সাহিত্যিকা

দুধের সাগরে

দুধের সাগরে
অসীম সাহা, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার

আমি কোনোদিন কিছু লিখিনি কারণ আমার অক্ষমতা আমি জানি, তাই কোনোদিন চেষ্টাও করিনি। আমার খুব প্ৰিয় এক বন্ধুর অনুরোধ এবং অনুপ্রেরণায় আজ এই লেখাটা লিখতে চেষ্টা করছি, জানিনা সবার কেমন লাগবে, না ভালো লাগলে ডিলিট করে দিলেই হবে, আওয়াজটা না দিয়ে।

আমি সবে কলেজ থেকে পাস করে জেশ্যপ কোম্পানিতে ট্রেনি হিসেবে রয়েছি কিন্তু আমার মন একেবারেই এইখানে বসছে না। ডুবন্ত কোম্পানিতে কাজের কোনই পরিবেশ নেই, তার সাথে ইউনিয়নবাজি, ম্যানেজমেন্টের অকর্মণ্যতা। যেকোনো দিন এই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাবে।

যাইহোক, NDDB (National Dairy Development Board) থেকে আমি এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেলাম এবং আমাকে জয়েন করতে হবে সেই অনেক দূরে, কলকাতা থেকে আমাদের দেশের আরেক প্রান্তে Anand নামে গুজরাটের একটা প্রায় গ্রামে, NDDB র HQ-এ। আমাদেরকে জয়েন করতে হবে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। বাড়ি ঘর, বাবা, মাকে ছেড়ে, প্রেমিকাকে ছেড়ে ঐ অতদূরে। গুজরাট সম্পর্কে আমার বা বাড়ির লোকেদের একেবারেই কোন ধারণা ছিলো না, তাও একটা প্রায় গ্রাম সম্পর্কে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, তখনের গুজরাট আর এখনকার গুজরাট কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ, কোনো তুলনাই চলে না।

ঠিক হলো আমি প্রথমে মুম্বাইতে আমার এক পিসির বাড়িতে যাবো, সেখান থেকে আনন্দ গ্রামে। আমি নির্দিষ্ট দিনে মুম্বাই থেকে আনন্দ এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ট্রেনে চেপে, ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসের এক রবিবার, পরের দিন আমার জয়েন করতে হবে। ট্রেনে দেখি লোকজন যে যার নিজের মতো ব্যস্ত, কেও কারুর ব্যাপারে অযথা নাক গলাচ্ছে না, বেশিরভাগ লোকই শেয়ার বা ব্যবসা নিয়ে কথা বলছে। আমার যেহেতু শেয়ার এর ব্যাপারে কোনো আইডিয়া বা ইন্টারেস্ট ছিলো না, তাই আমি বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চললাম। বাইরের পরিবেশ প্রায় আমাদের বাংলার মতই, সবুজ গাছপালা, খেত, পরিবেশ বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু তার মধ্যেও ভেতরে একটা চাপা টেনশন কাজ করছিলো। ধীরে ধীরে বেশিরভাগ লোকজন যাচ্ছে আর ট্রেনটাও ফাঁকা হয়ে যেতে লাগলো। আর আমার মনে অজানা আশঙ্কা এই ভেবে যে, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায় কোনো লোকজনই থাকে না। আনন্দ স্টেশনে নেবে আরো অবাক হলাম, যে আমি ছাড়া আর মাত্র চার ছয়’জন লোক নাবলো, বাকী পুরো স্টেশন ফাঁকা। আমি কিছুক্ষন স্টেশনে বসে রইলাম কি করবো? কোথায় যাবো? আরো দেরি করলে রাত হয়ে যাবে, তার মধ্যে একটা থাকার জায়গা জোগাড় করতেই হবে, রাতটুকু কাটাবার জন্য।

স্টেশন থেকে বেরোলাম কাঁধে, হাতে বড়ো সুটকেস, হোল্ডল আর ছোট ব্যাগ নিয়ে, খোঁজ নিচ্ছি কোথায় একটু থাকার জায়গা পাওয়া যায়। ভাষার সমস্যা আছে। কোনরকমে লোকজনকে বুঝিয়ে বেশ কিছুক্ষন খোঁজ করার পরে একটা আস্তানা খুঁজে পাওয়া গেলো এবং আমি সেইখানে গিয়ে পৌঁছলাম। থাকার জায়গা মানে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট। তার পেছন দিকে সিঁড়ির পাশে একটা ছোট ঘর আর তার মধ্যে একটা চৌকি, আর প্রায় কিছুই নেই সেই ঘরে, আমি যাবার পরে কোথা থেকে একটা তোষক জোগাড় করে ঐ চৌকির ওপর পেতে দিলো, ব্যস হয়ে গেলো আমার থাকার জায়গা। যেটা তখনকার মতো রাত কাটিয়ে দেবার জন্য যথেষ্টই বলে আমার মনে হয়েছিলো। এতো জার্নি করে সারাদিন প্রায় না খেয়ে থেকে খুব খিদে পেয়ে গেছিলো তাই তাড়াতাড়ি স্নান করে সেই রেস্টুরেন্ট এ খেতে বসে গেলাম। খুব খিদে পেয়েছিলো, বেশ কিছু অর্ডার দিয়েছিলাম। খাবার যথা সময় এলো, প্লেট ভর্তি বিভিন্ন রকমের খাবার, বিভিন্ন ছোট ছোট বাটিতে বিভিন্ন item। আমি রুটি দিয়ে একটা item মুখে দিয়েছি, মনে হলো কেউ চিনি গোলা সবজি ঢেলে দিয়েছে, এরপর যে item নিচ্ছি সবই এক টেস্ট, এতো মিষ্টি যে, সেগুলো মুখ দিয়ে ঢুকতেই চাইছে না। আমি করোলা’র একটা আইটেম নিলাম যাতে সেটা দিয়ে অন্তত খাওয়া যায়, ওরে বাবা, সেই করোলার মধ্যেও মিষ্টি দিয়ে রেখেছে। ভাগ্যিস পিসিমা কিছু খাবার আমার সাথে দিয়ে দিয়েছিলেন তাই রাতটা ঐ খাবার খেয়ে উদর পূর্তি হয়েছিলো। এরপর ঘরে গিয়ে মনে একরাশ চিন্তা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি।

পরের দিন সকালে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেলাম, কারণ এখানে কিছু খাওয়া যাবে না। খোঁজ নিয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলাম, ভেবেছিলাম অফিসের কাছাকাছি কোনো খাবার দোকান থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে নেবো। অফিসের কাছাকাছি এসে আমি অবাকই হয়ে গেলাম, এ কোন জায়গায় এসেছি? একেবারে ঝাঁ চকচকে পরিবেশ। মনে হলো বিদেশের কোন উন্নত অফিস অঞ্চলে এসে পড়েছি, চারিদিক বিভিন্ন রকমের বাহারি গাছপালা, ভাবতেই পারিনি গুজরাটের প্রায় এক গ্রামে কি ভাবে এতো সুন্দর অফিস অঞ্চল তৈরি করেছে, অফিস বিল্ডিং আর তার আশপাশ এতো সুন্দর করে তৈরি হয়েছে যে, যেকোনো উন্নত শহরের অফিসের পরিবেশের সাথে তুলনা করা চলে। আমি কিন্তু ১৯৭৮ সালের কথা বলছি।

অফিস এরিয়ার পাশেই একটা বড় বেকারী কাম রেস্টুরেন্ট দেখলাম, সেখানে গিয়ে ব্রেকফাস্ট এবং চা খেতে গিয়ে আবার ধাক্কা, কারণ চা পুরো ঘন দুধ আর একগাদা চিনি দিয়ে তৈরি। নামমাত্র চা পাতা দেওয়া, আবার এলাচিও রয়েছে। পরে জানলাম ওখানেরলোকজন এই গাদাখানেক মিষ্টি দিয়ে সবকিছু খেতে অভ্যস্ত। কিছুক্ষনের মধ্যে আরো বেশ কিছু ছেলে ঐ বেকারীতে ঢুকলো আমারই মতো ব্রেকফাস্ট করার জন্য। জানতে পারলাম সবাই আমার মতো আজই এই অফিসে জয়েন করতে এসেছে।

আমরা সবাই মেইন অফিস বিল্ডিং এ ঠিক সাড়ে নটায় কাঁচের বিশাল দরজা ঠেলে ঢুকলাম এবং সামনে বিশাল লবিতে সবাই জড়ো হলাম রিসেপশন কাউন্টারে, যেখানে বসে ছিলেন দুজন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী (দেখে জমজ বলে ভুল হতে পারে, কারণ দেখতে এবং সাজ পোশাকে প্রায় এক) একজন মহিলা এক কোনায় টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করে চলেছেন। ওনারাই বলে দিলেন যে দোতলায় গিয়ে অ্যাডমিন সেকশনে রিপোর্ট করতে। আমরা গিয়ে রিপোর্ট করলাম। সেখানে দেখলাম আরো কিছু আমাদের বয়সি এবং কিছু সিনিয়রও এসেছে জয়েন করতে। এত এত সুন্দরী মেয়েদের একসাথে দেখে সেই প্রবাসে আমাদের মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে গেলো। হঠাৎই দারুন এনার্জি পেয়ে গেলাম।

জয়েনিং এর পর আমাদের বলা হলো ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে গিয়ে ডিরেক্টর এর সাথে দেখা করতে। আমরা ঐ বিল্ডিং এরই দোতলায় গেলাম। ডিরেক্টর এর সেক্রেটারি (দেখলে মাথা ঘুরে যায়, অবশ্য ঐ বয়সে একটু সুন্দরী যে কোনো মেয়েকে দেখলেই আমার এই অবস্থা হয়ে যেতো) জানালেন ডিরেক্টর দেখা করবেন কনফারেন্স রুমে এবং সেইমত গিয়ে বসলাম কনফারেন্স রুমে। এই বিশাল কনফারেন্স রুমের চাকচিক্য দেখে অবাকই হইয়েছিলাম কারণ আমি এসেছি জেশ্যপ এর মতো একটা ডুবে যাওয়া কোম্পানির ভেতরের দুরাবস্থা দেখে। এই প্রায় গ্রামে এতো মডার্ন এবং এতো হাই ফাই একটা কনফারেন্স রুম দেখে অবাক হওয়ারই কথা।

ডিরেক্টর সাহেব কিছুক্ষনের মধ্যেই এলেন। হ্যান্ডসাম, সুট, টাই পরা, অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব। আমি আরেকটা ধাক্কা খেলাম যখন উনি নিজের নাম বলে পরিচয় দিলেন। ডক্টর অসীম কুমার ব্যানার্জী। অবাক হয়ে ভাবলাম এই আধা শহর, আধা গ্রামে, গুজরাটের মতো একটা রাজ্যে এই উচ্চ পদে অধিষ্টিত এক বাঙালী?

উনি সবার সাথে প্রাথমিক আলাপ চারিতা সেরে নিয়ে আমাদের সকলকে বললেন ইনস্টিটিউট হলে চলে যেতে যেখানে আমাদের ট্রেনিং শুরু হবে। এই অফিস বিল্ডিং থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই ইনস্টিটিউট হল, পথে চোখে পড়ছিলো কি সুন্দর চারিদিক সাজানো, বিভিন্ন ফুল আর গাছপালা দিয়ে, কার্পেট এর মতো ঘাস, উঁচু নিচু ঢিপির মতো, তার ওপর ঘাসের বাগান। এক মনোরম পরিবেশ। মন ভরে গেলো।

এই অফিস ক্যাম্পাসের অনেকগুলো বাড়ির মধ্যে একটা তিনতলা বাড়ি সবে কমপ্লিট হতে চলেছে, তার বাইরের দেওয়াল এক বিশেষ ধরণের প্লাস্টার দিয়ে তৈরি এবং জানা গেলো যে এই প্লাস্টারকে wrinkle plaster বলে। পরে দেখেছি যে প্রত্যেকটা বাড়িরই বাইরের দেওয়ালে এইরকম wrinkle plaster করা, এতে একটা অন্য ধরণের সৌন্দর্য্য আছে। NDDB র কলকাতার সল্টলেকে যে অফিস আছে সেই বিল্ডিং এর বাইরের দেওয়ালেও একই রকম wrinkle প্লাস্টার করা।

আরো জানতে পারলাম এখানেই আসছে এক বিশাল মেনফ্রেম কম্পিউটার, যা শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কারণ আমাদের দেশে তখনও কম্পিউটারের বানিজ্যিক ব্যাবহার সীমিত, অথচ এই ছোট্ট একটি গ্রামের মতন শহরে কম্পিউটার? পরে জেনেছিলাম যে EU থেকে NDDB এই বিশাল IBM কম্পিউটার অনুদান হিসেবে পেয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই কম্পিউটার installation এর কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাদের অফিসের যাবতীয় বিভিন্ন ধরণের সব কাজ এই কম্পিউটারের মাধ্যমে শুরু হয়ে যাবে এবং দু’জন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগও হয়ে গেলো।

এবার ফিরে এলাম আমাদের গন্তব্য স্থলে, মানে ইনস্টিটিউট হলে। আমাদের কারুর কোনো ধারণাই নেই এর পরে আমাদের কি কাজ? একজন খুব সুন্দরী মহিলা ঠকঠক আওয়াজ কয়ার হাইহিল পরে এসে আমাদের একটা হল ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন। সেখানে অনেক চেয়ার, টেবিল, আমাদের স্কুল কলেজের ক্লাসরুমের মতন। কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন প্রফেসর গোছের ভদ্রলোক, চোখে চশমা, সুট, টাই পরে আমাদের সামনে হাজির হলেন। ওয়েলকাম মেসেজ এবং প্রাথমিক আলাপ সেরে বললেন যে, পরশু থেকে আমাদের এখানেই ক্লাস শুরু হবে, রোজ দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত, এবং প্রতিদিনের রুটিন একটু বাদেই আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

এবার আমরা একটু সময় পেয়ে অন্যদের সাথে পরিচয় পর্ব শুরু করে দিলাম, কে কোথা থেকে? কোন কলেজ? ইত্যাদি, ইত্যাদি ।।। ইতিমধ্যে লাঞ্চটাইম হয়ে গেলো আর আমরা সবাই চললাম অফিসের ক্যান্টিনে। নতুন ধরনের লাঞ্চ, ভালোই লেগেছিলো। একটা বড়ো স্টিলের থালাতে ছোট সাইজের চারটে বাটি, তার দুটোর মধ্যে তরকারি (এই রান্নাগুলো অতো মিষ্টি নয় এবং সুস্বাদু), একটাতে সাম্বার ধরনের ডাল, আরেকটাতে একেবারে সাদা দই আর একটু স্যালাড (পেঁয়াজ আর সাদা মুলো)। আমূল মাখন লাগানো গরম গরম ছোট সাইজের রুটি। একটা ছোট বাটিতে ভাত যেটা চেহারায় অনেকটাই জিরা রাইসের মতো দেখতে কিন্তু স্বাদ আলাদা। এতোই খিদে পেয়েছিলো যে প্রায় গোগ্রাসেই খেতে শুরু করে দিলাম।

আমার মাথায় অনেকক্ষণ ধরে একটা কথাই ঘুরছিলো, আমাকে যে করেই হোক একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে এবং আজকের মধ্যেই।। তাই খোঁজ নিতে থাকলাম কলকাতা বা বেঙ্গল থেকে কারা এসেছে, সেই অনুযায়ী আমি ভাবনাচিন্তা করতে পারবো। জানতে পারলাম যে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির তিনজন আর আইআইটি খড়গপুরের দুজন বাঙালি আমাদের এই গ্রুপে আছে। ঐ অফিসের নিয়মকানুনে কড়াকড়ি ছিলো যে অফিস টাইম শেষ হবার আগে কারুর বাইরে যাবার কোনো অনুমতিই ছিলো না। অফিসের পরে যাদবপুরের ছেলেদের সাথে কথা বলে একটা থাকার জায়গার খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়লাম।

ঐখানে যেহেতু সন্ধ্যা হয় অনেকটা দেরিতেই, তাই হাতে কিছুটা সময় ছিলো বাড়ি খোঁজার জন্য। এই ব্যাপারে ঐ বেকারী থেকেও সাহায্য পেয়েছিলাম। ওঁরাই খবর দিলো যেখানে গেলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেতে পারে। আনন্দ খুব একটা বড়ো জায়গা নয়। আমরা তিনজনে বাড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। আর একটু খোঁজাখুঁজির পর একটা থাকার জায়গাও পেলাম। বাড়িওয়ালা পুরো দোতলা বাড়িতে নিজেরাই থাকেন, শুধু basement (অর্ধেকটা একতলার নীচে আর বাকিটা একতলার সামান্য উপরে, যেটা ঐখানে খুবই দেখা যেতো)। একটা বিশাল ঘর দেখলাম যেটা উনি আমাদের থাকার জন্য দিতে পারেন, তারসাথে একতলার একটা ছোট্ট মতো ঘর আছে বাড়ির পেছনের দিকে সেটাও আমাদের ব্যাবহার করতে দেবেন। এই ছোট্টঘরটা আমরা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করবো, পাশেই টয়লেট আর জলের ব্যবস্থা। বাড়িটা ছোটখাটোর মধ্যে খুব সুন্দর, ছিমছাম, সামনে খোলা চাতাল। আর আছে কিছু ফুলের গাছ। বাড়ির লোকজনকে দেখে বেশ ভদ্রলোকের মতোই লাগলো। বাড়িওয়ালা আমাদের পরিচয় আর কোথা থেকে আসছি এইসব জানার পরে একটাই শর্ত দিলেন যে এই বাড়িতে কোন রকম আমিষ রান্না করা বা খাওয়া চলবে না। যাইহোক আমাদের আর যেহেতু অন্য কোন উপায় ছিলো না, তাই আমরা তিনজন এই শর্তেই রাজি হয়ে যে যার জিনিসপত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি হাজির হলাম ঐ basement এর ঘরে।

আমাদের মধ্যে একজন (নির্মল) বেশ ভালো রান্না জানতো। আরেকজন (রয়’দা, আমাদের চেয়ে একটু সিনিয়র) একটু আধটু জানতো আর আমি একেবারেই হাবাগোবা, তাই আমি ওদের সাথে অন্য কাজ কিছু করেই একটু ম্যানেজ করার চেষ্টা করতাম। এই করে প্রায় দু মাস কাটিয়ে ছিলাম।

এদিকে আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, মানে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং। সকালে ঠিক দশটায় ক্লাসের শুরু হতো, একঘন্টা করে একেকটা ক্লাস আর ঠিক বিকাল পাঁচটা নাগাদ শেষ। বেশিরভাগ প্রফেসর আর লেকচারাররা আসতেন IIM আমেদাবাদ থেকে, তাঁদের অসাধারণ পড়ানোর স্টাইল। প্রত্যেকটা ক্লাসই আমাদের ভালো লাগতো। সপ্তাহের শেষে ক্লাসটেস্ট। এই ট্রেনিং এর রেজাল্ট এর ওপরই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাই আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনো করতাম।

ছ’মাস ধরে আমাদের এই ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং হয়েছিলো। তারমধ্যে অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় ফিল্ড ট্রেনিংও হতো। সারা গুজরাটে যত গুলো Dairy plant আছে তার প্রায় সবকটাতেই আমরা গিয়েছিলাম। সেই সুবাদে আহমেদাবাদ, সুরাট, বরোদা আরো বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগও হয়েছিলো। যেমন আমূল ডেইরি, আরো অন্য Dairy/ chilling plant, গুজরাটের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখেছি, কি করে বিভিন্ন কোওপারেটিভ সোসাইটিগুলি দুধ সংগ্রহ করে, তারপরে কি ভাবে বিশাল পরিমানের সেই দুধ দূর দূর গ্রাম থেকে Dairy তে এসে পৌঁছয় এবং কি ভাবে প্লান্টের মেশিন ও দুগ্ধজাত কোয়ালিটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এবিষয়ে আমার সবথেকে ভালো লেগেছে Amul Dairy তে গিয়ে। Amul Dairy plant আমাদের দেশের এক অনন্য উদাহরণ।।

এই বিশাল ভাবনাচিন্তা আর কর্মযজ্ঞের সর্বাধিনায়ক হলেন আমার প্ৰিয় এবং শ্রদ্ধেয় Dr Verghese Kurien, The Father of White Revolution, যার পরিকল্পনার ফসল এই NDDB, যাকে সবাই Milk Man of India বলে জানেন।

NDDB নিয়ে দু’কথা বলি।
National Dairy Development Board, একটি কেন্দ্রীয় সরকারী Autonomous সংস্থা, ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত ব্যাক্তি Dr. Verghese Kurien, যিনি আবার Amul Dairy, IRMA (Institute of Rural Management Anand), Gujarat Co Operative Marketing Federation এবং আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। থাকতেন Amul এর Chairman’s Quarter এ। আমূল ছাড়া আর কোথাও থেকে কোনো পারিশ্রমিক বা মাইনে নিতেন না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র এক টাকা করে সান্মানিক পেতেন। Dr. V Kurien ছিলেন একজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার, MTech, Michigan University। আমরা যাকে বলি Operation flood, সেটা ওঁনারই পরিশ্রমের ফসল, সারা ভারতে AMUL (Anand Milk Union Ltd) এর মাধ্যমে ভারতে সবথেকে বেশি গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সূচনা তিনিই করেছিলেন। এই আমূল আগে Kaira District Co-op Milk Producers Union Ltd নামে পরিচিত ছিলো। ডক্টর ক্যুরিয়ান পরে Father of White Revolution in India নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

আমরা ছোটবেলায় যে Polson Butter খেতাম যেটা টিনের কৌটোয় দেখা যেত, নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকবে। এই পলসন কোম্পানি গুজরাট থেকে লাখ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে বম্বে শহরে (তখনো মুম্বাই নাম হয় নি) চড়া দামে বিক্রি করতো আর গরিব গোয়ালারা খুবই কম পয়সা পেতো। এমনকি flush season এর সময় সব দুধ কিনতোই না ওদের থেকে, এবং নিরুপায় হয়ে গোয়ালারা বেশিরভাগ দুধ ফেলে দিতে বাধ্য হতো। এরপরেই আনন্দের এই কালরা জেলায় তৈরি হলো Kaira District Co Op Milk Producer’s Union Ltd। এখানে একটা কথা বলে রাখি যে, দুধের যোগানের flush season এবং lean season আছে, মানে গরু বা মোষরা সারা বছর একই পরিমানের দুধ দেয় না, তাই flush/lean season বলে একটা কথা আছে।। তখনকার দিনে যেহেতু আমাদের দেশে গুঁড়ো দুধ তৈরি করার প্রযুক্তির প্রচলন হয়নি, বিশেষ করে মোষের দুধ থেকে (যেটার প্রচলন বেশি) তাই flush season এ অতিরিক্ত দুধ store করে রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। এই Amul Dairy তেই আমাদের দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম গুঁড়ো দুধ তৈরি শুরু করলেন, Dr. Kurien বিদেশ থেকে যাবতীয় মেশিন নিয়ে এসে। তাও আবার মোষের দুধ, যা আমাদের দেশে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়।

NDDB প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো, যে Amul কোম্পানির ধাঁচে সারা দেশে Co-op Society তৈরি করে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের উদ্যোগী হওয়া আর তার সাথেই গ্রামের শ্রমজীবীরা যাতে নায্যমূল্যে তাদের পরিশ্রমের ফসল বিক্রি করতে পারে সারা বছর ধরে, আর তাঁদেরকে যেন হঠকারীদের শিকার মুক্ত করা যায়, যা অহরহই করা হতো।

মন্থন সিনেমা নিয়ে দু’চার কথা বলি। এই সিনেমাটি তৈরি হয়েছিলো প্রধানত ডক্টর ক্যুরিয়ানের গ্রামীণ কোঅপারেটিভ উদ্যোগ পরিকল্পনা থেকেই এবং কিছুটা তার শুরুর দিকের আত্মজীবনী থেকেও নেওয়া। তাই, ডক্টর ক্যুরিয়ানকেই এই সিনেমার কাহিনীকার বলা হয়েছে। পরিচালনা করেছেন শ্যাম বেনেগল, আর প্রযোজনায় Gujarat Co Operative Milk Marketing Federation Ltd। অভিনয়ে ছিলেন স্মিতা পাতিল, গিরীশ কাড়নাড, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরীশ পুরী, কুলভূষণ খারবান্দা, ও আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। এনাদের সুন্দর আর স্বাভাবিক অভিনয়ের গুণেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অসাধারণ সিনেমাটি নির্মিত হয়। এই সিনেমাটি সাধারন লোকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সম্ভব হয়েছিলো যে, কতো বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে একজন মানুষ গ্রামের গরিব সাধারণের উন্নতির জন্য লড়াই করে, অবশেষে একটি সোসাইটি বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি একটা উজ্জ্বল উদাহরণ এবং বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।।

গুজরাটিরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণত শিক্ষিত, পরিশ্রমী এবং আধুনিকমনস্ক। ঐ ছোট্ট শহরেও দেখেছি প্রতি ঘরেই কোন সদস্য বিদেশে থাকেন। এইভাবেই বিদেশী মুদ্রা আমাদের দেশে আসে, আর এই টাকা দিয়ে জমিজমা কিনে লোকেরা চাষবাস করেন। লোকজন কে দেখতাম সারাদিন চাকরি বা ব্যবসার পরেও বিকালের দিকে বা সন্ধ্যাবেলায় চাষবাসের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতো, আর ঘরের মেয়েরাও আড্ডা দিয়ে সময় নস্ট করে না, তারাও বাড়ির কাজকর্ম সেরে খেত খামারের কাজকর্ম দেখে। শুধু সৌন্দর্য্য নয়, তাঁদের ব্যাবহার, পোষাক, সাধারণের সাথে মেলামেশা, সবই তাঁদের আধুনিকতার প্রমাণ। আমরা সাধারণত রাতের দিকে মানে নাইট শো সিনেমায় গিয়ে দেখতাম বেশিরভাগ সময় শো হাউসফুল, কারণ বাড়ির মেয়েরা দিনের কাজকর্ম সেরে, দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যেতো। এতেই প্রমাণিত হয় যে আনন্দ কতোটা নিরাপদ জায়গা। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়িতে বাড়িওয়ালার দুই মেয়ে ছিলো, দেখতে বেশ ভালো এবং স্মার্ট, ফিগার খুব সুন্দর যেটা গুজারাটিদের মধ্যে খুবই দেখা যায়। (কি করে বেশিরভাগ মেয়েদের এইরকম হয় জানার ইচ্ছে হতো), একজন হাই স্কুলে আরেকজন কলেজে পড়তো। তাঁরা ছুটির দিনে সারাদিন বাবা, মায়ের সাথে কিছু না কিছু কাজ করতো, আর বিকালের দিকে প্রায়ই আমাদের সাথে গল্পগুজবে যোগ দিতো। কখনো কোনোরকম জড়তা চোখে পড়েনি। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলতো। আরও একটি নিজস্ব মতামত না দিয়ে পারছি না, সেটা এই যে গুজারাটি মেয়েরা ওদের ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি মিশুকে এবং স্মার্ট।

২৫ মে, ২০২১

Sahityika Admin

1 comment

  • গুজরাতের আনন্দ শহর আর সেখানের কর্মযজ্ঞ, মানুষজন সম্বন্ধে সাধারণ লোকের ধারণা খুবই কম। সেই হিসেবে এই লেখাটা ছোটর উপর বেশ ভালো।