বর্ষশুরু, বর্ষশেষ ও আগমনী
কল্যাণ কুমার মিত্র, ১৯৬৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রথম পর্ব
পাশ্চাত্ত দেশে বছরে দুটো আনন্দমুখর দিন, ক্রীসমাসও নিউ ইয়ার। এর সাথে আরও আছে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ইত্যাদি। প্রাচ্যের দেশগুলোতে বছরে অনেক উৎসব পালিত হয়, আমি তার সব জানি না, আমি মনে প্রাণে বাঙালী, তাই খালি বাংলার পুজোপার্বণ আর উৎসবমুখর দিনগুলোর কথাই জানি। আজকে আমার মন জুডে আছে বাংলা নববর্ষ, মাস দুয়েক আগেই চলে গেছে ইংরেজী নববর্ষ, যে ইংরেজীর প্রাক নববর্ষকে বলা হয় নিউ ইয়ার্স ইভ, যখন নবীন প্রবীন এক শ্রেণীর লোক এই সন্ধ্যাটি ড্রিংকস আর ডিনার দিয়ে উদযাপন করেন।
বাংলায় প্রাক নববর্ষের কোনো ব্যপার নেই। নববর্ষের দিন অনেকেই নতুন ধুতি বা পায়জামার ওপর সুদৃশ্য পান্জাবী চডিয়ে সন্ধ্যেবেলা বৌ ছেলেমেয়েকে নিয়ে কেউ গয়নার দোকানে, কেউ বা কাপড়ের দোকানে আসেন। ফিরে যান মিষ্টির বাক্স আর বাংলা ক্যলেন্ডার নিয়ে। আমার কিন্তু এই ব্যপারটা বড্ড সাদামাটা লাগে। তাই বাংলা প্রাক নববর্ষের সন্ধ্যায় ভাবতে বসেছি বাংলা নিউ ইয়ার্স ইভের কথা।
ইংরেজী নিউইয়ার ইভে চলে হাই পিচের মিউজিক, উদ্দাম নৃত্য, আকণ্ঠ সুরা পান। নেশার ঘোরে কোন মহিলাকে কখন যে জডিয়ে ধরেছিলাম সে পরের দিন আর মনেই পডতো না। একটা ঘটনা আজও মনে আছে। এক বন্ধু আস্টেপিস্টে মদ গিলে আউট হয়ে গিয়ে অন্য এক বন্ধুর বাড়ির বিছানায় জুতো শুদ্ধু পা তুলো ঘুমোচ্ছে। গৃহকর্তা আর গৃহকত্রীর অবস্থা তথৈবচ। কে জুতো পরে বিছানায় শুয়ে, আর কে জামাকাপড় খুলে ঘুমোচ্ছে তা লক্ষ্য করার অবস্থায় কেউ নেই। হঠাৎ ঘোর কেটে গেলো, সেই খাটে জুতো পরে শুয়ে থাকা বন্ধুকে কাজের মহিলা উঠতে বলেছে বারবার। “বাবু ড্রাইভার অনেকক্ষণ ধরে গাড়ির হর্ণ দিচ্ছে। বাবু উঠুন, রাত দুটো বেজে গেছে।“ বন্ধুটি উঠে পড়ে চিৎকার করতে লাগলো “শুয়োরের বাচ্চার কোনো সিভিক সেন্স নেই, অসময়ে গাডির হর্ণ বাজাচ্ছে, শালাকে কালই তাডাতে হবে।” আমরা ভেরি গুড ভেরি গুড বলে হাততালি দিয়েছিলাম।
যাই হোক সে কথা, আমি ইংরেজী আর বাংলা নববর্ষের কথা পাঞ্চ করে লিখতে বসেছি। ইংরেজ কবি টমাস হার্ডি এক বর্ষণসিক্ত অন্ধকারে ভগ্নহৃদয়ে জানালার কাছে বসেছিলেন। সেদিন ছিলো ইংরেজী বছরের শেষ দিন, কবির ভারাক্রান্ত হৃদয় পরাজিত সৈনিকের মতো মুহ্যমান। এমন বিবর্ণ বৎসরান্তে কবি যে শুধু বিরক্ত বোধ করেছিলেন তা নয়, তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ভয়ানক। সারা বছরের বৈচিত্রহীনতার পীডন ভাবমুখর কবিকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। আশার বাতি জ্বালিয়ে কবি বসেছিলেন সেই দিনটিতে শুভলগ্নের প্রতীক্ষায়। ভাগ্যের কি নিদারুণ পরিহাস। বরফে মাঠ ঘাট সাদা হয়ে গেছে। ঝরঝর করে বৃষ্টি। কোনো লোকজনকে দেখা যাচ্ছে না। নতুন বছরের আনন্দবার্তার বাহক ক্রন্দনরত মসীলিপ্ত। আর কবি ছিলেন অমৃতের সন্ধানে মগ্ন। হঠাৎ রিক্ত কবির ভগ্নহৃদয়কে সিক্ত করলো দূর থেকে ভেসে আসা এক পাখির গান। সেই গানে যে কোনো অসাধারণ উন্মাদনা ছিলো তা নয়, কিন্তু কবি সেই পাখীর ডাকে উত্তীয় জীবনের ভৈরববাণী শুনতে পেলেন, সারা পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ স্পর্শের অনুভূতি কবির প্রাণে সাড়া জাগালো। অন্ধকারের মধ্যে আলোর রেখা দেখতে পেলেন তিনি, নতুন বছরের উন্মাদনা আস্বাদন করলেন।
এবার বাংলা নববর্ষের কথায় আসি। ইংরেজী নববর্ষের প্রাকসন্ধ্যায় কবি টমাস হার্ডির মনোবেদনার কথা বাংলা নববর্ষে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়। বাংলার বর্ষশেষে কবিহৃদয়ের এমন প্রাণোচ্ছোস আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পডেছি। ট্রান্সফরমেশন বা রুপান্তর বলতে আমরা যা বুঝি সেটি কবিগুরুর জীবনে উপনীত হলো বর্ষশেষে যখন কবি উদ্বাহূ হয়ে বৈশাখকে আহ্বান জানালেন জীর্ণ পুরাতন বছরকে বিনাশ করার জন্যে। হৃদয়ের এই ভাবান্তর কম বেশী সব মানুষের মধ্যেই জাগে, আর তা কোনো বিশেষ ঋতুতে বা সময়ের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে গোরার এমন রূপান্তর হয়েছিলো ভোরের সূর্যোদয় দেখে, ধর্মের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে সে নির্মল অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে উঠেছিল।
এই ভূমিকা অবতারণার পিছনে যে সক্রিয় চরিত্র উঁকি দিচ্ছে সে কোনো মননশীল বিদগ্ধ পুরুষ নয়, নিদাঘের ঝরে পড়া বকুলের কোনো গন্ধপিয়াসী নয়, সে আমার অনুজপ্রতিম হাবলা, বাবা মায়ের দেওয়া আদরের নাম হাবুল, বংশপরিচয়ের দিক থেকে জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি। অসুস্থ বাবা, সংসারক্লিষ্ট মা, ছোটো তিন বোনের ছোডদা, আর পেশায় করণিক দাদার ভাই। এই সেই বাইশ বছরের ছেলে হাবুল।
এহেন বাবুলের আনন্দের ভৈরববাণীর কাহিনী পরবর্তি পর্বে শোনাবো।
দ্বিতীয় পর্ব
গীতায় পড়েছিলাম যে দু:খের দিনে অনুদ্বিগ্ন, আর সুখে বিগতস্পৃহ থাকে সেই উত্তম পুরুষ। হাবুল কি পুরুষ, উত্তম না অধম বলা শক্ত কারণ সে দু:খে সদাই অনুদ্বিগ্ন কিন্তু তার সুখের বালাই নেই। হাবুলকে সামাজিক অবক্ষয়ের এক মূর্ত প্রতীক বলা যেতে পারে। বি এস সি পাশ, চেহারায় উদাস অথচ ইন্টেলেক্টের নামমাত্র গন্ধ নেই, লোকে বলে ও ভবিষ্যত নিয়ে মাথা ঘামায় না। এ হেন তার মতো ছেলের প্রেমে যদি কোনো মেয়ে পড়ে তবে সে প্রেম যে স্বপ্নমুখর হবে না হাবুল সেটা জানে। শুধু সাময়িক উন্মাদনার জন্য তাই সে কোনো মেয়েকে মন প্রাণ সঁপে দেবার চেস্টা করে নি। সংসারের কোনো কাজে তার মন নেই। কোনো ভাবাবেগে তাকে আহত হতে দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। ওর মায়া নেই, মমতা নেই, কোনদিন দেখিনি ও বোনেদের নিয়ে কোথাও বেরিয়েছে, ও যেন একটা যন্ত্র বিশেষ, একঘেয়ে শব্দ করে ঘুরে চলেছে, মাস গডিয়ে যায় বছর ঘুরে যায় হাবুল স্থবির, কারো জন্যে ওর উৎকন্ঠা নেই, কারো কাছে ওর কিছু প্রত্যাশাও নেই। এহেন হাবুলের যে কারো প্রতি এক অস্ফূট ভালোবাসা ছিলো সেটি অনেকে না জানলেও আমি জানি। কার প্রতি জানেন? কোনো ব্যক্তি বিশেষের ওপর নয়, এই বেহৃদয় ব্যক্তিটির মনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো মোহনবাগান ক্লাব। কতো তপ্ত গ্রীষ্মের দুপুরে সে তার ঘর্মাক্ত কলেবরকে নিয়োজিত করতো এই ক্লাবের শুভকামনায়, কিন্তু তার উত্তরে ক্লাব তাকে কি দিয়েছে? ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর পরাজয়ের গ্লানি তাকে নিস্তেজ করে রেখেছে। ধন নয় মান নয় একটা ক্লাবকে ঘিরে সে বাঁচতে চেয়েছে, এসবই হাবুলের কাছে শোনা কথা।
ফুটবল খেলার ওপরে আমার কোনো উৎসাহ নেই। আজকাল হাবুলের সঙ্গে কম দেখা হয়। কথা বিশেষ একটা হয় না। ওকে দেখলে ভাবি যদি মোহনবাগান একবার অন্তত ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারতো, ছেলেটা হয়তো বেঁচে যেতো। কর্মসূত্রে আমাকে রাঁচি চলে যেতে হয়েছে। ছুটিছাটা পেলে দেশের বাডিতে আসি। আর কর্মব্যস্ততায় হাবুলের কথাও ভুলেই গেছি।
দেশের বাডিতে এসেছি, বাংলার নববর্ষে মা বাবাকে প্রণাম করতে। সেদিনের কথা আজও মনে আছে। সেদিন ছিলো চৈত্র সংক্রান্তির সকাল, বাজারে যাচ্ছি, অন্যমনস্ক হয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে চলেছি, হঠাৎ কার গানের আওয়াজে চোখ মেলে সামনে তাকালাম, একটা ছেলে দুহাত তুলে গাইছে
একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রানেশ হে
আনন্দ বসন্ত সমাগমে।
আরে গানটা গাইছে হাবুল।
ওকে ডাকলাম, ও আমার ডাক শুনে থেমে গিয়ে পেছনে তাকালো। আমি ওকে বললাম “কেমন আছিস হাবুল, তুই যে এতো ভালো গান গাইতে পারিস জানতাম না তো, কবে শিখলি?“
ও আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো গতকাল ডুরান্ড কাপ ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে মোহনবাগান এ বছর ত্রিমুকুট অর্জন করেছে আর এই জয় ওকে দিচ্ছে আনন্দের উচ্ছাস।
হাবুল এখন নতুন বছরের আগমনী গান গাইছে।
খুব সুন্দর ভুমিকা নিয়ে একটি লেখা।
পড়ে ভালো লাগলো।