অচেনা পাখি
শ্রী দেবাশীষ গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৭৭, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং
অস্ংখ্য নদী-নালা-খাঁড়িতে আঁকিবুঁকি কাটা সুন্দরবনের জঙ্গল শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে আসে তাঁর রয়াল বেঙ্গল টাইগার। আমরা সুন্দরবনকে জানি তথাকথিত মানুষখেকো বাঘেদের বাসভূমি হিসাবে। যেটুকু কম জানি, সেটা হলো এই যে প্রকৃতি এখানে তাঁর অপরূপা বন্য সাজে নিজেকে মেলে ধরেছেন। প্রকৃতি মূলতঃ বিরূপা, করালমূর্তি হলেও সুন্দরবনকে তিনি সাজিয়েছেন অন্যভাবে। জীব, জল ও উদ্ভিদের এক অনন্য অসাধারণ বৈচিত্রে।
পাখীরা এখানে নিজেদের পরিবেশে নিজেদের মতন থাকে। মানুষের তথাকথিত ইন্টারফেয়ারেন্স এখানে এসে পৌঁছায় না। তাই এরা নির্ভয়ে মুক্ত পরিবেশেই বিচরণ করে। আমি নিজে বহুদিনের পক্ষীপ্রেমিক হয়ে বলতে পারি যে সুন্দরবন অঞ্চল পাখী দেখার এক অসাধারন জায়গা। তবে এর সাথে আরও একটা কথা বলে রাখা ভালো, যে ভ্রমণকারীদের পক্ষে পাখী দেখা এখানে মোটেই সহজ নয়। কারণ, জলচর ও জলের ধারের পাখীদের নদীনালার ধারে ধারে নৌকা বা বোট থেকে দেখা গেলেও, শুধু পাখী দেখার জন্য ডাঙায় নেমে জঙ্গলের ভিতর ঢোকার উপায় নেই। তার কারন সুন্দরবনের বিখ্যাত এঁটেল কাদা, ছুরির ফলার মত শ্বাসমূলের কার্পেট আর মানুষখেকো বাঘ। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টুরিস্ট ডিপার্ট্মেন্টের বদান্যতায় সজনেখালি, নেতিধোপানি, সুধন্যখালি, দোবাঁকি, বুড়ির দাবড়ি ইত্যাদি কিছু অঞ্চলে জঙ্গলের সামান্য ভিতরে ওয়াচটাওয়ার করা আছে। পাশেই মিষ্টি জলের পুকুর। সেখানে ওয়াচটাওয়ার থেকে অনেক পাখীর দেখা পাওয়া সম্ভব। তবে সেই একই কথা, যদি ভাগ্যে থাকে।
প্রধানতঃ চরম প্রতিকুলতা ও বিপদের জন্য সুন্দরবনে কোথাও, বিশেষতঃ ব্যাঘ্রপ্রকল্পের ভিতরে, বিশেষভাবে পাখী ও তার বৈচিত্র্য নিয়ে কখনো কোন দীর্ঘমেয়াদি চর্চা হয়নি। বনবিভাগের কর্তাদের সাথে আমার সুদীর্ঘ সুসম্পর্কের সুত্রে ১৯৮৯ সালে আমাদের সংস্থা “প্রকৃতি সংসদ”কে ভার দেওয়া হয় ব্যাঘ্রপ্রকল্পের মধ্যে বিজ্ঞানসন্মতভাবে পাখী সমীক্ষা করে একটা বিশদ তালিকা নথিবদ্ধ করার জন্য। অবশ্য কাজ শুরু হওয়ার বছরেই নভেম্ব্র মাসে ব্যাঘ্রসুমারি শুরুর দিন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বনবিভাগের ভাড়া করা “রাঙ্গাবেলিয়া” ও “অতুলচন্দ্র” নামে দুটি স্টীমার ডুবে যায় ও অন্যান্যদের সাথে ব্যাঘ্রপ্রকল্পের রিসার্চ অফিসার প্রাণ হারান। এর ফলে দীর্ঘ সময়ের জন্য এই কাজ বন্ধ থাকে। পরে ১৯৯৬ সালে আবার সমীক্ষা শুরু করে দীর্ঘ আট বছর ধরে সমীক্ষা করা হয়। তালিকা তৈরীর সংগে দরকার ছিল ছবি তোলার এবং সর্বসাধারণের জন্য একটি প্রামাণ্য পুস্তিকা বের করা। প্রায় ছ-সাত দিন ধরে প্রতি মাসে পালা করে একবার আমাদের যাওয়া হত। সেই সময়ে দুশোর বেশী প্রজাতির পাখী দেখা হয়েছে সেইসঙ্গে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাও হয়েছে যা মনের মণিকোঠায় সযত্নে থাকবে যতদিন বাঁচবো।
বিশেষভাবে মনে পড়ে ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে, সেটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় সফর। সকাল আটটা নাগাদ সুধন্যখালি ছাড়িয়ে লঞ্চে চলেছি পীরখালির দিকে। হঠাৎ সামনেই একটা ডানহাতি খাঁড়ির মুখে জলের ধারে চোখে পড়ল এক অতিকায় সারস জাতীয় পাখী। দাঁড়ান অবস্থায় উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। পা আর ঠোঁট কালো রঙ, মাথা এবং ঘাড় উজ্জ্বল লালচে ছেষত্না; পেট এবং দুই ডানার তলার রং চেস্টনাট; পিঠ বাদামি ধুসর। প্রথমে তো পার্পল হেরন (Purple Heron) বলে ভুল করেছিলাম। কাছে আসতে বুঝলাম এ অন্য পাখী। বই দেখে ও ছবি তুলে পরে মিলিয়ে বোঝা গেল এটা হল জায়েন্ট বা গলিয়াথ হেরন (Goliath Heron) যা কিনা মূলতঃ আফ্রিকার পাখী। সুন্দরবন অঞ্চলে একে শেষ দেখা গিয়েছিল ১৯০৪ সালে। এক ব্রিটিশ নাবিক জাহাজে করে কলকাতা থেকে সমুদ্রে যাওয়ার পথে এর দেখা পেয়েছিলেন। পরেও বেশ কয়েকবার এ পাখীর দেখা আমরা পেয়েছি বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু এদের কোন বাসা আজও খুঁজে পাইনি।
আরেকটি স্মরণীয় ঘটনার উল্লেখ করবো। সেটা ২০০০ সালের নভেম্বর মাস। ছবি তোলার জন্য আমাদের জাল পেতে ছোট পাখী ধরতে হত। জঙ্গলে নেমে এ্যলুমিনিয়াম পোল গেঁথে তাতে পাতলা, মিহি অথচ শক্ত জাল (Mist Net) খাড়া করে টাঙানো হত। ভোরের আলো ফোটার সময় আর শেষ বিকালে পাখীদের ওড়াউড়ি শুরু হয়। তখন ছোট ছোট পাখীরা, যাদের সহজে চোখে পড়েনা, এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে উড়ে যেতে গিয়ে ঐ জালে আটকা পড়ত। আলো ফুটলে বা অন্ধকার গাঢ হবার আগেই পায়ে হেঁটে গিয়ে জাল থেকে পাখীদের ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হত। নাহলে বেশীক্ষণ ঐ ভাবে থাকলে মরে যেতে পারে।
খুবই সাবধানে একাজ করতে হতো – একে মানুষখেকো বাঘের জঙ্গল, সাপও প্রচুর, তার উপর ছোট্ট পাখীদের এতোটুকুও আঘাত যাতে না লাগে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই – লাঠি, বন্দুক পর্যাপ্ত সঙ্গে থাকলেও সবসময় পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইত এবং পেটের ভিতর গুড়গুড় করত। এরপর বালিশের খোলে পাখীদের ভরে ফেরা হতো লঞ্চে। এ্যলুমিনিয়াম রড দিয়ে একটা লম্বাটে খাঁচা বানানো হয়েছিল এবং সেটা একটা সেলাই করা ধুতির খোলের মধ্য ভরে লঞ্চে রাখা থাকত। এবার একে একে পাখীদের ঐ খাঁচায় ছেড়ে দিয়ে ছবি তোলা হতো এবং পরে আবার মুক্ত করে ছেড়ে দেওয়া হতো।
এরকমই সেবার নেতিধোপানিতে জাল পেতে পাখী ধরা হয়েছে ভোরবেলা। অন্যান্য অনেক পাখীর সঙ্গে একটা মৌটুসি (Purple Sunbird) ধরা পড়েছে। এর আগে মৌটুসির অনেক ছবি নেওয়া হয়েছে। তবু ছেড়ে না দিয়ে সেটাকে লঞ্চে নিয়ে আসা্ হলো। খাঁচার মধ্যে ক্যামেরার ভিতর দিয়ে ভালো করে পাখীটাকে যখন দেখলাম, সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম তার বুকের ওপর এক ডানা থেকে অন্য ডানা অবধি একটা সরু লাল দাগ আড়াআড়ি আঁকা রয়েছে। আমাদের পরিচিত মৌটুসির মতো চকচকে ধাতব নীল-সবুজ-কালো গায়ের রং, কিন্তু ঐ লাল দাগ আগে কখনো দেখিনি। ছবি তোলার পর কৌতূহলী হয়ে তাকে হাতে ধরে নিয়ে আসা হল উপরের ডেকে। খুঁটিয়ে দেখা গেল সাধারন মৌটুসির থেকেও আকারে ইঞ্চি খানেক ব্ড়, ঠোঁটও লম্বায় বড়, প্রায় দেহের দৈর্ঘ্যের সমান, অনেক বেশি বাঁকা ও কিছুটা মোটা। ডানা তুলে দেখা গেল দুই ডানারই গোড়ায় বগলে একটা করে হলদে ফুটকি আঁকা। যেখানে আমাদের মৌটুসি পাখীর থাকে একটা করে লাল ও একটা হলদে ফুটকি। সঙ্গে আনা বই ঘেঁটে মিলিয়ে দেখা গেল এটা হল লোটেনের মৌটুসি (Loten’s Sunbird)। যা কিনা দেখা যায় শুধু শ্রীলঙ্কায় এবং কন্যাকুমারির আশেপাশে। চোখকে কেউ অবিশ্বাস করতে পারছি না, হাতে ধরা জলজ্যান্ত পাখী। কিন্তু তা বলে এই সুন্দরবনে? কোথায় শ্রীলঙ্কা, কোথায় কন্যাকুমারি? প্রকৃতির কি বিচিত্র রহস্য! ধরা না দিলে কেউ জানতেও পারতাম না লোটেনের মৌটুসি সুন্দরবনেও পাওয়া যায়। এই আবিস্কারের কথা আমরা জানাই ইংলন্ড থেকে প্রকাশিত Bird Life International প্ত্রিকার কতৃপক্ষকে এবং আমেরিকার অডোবন সোসাইটিতে (Audobon Society) বিধিসন্মত ভাবে নথিবদ্ধ করতে।
উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্য ধৈর্য্য ধরে সময় নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করলে এরকম আরও কত অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। আমাদের পর্যবেক্ষণ কালে এরকম আরও কত বিচিত্র পাখীর সন্ধান পেয়েছি। যেমন – গ্রীণ বিল্ড মালকোহা (Green Billed Malkoha) যা হিমালয়ের পাদদেশে পাওয়া যায়; লালচে কাঠ ঠোকরা (Rufous Woodpecker) যা পাওয়া যায় বর্মা থেকে মালয়েশিয়ায়। প্রকৃতির এই অপার রহস্যের কতটুকুই বা আমরা জানি এবং সমস্ত জীবনের সাধনাতেও সামান্যতম জ্ঞান আহরণে আমরা অসমর্থ।
Add comment