জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক)
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
*******
নাইটহুড পরিত্যাগ
১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল, অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে যে ভয়ঙ্কর হত্যালীলা ঘটেছিলো তার কথা আমরা সবাই জানি। এরই প্রতিবাদে ৩০শে মে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজের দেওয়া মানের মুকুট ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, এসে দাঁড়ালেন লাঞ্ছিত স্বদেশবাসীর কাছে। নাইটহুড (Knighthood) ত্যাগ করে একটি চিঠি লিখেলেন তদানীন্তন বড়লাট চেমসফোর্ডকে। চিঠিটি ঐতিহাসিক। কঠোর শাস্তির ভয়ে, সারা ভারতের রাজনীতিবিদরা যখন নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে, তখন বাংলার এক কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হ’ল নির্ভীক ধিক্কারবাণী।
চিঠির শুরুটা এইরকম :
Your Excellency,
The enormity of the measures taken by the Government in the Punjab for quelling some local disturbance has, with a rude shock, revealed to our minds the helplessness of our position as British subjects in India. The disproportionate severity of the punishments inflicted upon the unfortunate people and the methods of carrying them out, we are convinced, are without parallel in the history of civilized governments, barring some conspicuous exceptions, recent and remote…….
6, Dwarkanath Tagore Lane, Calcutta, May 30, 1919
প্রশ্ন হ’ল রবীন্দ্রনাথ জানলেন কি করে এই বীভৎস অত্যাচারের কথা। দেশে তখন খবরের উপর প্রচন্ড সেন্সরশিপের পাহারা চলছে। পাঞ্জাবের থেকে কোন খবর, এমনকি চিঠিপত্রও বাংলায় আসছে না। এর উত্তর খুঁজতে অমল হোম আমাদের দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা : “জানো জালিয়ানওয়ালাবাগ ব্যাপারের সময়, তখনও ভালো করে খবর পৌঁছায়নি। আমি বোধহয় চৌধুরীদের [আশু চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরীদের কথাই যেন বলছেন মনে হয় ] ওখান থেকে খবর পাই, ভাল করে মনে নেই। শুনে মনে হতে লাগল – এর কোনো উপায় নেই ? কোনো প্রতিকার নেই ? কোনো উত্তর দিতে পারব না ? এও যদি নীরবে সইতে হয়, তা হ’লে জীবন ধারণ যে অসম্ভব হয়ে উঠবে।” [মৈত্রেয়ী দেবী – “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ”]
ভাইসরয়কে চিঠি লেখবার আটদিন আগে ২২শে মে – শান্তিনিকেতনে তখন অসহ্য গরম চলছে – রবীন্দ্রনাথ একখানা চিঠিতে তাঁর স্নেহাষ্পদা রাণুকে (পরবর্তীকালে লেডী রাণু মুখার্জী) লিখছেন (মেয়েটি তখন সিমলা পাহাড়ে) – “আকাশের এই প্রতাপ আমি একরকম সইতে পারি কিন্তু মর্ত্যের প্রতাপ আর সহ্য হয় না। তোমরা ত পাঞ্জাবেই আছো, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধ হয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার পাঁজর পুড়িয়ে দিলে। [ভানুসিংহের পত্রাবলী ]
রাতের পর রাত কবি ঘুমুতে পারছেন না। চলে এলেন কলকাতায়। দেখা করলেন তাঁর প্রীতিভাজন কোন একজন দেশ নেতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন: ” …..তাকে বল্লুম যে একটা প্রোটেস্ট মিটিংয়ের ব্যবস্থা কর, আমিও বলবো, তোমরাও বলবে।” নেতা মহাশয় রাজী হলেন না। দেশের বুকের উপর তখন ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া আইন (১৯১৫) চেপে বসে রয়েছে – কি জানি কি হয়। ভয়ে মুহ্যমান সারা দেশ। সি. এফ. এন্ডরুজ (C. F. Andrews) তখন ছিলেন কবির পাশে। তিনি লিখলেন: ” He tried to get up a public meeting of protest; but no one was willing to take the chair.”
শেষে ২৯শে রাত্রি কবি লিখলেন সেই বিখ্যাত চিঠি। কবি বলেছেন: ” রাত চারটের সময় চিঠি শেষ ক’রে আমি শুতে যেতে পেরেছিলুম। কাউকে বলিনি এ বিষয়ে। রথীদেরও নয়। জানি, এ সব ব্যাপারে বেশি পরামর্শ কিছু নয়। পাছে কেউ বাধা দেয় এই ছিল ভয়। “ [মৈত্রেয়ী দেবী – “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ”]
ভয় আত্মীয়-বন্ধুদেরও ছিল – আর ভয়ের কারণও ছিল যথেষ্ট । রাওলাট আইন তখন পাশ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে তিনি তাঁর এই চিঠির জন্য গ্রেপ্তার, সরাসরি-বিচার ও জেলের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক সেই সময় পাঞ্জাবে অনেকেই এর চেয়ে কম সরকার-বিরোধী কাজের জন্য যাবজ্জীবন দীপান্তর ও সম্পত্তি-বাজেয়াপ্ত শাস্তি পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ভয় পান নি। ৩০শে মে-র সকালে তিনি তাঁর লেখা চিঠিটি একবার শুধু এন্ডরুজ সাহেবকে দেখান। সাহেব অনুরোধ করলেন একটু মোলায়েম করে লিখতে। রবীন্দ্রনাথ সাহেবের দিকে যে ভাবে তাকিয়েছিলেন তা সাহেব কোনো দিনই ভুলতে পারেন নি – ” Such a look as I had never seen in the eyes of Gurudev before or after!”
নাইটহুড-ত্যাগ নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সরকারপক্ষ শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিয়ে তাকে আরও তীব্র করার নির্বুদ্ধিতা দেখায়নি – একে নীরবে উপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করেছিল। তবে ইংরেজ কিন্তু তাঁকে ক্ষমা করেনি। বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহের জন্য রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২১-এ আমেরিকায় গেছেন, তখন ব্রিটিশ কতৃপক্ষ নানাভাবে বাধা দিয়েছে। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি অনেক ইংরেজ বন্ধুদের উত্তাপের অভাব অনুভব করেছেন।
তিনি বলছেন -“ওদের ওটা খুব অপমান লেগেছিলো। তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে দেখলাম ওরা সে কথা ভুলতে পারছে না। ইংরেজ রাজভক্ত জাত; – রাজাকে প্রত্যাখ্যান তাই অত আঘাত দিয়েছিল ওদের। [মৈত্রেয়ী দেবী – “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ”]
*******
বিশ্বভারতী
১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ শান্তিনিকেতনের যে ইস্কুলটি (‘পূর্ব বিভাগ’) গত কুড়ি বছর ধরে বাংলায় তথা সারা বিশ্বে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিল তার সঙ্গে একটি কলেজ (‘উত্তর বিভাগ’) যোগ করে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বিবিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা করারও ব্যবস্থা করা হল। সর্বদা রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা ছিল পূর্ব-পশ্চিমের গুণীজ্ঞানীরা যেন শান্তিনিকেতনে সম্মিলিত হয়ে একে অন্যের সহযোগিতায় ব্যাপকতর সাধনায় নিযুক্ত হন। তিনি চেয়েছিলেন দেশ বিদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বভারতীতে এসে বিশ্ববরেণ্য এইসব পন্ডিতদের সাহচর্য লাভ করে, তাঁদের বক্তৃতা শুনে মনের বিস্তার ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ সে ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর সর্বশেষ কপর্দক দিয়ে। যদিও মনে রাখা উচিত যে এই সব বিশ্ববরেণ্য পন্ডিতরা সামান্যই দক্ষিণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া দিতেন।
প্রথম এসেছিলেন ফ্রান্স থেকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যলয়ের বিখ্যাত প্রাচ্য-বিদ্যাবিৎ অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি [Sylvain Lévi (১৮৬৩ – ১৯৩৫)], ভারতীয় সংস্কৃতির সর্ববিষয়ে লেভির অসামান্য পান্ডিত্য ছিল তো বটেই তাঁর সঙ্গে ছিল অসামান্য বৌদ্ধধর্মের জ্ঞান। তিনিই বোধহয় প্রথম বিদেশি অধ্যাপক যিনি শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করতে এসেছিলেন। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় বিদ্যাবিৎ ভিন্টারনিট্স্ [Moriz Winternitz (১৮৬৩-১৯৩৭)] এবং তাঁর ছাত্র লেজনী [Vincenc Lesný (১৮৮২ – ১৯৫৩)] বিশ্বভারতীতে এসে অধ্যাপনা করেন। ১৯২০ সালে চেকোস্লোভাকিয়াতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লেজনীর পরিচয় ঘটে।
নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ প্রাচীন লিপিবিৎ ও ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বজ্ঞ অধ্যাপক স্টেন কোনো [Sten Konow ১৮৬৭ – ১৯৪৮)] বিশ্বভারতীতে এসে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রধানত তিনি ভারতীয় ধর্মবিষয়ক চিন্তার বিকাশ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন, খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত বৌদ্ধশাস্ত্র ধর্মপদের ব্যাখ্যা করেন। চীনদেশ থেকে চৈনিক অধ্যাপক ঙো চিয়াং লিম্ মহাশয় এসে চীনা ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন এবং চীনের সাহিত্য ও সভ্যতা সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়েছেন। ফ্রান্সের অধ্যাপক বেনোয়া [Fernand Benoit (১৮৯২-১৯৬৯)] শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে থেকে ছাত্রদের ফরাসি ও জার্মান শেখাতেন।
বিদেশ থেকে আরও অনেক জ্ঞানীগুণীজনেরা এসেছেন বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করতে। কয়টি উল্ল্যেখযোগ্য নাম হল : ইতালি থেকে ফরমীকি [Carlo Formichi (১৮৭১ – ১৯৪৩)] এবং আচার্য তুচ্চি [Giuseppe Tucci (১৮৯৪ – ১৯৮৪)], রাশান অধ্যাপক ইগর বগদানোভ (Igor Bogdanov ), এসেছেন স্টেলা ক্রামরিশ [Stella Kramrisch (১৮৯৬ – ১৯৯৩)], আঁদ্রে কার্পেলেস [Andrée Karpèles (১৮৮৫ – ১৯৫৬)] এবং আরও অনেকে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এঁদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের জন্য ছাত্র কোথায়? এই ব্যাপারে সৈয়দ মুজতবা আলী একটা ঘটনার কথা বলেছেন। সেবার সিলভাঁ লেভি তাঁর প্রথম বক্তৃতা দেবেন শান্তিনিকেতনে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পৃথিবীবিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত আসছেন অথচ বিশ্বভারতীতে তখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বারো জনও হবে না। তার মধ্যে সংস্কৃত পড়তেন মাত্র চারজন। এই চারজনের সামনে (অবশ্য পন্ডিতরাও উপস্থিত থাকবেন) বক্তৃতা দেবেন ভুবনবিখ্যাত পন্ডিত লেভি !
রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করলেন যাতে সেখানকার ছাত্ররা এসে সপ্তাহে অন্তত লেভির একটি বক্তৃতা শুনে যেতে পারে। ব্যবস্থা হল রবিবার লেভি বক্তৃতা দেবেন যাতে কলকাতার ছাত্ররা শনিবারের বিকেলের কিংবা রবিবারের সকালের ট্রেনে এসে লেভির বক্তৃতা শোনবার সুযোগ পায়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ খবর নিয়ে জানলেন লেভির প্রথম বক্তৃতা শুনতে কলকাতা থেকে মাত্র দুটি ছাত্র এসেছে। তারও একজন রসায়নের ছাত্র – আর পাঁচজন যেমন ‘বোলপুর দেখতে’ আসে এই সুযোগে সেও সেই রকম এসেছে। রবীন্দ্রনাথ বড় মর্মাহত হলেন। হাতে খাতাকলম নিয়ে লেভির প্রথম বক্তৃতা শুনতে বেরিয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ; ক্লাসের পুরোভাগে গিয়ে বসে পড়লেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেখানে ছাত্রের আসনে বসেছেন সেখানে লেভির কোনো খেদ না থাকবারই কথা।
******
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১. পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ – অমল হোম, প্রকাশক : এম্ সি সরকার এন্ড সন্স লিঃ ।
২. মংপুতে রবীন্দ্রনাথ – মৈত্রেয়ী দেবী, প্রকাশক : প্রজ্ঞা প্রকাশনী ।
৩. ভানুসিংহের পত্রাবলী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থন-বিভাগ।
৪. রবিজীবনী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা – ৪২২ – প্রশান্তকুমার পাল, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
৫. ‘বিশ্বভারতী’ – সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, প্রথম খন্ড, প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
৬. রবিজীবনী, নবম খন্ড, – প্রশান্তকুমার পাল, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
৭. রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
৮. সাময়িকপত্রে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ – প্রবাসী।
Jana Ajana Rabindranath Thakur khoob valo légéché