সাহিত্যিকা

ঘৃণা

ঘৃণা
সৌরিশ সরকার, ১৯৯৫ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

ভিড় বাসের পাদানিতে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক, বেঁটেখাটো, খুব নিরীহ গোবেচারা মতো দেখতে লোকটার নাকের ঠিক মাঝ বরাবর একটা বিরাট আঁচিল। নজর যাবেই ওদিকে, এমন বিচ্ছিরি স্ট্রাটেজিক জায়গায় জিনিসটা। চোখ পড়ে গেলে সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আবার মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ আটকেও যায়। খালি মনে হয় খুবলে দিলে কেমন হয়?

আঁচিলটার দিকে ভীষণ বিতৃষ্ণার চোখে তাকিয়ে ছিলো সাদা জিন। চলন্ত বাসটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় শুয়ে। বাসটায় দমবন্ধ করা ভিড়, তবে জিনদের তো বাসে উঠতে লাগে না।
‘লোকটা কিরকম সেটা তুই অলরেডি ভেবে ফেলেছিস, না?’ পাশেই ভাসতে ভাসতে ফিশ ফিশ করে শুধায় কালো জিন।

সাদা জিন আর কালো জিন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অলীক মানুষ গল্পের চরত্র ছিলো। পীর পয়গম্বরদের সাথে তারা কথা বলে, সাধারণ মানুষকে ভালো বা খারাপ পথে চলতে মদত দেয়। সাদা জিন ভালো পথে আর কালো জিন খারাপ পথে পাঠায়। কেন কারো জানা নেই – দুনিয়ার সব সভ্যতা সংস্কৃতি এই ব্যাপারে একমত যে সাদা ভালো, কালো খারাপ। এমনকি কালো মানুষদের সভ্যতাও সাদাকেই ভালোর প্রতীক মানে। আদতে সবই ধূসর – সাদা জিন কালো জিনও তেমনি ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে আমাদের মানুষদের মাঝে ঘুরে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাদা জিন। ‘এরকম একটা জিনিস নাকের ডগায় ঝুলে থাকলে পছন্দ করা মুশকিল, না? যেমন কানের থেকে একগাদা চুল বেরিয়ে থাকে যদি, বা টাকের ওপর ছোপ ছোপ।’
‘আমি কিন্তু এই মাত্র লোকটার মনের মধ্যে ঢুকে দেখে এলাম।’ কালো জিন মুচকি হাসে। ‘লোকটা নিজের স্ত্রী ছেলে মেয়েদের সত্যি ভালোবাসে। বাড়ির সব কাজে বৌকে হেল্প করে। যখনি সময় পায় ছেলে মেয়ের সাথে খেলে। পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধব সবার কথা মন দিয়ে শোনে। পাশের বাড়ির বৌদির দিকে কুনজরে তাকায় না। আর নিজের কথা সারাক্ষণ সাতকাহন করে বলে বেড়ায় না।’
‘সত্যি!’ সাদা জিন বেশ লজ্জায় পড়ে যায়। ‘আর দেখ আমি শুধু একটা তুচ্ছ শারীরিক জিনিস দেখে একটা বাজে ধারণা করতে শুরু করেছিলাম।’
‘শুধু তুই না। সব মানুষই এটা করে। জিনরাও করে – তবে আমরা চট করে চেক করে নিতে পারি – মানুষ তো সেটা পারে না – তাই ওই ধারণাগুলো নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়। অনেক ব্যক্তিগত পক্ষপাত – কিছু বাবা মায়ের থেকে আসে, কিছু যেখানে বড়ো হয়েছে সেইখান থেকে, কিছু স্কুল কলেজ চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে।’

মাথা নাড়ে সাদা জিন। ‘ঠিক। এরকম তো হতেই পারে – সবাই তো সবাইকে পছন্দ করবে না। জানা কথা। প্রেম, ভালোবাসা, প্যাশন, ভক্তি – এগুলো তো কার যে কিভাবে, কাকে দেখে হবে কেউ জানে না। তাই না?’
কালো জিন সম্মতির ঘাড় নাড়ে। ‘নিশ্চয়। কিন্তু কখন এই হালকা অপছন্দটা ঘৃণায় গিয়ে দাঁড়ায়? কেনই বা দাঁড়ায়? ঘৃণার পাত্র কারা, সেটা কিভাবে অনেক আগেই ঠিক হয়ে যায়, লোকটাকে চোখে দেখবারও অনেক আগে?’
সাদা জিন বলে ‘আচ্ছা চল তাহলে, যাদের আছে এতো ঘৃণা, তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখি কারণটা কি? সত্যি সত্যি কারণ আছে? নাকি মনগড়া? নাকি অন্য কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে মনে?’
‘তাহলে কোথা থেকে শুরু করা যায়? ছোটোখাটো দিয়ে শুরু করা যাক? ঠিক ঘৃণা না – ধর তীব্র অপছন্দ। তারপর আস্তে আস্তে কড়াপাক করা যাবে?’

কালো জিন গালে হাত দিয়ে একটু ভাবে। বাসটা ততক্ষণে এসপ্লানেড পেরিয়ে ময়দানকে ডানহাতে রেখে স্পিড তুলে দিয়েছে। কালো জিন হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ঐত্তো, ওই যে, পেয়ে গেছি। চলে আয় সাদা।‘

হুশ করে বাস ছেড়ে দুই জিন গিয়ে দাঁড়ায় যে লোকটির সামনে, তার টেরিকাটা চুল, চোখে বাহারি সানগ্লাস, পরনে চোঙা প্যান্ট আর লাল হলুদ গেঞ্জী। কালো জিন একটা গলা খাকারি দিয়ে বললে, ‘নমস্কার পটলবাবু – আপনি তো ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার? আচ্ছা, মোহনবাগানীদের আপনি অপছন্দ করেন কেন একটু বলবেন?’

জিনদের চেহারা একটু ভীতিপ্রদ। তালঢ্যাঙা লম্বা, হালকা ফিনফিনে স্বচ্ছ চেহারা, ভেতর দিয়ে সব কিছু দেখা যায় – অনেকেই ভয় পেতে পারে। লোকটা অবশ্য বিশেষ বিচলিত হলো না। মনে হয় এর চেয়েও আরও অনেক ভয়াবহ, রক্তচোষা মানুষ/ভূত নিজের ক্লাবের টেন্টেই সে নিয়মিত দেখতে পায়।
গম্ভীর ভাবে বললো, ‘ওই মাচাদের পছন্দ করবো? আপনাদের কি মাথা খারাপ? জানেন, আমাদের সাথে কি খারাপ ব্যবহার করে? সারাক্ষণ বলে তোরা কাঁটাতার টপকে এসেছিস, জমিজমা পুকুর আর নারকেল গাছের গুলতাপ্পি ঝাড়িস, যা নিজের দেশে ফিরে যা। আচ্ছা বলুন তো এটা একটা কথা হলো? সাতচল্লিশের দেশভাগ তো আমরা করতে বলিনি? একাত্তরের যুদ্ধের সময় কতো কষ্ট করে প্রাণ হাতে করে কতজনকে একবস্ত্রে পালিয়ে আসতে হয়েছে? তাদের দু:খ না বুঝে এরকম করে বলবে?’

সাদা জিন প্রচন্ড অবাক হয়ে বললো, ‘হচ্ছিলো তো ফুটবল টিমের কথা ? এ তো আপনি কাবাডির মাঠে চলে গেলেন!’
তখনই পাশ থেকে ফিশ ফিশ করে কালো জিন বললো, ‘সাদা, শোন। বোঝার চেষ্টা কর। বাঙাল ঘটি পটভূমি বাদ দিয়ে এই দুই টিমের ফ্যান বেসের আবেগ বোঝা যাবে না। ওটা মাস্ট।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু ঘটিরা যদি একটু এই সব খোরাক দিয়েই থাকে তো কি হয়েছে পটলবাবু? একটু না হয় শুনলেন ভাইয়ের দেয়া আওয়াজ? সত্যি তো, আপনাদের সব্বার গল্পের নারকেল গাছ অ্যাড করলে সারা বাংলাদেশ ছেয়ে যায়। ধানক্ষেতের আর জায়গা থাকে না!’ সাদা জিন একটু বোঝাবার চেষ্টা করে।

পটলবাবুর চোখমুখ দেখে মনে হলো খেলার ফার্স্ট মিনিটেই টিম গোল খেয়েছে। গলা ছেড়ে একটা ভাষণ শুরু করতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই কালো জিন গম্ভীরভাবে বললো ‘সারা পৃথিবীতেই হাজারখানেক বার মেজর রিফিউজি ক্রাইসিস হয়েছে। যে কোনো যুদ্ধের আগে পরে তো বটেই, এমনকি শান্তির সময়েও বহুবার। সাউথ আমেরিকা থেকে রোজ লাখখানেক লোক আজ ইউ এস এ তে ঢুকে পড়ে। কিউবা থেকে যখন তখন নৌকো ভাসিয়ে লোক চলে আসে। নর্থ আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে। বর্মা থেকে রোহিঙ্গা। উদাহরণের কোনো অভাব নেই। সবারই তো একটাই চাহিদা – আমার সন্তান যেন দুধে ভাতে না থাকলেও একটু ভালো থাকে। অনেক অপমান এমনকি মৃত্যুভয় সহ্য করে এদের থাকতে হয় নতুন জায়গায়। ঘর দোর জ্বালিয়ে দেয় যখন তখন সেখানকার নেটিভ লোকেরা। এদের কাউকে বলে দেখবেন দুটো ঠাট্টা করে বলা কথা আপনারা হজম করতে রাজি নন। দেখবেন কি বলে।’

বেগতিক দেখে পটলবাবু খেলার জগতে ফেরার চেষ্টা করলেন। পঁচাত্তর সালের ৫-০ টার উল্লেখ করলেন বার বার। দেখা গেলো রিসেন্ট কোনো খেলা নিয়ে আলোচনা করতে উনি একেবারেই রাজি নন।
সাদা জিন বললো, ‘তা আপনারা ওদের গালি না দিয়ে নিজেদের টিমটা ভালো করুন না? এ তো আর জিরো সাম গেম নয়। আই এস এল টুর্নামেন্টে দুটো ভালো টিম তো থাকতেই পারে?’
পটলবাবু দেখা গেলো বিশেষ আশা রাখেন না – বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন খালি। কালো জিন একবার চট করে ওনার মনের মধ্যেটা ঢুকে দেখে এসে বললো, ‘ইনি আসলে মনে মনে জানেন মোহনবাগান ম্যানেজমেন্ট অনেক বেটার আর আজকের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে জানে। কিন্তু এই লোকটি সেটা স্বীকার করতে চান না। অতীত আঁকড়ে পড়ে আছেন, তাই। টিম দুটো কোনো ভাবে একটু সমান লেভেলে এলেই অপছন্দর মাত্রাটা অনেক কমে যাবে।’

সাদা জিন ভারি খুশি। ‘এই কেসটা তাহলে স্যুটকেস হয়ে যায়নি বলছিস। এখনো আশা আছে।’
কালো জিন মাথা নাড়ে। ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক হয়ে যাবে আর শ খানেক বছরে। চল, পরের লেভেল ঘৃণা দেখাই তোকে। ধর্ম আর জাতীয়তাবাদ বেশি উগ্র হলে কি হয় দেখবি।’

দুই জিন তারপর একে একে দেখা করলো ক্যাথলিক/প্রটেস্টান্ট (১৫১৭ থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে), শিয়া/সুন্নি, চার্লি হেবদো আর সালমান রুশদির সাথে। চীন আর নর্দার্ণ আয়ারল্যান্ডেও ঘুরে এলো চট করে। শেষে একবার পাকিস্তান/বাংলাদেশে টুক করে ঢুঁ মেরে নিলো ইন্ডিয়ার সাথে অন্য কোনো দেশের ক্রিকেট খেলার সময়। সেই গল্পগুলো হয়তো আর একদিন লিখবে সাদা জিন কালো জিন।

Sahityika Admin

1 comment