সাহিত্যিকা

ভারতের প্রথম মহিলা যাঁর নামে রেলপথ স্টেশন

ভারতের প্রথম মহিলা যাঁর নামে রেলপথ স্টেশন
অর্ণব চন্দ্র, ১৯৮৬ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বাংলা তথা ভারতের এক বীরাঙ্গনা – বেলা মিত্র (১৯২০ – ৩১ জুলাই, ১৯৫২)

বেলা বসু (বিবাহ সূত্রে মিত্র) ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের যোদ্ধা। পিতা সুরেশ চন্দ্র, মাতা সুধা ও সম্পর্কে তিনি নেতাজীর ভাইঝি। ১৯৩৬ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের সহকর্মী হরিদাস মিত্রের (পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার) সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর পুত্র ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।

পারিবারিক যোগসূত্রেই তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনে প্রবেশ। যখন ১৯৪০ সালে রামগড়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে পদত্যাগ করে নেতাজী এক আপোস বিরোধী সম্মেলনের ডাক দেন ও পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে তোলেন, বেলা ছিলেন তাঁর নারী বাহিনীর প্রধান। যেসব বিভিন্ন দল নেতাজী ভারতে প্রেরণ করেন, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা ও নিরাপদে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তাঁর ওপর। ১৯৪৪ এর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুরে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সংবাদ আদান প্রদান ও নিরাপদে বিপ্লবীদের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে দেন বেলা। সেই সময়ে তাঁর স্বামী হরিদাস মিত্র গ্রেপ্তার হলে তিনি সেই সকল কাজ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। নিজের অলংকার বিক্রির অর্থে কর্মীদের নিরাপদে আনা ও থাকার ব্যবস্থা করেন। বহু বিঘ্ন সত্ত্বেও উড়িষ্যার উপকূলে লোক পাঠিয়ে কর্মীদের অবতরনের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।

আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্য ধৃতদের সঙ্গে হরিদাস মিত্রের ফাঁসির হুকুম হলে তা মকুব করার জন্য ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গান্ধীজির কাছে তদ্বির করেন তিনি (কিছুটা বিশদে লেখা হয়েছে নীচে)। গান্ধীজির আবেদনকে মান্যতা দিয়ে হরিদাস মিত্র ও আরো তিন দেশপ্রেমিকের (ডা. পবিত্রমোহন রায়, সর্দার মহিন্দর সিং ও অমৃক সিং গিল) ফাঁসির আদেশ বদলে যায় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে ও কালক্রমে তাদের মুক্তিও ঘটে। ১৯৪৭এ তিনি “রানী ঝাঁসি সেবা দল” গঠন করেন এবং ১৯৫০এ আগত উদ্বাস্তুদের সেবা ও তাদের উন্নয়নমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বালি-ডানকুনির কাছে অভয়নগরে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে।

১৯৫২ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। ১৯৫৮তে তাঁর জন্মদিনে সেখানকার রেলওয়ে স্টেশনটির নতুন নাম দেওয়া হয় ‘বেলানগর’ – ভারতের ইতিহাসে কোনো ভারতীয় মহিলার নামে স্টেশনের নামকরণ সেই প্রথম।

বেলা বোস’কে বলা হতো “বাংলার ঝাঁসির রানী”। ১৯৫৮ সালে পূর্ব রেলওয়ে তার চিরাচরিত নিয়ম (কিছু স্টেশনের নাম ভারতের বিখ্যাত পুরুষদের নামে করার প্রথা) ভেঙে হুগলি জেলার ডানকুনি ও হাওড়া জেলার বালির মধ্যস্থিত রেল স্টেশনটির নাম এই ভারতীয় বীরাঙ্গনাকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন – বেলা বোসের নামানুসারে স্টেশনটির নতুন নাম হয় “বেলানগর”। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা যাঁর নামে দেশের একটি রেলস্টেশন উৎসর্গ করা হয়েছে।

প্রাসঙ্গিক সংযোজনঃ পল্লব মিত্র সংকলিত “ফাঁসি থেকে ফিরে” বইটির থেকে, যা বিপ্লবী জ্যোতিষ চন্দ্র বসুর জেল ডায়েরির ওপর আধারিত, বেশ কিছু কথা জানা যায়। গান্ধী তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল’কে সাতটি চিঠি লেখেন, চারজন বিপ্লবীর হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে তাঁদের ফাঁসির সাজা মকুব করার জন্য – তাঁরা হলেন জ্যোতিষ বসু, অমর সিং গিল, পবিত্র রায় ও হরিদাস মিত্র। হরিদাসের স্ত্রী বেলা বোস গান্ধীকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন। এই চারজন বিপ্লবী ফাঁসিতে দণ্ডিত হয়েছিলেন নেতাজীকে গোপনে খবরাখবর পাঠানোর অভিযোগে।

বইটিতে জ্যোতিষ বসুর প্রেসিডেন্সি জেলে কয়েদ থাকাকালীন শেষ কয়েকদিনের ডায়েরি-লেখা পাওয়া যায়। তাঁরা সবাই জুলাই-আগস্ট ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান। গিল ও রায়ের পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও, মিত্র তারপরে কংগ্রেসে যোগ দেন (পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন) আর বসু বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করেন (২০০০ সালে ৯২ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন)। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী আর মাত্র একবারই গান্ধী কোনো বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড রদের জন্য অনুরোধ করেছিলেন – তিনি হলেন ভগৎ সিং, যদিও শেষ পর্যন্ত ১৯৩০ সালের তেইশে মার্চ তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়।

বসুর ৬এ বিপিন পাল রোডের বসতবাটিতে আইএনএ -র গোপন যোগাযোগ কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এই বাড়ি থেকেই বসুকে ১৯৪৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় এবং তারপর বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েক মাস ধরে বিচার চলার পর চারজনকেই কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী করা হয় এবং তাঁদের ফাঁসির হুকুম হয়। ফাঁসির আগে তাঁদের অন্তিম ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে গিল বলেন যে তিনি সাধনা বোসের (হিন্দি চলচিত্রের তৎকালীন খ্যাতনাম্নী নায়িকাদের একজন) নাচের অনুষ্ঠান দেখতে চান আর বসু বলেন যে তিনি কানন দেবীর গান শুনতে চান।

মিত্র’র 22 বছর বয়সী পত্নী পুণা গিয়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের মুক্তির জন্য ভাইসরয়’কে অনুরোধ করতে বলেন বা যদি সেটা সম্ভব না হয়, কমপক্ষে তাঁদের ফাঁসির আদেশ মকুব করার কথা বলেন। বসুর বাবা রঞ্জন বিলাস’ও তার কিছুদিনের মধ্যে ওই একই অনুরোধ নিয়ে গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধী তাঁর চিঠিতে প্রথমে হরিদাসকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করেন এবং পরে বাকি তিনজনের জন্য লেখেন। চিঠিগুলি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা আছে।

১৯৪৫ এর ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রথম চিঠিতে গান্ধীজী লেখেন যে হরিদাস মিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এম.এ. স্নাতক এবং সুভাষ বোসের ২২ বছর বয়সী ভাইজির স্বামী, তিনি কোনো এক অসমর্থিত কারণে ফাঁসির আদেশে দণ্ডিত। আমি দন্ডিতের কাকা এবং এ্যডভোকেট ক্যাডেন নোটের ক্ষমাপ্রার্থনার অনুরোধ অধ্যয়ন করে জানাচ্ছি যে বন্দীকে তার ক্ষমাপ্রার্থনার নিরিখে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ আছে এবং সেই কারণ আরো জোরদার হয় যেহেতু জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে রাজনৈতিকভাবে অপরিসীম ভুল হয়ে যাবে। বন্দীর স্ত্রী বিষয়টির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যিনি প্রায়ই আমার প্রার্থনাসভায় গান গাইতেন, যে সময়ে আমি সুভাষের বড় ভাই এ্যডভোকেট শরৎ চন্দ্র বোসের (যাঁকে ভারত সরকার মুক্ত করে দিয়েছে জেনে আমি খুশি হয়েছি) বাড়িতে অতিথি হবার সৌভাগ্য লাভ করি।

প্রধান তথ্যসূত্র: উইকিপেডিয়া

Sahityika Admin

1 comment

  • লেখাটি পড়ে ভালো লাগল।
    সংযোজন : পুনের জেলে বেলা মিত্র যখন গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করেন, গান্ধীজি প্রথমেই হরিদাস মিত্র’র ফাঁসির সাজা মকুবের জন্য আবেদন করতে সম্মত হন।
    কিন্তু বেলা জানান, তিনি নিজের স্বামীর একার মুক্তির কথা বলতে আসেননি। একই মামলায় অভিযুক্ত বাকি তিন সঙ্গীর জন্য যদি আপনি বলতে না পারেন, তাহলে আমি আমার অনুরোধ প্রত্যাহার করলাম।
    শুনে গান্ধীজি খুব প্রীত হন। বলেন, তুমি সুভাষের উপযুক্ত ভাইঝির মত কথা বলেছো।