়েছে।
বিকেল চারটের সময় অমৃতসর পৌছালাম। স্টেশনে গাড়ি তৈরি ছিলো। কুন্ডু ট্রাভেলসের ছেলেটাই সবার মালপত্তর তদারকি করে আমাদেরও বাসে তুলে দিলো। সোজা হোটেলে এসে উঠলাম। এতক্ষনের ট্রেন সফরে কিছুটা ক্লান্তিও এসেছিলো। হোটেলে আমি একটা আলাদা, মানে ডাবল বেড সিঙ্গল অকুপেন্সি রুম পেয়েছি। এসেই স্নান করে নিলাম, আর নিজেকে অনেকটাই চাঙ্গা মনে হলো।
ভাবছি, রুমে চায়ের অর্ডার দেবো, বেল বাজলো টুং টাং। দরজা খুলে দেখি কাবেরী।
– কিরে, কি ব্যাপার? আয় ভেতরে আয়।
– সে পরে হবে, তুমি এখন কি করছো? মানে তোমার কি প্ল্যান?
– প্ল্যান আবার কি? কাল সকালের আগে তো কিছুই নেই। ভাবছি একটু শুয়ে থাকি।
– মানে? শুয়ে থাকবে? আঠাশ ঘন্টায় সতেরো’শ কিলোমিটার ট্রেনে চেপে তুমি এখানে শুয়ে থাকবে বলে এসেছো?
কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
– চলো, চলো, গেট আপ, কুইক। দুর্গিয়ানা মন্দির হয়ে স্বর্ণমন্দির যাবো। স্বর্ণমন্দিরে পালকি বলে একটা ব্যাপার হয়, সেটা হয় রাত দশটায়, আর ভোর সাতটায়। কালকের কুন্ডুর টিমের প্রোগ্রামের সাথে গেলে সেটা আর দেখা হবে না। এখনই দেখে নিতে হবে।
মনে পড়লো, কামদেব বলেছিলো, অমৃতসরে এলে পালকি দেখতেই হবে।
আমি, কাবেরী, আর ওর মা, তিনজনে মিলে অটোতে করে রওয়ানা দিলাম।
কাবেরী পড়াশোনা করে বেশ তৈরি হয়েই এসেছে। অটোওয়ালাকে বললো, দুর্গিয়ানা মন্দির চলো। আর চলার পথে আমায় খানিকটা জ্ঞানও দিয়ে দিলো, এটি ষোড়শ শতাব্দীর হিন্দু মন্দির যার স্থাপত্য অনেকটাই স্বর্ণমন্দির ঘরানায় তৈরি, চূড়ার সোনার পাতও সেই একই ঘরানার। এর চারিপাশে পুষ্করিণীও খনন করা হয়েছে। দেবী দূর্গার নামেই এই মন্দিরটি, তবে এখানে বিষ্ণু ও লক্ষীরও পূজা হয়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম ছিলো। এবং লোকের বিশ্বাস, রামায়ণের লব ও কুশের জন্ম হয় এই আশ্রমেই। জনশ্রুতি এই যে রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে ও হনুমানকে লব-কুশ এখানের দুর্গিয়ানা মন্দিরের একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো।
দুর্গিয়ানা মন্দিরে গিয়ে মনে হলো, এখানে না আসলে আর কাবেরীর ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক তথ্যগুলো না জানলে অমৃতসর ট্রিপটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। কাবেরীকে ডেকে বললাম, থ্যাংক ইউ। সে বুঝলো না, হঠাৎ থ্যাংক ইউ? কেন?
– তুই আগে থেকে আমাকে ব্রিফ না করে দিলে এই মন্দিরের ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্টই হতো না।
– ওহ, এখন ইন্টারেস্ট হয়েছে? ঠিক আছে, তাহলে চলো আইসক্রীম খাওয়াও।
– আইসক্রীম খাবি?
– বাহ রে! এপ্রিল মাসে অমৃতসরে এসে আইসক্রীম খাবো না?
– এখন?
– তুমি কি বলতে চাও জেঠু? এই এপ্রিলের গরমে আইসক্রিম খাবো না, তো ডিসেম্বরে আলাস্কায় গিয়ে রাত তিনটের সময় আইসক্রিম খাবো? জেঠু ……, তুমি না, একটা ……, আর কি বলবো?
– হ্যাঁ, বল বল, থামলি কেন?
– না, এখন বললে তুমি আর আইসিক্রিম খাওয়াবে না। আগে খাওয়াও, তারপর।
ঠিক হলো স্বর্ণমন্দির গিয়ে আইসক্রিম খাবো। যাওয়ার পথে বললো, “জেঠু, তুমি ভাবছো, কেন এই রাতে তোমাকে স্বর্ণমন্দির টেনে নিয়ে যাচ্ছি,তাই তো? তাহলে শোনো, রাতের স্বর্ণমন্দির দেখে তারপর আমাকে জানিও, কেমন লাগলো?”
স্বর্ণমন্দিরে এসে মন্দিরের বাইরে অটোটা ছেড়ে দিলাম। একদম সামনেই আইসক্রিমের দোকান। “জেঠু, জেঠু, আইসক্রিম, আইসক্রিম।“
ওর মা সারাক্ষণ দেখলাম চুপচাপ। এবার তিনিও ধমক দিলেন, “চুপ কর। পাগলের মতন চ্যাঁচাস কেনো?”
মেয়ে থামবে না। আইসক্রিম কিনে দিলাম, খেয়ে যেন সে শান্ত হলো।
“জেঠু, পঞ্জাবের দুধের আইসক্রিম না…, এক্কেবারে পাগলা। তবে জেঠু, আমাদের ধানবাদের ষ্টেশনের চাও কিন্তু কম যায় না।“
না, এই মেয়ের সাথে তক্কাতক্কি একদম নয়।
আমরা এগিয়ে গেলাম। সামনেই স্বর্ণমন্দির। নিজের মনে হলো, এর ইতিহাসটা জানলে হয়তো ইন্টারেস্ট আরেকটু বাড়বে। কাবেরীকে বললাম। মোটামুটি সে যা বললো, ষোড়শ শতাব্দীতে, ১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ মুঘল সম্রাট আকবর এই জায়গাটি দান করেন। এই মন্দিরের নাম হরমন্দির সাহিব। শিখ গুরু রামদাসের নির্দেশে অমৃত সারস পুষ্করিণী খনন করা হয়। সুতরাং এই পুষ্করিণী প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, এটিকে খনন করা হয়েছিলো। আর এই অমৃত সারস নাম থেকেই অমৃতসর নামকরন। এরপর ১৫৯০ সাল নাগাদ পুস্করিণীর কেন্দ্রে হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই হরমন্দির সাহিবকেই আমরা সাধারণ লোকেরা স্বর্ণমন্দির নামে জানি। এরপর সপ্তদশ শতাব্দীর একদম শুরুতে ১৬০০-১৬০৫ সাল নাগাদ শিখ গুরু অর্জুন গ্রন্থসাহিব রচনা করে এই হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করেন। বাবা বুদ্ধ সাহিব ছিলেন এর প্রথম গ্রন্থী।
– আর পালকি?
– জেঠু, এটি একটি অনুষ্ঠান, দিনে দু’বার হয়। রাত দশটা নাগাদ হরমন্দির সাহিবে দিনের শেষ হুকুমনামা পাঠ হয়ে গেলে, গুরু গ্রন্থসাহিবকে হরমন্দির সাহিব থেকে সোনার পালকি সিংহাসনে সাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে সামনের অকাল তখত সাহিবে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পালকিকেই বলে পালকি সাহিব। সকলের আগে একজন ট্রাম্পেট বাজিয়ে আসেন। পিছনে ভক্তরা কাঁধে সেই পালকি বহন করেন। সকলের বিশ্বাস, অকাল তখতে গুরু গ্রন্থসাহিব ঐসময় রাত্রির বিশ্রাম নেন। অকাল তখতে সেইসময় গ্রন্থসাহিব বন্ধ রাখা হয়, উনার নির্বিঘ্নে বিশ্রামের জন্য কীর্তন বন্ধ থাকে, শুধু কিছু বিশেষ স্লোক উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে এইসময় হরমন্দির সাহিবের দৈনন্দিন পরিস্কারের কাজ চলে। ভক্তরাই এটি করেন।
তবুও সবকিছু বোঝা যাচ্ছে না। কোথায় যেন ডিসকানেক্ট হচ্ছে। কাবেরী বুঝতে পেরেছে।
– শোনো জেঠু, আমরা হিন্দুরা যেমন দেবদেবীর মূর্তিপুজা করি, শিখধর্মে ওরা গুরু গ্রন্থসাহিবকে সামনে রেখে প্রার্থনা করে। এই গ্রন্থসাহিব ওঁদের ধর্মগ্রন্থ। এই গুরু গ্রন্থসাহিব মূলত গুরু নানক, গুরু অঙ্গদ, গুরু অমর দাস, গুরু অর্জন, ও গুরু তেগবাহাদুর রচনা করেছিলেন। তবে একটু আগেই যে বললাম ১৬০০ সাল নাগাদ যখন হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠা হয়, তখন পঞ্চম শিখ গুরু, গুরু অঙ্গদ, আদি গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন। তারপর সেই গ্রন্থটি হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করা হয়।
অবাক হয়ে সব শুনলাম। “তুই হিস্টোরিয়ান না হয়ে লাইব্রেরিয়ান কেন হলি?”
মনে হলো প্রশ্নটা কাবেরীর পছন্দ হলো না। বেকায়দা প্রশ্ন করলাম না তো?
– জেঠু, ভালো লাইব্রেরিয়ান হতে গেলে কত কিছু জানতে হয় সে খেয়াল তোমার আছে? ট্রেনে আসার সময় আমাদের রেলব্রিজ নিয়ে আমি তোমায় অনেক ফান্ডা দিলাম। ধরে নাও তুমি লাইব্রেরি গিয়ে সেই ভেম্বানন্দ রেল ব্রিজের উপরই একটা রেফারেন্স বই চাইলে। এবার লাইব্রেরিয়ান যদি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? সুতরাং… একজন লাইব্রেরিয়ানকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। আমি মাসে সাত আটখানা বিভিন্ন রকমের ম্যাগাজিন পড়ি।
আমি জানতাম লাইব্রেরিয়ান মানে বইপত্তরের কেয়ার টেকার। আমার ধারণাটাই সে পাল্টে দিলো।
পালকি অনুষ্ঠান হলো রাত দশটায়। কামদেবের কথাই ঠিক, আর কাবেরী আমাকে এই পালকির ইতিবৃত্ত আগেই বলে রেখেছিলো। যদি এই রাতে না আসতাম, তাহলে ভাবতেও পারতাম না কি সুন্দর এই অনুষ্ঠান, আর কি ডিসিপ্লিন! চারিদিকে আলোর ফোয়ারা। আর রাতের আলোয় পুকুরের জলে স্বর্ণমন্দিরের অসাধারণ সব প্রতিবিম্ব। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মন্দিরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু তখন ভিতরে পর্দা টাঙিয়ে দিয়ছে। ঐ ভীড়ে মা ও মেয়ের অবস্থা শোচনীয়। আমি না থাকলে ওরা ফিরেই আসতো। সেই রাতেও চারিদিকে দলে দলে দশ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের শিখ ছেলেমেয়েরা সেবা করে যাচ্ছে। স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গনের পুরোটাই মার্বেল পাথরে বাঁধানো। সেখানে একদল লোক মন্দিরের সোনার দেওয়াল, অন্য দল রেলিং, একদল পুরো মন্দির চত্বররের মেঝে মুছছে। একনজরেই বোঝা যায় সকলেই অবস্থাপন্ন ঘরের লোকজন। সেখানে ধনী গরীবের ভেদাভেদ নেই। আরেকদিকে বিরাট লঙ্গর চলছে, কাতারে কাতারে লোক। গুরুদ্বারের উল্টোদিকে একটা বড় মিউজিয়াম আছে, কিন্তু সন্ধ্যার পর বন্ধ। দেখা হলো না। ঐ রাতের ভীড়ে আমাদের কলকাতার পূজোয় মহ: আলি পার্ক, একডালিয়া এসবের কথা মনে এলো। কামদেব যে পালকির কথা বলেছিলো, সেটা দেখাও সার্থক হলো। শুনলাম স্বর্ণমন্দিরের ভিতর শিবের মূর্ত্তির রোজ পূজো হয়। কিন্তু দেখা হলো না।
রাতের পালকি শোভাযাত্রা দেখে মন্দির চত্ত্বরের বাইরে এলাম। রাস্তার উপরে বেশ কিছু খাবারের দোকান। সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। রাস্তায় পরিস্কার চেয়ার টেবিল পাতা আছে। সেরকম একটা দোকানের বাইরের চেয়ারে কাবেরী বসে পড়লো। আমি কিছু বুঝে উঠে বলার আগেই কাবেরী বলে দিলো, আগে বসো, পরে কথা বলবে। দোকানীকে ডেকে অর্ডার দিলো, মালাই লসস্যি, পিতল কি গেলাস মে। দো বড়া, এক ছোটা।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ জেঠু কি যেন বলতে চাইছিলে?
– এখন রাত এগারোটা বাজে, এখন লসসি?
– তাহলে অর্ডার বাতিল করে দি? তুমি ধর্মতলার অনাদি কেবিনে, বা আমহার্স্ট স্ট্রীটের পুটিরামের দোকানে গিয়ে কাঁচের গ্লাসে পঞ্জাবের স্পেশাল মালাই লসসি খেয়ে নিও।
না, তক্কো নয়, মেয়েটা ঠিকই বলছে। পঞ্জাবে এসে লসসি খাবো না? সেই কাঁসার গেলাসের লসসি খেয়ে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তিও উধাও।
খাওয়া হয়ে গেলে কাবেরী একটু কাছে এসে গলা নামিয়ে বললো, “এইটা কিন্তু তুমি খাওয়াচ্ছ।“
বললাম, “কেন? কালকেই যে লম্বা লম্বা ডায়লগ দিলি, তুই চাকরী করিস, আমি রিটায়ার্ড, এবার উল্টো কেন?”
– উল্টো নয় জেঠু, উল্টো নয়। তোমার কাছে সব পাঁচশ টাকার নোট, সেটা ভাঙিয়ে নাও।
পয়সা মিটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। কাল সকালে কুন্ডু টিমের সাথে এখানেই আবার আসতে হবে। কাবেরী বলে দিলো, আমরা যেন হোটেলে ব্রেকফাস্ট না করি। “আরে, আমরা তো ব্রেকফাস্টের জন্য পয়সা দিয়ে রেখেছি।“
– ঠিক আছে, তুমি পাউরুটি মাখন ডিমভাজা খেয়ে নিও। আমি কিন্তু হোটেলের ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি না।
বুঝলাম মেয়েটি কিছু সারপ্রাইজ প্ল্যান করে রেখেছে, এখন এর বেশি কিছুই বলবে না।
ন’টা নাগাদ দলের তেরো জন ছোট্ট ১৭ সীটের এসি ট্রাভেলরস বাসে করে স্বর্ণমন্দির চত্তরে পৌছালাম। কাবেরী বলে দিয়েছে, স্বর্ণমন্দির মানে হরমন্দির সাহিব। শুরুতে সাহেব সাহেব বলছিলাম, সে ভুল সংশোধন করে দিলো, সাহিব হবে, সাহেব নয়। সাহিব কথাটির অর্থ হৃদয়ের গভীর সম্মান উৎসর্গ করা। এখানে সাহেব মেমসাহেবের ব্যাপার নেই।
আমাদের দলে আছে
বাবা, মা, মেয়ে (বাবা রিটায়ার্ড, মা মেয়ে চাকরী করে, বয়স আন্দাজ ২৩-২৪)
বাবা, মা, মেয়ে (বাবা মা রিটায়ার্ড, মেয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার, বয়স আন্দাজ ২৪-২৫)
স্বামী, স্ত্রী (স্বামী SAIL এ কর্মরত)
স্বামী, স্ত্রী (ব্যবসায়ী পরিবার)
মা, মেয়ে (মেয়ে লাইব্রেরিয়ান, বয়স আন্দাজ ২৩-২৪)
আর, আমি একলা (কাবাব মে হাড্ডি)
আর দলে আছেন একজন ম্যানেজার, দুজন অলরাউন্ডার সহকারী।
সেদিন ছিলো রবিবার, তাই প্রচন্ড ভীড়। আমাদের পূজোয় মহম্মদ আলি পার্ক বা একডালিয়ার মতো। দূরের লোক যেমন এসেছে, নিকটবর্ত্তী অঞ্চলেরও অনেক লোকই এসেছে। সবাই যখন হরমন্দিরের দিকে যাচ্ছে, কাবেরী আমাদের সেদিকে যেতেই দিলো না। যেহেতু গতকাল রাতেই আমাদের দেখা হয়ে গেছে।
আমরা বসে আছি, দেখলাম কাবেরীর ছবি তোলার খুব শখ। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডে সে ছবি তুলবে। এখন আমার কাজ ছবি তুলে দেওয়া। আমি বিরক্ত হলেও, জোর করে আমাকে দিয়ে ছবি তোলাচ্ছে। ম্যানেজার ঐ ভীড়ে পাগলের মতন দলকে খুঁজতে খুঁজতে এদিক ওদিক করছে। আবার মাঝে মাঝে আমাদের টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে। রসায়নটা ঠিক বুঝতে পারছে না। খানিক পরে নিজেই এসে আমাদের বললো, আপনারা পাশেই জালিয়ানওয়ালাবাগটা দেখে আসুন।
এক্কেবারে শুরুতেই বাঁদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের সদর দরজা। আমরা সেদিকেই গেলাম। এখন অনেক গ্যালারী বানিয়েছে, তাতে হাল্কা সাউন্ড আর আলো, আর ছবি সহ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জালিয়ানওয়ালাবাগের ইতিহাসটাও তুলে ধরেছে। সেই অভিশপ্ত কূঁয়োটা দেখলাম যেখানে অনেকে প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়েছিলো, আর পরে লাশগুলো স্তূপাকৃত করে ফেলা হয়েছিলো। দেওয়ালে গুলির দাগগুলো সযত্নে মার্ক করে রাখা আছে। এসব দেখে যখন একটা নিদিষ্ট জায়গায় সকলে ফিরলাম, তখন বাকী দল স্বর্ণমন্দির দেখে ফিরলো। সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকায়, বাকিদের আর জালিয়ানওয়ালাবাগ দেখাই হলো না। এবার দলের সকলে দূর্গিয়ানা মন্দির যাবে। আমরা জানালাম যে গতকালই দেখে এসেছি, তাই আজ আর যাবো না। আমরা তিনজনে থেকে গেলাম, বাকীরা চলে গেলো।
জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বাইরে আসার জন্য একটা গলিপথ দিয়ে সামনের দিকে আসতে হয়। কাবেরী আমাদের সেই গলিতে ডেকে নিয়ে গেলো। “জেঠু, তোমার তো ব্রেকফাস্ট হয় নি। চলো, আজ সাদা মাখনে ফ্রাই করা আসল পঞ্জাবী পরোটা তোমাকে খাওয়াই, সঙ্গে পঞ্জাবী দাল মাখানি।“
মেয়েটা মন্দ বলে নি। আর এখন বুঝলাম যে এইজন্যই হোটেলে আমাদের ব্রেকফাস্ট করতে দেয় নি।
স্টীলের থালায় পরোটা দাল মাখানি, সঙ্গে লঙ্কা আর আচার। তাই খেলাম। অপূর্ব। এই পরোটা আর দাল মাখানি কলকাতার পঞ্জাবী রেস্তোরাঁতেও পাবো না। এরপর বাইরে এসে ছোট কাঁসার গ্লাসে মালাই লস্যি। তখন বাজে প্রায় বারোটা। সুতরাং আজ লাঞ্চে আর কিছুই নয়।
যা ভাবি অতই সহজ, ততটা নয়। আইসক্রিমের দোকানের সামনে কাবেরী দাঁড়িয়ে পড়লো। সেই আইসক্রিম খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। এখন ঘন্টা দুয়েকের বিশ্রাম, তারপর ওয়াগা বর্ডারের প্যারেডের দেখতে যাবো।
ওয়াগা সীমান্ত অমৃতসর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। পৌঁছলাম বিকেল চারটে নাগাদ। কামদেব বলে দিয়েছে, এখানে আমাদের বিএসএফ সেনাদের প্যারেড না দেখলে অমৃতসর ট্রিপটাই অপূর্ণ থেকে যাবে। রাস্তায় কাবেরি ছোট করে বুঝিয়ে দিলো, যে এটা শুধু ভারতের অনুষ্ঠান নয়। ১৯৫৯ সাল থেকেই ভারত পাকিস্তান দুই দেশের এই ড্রিল চলছে। আমাদের থাকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) জওয়ান, আর পাকিস্তানের দিকে থাকে পাকিস্তান রেঞ্জারস। এই প্যারেড ফৌজি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় displaying the two countries’ rivalry আর দুই দেশের কূটনৈতিক বিবৃতিতে বলা হয় a display of brotherhood and cooperation. তবে শত্রুর সাথে কিভাবে মোকাবিলা করা উচিৎ, সেটাই বড় করে চোখে পড়ে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই দেশের বর্ডারের গেট খুলে দেওয়া হয়। আমাদের বর্ডার গেট তেরঙ্গা। আর সবার শেষে Beating Retreat. সূর্যাস্তের ঠিক আগে দুই দেশের জাতীয় পতাকা একই সাথে নামিয়ে আনা হয়। তারপর দুই দেশের জওয়ানরা হাত মেলায়।
চারটা নাগাদ হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে আমাদের একজন কম্যান্ডিং ফৌজি অফিসার এলেন। প্রাথমিক জয় হিন্দ, ভারতমাতা কি জয়, বন্দে মাতরম ইত্যাদি বলে আসরটাকে একটু নয়, অনেকটাই চাঙ্গা করে দিলেন। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে সাউন্ড সিস্টেম, তার সাথে আমাদের স্লোগানের আওয়াজে চারিদিক গমগম করছে। আর উনি লম্বা স্টেডিয়ামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। হাতের, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের কায়দায় বারবার বোঝাচ্ছেন যে আওয়াজ আরও জোরে চাই। হাতের ইশারায় বারবার বোঝাচ্ছেন, আমাদের এই আওয়াজ বর্ডারের ওপারে পাকিস্তানে পৌঁছানো চাই।
এবার প্রায় তিরিশ চল্লিশ জন ছেলেমেয়ের একটা দল এলো। এরা সবাই অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। বিএসএফের লোকেরা এঁদের হাতে আমাদের পতাকা ধরিয়ে দিয়েছে। আর এঁরা স্টেডিয়ামের মাঝখানের রাস্তায় আমাদের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলো। সারা স্টেডিয়াম তখন তালি দিয়ে তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছে। তালি বা আওয়াজ কম হলেই সেই ফৌজি কম্যান্ডার বলছেন, আওয়াজে আরও জোর চাই। আওয়াজ বর্ডারের ওদিকে পৌঁছানো চাই। মিনিট দশেক বাদে, মানে চারটা কুড়ি নাগাদ ফৌজি কম্যান্ডার মাইক্রোফোনে ঘোষনা করলেন, মেয়েদের মধ্যে যারা নাচতে চায়, তাঁরা নীচে নেমে আসতে পারে। এটা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই। এই ঘোষনা শোনামাত্রই সারা স্টেডিয়ামের কোনা কোনা থেকে মেয়েরা সব দৌড়ে দৌড়ে নেমে এলো। শুরু হলো নাচ। পাকিস্তান বর্ডারের সামান্য দূরত্বে পাকিস্তানকে সামনে রেখে সারা স্টেডিয়াম জুড়ে গান চলছে হামসে যো টকরায়গা, আর সেই গানের সাথে নাচছে প্রায় হাজার খানেক ভারতীয় মেয়ে। তাল মিলিয়ে সাপোর্ট দিচ্ছে পুরো স্টেডিয়াম। মেয়েরা, কেউ একজন অন্য আরেকজনকে চেনে না, তবু হাতে হাত ধরে দলবেঁধে হিউম্যান চেইন বানিয়ে স্বতঃফুর্ত হয়ে নেচে চলেছে। আর ফৌজি কম্যান্ডারের ভূমিকা তো আছেই। এই নাচ চললো প্রায় মিনিট চল্লিশেক। এর ফাঁকে ফাঁকেই ফৌজি কম্যান্ডারের সাথে তাল মিলিয়ে সারা স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে বারংবার আওয়াজ উঠছে
– হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ
– ভারতমাতা কীইইইইইই
– ঝয়য়য়য়য়য় (কেন জানিনা, জয় বলতে গিয়ে আমার ঝয় বেরিয়ে আসছিলো)
– বন্দে মাআআআআতরম
এরপর প্যারেড করে এলো আমাদের বিএসএফ এর জওয়ানরা। বর্ডার থেকে আন্দাজ ৭০ মিটার দূরে আমাদের সীমানায় এসে দাঁড়ালো। একদম প্রথম সারিতে দু’জন বিএসএফ মেয়ে। ড্রিলের শুরুতেই এরা হাতে তরোয়াল উঁচিয়ে ধেয়ে গেলো বর্ডারের দিকে। এই ড্রিলকে সঠিক বর্ণনায় কি বলবো জানিনা। যেভাবে, মানে যে স্পীডে মেয়ে দুটি এগিয়ে গেলো, সেটা ঠিক হাঁটা নয়, প্রায় দৌড়ে ধেয়ে যাওয়াই বলা চলে। মানে আমরা যদি কাউকে তাড়া করি, বা আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে যাই, অনেকটাই সেইরকম। তারপর বর্ডারের গেটের সামনে গিয়ে এক্কেবারে কাঁধের উপর পা তুলে একটা এয়ারকিক। পাকিস্তানের তরফেও একই রকম ড্রিল দেখলাম। এই ড্রিল উভয় দেশের মধ্যে সিনক্রোনাইজড। এরপর একে একে ভারতীয় বিএসএফ জওয়ান ড্রিল করে চলেছে। এই ফৌজি ড্রিল অনেকটাই “আজ তোকে শেষ করে দেবো”। সবই নিঃশব্দ শারীরিক ভাষায় শত্রুকে নিজের শৌর্যের প্রকাশ, অবশ্যই ফৌজি কায়দায়। একটা ছবি দিলাম। দুজনে হ্যান্ডশেক করছে, কিন্তু ফৌজির দু’চোখে যেন আগুনের ফুলকি। এই বিশেষ শারিরীক ও মুখচোখের ভাষার হাত মেলানোকে ইংরেজি ভাষায় বলবো brusque handshake যার অর্থ quick and direct in manner or speech, and often not polite. If you describe a person as brusque, you mean that they seem to be rude
এই প্যারেড এককথায় ফৌজি ভাষায় displaying the two countries’ rivalry আবার দুই দেশের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারিভাবে বলতেই হয় an effort to display of brotherhood and cooperation between the two nations. কিন্তু যেটা পাওনা, সেটা আমাদের মতন সাধারণ দর্শনার্থীদের একটা জাতীয়তাবোধের চেতনা।
এই ড্রিল দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই সেই জাতীয়তাবোধ বারংবার মনে চলে আসে। তাইতো একসাথে আওয়াজ তুলি
– হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ
– ভারতমাতা কীইইইইইই ঝয়য়য়য়য়য়
– বন্দেএএএএ মাআআআতরমমমম
শো দেখে স্টেডিয়ামের বাইরে এসেছি, বাসের দিকে যাচ্ছি।
– জেঠু…… আইসক্রিম
– আবার আইসক্রিম? দাঁড়া, এবার তোর মাথায় আইসক্রিম ঢেলে মাথা ঠান্ডা করছি।
– সামান্য তো একটা আইসক্রিম চেয়েছি জেঠু, তার জন্য এত কথা বলে দিলে?
আইসক্রিম খাইয়ে ভাইঝির মানভঞ্জন করতে হলো। শুধু তাই নয়, কাবেরী সেখানে দাঁড়িয়ে একটা খেলো, আর বাসে করে ফেরার এক ঘন্টার রাস্তায় খাবে, তাই আরেকটা কিনতে হলো।
– জেঠু, ইউ আর রিয়েলই আ সুইট সুইট বয়।
ফিরবার সময় ভাবছি, এই ওয়াঘা বর্ডারের প্যারেড এককথায় Lifetime Visual Experience.
আর আমার মাত্র কয়েকদিনের অমৃতসর ভ্রমণ, তৎসহ রেল ব্রিজের ফান্ডা, কাঁসার গেলাসে মালাই লসসি, সাদা মাখনের পরোটা, ভাইঝির চা- আইসক্রিমের বৃত্তান্ত, এত ইতিহাস আজও মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলেছি।
হরমন্দির সাহিব, পালকি, বিএসএফের ড্রিল, আর এছাড়াও পঞ্জাবের বিখ্যাত লস্যি সবকিছুর দুর্দান্ত বর্ননা হয়েছে। লেখককে ধন্যবাদ জানাই, আরও লিখুন।
The greatest achievement of Asim is to ensure Uttam Khan to take up a pen. Excellent work Uttam