ইঁদুর
সুদীপ রায়, ১৯৭০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
‘শালা, আজও কিছু হল না?’
সকালে উঠেই দেবেশের মাথায় আবার চাড়া দিলো, ‘রমা ডার্লিং, দেখেছ কী কান্ড … কী ধড়িবাজ ইঁদুর রে বাবা … আজ তিন দিন হয়ে গেল, ওষুধ দেওয়া বিস্কুটটা যেমন কে তেমনই পড়ে থাকছে। ওদিকে তোমার ঠাকুরের আসন থেকে সন্দেশটা ঠিক খেয়ে গেছে। নাহ, ইঁদুর মারার বিষে এটাকে বাগে আনা যাবে না, শেষ পর্যন্ত সেই গাঁটের পয়সা খরচা করে ইঁদুর ধরার কলই কিনতে হবে।’
দেবেশ ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাবার সময়ে ছোট ঘরটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিরাশ গলায় এতগুলো কথা রমাকে বলল।
রমা কোনো উত্তরই দিল না, ওভেনে চায়ের জল চাপাতে চাপাতে নিজের মনেই বলল ‘ইসস … রান্নাঘরের কী অবস্থা করেছে। ডালের প্যাকেট দাঁতে কেটে চারদিক ডালে ডালাক্কার করে রেখে গেছে। কী যে করি!’
কিছুদিন হলো দেবেশ-রমার বাড়িতে ইঁদুরের চরম উপদ্রব শুরু হয়েছে। ওঁরা দুজনেই ইঁদুর দুটোকে প্রায়ই ছোটাছুটি করতে দেখছে, কিন্তু শত চেষ্টাতেও কিছুতেই তাড়াতে বা মারতে পারছে না। মাঝখান থেকে দুদিন আগে ইঁদুর মারার বৃথা চেষ্টায় ইঁদুরের দিকে দেবেশের ছুঁড়ে মারা জুতোয় সিরামিকের একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাস ভেঙেছে।
‘কে জানে ইঁদুর মারার বিষেই হয়তো ভেজাল। শালা ফোরটোয়েন্টিতে দেশ ভরে গেছে। ওষুধের গন্ধেই হয়তো ইঁদুর পালাচ্ছে। আর এসব কেমিক্যাল ফেমিক্যাল নয়, আজ আমি অফিস ফেরতা ইঁদুরের কল কিনে আনব। ও ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই’ দেবেশ দাঁত মাজতে মাজতে বলল।
চা খেতে খেতে ভটচাজের ফোন এল ‘দাদা নমস্কার, অনিল ভটচাজ বলছি। থ্যাঙ্ক ইউ দাদা। কাল অর্ডার কপি পেয়েছি। সব ঠিকঠাক আছে। আমার কথারও নড়চড় হবে না। পঞ্চাশ হাজার রেডি আছে। কখন, কোথায় কিভাবে টাকাটা দিতে হবে যদি বলেন।’
এসব কথাবার্তা রমার সামনে করা যায় না। দেবেশ ফোন হাতে ব্যালকনি তে চলে এলো। আজ সারাদিন অফিসে পারচেজ কমিটির মিটিং আছে জিএম সাহেবের অফিসে। আজ সময় হবে না। কাল বিকেলে বরং ভটচাজকে আসতে বলা যাক অফিসে। দেবেশ উঠে চলে গেলেও রমা কান খাড়া করে রইল দেবেশ কী কথা বলে তা শোনার জন্য। দেবেশ না জানলেও রমা তার স্বামী অবতারটিকে ভাল করেই চেনে।
‘হ্যাঁ ভটচাজবাবু, কাল বিকেলে ঠিক চারটের সময়ে টাকাটা নিয়ে আসুন আমার চেম্বারে, পাঁচশোর বান্ডিল আনবেন।’
‘ওকে, ডান। কাল চারটের সময়ই আসছি।’ বলে ভটচাজ ফোন রেখে দিলো।
কাল শনিবার। প্রতি শনিবার লাঞ্চের পরে অর্ডার স্ট্যাটাস রিভিউ করতে জি এম সেনগুপ্ত সাহেব সেলস অফিসে যান। টপ বস থাকবে না, তাই দু নম্বরী লেনদেনের জন্য ওটাই প্রশস্ত সময়।
ফোন রেখে দেবেশ ফিরে এল চায়ের কাপে। সকাল সকালই আজ মেজাজটা আতর হয়ে গেল। ভটচাজ নতুন পার্টি। অফিসে কম্প্যুটার স্টেশনারি এন্ড একসেসারি সাপ্লায়ের জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছিল। আগের পুরনো সাপ্লায়ার বসাক বখরার পারসেন্টেজ নিয়ে গড়বড় করতে শুরু করল। শালা, হারামজাদা এটা ওটা বলে দেবেশের কমিশন কমাতে চায়। দেবেশের কপাল ভাল, নতুন পার্টি ভটচাজের কোটেশন হলো এল ওয়ান। আর দেবেশ সময়মত ভটচাজকে ডেকে পারসেন্টেজ কমিশনও ঠিক করে ফেলেছে। এল ওয়ান কোটেশনে টেন্ডার কমিটিকে দিয়ে অর্ডার পাস করিয়ে নিতে কোনো অসুবিধেই হলো না দেবেশের।
ফোনে অনিলের সঙ্গে দেবেশের কথা শুনে রমার গা ঘিনঘিন করে উঠল। আবার সেই নোংরা কালো টাকা ঘরে ঢুকবে আর সেই টাকায় রমা সংসার চালাবে। দেবেশ অফিসে বেরিয়ে যেতেই রমা ফোন লাগালো হোটেল বসেরায়।
বিকেলে দেবেশের কাছে অফিসে ফোন এল রমার। ইঁদুর মারার কল আনার কথাটা মনে করিয়ে দিলো। আর দেবেশ অফিস ফেরতা বাড়ি ফিরল ইঁদুর মারার কল আর বড় সাইজের একখানা ইলিশ মাছ নিয়ে। কাল ঘরে লক্ষ্মী আসছে ভটচাজের হাত ধরে। দেবেশের আজ দিল দরিয়া।
মাছটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে আরো একবার গা গুলিয়ে উঠল রমার। রমা খুব ভালো করেই জানে যে ইলিশ’টা কেনা হয়েছে ঘুষের টাকায়। দেবেশ রমাকে কিছু না বললেও রমা গত কয়েকবছর ধরেই এম এম কন্ট্রোল এন্ড কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার দেবেশ রায়ের উপরি রোজগারের ব্যাপারটা জানে। টাকার গন্ধ পেলে লোকটা যে কোনো নোংরা কাজ করতে পিছপা হয় না। মাস তিনেক হল দেবেশ অফিসকে লুকিয়ে বেনামে হলদিয়ার সুদেশ বেরার সাথে পার্টনারশিপে সাপ্লাই এজেন্সি খুলেছে। রুংটা স্টীলের একটা বড় অর্ডার ধরতে কার্যসিদ্ধির জন্য একবার রমাকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে চেয়েছিল। রমা শক্তভাবে মুখের ওপর না বলে দেওয়ায় সেবার কিছু করতে পারে নি। কিন্তু তার পর থেকেই রমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে রমা, দেবেশ রমাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মনে মনে ফন্দি আঁটছে। লোকটার সঙ্গে এক বিছানায় শুতেও আজকাল ঘেন্না হয় রমার। ইসস, বিয়ের সময়ে কেন যে রমা বাড়িতে বাবলদার সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে স্ট্রং স্ট্যান্স নিতে পারে নি। বাবলা রমার বাড়িতে দেখা করতে চেয়েছিল। গোলমালের ভয়ে রমাই মানা করে দেয়। তখন বাবলাদাকে বিয়ে করলে হয়তো টাকাপয়সার দিক থেকে এত প্রাচুর্য থাকত না, কিন্তু নোংরা পয়সায় হাত ময়লাও তো করতে হত না। সবচেয়ে বড় কথা মনের মানুষটাকে পাওয়ার সুখটা তো পেত। দেবেশ লোকটাকে আজকাল দেখলেই বমি পায় রমার। টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না দেবেশ।
রাতে ইঁদুর মারার কলটাকে ফিট করে দুরুদুরু বুকে দেবেশ শুতে এল। কে জানে এতে কাজ হবে কিনা। যা খচ্চর সেয়ানা ইঁদুর … ধরা পড়বে কিনা কে জানে।
রমাও শুয়ে শুয়ে ওই একই কথা ভাবছিল … ইঁদুর ধরা পড়লে হয়। তাহলে একটু স্বস্তি আসে।
সকাল হতেই রমার ঘুম ভাংলো দেবেশের চিৎকারে। চেঁচিয়ে দেবেশ বাড়ি মাত করছে ‘রমা এদিকে এসে দেখে যাও একবার। ব্যাটাচ্ছেলে কলে আটকেছে। বার বার বাছা তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার এইবার বধিব পরাণ।’
রমা উঠে দেখল যে সত্যিই একটা ধেড়ে ইঁদুর কলের ভেতরে ধরা পড়েছে। জুলজুল করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘ওটা এখন এভাবেই থাক। বেলায় বিশু জমাদার এলে ওকে বল, ইঁদুরটাকে যেন মেরে বাইরে ফেলে দেয়।’
দেবেশ রমাকে কথাটা বলে দাঁত মাজতে চলে গেল। ইঁদুরটার কাতর চোখ দেখে রমার মনটা কেমন যেন একটু নরম হয়ে গেছল। পরমুহূর্তেই মনটা শক্ত করে নিল। তবে ইঁদুরটাকে প্রাণে মারবে না। কাজের মাসি এলে দূরে কোথাও গিয়ে ইঁদুরটাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে। জোড়াটাকে দেখতে না পেলে অন্য ইঁদুরটাও চলে যাবে নিশ্চয়ই।
ব্রেকফাস্ট করে দেবেশ হাসিমুখে অফিসে বেরিয়ে গেল। আজ ভটচাজ নগদ নারায়ণ নিয়ে আসছে … কী আনন্দ … কী আনন্দ।
লাঞ্চের পরে তিনটের সময়ে দেবেশ দেখল নিয়মমাফিক সেনগুপ্ত সাহেব অফিস থেকে সেলস অফিসের মিটিঙে বেরিয়ে গেলেন। আর বিকেল ঠিক চারটের সময় দেবেশের চেম্বারে ডাক পড়ল অনিল ভটচাজের।
‘দাদা প্যাকেটে পঞ্চাশ আছে। গুনে নিতে পারেন।‘
‘আরে না না, কোন দরকার নেই। এসব ব্যাপারে মিউচুয়াল বিশ্বাসই হলগে আসল ক্যাপিটাল।‘ একগাল হেসে টাকার প্যাকেটটা টেবিলের ডানদিকের ড্রয়ারে ঢোকাতে ঢোকাতে দেবেশ বলল।
‘তাহলে আজ উঠি দাদা। পরের বারেও কাইন্ডলি মনে রাখবেন।‘
ভটচাজ উঠে দরজা খুলে বেরুচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই সেনগুপ্ত সাহেব ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে দুজন সাদা পোষাকের পুলিশ।‘
‘আপনার ঘর সার্চ করা হবে মিঃ রায়। আর আপনিও দাঁড়ান।‘ শেষের কথাটা ভটচাজের উদ্দেশ্যে।
ড্রয়ার খুলতেই পঞ্চাশ হাজারের বান্ডিল বেরুল। পুলিশের সঙ্গে নোটের নম্বর গুলো মিলিয়ে নিলেন সেনগুপ্ত সাহেব ।‘
‘এ টাকার হিসেব আপনি দিতে পারবেন মিঃ রায়?’ সেনগুপ্ত সাহেব সোজা দেবেশকে প্রশ্ন করলেন।
দেবেশ কোনই উত্তর দিতে পারল না। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েছে দেবেশ।
‘ইউ আর আন্ডার এরেস্ট মিঃ রায় অন গ্রাফটীং চার্জ। ঘুষ নেবার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হল।‘ সাদা কাপড়ের একজন পুলিশ অফিসার বললেন।
‘ম্যানেজমেন্টের কাছে আপনার সম্বন্ধে এর আগেও গ্র্যাফটিং এর কমপ্লেইন এসেছিল। এতদিন প্রমাণ পাচ্ছিলাম না। আজ আপনি ধরা পড়লেন।‘ সেনগুপ্ত সাহেব বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে দেবেশের দিকে তাকিয়ে বললেন।
ভটচাজের দিকে তাকিয়ে এবারে সেনগুপ্ত সাহেব বললেন ‘থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ ভট্টাচারিয়া। আপনি হেল্প না করলে এই লোকটাকে হাতেনাতে ধরতে পারতাম না। আপনি রিসেপশনে একটু অপেক্ষা করুন।‘
‘সার, আমি যদি একটু আপনার সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলতে পারি।‘ দেবেশ মরিয়া হয়ে একবার শেষ চেষ্টা করল।
‘কোনো কথা নয়। অফিসার, প্লীজ এরেস্ট হিম।‘
পাঁচ মিনিট পরে রমার কাছে ফোন এল, ‘রমা, আমি বাবলা’দা বলছি দেবেশের অফিসের রিসেপশন থেকে। এভরিথিং ওয়েন্ট এজ পার প্ল্যান। হি হ্যাজ বীন কট রেড হ্যান্ডেড এন্ড এরেস্টেড। আমি আবার বলছি তোমার অবস্থাটা বূঝতে পেরে, তোমার অনুরোধেই এই আনপ্রোফেশনাল কাজটা আমি করলাম। কিন্তু এটাও সত্যি এবার গঙ্গাস্নান করে আমার পাপস্খালন করতে হবে। কি বলছ … না না আমি বসেরা থেকে চেক আউট করে আজ রাতের ট্রেনেই বহরমপুরে মেসে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি এবারে সমস্ত জিনিসটা কীভাবে হ্যান্ডেল করবে আমি ভেবে পাচ্ছি না। অসুবিধেয় পড়লে, আমার হেল্পের আবার দরকার হলে জানিও। আই’ল বী এট ইওর সাইড অলওয়েজ। বাই ফর নাউ। ‘
‘থ্যাঙ্ক ইউ বাবলাদা। আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। হী ডিজারভড আ পানিশমেন্ট এন্ড হী গট ইট। আমি খুশি যে নোংরা ইঁদুরটা এট লাস্ট ধরা পড়ল। থ্যাঙ্ক ইউ ওয়ান্স এগেইন। বাই।‘ রমা অন্যমনস্কভাবে ম্লান হেসে বলল।
২৪ অক্টোবর ২০২২
দারুণ
একেবারে পাকা হাতের লেখা ।