সাহিত্যিকা

তালি

তালি
অঙ্কিতা মজুমদার, ২০০৯ ইলেকট্রিনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

“তালি” দেখছিলাম। আর দেখতে দেখতেই টের পেলাম এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমার তেমন ধারণাই নেই। নাকি মাথাব্যথাই! আমার বললাম কারণ বাকিদের কথা আমি খুব একটা জানিনা। তবে আশেপাশের মানুষদের সাথে এই বিষয়ে কখনো যে কথাবার্তা হয়েছে তেমন একটা, উঁহু মনে পড়ে না। হিজড়া শব্দটার সাথে আমরা সবাই যেমন অল্প বিস্তর পরিচিত, তেমন আমিও। ছোটবেলায় বা বড় হয়ে ওঠার সময়ে আমাদের কৃষ্ণনগরে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ খুব বেশি দেখিনি। বন্ধুদের সাথেও কখনো খুব বেশি কথা হয়নি এঁদের নিয়ে। কিংবা বাড়িতেও। কি জানি হয়তো দেখিনি বলেই। পরে বড় হতে কৌতূহলেই জানার চেষ্টা করেছি। খুব যে জেনে ফেলেছি তেমনটাও নয়। আসলে পুরুষ কিংবা মহিলা কোনোটাই নন বিষয়টা ঠিক কেমন তা নিয়ে ধাঁধা তো ছিলই। তাঁরা কেন আলাদা থাকেন এইসব প্রশ্নও মনে এসেছে। এইট নাইনে পড়ার সময় কারো কাছে শুনেছিলাম, কারো সন্তান হিজড়া জন্মালে তাঁরা বাচ্চাটাকে সেখানকার হিজড়াদের কাছে দিয়ে আসে। ওঁরা তাকে মানুষ করে। হিজড়া বাচ্চাকে নাকি সবার সাথে বড় করার নিয়ম নেই। এই নিয়ম কে বানালো সে প্রশ্নেরও উত্তর নেই। বাচ্চাটাকে ছেড়ে আসার দরকার কী, সে প্রশ্নেরও। এঁরা যদি আর পাঁচটা মানুষের মত নটা- পাঁচটা চাকরির জীবন চায় তাহলে কী হবে তাও জানিনা। মোদ্দা কথা, পুরো বিষয়টাই বড্ড রহস্য ঘেরা। এঁরা কেন চাকরি করে, খেটে খান না সে প্রশ্ন মাথার ভেতর প্রায়ই চলে তখন।

কলেজে ওঠার পর ট্রেনে যাতায়াতের সময় প্রথম এঁদের দেখি ট্রেনে টাকা চাইতে আসতেন। সহজ ভাষায় বললে ভিক্ষা করতে। টাকা থাকলে দিতাম, এঁরা মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতেন। তারপর চলে যেতেন। তালির আওয়াজ শুনেই টের পাওয়া যেত এঁদের উপস্থিতি। তালি দেওয়ার ধরণটাও বড় বিচিত্র মনে হত। তবে একবার খুবই অপ্রীতিকর একটা ঘটনা ঘটেছিল। এরকমই ট্রেনে। মেদিনীপুর যাচ্ছি বোধহয়। দুই তিনজনের একটা দল উঠল। সবাই বয়স্ক। টাকা মোটামুটি সবাই দিচ্ছে। এর ভেতরে একজন বয়স্ক মহিলা টাকা দেবেন না বললেন। আর সেই বলাতে তাঁকে কী অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করলেন ওই দলের একজন। একজন শুরু করতেই বাকি দুইজন যোগ দিলেন। একজন কাপড় তুলে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে থাকলেন হাঁটু অবধি শাড়ি তুলে। ভাগ্য ভালো যে ট্রেন স্টেশনে ঢুকল এবং তাঁরা নেমে গেলেন। এই ঘটনা আমার মনে কী যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী করল! যে কারণই থাকুক, এইভাবে মানুষকে হ্যারাস করা মোটেও আমি মেনে নিতে পারিনি। আসলে আমি কোনোদিনই বিয়েবাড়িতে বা বাচ্চার জন্মের পর বাড়িতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আসতে দেখিনি। আমার সাথে এঁদের দেখার ক্ষেত্রটাই মূলত ট্রেন।

ধীরে ধীরে এদিক ওদিক পড়ে জানতে পারি সাউথ এশিয়ান দেশগুলোতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নাকি খুবই নর্মাল ছিল। তাঁরা আলাদা ছিলেন কিন্তু চিরকালই তাঁদের মানুষ খানিকটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে দেখত। শুভকাজে আসতেন তাঁরা। ব্রিটিশরা আসার পর ১৮৭১ এ সমস্ত হিজড়াদের ক্রিমিনাল বলে ঘোষণা করা হয় এবং তাঁদের দেখতে পেলে জেলে ভরার আদেশ দেওয়া হয়। সেই ট্রাডিশন মেনেই হয়তো স্বাধীন ভারতেও এঁদের অধিকার নিয়ে কিছু ভাবাই হয়নি। আরো পরে মুঘলদের নিয়ে লেখা কোনো বইয়ে পড়েছিলাম, মুঘল বাদশারা নাকি শয্যাসঙ্গী হিসাবে হিজড়াদের খুবই পছন্দ করতেন। তাই বাংলা থেকে তৃতীয় লিঙ্গের প্রচুর মানুষ তাঁদের ভেট হিসাবে পাঠানো হত। এই তথ্য জানার আগে অবধি প্রস্টিটিউশন এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কোনো যোগাযোগ থাকতে পারে, এ আমার মাথায় আসেনি। আমি ভাবতাম তাঁরা কেবল আশীর্বাদ করতেই আসেন, আমি দেখিনি যদিও টিভিতে ছাড়া, আর ট্রেনে ভিক্ষা করেন।

আসলে আমার কাছে এই তৃতীয় লিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার এই পুরো বিষয়টাই ভীষণ আবছা। ট্রান্সজেন্ডার মানে আমি জানি। যখন প্রথম জানতে পারি, তখন বোধহয় কলেজে। একজন ছেলে বা মেয়ে ভিতর থেকে কিভাবে বিপরীত লিঙ্গের হতে পারে এইটা আমি কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারতাম না। শুধু মনে হত এমনটা হলে তো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হওয়ার কথা। প্রচন্ডভাবে। নিজের সাথে বা নিজের খুব কাছের মানুষজনের সাথে যেটা ঘটছে সেটা বুঝতে পারাই বোধহয় সবথেকে স্বাভাবিক। আসলে আমরা যেসব বিষয় চারপাশে অহরহ দেখি সেগুলোই একসময় স্বাভাবিক বলে মনে করতে থাকি। প্রায়ই ভুলে যাই অন্য বিষয়গুলো অন্যরকম, আলাদা হতে পারে, অস্বাভাবিক নয়। যা বলছিলাম, অস্বাভাবিক মনে হয়নি কখনো, কিন্তু আসলেই বুঝতে পারিনি। মাঝের বছরগুলোতে অনেক ইন্টারভিউ দেখেছি, আর্টিকল পড়েছি, কিন্তু কখনো কারো সাথে আলাপ হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। আলাপ হওয়ার বোধহয় খুব দরকার। আমাদের প্রত্যেকের।

এই যেমন সমকামিতা সম্পর্কেও প্রথম জানতে পারি কলেজে। না, তার আগে মনে আছে ইলেভেন বা টুয়েলভে পড়তে ইটিভিতে একটা টেলিফিল্ম দেখেছিলাম। দুজন মেয়ে বন্ধুর। তারা যে সমকামী একথা খুব একটা পরিষ্কার ছিল না ছবিটিতে, কিন্তু ঐরকম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। ওই অবধিই। আর কলেজে পড়তে আমাদের অদ্ভুত একটা ধারণা ছিল, যে সমস্ত ছেলেদের ভেতর সমাজের চোখে মেয়েলি গুণ বর্তমান, তারা সবাই গে। এ ধারণা কার প্রথম কিভাবে এবং কেন তৈরী হয় খেয়াল নেই।

যা বলছিলাম, সমকামিতা বিষয়টাই তখন খুব নতুন। বুঝতে পারছি একজন ছেলে এবং মেয়ে যেভাবে প্রেমে পড়ে, ঠিক সেইভাবেই একজন ছেলে, ছেলে কিংবা মেয়ে, মেয়ে প্রেমে পড়ে। কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন ঠিক বুঝছিও না। মনে অজস্র প্রশ্ন। কিন্তু কাউকে যে প্রশ্নগুলো করব সে সুযোগ নেই। আমি নিজে তো কেবল ছেলেদেরই প্রেমে পড়ছি, ঠিক সেইভাবেই কি একজন ছেলে আরেকজন ছেলের প্রেমে পড়ছে? কিভাবে? যদি পড়লোও, সেই প্রেম কি শারীরিক প্রেমও? দুইজন সমলিঙ্গের মানুষের কিভাবে শরীরের প্রেম হতে পারে? একটা মস্ত প্রশ্ন বিচিত্রা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। অত্যন্ত লজ্জার সাথে স্বীকার করছি, প্রথম যখন ছোট বা বড়পর্দায় দুইজন একই লিঙ্গের মানুষকে ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাতে দেখি, একদম ভালো লাগেনি। ওই যে, যা দেখে অভ্যস্ত নই, তা প্রথমবার দেখার কিছু তো অভিঘাত থেকেই যায়। এমনকি দ্বিতীয় পুরুষ ছবিতেই তো বোধহয়, অনির্বান এবং পরমব্রতর একটি চুম্বনদৃশ্য আছে। ছবিটা অতি বাজে লেগেছিল, সে কথা ভিন্ন এবং এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ওই চুমুর দৃশ্যটি ওই বিশাল পর্দায় দেখতে খানিকটা অস্বস্তি হয়েছিল বইকি! কেন অস্বস্তি হয়েছিল ঠিক জানিনা। এঁদের দুজনকে আলাদা আলাদাভাবে মেয়েদের চুমু খেটে কি আমি দেখিনি! অনেকবার ভেবেছি, ওই দৃশ্যটায় একজন ছেলে আর মেয়ে থাকলেও কি একইরকম অস্বস্তি হত! হয়তো হত না। তারপর সম্ভবত আরেকটু বড় হয়েছি। আর অস্বস্তি হয় না, কিছুই মনে হয় না। কিংবা ছোট এবং বড়পর্দায় এইরকম দৃশ্য এখন প্রচুর দেখা যায়। ভাগ্যিস! আমার মনে হয় এই দেখাগুলোর দরকার আছে। দেখতে দেখতেই মানুষ আর কিছু না হোক অভ্যস্ত তো হয়।

আমাদের আগের প্রজন্মের বয়স্ক এবং আমার কাছের একজন মানুষ তিন চার বছর আগে কথায় কথায় আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আজকাল তো ছেলেতে, ছেলেতে, মেয়েতে মেয়েতেও নাকি প্রেম হয়!” আমাদের কথা হচ্ছিল বিয়ে নিয়ে। ছেলে মেয়েরা নিজের পছন্দে বিয়ে করবে এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম, জাত, দেশ যাই আলাদা হোক না কেন, বাবামায়েদের আর তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। আর সেই কথাপ্রসঙ্গেই ওঁর এই প্রশ্ন। আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। যতটুকু বুঝি, ওঁকেও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। বিষয়টা কতটা স্বাভাবিক। আর তার চেয়েও বড় কথা কেউ তো জোর করে কাউকে ভালোবাসতে পারে না। আর হ্যাঁ, প্রকৃতিবিরুদ্ধ হলে তো প্রকৃতিই সবার আগে বিরোধিতা করত। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কোনোকিছুই প্রকৃতি খুব বেশিদিন সহ্য করে না। আর সমকামিতা যুগ যুগ ধরে রয়েছে। এসবই বলেছিলাম। হয়তো উনি বোঝেননি। বোঝার চেষ্টা করেছেন। কঠিন তো লাগবেই। যা উনি দেখেননি, শোনেননি, তা দুম করে কোনো প্রশ্ন ছাড়া নর্মাল একটা বিষয় বলে ভাবতে শুরু করা কঠিন বই কী! তবে এই যে আমাদের আগের প্রজন্মের মহিলারা, যাঁরা খুব ছোটবেলায় বাড়ির ইচ্ছায় বিয়ে করেছেন, ঘর সংসারটাকেই পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছেন, তাঁরাও যে এখন সমকামিতা নিয়ে কথা বলছেন, এ তো দারুন ব্যাপার। কথা বলতে থাকলেই মানুষ আস্তে আস্তে তার কাছে অন্যরকম সবকিছুকেও জীবনের অংশ করে নিতে পারবে। সময় লাগবে। তবে পারবে।

এই যে ব্রিটিশরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্রিমিনাল সাব্যস্ত করেছিল, সেই ব্রিটিশ মুলুকে এসেই কিন্তু আমি প্রথম সমকামী দুইজন মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। প্রথম যেদিন অফিস গেছি, আমারই এক টিমমেট, সেদিন আমরা পাশাপাশি বসেছি, কথায় কথায় তার বয়ফ্রেন্ডের গল্প শুরু করল। এখানে সবাই তাদের পার্টনারকে নিয়ে কথা বলে। ছেলেটির কাছে জানলাম সে প্রথমে একটি মেয়েকে ডেট করত, তাদের দুই তিন বছরের সম্পর্ক ছিল। এবং তখনই সে বুঝতে পারে তার আসলে মেয়েদের ভালো লাগে না। মানে, প্রেমের সম্পর্কে। আর সেই প্রেম ভাঙার বেশ কিছুদিন পর সে এক ছেলের প্রেমে পড়ে। তারা লিভ ইনও করেছে। সেই সম্পর্কও টেকেনি, কিন্তু তার কারণ আর পাঁচটা সম্পর্কে ভাঙার কারণের মতোই বনিবনা না হওয়া। এই ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি তো! আগে ভাবতাম সমকামী হলে তারা প্রথম থেকেই জানতে পারবে। এখানেও যে ট্রায়াল এন্ড এররের ভেতর দিয়ে যেতে হতে পারে, এ আমার মাথাতেই আসেনি। তবে যেটা ভালো লেগেছিলো, কেউ তাকে তার পছন্দের ভিত্তিতে জাজ করেনি। মানুষ বড় খোলামেলা কথা বলতে পারে এখানে।

আরেক ভদ্রলোক, আমার সহকর্মী, অনেক উচ্চ পদাধিকারী। তাঁর সাথে ভালোভাবে প্রথম দেখা এক টিম মিটিঙে, মূলত একটা ট্রেনিং ছিল। আগের সামারে। তিনি ঘরে ঢুকেই আসার সময় তাঁর বর তাঁকে দেখে কী বলেছেন সকালে সেই গল্প শুরু করলেন। আমরা খুবই আমোদ পেলাম এবং খুব হাসলাম। পরোক্ষনেই মনে হল, উনি কি বর বললেন না বৌ! আরো কিছুক্ষণ কথার পর বুঝলাম উনি বরই বলেছেন। ঠিক যেমন আমি গল্প করার সময় আমার বর বলি। এত ভালো লাগল। এরকমই তো হওয়ার কথা। পরে তাঁর কাছে শুনেছি আজ থেকে প্রায় ১০-১২ বছর আগে তাঁরা যখন বিয়ে করেন এখানে তখন সেম সেক্স ম্যারেজ বেআইনি ছিল। তিনি তাঁর শাশুড়ির গল্প করেন, শ্বশুড়বাড়ির গল্প করেন, তাঁদের নতুন করা বাগানের ছবি দেখান। এখানে আসার পর নিজে আশেপাশের মানুষজন দেখেই এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, লিঙ্গ যাই হোক, সম বা অন্য, সম্পর্কে প্রেম, অভিমান, ঝগড়া, রাগ, জেদ সবকিছুর রঙ এক, এমনকি ভুল বোঝাবুঝি আর বিরহেরও। সম্পর্কের ডাইমেনশনগুলো একইরকম।

আরো একটা জিনিস ভালো লেগেছিলো। তখন নাগাড়ে চাকরির আবেদন করছি। এখানে চাকরির আবেদন বেশ ঝক্কির কাজ। এত বড়ো বড়ো সব ফর্ম ভরতে হয়! নানান প্রশ্ন। সাথে কভার লেটার তো আছেই। সেই ফর্মের একটা অংশে বয়স, লিঙ্গ, এথনিসিটি, অনেককিছু ভরতে হয়। সাথে এও লেখা থাকে যে তারা এইসবের ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ করে না, এই তথ্য গোপন থাকবে আর এইসব প্রশ্নের উত্তর চাইলে নাও দেওয়া যেতে পারে। তবে যেটা আমায় অবাক করেছিল সেটা হল দুটো প্রশ্ন। এক, তোমার সেক্স কী আর তোমার সেক্স আর তোমার জন্মের সময়কার সেক্স কি এক (Do you identify your sex as your birth sex)! আরেক জায়গায় বলতে হয় আমাকে কী বলে ডাকলে আমি পছন্স করব, হি, শী, না অন্য কিছু। আমি ফর্ম ভরতাম আর অভিকে বলতাম, কতকিছু ভেবেছে এরা। আর এই ভাবনাগুলো কত জরুরি। এই যে বারবার দেখতে দেখতে, ফর্ম ভরতে ভরতেই তো কতকিছু মাথায় গেঁথে যায়।

আসলে ইনক্লুসিভিটি একটা প্র্যাকটিস। এমপ্যাথিও। করতে করতেই হবে। প্রথমে হয়তো অন্যরকম লাগবে। কিন্তু অস্বাভাবিক লাগবে না। আর প্রথমে একটু সতর্ক থেকে, চিন্তা করে করতে করতেই সেটা মাথার ভেতর ঢুকে যাবে।

একটা গল্প বলে এই অবান্তর আলাপ শেষ করব। আমি তখন থার্ড ইয়ার খুব সম্ভবত। ট্রেনে করে কলেজে ফিরছি। জানলার ধারে সিট পেয়েই একটা পত্রিকা খুলে বসেছি। কয়েকটা স্টেশন পরে একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ উঠলেন। তার ভেতরে একজন জিন্স টপ পরে। বেশ মিষ্টি মত। বয়স খুব বেশি হবে না। আমার কাছে এলেন। পয়সা চাইলেন। সেদিন আমার কাছে খুচরো ছিল না। নেই বলায় বিরক্ত হলেন। চলে যাওয়ার সময় আমার হাতে যে চিপসের প্যাকেট চিল সেখান থেকে কয়েকটা চিপস নিয়ে খেতে খেতে চলে গেলেন। এতটাই চমকে গেলাম যে কী করব বুঝতে পারলাম না। চিপসের প্যাকেটটা ব্যাগে রেখে দিলাম। পরে ফেলে দিয়েছিলাম। উনি নেমে যাওয়ার পরেই মনে হয়েছে আরে ওঁকে দিয়ে দিলেই তো হত! পরে যতবার ভেবেছি কেন জানি না কেমন লজ্জিত হয়েছি। যদিও আমার ধারণা হয়তো অন্য অচেনা যে কেউ হঠাৎ করে এমন করলে আমার প্রতিক্রিয়া একই হত। কিন্তু এক্ষেত্রে উনি তৃতীয় লিঙ্গের বলে আমার মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে বহুবার। আমি কী তবে মানুষে মানুষে ভেদ করছি! একটা মন উত্তর দিয়েছে করছি না কারণ আমি যে কেউ হলে এমনটাই করতাম। আরেক মন চুপ করে থাকছে। বলছে সেই ট্রেনের ঘটনা আমার মনে হয়তো খুব গভীরে গেঁথে গেছিল। আমি বোধহয় এঁদের সকলকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। বড্ড ঘেঁটে গেছে সব। আমার মনের ভেতর কি আসলেই অনেকগুলো বাধা যেগুলো পার হয়ে আসার জার্নিটা খুব দীর্ঘ। তবে, চেষ্টা করছি নিরন্তর।

কখনো কখনো মানুষ হিসাবে নিজেকে তিন চারের বেশি দিতেই পারি না।

Sahityika Admin

1 comment