সাহিত্যিকা

স্মৃতিচারণ

স্মৃতিচারণ

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়
আয়, আরেকটি বার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়
মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়
……………

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়

অনন্তলোকে যারা

১. কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় সিভিল
২. পৃথ্বীশ চক্রবর্তী মেকানিক্যাল
৩. সহদেব সাধু খান ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন
৪. বাসবেন্দু গুপ্ত, মেকানিক্যাল
৫. মনোজ জস, মেটালার্জি
৬. অরূপ রতন গাঙ্গুলী, ইলেকট্রিক্যাল
৭. সলিল মোহন সাহা, সিভিল
৮. দেবাংশু ভট্টাচার্য্য (গোরা’দা), সিভিল
৯. মৃণ্ময় গাঙ্গুলী, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন
১০. জয়ন্ত কুমার গোস্বামী (ক্যাগা), সিভিল
১১. অশোক কুমার গিরি, ইলেকট্রিক্যাল
১২. উৎপল কাহালী, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন
১৩ সাগর দাশগুপ্ত, ইলেকট্রিক্যাল
১৪. তাপস চক্রবর্তী (ভাবুক), মেকানিক্যাল
১৫. তমাল বাসু, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন
১৬. ভাস্কর ভৌমিক, মেটালার্জি
১৭. অমিতাভ সাহা (ঘুম,) সিভিল
১৮. দুলাল মুখোপাধ্যায়, মেটালার্জি
১৯. অরুণাচল দত্ত (শত্রু), সিভিল
২০. প্রবীর ব্যানারজী (জ্যেঠু), মেটালার্জি
২১. স্বপন তালুকদার, মেকানিক্যাল
২২. সিদ্ধার্থ চৌধুরী, সিভিল
২৩. পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন
২৪. হরিদাস মন্ডল, মেকানিক্যাল
২৫. মলয় কুমার গাঙ্গুলী, ইলেকট্রিক্যাল
২৬. গৌতম পাল, মেকানিক্যাল
২৭. বিপ্লব কুমার পাল, মেকানিক্যাল
২৮. বার্তা বস্‌ মেটালার্জি
২৯. তাপস কুমার গুপ্ত (মেসো), সিভিল
৩০. অরূপ দে, ইলেকট্রিক্যাল
৩১. অমল পাল, সিভিল
৩২. প্রবীর চক্রবর্তী (লগা), ইলেকট্রিক্যাল
৩৩. সৌমিত্র লাহিড়ী (রবি’দা), ইলেকট্রিক্যাল
৩৪. অমিত পালিত (পালতে), মেকানিক্যাল
৩৫. অতনু রঞ্জন পালচৌধুরী, সিভিল
৩৬. অভিজিৎ দত্ত (লেটু), মেকানিক্যাল
৩৭. সোমনাথ ব্যানার্জি,
৩৮. সুপ্রীতি গোরা, আর্কিটেকচার

Goodbye, my friend, it’s hard to die
When all the birds are singing in the sky
Now that spring is in the air
Little children everywhere
Think of me and I’ll be there.

We had joy, we had fun, we had seasons in the sun
But the hills that we climbed were just seasons out of time.
We had joy, we had fun, we had seasons in the sun
But the wine and the song like the seasons have all gone

Now that the spring is in the air
With the flowers everywhere
I wish that we could both be there.
We had joy, we had fun, we had seasons in the sun
But the wine……..
Goodbye, my friend, it’s hard to die
When all the birds are singing in the sky.

Source: Musixmatch
Songwriters: Jacques Romain G. Brel / Rod Mckuen

 

স্মৃতিচারণ
***********

সুপ্রীতি গোরা
– স্মৃতিচারণে শৈবাল নন্দী, দেবজ‍্যোতি মুখোপাধ‍্যায়

গুরুতর অসুস্থ সুপ্রীতির চলে যাওয়ার খবরটা পাওয়া মাত্রই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল এবং মনে পড়ে গেল আমাদের কলেজ জীবনের আনন্দমুখর দিনগুলোর কথা। আমার সাথে সুপ্রীতির আলাপ হয়েছিল কলেজে ভর্তির পরে। দু’জনেই আর্কিটেকচার নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর থেকে যে বন্ধুত্ব ও সখ‍্যতা গড়ে উঠেছিল সেটা আজকেও ছিল অটুট, কিন্তু জীবনের শেষদিকে সুপ্রীতি স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সে আর আমাকে চিন্তা পারে নি। আজ সে চলে গেল। পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধবদের থেকে দূরে বহুদূরে, একেবারে না ফেরার দেশে। মনে পড়ছে তার কিশোরী বয়সের শান্ত মুখটার কথা। মনে পড়ছে তার বাড়িতে গিয়ে পুজোর সময় প্রসাদ খেয়ে আসার কথা।

সুপ্রীতি হোস্টেলে থাকত না, যদিও আমাদের কলেজে হোস্টেলে থাকা বাধ‍্যতামূলক ছিল, তবুও সুপ্রীতির মতন দু’একজনকে, যারা কলেজের কাছাকাছি থাকত, তাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে কলেজ করার জন‍্য।

ওর বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সেইজন‍্য সে বাবা মা এবং ছোট ভাই বোনের সাথে শালিমার ৩ নম্বর গেটের কাছে রেলের কোয়ার্টারে থাকত। স্কুলের পড়াশোনাও করছে আমাদের কলেজের মধ‍্যে অবস্থিত ‘বি ই কলেজ মডেল স্কুলে’। পড়াশোনার পাশাপাশি সে একজন দক্ষ নৃত‍্যশিল্পীও ছিল। আমাকে অনেকবার নিয়ে গেছে হাওড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেছি তার নাচ। এখনও ভাসছে চোখের সামনে তার সুশৃঙ্খল পদচালনা, অপূর্ব নৃত‍্যশৈলী ও মুখের প্রকাশভঙ্গী।

পড়া শেষে বৃহত্তর জগতে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ‍্যে দেখা সাক্ষাত না হলেও বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়, অভেদ‍্য ও অনন‍্য। আমি চলে গেলাম সুদূর মধ‍্যপ্রাচ‍্যের দেশ ওমানের মাসকাটে এবং সুপ্রীতি কর্মজীবন শুরু করল এই বাংলায়। সে ‘মেট্রো রেল’, ‘ইন্ডিয়ান পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফে’ চাকরি করে শেষে ‘বি এস এন এল’ থেকে চিফ আর্কিটেক্ট হয়ে অবসর নেওয়ার পরে সুন্দরভাবে দুই কন‍্যা ও স্বামীকে নিয়ে সংসার করছিল।

আমি যখন মাসকাট থেকে কোলকাতায় আসতাম তখন সুপ্রীতির সাথে দেখা করতে অফিসে যেতাম এবং অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে বাড়ি ফিরতাম।সেদিনও বুঝতে পারি নি সে হয়ে যাবে এক স্মৃতি হারানো জড় পদার্থ। এখন আমি কোলকাতায়। তার ছোট মেয়ের বিয়েতে যখন গেলাম তখন সে চিনতে পারল না। বুঝতেই পারল না যে তার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। সেই নুপূরের আওয়াজের সাথে মঞ্চ বিচরণ করা সুপ্রীতি এখন ভাবলেশহীন, অস্তিত্বহীন এক মানুষ। শান্তশিষ্ট হাসিখুশি নৃত‍্য পারদর্শী মেয়েটাকে অসহায়ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি। আজও পারছি না। জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি সে যেন ভাল থাকে। তার আত্মা যেন মুক্তি পায় অমর স্বর্গলোকে।

আমি সুপ্রীতি বলছি!
প্রিয় বন্ধুরা,
আমার নশ্বর দেহ হয়ত নেই
কিন্তু আমিতো তোদের মাঝেই রয়েছি,
স্মৃতির সব পাতা গুলো আজ
বসন্তের মত ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে,
তোদের এই ভালোবাসা, এই রোমন্থন
আমাকে নতুন আলোর পথ দেখাচ্ছে,
কিছুই তো হারিয়ে যায়না
ফিরে আসে নতুনের রূপ নিয়ে,
তোদের সবার এই হৃদয়ের স্পর্শ
আমাকে যেন উত্তীরন করে এক
নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে,
আমরা এতটা পথ চলেছি এক সাথে
আবারও দেখা হবে নতুন কোন রূপে!

– দেবজ‍্যোতি মুখোপাধ‍্যায়

********

বাসবেন্দু গুপ্ত ও মনোজ যশ
– স্মৃতিচারণে চন্দন গুহ

গীতায় একটা শ্লোক আছে,সাংখ্য-যোগ অধ্যায়ে,
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি। ।

এই শ্লোকের অর্থ বোঝা খুব সহজ, যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্ম অবশ্যম্ভাবী।অতএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়। আমাদের সাধারণ ব্যক্তিগত জীবন এত সুক্ষ্ম ফিলসফি দ্বারা চালিত হয় না।এই জগত প্রপঞ্চ বা মায়াজালে আবদ্ধ থাকে।পতির মৃত্যুতে পত্নী,পত্নীর মৃত্যুতে স্বামী বা পরিবারের প্রিয়জনের মৃত্যুতে অন্য প্রিয়জনে শোকে আকুল হয়ে পড়েন,তখন কেউ গীতার শ্লোক মনে করেন না।আর যদি সেই মৃত্যু অকস্মাৎ হয়,সেই মৃত্যুর সাথে পরিবারের স্থায়িত্বর প্রশ্ন জড়িত থাকে তখন গীতায় দেখানো পথের চাইতে তাৎক্ষণিক কোন বাস্তব রাস্তার গ্রহণযোগ্যতা বেশি মনে হবে।

বাসবেন্দু আর মনোজকে স্মরণ করতে গিয়ে এই সব কথার অর্থ একটু পরেই পরিস্কার হবে।
সেই কোন ১৯৭২ সালের ১০ই ডিসেম্বর আমরা প্রশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে বিই কলেজে পড়তে এসেছিলাম। একই হস্টেলে চারতলায় আমাদের সাথে ছিল বাসবেন্দু গুপ্ত আর মনোজ যশ।দু’জনেই হুগলি জেলা থেকে এসেছিল। বাসবেন্দু ত্রিবেনী থেকে,আর মনোজ এসেছিল তারকেশ্বর থেকে।বাসবেন্দু বা বাসু ছিল ছোটখাট চেহারার, হাসিমুখ, ইজিগোইং টাইপের,আর মনোজ ছিল শক্ত পোক্ত,নো ননসেন্স ধরনের ছেলে।হস্টেলের খাবার বাসুর খুব একটা পছন্দ হোত না,ওর কথা অনুযায়ী খাবার খেতে নয়,গিলতে যায়।
আর একটা বিষয়ে বাসুর বেশ বৈচিত্র্য ছিল,যখন যেমন সেই রকম চলা।একবার জুলাই মাসে পর পর ক’দিন বৃষ্টিপাতের ফলে সন্ধ্যার সময় বেশ শীত শীত লাগছিল বলে,বসু ডাইনিং হলে পৌঁছল একটা চাদর গায়ে দিয়ে।সিনিয়ার ইয়ারের দাদারা একটু তির্যক দৃষ্টিতে দেখলো,কিছু বলেনি।ব্যাচের বন্ধুরা হঠাত অসময়ে চাদর গায়ে দেবার কারন জানতে চাইলে বাসু সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,”শীত করছে”।ঠান্ডা লাগছে, চাদর গায়ে দাও, সে জুলাই মাসের বর্ষা হলেই বা।বাসুর এই যুক্তির সমর্থনে ছিল আমাদের স্বর্গীয় সৌমিত্র লাহিড়ী।বহুদিন পরে আমি ওর এই মনোভাবের যুক্তি ঠিক মনে করেছিলাম।

লেখাপড়া শেষ হলে আমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাই। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরির চেষ্টা করতে করতে আমরা নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তী দশ পনের বছর নিজেদের জীবিকার সন্ধান আর সাংসারিক জীবনে ঘুরতে ঘুরতে আবার অনেকে কাছাকাছি চলে এসেছিল, যেমন বাসু,মনোজ, হরিদা, আর এক জন,যার নাম লেখার অনুমতি নেই।এরা সবাই দুর্গাপুরে পোস্টেড ছিল,বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে।নিজেদের মধ্যে পরিচয় তো ছিলই, স্ত্রী পুত্রের মধ্যে পরিচয় আত্মীয়তার স্তরে পৌঁছেছিল।হোলি,দিওয়ালির সংযত নিজেদের মধ্যে যাতায়াত চালু ছিল। হাসি আনন্দময়,নিরুদ্বেগ এই জীবনধারায় হঠাৎই একদিন যে কুঝ্বটিকা নেমে আসবে কেউ কল্পনাও করতে পারে নি।এই রকম আনন্দময় পরিবেশ থেকে ফেরার পথে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তিন পরিবারের মোট ছ’সদস্যর জীবনদীপ চিরদিনের জন্য নিভে যায়।সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা কেউ স্মরণ করতে চাই না।ঘটনার বিবরণ দেবার কোন ভাষাই আমার নেই বলে কিছুটা স্থান শূন্য রাখলাম। এ শূন্যতা পুরণ হবার নয়।

২৫শে মার্চ,২০০৫ সালের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর উনিশ বছরের একটা প্রলেপ লেগে পরিবারের মনের জখম হয়তো ভরে উঠেছে।প্রিয়জনের অসময়ে বিদায়ের দুঃখ আর হয়তো অতটা কষ্টকর মনে হয় না।বাসুর এক মাত্র জীবিত ছোট মেয়ে আজ ইঞ্জিনিয়ার,বিদেশে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে।মনোজের অনাথ ছেলে আজ প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার, এদেশেই কর্মরত।আর এক বন্ধুর মা হারা ছেলেকে সেই বন্ধু পিতা মাতার স্নেহ মমতায় অসীম যত্নে আজ বড় করে তুলেছে।সেই ছেলেও এখন ঘর সংসার করা যুবক।নিদারুণ শোকের পরিস্থিতি কাটিয়ে এই তিন পরিবারের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার এই কাহিনী বিখ্যাত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের এক উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়:
আমাদের জীবনের কোন কিছুই স্থায়ী নয়,এমনকি দুঃখ কষ্টও নয়।

বাসুর মেয়ে,মনোজের ছেলের দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ওঁরা এই পৃথিবীর বায়ু,জল, সূর্য কিরণ গাছ পালা সব দেখছে আর আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছে,আর থাকবে।

শুরুতেই যে গীতার শ্লোকের কথা উল্লেখ করেছিলাম সেই কথায় ফিরে আসি।
উনিশ বছর আগে বন্ধুদের জীবনে যে গভীর অন্ধকার নেমে এসেছিল, তখন গীতার বাণী বা শ্লোক অবাস্তব মনে হয়েছিল। আজ যখন শোক কেটে গেছে,অন্ধকার কেটে উজ্জ্বল আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে,তখন মনে হয় গীতার বাণী শাশ্বত, কোন ভুল নেই।অনুধাবন করতে একটু সময়ের দরকার হয়।

বন্ধুরা,তোদের বিদায় জানানো সম্ভব নয়,আমাদের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবি।

*******

Amal Pal (Civil)
– স্মৃতিচারণে প্রশান্ত পাচাল, শৈবাল নন্দী, প্রসূনজ্যোতি রয় মিত্র

A gentle, sober, soft spoken boy preferred to live within his limited friend circle, he was most close to Arup Pal and Prashanta Pachal. During lunch or dinner time, the trio used to sit at a corner, and with a competition of breaking the previous day’s record. At lunch, of course, they were restricted about the quantity, but during dinner both of them were keen in setting new record everyday. The number of roti Amal used to take was unbelievable.
Amal was our college team’s goalkeeper, and also a good Table Tennis player, though his preferred competitor was Arup, and some selected players.
Amal used to play mouth organ in his room alone and very hardly joined in chorus.
However, some of his deep night adventures, teaming with Pachal was remarkable. He was physically fit enough in those few dark night ventures to Professors’ Quarter Garden, stealing the banana cluster (cluster of plantain) and brought to the room showing his tremendous courage of cutting the clusters with artistic skill and fleeing with trot.
However, we all lost contacts for long. I was too upset when I heard about his illness. I was briefed that he was suffering from Immunity Compromise disease which was diagnosed late but hoping to see him in good health again when after getting treatment at Vellore showing improvement, but alas, he left for heavenly abode giving all a heavy shock.
I lost one of my good friends and pray almighty for his eternal peace.

অমলকে শুধু হস্টেল বা ইয়ারের নয়, কলেজের সবাই চিনতো কলেজ টিমের বিশ্বস্ত গোলকীপার হিসেবে। থার্ড ইয়ার থেকেই জায়গাটা তাঁর পাকা হয়ে গিয়েছিলো।
এছাড়াও আমার (প্রসূনজ্যোতি) দেখায় অমলের হাতের ড্রয়িং খুবই ভালো ছিল। মনে পড়ে আমাদের সার্ভেক্যাম্প হয়েছিল ফারাক্কা চামাগ্রামে প্রফেসর শান্তি দাশগুপ্ত ও শৈবাল ঘোষের তত্ত্বাবধানে। অনেক রাত অবধি ড্রয়িং টেন্টে ড্রয়িং করতাম আমরা। মনে আছে একদিন অমল আর আমি চাদর মুড়ি দিয়ে বড় ড্রয়িং টেবিলের ওপর বসে আটটা গ্রুপের Contour plan নিয়ে একটা Master Plan বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে নি:শব্দে কখন যে শৈবালদা এসে দাঁড়িয়েছেন, বুঝতেও পারি নি। আমরা স্যারকে দেখে তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে পড়েছি। শৈবালদা অমল আর আমার (প্রসূনজ্যোতি) সাথে একদম বন্ধুর মতো পিঠে হাতে দিয়ে বললেন, আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে… দেখি কতটা কাজ এগিয়েছে? তারপর নিজেই সিগারেট ধরিয়ে আমাদের সাথে interpolate করে point গুলো প্লটিং করা থেকে শুরু করে contour lines টানা পর্যন্ত সবেতেই হাত লাগিয়ে ছিলেন।
আজ হঠাৎই মনে পড়ে অমলের সাথে কলেজ জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তের কথাটা। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা, কিন্তু মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা।
পাস করে অমল দিল্লী চয়ে যায়, সিমপ্লেক্সে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে জয়েন করে। সিমপ্লেক্স অফিসের মেসে কয়েকজন ব্যাচেলর থাকতো, মানে সেই হস্টেলের মতনই জীবন। আর দিল্লি বিই কলেজ এল্যুমনির সাথে খুবই যোগাযোগ ছিল। তার কারণও আছে, সিমপ্লেক্স দিল্লির অফিসে যেদিকে তাকাও, বিই কলেজের জনতা ছড়িয়ে আছে। চাকরীর পাশাপাশি দিল্লী আইআইটি থেকে মাস্টার্স করে। ২০০৫/৬ নাগাদ হঠাতই কোলকাতা চলে আসে, এবং বহুদিন ওঁর সাথে কারোর যোগাযোগ ছিল না। তারপর বহুদিন পরে ২০২১ সাল নাগাদ কলেজ গেট টুগেদারে দেখলাম সস্ত্রীক অমলকে। সেই হাসিমুখ, মিতভাষী অমলকে।
তার কয়েক বছর পরেই ভেলোর থেকে ফোন পেলাম। অমল অসুস্থ। অসুখটা ঠিক যে কি সেটাই বুঝে উঠতে না পারায় ভেলোর যেতে হয়েছিল স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। সেইসময় একটানা বেশিক্ষন চলতে পারতো না, হাঁপিয়ে বসে পড়তে হতো। ওর মুখ থেকে ফোনেই শুনতাম এইসব কথা, যথাসম্ভব সাহস যোগাতাম ওকে। পরে আর একবারও যেতে হয়েছিল ভেলোরে। শেষে লখনউতে মেয়ের কাছেই ছিল, ফোনে কথাবার্তা হতো মাঝেমধ্যে। টালিগঞ্জের তাঁর নিজের বাড়িটা দীর্ঘদিন তালাবন্ধই পড়েছিল, সেখানে আর কোনোদিনই ফেরা হোলো না তার।
এভাবেই অসময়ে সবাইকে রেখে অমৃতলোকের যাত্রী হয়ে চলে গেল অমল পাল।

******

অমিত পালিত (পালতে) (মেকানিক্যাল)
– স্মৃতিচারণে সোহম দাশগুপ্ত, হিমাংশু নাথ

বন্ধু অমিতের জীবনে এমন আকস্মিক যবনিকা পতন সহপাঠিদের কাছে এতোটাই মর্মান্তিক যে কয়েকটা দিন প্রসঙ্গটাকেই এড়িয়ে চলছিলাম। মন না চাইলেও ধীরে ধীরে জীবনের এই অমোঘ শর্তটাকে একসময়ে মেনে নিতেই হয়। ধাতস্ত হতে হতে নানা কথার মধ্যে মনে পড়ল, অমিত, মানে আমাদের পালতে আন্তরিক ভাবে একজন কবিতা প্রেমীও ছিল। কবিতা পড়তে ভালবাসতো শুধু নয়, মাঝে মধ্যে সুন্দর কবিতা লিখে আমাদের চমকও লাগিয়ে দিত! ওর অধিকাংশ কবিতার মূল ভাবনাই ছিল গভীর জীবন বোধ। তাই আজ অমিতের স্মৃতিতে লর্ড টেনিসনের একটা কবিতার অনুবাদ উৎসর্গ করলাম। এই মুহুর্তে নিজের মনের কথাটা জানাতে পারলে অমিত হয়তো টেনিসনেরই প্রতিধ্বণি করত।
সকল সীমানা শেষে

অস্তে চলেছে রবি, ফুটেছে সাঁঝের তারা,
স্পষ্ট শুনেছি আমি- এসেছে সে আহ্বান;
আজই ভাসাবো তরী কেটে সব দড়িদড়া,
গা’সনেরে তীরে বসে বিদায় বেলার গান।

তন্দ্রা মগ্ন যেন নীরব জলোচ্ছ্বাস,
চলেছে উতল বেগে বিপুল অমোঘ টানে।
অতল পাতাল হতে, বুকে ভরে নিঃশ্বাস,
তীর ছুঁয়ে যায় ফিরে, আপনার গেহ পানে।

প্রদোষের ক্ষীণ আলো, সন্ধ্যা আরতি-ধ্বণি,
মিলাবে ক্ষণিক পরে, গভীর অন্ধকারে!
তরী দেব যবে খুলে, বিদায়ের বাঁশীখানি
বাজাসনে আজ তোরা বিষাদ ব্যাকুল সুরে।

দেশ, কাল, চরাচর, পিছে ফেলে দেবো পাড়ি,
তরঙ্গ পরে ভেসে অনন্ত উদ্দেশে,
একটাই শুধু আশা, আমার সে কান্ডারী,
সমুখে দাঁড়াবে এসে, সকল সীমানা শেষে।

পালতে আমাদের অনেকের মতোই খুব পড়াশুনো করা ছাত্র ছিলো না। কিন্তু অনেক ব্যাপারেই উৎসাহটা বেশিই ছিলো। অতো লম্বা চেহারার মধ্যে একটা হাসিখুশি ছটফটে স্কুলের ছেলে লুকিয়ে থাকতো। সেটা পরিনত বয়সেও। বিতর্কিত ‘মোবাইল অদৃশ্য রহস্য’ তেও দেখা গেছে।

আমার সঙ্গে (হিমাংশু নাথ) হোস্টেলে থাকতে একটু আলাদা যোগাযোগ হতো কুইজ প্রতিযোগিতা নিয়ে। তখন Bournvita quiz contest বলে একটা জনপ্রিয় রেডিও প্রোগ্রাম হতো রবিবার দুপুরে। আমরা দুজনেই শুনতাম। একজন না শুনলে প্রশ্নগুলো অন্যকে বলতাম। অন্য দেশের রাজধানী, কারেন্সি এসব আলোচনাও হতো। দুজনেরই খুব ঘুরে বেরানোর শখ ইচ্ছে ছিলো। তখন অবশ্য ‘দি-পু-দা’ বেশ বড়ো সীমানা।
হোস্টেলের শীতের বিকেলে ভলি খেলায় অদম্য উৎসাহ। যতটা না খেলার পারদর্শিতা, বেশি উৎসাহ ছিলো কোন বল লাইনের ভিতরে না বাইরে, এই ব্যাপারে অক্লান্ত তর্কে! (এক পয়েন্টের জন্য একটা কিডনি সহজেই দিতে রাজি থাকতো!)।
আমরা যখন 3rd year এ, পালতের দাদা (তখন সদ্য MBBS পাশ করেছেন) ম্যানিলা গেছিলেন একটা প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য। দাদা ফিরে আসার পরে পালতে শনিবার সাপ্তাহিক বাড়ি গিয়ে রবিবার রাতে ফিরে আসার সময় একটা বিদেশী সাবান নিয়ে ফিরলো। পরের দিন হোস্টেলে যা হয়, পুরো ২৮ জনের গণ স্নান (৮ নং পুরো ব্যাচ) ওই সাবান মেখেই হলো। বেশ উত্তেজনা সবারই – জীবনে প্রথম বিদেশী সাবান মাখা বলে কথা! সে যাহোক দু’একজন একটু কিন্তু কিন্তু করে বললো সাবানের বিশেষ ফেনা হয় নি, এছাড়া গন্ধটাও যেন কেমন কেমন – পছন্দের নয়! এই বিরুদ্ধ লবি বিশেষ পাত্তা পেলো না। সবজান্তারা বললো সাহেবদের সাবান এরকমই হয়। সাবান সেদিনই গণ স্নানের ঠ্যালায় শেষ।
এরপরের শনিবার পালতের সাপ্তাহিক বাড়ি যাওয়া ও রবিবার রাতে ফেরা। দেখলাম একটু গম্ভীর। কি ব্যাপার ? চাপাচাপিতে বললো – একটু ইয়ে হয়ে গেছে। সাবানটা Dog soap. পালতে বুঝতে পারে নি। সম্ভবতঃ বাড়ির কুকুরের জন্য দাদা এনেছিলেন, পালতের হাত সাফাই তে হোস্টেলে !!
পালতের বাবা ছিলেন কেনিসন জুট মিলের চিফ মেডিক্যাল অফিসার। সমাজে বেশ পরিচিতি ও সম্মান ছিলো। কিন্তু একদিনের জন্যও সেই নিয়ে কোনো বাগাড়ম্বর শুনিনি। এক পুজোর সময়ে পালতের মামা এসেছিলেন ওদের ব্যারাকপুরের বাড়িতে। বাড়িতে হুলুস্থুল। পালতে এবং তার দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পালতের মা এর কান্নাকাটি, সারা বাড়ি বিচলিত। মামা শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পরেই দু’ভাইকে নিয়ে হাজির। কোথায় ছিলো? সেটা মামার অভ্রান্ত অনুসন্ধানে প্রকাশিত হোলো। পাশের পাড়াতে কাঙালি ভোজনে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। দুই ভাই পাশাপাশি সতরঞ্চিতে বসে খিচুড়ি খাচ্ছিলো।
২০১৮ তে একসঙ্গে আসামের কয়েকটা জঙ্গল ঘুরেছিলাম। মধুমিতার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হোলো। দেখলাম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক মিল। দুজনেরই ঢক্কানিনাদ একদমই না-পসন্দ!

আমরা জানি পালতের প্রফেশনাল কৃতিত্ব ও সাফল্য। এছাড়াও কতটা লোকের সঙ্গে মিশতে পারে যেটা দুর্গাপূজা উদ্যোক্তা, আবাসনের আইনি ব্যাপার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া এরকম আরো কিছু ওকে সবার প্রিয় করে তুলেছিলো। পালতের চলে যাবার পরে অনেকে ওর সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লেখা, কবিতায় শেষ বিদায়ের একটা ইঙ্গিত কারো কারো চোখে পড়েছে। খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার, কিছু মন্তব্য করা ঠিক হবে না আমার থেকে। তবে যেটুকু দেখেছি পরিনত বয়সে, সেরকম কিছুই দেখি নি। সেই ছটফটে কিশোরই আমার চোখে আসতো। যাকে বলে Full of life. কোনই আক্ষেপ নেই – জীবন নিয়ে। অবশ্যই চলে যাবার তাড়াহুড়ো কিছুই ছিলো না – বরং ওর অতি সুখের সংসারের তাপ ওকে উষ্ণ, প্রাণবন্ত রাখতো।
গত বছর আমার উৎসাহে জাপান অলিম্পিক দেখা এক কথায় রাজি। পরে কোভিডের জন্য বাতিল। এই বছরই মার্চ- এপ্রিলে ফোন -‘হিমু, কাতার যাবি?’ আমার নিরুৎসাহে ওরও হয়তো উৎসাহে ভাঁটা পরলো। তখন ঠিক হলো সুস্থ থাকলে ২০২৬ WC দেখবো একসঙ্গে। ওর দাদা থাকেন, এই সব আলোচনা।
এরকম অফুরন্ত স্মৃতি, অফুরন্ত হয়েই থেকে যাবে।
পালতে, কোথায় যেনো পড়েছিলাম – তীব্রভাবে কিছু চাইলে সেটা পাওয়া যায়।
হয়তো একসঙ্গেই খেলা দেখবো ২০২৬ এ – টিকিট ও লাগবে না।

*******

অরূপ রতন গাঙ্গুলি (ইলেকট্রিক্যাল)
– স্মৃতিচারণে দেবাশীষ গাঙ্গুলি

অরূপ আর মলয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭২ সালের ১০ ই ডিসেম্বর বি.ই. কলেজের ডাউনিং হস্টেলে। সেই আমাদের শুরু, ইলেকট্রিকাল ইন্জিনিয়রিং বিভাগের চার গাঙ্গুলির পাঁচ বছর ধরে এক সঙ্গে থাকা। আমাকে যে একদিন ওদের স্মৃতিচারণ লিখতে হবে, সে আমি কোনোদিন ভাবতেই পারিনি।

অরূপের জন্ম ১-লা ডিসেম্বর, ১৯৫২ দার্জিলিং এ। যাদবপুরে পৈতৃক বাড়ী, একান্নবর্তী সংসার, কিন্তু হাঁড়ি আলাদা। অল্প বয়সেই পিতৃহারা। মা চাকরি করে এক ছেলে ও এক মেয়েকে কষ্ট করে মানুষ করেছেন। বাড়ীতে ওর ডাক নাম ছিল বাবলু, কিন্তু কলেজে কখন যে ওর নামটা “পাবলিক” হয়ে গেলো, আর কেনই বা এরকম নামকরণ হয়েছিল, আজ আর মনে পড়ে না। পাক্কা বোহেমিয়ান চরিত্রের অরূপ ছেলেটার মনটা ছিল সরল, অসম্ভব মুডি – মানে খেয়ালি এবং আত্মভোলা ও পরোপকারী।

কয়েকটি ঘটনার কথা বলা যায়।
১৯৭২ সালের দুটি ঘটনা। আমরা তখন ডাউনিং হলে। অরূপকে কোনদিন আমরা ফুটবল খেলতে দেখা দূরের কথা, ফুটবলের আলোচনাতেও দেখিনি। সেই অরূপ ময়দান লীগের ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের টিকিট কাটতে রাত জেগে লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। গায়ে নিলো কলেজের এনসিসি ইউনিফর্ম। মেজাজে সারারাত রীতিমত লাইন ম্যানেজ করলো। ওখানে যেসব পুলিশ ডিউটিতে ছিলো, তাঁরা ভাবলো সিভিল ডিফেন্সের লোক, অন ডিউটি। সেদিন যাকেই চেনা মনে হচ্ছে, লাইনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো।
৭২ সালের আরেকটি ঘটনা, হাওড়া ষ্টেশনের পাশেই রেল কোয়ার্টার মাঠে সার্কাস চলছে। সপ্তাহের মাঝে এক সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি টিকিটের ভালোই দাম। অরূপ কাউন্টারে গিয়ে স্টুডেন্টস্ ডিসকাউন্ট চেয়েও পেলো না। টিকিট ম্যানেজ করছিলো পাড়ার ছেলেরা। সে গিয়ে একটা ছেলেকে লাইন করলো। আর যতদূর মনে পড়ে সাত-আটজনের দল পাঁচ টাকা খরচ করেছিলাম। বিনা টিকিটে ঢুকলাম, এবং প্রথম সারিতে সবথেকে দামী সীটে বসে সার্কাস দেখলাম।
এবার ১৯৭৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর, আমরা ডাউনিং ছেড়ে ১১ নম্বর হস্টেলে চলে এসেছি, এবং সেদিন আমাদের ক্যাম্পাস লাইফের একবছর পুর্তি। মোটিভেটর “পাবলিক” আছে অথচ এমন দিন নিরুত্তাপ? হতেই পারে না। আজ দুপুরে ১১ নম্বরের কেউ ক্লাসে যাবো না। সেকেন্ড গেটের দোকান থেকে মাইক এলো। চাঁদা তুলে মুরগী কিনে আনলাম। মেস থেকে চাল, তেল, নুন। রাতে আমাদের ইয়ারের গ্রান্ড ফিস্ট।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, হস্টেলে মেস ধর্মঘট চলছে। তখন আমাদের ১১নং হস্টেলে তিনখানি বারোয়ারী বাইসাইকেল ছিল ঘোরাঘুরির সুবিধার জন্য। হঠাৎ এক বিকালে অরূপের মাথায় ভুত চাপল যে সাইকেল করে দীঘা ঘুরতে যাবে এবং অবিলম্বে মানে বিনা সময় অপব্যায়ে তখনই। যেমন ভাবা, ভর সন্ধেবেলায় দুটি মাত্র দু-ব্যাটারীর টর্চের ভরসায় প্রায় একবস্ত্রে (যতদূর মনে হয় অরূপ এনসিসি’র ঢোলা ইউনিফর্ম জোগাড় করে এনেছিলো) তিনজনে মিলে বেরিয়ে পড়া – কারও কথা না শুনে। সে এক নাতিদীর্ঘ এডভেঞ্চারের কাহিনী। শেষে ভালয় ভালয় ফিরে আসা।
সে বছরই পরের মাসে দোলের আগে ধুয়ো উঠল বিনা টিকিটে সদলবলে শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাওয়ার। যথারীতি অরূপ একজন অন্যতম উদ্যোক্তা। দুপুরে ক্লাস থেকে ফিরে কথা হলো। আরে ট্রেনে না হয় বিনা টিকিট, কিন্তু ওখানে গিয়ে তো সুনীল’দার ব্যারাক নেই যে মাসের শেষে পেমেন্ট করবো? পকেটে তো পয়সা নেই, চারদিন থাকলে নগদ ট্যাঁকের কড়ি দিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু ঐ যে মোটিভেটর “পাবলিক”!! হস্টেলের সাতজনের একটি দল বেলা তিনটেয় হাওড়া থেকে রামপুরহাট লোকালে রওয়ানা দিলাম। শান্তিনিকেতন, বক্রেশ্বর হয়ে দারুণ আনন্দ করে চারপাঁচ দিন পরে ফেরা হলো।
অরূপের ভবঘুরেমির আরেকটি ঘটনা। সপ্তাহান্তে স্থানীয় ছেলেরা বাড়ীতে ঘুরে আসত। ১৯৭৪ সালের ১লা ডিসেম্বর রবিবার রাত্রে হস্টেলের ঘরে ফিরে দেখি আমার ট্রাংকের ওপর জুতো চাপা দেওয়া অরূপের লেখা “দেবু, দার্জিলিং চললাম মনুকে নিয়ে। কবে ফিরব জানিনা। চিন্তা করিস না। ক্লাস গুলো ম্যানেজ করে দিস”। আমাদের চতুর্থ সঙ্গী মলয় বাড়ী থেকে পরদিন সকালে আসবে। মনে মনে ওদের দুজনের মুন্ডপাত করে শুতে গেলাম। ওমা, সকালে দরজায় ধাক্কার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে দেখি বেলা হয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখি অরূপ আার মনু দাঁড়িয়ে। ভাবলাম ভুল দেখছিনা তো? বললাম ‘তোরা তো দার্জিলিং এ?’ একগাল হেসে অরূপ বলল ‘হ্যাঁ, ঘুরে এলাম। শনিবার দার্জিলিং মেলে গেলাম আর রবিবার রাত্রে ফিরতি ট্রেন ধরলাম। দার্জিলিং এ জন্মদিনে এক কাপ চা খেয়ে ফিরে এলাম। আসলে পকেটে তো পয়সা ছিলনা থাকার মতো!’ এরকমই ছিল আমাদের পাবলিক।
ওর ছিল ফটোগ্রাফির শখ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্যামেরা নিয়ে গঙ্গার ধারে, কুমোরটুলির গলিঘুঁজিতে, বাবুঘাটে, চিড়িয়াখানায়, বি. গার্ডেনে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলা আর কলেজে BECPHOS এর ডার্করুমে রাত জেগে সাদা-কালো ছবি ডেভেলপ আর প্রিন্ট করা আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পাঠানো।
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে, আমার প্রথম সিমলিপাল জঙ্গল ভ্রমণের সঙ্গীও ছিল অরূপ। বাঘীনি খৈরী তখনও এত বিখ্যাত হয়নি। বিছানায় টানটান হয়ে শোয়া খৈরীর ছবি অরূপেরই তোলা দেবসাহিত্য কুটীরের শারদীয় সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।
ছাত্রাবস্থায়ই ও ঠিক করেছিল চাকরী করবে না। তাই পাশ করার পরই শুরু করলো নিজের কন্ট্রাক্টরির ব্যাবসা। কিন্তু ওর ভালমানুষী মানসিকতায় কোনও দিনই ঘাঘু মালদার ব্যাবসায়ী হয়ে উঠতে পারেনি।

২০০৭ সালে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিল সিমলিপালের জঙ্গলে। ফিরে এসে জ্বর হল। কিন্তু ডাক্তার দেখালোনা, ওষুধ খেল না। শেষে যখন হাসপাতালে দেওয়া হল অনেক দেরী হয়ে গেছে। ১৪ই জুন ম্যালিগনান্ট ম্যালেরিয়ায় জীবনটা বেঘোরে শেষ হয়ে গেল। বিধবা মা, স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে আর সব বন্ধুদের ছেড়ে অকালে চলে গেল আমাদের অরূপ রতন।

******

উৎপল কাহালী (ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন)
– স্মৃতিচারণে অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায় (গাগা)

কাহালীর এতো স্মৃতি; কোথা দিয়ে যে শুরু করি!
ও আমার ডিপার্টমেন্টের সহপাঠী ও Project Partner. যদিও Projectটা ঐ লিখেছিল; আমি প্রায় কিছুই করি নি। তাই ওর প্রতি আমার ঝণ অপরিসীম!
পাশ করে আমরা যখন বেকার ও MEতে ভর্তি হয়!
এর মধ্যে আমার CMCতে একটা আলাদা Interview হয় এবং আমি যথারীতি অসফল হই অজ্ঞানতার কারণে। তবে আমার IITর বন্ধু ন্যাড়া সফল হয় ও সুযোগ পায়।
অদ্ভুতভাবে ওখানে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হতো এবং প্রশ্নগুলো আমার আর ন্যাড়ার মনে ছিল। কাহালী ডাক পেতে ন্যাড়া ওকে সঠিক উত্তর বলে দেয়। আর আমি ওকে বলি প্রথম মাসের মাইনের ৫০% আমাকে দান করতে। এটাও বলে দি যে তু্ই সব কটার সঠিক উত্তর দিস না; তাহলে ওদের সন্দেহ হবে!
যে কারণেই হোক ওর চাকরিটা হয় না।
তারপর কর্মসূত্রে আমরা বিছিন্ন হই। ও হলদিয়া ফার্টিলাইজারে যোগ দেয়। ফ্যাক্টরি অচল থাকায় ওর কোন কাজ ছিল না। তবে সরকারি চাকরি হওয়ায় মাইনে পেতো। পরে ওকে গৌহাটিতে বদলি করা হয় Salary Disbursement এর কাজে। ঐসময় একবার আমার সাথে গৌহাটির হোটেলে দেখা হয়। ও সেদিন গান গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তিকালে VRS পাওয়ার পর ও B. C. ROY Engineering College এ Training & Placement Officer হিসেবে যোগ দেয়।
এরপর থেকেই ওর জীবনে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করি।
হঠাৎ ওকে Corporate World এর HR Deptt. এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়!
এই সূত্রে মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী ও হায়দরাবাদের মতো জায়গায় ঘনঘন যাতায়াত শুরু হয়।
বিভিন্ন জায়গায় তাদের পানভোজনের বন্দোবস্তও করতে হয়। ও কিছুটা উশৃংখল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
ওর এক ক্লায়েনটের কাছে জনঅরণ্য টাইপের অভিজ্ঞতাও হয়েছিল!
ও কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমি জানি না! হয়ত ঐ ধরণের ফাস্ট লাইফের জন্যই ওর একটা Massive Heart Attack হয় এবং পরবর্তিকালে Bypass Surgery করতে হয়।
এই সময়ে কাহালীর একটি উক্তি অবিস্মরণীয়
উপপত্নীর থেকে পত্নী শতগুণে ভালো!
😅🤣😆😁
আমার ছেলে সরকারি কলেজে সুযোগ না পাওয়ায় আমরা খুব আশাহত হয়ে পড়ি।
তখন ও আমাকে বেসরকারি কলেজ নির্বাচনে সাহায্য করে। সেখান থেকে পাশ করে ও আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।
এরপর ও হলদিয়া ইনস্টিউট ওফ টেকনলজিতে যোগ দেয় এবং ওখানেই থাকতে শুরু করে। হয়ত কিছুটা অনিয়মেরও শিকার হতে হয়। শেষে ও কোলকাতায় ফিরে Regent Engineering কলেজে যোগদান করে। এখানেও ও সোদপুরে একটা মেসে থাকতো। আমি অনেক বারণ করেছিলাম।
হঠাৎই ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ,রবিবার ওর একটা ফোন আসে:
আমি বলি কাহালি বল!
উত্তর আসে আমি উৎসা বলছি!বাবা আর নেই!
চার পাঁচদিনের নিউমোনিয়া ওর প্রাণ কেড়ে নেয়।ভর্তি হতে একটু দেরী করেছিল।
আমি আর অতনু ওর শেষ যাত্রার সঙ্গী ছিলাম!

******

গৌতম পাল (মেকানিক্যাল)
– স্মৃতিচারণে সমীর সরকার, অমিত পালিত, অসীম দেব, উত্তম খান

জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের জীবনটা একটা ছোট গল্প। ছোট গল্প ‘শেষ হইয়াও শেষ হয় না’ । আর এই শেষ না হওয়ার রেশ ধরে আমরা মৃতের স্মৃতি রোমান্থন করে তাকে অমর করে রাখার একটা প্রয়াস করি।
কলেজ জীবনে একসাথে কত রাত কাটিয়েছি, পড়াশোনা করেছি, লোডশেডিংয়ের দিনগুলোতে মোমবাতির আলোতে অঙ্ক করেছি সেসব কথাগুলো একলাফে মনে ভাসতে শুরু করে দিল। সেই মধুর স্মৃতিগুলি সব একজোট হয়ে আমাকে বেঁধে ফেলেছে। এমন এমন ঘটনা মনে পড়ছে যেগুলো এই দীর্ঘ কলেজ পরবর্তী জীবনে কখনই মনে পড়ে নি। এটাই হয়তো মৃত্যুর সার্থকতা । এ ‘ জন্যই হয়তো স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘জগতে যখন এসেছিস, কিছু একটা দাগ কেটে যা। ‘ বীর…

গৌতম পাল আমাদের সঙ্গে (অমিত পালিত) একসাথে ১৩ নং হোস্টেলে থাকত… পালবংশের এক পাল ছিল… খুব অল্পভাষী ছিল… চাঁচাছোলা ভাল ছেলে. শেষ দেখা হলো কলেজের মিটে…. কি আর বলব… এক একজনের এইরকম চলে যাওয়াটা…. পর পর … খুব বিষাদের…. লিস্টে আরো একজনের নাম উঠে গেল… এই ত সেদিনের কথা…. ভাবতেও অবাক লাগে…. যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক

গৌতম পাল মেধাবী ছাত্র, মিতভাষী, স্বল্পবাক। এককথায় অজাতশত্রু। দিল্লিতে আমরা (অসীম দেব) একসময় ছিলাম। পারিবারিক যোগাযোগ ছিলো। কলকাতায় আসার পরেও খানিকটা যোগাযোগ ছিলো। ২০১৮ বিই কলেজ গেট টুগেদারে এসেছিলো এবং যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো এই শেষ কলেজ আসা। আর হয়তো সুযোগ হবে না। দিল্লিতে থাকাকালীন ওর অনেক মানসিক সমস্যা ছিলো যার সমাধান ওর হাতে বা কন্ট্রোলে ছিলো না। জীবনের শেষদিনগুলোর জন্য কলকাতায় এসেছিলো ভগ্নহৃদয় ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে। যাই হোক। অনেক দুঃখ শোকের থেকে মুক্তি পেয়েছে।

আমি (উত্তম খান) তখন Bharuch (Gujrat)। Baroda প্রায়ই যেতাম। সালটা 1978।পূজোয় ছুটি নেই। আর Bharuch এর পূজোর চেয়ে Baroda অনেক আকর্ষণীয়। বাঙালীর সংখ্যা বেশী। কয়েক জন মিলে চললাম বরোদা। এই প্যান্ডাল ঐ প্যান্ডাল ঘুড়ছি। দূর্গা পূজোর আকর্ষণ ছাড়া প্রথম বার গরবা নৃত্য দেখা। এই রকম একটা pandel এ দূর থেকে ঠাকুর দেখছি আর দেখছি সামনে ঢাকের সাথে বঙ্গ সন্তানদের নৃত‍্য। একটু এগিয়ে সামনে এসে ‘থ’! ঘোর কাটছে না। শান্ত, স্বল্প ভাষী, নিরীহ, নিপাট ভালো ছেলের তকমা পাওয়া ‘ গৌতম’! উদোম নৃত্যে নাচছে।
তার পর যা হয়, দুই বন্ধুর নানান গল্প। এই পরিবর্তিত গৌতম এই রকম থাকলে আরও আনন্দ পেতাম কিন্তু বিভিন্ন জনের কাছে শোনা যে শেষ জীবন খুব কষ্টে কেটেছে।

*******

জয়ন্ত গোস্বামী (ক্যাগা) (সিভিল)
– স্মৃতিচারণে অব্যয় মিত্র

লেখার ব্যাপারে আমি আনাড়ী, আর Obituary তো বটেই। ক্যাগার মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিচারণ ভাবতে ভাবতে আমার মনে অগোছালোভাবে যে যে ছবিগুলো ভেসে উঠছে, সেইগুলি আমার দুর্বল শব্দবন্ধনী দিয়ে স্মৃতির ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি টানার চেষ্টা করছি।

১৯৭২ সালের ১০ই ডিসেম্বরে বাক্সবিছানা নিয়ে শিবপুর বি ই কলেজে আমরা প্রায় ২০০ জন ছাত্রছাত্রী হোস্টেলে এসে উঠেছিলাম। আমার রুম পেয়েছিলাম ১৩ নং হোস্টেলে, জয়ন্ত হলো আমার রুমমেট। আমাদের নতুন জীবন শুরু হলো।
রাতের ডিনার সেরে, নতুন পরিবেশের মন কেমন করা ভাবনা নিয়ে সবাই শুয়ে পরেছিলাম। একটু রাতেই হটাৎ বিকট আওয়াজ, হাঁকাহাঁকি, দুমদাম দরজায় ধাক্কা। সিনিয়াররা আমাদের অনেককে বিভিন্ন ঘর থেকে তুলে নিয়ে এলো ১২ নং হোস্টেলে। শুরু হলো র‍্যাগিং, প্রথমে পরিচয় পালা, পরে যে বিষয়ে যে পারদর্শী সেটা করে দেখানো। কেউ বলে কবিতা বললো, কেউ শোনায় গান, কেউ টেবিলের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে দেখালো যে সে ডাইভার। আর জয়ন্ত গোস্বামী বলে যে কিছুই পারেনা। প্রায় সমস্বরে সিনিয়াররা আওয়াজ দিয়ে উঠলো “তুই চুনী গোস্বামীর পরিবারের লোক হয়ে ফুটবল খেলা জানিস না?” একজন বলে “তুই বাথরুম গান করিস না?” এবার খানিক ভেবে জয়ন্ত ধরলো রবীন্দ্রসংগীত “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ক্যাগা বিদেশিনী”।
ব্যাস সেই “ক্যাগা বিদেশিনী” থেকেই জয়ন্ত হয়ে গেলো “ক্যাগা”, আমাদের চিরকালের ভালবাসার বন্ধু। “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ক্যাগা বিদেশিনী” থেকে আমাদের ক্যাগা। আমাদের ব্যাচে বহু বন্ধু ওর পিতৃদত্ত নাম জানতোই না।
‘৭৩ সালে আমরা কয়জন ৭নং হোস্টেলে এসেছিলাম। এখানেই কেটেছিল আমাদের পরের ৩ বছর। একাহ্নেই ক্যাগার সাথে আমার বন্ধুত্বটাও গভীর হয়ে উঠেছিল। দেখতে দেখতে খেলা, গান, সিনেমা, তাস, ক্যারাম, হ্যাঁ আর অবশ্যই নিজের পড়া আর ক্লাসের পরীক্ষা নিয়ে বছরগুলো কেটে গেলো।
জয়ন্ত’রা আগরপাড়ায় থাকতো, ওরা তিন ভাই, ও ছিল মেজ। শুনেছি ও নাকি প্রিম্যাচিওরড বেবি, মাত্র ৬ মাসে ওর জন্ম। তাই আমরা ওকে ছ’মাসি বলেও ক্ষ্যাপাতাম। মানিক আর চুনী গোস্বামীরা ওর জ্যাঠতুতো ভাই।
ক্যাগার জীবনধারণ ছিল সহজ। একটি ঘটনা না উল্লেখ করলে মনে হয় খামতি থেকে যাবে। সেদিন হস্টেলে রাতের খাওয়ার পর প্রতিদিনের মতো গল্প আড্ডা সেরে সবাই ঘুমোতে গেলাম। তারপর গভীর রাতে প্রায় ২টো ৩টে নাগাদ কান্নার আওয়াজ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিঝম রাতে কে এমন করে বাচ্চাদের মতো কোকিয়ে কাঁদে? ৩ তলা,৪ তলা খুঁজে আমরা ছাদে গিয়ে দেখি ক্যাগা কার্নিশের উপর বসে চীৎকার করে কাঁদছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে ঘরে নিয়ে এসে কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর দিয়েছিল “হোস্টেলের ১০০টা ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর আমার চোখে ঘুম নেই, কাঁদবো না তো কি করবো তোরা বল?” এইরকমই সহজ, সরল ছিল আমাদের ক্যাগা।
একবার পরীক্ষার আগে একসাথে পড়াশোনা করবে বলে, সকালে আগরপাড়া বাড়ি থেকে সোজা মানিকতলায় আমার বাড়িতে হাজির, কিন্তু আমি সেদিন বাড়ি ছিলাম না। তাতে ক্যাগার কোনো অসুবিধা হয়নি, সে আমার ঠাকুমার কাছে খাওয়াদাওয়া করে, পাড়ার বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। বিকাল বেলায় বাড়ি ঢোকার মুখে দেখি আমাদের পাড়ার রকে বসে ক্যাগা আড্ডা মারছে।
এরপর ফিফথ ইয়ারে আমরা গেলাম উলফেন্ডেন হলে আর ক্যাগা চলে গেল সম্ভবত সেন হলে। মধ্যিখানে ফারাক্কায় একসাথে সার্ভে ক্যাম্প করেছি। সেখানে আমাদের ৮ জন করে মোট ৮ টা গ্রুপ হয়েছিল। ৫ কিমি রোড সার্ভে করতে এক একটা গ্রুপ এক একদিকে ছড়িয়ে গেলাম। সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফিরে শুনলাম বিশুদের গ্রুপ রোড সার্ভে করার সময় একটা মিষ্টির দোকান পথে পেয়েছিল আর দোকানের উপর দিয়ে নতুন রাস্তা যাবে শুনে মালিক অনেক মিষ্টি খাইয়েছিল যাতে দোকানটা না ভাঙ্গা পরে। সেই শুনে পরের দিনে বাকি গ্রুপগুলো সবাই সেই দোকানের উপর দিয়ে রাস্তা সার্ভে শুরু করে দিল। ক্যাগাদের গ্রুপ বা আমাদের গ্রুপ যখন পৌঁছালো তখন দোকানদার আমাদের চালাকি ধরে ফেলেছে এবং হ ই হ ই করে ক্যাগাদের তাড়া করেছিল।
‘৭৭ সালে পাশ করে ৭৮ থেকে শুরু হয়ে গেলো চাকরি জীবন। ক্যাগা প্রথমদিকে টেলকোতে চাকরি করতো।পরে লখনৌতে স্থায়ী বাসা করে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে থাকতো।
দীর্ঘদিন ক্যাগার কোনো দেখা বা খবর পাইনি। একদিন প্রনব (মন্ডল, বানু) ,অরূপ (মিত্র), গাগা, আমি এরকম কয়েকজন এক আড্ডার আসরে বসে পুরানো দিনের কথা স্মৃতিচারণ করতে করতে ক্যাগার কথা উঠে এলো। ওকে আমাদের বেক৭৭ ব্যাচের বড় বড় অনুষ্ঠানে দেখতে পাওয়া যায়না। নিজেকে যেন নিজের মধ্যেই ধরে রেখেছিল। যাই হোক সেই আড্ডায় ক্যাগার সাথে যোগাযোগ করার উপায় নিয়ে আলোচনা চলছিল, হটাৎ করে বানু বলে উঠলো ওর কাছে ক্যাগার একটা বহু পুরানো মোবাইল নং আছে। আমি সেই নম্বরে ফোন করতেই ওধারে এক মহিলার গলা ভেসে এলো। আমার পরিচয় দিয়ে ক্যাগার খবর নিতেই ভদ্রমহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন, আমাদের ক্যাগা সব মায়া ত্যাগ করে কোভিডের আগেই চলে গেছে। শুধু জানালেন প্রসুন ( মিত্র, ভাই) কে ফোন করেছিলেন। তখন ভাই’র কাছ থেকে খবর নিয়ে জানলাম যে ক্যাগার স্ত্রীও কোভিডের পরেই মারা গেছেন।

পরিশেষে জানাই যে স্মৃতিকথায় বন্ধুরা কখনই চিরকালের তরে চলে যায় না, শুধু স্থান পরিবর্তন করে। আমাদের ক্যাগা আমাদের মাঝেই আছে এবং ওকে চিরকাল স্মৃতির মণিকোঠায় ধরে রাখবে।

*****

তমাল বসু, (ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন)
– স্মৃতিচারণে সুহাস বসু

তমালের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আমাদের হোস্টেল জীবনের প্রথম দিনে। ডাউনিং হস্টেলের ১৯ নং ঘরে সে আমার রুমমেট ছিলো। সেদিনই জানতে পারলাম, ও জয়েন্ট এন্ট্রান্সে 42nd rank করেছে, আর ওর বাবা হুগলি জেলার ইটাচুনা বেসিক ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ। ওরা ছিল ৩ ভাই, ওর ছোট ভাই ৮০-৯০ দশকের মোহনবাগান ও ভারতের বিখ্যাত গোলকিপার তনুময় বসু। তমালের সেই সদা মনভোলানো হাসি আর দিলখোলা স্বভাবের জোরে শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম।
তমাল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সেকেন্ড ইয়ারে ওর জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। সেসময় ছাত্র রাজনীতির টানে ও কিছুটা বিপথগামী হয়, পড়াশোনার বাইরে চিন্তাভাবনা শুরু করে, আর তার ফলস্বরূপ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। পরের বছর সম্পূর্ণ নতুন সিলেবাসে ওকে পরীক্ষা দিতে হয় আর ও আবার অসফল হয়। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন সিলেবাসে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওকে CNR না করে আরও একটা সুযোগ দেন। ইতিমধ্যে তমালের একটা বড় পরিবর্তন হয়ে যে সে মাঠে নেমে নিয়মিত খেলাধুলা শুরু করে। ১৯৮০ সালে সে ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করে।
চাকরীজীবনে ও MOTWANE কোম্পানিতে Regional Head পদে উন্নতি করেছিলো। নব্বই দশকের শেষের দিকে MOTWANE তাদের কলকাতা অফিস বন্ধ করে দেয়, একই সময়ে ওর মাও পৃথিবী ছেঁড়ে চলে যান। MOTWANE র পর সে মহারাষ্ট্র সরকারের MELTRON এ জয়েন করে এবং সেখানেও ভালো কাজ করছিলো। কিন্তু ইতিমধ্যে মায়ের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে আনছিলো। প্রায় ঘরবন্দী। কিছুদিন পরেই অবশ্য সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে আর MELTRON এর পুরনো কয়েকজনের সাথে মিলে কনসালটেন্সি শুরু করে। এইসময় আমাদের সিভিলের নীলাংশু ভূষণ বাসু ওঁকে অনেক সাহায্য করে। এ ছাড়াও ওঁরা বিভিন্ন সরকারী কোম্পানিতে কমিউনিকেশন লাইনের কাজ করেছিলো।

২০১৪ সালের ২৬শে মার্চ নিজের বাড়িতেই ওর হার্ট অ্যাটাক হয় আর তার পরের দিন আমার সামনেই তমাল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। আজও যখন সে দিনটার কথা মনে পড়ে, একজন প্রকৃত বন্ধু হারানোর দুঃখে মনটা কেঁদে ওঠে।

*****

প্রবীর ব্যানার্জী (মেটালার্জি)
– স্মৃতিচারণে সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, অসীম দেব

প্রবীরের কথা ভাবলেই প্রথমেই মনে পড়ে শক্ত চোয়ালের দৃঢ়চেতা, নির্ভীক সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক যুবককে। এত অল্প বয়েসের একটি ছেলের ঐরকম নো ননসেন্স মানসিকতা আমার সঙ্গে অনেককেই মুগ্ধ করেছিলো। অবশ্য ঐ জ্যাঠামশাই সুলভ হাবভাব খুব তাড়াতাড়ি ওর জন্যে এনে দিলো ‘জেঠু’ নামটা, যা চিরকালই সঙ্গে রইলো।
সেকেন্ড ইয়ারে জেঠু আর আমি রুমমেট হলাম রন্জন আর মার্কোর সঙ্গে দশ নম্বর হস্টেলে। জেঠুর খুব পছন্দের বিষয় ছিলো মেটালার্জি এবং আড্ডা মারার ফাঁকে ফাঁকে মন দিয়ে পড়াশুনো করতো। চারমিনার আর দেশীয় তরলের ভেল্কিতে কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্বটা বেশ মাখোমাখো হয়ে উঠলো।
আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের সময় হঠাৎই একদিন খবর এলো যে মেস ওয়ার্কার দের স্ট্রাইক শুরু হবে। সমস্ত আবাসিকরা হস্টেল ছেড়ে বাড়ী ফেরার তোড়জোড় শুরু করতেই সেই পরিস্থিতিতে জেঠু জাহাজের ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে জানিয়ে দিলো, কাউকে ফিরতে হবেনা, মেস চালু থাকবে এবং ও একাই সবাইকে রান্না করে খাওয়াবে। এবং দু’বেলা ভাত, ডাল, সব্জী আর মাছের ঝোল- রান্না করে সত্যিসত্যিই সবাইকে খাওয়ালো। আমরা কয়েকজন সামান্য সাহায্য করেছিলাম মাত্র। সেটা ছিলো এক বিরাট যজ্ঞ এবং জেঠু তার ঋত্ত্বিক। জেঠু প্রমাণ করে দিলো ও হারকিউলিয়ান টাস্ক একাই হ্যান্ডেল করতে পারে।
ফোর্থ ইয়ারে আমি আর জেঠু রিচার্ডসনে চলে এলাম পাশাপাশি ঘরে। অন্য বিবর্তন এবার শুরু হলো। জেঠুর তামসিক প্রবৃত্তি অল্প অল্প করে মাথা চাড়া দিতে লাগলো। এক এক সন্ধ্যেতে ও হয়ে উঠতো আগুনে ঝলসানো ফিনিক্স পাখী, তারপর রাত গভীর হলে পোড়া ছাইয়ের স্তুপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতো সেই সাত্ত্বিক যুবকটি।
অনেক পরে বুঝেছি ওটা ছিলো সামান্য বাই পোলারিজম।

কলেজ ছাড়ার পরে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেলো, আমরা দুজনে দুদিকে ভেসে গেলাম। প্রায় তিরিশ বছর পরে আবার দেখা হলো। তারপর মাঝেমাঝে ক্যালকাটা ক্লাবে আড্ডা মারতাম। কথাবার্তায় মনে হতো ও যেন সংসারে সন্ন্যাসীর মতো আছে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের আকর্ষণ দুজনেরই ছিলো, পন্ডিত যশরাজ আর পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ এর দুটো প্রোগ্রাম একসঙ্গে দেখলাম। তখনই বললো, বিপি টা বড্ডো ফ্ল্যাকচুয়েট করছে।
কয়েকদিন পরে এক সকালে গ্রুপে খবর পেলাম জেঠু আর নেই। ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এরেস্ট, ডাক্তার ডাকারও সুযোগ পাননি আত্মীয় পরিজন রা।
আমার অতি প্রিয় সেই ফিনিক্স পাখী, তার অতিকায় আগুন জ্বালা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে গেলো, না ফেরা দের দেশে।

আহা রে বিধি গো তোর
লীলা বোঝা দায়,
সে যে উড়িয়া বেড়ায়
তারে বাঁধিস খাঁচায়,
সে যে উড়ে যায়, উড়ে যায়,
যায়, যায়, যায়, যায়

সংযোজনে অসীম দেব
দিল্লীতে আমাদের বেক ৭৭ পরিবারদের ঘন ঘন মোলাকাত হতো, এবং জেঠু ছিল লাইফ মেম্বার। শেখর চড়ুইভাতির জন্য একটা ফার্মহাউস (ভালো সুন্দর বিরাট বাগানবাড়ি) ঠিক করে দিলো। জেঠু এসে সোজা কিচেনে। একটা এপ্রনও নিয়ে এসেছিল। দূরে সবুজ ঘাসের লনে সবাই মস্তি করছে, আর জেঠু কিচেন থেকে মেটিরিয়াল সাপ্লাই এর দায়িত্বে। মিনিট দশেক পরে আমি হেল্পার হয়ে জয়েন করলাম। সেদিন ব্রেকফাস্ট, দুপুরের ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস, চাটনি এবং সারাদিনের চায়ের ঝামেলা একাই সামলে দিলো, আমি সামান্য হেল্পার মাত্র ছিলাম।
পাড়ার দুর্গাপূজার জন্য ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, নিজের হাউজিং সোসাইটির যত ঝুটঝামেলা, আজ লিফট খারাপ, কাল জলের সমস্যা সব সেই সামলাচ্ছে। আসলে পাবলিকদের সাথে থেকে পাবলিকদের জন্য সার্ভিস দিতে ওর একটা প্যাসন ছিল, সেই কলেজ থেকেই দেখেছি।
এবার দিল্লীর আমাদের বেক ৭৭ পরিবারদের রোটেশন সিস্টেমের রিউনিয়নের কথায় আসি। যার বাড়িতেই হোক, শেখর আর জেঠু এই দুজনে মিলে এক বোতল, বা অনেক সময় দ্বিতীয় বোতলও খুলতে হয়েছে। এবং দুজনেই সম্পূর্ন স্বাভাবিক। এরপর মাঝরাতে রাত একটা দুটো নাগাদ, দুজনেই গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। যদি বলি আমার বাড়ি, তাহলে ওঁদের দুজনের বাড়িই ২০-২২ কিলোমিটার। কুল ঠান্ডা মাথায় গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। স্ট্যামিনা ছিল বটে।
আজ দিল্লির বেক ৭৭ পরিবারের সদস্য অনেক কমে গেছে। তবে সেদিনের অনেক কথা অনেক সময়ই মনে হয়।

*******

পৃথ্বীশ চক্রবর্তী, ভাবুক (তাপস) চক্রবর্তী, (মেকানিক্যাল)
আমার দুই ল্যাব পার্টনার।
– স্মৃতিচারণে প্রশান্ত চন্দ্র

পদবীর ইংরাজী বর্ণমালার ক্রমানুসারে আমাদের ক্লাসে রোল নং হতো। আমার পদবীর আর কেউ ক্লাসে না থাকায় আমার রোল নম্বর ছিলো সব চক্রবর্তীর শেষে এবং চ্যাটার্জিদের আগে। আমার রোল নম্বর ছিল ১৫। আমার আগের দুজন পৃথ্বীশ চক্রবর্তী (১৩) ও তাপস চক্রবর্তী (১৪)। আমাদের তিনজনকে সমস্ত ল্যাবরেটরি ক্লাসে একটা গ্রুপে দেওয়া হতো।

পৃথ্বীশ ছিল গোলগাল চেহারার শান্ত স্বভাবের। কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ডাউনিং হলে এসে প্রথমদিকে সে ফুটবল খেলত। অন্যদিকে পড়াশুনার ব্যাপারে ছিল খুবই সিরিয়াস। অথচ তাপস (ওরফে ভাবুক) ছিল একেবারেই অন্যরকম। সবসময় একটা উদাসীন ভাব, জাগতিক ব্যাপারে যেন কোন ভ্রক্ষেপই নেই। কোনও কথাই সিরিয়াসলি নেয় না। কলেজে ওর নামটা ভাবুক কে দিয়েছিল এখন মনে নেই, কিন্ত নামটা যে একেবারে উপযুক্ত ছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশই ছিলো না। কলেজে ওর ভাবুক নামটা এতটাই বিখ্যাত ছিল যে ওর আসল নামটা যে তাপস, সেটা আজও হয়ত অনেকেই জানে না।

ক্লাসে ভাবুককে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও ল্যাবে এসে প্রথমে রোল কোল হয়ে যাওয়ার পর কোথায় যে ভ্যানিস হয়ে যেত, কেউ জানে না। শুধু যাবার আগে আমাদের একবার বলে যেত, ‘এই, তোরা নামিয়ে দিবি তো’, ‘তোরা নামিয়ে দিবি তো’?
একটা কথা দুবার বলে রিপিট করা ছিল ওর অভ্যাস। কোনও কোনও দিন আবার ল্যাব শেষ হওয়ার আগেই একবার ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করত, ‘এই, তোদের হয়ে গেছে’, ‘তোদের হয়ে গেছে’?

এরপর আবার ওর দেখা মিলত প্রায় এক সপ্তাহ পর, পরের ল্যাব ক্লাসের আগের দিন রাত্রি দশটার পর। কারণ কালকেই ল্যাবের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। আমাদের ১১ নং হোস্টেলে এসে জিজ্ঞেস করত, ‘রিপোর্ট হয়ে গেছে’, ‘রিপোর্ট হয়ে গেছে’? আমার রিপোর্টটা নিয়ে চলে যেত আর ফেরত দিত পরের দিন ল্যাব ক্লাসে এসে। আমাদের ক্লাসের অনেককেই ওকে বলতে শুনেছি ‘গুরু, তোমার ভাগ্য ভাল যে এইরকম একটা সিরিয়াস গ্রুপ পেয়েছো, আর তুই কিনা কিসস্যু না করেই নম্বর পাচ্ছিস’। ওর অবশ্য এইসব মন্তব্য শুনে কোনও প্রতিক্রিয়াই ছিল না। বলেছি না, জাগতিক ব্যাপারে একেবারেই নির্লিপ্ত। ভাবুক ভাবুকের মতোই অন্য কিছু ভাবতে ভাবতে চলে যেত।

একদিনের কথা মনে আছে। সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ম্যাথমেটিক্স পরীক্ষার দিন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। আমি সাধারণত পরীক্ষার টেনশন কাটানোর জন্য পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় কোনও গান গুনগুন করতে করতে যেতাম। সেদিনও বোধহয় শ্যামল মিত্রের কোনও গান গুনগুন করতে করতে ওভালের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি, ভাবুক আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফর্মুলা জিজ্ঞাসা করছে। ওকে ফর্মুলা বলে দেওয়ার পর আমি আবার গুনগুন করছি। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “আমার ভয়ে জ্বর এসে যাচ্ছে আর তুই গান গাইছিস?”
সেই ভাবুক কিন্ত সব পরীক্ষায় পাশ করে যেত।

অসীমের (দেব) দাদা আমেরিকায় থাকতো, আর সেই সূত্রে অসীমের কিছু ভালো ভালো আমেরিকান জামা ছিলো। একদিন ধোপা কাপড় কেচে নিয়ে এসেছে, ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। এমনসময় অসীমের আমেরিকান জামা আর সে খুঁজে পায় না। ধোপার মাথায় হাত। অসীমের সেদিনের দুঃখ অসীমই জানে। সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় অসীম দেখলো ভাবুক সেকেন্ড গেটে সেই শার্ট গায়ে টহল দিচ্ছে। ভাবুক নির্লিপ্ত হয়ে জবাব দিলো, “এগারো নম্বরে গিয়েছিলাম। দেখলাম একটা ভালো শার্ট, নিয়ে এসেছি। এতে এত টেনশনের কি আছে?”
অসীম জানে এরপর সেই শার্ট আরও অনেকের গায়ে চড়বে। সেদিনই রাতে অসীম দশ নম্বর হস্টেলে গিয়ে চোরের উপর বাটপারি করে জামাটা নিয়ে এলো।

পাস করে অনেকগুলি বছর কেটে গেলো। কলেজ ছাড়ার পর ভাবুক বা পৃথ্বীশ কারোর সঙ্গেই আর যোগাযোগ ছিল না। শুধু শুনেছিলাম, পৃথ্বীশ ইন্ডিয়ান অয়েল আর ভাবুক ইন্টারন্যাশনাল কম্বাসশনে আছে।

এর বেশ কয়েক বছর পর হঠাৎই শুনলাম, পৃথ্বীশ দুর্ভাগ্যবশতঃ বিহারের বারাউনি শহরে এক আততায়ীর গুলিতে অকালে প্রাণ হারিয়েছে। সম্ভবত ৮৫-৮৬ সালের আশেপাশে, সেইসময়।
পৃথ্বীশ ছিলো কোম্পানির মার্কেটিং ডিভিশনে। সে ছিলো সৎ অফিসার। ট্যাংকারে তেল ভরা নিয়ে মাফিয়াদের সাথে অনেকবার বিবাদ হয়। পরিনতিতে বারৌনিতে জিরো মাইল বলে একটা মোড় আছে। ওখানে অষ্টমী পূজোর দিন পাম্পে তেল ভরছিলো। গাড়ির ভিতরে স্ত্রী ও ছেলে ছিলো। পৃথ্বীশ নিজে ছিলো স্টিয়ারিং এ। আততায়ীরা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ওঁকে গুলি করে মেরে দিয়ে চলে যায়।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমি মুম্বই, জাকার্তা ঘুরে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছি ২০০৩ সালে। তারও কয়েক বছর পর হঠাৎ ভাবুকের সঙ্গে দেখা একদিন সকালে রবীন্দ্র সরোবরে হাঁটার সময়। ওখানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হোল। ও চাকরি ছেড়ে একটা ফেব্রিকেশনের ব্যবসা করছিল। বলেছিল, আমার অফিসে একদিন আসবে। কিন্ত আসেনি। আমারও নানা কাজের ব্যস্ততায় ওকে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। এর দু তিন বছর পর হঠাৎ জানলাম পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সেও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

পৃথ্বীশ আর ভাবুক – আমার কলেজের দুই ল্যাব পার্টনার আর আমাদের মধ্যে নেই। ওরা যেখানেই থাক, ভাল থাক। ওদের দুজনের পরমাত্মার শান্তি কামনা করি।

সংযোজন, সোহম দাসগুপ্ত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
পৃথ্বীশ যে কলেজের প্রথমদিকে ওভালে গিয়ে ফুটবল হকি খেলত, সেটা অনেকেরই অজানা। ওঁর ভারিক্কী শরীরের জন্যই হয়তো, সাধারণের এরকমই একটা ধারণা ছিল। একদিন বিকেলে আমি ওভালের পাস দিয়ে ফিরছি, দেখি পৃথ্বীশ ডাকছে। স্পোর্টসের হ্যামার থ্রো কম্পিটিশন, সেটা বাতিল হতে চলেছে, কারণ কমপক্ষে পাঁচজন প্রতিযোগী চাই, চারজন হয়েছে, আমি যদি রাজি থাকি তাহলে আমিই পঞ্চমজন, এবং প্রতিযোগিতা হবে। যাই হোক গেলাম। কিভাবে হ্যামার থ্রো হয় কিছুই জানিনা। পৃথ্বীশ আর এথলেটিক্স ক্লাবের ইন্সট্রাকটররা দেখিয়ে দিলেন, কিভাবে ছুঁড়তে হয়। এবং সকলকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমি হলাম ফার্স্ট, পৃথ্বীশ হয়ে গেলো সেকেন্ড।
কেন জানি না, আজকের দিনে হঠাতই ওঁর কথা মনে এসে গেলো।
ওঁ শান্তি।🙏

 

******

পার্থসারথী মুখোপাধ্যায় (ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন)
– স্মৃতিচারণে হিমাংশু নাথ

মন খারাপ সরিয়ে রেখে পার্থর জন্য লিখতে বসলাম। শুরুতে ক্লাসরুম (ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে একই সেকশনে, পরবর্তীকালে আমাদের ইটিসি আর ইলেকট্রিক্যালের অনেক ক্লাস একইসঙ্গে ছিলো), আর তারপর পাঁচ বছর হোস্টেলেও একসাথে ছিলাম (৮নং, রিচার্ডসন), সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে কাছের থেকে দেখা। পরবর্তীকালেও অনেক মিট্, গেট টুগেদার, ক্লাবে দেখা হওয়া। যোগাযোগ তো ছিলই, কারণ পার্থর প্রানবন্ত উপস্থিতি সব গ্রুপেই বোঝা যেতো। একবার বলতেই নাগপুর থেকে সপরিবারে আমার পারিবারিক আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগদান তো ভোলাই যাবে না।
কলেজ পরবর্তী দিনগুলি উল্লেখ করছি না, স্থানাভাবে। বরং ফ্ল্যাশব্যাকে আমাদের সবথেকে আনন্দময় জীবন – হোস্টেলের গপ্পে ফিরে যাই।
পার্থর চেহারার সবথেকে দৃশ্যমান ছিলো ওর মাথার চুল। অনেকটাই এখনকার অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজার হেয়ার স্টাইলের IPR পার্থর দখলে। যেদিন চুল কাটতো, মনে হোতো এখনই চুল কাটার উপযুক্ত! ৮ নম্বর হস্টেলে পড়াশুনোর তীব্র ইচ্ছা বিশেষ কারোর মধ্যেই ছিলো না। কিন্তু কারোরই সর্পদংশন (SUP পাওয়া) এর অভিজ্ঞতা হয় নি। ক্লাস সবাই করতাম – সেটা বুঝি বা না বুঝি! একা ক্লাস না করাই বোরিং ছিলো। বাকি সময় খেলা, আড্ডা সবই হতো।
অন্য খেলা বাদ দিলেও ৮ নং হস্টেলের করিডোর এ আন্ডারআর্ম ক্রিকেট জবরদস্ত জমতো। পার্থ অবশ্যই থাকতো। ওর আউট হওয়া ছিল সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু কিছুতেই lbw মানবে না। যতক্ষণ না খেলার পিছনে সময়, lbw যে সঠিক নয় সেটার তর্কে সময় বেশি যেতো।
গানের উৎসাহ বিশেষত মুকেশের গান বেশ পছন্দের ছিলো। গানের গলা ছিলো না, সেটা চোখ বন্ধ করে আবেগ পাঞ্চ করে ম্যানেজের চেষ্টা হতো।
পার্থও বাকিদের মতো বিশেষ পড়ুয়া ছিলো না। ফিল্ম (অবশ্যই হিন্দি) নিয়ে বেশ উৎসাহী ছিলো। অনেক ফার্স্ট’ডে ফার্স্ট’শো এর পালক পার্থর টুপিতে। কিন্তু বিশেষ ভাবে বলতে হবে ‘ববি’ নিয়ে obsession. আমার মনে হয় যখনই টিভিতে ‘ববি’ দেখানো হয়, ৮ নং এর জনতার পার্থর স্মৃতি মনে আসে – বিশেষত ওর শেষ বিদায়ের পরে। ববি এবং ডিম্পলের আকর্ষণ বলার কিছুই নেই। এমন কেউই নেই যে আকর্ষিত হয় নি! কিন্তু পার্থর আকর্ষণ ছিলো স্বতন্ত্র। ৪৩.৫ বার এই ফিল্ম দেখার বিশ্ব রেকর্ড পঙ্কার (পঙ্কজ প্রধান) সঙ্গে যুগ্মভাবে। লিপির নাইট শোতে প্রতিদিন যাওয়া তাঁর এক রুটিন ছিলো। কিন্তু তার প্রস্তুতিও উল্লেখযোগ্য। সন্ধ্যার পরেই একদম গুডবয়ের মতো (শরৎচন্দ্রের মেজদার ছাত্রদের মতোই) পার্থ-পঙ্কা (পাশাপাশি রুম) বই খুলে বসে যেতো। অসম্ভব রকমের ‘ফোকাসড’ পড়াশুনোয়। ঠিক বিশেষ সময়ে পার্থর ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ‘পড়াশুনোর’ সমাপ্তি। ১ মিনিটের মধ্যে পোষাক পরিবর্তন এবং পাশের ঘরের পঙ্কাকে অতি মিহি স্বরে পঙ্কা বলে ডাকা। পঙ্কাও এই নিশির ডাকের অপেক্ষায় থাকতো বলাবাহুল্য। পার্থর মধ্যে চিরকালই সেই রোমান্টিক কোশেন্ট তীব্র। বলাবাহুল্য টিকিট কেটে দুজনে দেখতো না। হাফ-টাইমে ঢুকে গম্ভীর ভাবে বসে যেতো। নিশ্চয়ই সিনেমা হলের লোকেরা বুঝতো। কিন্তু কলেজের ছেলেদের আর কে ঘাঁটায়? একবারই মাঝপথে কে যেনো বার করে দিয়ে ছিলো অন্যের সিটে বসা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। তাই জন্য ৪৩.৫ ধরা হয়েছে। কিন্তু পার্থ শুধুমাত্র ডিম্পলের সঙ্গে ভার্চুয়াল প্রেম করে সমাপ্তি ঘোষনা করে নি। রক্তমাংসের প্রেম রিঙ্কুর (পার্থ ঘরনী) সঙ্গে হয়েছিল। গোটা ৮ নম্বর হস্টেলের একমাত্র সফল প্রেম কাহিনী। পার্থ তখন থার্ড ইয়ারে, আর রিঙ্কু বালি’তে কোনো এক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রেম হলো, মিঁয়া-বিবি দুজনেই দুজনকে পছন্দ করলো। এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু সমস্যা ছিলো যে দেখা হবে কি করে? এছাড়া ফান্ড ম্যানেজ করা প্রবলেম। কাঁহাতক লগ-টেবিলের পায়া ভেঙেছে বলে বাড়ি থেকে চাওয়া যায়? পার্থর ক্লাসে বিশেষ innovation না থাকলেও প্রেমের ব্যাপারে ভীষণ creative সেটা প্রমাণ করেছিলো। (জানিনা রিঙ্কুর অবদান কতটা ছিলো!) দুজনে স্কুলটাইমে একটা প্রাইভেট বাসের (বালি থেকে শ্যামবাজার যেতো সম্ভবত) শেষ সিটের কোনায় বসতো। বাস স্টপে পৌঁছে গেলেও বাসেই বসে থাকতো। আবার স্টার্ট দিয়ে বালিতে স্কুল ছুটির সঙ্গে সময় মিলিয়ে বাড়ি ফেরত। (বোধহয় রিঙ্কু বাড়িতে ম্যানেজ করে বাড়তি টিফিন নিতো, ওটাই লাঞ্চ!)। দুজনের প্রেম শেষদিন পর্যন্ত দুজনকে বন্ধনে রেখেছিল।
শেষদিন পার্থ যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে যায়, স্টিয়ারিং এ নর্মাল ভাবেই চালাচ্ছিলো। পাশেই রিঙ্কু….. হঠাৎই……. ।
মনে হয় শেষ সময়েও রিঙ্কুর আঙ্গুল ছুঁয়ে ছিলো।
পার্থ ভালো থাকিস – দেখাতো হবেই। আবার আন্ডারআর্ম ক্রিকেট হবে…. এবার তোর জন্য lbw বাদ… আউট দেওয়া হবে না! 🙏

******

বার্তা বোস (মেটালার্জি)
– স্মৃতিচারণে সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, সাধন চ্যাটার্জি

বার্তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রপাত সেকেন্ড ইয়ারে দশ নম্বর হস্টেলে। আমাদের পাশের ঘরেই ও থাকতো। ছিপছিপে লম্বা সামান্য অন্তর্মূখী বার্তাকে পছন্দ না করে উপায় ছিলোনা। পড়াশুনোয় উৎসাহ খুবই কম, বলেছিলো বাড়ির চাপে ইন্জিনীয়ারিং পড়তে এসেছে। পড়াশোনার বাইরে খুব মন দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নতির কথা বলতো। বড্ডো আবেগপ্রবণ ছিলো। আমার মনে হতো, হয়তো ফিলোজফি পড়লে ভালো করতো। নিৎসে, কান্ট বা হেগেলের মতো আমরা এক অসাধারন দার্শনিক পেতাম।
যেটা নজরে করার মতো ছিলো তা হলো, রোগা পাঁজরের আড়ালে থাকা এক বড়ো মাপের মন। কারনে অকারনে বন্ধুদের জন্যে খরচা করতো। মাঝেমাঝেই আমাদের ব্যারাক সারভেন্ট দুলাল দার দামী দামী বৈকালিক খাবারের বিল সেই মিটিয়ে দিতো। টাকা ফেরত নিতো না। কত ধার রইলো, যা আর শোধ করা হলোনা!
আমার আফশোষ রয়ে গেলো।
দশ নম্বরের পালা চুকিয়ে চলে গেলাম রিচার্ডসে। তখন রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে সামান্য রজনীকান্তের গানও গুনগুন করে গাইতাম। তার মধ্যে একটা গান ছিলো:
“কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইবো
তোমারি রসালো নন্দনে………”
বার্তা রিচার্ডসে মাঝে মাঝেই আমার সাথে দেখা করতে আসতো। এসেই বলতো ঐ গানটা শোনা। গান শুনে প্রতিবার চোখ ছলছল করতো, বুঝতে পারতাম অনেক চাপা কষ্ট আছে, যার নাগাল আমি আর পেলাম না।
বার্তা পাশ করে হিন্দ মোটরে জয়েন করে। কিন্তু আমার যোগাযোগ পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে গেলো। হিন্দ মোটরে যখন চরম বিশৃঙ্খলায় হয়ে যায় তখন ২০০৫/০৭ সাল নাগাদ কলকাতার ম্যাকনলি ভারতে জয়েন করে, ২০১৬/১৭ পর্যন্ত সেখানেই ছিলো। শেষের দিকে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গিয়ে প্রচুর খরচ করতে হয়। কিন্তু এর মধ্যেও ২০১৫ সালে ৭৭ ব্যাচের ফান্ড রেইজিং এর সময় নিজের থেকেই ২০,০০০/- টাকা দেয়। এতটাই ছিলো ওর কমিটমেন্ট।
ওর নিয়মিত আড্ডা হতো বেহালা পর্ণশ্রী মাঠে সাধন, অসীম দত্ত, দ্বিজদাস মাঝি, বারীন আর রথীনের সাথে। ভগ্নসাস্থ্য নিয়েও সে এই বন্ধুদের সাথে টাকি ঘুরতে গিয়েছিল, আর যতদিন পেরেছে কলেজের শীতকালের গেট টুগেদারে নিয়মিত এসেছে।

আমাদের বার্তাকে শেষদিকে ঘরেবাইরে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে, কিন্তু কেউ কোনদিন ওঁকে হার মানতে দেখেনি। ওদের পৈতৃক বাড়ি প্রোমোট করার সময় মনোমালিন্য হওয়ায় প্রতিবাদে নিজের ভাগ ওর দাদাকে লিখে দিয়েছিল।
ধান্দাবাজ নয়, সত্যিকারের কমিউনিস্ট। যাদের খুঁজে পাওয়াই ভার।
যদিও ওর নিজের বাড়ি তৈরি করার সময়ে মাকুরা ভীষণ বাধা দিয়েছিল। রঘুনাথ কুশারী’কে ধরে ঝামেলা মেটাতে হয়েছিল। কলেজে সিপিএম এর সংগঠনে যুক্ত থাকায় অনেক শারীরিক মানসিক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিলো, কিন্তু পরে পার্টির ব্যাপারে মোহভঙ্গ হয়। গনশক্তির গ্রাহক হতে অস্বীকার করার জন্য অনেক ঝামেলাও সইতে হয়েছিল।
ইতিমধ্যে আমি ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে দেশবিদেশের নানান ঘাটে নৌকো বেয়ে অবশেষে কলকাতায় থিতু হলাম। আবার ফোনালাপ শুরু হলো। বললো আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা।
তখনই অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে শুনলাম বার্তার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয় এবং মনোমতো চিকিৎসা পাচ্ছেনা। অনেক অনুরোধের পরেও কোনো সাহায্য নিতে রাজী হলোনা। ফোন করলেই হাসতো, বলতো, খুব ভালো আছি, কোনো অসুবিধে নেই। বুঝতে পারছিলাম আমার দার্শনিক বন্ধুটি এবার আমাদের চিরতরে ফাঁকি দেবে।

তাইই হলো, কদিন পরে শুনলাম ও আর নেই।
অবশেষে, তৃষিত এ মরু ছেড়ে, বার্তা নিঃশব্দে চলে গেলো দিকশূন্যপুরের দিকে।

 

******

বিপ্লব পাল
– স্মৃতিচারণে শৈবাল নন্দী, সমীর সরকার

নিজের মধ‍্যেই গুটিয়ে থাকার জন‍্য আমাদের ব‍্যাচের বিপ্লব পালকে হয়ত অনেকেই চিনত না। তার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। অধিকাংশ সময়েই গুটিয়ে থাকত এবং যেটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে ছোটবেলায় পোলিও আক্রান্ত হওয়ায় কিছুটা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল চিল, আর হয়তো সে একটু হীনমন‍্যতায় ভুগত। অন্যরকম উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করলেও পড়াশোনার মধ‍্যেই নিজেকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু তাঁর যে শারীরিক শক্তি ছিল সেইরকম শক্তি আমার তো ছিলই না, আমাদের ব‍্যাচের ছেলেদের মধ‍্যে খুব কমই হয়ত তার সমকক্ষ হতে পারত।
প্রত‍্যেক শনিবারে বিপ্লব মেটিয়াব্রুজে নিজের বাড়ি যেত, ব‍্যাগে তার নিজের ব‍্যবহারের জিনিস ছাড়াও থাকত মোটা মোটা বইখাতা। যে ছেলে সেই ভারী ব‍্যাগ নিয়ে একদিকে কাত হয়ে হেলে গিয়েও সাহেবপাড়া থেকে হেঁটে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতর দিয়ে গিয়ে নাজিরগঞ্জ থেকে লঞ্চ ধরতে পারত, সেই ছেলেকে তো আমি কোনোদিনই শারীরিকভাবে দুর্বল বলতে পারি না। এছাড়াও বিপ্লব অবলীলায় কলেজের পাশে হুগলী নদীতে সাঁতার কাটতো, অনায়াসে বহুদূর চলে গিয়ে আবার সাঁতারুর গতিবেগে ফিরে আসত। আর আমাদের অন‍্য বন্ধুরা পাড়ের পাশেই হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করত। তবুও সে নিজেকে গুটিয়ে রাখত।
বিপ্লব পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিল। একদমই আড্ডাবাজ ছিল না, সবসময় বই নিয়ে থাকত। পড়াশোনার পাশাপাশি অসম্ভব ভালো ড্রইং করত। তাঁর পেন্সিলে আঁকা মা কালীর ছবি যেমন দেখেছি সেরকমই কিছু মনীষীদেরও নিঁখুত ছবি দেখেছি। পাশ করার পরে এদিকে ওদিকে কিছুদিন ঘোরাঘুরির পরে EIL এ জয়েন করে। একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ‘ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এর ‘জেনারেল ম‍্যানেজার’ পদে অবসরের পরে দুই কন‍্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে হায়দ্রাবাদ শহরে নিজের বাড়িতেই ছিল। চাকরি জীবনের পরে অবসর জীবনে সে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারির সাথে সাথে উঁচু ক্লাশের ছাত্রছাত্রীদের অত‍্যন্ত সুনামের সঙ্গে কোচিং ও করাচ্ছিল।
এই ষাটোর্ধ বয়সেও শুনতাম যে সে নিজের বাড়ির সিলিং ফ‍্যান খুলে overhauling করে নিজেই লাগাত। ওর সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল Corona pandemic এর ঠিক আগে। তারপর, হঠাৎ খবর পেলাম সব শেষ। তাঁর বাড়ির লোকেরাও এই আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সেখানেই শেষকৃত‍্য হল। বিপ্লব দেখিয়েছিল যে জীবনে নীরবে নিভৃতে লড়াই করে কীভাবে সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করা যায়।
আজ অত‍্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

 

******

মলয় কুমার গাঙ্গুলি, (ইলেকট্রিক্যাল)
– স্মৃতিচারণে দেবাশীষ গাঙ্গুলি

মলয় বা আমাদের আদরের মলি officially ছিল আমাদের থেকে বছর তিনেকের ছোট। নাকতলায় নিজেদের বাড়ী। বাবা, মা আর এক ছোট বোন এই নিয়ে সংসার। বাবা ছিলেন কলকাতা টেলিফোনের কর্মী।
মলয় আমাদের ইলেকট্রিকাল ইনজিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ফোর মাস্কেটিয়ার্সের একজন। সে ছিলো রাহুল দেব বর্মণের অনুরাগী, আর আমাদের ইয়ারের অসীম (দেব) কিছু হলেই কল্যানজী আনন্দজী, লক্ষীকান্ত প্যারেলালে বা অন্যান্যদের খুব প্রশংসা করে ওকে খেপিয়ে দিতো। সাথে মনু (মনোতোষ), মানে ফোর মাস্কেটিয়ার্সের আরেকজন। এই মনু আবার ছিলো মহম্মদ রফির ফ্যান। এই অসীম আর মনু মিলে আমাদের মলি’কে চাগিয়ে (ক্ষেপিয়ে) দিতেই মলি শুরু করে দিতো আরডি – কিশোর কম্বিনেশনের গান। গানের আসরে টেবিল সেই বাজাতো, সে নিজের গানই হোক, বা অন্য কারুর। সুরেলা গলা ছিলো, খুব ভাল গান গাইত। কিশোর কুমার, মান্না দের সব গান ছিল কণ্ঠস্থ। হস্টেলে সান্ধ্য আসর গুলো জমে উঠত মলয়ের গানে।
১৯৭৫-৭৬ সালের একটি ঘটনা। আমরা তখন ফোর্থ ইয়ারে, এগারো নম্বরে। ডাউনিং হস্টেল ইন্সটিটিউট হলে নিজেদের একটা ফাংশান নামালো। মলয় দেখলো, এবং এসেই জানালো যে এবার এগারো নম্বরও নিজেদের ফাংশান করবে। জুনিয়র ছেলেরা বলে দিলো যে করা যাবে, কিন্তু মেস থেকে এক পয়সাও নয়, আর কোনরকম ডেফিজিট চলবে না। ঠিক আছে, আমাদের স্যুভেনির হলো, প্রায় হাজার খানেক টাকাও উঠলো। মলয় নিয়ে এলো তপন রায়কে (ডুপ্লিকেট মান্না দে), অসীম আর সন্দীপ দত্ত (কুচবিহার, মেকানিক্যাল) Moulin Rouge গিয়ে পি রাজকে (ডুপ্লিকেট মান্না) কন্ট্রাক্ট করলাম, মামু নিয়ে এলো অর্কেস্ট্রা, সমীর খাসনবিসকে। জ্যাঠামশাই এর দোকান থেকে বলে দিলো আর্টিস্টদের চা মিষ্টি ওরাই খাওয়াবে। কলেজের মাইনিং ডিপার্টমেন্টের বাস পেলাম অর্কেস্ট্রা পার্টির জন্য। ইলেকট্রনিকস ডিপার্টেমেন্ট থেকে পেলাম মাইক সিস্টেম। ক্যাম্পাসে বেশ সাড়া তুলেই সেদিন আমাদের হস্টেলের ফাংশান হলো। সেদিনের সেই হট এপ্রিল নাইটের মাস্টারমাইন্ড ছিলো আমাদের মলি।
(*** জনান্তিকে বলি, সবাই যখন ফাংশান দেখছে, আমি তখন এল্যুমনি হাউসে আর্টিস্টদের চা মিষ্টি খাওয়ানোর দায়িত্বে ছিলাম ***)

স্বাস্থ্যবান, সরল, সাধাসিধে ছেলে, কিন্তু একরোখা, গো্ঁয়ার আর জেদী। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। প্রতিদিন সকালে দেখা যেতো হস্টেলের বারান্দায় স্বচ্ছ একটা লাল গামছা পরে হাতে সিগারেট নিয়ে পায়চারি করছে। নইলে প্রাতকৃত্য হবে না।
এমনিতে খোলামেলা দিলদার লোক। কিন্তু বাবার কড়া নজরদারির জন্য হস্টেলের বেপরোয়া জীবনযাত্রা এড়িয়েই চলত। পড়ালেখায় ফাঁকি ছিল না।
পেশাদারি জীবনে মলয় লাইটিং টেকনোলজিতে সারা দেশের একজন নামী বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। বিশেষতঃ হাইমাস্ট লাইটিং এর। ভারতের বহু বড় বড় শহরের রাস্তা, স্টেডিয়াম, অডিটোরিয়ামের আলোকসজ্জায় মলয়ের বিশেষ অবদান আছে। পরে চাকরী ছেড়ে নিজের কনসালটেন্সি শুরু করে। দেশের অনেক বড় বড় লাইটিং প্রজেক্ট, যেমন আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের সময় মুম্বাইয়ের ওয়াংখাড়ে স্টেডিয়াম, দিল্লী কমনওয়েলথ গেমসের সময় সব ইন্ডোর আর আউটডোর স্টেডিয়াম, দিল্লি এয়ারপোর্টের অনেকটাই, মুম্বাই-পুনে হাইওয়ে, দিল্লী মেট্রে রেলের অনেক জায়গা, এইরকম সব। অসীমকে বলেছিলো যে ব্রাজিলের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের সময় বিড করতে চেয়েছিলো, কিন্তু ফাইনাইন্সিয়াল ক্রেডিবিলিটি ছিলো না বলে এলিজিবল হতে পারে নি।
কর্মসূত্রে পুনা আর বম্বেতে থাকতো। পুনায় বাড়ীও করেছিল।
দুর্ভাগ্যবশতঃ ওর সংসার জীবনটা শেষে সুখের হয়নি। অবসরের পর স্ত্রী ও দুই পুত্রের সঙ্গ ত্যাগ করে একা কলকাতায় পৈতৃক আবাসে থাকতে শুরু করে। শেষে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে পাড়ার বন্ধুরাই হাসপাতালে ভর্তি করে। ডাক্তার বলেন লিভারের অবস্থা সঙ্গীন। কিছুটা সামলে উঠলে বাড়ীতে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু তারপরই কোভিড মহামারীর লকআউটের সময় রাত্রে ঘুমের মধ্যেই একদিন চলে যায়। সারা ভারত অবরুদ্ধ থাকায় স্ত্রী-পুত্রেরা আসতে পারেনি যান চলাচলের অভাবে। অনেক অনুরোধ-উপরোধ ও তদ্বির সত্ত্বেও ওর মরদেহটা বন্ধুদের হাতে তুলে দেননি কর্তৃপক্ষ। অসহায়ের মতো দেখতে হল বেওয়ারিশ লাশ হয়েই মলয়ের অন্তিম যাত্রার শেষ।

কি মর্মান্তিক পরিণতি জীবনের – অতিবড় শত্রুর ও যেন এই দশা না হয়।

 

******

মৃণ্ময় গাঙুলী (ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন)
– স্মৃতিচারণে চব্দন গুহ

মৃণ্ময় আর আমি বেলঘরিয়ার একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমি ক্লাস ফাইভ থেকে আর মৃণ্ময় এক বার ক্লাস এইট,পরে টেন ও ইলেভেনে পড়েছিল । মৃণ্ময়ের বাবা ও ক্লাস নাইনে পড়ার সময় কল্যাণীতে নতুন বাড়ি বানিয়ে চলে যান,ফলে আমাদের স্কুল থেকে এই সাময়িক বিরতি ছিল।এত দীর্ঘ দিনের বন্ধুর সম্পর্কে কিছু মনে করে লেখা বেশ কষ্টকর,বয়সের তো গাছ পাথর গজিয়ে গেছে,স্মরণ শক্তি বেশ বিশ্বাস ঘাতক হয়ে গেছে।এলোমেলো যা মনে আসছে তাই লিখে দিলাম, অসীম ছাপবে কি না জানি না।
সেই জয়েন্টের প্রস্তুতির থেকে ১৩নম্বর হস্টেলের ৬নম্বর রুমের সফর বেশ জমে ছিল। তারপর আরও তিন বছর একই সাথে একই রুমে থাকা,ফাইনাল ইয়ারে ম্যাকডোনাল্ড হস্টেলের পাশের ঘরে থাকতে থাকতে দু’জন দু’জন কে এত জেনেছি ,কার কি পছন্দ অপছন্দ ছিল সব জেনেছি, like the fingers of the palm!
মৃণ্ময় লেখা পড়ায় আমার মত অষ্টরম্ভা ছিল না,বেশ ভাল ছাত্র ছিল।আড্ডা মারার বিষয়ে দুজনে একই মানদন্ড ফলো করতাম।
হস্টেলে কিছুদিন পরে মৃণ্ময়ের নাম হয়েছিল জকি, বন্ধুদের পেস্ট, সাবান, তেল সহজে নিঃসঙ্কোচে ব্যবহার করার সহজাত ক্ষমতার জন্য ঐ উপাধি পেয়েছিল।
হস্টেলে মৃণ্ময়ের জক মারার নাম বা বদনাম যাই থাকুক, ওর কল্যাণীর বাড়ি গিয়ে চমৎকার আতিথিয়তার পরিচয় পেয়েছিলাম। একবার পূজোর পর বিজয়া করতে কল্যাণীতে যাবার আদেশ হলো।আমি একজন স্কুলের বন্ধু নিয়ে বিকেলে ওর বাড়ি গিয়ে দেখি ওর বাবা মা ছোট ভাই কেউ নেই,মামার বাড়িতে গেছেন।মৃণ্ময় ও মেঝ ভাই ছিল। মৃণ্ময় বলেছিল, সব সরঞ্জাম আছে, লুচি,আলুর দম বানিয়ে খাওয়া যাক।শুরু হলো আমাদের রান্নার ভেঞ্চার।ময়দা মেখে,ডালডা বনস্পতিতে ভেঁজে যে লুচি হয়েছিল সেগুলো শক্ত শক্ত বাকরখানির মতো লেগেছিল। সেই বিখ্যাত লুচি খাওয়ার কথা এখনও মনে পড়ে।
খাবার কথায় হস্টেলের গ্রান্ড ফিস্টের কথা মনে পড়ে।আমরা সবাই মাসে একটা ফিস্টের জন্য খুব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এই রকম একটা ফিস্টের এক দিন আগে বেচারা মৃণ্ময়ের খুব জ্বর হয়েছিল,যা ফিস্টের দিনেও কমে নি।রাতে যখন আমরা দল বেঁধে ডাইনিং হলে যাচ্ছিলাম খেতে আর মৃণ্ময়ের জন্য দুধ রুটি পাঠাতে তখন ও বলেছিল ওর জন্য চারটে পরোটা আর এক বাটি মাংস যেন বড় ঠাকুর কে বলে পাঠাই।জ্বরে এই খাবার!সুস্থ থাকলে কি খেত?
খাবার পর একটা সিগারেট হলে কেমন হয়?ফিস্টের পর আমাদের একটা করে 555 ব্রান্ডের সিগারেট প্রাপ্তি হতো,যে খেত না,তার অংশ পাওয়ার লাইন বেশ লম্বা হতো।
মৃণ্ময় কলেজে স্পোর্টস এ কোন দিন অংশ গ্রহণ করে নি,কিন্ত কিছু স্পোর্টস এ রুচি রাখতো,যেমন ওয়াকিং। 1952 সালের অলিম্পিক5000,10,000 আর ম্যারাথন চ্যাম্পিয়ন এমিল জেটিপেকের ভক্ত ছিল। রোজ লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতো।ফোর্থ ইয়ারে পড়ার সময় একদিন হঠাৎ
ঘোষনা করলো যে ও হাওড়া থেকে কল্যাণী পায়ে হেঁটে যাবে।
সবাই প্রথমে পাগলের প্রলাপ বলেছিল। পরে এক শনিবার সত্যিই ও আমাদের সাথে লাঞ্চের পর হাওড়া পর্যন্ত বাসে গিয়ে হাঁটা দিয়েছিল 63 কিমি দূরের কল্যাণীর উদ্দেশ্যে। তখন মোবাইল ছিল না ,কোথায় কখন পৌঁছল জানা সম্ভব হয় নি। সোমবার হস্টেল পৌঁছে সব জেনেছিলাম। রাত নটার পর বাড়ি পৌঁছে গরম জলে পা ডুবিয়ে আরাম করেছিল।
আজ এত বছর পরে এই সব ছোট ছোট জিনিস নিয়ে আনন্দ বা মনোমালিন্য হবার কথা মনে পড়লে বেশ ভাবুক করে তোলে।

পাশ করে যে যার চাকরি স্থলে চলে যাই।আমি ধানবাদে কয়লার কালি মাখি, মৃণ্ময় সেই কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো এনটি পি সির বদরপুরে। চিঠিপত্র লিখে যোগাযোগ চলতো।ওর বিয়েতে বরযাত্রী হবার অনুরোধ করেছিল। যেতে হবে বালি,হাওড়ায়।আমি বেলঘরিয়া থেকে সোজা বালি পৌঁছে দেখি মৃণ্ময় ও বরকর্তা বাদে তখনও কেউ বালি পৌঁছয় নি।অত দূর থেকে রাত নটার আগে কেউ পৌঁছতে পারে নি।বিয়ের আসরের ছোট্ট একটা মজার ঘটনা এখনও মনে পড়ে।আজীবন সাদাসিধে পোষাক পরা মৃণ্ময় ,বিয়ের আসরে সিল্ককের পাঞ্জাবী না পড়ে আদ্দির পোষাক পড়েছিল। এক মহিলা বর কোথায় বর কোথায় বলতে বলতে ঘরে ঢুকে এদিক সেদিক খুঁজছেন দেখে মৃণ্ময় স্মার্টলি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “এই তো আমি বর”।মহিলার তো বিশ্বাস হয় না,মৃণ্ময় তার কপালের চন্দন ফোটা দেখালে ঐ মহিলা,জিভ কেটে ,”ও মা” বলে চম্পট দেন।
রাতে বিয়ের পর মৃণ্ময় আসর জমিয়ে রেখে প্রমাণ করেছিল সাজ পোষাক সব সময় মুখ্য নয়,সপ্রতিভতা বেশি জরুরী।
বিয়ের পর সবাই সংসার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়।খবর পেতাম মৃণ্ময় দিল্লির চাকরি পরিবর্তন করে মালয়েশিয়ার এক কোম্পানিতে জয়েন করেছে।বেশ কিছু বছর পর আবার শুনলাম যে মৃণ্ময় ব্যাঙ্গালোরের টি সি এস এ জয়েন করেছে।ওর স্ত্রীও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার, একই কোম্পানির অফিসার। দু’জনের সংসার এক পুত্র ও কন্যায় আনন্দে ভরপুর। ততদিনে মোবাইল ফোনের দৌলতে যোগাযোগ সহজ হয়ে গেছে।ফোনে কথা হতো,সুপ্রীয়র সাথেও কথা হতো।ইতিমধ্যে মৃণ্ময়ের চেহারায় বেশ ভারিক্কি ভাব এসেছিল। পরে বেশ অসুস্থ হয়েছিল। একদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর ফোন করলে ওর স্ত্রী সুরভী বলেছিল,মৃণ্ময় ঘুমিয়ে পড়েছে।মৃণ্ময়ের শরীর যে ভাল চলছিল না,এই অসময়ে ঘুম থেকে বুঝেছিলাম। তারপর একদিন জুলাই মাসে বিষন্ন বৃষ্টির দিন বিকেলে সুরভী আরও বিষন্ন খবর দিলো,মৃণ্ময় চির নিদ্রার জগতে চলে গেছে। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু অসময়ে বিদায় নিলো।
এই ঘটনার আট মাস পরে একদিন আবার সুরভীর ফোন এলো,এবার একটু ভাল খবর ছিল। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে,কোলকাতায় বিয়ে হবে,আমি যেন অবশ্যই যাই।সম্মতি জানাই।
ফাল্গুন মাসের এক পূর্ণিমার রাতে,ঘরের উজ্জ্বল আলোর মধ্যে সুসজ্জিত বিয়ের আসরে বসা মৃণ্ময়ের সুন্দরী হাসিমুখ কন্যাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ওদের জীবন থেকে সব আনন্দ নিঃশেষ হয় নি।মা ও দাদার স্নেহে বেড়ে ওঠা মৃণ্ময়ের মেয়ের মাথায় মৃণ্ময়ের অশেষ আশীর্বাদও আছে। আজ এক দশকের বেশি সময় মৃণ্ময় আমাদের মাঝে নেই কিন্ত ওর স্মৃতি আজও অমলিন আছে আরও দীর্ঘদিন থাকবে।

“গুণানেতানতীত্য ত্রীণ্ দেহী দেহসমুদ্ভবান।
জন্ম মৃত্যু জরা দুঃখৈ বিমুক্তোহমৃত মশ্নুতে”।।

 

******

সাগর দাশগুপ্ত, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং 
– স্মৃতিচারণে সোহম দাশগুপ্ত

সেই উত্তাল সত্তরের দশক, সেই কলেজের যৌবনোচ্ছল দিনগুলো মনে পড়লেই স্মৃতির মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে বৃষ্টি নামে। হঠাতই যেন বড় একা হয়ে যাই। লক্ষ লক্ষ অশ্বারোহীর মত ধেয়ে আসা বৃষ্টি ফোঁটায় প্রান্তরের মাঝখানে নিঃসঙ্গ গাছটার মত আশরীর ভিজতে থাকি। আজ ঠিক ঐ সময়টার ঘনিষ্ট বন্ধু সাগরের স্মৃতিচারণ করতে বসে ফের সেই একই অবস্থা।
প্রথম দিন তল্পিতল্পা নিয়ে ডাউনিং হোস্টেলে পা দিয়ে জানতে পারলাম পূবদিকের একতলায়, এগারো নম্বর ঘরে আমার ঠাঁই হয়েছে। তিনজন দাশগুপ্ত আর একজন দাশশর্মা নিয়ে আমরা চারজন। প্রথম দিনে র‍্যাগিংএর ফাঁকে ফাঁকেই হাল্কা আলাপ হল। কলেজে পা দিয়েই মনে হয়েছিলো এমন মেধাবী মহলে আমার পদার্পণ নিছকই এক বিশাল অঘটন! রুমমেটদের, বিশেষ করে সজলের, গম্ভীর এবং পরিশীলিত আলাপচারিতায় সে ধারণা আরও গভীর হল। তার ওপরে আবার গৌরাঙ্গ তার ট্রাঙ্কখানা খুলতেই দেখি সবার উপরে একটা দাস মুখার্জীর ক্যালকুলাস বই। ব্যাস, এবার আমার ধারণা একেবারে বদ্ধমূল হয়ে গেল! বুঝলাম এহেন জায়গায় আমার মত সাধারণ মেধার ছেলের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কি আর করা, পালানোর কোন উপায় নেই। তাই এমন জ্যোতিষ্ক খচিত পরিমন্ডলে কি ভাবে মানসম্মান নিয়ে টিঁকে থাকবো, সেই দুশ্চিন্তায় সিঁটিয়ে রইলাম। ঠিক পরদিনই কপালক্রমে নতুন একজনের সাথে আলাপ হতে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া গেল।
বৃদ্ধ ব্যারাক সার্ভেন্ট শুখাদার কাছ থেকে লুচি-হালুয়া গোছের কোনো খাবার নিয়ে ঘরে ফিরছি, হঠাতই কেউ কাঁধে হাত রাখল।
– গুরু, কি নাম তোর?
ফিরে দেখি, ছোটোখাটো চেহারা, একমাথা কোঁকড়া চুল আর দু’টো উজ্জ্বল, ঝকঝকে চোখ! নিজেই আবার বলে উঠলো-
– আমি সাগর; সাগর দাশগুপ্ত, ইলেক্ট্রিকাল।
– আমি সোহম দাশগুপ্ত। আমিও ইলেক্ট্রিকাল।
– বাঃ, তুইও বদ্যি! পড়াশোনা ছাড়া আর কি করিস? মানে কোনো হবি আছে, খেলাধূলা, গল্পের বই, প্রেম?
হবির মধ্যে প্রেম শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেও সাগরের সটান চাউনি, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা আর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাঁসিটা দেখে আশ্বস্তও হলাম। একটু স্মার্ট সেজে জবাব দিলাম-
– হ্যঁ, খেলা, গল্পের বই, তবে ঐ প্রেমটা বাদ।
– ব্যাস, ব্যাস, আপাততঃ ওতেই চলবে, আর প্রেমটাও সময় মত হয়ে যাবে।
দিনে দিনে হৃদ্যতা বাড়তে থাকল। যতদূর মনে পড়ে হোস্টেলের প্রথম দিনগুলোয় সাগরের দৌলতেই ডাউনিং ইষ্টের একতলায় আমাদের গ্রুপটা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। সেখানেই শেষ নয়, সাগরের মাধ্যমেই ওদের ব্যারাকপুরের অমিত (পালিত) আর হারাধনের সাথে আমাদের আলাপ। এমনকি সেকেন্ড ইয়ারে উঠে অঞ্জনার সাথে প্রথম পরিচয় আর বন্ধুত্বও এই সাগরেরই জন্য। আমাদের কলেজ জীবনে সিনিয়ার, জুনিয়ার বা হোস্টেল নির্বিশেষে বহু মানুষের সাথে ভাব জমাতে সাগরের জুড়ি মেলা ভার! ফলে আমাদের অন্তরঙ্গ হতেও বেশী সময় লাগলোনা। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে নিতে বেশ উত্তেজনার মধ্যেই দিন কাটছিল। তিনমাসের মাথায় হঠাতই একদিন সাগর বলল,
– গুরু, আর অন্য ঘরে কেন? মালপত্র নিয়ে আমদের দশেই চলে আয়। এই ঘরে নারায়ণ স্যান্যাল থাকতেন।
– তাই নাকি! কে বললো?
– কে আবার খোদ নারায়ণদা, এটা পড়ে দেখ।
বলতে বলতেই সাগর আমার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলো বইটার নাম “সত্যকাম”। গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। চমৎকার একটা উপন্যাসের মধ্যে চল্লিশের দশকের ডাউনিং হলের নানা তথ্য! হ্যাঁ, সেখানে “ডাউনিং টেন” এর কথা তো আছেই, তার সাথে ব্যারাক সার্ভেন্ট শুখাদার কাহিনী এমনকি তার বৃটিশ আমলের ঢাউস সাইজের চায়ের কেটলীটার কথাও রয়েছে! সবই মিলে যাচ্ছে তবু কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা! পরদিনই সরেজমিন তদন্তের জন্য শুখাদাকে পাকড়াও করলাম। নারায়ণ সান্যালের নামটা শুনে শুখাদা কয়েকমুহুর্ত আনমনা হয়ে রইলো।
– সে তো বহুদিন আগের কথা। সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়। নারায়ণবাবু ঐ দশ নম্বর ঘরেই থাকতেন। সাগরবাবুর খাটটা তখন ওনার ছিল।
– তোমার ঠিক মনে আছে?
– সে সব কথা কি ভুলতে পারি? তখন যুদ্ধ চলছে। ইংরেজ সৈন্যরা এই ডাউনিং এর ছাদে তাঁবু বানিয়েছিল।
তারপর অনেক টোল খাওয়া একটা বিশাল কালো কেটলি দেখিয়ে শুখাদা বলল-
– আমি চা বানিয়ে এই কেটলীটা করেই ওদের জন্য ছাদে নিয়ে যেতাম।
– -নারায়ণবাবুর ঘরে আর কে থাকতো?
– নারায়ণবাবুর রুমমেট ছিলেন সত্যপ্রিয়বাবু।
আর কোনো সন্দেহ রইলোনা। শুখাদার কথার সাথে “সত্যকাম”এর সমস্ত তথ্য নির্ভুল মিলে যাচ্ছে! মনে মনে ঘর বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলাম। এবার মহানন্দে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমি দশ নম্বর ঘরে সাগরের রুমমেট হয়ে গেলাম। ফার্স্ট ইয়ারের সেই দিনটা থেকে ফিফথ ইয়ারে ম্যাকডোনাল্ড হস্টেলে ঠাঁই হওয়া পর্যন্ত চার চারটে ঘটনাবহুল বছর আমরা একসাথে কাটিয়েছি।
ঘর বদলের পর থেকে আমাদের ঘনিষ্টতা গভীরতর হতে লাগল। সাগরও ছিলো বাংলা গল্প, উপন্যাসের avid reader আর রোমান্টিকতার একনিষ্ঠ পূজারী। আমরা যখন উপন্যাসের জগতে সবে তারাশংকর, সমরেশ, আশাপূর্ণা, শীর্ষেন্দুতে হাবুডুবু খাচ্ছি, ও তখন আমাদের টপকে বুদ্ধদেব বসুর “রাত ভোর বৃষ্টি”তে পৌঁছে গেছে! ওর একটাই শর্ত – কাহিনীতে রোমান্স থাকতেই হবে। স্বভাবতঃই কলেজের বয়েসে সাগরের আরেক প্রিয় লেখক ছিল বুদ্ধদেব গুহ। এহেন রোমান্টিক মানুষ সেই বয়েসে প্রেমে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সাগরের বেলাতেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। আজ ওর অবর্তমানে সে প্রসঙ্গে যেতে চাইনা। তবে রুমমেট বা সহপাঠিদের প্রেমের ব্যাপারেও সাগরের ছিল অফুরন্ত উদ্যম। আমাদের ষোলো নম্বরের বন্ধুদের গ্রুপেই শুধু নয়, অন্যান্য হোস্টেলের কোনো সহপাঠির প্রেমের ব্যাপারেও স্বতস্ফুর্ত পরামর্শ বা সাহায্য দানে সাগর ছিল কল্পতরু। শুধু হোস্টেলেই নয়, ধর্মতলায় সিনেমা দেখা, অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখা, মনুমেন্টের নীচে প্রেম করা, এমনকি বৃষ্টির মধ্যে সারারাত লাইন দিয়ে ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগান খেলার টিকিট কাটার মত সব কীর্তিকলাপেই সাগর ছিল পুরোভাগে!
আসলে ও ছিল সহজাত ভাবেই একজন আদর্শ “টিমম্যান”। নিজে বিশাল বড় খেলোয়াড় না হলেও খেলার মাঠে পর্যন্ত ওর উদ্দীপনার সীমা ছিলোনা। ফার্স্ট ইয়ারে ডাউনিং এর চত্ত্বরে ভলিবল খেলা থেকে শুরু করে পরে সাহেবপাড়ায় লর্ডসের মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলা পর্যন্ত সাগর ছিল আমাদের প্রধান উদ্যোক্তা। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। ফিফথ ইয়ারে ইন্টার হোস্টেল ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রস্তুতির সময় সাগর নিজেই ঘোষণা করল- ও হবে টিমের ম্যানেজার। সবাই এককথায় রাজী হয়ে যেতে সাগর তুমুল উৎসাহে টিম তৈরী করতে বসে গেল। টুর্নামেন্ট শুরু হল, টুক টুক করে আমরা ফাইনালেও পৌঁছে গেলাম। এবার প্রতিপক্ষ উলফেন্ডান। সে আমলে কলেজের পাওয়ার সেন্টারও বলা যায়। ওদের দলটাও প্রায় সেই সময়ের কলেজ টিম। সাগর ক’দিন আগে থেকে শুধু টিমের প্র্যাক্টিস করানোই নয়, সবার খাওয়াদাওয়া, ঘুমের টাইমও বেঁধে দিল। ঐ ক’দিন ওর চোখেমুখে যে সিরিয়াসনেস তা ডার্বির আগে অমল দত্ত বা পিকে ব্যানার্জীর চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নয়! অবশেষে খেলার দিন ওভালে পৌঁছে দেখি সারা কলেজের ছেলেপুলে এসে ভিড় জমিয়েছে। উলফের কর্মকর্তারা সকালে কালিঘাটে পুজো দিয়ে কপালে সিঁদুর লাগিয়ে হাজির। টানটান উত্তেজনার মধ্যে খেলা শুরু হল, ঘটনাচক্রে আমরা ৩-০ গোলে জিতলাম। সাগর সেদিন মাঠে নেমে খেলেনি বটে, কিন্তু উলফেন্ডানের বিরুদ্ধে আমাদের ঐ নাটকীয় জয়ের পেছনে ওর টিমম্যানশিপ ও আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়।
এমন একটা মানুষ পাশ করার পর কোন অজানা কারণে আমাদের সবার থেকে নিজেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে নিল, তা আমাদের ঘনিষ্ট মহলে আজও রহস্য! কলেজ ছাড়ার পর চাকরীতে থিতু হওয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটা মাস আমরা প্রায় সমস্ত সহপাঠিই কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। পরে যখন নতুন যোগাযোগ শুরু হল, তখন আর সাগরের খোঁজ পেলাম না। দু-একবার আকষ্মিক ভাবে দেখাও হয়েছে, কিন্তু সে যেন এক অপরিচিত সাগর! শুধু জেনেছিলাম, ও খোসলা কম্প্রেসারে জয়েন করেছে। শুনেছি কয়েক বছর বাদে ও চাকরী সূত্রে চেন্নাই চলে যায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ, ততোদিনে বন্ধুদের আড্ডায় সাগরকে মিস করাটা আমাদের সয়ে গেছে। তাই বহুদিন বাদে ওর এক সহকর্মীর কাছে যখন ওর মৃত্যু সংবাদটা পেলাম, তখন আর ওকে নতুন করে মিস করার অবকাশ ছিলনা! শুনেছি চাকরীর কাজেই দিল্লীতে গিয়ে কোনো হোটেলে উঠেছিল। সেখানেই রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ও এই পৃথিবী ছেড়ে যায়।
বহুদিন হল সাগর আমাদের মধ্যে নেই। ইতিমধ্যে আমাদের বয়েস বেড়ে চলেছে, কিন্তু সাগরের বয়েস আর বাড়েনি। তাই আজ স্মৃতির অঝোর ধারায় ভিজতে ভিজতে ওর সেই পুরোনো মুখটাই মনে পড়ে

 

******

সৌমিত্র লাহিড়ী (রবি’দা)
– স্মৃতিচারণে সুমন্ত চৌধুরী, অব্যয় মিত্র, উত্তম খান, অমিয় মল্লিক

আমি, অমিয় মল্লিক ওঁর রুমমেট ছিলাম, চার বছর এক সাথে পাশাপাশি বেডেই থাকতাম। ওঁকে খুবই কাছে থেকে দেখেছি, আর অনেক কিছুই শিখেছি।
সবার আগে বলবো, রবি’দার ছিলো সুশৃঙ্খল স্বভাব, যা হস্টেল জীবনে খুবই বিরল। ছিলো আদ্যন্ত একজন ভদ্রলোক। বেশভূষার কথা বললে ও সবসময় ইস্ত্রী করা জামাকাপড়ে টিপটপ থাকতো। প্রথম দিকে, সপ্তাহের মাঝে রবি’দার বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক দুপুরের খাওয়ার সময় কাচা ইস্ত্রি করা জামা প‍্যান্ট, এমনকি অনেক সময় বড় টিফিন ক‍্যারিয়ার করে খাবারও দিয়ে যেতো।
রবি’দা ছিলো সঙ্গীতপ্রেমী। রবীন্দ্র সঙ্গীতের, বিশেষ করে দেবব্রতের (জর্জ বিশ্বাস খুব ভক্ত ছিল। কিছু টাকা পকেট মানি থেকে বাঁচলে, সোজা এসপ্ল্যানেড চলে যেতো দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ড কেনার জন্য। জর্জ দার রেকর্ডসের এক অপূর্ব সংকলন ছিলওঁর কাছে। আমাদের ব্যাচের সুমন্তের স্ত্রী সঞ্চিতার গানেরও খুবই গুণগ্রাহী ছিল।
আর ছিলো বই এর সাথে প্রেম। P. G. Wodehouse এর লেখা কমিক নভেল সিরিজ পড়তে খুব ভালোবাসতো। ওর কাছ থেকেই নিয়ে প্রথম আমি Jeeves সিরিজ পড়ি।
ডন বস্কো স্কুলে সুমন্ত, রবি’দা আর অমৃতাভ (রয়, মেটালার্জি) ছিলো খুবই কাছের বন্ধু। তিন জন একই কলেজে ভর্তি হলেও হোস্টেল আলাদা আলাদা হওয়ার জন্য ও পরবর্তী সময়ে প্রফেশনাল কারণে সামনাসামনি যোগাযোগ অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু দূরে থেকেও বন্ধুত্ব আগের মতই বজায় ছিল। আমি (সুমন্ত) ওর পাইকপাড়ার বাড়িতে বহুবার গেছি। রবিদাও সস্ত্রীক আমার বিয়ের এনিভর্সারিতে রাজারহাটে এসেছিলো।
ফার্স্ট ইয়ারে ১৩ নম্বর হোষ্টেলের চারতলায় সব মার্কামারা ছেলেদের মধ্যে রবি’দা ছিলো কিছুটা স্বতন্ত্র। একটু আগেই বলা হয়েছে, সে ছিলো জেন্টলম্যান। অন্যদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন প্রকৃতির। এমনকি হোষ্টেলের খাবারও অনেক সময় ওঁর মুখে রুচতো না। হোষ্টেলে এসে এই সমস্যা অনেকেরই হয়েছিলো, কিন্তু পরে বাধ‍্য হয়ে সবাই এসবের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়। কিন্তু রবি’দার সমস্যা রয়েই গেলো।
একদিন রবি’দার বিশ্বস্ত কাজের লোক জামাকাপড় আর টিফিন নিয়ে আসতে দেরী করে। আর ওদিকে রবি’দা ক্লাসে চলে যায়। তখন রোজই হস্টেলের কেউ না কেউ দুপুরের ক্লাস কামাই করতো। সেইদিন রবি’দার ঘরে তালা। আর সেই লোকটি এসে রবি’দার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা তখন সেই লোকটিকে আপ‍্যায়ন করে একটা ঘরে বসাই। বলি, রবি’দা তোমার আসার কথা বলে গেছে। তখন লোকটি আমাদের বিশ্বাস করে যা যা এনেছিলো, আমাদেরকে দিয়ে চলে যায়। জামা প‍্যান্ট আমরা নিয়ে গুছিয়ে রেখে দি। এরপর টিফিন ক‍্যারিয়ার খুলে দেখি, বেশ অনেকগুলো লুচি, বেগুন ভাজা, আলুর দম, আর সন্দেশ। আমরা বললাম ও বলে গেছে, যে ওঁর শরীরটা ভালো নেই, তাই আমরা যেন কিছুটা খেয়ে ওঁর জন্য অল্প রেখে দি। সেই দলে সম্ভবত শ্রীদীপ, দৈত‍্য, গাগা, বানু, মেশোও ছিলো। আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খেয়ে আর আগান্তুককেও জোর করে একটা লুচি ও আলুর দম খাইয়ে, খাতির করে সিঁড়ি অবধি পৌঁছে বলে ছিলাম, যে বাড়িতে শরীর খারাপের কথা যে সে না জানায়। এও জানিয়ে দিলাম যে দাদা সব ঠিক ঠাক পেয়ে যাবে।
এবার বিকেলের দিকে সবাই বারান্দা থেকে দেখছি, কখন রবিদা আসছে। দূর থেকে রবি’দাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে যে যার ঘরে। ওর ঘরের বাইরে বারান্দায় একটা টেবিলের উপর জামা প‍্যান্ট আর টিফিন ক‍্যারিয়ারের ভেতর একটা লুচি আর একটু আলুর দম রাখা ছিলো। উঁকি মেরে দেখলাম, রবি’দা তালা খুলে বেশ প্রসন্ন চিত্তে, সব নিয়ে ঘরে ঢুকলো। এর কয়েক মিনিট পরেই চিৎকার করে ঘরের বাইরে এসে বলতে লাগলো সব বাঁদর আর জন্তুর দল। কে কে করছে জানতে চাই? বাড়িতে খেতে দেয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সবই খুব ভদ্র সম্বোধন, অশ্লীল কথা ওর মুখ থেকে বেরতো না।
ফল স্বরূপ, এরপর আর কোনদিন খাবার আর জামা-প‍্যান্ট এলো না।

১৩নং হোস্টেলের সেই “রক্তচোষা দিন”টায় আমরা সেই রাত্রিতে ধর্মতলা থেকে নাইট’শো সিনেমা দেখে হোস্টেলে ফিরে রাতে কোনমতে আধপেটা খেয়ে ৪ তলায় আমাদের ঘরে ঢোকার আগে দেখি ভালো ছেলের দল, যেমন রবিদা, লেবু এরা যথারীতি ঘুমিয়ে পরেছে। তখন আমি, শ্রীদীপ, অরূপ সবাই মিলে ওদের ঘরের দরজার ওপর দমাদ্দম আওয়াজ করে যে যার ঘরে পালিয়ে গেলাম। রবিদা ঘুম ভেঙ্গে উঠে দরজা খুলে কাউকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক দেখছে, এই সময় গাগা হঠাৎ বললো আমি তো দরজায় ধাক্কা মারিনি। উঠে বাইরে বেরিয়ে দেখি রবিদা চিৎকার করে বলে ওঠে “গাগা আমি তোর রক্ত চুষে খাবো”, ইত্যাদি।
ঘটনাক্রমে ২০২০ ডিসেম্বরে কলেজের মাঠে আমাদের শেষ মিটে এই কথাটি নিয়ে রবিদার সাথে আলাপ করায়, রবিদা উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে বলেছিলো, আরে ওই সময়টাই তো আমাদের জীবনের এক স্মরনীয় ইতিহাস।

কর্মজীবনে রবি’দা অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানির কল্যাণীর বেলটিং ডিভিশনে ছিলো। মাঝে একসময় ও দুবাইতেও পোস্টেড ছিলো। কল্যাণীর অ্যান্ড্রু ইউল এর বেলটিং ডিভিশনের ফ্যাক্টরিতে অনেক কিছু ইনোভেটিভ ইঞ্জিনিয়ারিং আইডিয়ার সার্থক রুপকার আমাদের রবি’দা। কিন্তু এরপর কল্যাণীর ফ্যাক্টরি বিক্রি হয়ে যাওয়ায় খুবই মানসিক কষ্ট পায়। কেন জানি না, সব বিষয়ে রবিদা ধীরে ধীরে নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করে দিলো। স্কুল লাইফে রবি’দাকে যেরকম এক্টিভ দেখা গেছে, বিভিন্ন বিষয়ে এত এনার্জেটিক, সেই রবি’দাই আস্তে আস্তে কম বয়সেই কেমন যেন নিষ্প্রভ ও উদাসীন হয়ে গেলো।
বন্ধুদের মধ্যে ও বড় অভিমানী ছিল। বোধহয় এই জীবন সম্বন্ধে অকাল নির্লিপ্ততা ওকে বড় তাড়াতাড়িই অন্য জগৎ-এ নিয়ে গেলো। আমার নিজেকেও আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না ।
রবি’দা খুব হাসছিস,তাই না? ক্ষমা করে দিস। যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস।
ওম শান্তি, ওম শান্তি, ওম শান্তি।

*******

সহদেব সাধুখাঁ, (ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন)
– স্মৃতিচারণে সন্দীপ রুদ্র

ফার্স্ট ইয়ারে কলেজে প্রথম হস্টেলে যাওয়ার দিনে আমি একাই গিয়েছিলাম। পৌছেছিলাম একটু দেরীতে। ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নাবিয়ে একেসি (আনারকলি) স্যারের থেকে ঘরের নম্বর জেনে দোতলায় এসে ঘরে ঢুকে দেখি আমার আগেই বাকী তিনজন এসে গেছে, তাঁদের বাবা /মা / দাদাদের সঙ্গে নিয়ে। বিছানাও পাতা সারা। দেখলুম বারান্দার দিকের জানলার ধারে আমার যে রুমমেট তাঁকে তার মা হরলিক্স গুলে দিচ্ছেন। একটু অবাকই হলুম। কারণ আমার দাদা বি ই কলেজের। তাছাড়াও অনেক ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয়স্বজন থাকায়, হস্টেল জীবন সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এটা একটু অন্যরকম মনে হল। দেখলুম আশপাশ থেকে দাদারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। প্রমাদ গুনলুম।
বাড়ির লোকেরা চলে যেতেই দাদারা ভিড় করলেন। আলাপের শুরুতেই নাম, ধাম, স্কুল ইত্যাদি হরেক প্রশ্ন। জানলুম ওই রুমমেটের নাম সহদেব সাধুখাঁ। পারিবারিক ব্যবসা। শ্যাওড়াফুলির ছেলে। রোগা লম্বা সহদেবকে দাদারা জিজ্ঞেস করলেন, “খেলাধুলা কর?” সহদেব জানালো, সে ফুটবল খেলে। “কার সমর্থক?” – মোহনবাগান। “কোন পোজিশান এ খেল?” – লেফট ইন। পরের প্রশ্ন, “চুনী কি পোজিশানে খেলত জানো?” সহদেব নিরুত্তর।
“রুবি পান্না এরা কি খেলত জানো?” নো উত্তর।
ব্যাস। এর পরই শাস্তি। টেবিলের তলা দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া। আর চেরাপুঞ্জি তে ওঠা।
নিপাট ভালমানুষ, মিতভাষী সহদেব ছিল খুব ভাল এক সাদাসিধে ছেলে। প্রতি সন্ধ্যায় খুব মনোযোগ দিয়ে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসত। ওর দেখাদেখি প্রথম প্রথম আমরাও কয়েকদিন চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলুম। সহদেবের ক্যালকুলাস আর ইন্টিগ্রেশন এর সলভ করা অঙ্কের খাতার প্রচুর চাহিদা ছিল। আমাকেও প্রচুর সাহায্য করেছে।
হস্টেল থেকে আমরা সবাই ওর শ্যাওড়াফুলির বাড়িও গেছি। বাড়িটা প্ল্যাটফর্ম ধরে এগিয়ে গেলেই সামনেই পড়ত।
থার্ড ইয়ারে ও রিচার্ডসন হস্টেলে চলে গেলেও বন্ধুত্ব অটুট ছিল।
পাস করার কিছুদিন বাদে হঠাই ও চলে গেলো।
যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক।

*******

অমিতাভ সাহা (ঘুম) (সিভিল)
– স্মৃতিচারণে সন্দীপ রুদ্র

ফার্স্ট ইয়ারে তপেন মৌলিক স্যারের অঙ্কের ক্লাস, ভোরের দিকে ছিল। স্যার রোল কল করছেন। ছেলেরা এটেনডেন্স দিচ্ছে। হঠাৎই বলে উঠিলেন – অমিতাভ সাহা??? ঘুম চোখে ধড়ফড়িয়ে উঠে অমিতাভ বললো, ইয়েস স্যার। স্যার বললেন “জেগে ঘুমচ্ছিলে না কি?” ব্যাস!! আমার রুমমেটের নাম হয়ে গেলো ঘুম। ঘুমপ্যাগের সদস্য।
ছোটখাট চেহারার প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা ঘুম – এক অসম্ভব কোমল মনের মানুষ এবং ততটাই আদর্শবান ও সময়ে সময়ে একগুঁয়ে। ভবিষ্যৎ জীবনে এই চারিত্রিক ব্যাবহার ওকে অনেক অনেক মাসুল গুনিয়েছে। তা পরে বলছি।
খিদিরপুরের সেন্ট তমাসের ছাত্র, কিন্তু সে যে ইংরাজি মিডিয়ামে পড়েছে সেটা কথাবার্তা বা ব্যাবহারে বোঝা যেত না। ১৩ নম্বর হস্টেলের ঘরে সময় কাটত কম। এরপর আমরা ১৫ নম্বর হস্টেলে এলাম। ওর নতুন রুমমেট মলয় রায়। বর্ষার দিনে লর্ডসের মাঠের পিচ্ছিল ঘাসের উপর ফুটবল খেলা আর ওর ওই ছোট্ট শরীর দিয়ে এক্রোব্যাটিক স্লাইডিং ট্যাকল আমার মনে গেঁথে আছে। রাজেশ খান্নার ফ্যান, চুটিয়ে হিন্দী আর বাংলা সিনেমা – লিপি, ঝর্ণা, অলকায় এমনকি এসপ্ল্যানেডে এসে মেট্রো, গ্লোব বা লাইট হাউসে ইংরাজি সিনেমা দেখে, আমিনিয়ার বিরিয়ানি / নিজামের শিক কাবাব / বাদশার এগ রোল খেয়ে, ৫৫ নম্বর বাসে হাওড়া আসা। আবার অনেকদিন রাতের বেলায় হাওড়া ময়দান থেকে হেঁটে মাঝরাতে কলেজ ফেরার স্মৃতিও আজ অমলিন। বিনাকা গীতমালার আমীন সাহানির কথা নকল করে বলা ওর সহজাত মজা করার অঙ্গ ছিল। প্রচুর সিনেমার গান মুখস্থ ছিলো, তাই অন্তাক্ষরীতে ওকে পার্টনার পাওয়া ভাগ্যের ছিল।
বাড়ির কথা বলতে হলে ঘুমের মামার বাড়ি বামপন্থী পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করত। ওর মামা ছিলেন উত্তরবঙ্গের বামমহলে পরিচিত ও শ্রদ্ধেও।
বাবা আর জি করের নামী ডাক্তার৷ কোনদিন প্রাইভেট প্রাক্টিস করেন নি। বাড়িতে রোগী এলে বিনা পয়সায় পরামর্শ দিতেন। মা কাজ করতেন স্বাস্থ্য বিভাগে।
পাশ করার পর ঘুম দুর্গাপুরে কেন্দীয় সরকারের (নাম নিচ্ছি না) প্রতিষ্ঠানে জয়েন করার দু’বছরের মধ্যেই দাদা ওঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনলেন। কারণ ইন্সট্রাকশন এর ইন্সপেকশন এর সময় ভুয়ো বিল না সই করায়, ওকে সোজাসুজি হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে জনমনিষ্যি শূন্য ফাঁকা মাঠে পিটিয়ে মেরে বডি ফেলে দেওয়া হবে।
ফিরে রাজ্য সরকারী দফতরে কাজ নিল। ডিপার্টমেন্টের নাম এবারও নিচ্ছি না। কিন্তু একই সমস্যা। নানান জায়গায় বদলি হচ্ছিল। এডমিনিস্ট্রেশনেও গেল। সেখানে ড্রাইভার, পিওনদের অনায্য ওভারটাইমে সই না করা, তাদের সময় মত অফিসে না আসা ইত্যাদি নানান বিষয়ে তাদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হল। তারা উল্টে অসহযোগ শুরু করল। ইতিমধ্যে ওর শরীর ভাঙতে শুরু করে। হার্ট এর সমস্যা শুরু হয়। ড্রাইভার ডিউটি দিতে অস্বীকার করায় সব কাজ নিজেকে হেঁটে করতে হত। পিওন জল পর্যন্ত দিত না। নিজেকেই নিতে হত। ক্রমাগত অফিসের চাপে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসার খরচ বাড়তে থাকে। দুর্বল শরীরেও দৃঢ়চরিত্রের ঘুমকে কখনও ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। ওঁর এত চেনাপরিচিত থাকা সত্বেও কোন সুরাহা হয়নি। মাঝখানে উত্তরবঙ্গে কাজের খারাপ মানের ওপর স্থানীয় কাগজে ইন্টারভিউ দেওয়ায় ডিপাররমেন্টাল এনকোয়ারী শুরু হয়। সরকারি কাজের ট্যুরের টি এ / ডিএ বন্ধ হয়ে যায়। চীফ ইঞ্জিনিয়ার হওয়া আটকে যায়। অথচ কাজের জন্য ট্যুর বন্ধ নয়। নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে ট্যুরে গেছে, যার টাকা পেতে বছর বছর অপেক্ষা করেছে। অবস্থা পাল্টানোর কিছু চেষ্টা করা যে হয় নি তা নয়। তবে ঘুঘুর বাসায় তা নিষ্ফল হয়েছিল।
ভগ্নস্বাস্থে ওর একমাত্র সম্বল ছিল রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের স্বাস্থ্যর জন্য সরকারী স্কীম। যত দেরীই হোক কয়েকবছর পর খরচের টাকা ওর পরিবার পেয়ে গেছে ।
আজ বেশ কয়েকবছর হলো ঘুম নেই। চারিদিকে দেখে মনে হয় আজ ও থাকলে – এই অনাচার আর অসাম্য দেখলে ও কি ভাবত বা বলত কে জানে!!
ওর নিজের ঘুম কি আসত ঘুমপ্যাগের সদস্যের?

******

সলিল মোহন সাহা (সিভিল)
– স্মৃতিচারণে সন্দীপ রুদ্র

তখন সদ্য কয়েকদিন ক্লাস হয়েছে। ডিপার্টমেন্টাল ফেশার ওয়েলকাম। ফার্স্ট ইয়ারে আমি সিভিল এ ছিলুম। সেদিন দাদারা আমাদের ১৩ নম্বর হস্টেলের লম্বা, রাজেশ খান্না স্টাইলের চুলওয়ালা এক ছেলের হাতে একটা হাওয়াইন গীটার দিয়ে বাজাতে বলল। সে বাজাল কিন্তু জমল না। বললো আমি ইলেকট্রিক গীটার বাজাই। এতে ঠিক পারছি না। এর পরে হোস্টেলের কয়েকটা অনুষ্ঠানে সে ইলেকট্রিক গীটার বাজিয়েছে। ভালো বাজাতো। গীটারিস্ট সলিল ছিলো ওঁর একটা পরিচয়।
সেই সলিল ওই ফার্স্ট ইয়ারেই বিখ্যাত হয়েছিল ক্লাস না করার জন্য। সোমবার হস্টেলে এসে বড় জোর বুধবার অবধি ক্লাস করে দুপুরে লাঞ্চের পরেই টাটা করে বাড়ি। ওকে আটকাতে একমেবাদ্বিতীয়ম টোপ ছিল সিনেমা দেখা। তাতে বড়জোর ওই বুধবার রাতটা হোস্টেলে থাকত। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল বেলাই হাওয়া। প্রতিবার ফাইনাল পরীক্ষার এটেন্ডেন্স কম থাকায় বাড়তি ফি দিয়ে পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র পেত। ল্যাবগুলো যে কিভাবে ম্যানেজ করত তা না বললেও চলে। তবে ফোর্থ আর ফিফথ ইয়ারের সিভিলের সেশানালগুলো মিস করত খুব হিসেব করে।
ওর আরেক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল মুখস্থ করা। এমন কি অংক ও!! পরীক্ষার ঠিক আগে কয়েকজনের থেকে ইম্পরট্যান্ট চ্যাপ্টারের খাতা নিত যার থেকে অন্তত ৪/৫ টা কোয়েশ্চেন আসবেই। অনেকবার সে মাত্র ৪’টে উত্তর করেছে। কিন্তু প্রতিবারই পাশ করে গেছে।
সলিল কুমোরটুলি এলাকার নামী ব্যাবসায়ী পরিবারের ছেলে। হোসিয়ারী থেকে ফল – নানান ব্যবসায়ে সাম্রাজ্য বিস্তৃত। আমরা জানি নানান করণে ছেলেরা রাজনীতিতে যুক্ত হয়। আমার দেখা সলিলই প্রথম – যে পারিবারিক ব্যবসার কারণে ৭০/৭২ এর তৎকালীন অতিবাম রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিল। অবশ্য খুব স্বল্পদিনের মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। মেসোমশাই ওই ৭২ সালেই খোলা অফার দিয়ে রেখেছিলেন – যে যে দিন ও গদিতে বসবে তখনকার দিনে ১০০ টাকা করে পাবে। সুতরাং কেন সে ক্লাস কাট করত তা নিয়ে এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন নেই।
সলিলদের পরিবার নবদ্বীপের মোহন্ত পরিবার। ওঁদের বাড়িতে আমি দেখেছি রীতি অনুযায়ী বয়জ্যেষ্ঠরাও সলিলকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন। ওর দিদির বিয়েতে আমি দুটো জিনিষ প্রথম দেখেছিলাম। ঢাকের বাদ্য আর পোস্ত মাখা রসকদম্ব। প্রচুর জাঁকজমক হত ওদের বাড়ির বিয়েতে।
এহেন সলিলকে গ্রান্ড ভাইভায় প্রশ্ন করা হয়েছিল। এত কম ক্লাস করে প্রায় কিছুই না জেনে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে কি করবে? ওর উত্তর ছিল – ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি থাকলে ব্যাঙ্ক লোন সহজে পাওয়া যায়। ব্যাস!! তারপর আর কোন প্রশ্ন হয় নি। আর সলিল সত্যি সত্যিই পাশ করার পর হাই টেনশান লাইন ইক্যুইপমেণ্ট তৈরির কারখানা খোলার জন্য ব্যাঙ্কলোন এপ্লাই করেছিল। কিন্তু প্রজেক্ট রিপোর্ট ঠিকঠাক না থাকায় লাভ হয়নি। পরে পারিবারিক ব্যবসা শুরু করেছিল। কিন্তু সাফল্য সেভাবে কোন দিনই সলিলকে ধরা দেয় নি – কারণ সলিল কোনদিনই অন্তর থেকে ব্যবসায়ী ছিল না।
জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গ্যাছে। হার্টের প্রবলেম সলিলের ও হয়েছিল। অকালে চলে গ্যাল অনেক প্রশ্ন রেখে।
হৈ হুল্লোড় করা মজাদার এক ঝলক টাটকা বাতাস আনা সলিল।

******

 

Sahityika Admin

2 comments

  • খুব ভালো লিখেছিস সন্দীপ। তোর লেখা পড়ে পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে গেলো। ঘুম আর সলিল এই দুজনে খুবই প্রাণবন্ত মানুষ ছিলো। মনটাও খুব উদার ছিলো। ওরা যেখানেই থাক শান্তিতে থাক। 🙏

  • অসীম,
    আমার দ্বারা এসব হয় না। তবু রুমমেটদের সম্বন্ধে না লিখলে অপরাধী থাকব। তাই যা পারি লিখলুম।
    প্রয়োজন মত কিছু পরিবর্তন করতে পারিস – বিতর্কিত কিছু আংশ আছে ঘুমের ব্যাপারে। কিন্তু বিষয়টা থাকা জরুরি – ওকে বোঝার জন্য এবং ভুল না বোঝার জন্য।