শিক্ষা গুরু
দীপক সেন, ১৯৬৮ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
সেই সময়, বাবার রেলের চাকরি আর বদলির দৌলতে আমার ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস এইটে পড়তে, চারটে জায়গায় চারটে স্কুলে পড়ে, কিছুই পড়াশুনা হচ্ছে না দেখে, বাবা অনেক চেষ্টা করে আসানসোলের রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধানকে দিয়ে আমায় ক্লাস নাইনে ভর্তি করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু আমার রেজাল্ট ভালো না থাকায়, ওনারা আমাকে ছ মাস Arts, এ পড়ে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার পর কোন বিভাগে (stream) দেবেন, ঠিক করবেন, জানালেন।
সুতরাং ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃত, হিন্দির সাথে সাথে এবার আমার Physics, Chemistry, Mathematics, এগুলোও পড়া শুরু হয়ে গেলো। দেবতুল্য শিক্ষকগণ, আমাকে আলাদা করে সময় দিতেন, ও লাইব্রেরী থেকে সবরকম বই এরও ব্যবস্থা করে দিতেন।
ঠিক সেই সময়, আমাদের দুজন বাংলার শিক্ষক, ভূদেব বাবু আর আলো দা, আমাকে বিশেষ করে বাংলায় রচনা ও সাহিত্য নিয়ে খুব উৎসাহ দিতেন।
ড্রইং এর শিক্ষক, অক্ষয় বাবু, আর ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাক্টিক্যাল এর শিক্ষক মণ্ডল বাবু , স্কুলের সময় শেষ হলে নিজের হাতে ধরে শেখাতেন।
ছ’মাস পরে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায়, অঙ্কে ৮১, আর সবকটি বিষয়ে ভালো করায়, আমার জীবনে প্রথম টেকনিক্যাল স্ট্রিম এ পড়াশুনোর সুযোগ হলো।
আমার বাংলার শিক্ষকেরা দুজনেই আমার প্রতি খুবই স্নেহশীল ছিলেন, আর আমার প্রতিটি ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাতেন। থিয়েটার, আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগতায় অংশ গ্রহণ করতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করতেন।
আবার ড্রইং আর practical এর মাষ্টারমশাইও বেশ উৎসাহ দিতেন। তার ফলে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়, ড্রইং ও engineering subjects, আর বাংলায় খুবই ভালো নম্বর পেলাম, আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স admission test এ ভালো করায়, B.E. College এ আর্কিটেকচার ডিপার্ট্মেন্টে পড়ার সুযোগ হলো।
তারপর পাস করে, জীবনের অনেক ভালো ও খারাপ অবস্থা পেরিয়ে , আমেরিকা থেকে M.S. করে ফিরে সরকারি টেলিকম কোম্পানিতে চাকুরী শুরু করলাম।
অনেক বছর পরে, যেবার দু’বার দুর্গাপুজো হয়েছিল, সেবার কাশী রামকৃষ্ণ মিশনে দুর্গাপুজো দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পূজারী স্বামীজিকে আমার খুবই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু, কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন পুজো শেষ হয়, আর মহারাজ, সেখান দিয়ে নেমে আসেন।
হটাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে পিঠে এক চাপড় মেরে সেই স্বামীজি বলে উঠলেন,”দীপক ,আমায় চিনতে পারলে না ?
– আমি তোমাদের আলো দা”
বিস্ময়ে অভিভূত আমি,
– আপনি মিশনে যুক্ত হয়েছিলেন শুনেছি, কিন্তু কিছুই আর জানি না আপনার সম্বন্ধে। ইতিমধ্যে আমি দীক্ষা গ্রহণ করেছি স্বামী বীরেশ্বরানন্দজীর কাছ থেকে।
এই শুরু গুরু ছাত্রের নতুন রকমের সম্পর্কের এক স্বর্গীয় যাত্রা।
যখনই সুযোগ পেয়েছি ওনার কাছে গেছি, সে লখনউ হোক বা বেলুড় মঠ হোক,
আর উনিও সাথে করে আমাকে দক্ষিণ ভারতের মিশনের শাখা কেন্দ্রে নিয়ে গেছেন। অনেক প্রাচীন ও নবীন সাধুর সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন।
এবার চাকরি থেকে রিটায়ার করে সল্ট লেকে এসে থাকা শুরু করলে, উনিও আমার সঙ্গে ভাই এর মত আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়ে অনুগ্রহ করতেন।
আমার স্ত্রী কে বলে দিতেন, লুচি ছক্কা, কবে আসবেন প্রসাদ করে দিতে।
খুব বিপদের সময় ওনার কাছে চলে যেতাম, আর ওনার উপদেশ মত চলে সব বিপদ থেকে উদ্ধার হয়ে যেতাম।
এই জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওয়া, আমার ঈশ্বর, প্রেরণা, ও কর্মের এক সমন্বয়ে আনন্দে চলার পথে এগিয়ে যেতে ওনার আশীর্বাদ।
ঈশ্বরের পুত্র আমাদের সবসময় ভালো প্রার্থনা করতেন।
বেশ কিছুদিন আগে বেলুড় এ আরোগ্য নিকেতন এ যেতে বললেন, “বুঝলে দীপক, এবার আবার হসপিটালে যেতে বলছে, কিন্তু আমার মন বলছে, বোধ হয় আর ফেরা হবে না। আমার কাছে যা আছে সব মঠে দিয়ে জানিয়ে দিলাম, বেশ ভালো রকম উৎসব অনুষ্ঠিত করে সকলকে প্রসাদ বিতরণ করে ঈশ্বরের আশীর্বাদ যেন সকলে পায়।”
এরপরে তিন চার সপ্তাহ, উনি ফোন ধরেছেন।
তারপর এক রাতে এক বন্ধুর মাধ্যমে ওনার রামকৃষ্ণ লোকে যাত্রার খবর পেলাম ।
ঈশ্বরের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য,
এই ছাত্র, তার শিক্ষক,
ভ্রাতা, ও গুরু কে চিরকাল
আলোর পথে এগিয়ে থাকতেই দেখবে,
দেখতেই থাকবে।
Tell me and I forget. Teach me and I remember. Involve me and I learn. – Benjamin Franklin
Add comment