এলোমেলো বেড়ানোর গল্প (ধারাবাহিক, চতুর্থ পর্ব)
অমিতাভ রায়, ১৯৭৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আগের পর্ব পড়তে হলে, লিংক
https://sahityika.in/2023/12/22/এলোমেলো-বেড়ানোর-গল্প-ধা-2/
প্রাচীন পাটন ও আধুনিক লেহ্
আগের পর্বে বলেছিলাম অভিশপ্ত তানোট গ্রামের কথা।
অভিশাপের ফলাফল দেখার আরও ইচ্ছে থাকলে এবার পাটনে আসুন। কোথায়? পাটোলা শাড়ি নিয়ে হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি করতে পারেন আর খবর রাখেন না শাড়িটা কোথায় তৈরি হয়! একটু অনুসন্ধান করলেই জেনে যাবেন যে গুজরাতের প্রাচীন রাজধানী পাটন শহরেই তৈরি হয় পাটোলা ঘরানার শাড়ি। অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রায় ছশো বছর ধরে সিন্ধু সরস্বতী অববাহিকায় সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত পাটন শহর ছিল গুজরাতের রাজধানী। চাওদা, সোলাঙ্কি, ভাগেলা প্রমুখ রাজবংশের রাজারা পাটন থেকেই রাজত্ব চালাতেন। স্বাভাবিক কারণেই রাজ উদ্যোগে এখানে গড়ে ওঠে মন্দির প্রাসাদ–জলাশয় সহ বহু উন্নতমানের স্থাপত্য। প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এককালে পাটন শহরে ছিল বাহান্নটা বাজার এবং সোনা–রুপোর মুদ্রা নির্মাণের টাঁকশাল।
রানি কি ভাও-এর দেওয়ালে কারুকাজ।
অনেকদিন আগেই রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে যাওয়ায় এখনকার পাটন ধূলায় ধূসরিত এক ছোট্ট জনপদ। তবে এখনও দেখতে পাবেন ছড়িয়ে থাকা সেইসব অনবদ্য কীর্তি। এখানকার শতাধিক জৈন মন্দির, বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দির, ডজনখানেক মসজিদ প্রভৃতি এখনও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। খুঁজে পাবেন রানি কি ভাও, সহস্রলিঙ্গ তালাও, খান সরোবর, হেমচন্দ্রাচার্য জ্ঞানমন্দির ইত্যাদি। হেমচন্দ্রাচার্য জ্ঞানমন্দির কিন্তু কোনও প্রথাগত পূজা–অর্চনা গৃহ নয়। এখানে খুঁজে পাবেন সহস্রাধিক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি যেগুলি সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রচিত। আর জানতে পারবেন যে প্রখ্যাত পণ্ডিত হেমচন্দ্রাচার্য এখানে জ্ঞানচর্চার সময় প্রণয়ন করেন গুজরাতি ভাষার প্রথম ব্যাকরণ।
প্রতিটি মন্দির–মসজিদ–জলাশয়ের আলাদা ইতিহাস থাকলেও আমাদের গন্তব্য শহরের এক অভিশপ্ত জলাশয়। সিদ্ধরাজ জয় সিংহ পাটন শহরে একটি পঞ্চভূজাকৃতি জলাশয় নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পাঁচ কিলোমিটার দূরের সরস্বতী নদী থেকে পাথরের তৈরি নালি দিয়ে এখানে জল আনার বন্দোবস্ত হয়। জলাশয়টির চারধারে একহাজার শিবলিঙ্গ স্থাপিত হয়েছিল বলে এই জলাধারটি ‘সহস্রলিঙ্গ তালাও’ নামে পরিচিতি পায়। জলাশয়টি খননের সময় গুজরাতের ওড জনজাতির শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়েছিল। এদের মধ্যেই ছিলেন শ্রমিক রমণী জাসমা। জনশ্রুতি, পূর্বজন্মে জাসমা ছিলেন এক অপ্সরা। দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে ওড জনজাতির একজন হয়ে মানবজন্ম পান জাসমা। এবং ওড জনজাতির জনৈক রুদা–র সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামীর সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছিলেন জাসমা। তারপর যা হয় আর কী! রাজা জয় সিংহের নজর পড়ল জাসমার উপর। রাজসভা থেকে জাসমাকে রানি হওয়ার প্রস্তাব জানানো হল। জাসমা আপত্তি জানালেন। রাজা জোরাজুরি করায় জাসমা অগ্রিম পারিশ্রমিক রাজদরবারে ফেরত দিয়ে এসে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হলেন।
পাটনের সহস্রলিঙ্গ তালাওয়ের ধ্বংসাবশেষ।
মারা যাওয়ার আগে জাসমা অবশ্যই অভিশাপ দিয়ে যেতে ভোলেননি। প্রথম অভিশাপে ‘সহস্ৰলিঙ্গ তালাও’জলশূন্য হয় আর পরবর্তী অভিশাপের ফলেই নাকি রাজা জয় সিংহ নির্বংশ হন। আর সেই থেকেই সহস্রলিঙ্গ তালাও পুরোপুরি জলশূন্য। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে এতদিন পরেও জলশূন্য জলাধারাটি কিন্তু সু–সংরক্ষিত। দ্বাদশ শতাব্দীতে জাসমাকে দেবী বলে স্বীকৃতি দিয়ে সহস্রলিঙ্গ তালাও–এর পাশে একটি মন্দির গড়ে দেওয়া হয়। এই জনশ্রুতি– লোককথার সত্যাসত্য বিচার করতে হলে আপনাকে একবার পাটন আসতে হবে। আমদাবাদ থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরের পাটন শহর রেলপথে সংযুক্ত। কোন ট্রেন আসে? সে তো টাইম টেবল বলবে। এই ওয়েবসাইটের যুগেও রেলের টাইম টেবল বা সময় সারণি প্রকাশিত হয় বা বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ করতে হয়। না হলে বুঝবেন কী করে কোন গাড়ি কত দেরিতে চলছে।
শীতল মরুভূমি লেহ্, যেকানে বৃষ্টি এক বিরল ঘটনা।
রাতারাতি কোনও জনপদ জনশূন্য হওয়া বা জলাশয়ের জলশূন্য হয়ে যাওয়া নিয়ে গল্পকথা বা লোকশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে কিন্তু এমন ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়। সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখতে হলে আপনাকে একবার অন্তত লেহ্ যেতে হবে। ২০১০-এর ৬ আগস্ট ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা হড়পা বানের দাপটে হিমালয় পর্বতমালার কোলে গড়ে ওঠা লেহ্ শহরের একাংশ, শহরতলি এবং আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম চিরতরে হারিয়ে গেছে। তখনকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ বিভাগের সবচেয়ে বড়ো শহর লেহ্। মায়াবী শহর লেহ্ বহুদিন ধরেই দেশি–বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য। প্রতি বছর জুলাই–আগস্ট মাসে গড়ে লাখখানেক না হলেও হাজার আশি–নব্বই পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। এখানে বৃষ্টি এতই কম হয় যে সমুদ্রতল থেকে সাড়ে এগারো হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লেহ্ ‘শীতল মরুভূমি’ বলে পরিচিত। আর মুষলধারা বৃষ্টি এখানে নাকি এক বিরল ঘটনা। সেই কবে ত্রিশের দশকে একবার হয়েছিল বলে সরকারি নথিতে লেখা আছে। অনেক খোঁজাখুজি করেও এমন একজনের সঙ্গে মোলাকাত হবে না যিনি নিজে তো নয়ই এমনকী বাপ–ঠাকুরদার কাছে অন্তত তেমন কোনও ভারী বর্ষণের কথা শুনেছেন। কাজেই স্থানীয় মানুষ বৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামায় না।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ বিভাগের সবচেয়ে বড়ো শহর লেহ্। মায়াবী শহর লেহ্ বহুদিন ধরেই দেশি বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য। প্রতি বছর জুলাই-আগস্ট মাসে গড়ে লাখখানেক না হলেও হাজার আশি-নব্বই পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। এখানে বৃষ্টি এতই কম হয় যে সমুদ্রতল থেকে সাড়ে এগারো হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লেহ্ ‘শীতল মরুভূমি’ বলে পরিচিত। আর মুষলধারা বৃষ্টি এখানে নাকি এক বিরল ঘটনা। সেই কবে ত্রিশের দশকে একবার হয়েছিল বলে সরকারি নথিতে লেখা আছে।
সত্যিই তো! যা নেই তা নিয়ে অযথা ভাবনাচিন্তার কী দরকার! কেন কে জানে সকলকে চমকে দিয়ে হঠাৎ করেই সিন্ধু নদের ধারে লেহ্ উপত্যকায় শুরু হল বৃষ্টি। ৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত দশটা নাগাদ শুরু হল ঝিরঝিরে বারিবর্ষণ। শহরবাসী তো বটেই, হাজার তিনেক পর্যটকের কেউই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়নি। সেই বৃষ্টিই যে ঘণ্টা দু’আড়াই বাদে এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে শুরু হল তীব্র বেগের ঝোড়ো হাওয়া। এতেও শেষ নয়। ঘন ঘন প্রবল বজ্রপাতের আওয়াজে সকলের রাতের ঘুম ভেঙে গেল। আর সবশেষে রাত দেড়টা নাগাদ ঘটে গেল সেই মারাত্মক ঘটনা। প্রচণ্ড শব্দ করে শুরু হল প্রবল মেঘভাঙা বৃষ্টি। কোনও বিকট বিস্ফোরণের শব্দের তীব্রতাকে হার মানিয়ে দেওয়া মেঘ ভাঙার আওয়াজে সকলেই আতঙ্কিত। ততক্ষণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। টেলিফোন মূক। মুঠোফোন নীরব। ভীত–সন্ত্রস্ত মানুষ কিছু বোঝার আগেই শুরু হয়ে যায় হড়পা বানের তাণ্ডব। প্রাণরক্ষায় ছোটাছুটি শুরু করার আগেই প্রবল বেগে ধাবমান জল ও ঘন কাদার তলায় হারিয়ে গেল অন্তত আড়াইশো মানুষ।
অনেকের মতে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ বহু মানুষ নিখোঁজ হলেও অনেক দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পনেরো–কুড়ি কিলোমিটার উচ্চতাসম্পন্ন এক বিশাল স্তম্ভ আকারের মেঘ সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে আকাশে ভাসতে ভাসতে গ্রাম–শহর বন–জঙ্গল পেরিয়ে সমভূমি ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে। এক সময়ে জল সম্পৃক্ত মেঘের ওজন এতই বেড়ে যায় যে জল ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন অনেক উঁচুতে থাকা ওই ভারী মেঘ সশব্দে ফেটে পড়ে। এত প্রকাণ্ড আকারের মেঘ যে বিপুল পরিমাণ জল ধারণ করেছিল, তা পাহাড়ের আশপাশের কোনও ছোট এলাকায় একবারেই ঝরে পড়ে। ফলাফল, মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কোনও ছোট জায়গায় ঘণ্টায় আনুমানিক একশো মিলিমিটার হারে বর্ষণ শুরু হয়। সঙ্গে থাকে তীব্র ঝোড়ো হাওয়া এবং অবশ্যই বজ্রপাত। প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে প্রকৃতি আচমকা এমন আঘাত হানলে তাকে প্রতিরোধ করার সাধ্য কি মানুষের আছে?
লেহ্-এর নুব্রা উপত্যকা। বৃষ্টিপাতশূন্য অঞ্চল।
এইরকমই এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল লেহ্। শহরতলির গ্রাম চোগলামসার হারিয়ে গেল। দুর্যোগের পরের দিন সকালে দেখা গেল, কাদার আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে পাহাড়ি গ্রাম চোগলামসার।
জায়গা বিশেষে কাদার গভীরতা দশ ফুট বা তার চেয়ে সামান্য বেশি। আর সেই কর্দমাক্ত প্রান্তরে টুপির মতো শোভা পাচ্ছে কিছু ধাতব ঢাকনা। বাস্তবে ওগুলো ছিল কাদায় গেঁথে যাওয়া বাড়িগুলির টিনের চাল। যে সমস্ত জায়গায় বরফ পড়ে সেখানকার গরিব মানুষ একটু উষ্ণতার খোঁজে বাড়ির দেওয়ালের দু’পাশেই মাটির পলেস্তারা লাগিয়ে দেয়। প্রচণ্ড জলের তোড়ের সামনে সেই মাটি লেপা বাড়িগুলি কতক্ষণ আর অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে! মেঘ ভাঙা জলের সঙ্গে গলে যাওয়া মাটি মিলেমিশে হয়ে গেল থকথকে কাদার প্রবাহ। কাজেই এক লহমায় হারিয়ে গেল একটা গোটা গ্রাম। সোবু, ফিয়াং, নিম্মু, নিয়ে এবং বাসগো গ্রামের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট। কাছাকাছির মধ্যে অবস্থিত চাংলা পাস্ বরাবর যেসব ছোট ছোট গ্রামগুলি ছিল সেগুলিও হড়পা বানের দাপটে কোথায় যে হারিয়ে গেল কে জানে। লেহ্ শহরেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। হাসপাতাল, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেডিও স্টেশন, বাস টার্মিনাস, সেতু ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোটাং পাসের দিক থেকে এবং শ্রীনগর থেকে জোজি লা হয়ে লেহ্ আসার সড়কটি বানের ধাক্কায় ভেসে যায়। কার্গিলের রাস্তায় সেতুটি উপড়ে পড়ে। বিদ্যুৎ সরবরাহের টাওয়ারগুলি যে কোথায় ছিটকে পড়েছিল, বলা মুশকিল। মোবাইল ফোনের টাওয়ারগুলো বোধ হয় হাওয়াতেই উড়ে যায়। পাহাড় ঘেঁষে তৈরি হওয়া নতুন বাস টর্মিনাসের ওপর ধসে পড়ে পাহাড়েরই একটা বড়ো অংশ। পাশেই ছিল একটি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সেটিও গুঁড়িয়ে যায়। ঘন কাদার মধ্যে আটকে পড়ে অসংখ্য গাড়ি। কাদায় ডুবে থাকায় গাড়িগুলি দেখা না গেলেও তাদের ছাদ দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল যে অনেক গাড়ি ওখানে গেঁথে আছে। লেহ্ শহরের ছোট্ট বিমানবন্দরের রানওয়ে কাদায় ডুবে গেলেও বোর্ডটা অক্ষত থাকায় পড়া যাচ্ছিল– কুশক বাকুলা রিমপোচে এয়ারপোর্ট ।
মায়াবি লেহ্।
অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রেক্ষাপটে সাজিয়ে গুজিয়ে গড়ে উঠেছিল মায়াবী শহর লেহ্। প্রকৃতির রুদ্ররোষে ধ্বংসের করাল ছায়ায় রাতারাতি হারিয়ে যায় সেই জনপদ। প্রশাসনিক এবং পর্যটনের প্রয়োজনে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শুরু হয় লেহ্ শহরের পুনর্নির্মাণ। তবে লেহ্ শহরের শহরতলির অবলুপ্ত জনপদগুলিকে পুনরুদ্ধারের তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আশঙ্কা হয় একদিন এই হারিয়ে যাওয়া জনপদগুলিকে নিয়েই হয়তো আবার গড়ে উঠবে কোনো নতুন গল্পগাথা। এবং সেই নতুন যুগের ভোরে অথবা সূর্যাস্তের পরে এখানে কৌতূহলী মানুষ ছুটে আসবে নতুন কোনো অলৌকিক গল্পের সন্ধানে।
********
Add comment