সাহিত্যিকা

জাপানের দিদিরা

জাপানের দিদিরা
আশিস্ বসু, ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

জাপানের নাগানো শহরে অরির কাজ একটু তাড়াতাড়ি মিটে যাওয়াতে শিরাইতো জলপ্রপাতটা দেখার কথাটা নুতন করে মাথায় এলো। কুড়ি পঁচিশ বছর আগে নাগানোর আশেপাশে খুব যাতায়াত ছিল। অরির কোম্পানি তখন সিকো এপসনের সঙ্গে এক যৌথ উদ্যোগে আবদ্ধ, তাই কাজে আসতে হত বেশ ঘন ঘন, যৌথ উদ্যোগে মাইসোরে প্রিন্টারের কারখানা তৈরী হবার পর অরিদের নাগানোর কাজে ভাঁটা পড়ল। তখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু সময় পেলেই অরি বেরিয়ে পড়ত আশেপাশের জায়গাগুলো দেখার জন্য। উত্তর পশ্চিম জাপানের এই জায়গাগুলো বরাবরই অরি’র বড় পছন্দের। এক দিকে পাহাড়, অন্য দিকে জাপান সমুদ্র। অরি ভেবে দেখল যে বাসে জলপ্রপাত দেখে আসতে বেশী সময় লাগার কথা নয়। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। তারপর সময়মত কাছাকাছি কোন স্টেশন থেকে শিনকানসেন বা বুলেট ট্রেন ধরে সন্ধ্যার দিকে সহজেই টোকিও ফিরে আসা যেতে পারে।

ব্যস, যেমন ভাবা কেমন কাজ, একটা টিকিট কেটে অরি উঠে পড়ল বাসে। জাপানে বাসের সামনের দিকের কয়েকটা সিট বয়স্ক বা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে। গত মাস খানেক ডান পায়ের হাঁটুর ব্যাথার জন্য চলাফেরা অরির পক্ষে বেশ কষ্টকর। বাসে উঠেই অরি ড্রাইভার শিকাদা সান কে জিগ্গাসা করল যে সে পায়ের সমস্যা র জন্য সামনের সিটেতে বসতে পারে কিনা। সব শুনে শিকাদা সান বললেন যে বাস মোটামুটি খালিই যাচ্ছে তাই অরির সামনের সিটে তে বসতে কোন অসুবধে নেই, তাছাড়া অরি নিজেও অসুস্থ।

বাসটির সব রো’তেই দুদিকে দুটি করে সিট, শুধু একেবারে সামনে একটা চারজনের একটি বেন্চ সিট। সামনে গিয়ে অরি লক্ষ্য করল যে সামনের সেই সিটটিতে দুই বয়স্ক বসে আছেন, দেখে মনে হয় সত্তরোর্ধ মহিলা, দুজনের পরনেই ঠিক একই রং এবং একই রকম কিমোনো। অরি ডানদিকের মহিলার অনুমতি নিয়ে খালি সিটটিতে বসতেই, তিনি ইংরেজীতে জিগ্গাসা করলেন, “তুমি কি এদিকে থাক? তোমার জাপানী উচ্চারন ঠিক এখানকার লোকেদের মত।” অরি তো কিমোনো পরা মহিলাটির মুখে ইংরেজী শুনে হতবাক, তবে বুঝল যে উনি অরির সঙ্গে ড্রাইভারের কথাবার্তা বেশ মন দিয়েই শুনছিলেন। অরি ভদ্রতা করে জাপানী তে উত্তর দিল, “না, এখন এদিকে থাকি না, তবে বছর পঁচিশ আগে এদিকে খুব আসা যাওয়া ছিল। এককালে হাচিওজি র কাছে থাকতাম আর কাজ করতাম। ওনিসান (জাপানী ভাষায় দিদি) আপনার ইংরেজীও খুব ভাল। আপনি কি কাছাকাছি থাকেন?”

অরি’র উত্তর শুনে পাশে বসা একইরকম কিমোনো পরা মহিলা বেশ জোরেই হেসে উঠে জাপানীতে বললেন, “ওর ইংরেজী তো ভাল হবেই, ইংরেজীতে বরাবর ক্লাসে সবথেকে বেশী নম্বর পেত। তাছাড়া অবসরের আগে পর্যন্ত কারুইজাওয়ার হাই স্কুলে ইংরেজী পড়িয়েছে। ও আমার ছোট বোন মিয়াকো কিতাগাওয়া, আর আমি হিরোকো।”
এবার অরিও হেসে ফেলে দুই বোনকে মাথা নীচু করে জাপানী সংস্কার অনুযায়ী অভিবাদন করে বলল, “হিরোকো ওনি, মিয়াকো ওনি আপনাদের দুজনকেই নমস্কার। আমার নাম অরিজিৎ সেন, সবাই বলে “অরি”, অভ্যাসের অভাবে আমার জাপানীটা এখন আগের মত সড়গড় নেই, তাই ভুল হলে ক্ষমা করবেন।”

এবার মিয়াকো বললেন, “তুমি ভাষাটা কতটা মনে রেখেছ তার পরীক্ষা তো আর এখন করা যাবে না, তবে এটা বলতে পারি তোমার উচ্চারন এখনও ঠিক আছে। তা তোমাকে এখানে এত আসতে হত কেন? কি কাজ করো?”
মিয়াকো প্রশ্নটা ইংরেজীতে করেছিলেন তাই অরি অজান্তেই ইংরেজীতে উত্তর দেওয়া শুরু করেছিল। হটাত হিরোকো বলে উঠলেন “নিহোঙ্গো দে, নিহোঙ্গো দে।” অরি বুঝল যে হিরোকোও শুনতে চান ওর উত্তর। ওঁনারও জাপানীই পছন্দ, উনি বোনের মত ইংরেজীতে অতটা স্বচ্ছন্দ নন।
“হাই, ওনিসান” বলে অরি শুরু করল, “আমি জাপানে আসি আমার কম্পানির জাপানের কাবুশিকি কাইশা (সাবসিডিয়ারি) শুরু করতে ১৯৯৪ সালে। তখনই থাকতাম হাচিওজিতে তার পর থেকেই আসাযাওয়া চলছে। এদিকে আসতে হত সিকো এপসনের কাজে। আমি পুর্ব ভারতের কলকাতার লোক, তবে গত তরিশ বছর থাকি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে।”

জলপ্রপাত এর রাস্তা পাহাড়ী, তাই বাসের গতি শুধু ধীরই নয়, বিলম্বিতও কারন সরু রাস্তা দিয়ে ওপরে ওঠার সময় বারবার নীচে নাবার গাড়ীগুলোকে জায়গা দিতে হচ্ছে। ধীর গতির বাসে অরি’র সঙ্গে মিয়াকো অনির কথা বেশ জমে উঠল। মিয়াকো বললেন, “কারুইজাওয়ার স্কুল থেকে অবসর নেবার পর থেকে আর ইংরেজী বলার সুযোগ পাই না। তোমাকে পেয়ে আমার পুরোন অভ্যাস ফিরে এল।”
অরি র মনে হল মিয়াকো অনি থেমে থেমে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন, হয়ত অনেকদিনের ইংরেজী শিক্ষকতার অভ্যাস। মিয়াকো বলে চললেন, “পঞ্চাশ এর দশকে আমি আর দিদি যখন স্কুলে তখন আমাদের দেশটা এখনকার মত ছিল না। আমাদের বাবা তো জাপানী সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরলেনই না, কাজেই আমরা দুবোন আমাদের মা’র কাছেই মানুষ। বাবা জানতেন যে যুদ্ধে জাপানের পরাজয় হবে, প্রথম দিকে যুদ্ধে যেতে চান নি। কিন্তু পরে যোগদান বাধ্যতামুলক হওয়ায় না গিয়ে আর উপায় ছিল না। আমাদের দেশ যুদ্ধে হারার পরের কয়েক বছর বেশ খারাপ সময় ছিল। যদিও কারুইজাওয়াতে আমাদের আশেপাশে মিত্রশক্তির বোমাবাজি তেমন হয় নি তাই যুদ্ধে আমাদের ওদিকটাতে রাস্তাঘাট বা বাড়িঘরের বিশেষ ক্ষতি হয় নি। তারপর ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তো আমেরিকান জেনারেল ডাগলাস ম্যাকআর্থার ছিলেন এদশের কর্ণধার। আমাদের স্কুলজীবনে অর্থাভাব আর খাদ্যাভাব দুইই ছিল, পুরো দেশটা যুদ্ধে পরাজয়ের পর ধুঁকছিল। তারপর ধীরে, ধীরে সব ঠিক হল।

“স্কুল শেষ করে আমি আর দিদি দুজনেই সেন্দাই তে তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম। আমি পড়লাম ইংরেজী সাহিত্য আর দিদি হিরোকো কৃষিবিজ্ঞান। আমার ইচ্ছে ছিল বিদেশে গিয়ে ইংরেজী সাহিত্য পড়বার, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয় এর পর আমি স্কুলে ইংরেজী পড়ানোর চাকরি নিলাম আর হিরোকো দিদি ঢুকেছিল একটা সরকারি চাকরিতে। হিরোকো আর আমি দুজনেই আমাদের বিয়ের পর ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে কয়েকটা দশক কোথা দিয়ে যে চলে গেলো বুঝতেই পারি নি। এখন আমাদের স্বামীরা নেই, আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকে ইউরোপ আর আমেরিকায়। আমরা দুই বোন আবার একা, ঠিক যেমন ছিলাম বাবা যুদ্ধে চলে যাবার পর পর। এখন হিরোকো থাকে সাপোরো তে আর আমি কারুইজাওয়াতে, ট্রেনে চার ঘন্টার ব্যাপার। আজকাল বছরের শেষের দিকে আমরা দুই বোন নিজেরা নিজেরা থাকি আর আমাদের ছোটবেলার জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়াই। আমাদের জন্য এটা খানিকটা ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার মত। কি যে ভাল লাগে বলে বোঝাতে পারবো না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা সেই আগের মতই ছোট আছি, আর মাঝখানের চলে যাওয়া কয়েকটা দশক নিছকই কল্পনা। এবারও তাই আমরা জলপ্রপাতটা আবার দেখতে যাচ্ছি। আমাদের ছোটবেলায় এখানে পুরো পাকা রাস্তা ছিল না। আমরা বন্ধুরা স্কুলের ছুটির সময় কিছুটা রাস্তা সাইকেলে আর বেশীরভাগটা পায়ে হেঁটে আসতাম। এই জায়গাগুলো, পাহাড় বা জলের ধারাগুলো পাল্টায় নি, আমরা দুই বোন এখনও এখানকার পাহাড়ে সেই ছোটবেলার ফেলে আসা দিনগুলোর গন্ধ পাই।”

অরি অবাক হয়ে শুনছিল। অবশেষে সে বলল, “ওনিসান, আপনি অদ্ভুত ভাল গল্প বলেন।”

কেউ খেয়াল করে নি যে মিয়াকো র গল্প শেষ হতে হতে ওদের বাস পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে জলপ্রপাতের কাছের পার্কিং এর জায়গায় পৌছে গেছে। এবার নেমে দেখার পালা। তিনজনের একসঙ্গেই জলপ্রপাত দেখা হল, কয়েকটা জায়গায় দুই বোনের উচ্ছাস দেখতে অরির খুব ভাল লাগছিল। একজায়গায় হিরোকো হটাৎ দাডিয়ে পড়লেন, তারপর বললেন, “মিয়াকো, মনে পড়ে এখানে আমাদের এক বন্ধু জলে পড়ে গেছিল?”
মিয়াকো ঘাড় নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ দিদি, মনে পড়ে।”
ফেরার পথে, মিয়াকো অরি’কে জিগ্গাসা করলেন, “তোমার ছোটবেলার ভারতবর্ষ কেমন ছিল, অরি?”

এবার অরি আর ইংরেজীতে শুরু করার ভুলটা করল না।
“ওনিসান, আমার ছোটবেলার শুরুটা মধ্যভারতের বস্তার জেলার জগদলপুরে, এককথায় যায়গাটা স্বপ্নের মত ছিল। পরে আমরা কলকাতায় চলে আসি। তখনকার ভারতবর্ষ ছিল রাশিয়া ঘেঁষা গরীব দেশ। তার মধ্যেও আমরা ছিলাম একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত তাই অর্থাভাব ছিল, সুযোগসুবিধাও বিশেষ ছিল না। তবে একটা ভাল জিনিস ছিল যে লেখাপডায় মোটামুটি ভাল হলে তখনকার ভারতে সহজেই সরকারি সাহায্য (স্কলারশিপের মাধ্যমে) পাওয়া যেত। আমাদের মত লোকেদের জন্য সেটা ছিল একটা বিরাট অবলম্বন। টাকাপয়সা বা সুযোগসুবিধে কম থাকলেও, চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা ছিল, নিজেদের দেশ এবং সংস্কৃতির ওপর একটা গর্ব ছিল। আমাদের রাজ্য আর শহর কলকাতা গানে, কবিতায় সাহিত্যচর্চায় সবথেকে এগিয়ে থাকত। এখন অনেককিছুই পাল্টে গেছে। এখনকার ভারতবর্ষ অনেক সফল, ধনী আর সরব, আগের মত নেই। লোকজন ও বেশ পাল্টে গেছে এই প্রজন্ম যেন কঠিন পরিশ্রম বা সহ্যশক্তি বা ধর্মনিরপেক্ষতাতে বিশ্বাসই করে না। আমি মাঝে মাঝে দেশটাকে চিনতেই পারি না।”
মিয়াকো ঘাড় নেড়ে বললেন “সব জায়গাই কেমন যেন পাল্টে গেছে, সেই মুল্যবোধ আর নেই। আমি এখানকার কাগজে পড়েছিলাম যে আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আবে সান তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। ভারতবর্ষের হিন্দু, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির অভাবের ব্যাপারেও একটা লেখা নিক্কেই শিনবুনে (জাপানের আনন্দবাজার পত্রিকার মতন) বেরিয়েছিল। তুমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াও বলে তোমার চোখে সেই পরিবর্তনটা হয়ত একটু বেশী নজরে পড়ে।”
অরি বলল,”আপনি হয়ত ঠিকই বলছেন, ওনিসান।”
অন্যদিক থেকে হিরোকোও সম্মতিসুচক মাথা নাড়লেন।

ফেরার পথের বাস রুটটি অপেক্ষাকৃত ছোট তাই কিছুক্ষনের মধ্যেই কারুইজাওয়া এসে গেল। দিদিরা আগে নামবেন আর অরি নামবে আরও দুটো স্টপ পরে কারুইজাওয়া স্টেশনে। অরি উঠে দাডিয়ে সদ্য পাওয়া দুই জাপানী দিদি কে বিদায় জানাল। উত্তরে মিয়াকো বললেন, “অরি, তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল।”
হিরোকো পুরো যাত্রাপথে চুপচাপ ছিলেন, মিয়াকোই বেশী কথা বলছিলেন। এবার হিরোকো ঘাড় নেড়ে বললেন, “সাধারন মানুষ সব জায়গাতেই সমান, অরি। তোমার সময়ের ভারতবর্ষের সঙ্গে আমাদের সময়ের জাপানের বাইরে থেকে অনেক পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু দুই দেশের মানুষগুলো ভেতরে হয়ত একইরকম। তুমি আমাদের থেকে বয়সে ছোট, তাই বলি, ভাল থেকো, সুস্থ থেকো আর তোমার দেশের মানুষের প্রতিনিধি হয়ে, তাদের সুখ, দুঃখের কথা নিয়ে আগামী দিনে আবার এদেশে এসো, এরকম যোগাযোগ কম্পিউটারে বা ফোনে হয় না।”

মিয়াকো ইতিমধ্যে বাস থেকে নেমে ফুটপাথে দাাড়িয়ে দিদির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, অরি কে এই কথাগুলো বলে হিরোকো কিতাগাওয়া ধীরে ধীরে বাসের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

© Ashish Basu 2023

Sahityika Admin

1 comment