অপরাজিতা
সমীর কুমার সরকার, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
– তুলি, ওহ্ তুলি, দরজা খোল না?
কিছু কিছু গলার আওয়াজগুলো চেনা চেনা মনে হলো।
বাইরের লোকেরা বলছে, “তোর বৌদিকে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারলে ওকে হয়ত বাঁচানো যাবে না। ওহ্ তুলি, দরজাটা খোল না!”
জানলা দিয়ে মা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
– কাকিমা, ঐশীর প্রসব ব্যথা উঠেছে। এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
– কিন্তু তুলির গায়ে তো অসম্ভব জ্বর। যেতে পারবে না,
– কাকিমা, একটু দেখুন না? আমাদের গ্রামে তো তুলি ছাড়া আর কেউ নেই। দেখুন না?
– আরে সে তো জ্বরে শুয়ে আছে। তোমরা ভাদুর ভ্যান রিক্সায় নিয়ে যাও।
– কাকিমা, ভাদুকে তো জানেন, রাতে মদ খেয়ে চূড় হয়ে থাকে। তাছাড়া ভ্যান রিক্সায় যেতে অনেক সময়ও লেগে যাবে।
– কিন্তু তুলির তো ভীষণ জ্বর। রাতে কিছুই খায় নি। যাবে কী করে?
– কাকীমা, তুলির কিচ্ছু হবে না। ওকে ডেকে দিন না? দেরী হয়ে যাচ্ছে। এরপর বড়ই দেরী হয়ে যাবে।
কথাবার্তা শুনে তুলি উঠে এসেছে,
– কী রে? তুই উঠে এলি কেন?
তুলি সোয়েটারের উপর চাদর জড়িয়ে এসেছে। ঐশী বৌদিকে টোটোতে বসিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দিলো। ভীড়ের মধ্যে অনেকেই আছে যারা চিরটাকাল তুলির বদনামটাই করেছেন।
শহরে ঢূকতেই ছোট হাসপাতালটায় যেতে একঘন্টা লাগে। তুলি স্পীডে গাড়ি নিয়ে এগোতে পারে না, কারণ একেই এই রাতে রাস্তা দিয়ে সব বড় বড় ট্রাক, ট্রেলার চলে। তাছাড়া, ঐশীর প্রসব যন্ত্রণাটাও আছে, রাস্তার ঝাঁকুনিতে গন্ডগোল হতে পারে। টোটোর পিঁ পিঁ আওয়াজটাও আগের ট্রাক ড্রাইভারদের কানে পৌঁছয় না। কোনোরকমে ছোট হাসপাতালে পৌঁছে তুলি নিজেই টোটোতে শুয়ে পড়লো। “তোমরা যাও, আমি এখানেই আছি। আমার গাড়ীতেই একটু শুয়ে নি।“
না, হাসপাতালে এত রাতে ডেলিভারির ব্যাবস্থাই নেই। সকাল ছ’টায় সকালের শিফটে ডাক্তার আসবে, নার্স আর অন্য স্টাফেরা এলে তারপরেই হবে। তড়িৎদের দুই ভাই গ্রামের মস্তান হতে পারে, কিন্তু হাসপাতালের লোকেদের সাথে কথা বলার এলেম নেই। হাসপাতালের লোকেই বলে দিলো, সময় খরচ না করে এখনই পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে। তাঁরা ঐশীকে ফিরিয়ে নিয়ে টোটোর কাছে আসতেই অসুস্থ তুলি লাফিয়ে উঠে হাসপাতালে গিয়ে চেঁচামেচি করে এক হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিলো। “ডাকুন রাতের ডাক্তার আর নার্সকে, আমি কথা বলতে চাই। কোথায় ওনারা?” গোলমালে একজন স্টাফ এগিয়ে এসে জানালো, “আরে তুলি? তুই? দাঁড়া দাঁড়া, আমি দেখছি।“ কিছুক্ষনের মধ্যেই রোগী স্ট্রেচারে শুয়ে ভেতরে চলে গেল।
*******
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় গায়ে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেই বিছানায় শুয়ে শুধু বলল, মা একটু জল দাও। কয়েকটা ওষুধ খেয়ে শুয়েই আছে। সেই তুলি এই অবস্থায় রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ালো।
ছোট থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে মা’র চিন্তা। অসুখ বিসুখ বিশেষ করত না কিন্তু তার দুরন্তপনায় লোকেরা সমানে এসে নালিশ জানাতো। এখন কাজের জায়গায় রীতিমতো লড়াই করে নিজের জায়গা করে নিলেও লোকজন তার সাথে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করে। কিন্তু যখন দলবেঁধে লোকজন গভীর রাতে দুটোর সময়েও বাড়ির সামনে এসে তুলির নাম ধরে ডাকে তাহলে তো মায়ের চিন্তা হবেই?
সেই ছোটোবেলা থেকেই মেয়েটা টো টো করে ঘুরে বেড়াত। কারোর কোনো কথাই গায়ে মাখত না। ওর বাবাই তুলিকে উৎসাহ দিতেন। মেয়ের ভালো নাম দিয়েছিলেন অপরাজিতা। বলতেন আমার মেয়ে নিজের নামের সম্মান রাখবে। বলতেন, মেয়েরা কী কি নিজের ইচ্ছেমত কিছু করতে পারবে না? আমার মেয়ে কী অন্যায় করেছে যে ওর খেলাধুলো, ঘোরাফেরা সব বন্ধ করে দিতে হবে? বাবার আস্কারাতেই মেয়েটা ছেলেদের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, ডাংগুলি, আবার গুলতি দিয়ে পাখিও মারত। গাছে চড়া, আমবাগান থেকে চুরি করা এসবে এতটাই পটু হয়ে গিয়েছিল যে গ্রামের ছেলেরাও তাদের দলে তুলিকে নিয়ে যেত। মা এসব পছন্দ করতেন না। সারাদিন কাজের পরে দুপুরের ঘুমের সময় ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ত। মেয়ে তখন আমপুকুরের মাঠে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলছে। ভর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরলে মা কিলচড় লাগিয়ে নিজেই বসে কাঁদতেন হে ঠাকুর কি মেয়ে দিলে? আমি মনেপ্রাণে ছেলে চেয়েছিলাম বলেই কি তুমি এই মেয়েকে দিয়েছ? ওর মধ্যে তো মেয়ের কোনো গুণই নেই। বড় হলে ওকে বিয়ে দেব কী করে?
আমার কথা শুনে মেয়ের বাবা হাসে। পাত্তাই দেয় না। বলে, সব খেলাতেই কি ছেলেদের আধিপত্য থাকবে? তুমি কী দেখেছ, ছোটন, বালু, এঁরা তুলিকে ডিঙিয়ে গোল করতে পারে না। ছেলেরাও জানুক, ওর নাম অপরাজিতা।
– হ্যাঁ, তুমি ঐ আনন্দেই থাকো। ও মেয়ে। ছেলে নয়। দুদিন বাদে বিয়ে দিতে হবে। কে তোমার এই মেয়েকে বিয়ে করবে? কোন শাশুড়ি চাইবেন তার বৌমা রান্নাঘরে না গিয়ে মাঠে ফুটবল খেলবে?
তুলির বাবা কোনো কথায় কর্ণপাত না করার জন্য মেয়েও দিনদিন ছেলেদের মত চালচলনে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন বাদে, যখন তুলির বয়স এগার-বারো হবে, ওর বাবা শহরে গিয়ে খাকি জামা প্যান্টও কিনে তুলিকে এক ক্লাবের এনসিসি-তে ভর্তি করিয়ে দিলো। মেয়ে তখন সপ্তাহে দু’দিন বিকেলে বাবার টোটোতে চড়ে এনসিসি ক্লাসে গিয়ে আবার বাবার সাথেই ফিরে আসতো। মা পছন্দ করতেন না। কিন্তু যেদিন ওঁকে আগের দিন বিকেলে গাড়ি করে নিয়ে গেলো, ডিস্ট্রিক্ট ব্লকের হয়ে কলকাতার রাজপথে প্রজাতন্ত্র দিবসের মিছিলের জন্য, সেদিন সেই রাজপথের ধারে মা’ও ছিলো। গ্রামের লোকেরাও ধীরে ধীরে জানতে পেরেছিলো, কিন্তু কটূক্তিই অনেক ছিলো।
এই ঘটনার পর, আশেপাশের পাড়া থেকে অনেক মেয়েরাও তার দলে এসে জুটেছে, আর সে নিজেই একটা মেয়েদের ফুটবল দল তৈরী করে নিলো। তৈরি হলো শান্তিবাহিনী। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেলো যে পাড়ার ছেলেরাই এবার তুলিকে সমীহ করতে শুরু করলো। ব্যাতিক্রম, শচীন, সুখেনরা ওকে শাসাত, কারণ ওদের দলটা রাজনীতি ঘেঁষা। কিন্তু তুলি তাঁদের ভয় পায় না। শচীনের সাথে সামনা সামনি তর্ক করে যেভাবে পাড়ার বুড়ি দিদার জমির ফসল বাঁচিয়েছিল, গাঁয়ের লোকেরা তার প্রশংসা করলেও বাবাকে বলেছিল যে তুলি যেন শচীনদের সাথে লড়াই না করে। তবুও তার বাবা তুলিকে বারণ করেন নি। বরং উৎসাহই দিয়েছিলেন।
গেলবার প্রচন্ড বর্ষায় একদিন সকালে গাঁয়ের লোক উঠে দেখে ফুলিবুড়ির ঘর ধ্বসে পড়েছে, কিন্তু ফুলিবুড়ি অক্ষত। সেইরাতে তুলি আগে থেকেই আন্দাজ করে শান্তিবাহিনী আর ফুটবলের কিছু ছেলেকে সঙ্গে করে ফুলিবুড়িকে পাঠশালায় নিয়ে যায় আর দারোয়ান’কে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে আশ্রয় করে দেয়।
আরেক দিনের কথা। তুলিদের বাড়ির সামান্য দূরেই মিত্তিরদের বাড়ির বড় মেয়ে দুর্বা, বছর চব্বিশ পচিশ হবে, গঞ্জের দর্জির দোকানে কাজ করে। সারাদিনের শেষে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়ি ফেরার সময় সেদিন তুলিও একই সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলো। এমন সময় বটতলায় ছেলেরা টিটিকিরি দিতেই দুর্বা বললো, চল চল, এখানে দাঁড়াতে হবে না। “কিসের দাঁড়াতে হবে না? দেখি তো?”
– কে হে ভাই? টিটিকিরি দিলে? আরেকবার আমার সামনে এসে দাও না, একটু শুনি।
দু’তিনজন এগিয়ে এলো। “কেন ভাই? শুনতে ভালো লেগেছে?”
– না, ভালো লাগেনি। তবে কে করেছে জানালে ভালো হয়। আরেকবার শুনে তাকে একটূখানি জুতোপেটা করতে চাই।
ব্যাপারটা আর এগুলো না। ঐ দলের কয়েকজন তুলিকে চেনে, জানে। তাই ছেলেরা আর এর বেশি ঘাঁটালো না।
তুলির বাবা যখন মেয়েকে দূরের ক্লাবে ক্যারাটে শেখাতে পাঠালেন তখন সেই ক্লাবের ছেলেরাই এক মাষ্টারমশাইকে নিয়ে এসে শনি, রবি এই দু’দিন পাড়ার মেয়েদের ক্যারাটে শেখার ব্যবস্থা করে দিলো। দলবল নিয়ে ষষ্টীকাকুর চোলাই মদের দোকান ভেঙ্গে দিলো। মেয়েটা পাড়ার মস্তানদের হুমকিতেও পিছু না হটে উল্টে দিনে দিনে আরও তেজী হয়ে উঠল, আর আজ এই মাঝরাতে সেই তড়িৎয়ের বউকে নিয়েই তুলি জ্বর গায়ে হাসপাতালে যাচ্ছে।
*****
তুলির গ্রামের লোকেরা প্রধানত চাষবাস নিয়েই থাকে। কিছু লোকের দোকানপাট আছে। তাঁরা সাইকেলে আর ভাদু’র ভ্যানে গ্রামের ফসল বড় হাটে ও বাজারে নিয়ে বিক্রি করে। মানুষের বিপদে আপদে এই ভ্যানই ছিল এতদিনের ভরসা। তুলির বাবা শহরের ব্যাবসায়ী জীবন মল্লিকের টোটো সারাদিন চালিয়ে দিনের শেষে টোটোটা মালিকের গ্যারেজে রেখে নিজের প্রাপ্য নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতেন। তুলির বাবা যখন মারা গেলেন, তুলি তখন সদ্য বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। ভেবেছিলো, শহরে বা দূরের কলকাতায় কিছু একটা চাকরী জোগাড় করে নেবে। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবে। কিন্তু বাবা হঠাৎই চলে যাওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। সারাদিন মাকে একলা বাড়িতে রেখে সে দূরে চাকরিতে যেতে পারবে না। একদিন মা’কে বলল, যখন কোন চাকরি পাচ্ছি না তখন বাবার মতন টোটোই চালাই। মা রাজি হলেন না। তখন তুলি বলে, “তুমি কী চাও মা? আমাদের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেলে আমরা লোকের বাড়িতে বাসন মেজে দিন কাটাই”
– তাই বলে, তুই টোটো চালাবি? লোকে কী বলবে?
– রাখো তো মা, তোমার লোকের কথা? ওরা কি একদিনও এসে তোমায় জিজ্ঞাসা করেছে যে আমাদের সংসার কী করে চলছে?
– তা, তুই বড় রাস্তায় এই গাড়ি চালাতে পারবি?
– কেন পারবো না? বাবার কাছে শিখেছি। কতবার এর আগেও তো চালিয়েছি।
বাবা মেয়ের আবদারে প্রায়ই সাইকেলে করে শহরে নিয়ে গিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে তুলিকে টোটো চালানো শেখাতেন। তুলির যখন কলেজ ছুটি, আর মোটামুটি চালানো শিখে নিয়েছে, তখন অনেকসময়ই তাকে ড্রাইভারের আসনে বসিয়ে যাত্রীদের নিয়ে যেতেন। টোটোর মালিক জীবনবাবু তুলির বাবাকে বলেছিলেন, মেয়েকে ভাল শিক্ষা দিচ্ছ। আজকাল ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কোনো তফাত করা উচিত নয়। তোমার মেয়ে যদি টোটো চালাতে চায়, করতে দাও। তুলির বাবা মারা যাবার পর উনি নিজেই একদিন তুলিকে ডেকে জানতে চান, তাঁর চাকরির কি হলো? তুলি জানায়, চাকরি যেমন সে পায়নি, আবার মাকে একা বাড়ি রেখে দূরে নিশ্চিন্তে চাকরীও সে করতে পারবে না। তখনই তুলি বলে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে টোটো কিনতে চায়। ভদ্রলোক খুবই খুশী হয়ে বলেন, “চলো, আমি নিজে তোমার লোনের গ্যারান্টার হবো।“ সেই থেকে তুলির নতুন এক জীবনের শুরু। জীবনবাবু তুলিকে শহরে নিয়ে গিয়ে খাকি ইউনিফর্ম বানিয়ে দিলেন, “প্রতিটি কাজের একটা পোষাক থাকে, এটা তোমার টোটো চালানোর ইউনিফর্ম।“
প্রথম দিনে খাকি ইউনিফর্ম গায়ে টোটো নিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে সরে যেতে বলে। তুলি সরলো না। সে বাবার সাথে অনেকদিন এই স্ট্যান্ডে এসেছে। নিয়মকানুন সে জানে। আরও কয়েকবার গাড়ি সরানোর কথা বললেও যখন সে সরালো না তখন একটি ছেলে তুলির কাছে এসে বলল, ‘”কি? কথা কানে যাচ্ছে না?”
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, সব শুনছি। আপনি আপনার মতন করে বলে যান। কেন সরতে হবে সেটাই আগে বলুন। আর, হ্যাঁ, আপনার নামটা একটু বলবেন?
ছেলেটি এই উত্তরের জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলো না। একটু অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “এখানে কোনো নতুন গাড়িকে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না।“
– সে তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার নামটা তো বললেন না?
ছেলেটি তখন আরেকজনকে ডেকে নিয়ে তুলির টোটোকে ঠেলে সরিয়ে দিলো। তুলি কিছুই বললো না, শুধু সীটের নিচের থেকে একটা লোহার ডান্ডা নিয়ে এসে ছেলেটিকে বললো, “তাহলে এবার আমার পালা।“
বাঁ হাতে লোহার রডটা হাতে রেখে, ডান হাতে সপাটে ছেলেটার গালে মারলো একটা চড়। আর অন্য ছেলেটির পেটে মারলো ক্যারাটের এক লাথি। ছেলেটি লাথি খেয়ে পাশের ড্রেনে পড়ে গেল।
– শুনুন, আমি ঝামেলা চাই না। কিন্তু ঝামেলা হলে আমি ক্যারাটে চালাতে পারি। আবার লোহার রডও চালাতে পারি। দয়া করে আমার এই কথাটা মনে রাখবেন।
ছেলেদের অবস্থা দেখে লোকজন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেও দু’একজন টোটোর ড্রাইভার, তাঁরাও লোহার রড বার করলো। তুলি আজ একটুও ভয় পায় নি, প্রস্তুত হয়েই এসেছে। আর ছেলেগুলো যতই হম্বিতম্বি করুক, প্রকাশ্য দিবালোকে স্ট্যান্ডে এত প্যাসেঞ্জারদের চোখের সামনে তুলির গায়ে হাত তুলবে, এমন সাহসও ওঁদের নেই। কথা কাটাকাটির মধ্যেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন তুলির গায়ে হাত দিতেই সে ক্ষেপে গিয়ে তার পেটে আবার মারলো ক্যারাটের এক কিক, মানে সহজ কথায় মারলো পেটে এক লাথি। আর ছেলেটাও তিনহাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। এসব দেখে স্ট্যান্ডের ঘুঘনি পিসি, যার কাছ থেকে তুলি নানান রকমের খাবার কিনে খায়, সেও বলতে শুরু করল, বাবা! সমরদা, কীরকম মেয়ে তৈরী করেছে? একেবারে গুন্ডা! এই বলে সে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে তুলিকে কোনরকমে সামলে নিলো।
মারপিট আর হলো না। বাজারের কমিটির প্রেসিডেন্ট বারীনবাবু এসে তুলিকে বলছে ”তুই পারবি, ছেলেদের সাথে মারপিট করে টিঁকে থাকতে? গাড়ি হয়ত চালাতে পারবি, কিন্তু মিস্ত্রীরা, হেল্পাররা যে ভাষায় কথা বলে, তুই পারবি সেই ভাষায় কথা বলতে? মনে রাখবি, তুই একটা মেয়ে।“
তুলির মাথা গরম হয়ে গেল। “শুনুন, আপনি রাজনীতি করেন, এঁদের সকলে আপনার পার্টিকে চাঁদা দেয়। এসব আমি কেন, সকলেই জানে। আমাকে ‘মেয়ে মেয়ে’ বলে দূর্বল ভাবলে সেটা কিন্তু আপনার বোকামি হবে। ছোট করে ছোট একটা কথা বললাম। কথাটা মনে রাখবেন।“
ঘুঘনি পিসি ডাকলো, “তুলি, আয় আমার সাথে আয়।“
ঘুঘনি পিসি অন্যদের বললো, “তোমরা কিন্তু কোন ঝামেলা করবে না, আমি সব নিজের চোখে দেখেছি। দরকার হলে আমি পুলিশের কাছে সাক্ষী হবো।“
এবার বিপিনবাবুকে বললেন, “আপনি আপনার কাজে যান। যদি সঠিক বিচার করতে না পারেন, তাহলে অবিচার করারও চেস্টা করবেন না।“
ছোট গঞ্জের জায়গা। গন্ডগোলের খবর পেয়ে পুলিশ এসেই ভিড় হয়ে থাকা জনতাকে সরিয়ে দিয়ে তুলিকে ধমক দিয়ে বললেন, “দাঁড়াও, এখন আমাদের কাজ করতে দাও”।
– দাঁড়ান, দাঁড়ান পুলিশ সাহেব, একটু দাঁড়ান। আপনি এখন সরকারি ডিউটিতে। ধমক দিয়ে আমার সাথে কথা বলবেন না, আর আপনি আপনি করে কথা বলবেন। তুমি তুমি করে নয়। আমাকে যদি আপনি আপনি বলে কথা বলতে অসুবিধে হয়, তাহলে আমি আপনার সাথে কথা না বলে আপনার উপরমহলেই কথা বলবো।
পুলিশ অফিসারের মুখের উপর এইধরণের উত্তর এই অঞ্চলে কেউ করতে সাহসই পায় না। তিনি একেবারেই চুপসে গেলেন। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে জীবনবাবু, যিনি তুলির বাবাকে টোটো চালাতে দিয়েছিলেন, তিনিও উপস্থিত। “কি তুলি? কি হয়েছে?”
– সেরকম কিছু না কাকু। পুলিশ এসে না জেনেই ফাঁকা ময়দানে তর্জনগর্জন করছিলো, আমি সে সামলে নিয়েছি।
“কি অফিসার? কি শুনছি? যদিও স্পটে ছিলাম না, কিন্তু আমার কাছে খবর গেছে যে এই টোটো ড্রাইভারেরা নাকি বলেছে, তুলিকে এখানে গাড়ি রাখতে দেবে না?”
অফিসার জীবনবাবুকে চেনেন। অঞ্চলের নামী লোক। কোনমতে বললেন, না, না আমাকে আগে ইনভেস্টিগেট করতে দিন। তারপর দেখছি।
– তাহলে শুনুন অফিসার। আপনাদের পুলিশের সাথে এঁদের যোগাযোগ আমার অজানা নয়। দরকারে আমিও আমার প্রভাব খাটাতে পারি, সেটা মনে রাখবেন। আমি সবসময় অল্প কথা বলি। আপনার সাথে এর বেশি কথা বলতে চাই না। শহরে আমার জরুরী কাজ আছে। এখন যাচ্ছি। প্রয়োজনে হলে আমি আবার আসবো।
উনি চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য ড্রাইভাররা অভিযোগ আনলো কীভাবে তুলি তাদের মেরেছে। তুলি শুনছে, কিছু বলছে না। পুলিশ বুঝতে পেরেছে, অবস্থা মেয়েটির অনুকুলেই। অন্যদের কথা শেষ হলে অফিসার তুলিকে বললেন, “তুমি কিছু বলবে?”
– হ্যাঁ বলবো, তবে আবার বলি, আর তুমি তুমি নয়, এরপর আমাকে আপনি করে বলবেন। আচ্ছা, ওঁদের জিজ্ঞেস করুন তো, এই স্ট্যান্ডের মালিক কে? আর, আমার গাড়িটাকেই বা ধাক্কা মেরে কেন সরিয়ে দিলো?
গোলমাল শুনে ঘুঘনিপিসিও চলে এসেছে। “শোনো পুলিশ, আমার অত ভয়ডর নেই। আমি সবই দেখেছি। দরকার হলে আমার সাক্ষী নাও।”
এবার পরিস্থিতি আরও পাল্টে গেলো। অফিসার ড্রাইভারদের বললেন, আপনাদের লজ্জা লাগছে না বলতে? একটা মেয়ের হাতে আপনারা মার খেয়ে নালিশ করতে এসেছেন? সে কেন মেরেছে? নিশ্চয়ই তোমরা কিছু করেছো?
– স্যার আমরা কিছুই করি নি,
– তার মানে সে বিনা কারণে তোমাদের মেরেছে?
অফিসার গোলমালের কারণ আন্দাজ করে ফেলেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তুলিকে টোটো চালাতে কেন দিচ্ছ না?
– স্যার, ও মেয়ে,
– তাতে কী হয়েছে?
– কতরকমের প্যাসেঞ্জার আছে। যদি কোনো বিপদ হয়।
– বিপদ হলে সে সামলাবে। তোমাদের সে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
– কী যে বলেন স্যার? ও আমাদের মেয়ে। সেই ছোট থেকে বাবার সাথে এসে টোটো চালাত। আমরা কী ওর কোনো ক্ষতি দেখতে পারি?
– তাহলে কী করবে? ওঁর বাড়িতে হাঁড়ি চড়ার ব্যাবস্থা করতে পারবে? যদি নাই বা পারলে, তাহলে ওঁকে নিজের মতন কাজ করতে দাও।
– স্যার, তবুও এই রাস্তায় দিনরাত বাস ট্রাক চলছে বলেই তো আমরা এতসব বলছি।
– শোনো, আর কথা নয়। মেয়েটা এখানেই টোটো রাখবে,আর নিজের মতন টোটো চালাবে।
টোটো ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্মল একবার চেষ্টা করলো, স্যার, রাস্তায় কতরকমের লোক থাকে। সব প্যাসেঞ্জারও ভালো নয়। এই জায়গায় কী ওর টোটো চালানোটা ঠিক হবে?
– তাহলে কী বলতে চাও, ওরা না খেয়ে মরবে?
– না স্যার, কিন্তু,
– কোনো কিন্তু নয়। তুলি ওর বাবার জায়গাতেই টোটো চালাবে।
এরপর তুলির প্রথম দিনটা ভালোই গেলো। মা ঘরে বসেই খবর পেয়েছিলেন। মেয়ে বাড়ি ফিরতেই বললেন, এইজন্য তো বলছিলাম, গাড়ি চালানো মেয়েদের কাজ নয়। টোটো না চালিয়ে অন্য কিছু কর।
এইভাবে টোটো চালনো শুরু হলেও টোটোওয়ালারা একদিন প্ল্যান করে কিছু বদমাশ ছেলেকে তুলির টোটোতে প্যাসেঞ্জার সাজিয়ে উঠিয়ে দিল। তুলি তার পাশে কাউকেই বসতে দেয় না। চারজন প্যাসেঞ্জারকেই পিছনের সীটে বসিয়ে নিয়ে যায়। আজকেও চারজন বসেছে। তুলি সামনে বসে গাড়ি চালাচ্ছে আর চারজন পিছনের সীটে। গাড়িটা একটু ফাঁকা রাস্তা ধরতেই ছেলেরা নিজেদের মধ্যে নোংরা ভাষায় কথা বলতে শুরু করল, আর সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া গাড়ির মধ্যেই ছাড়তে থাকলো। তুলি গাড়ি থামিয়ে তাদের অনুরোধ করল গাড়িতে সিগারেট না খাওয়ার জন্য। ছেলেরা হাসতে হাসতে বলছে, টোটোতেও সিগারেট খাওয়া বারণ? তুলি ঠান্ডা মাথায় জবাব দিল, আমার গাড়িতে খাওয়া যায় না।
– কেন? আপনার গাড়িটা কি স্পেশাল?
তুলি আবার ছেলেদের বলল, সিগারেট না খেতে এবং ভদ্রভাষায় কথা বলতে। ছেলেরা তার কথায় হাসতে শুরু করে দিল। এবার সে টোটো থামিয়ে তাদের নেমে যেতে বলায় তারা উত্তেজিত হয়ে ঝগড়া শুরু করে দিলো। মেয়ে ড্রাইভারের সাথে প্যাসেঞ্জারদের কথা কাটাকাটি দেখতে জনতার ভিড় হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় জ্যাম হতেই এক পুলিশ এসে উপস্থিত। তুলিকে টোটো চালাতে বললে, সে ছেলেদের অসভ্যতার কথা জানায়, আর ছেলেরা পুলিশকে বলল, দেখুন স্যার, আমাদেরকে নিয়ে যাবে বলে গাড়িতে উঠিয়ে এখন মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছে, আমরা কী করে যাই বলুন তো?
তুলি বলে দিলো, নিয়ে যাবো না। এই বলে সে টোটো নিয়ে চলে গেলো।
তুলি খালি টোটো নিয়ে এত তাড়াতাড়ি স্ট্যান্ডে ফিরতেই অন্য কিছু ড্রাইভার জানতে চাইলো, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?
– না দাদা, মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিলাম। নইলে আবার ক্যারাটের লাথি চালাতে হতো।
*****
এসব কথা ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে গেলো। মা ভাবছেন তুলি কি ঐশীকে নিয়ে হাসপাতালে ভালভাবে পৌঁছেছে? তুলি টোটো নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখলেন গা খুব গরম না হলেও চোখ ছলছল করছে আর গলাও বসে গেছে। পাশে বসা তড়িৎয়ের বোনের থেকে সব খবর শুনে তিনি বললেন, যাক্ বাবা, ভালোয় ভালোয় সব হয়েছে। তড়িৎয়ের মা বাবাও তুলির প্রশংসা করলেন।
তড়িৎ তার সদ্যজাত ছেলে আর বউকে নিয়ে বাড়িতে আসার পরে ছ’দিনের দিন ষষ্ঠী পুজোতে তুলিদের নেমন্তন্ন করায় তারা দুজনেই তড়িৎদের বাড়িতে গেছে। পাড়ার অন্যান্যরাও এসেছেন। এখন গ্রামের মহিলাদের অন্য সুর। মায়েরাও বলছে তুলি না থাকলে ঐশীর অবস্থাও আজ হয়ত শেফালির মতো হতো।
তুলিরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য উঠার সময় তড়িৎয়ের মা তাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন। পাড়ার সবাই চলে গেছেন। তড়িৎয়ের মা তুলির মায়ের হাত ধরে তুলিকে চাইলেন ছোট বউ হিসেবে। মা কিছুই বলতে পারছেন না। তুলিই জবাব দিলো, না কাকীমা। আগে তোমার দুই ছেলে অমানুষ থেকে মানুষ হোক, তারপর না হয় এসব ভাবা যাবে।
*****
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলো না।
তুলির এখন ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি আছে, এনসিসি সার্টিফিকেট আছে, প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকায়াজের সার্টিফিকেট আছে, ক্যারাটে জানে। জীবনবাবুই পুলিশ মহলে বলেছিলেন, এই অঞ্চলে একজন মহিলা পুলিশ অফিসার দরকার।
পুলিশ দপ্তর রাজি হয় কিন্তু তুলিকে অফিসার গ্রেড দিতে পারে নি, সে এখন নিজের অঞ্চলের পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর। এখন তাঁদের গ্রামে কেউ মেয়েদের টিটিকিরি মারে না, চোলাই মদের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, টোটো দৌরাত্ম একদমই নেই, কালীপূজা, সরস্বতী পূজার নামে তারস্বরে মাইক বাজে না। বাজারের দোকানের প্রেসিডেন্ট বিপিনবাবুও তুলির সাথে সমীহ করে কথা বলেন। ক্যারাটে ক্লাস আবার চালু হয়েছে। বেশ কিছু আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা শিখতে আসে।
অঞ্চলে তুলির নাম এখন অপরাজিতা ম্যাডাম।
Add comment