প্রফেসর আনন্দ মোহন ঘোষ
অজয় দেবনাথ, ১৯৭০, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
৫ই সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে আমাদের বিই কলেজ, বেসু, আইআইইএসটি-র মাসিক সাহিত্য পত্রিকা “সাহিত্যিকা”র সেপ্টেম্বর মাসের বিশেষ সংখ্যায় কিছু লেখার জন্য ভাবছিলাম কি লেখা যায় …..সত্যি কথা বলতে কি স্যারদের সঙ্গে আমার সরাসরি কোন কথা বার্তা ওই পাঁচ বছরে খুবই কম। প্রায় শুন্যই বলা যায় দু একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা বাদ দিলে।
আজকে যে ঘটনাটা বলবো সেটা আমার জীবনে একটা স্মরণীয় মুহূর্ত। অবশ্যই কারণ খেলাধুলা নিয়ে। অনেক স্মৃতি কলেজ জীবনে থাকলেও এটা একেবারে অন্য ব্যাপারে -হ্যাঁ, পড়াশুনা নিয়ে। আর যাঁকে নিয়ে বলবো তিনি একেবারে খুব কম আলোচিত স্যারদের মধ্যে একজন। তাঁর নাম প্রফেসর ডঃ আনন্দমোহন ঘোষ সংক্ষেপে এএমজি; ফাইনাল ইয়ারে (১৯৬৯~৭০ সালে) আমাদের ইলেক্ট্রিক্যাল মেজারমেন্ট এন্ড মেজারিং ইন্সট্রুমেন্টস পড়াতেন।
ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবার মাস দুয়েক আগে আমার টাইফয়েড হয়ে পড়াশুনার প্রস্তুতিতে সামান্য ব্যাঘাত ঘটে; আর সবচেয়ে দুঃখ জনক ঘটনা হল ঠিক সাত দিন আগে আমার পরের ভাই রাজনৈতিক দলের চাপান উতোরে মারা যায়। সেবারে বি ই কলেজে প্রথম তুমুল রাজনৈতিক আলোড়ন ও নকশাল আন্দোলনে কয়েকটা পরীক্ষা হয়ে যাবার পর কলেজ ক্যাম্পাস কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
আমরা এই সময়ে তল্পি তল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে আসি আর দিন গুনতে থাকি কবে আবার গিয়ে বাকি পরীক্ষা গুলো দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবো। ঠিক মনে নেই, মনে হয় একমাস পরে আবার আমরা ফিরে যাই হোস্টেলে। পরীক্ষা আবার শুরু হবে কিছুদিন পরে। দিন কয়েক কেটে গেলে আমাদের ইলেক্ট্রিক্যালে খবর রটে গেল এর মধ্যে এএমজি স্যার মেজারমেন্টের খাতা দেখে ফেলেছেন।
এই পরীক্ষার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে —আমার প্রস্তুতিতে একটু খামতি ছিল আগেই বলেছি। তাও মোটামুটি ভালোই দিয়েছি কিন্তু একটা প্রশ্নের পার্ট ওয়ান হয়ে গেছে, পার্ট টু র অঙ্কটা কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না। এদিকে সময়ও ফুরিয়ে আসছিল। আমার সামনে বসেছিল অমিত দত্ত (ওর পরিচয় পরে দেব); দেখলাম অমিতও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘ কি রে, সব হয়ে গেছে’? ও বলল ‘না, একটা অঙ্ক পারছি না’। তারপর জানতে পারলাম ও যেটা পারছে না সেটা আমার হয়ে গেছে আর আমি যেটা পারছি না সেটা ওর হয়ে গেছে। এবার আমরা স্যারের চোখ এড়িয়ে মুখে মুখে অঙ্ক দুটো বলে দুজনের খাতায় টুকে নিলাম। ঘন্টা বেজে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা সেটাই ছিল আমার কলেজ জীবনে প্রথম ও শেষ মানে একমাত্র টোকা বা চোথা মারার ঘটনা। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিলাম পরে।
খাতা দেখা হয়ে যাওয়ার খবরে দু একজন সময় মত এএমজি স্যারের কাছে গিয়ে নম্বর জেনে এসেছে। ফাইনাল ইয়ার আর এই পরিস্থিতিতে স্যারও দয়াপরবশ হয়ে নম্বর বলে দিচ্ছেন। আমাদের মধ্যে অমিত দত্ত, অমিতাভ দত্ত আর আমার পদবি কাছাকাছি হওয়ায় প্রতি বছর একই হোস্টেলে থেকেছি। অতএব আমরা তিনজন ঠিক করলাম একসঙ্গে যাব নম্বর জানতে। দিনক্ষণ দেখে অমিত দত্ত (যে ভবিষ্যতে নাসার নামকরা বিজ্ঞানী আই আই টি র এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডঃ অনুভব দত্তের বাবা হবে), অমিতাভ দত্ত (যে ভবিষ্যতে আই ই এস হয়ে রেলওয়ে বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হবে) আর আমি ফোতো কাপ্তান অজয় দেবনাথ দুরু দুরু বক্ষে স্যারের ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে কে আগে ঢুকবে তার ফয়সালা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। স্যার ই দেখতে পেয়ে আমাদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি ব্যাপার’? আমরা বলতে হেসে ওনার খাতা দেখে নম্বর বলে দিলেন। আমি শেষে আমার নাম বলতে আরেকটু বেশি হেসে বললেন ‘ও তুমিই অজয় দেবনাথ ‘!! মুখ দেখে বোঝাই গিয়েছিল যে উনি ক্লাশে আমাকে কোনদিন লক্ষই করেন নি। তার পরে বললেন ‘ তুমি তো হাইয়েস্ট পেয়েছো! আমি যত না আনন্দ পেয়েছি তার শতগুন অবাক হয়েছিলাম। স্যার তারপর একটু মৃদু সুরে বললেন ‘ তা, তুমি সবার দেখে টুকেছো….. না সবাই তোমার দেখে টুকেছে’। আমি তখন ‘না স্যার, না স্যার’ করে তোৎলা বনে গেছি । স্যার শেষে আমাদের আসতে বলায় ধনে প্রাণে বেঁচে ফিরলাম।
এরপরের ঘটনাটি কলেজ ছেড়ে আসার অনেক পরে ঘটেছিল যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি ছিলাম না কিন্তু সাক্ষী হতে আমি অস্বীকার করেছিলাম সে কথা বলা যায়। কারণ ঘটনাটা যে ওই রকমই কিছু একটা ঘটবে সে সম্পর্কে আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় সংকেত পাঠিয়েছিল। আমি একটা উপদেষ্টা কোম্পানিতে চাকরি করতাম যার ম্যানেজার সব কিছু ম্যানেজ করতে মহা ওস্তাদ ছিলেন। কলকাঠি নেড়ে একটা এম টেক ডিগ্রি ও ফলশ্রুতি হিসাবে আমাদের সেকশনের ম্যানেজার পদটিও বাগিয়ে ছিলেন। তার একদিন মনে অভিলাষ জাগলো যে তিনি পিএইচ ডি করবেন। আমার টেবিলের উল্টো দিকে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুজুং ভাজুং দিয়ে বললেন উনি আমাকে নিয়ে বি ই কলেজে এএমজির কাছে যেতে চান, স্যারকে ওর পেপারের গাইড করবেন বলে। আমাকে একটা আটপাতার জেরক্স করা ম্যাথমেটিক্যাল ক্যালকুলেশন দেখালেন ওর প্রাথমিক কার্যকলাপ হিসাবে। আমি ওই জেরক্স করা পাতাগুলোর বিন্দুবিসর্গ কিছু বুঝতে না চাইলেও এটুকু বুঝেছিলাম যে কোথাও একটা গন্ডগোল আছে তাই সরাসরি না বলে দিলাম। এবার তিনি গিয়ে ১৯৭৯ ব্যাচের স্বপন বসুকে এমন ভাবে চেপে ধরলেন যে স্বপন আর না করতে পারলো না।
এরপরের ঘটনা স্বপনের মুখে শোনা। এএমজি স্যারের সাথে আলাপ পরিষয়ের পরে ম্যানেজার সাহেব পেপার দেখিয়ে প্রস্তাব পেশ করলেন। স্যার পেপারটা দেখে নাকি অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপরে অক্ষমতা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। অতঃপর দুজনে মিলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময়ে স্যার স্বপনকে একটু থাকতে বললেন। ম্যানেজার বেরিয়ে যেতে স্যার স্বপনকে নাকি বলেছিলেন এই (ভদ্র)লোকটাকে কেন স্বপন নিয়ে গেছে! যে পেপারটা ম্যানেজার দেখিয়েছিলেন সেটা খুব সম্ভবত ফ্রান্সের AMSI (??) স্ট্যান্ডার্ড থেকে চোথা মারা। স্যার নাকি আরো বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে স্বপন যেন এই ধরণের বোকা বোকা কাজের সমর্থন আর না করে।
এই হলেন আমাদের এএমজি স্যার। তিনি স্পেড কে স্পেডই বলতেন সে ছাত্রই হোক আর বাইরের লোকই হোন। মাঝে মাঝে ভাবতে ভাল লাগে এখনকার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ এই আদর্শের পতাকা এখনো বহন করে চলেছেন।
File photo of Prof. Ananda Mohan Ghosh along with other Professors, during the 2023 annual get-together of 1972-1977 pass-out students.
Add comment