ছেলেবেলার ভূত
দেবাশীষ তেওয়ারি, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
এখন ভূত কোথায়? কিন্তু আমাদের যখন ছেলেবেলা তখন যেখানে সেখানে ভূত ঘুরে বেড়াত আর লোকে ভুতে বিশ্বাসও করত, ভয়ও পেত খুব।
আমাদের বাড়ী ছিল যাকে বলে চক মিলানো বাড়ী। ষাট ফিট চৌকো এক উঠোন, আর তার চারদিকে বাড়ী। দক্ষিণদিক শীতকালে রোদ গরমকালে হাওয়া আসার জন্যে একতলা, বাকী তিনদিক দোতলা। উত্তরে, পশ্চিমে বিশাল বড় বড় সব করিডোর বা বারান্দা, আমরা বলতাম পিঁড়ে, আর সেই পিঁড়ের পরে ছিল ঘর গুলো। বাড়ীর লোকেরা থাকত দোতলায়, একতলায় ছিল রান্নাঘর, খাবার ঘর, বিভিন্ন ভাণ্ডার ঘর, এছাড়াও বেশকিছু ছোট বড় শোবার ঘর যার কয়েকটাতে থাকত আমাদের কিছু সম্পর্কে আত্মীয়। চাকর বাকরেরা থাকত পিঁড়েতে। মোট বাসিন্দার তুলনায় বাড়ী বড় হওয়ায় বেশীরভাগ জায়গায় ফাঁকা পড়ে থাকত আর সেইজন্যে বিশেষকরে ঝি চাকরেরা হামেশায় ভূত দেখত। প্রায় শুনতাম চারুর মাকে (কাজের মেয়ে) দুপুর বেলা একা পেয়ে পেত্নী হেসেছে কিংবা চামেলিকে (আর এক কাজের মেয়ে) নিশি ডেকে প্রায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ তার হুঁশ ফিরে আসে বলে রক্ষা পায়। কিন্তু তাদের নিয়ে এই লেখা নয়।
যে কজন আত্মীয় একতলায় থাকত তার মধ্যে একজন ছিল ম্যানা বাবু, আমাদের সম্পর্কে জ্যাঠা। বিপত্নীক জ্যাঠা তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে এক তলার দুটো ঘর নিয়ে থাকত। তা জ্যাঠার একটু পানদোষ ছিল। প্রতি শনিবার রাত্রে পানটান করে এক ভাঁড় করে মাংস নিয়ে জ্যাঠা বাড়ী ফিরে একা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ত। এই রকমই এক শনিবার বাইরে মদটদ খেয়ে আমাদের জ্যাঠা বাড়ী ফিরছিল, হাতে বরাবরের মত এক ভাঁড় মাংস। শীতের রাত। জ্যাঠার একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, নেশাটাও বেশ জমেছিল। মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা থেকে গেট দিয়ে আমাদের কম্পাউন্ডে ঢোকার পর বেশ কিছুটা বাগান, তারপর বাড়ী। এই পুরো রাস্তায় মাত্র একটা ষাট ওয়াটের বাল্ব ছিল যাতে আলোর চেয়ে ছায়া বেশী দিত। তা আমাদের জ্যাঠা ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এই রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে, এমন সময় কেউ একজন নাকি সুরে বলে উঠল, ‘এই ম্যানা, একা একা মাংস খাঁবি, আমাকে দিঁবি না, খাঁব।’
জ্যাঠার নেশা চটকে গেল। সে ভাবল কোন চাংড়া ছোঁড়া ইয়ার্কি মারছে। দারুন রাগে জ্যাঠা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে রে ড্যাকরা, সামনে আয়, তোকে মাংস খাওয়াচ্ছি।’ উত্তর দিকের কয়েকটা বড় বড় গাছের নীচে অন্ধকার জমে ছিল, সেই জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকার এক মূর্তি বেড়িয়ে এল, রোগা, লম্বা, প্রায় আট ফুট উঁচু, ভাঁটার মত তার চোখ জ্বলছে,কালো শরীরে ধবধবে সাদা দাঁত, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সেই অন্ধকারেও বীভৎস হাসি হাসছে। ‘ভূত’, বলে এক আর্ত চিৎকার ছেড়ে জ্যাঠা মাংসের কটোরা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুট লাগাল বাড়ীর মধ্যে। কোন রকমে বাড়ীর উঠোনে পৌঁছেই জ্যাঠা উল্টে পড়ল। কাজের লোকেরা ছুটে এসে চোখে মুখে জল দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলতে কাঁপতে কাঁপতে কোন রকমে জ্যাঠা বলল, ‘ভূ – ভূত, মাংস চাইছিল।’
সেইদিন রাত্রে কেউই আর সাহস করে বাইরে বেড়ালো না। পরের দিন সকালে বাগানে গিয়ে কিছুই পাওয়া গেল না। না কোন মাংসের টুকরো, না মাংসের কটোরা। হয়ত কোন বিড়াল কুকুরে খেয়েছে, কিন্তু সবাই মোটামুটি একমত হল যে মাংসের কটোরাটা বুদ্ধি করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াতেই ম্যানাবাবু কোনরকমে প্রানে বেঁচে গেছে। না হলে ভূতে নির্ঘাত তার ঘাড় মটকাত।
সবাই মোটামুটি একমত হলেও বদি বাবু কিন্তু শুনে মুচকি হাসল। বদি বাবুকে আমরা কাকু বলতাম। কাকু (বাবার চেয়ে বয়সে ছোট), তখনও অবিবাহিত, দাদুর সম্পর্কে ভাগনে, ডাকাবুকো, দাদু আর দিদিমনির (ঠাকুর দা, ঠাকুমা) খুব প্রিয়। তা জ্যাঠার কাছে ভূতে মাংস চেয়েছিল শুনে কাকু তো খুব এক চোট হেসে নিল। ভূত না কচু, ম্যানদাদার ব্যাপার তো। মালের ঘোরে কি দেখতে কি দেখে ভূত ভেবেছে।
অলক্ষ্যে ভগবান হাসলেন।
কাকু একতলার উত্তরের একটা ঘরে থাকত। এই ঘরটার উত্তরেই শুরু হয়েছে গারদ বাড়ীর জঙ্গল। গারদ বাড়ী অর্থ জেলখানা, কারাগার। আমাদের পূর্ব পুরুষরা ইংরেজদের কাছ থেকে এই সম্পত্তি কিনেছিল। খুব কম লোকই জানে যে এক সময়, পলাশীর যুদ্ধেরও আগে ইংরেজরা বর্ধমানের জমিদার ছিল। তখন তাদের দেওয়ান খানা এবং তার সংলগ্ন গারদবাড়ী এখানেই ছিল। ইংরেজরা খুব অত্যাচারী ছিল। তাদের ভয়াবহ অত্যাচারের বহু গল্প তখনও মুখে মুখে ফিরত। গারদবাড়ীর বহু বন্দীকেই তারা নাকি মেরে ফেলত, অনেক সময় কতলও করতো।
ইংরেজরা চলে যাবার পর গারদবাড়ীর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় বহু দিনের অব্যবহারে গারদবাড়ী ক্রমে জঙ্গলে পরিণত হয়। সবাই নিশ্চিত জানত গারদবাড়ীর জঙ্গল বিভিন্ন রকম ভূতে থিকথিক করছে।এর মধ্যে যে ভূতকে লোকে সবচেয়ে বেশী ভয় পেত তার নাম কন্ধকাটা, সেই সব দুর্ভাগা বন্দী যাদের কতল করে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দেওয়া হত। তাদের মুণ্ডুহীন কবন্ধ সব সময় দুই হাত বাড়িয়ে তাদের হারিয়ে যাওয়া মুণ্ডু খুঁজে বেড়াত এবং যা কিছু হাতে পেত তাই ধরে পেটে চালান করে দিত। রীতিমত ভয়ের ব্যাপার; হাসি নয়, ভয় দেখানো নয়, সোজা পেটে পুরে দেওয়া। দিনের বেলাতেও ঐ জঙ্গলে ভয়ে কেউ ঢুকত না। সুতরাং একতলার উত্তরের ঘরটায় শোয়া রীতিমত সাহসের ব্যাপার ছিল।
জ্যাঠার ভূত দর্শনের পর খুব বেশী দিন যায় নি। এক গরম কালের রাত্রে কাকু ঐ উত্তরের ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। মধ্যরাত্রি। হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দে কাকুর ঘুম ভেঙ্গে গেল়। শব্দের উৎস সন্ধানে কাকু বিছানা থেকে উঠে পড়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
পূর্ণিমার রাত। বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জানালার পর ফুট পাঁচেকের মত ফাঁকা জায়গা, তারপর ফুট আষ্টেক উঁচু বাউন্ডারী ওয়াল যেটা আমাদের বাড়ীকে গারদবাড়ীর জঙ্গল থেকে আলাদা করে রেখেছে। দেওয়ালের ওপর বসে আছে এক কালো ছায়ামূর্তি, জানালার দিকে ঝুঁকে পড়ে তার দুই বিশাল হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জানালা দিয়ে। পূর্ণিমার আলোয় কাকু পরিষ্কার দেখল ছায়ামূর্তির কাঁধের ওপর থেকে আর কিছু নেই, মূর্তি মুণ্ডহীন।
‘কন্ধকাটা’ বলে এক বিকট ভয়ার্ত আওয়াজ দিয়ে কাকু ঘর থেকে ছুটে বড় পিঁড়েয় বেরিয়ে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। বাড়ীর কাজের লোকেরা ঐ বীভৎস চিৎকারে আগেই উঠে পড়েছিল। চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে শুশ্রূষা করে অবশেষে তারা বদি বাবুর জ্ঞান ফিরিয়ে আনল।
দিদিমনি কাকুর জন্যে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার শোবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে অন্য ঘরের ব্যবস্থা করা হল। এই ঘটনার পর ডাকাবুকো বদি বাবুর সুস্থ হয়ে আবার আগের ফর্মে ফিরে আসতে বেশ কিছু দিন সময় লেগে গেল।
ভুত. I believe ghost.