সাহিত্যিকা

জলের আখর থেকে তুলির আঁচড়

জলের আখর থেকে তুলির আঁচড়
সুদীপ্ত চক্রবর্তী স্থাপত্যের অপত্য ৮২

ভূমিকা ধূমিল
শিক্ষক দিবসে সেই নমস্য মানুষদের বিশেষভাবে স্মরণ মনন পূজন করা খুবই ভালো কথা। জন্মদিন, বার্ষিকী, পুজোআচ্ছা ইত্যাদিও তো বছরে একবারই হয়। প্রতি বছরেই গুরুদের কিছু স্মরণিকা রচনা করি, এবারে সম্পাদকের নির্দেশে তার সঙ্গে শিক্ষার আয়োজন আর শ্রেণীকক্ষের পরিবেশটিও একটু ছুঁয়ে যাওয়া যাক।

শিক্ষক বলতে আমাদের মধ্যে অনেকেই বলেন যে যাঁদের কাছে আমরা কিছু একটা শিক্ষালাভ করি, তাঁরা সকলেই আমার শিক্ষক। এই বলে এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়া বা সহজ করে দেয়া বা সত্যিই একটা খুব সত্যি কথা বলা। কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে শুধুমাত্র প্রথাগত বিদ্যা আহরণের পদ্ধতি আর যাত্রাপথের কথা, আর তার কান্ডারিদের স্মৃতি। আবার সৌভাগ্যবান অনেকে বলেন কোনো কোনো বিশিষ্ট শিক্ষকের কথা। এক একজন স্মরণীয় পরম শ্রদ্ধেয় মানুষের কথা যাঁরা উদাহরণ হয়ে উঠেন, পথ দেখিয়ে, ভালোবেসে, তাদের জীবনকে এনে দিয়েছেন শুভসুন্দর সঠিক পথে। অনেকে আবার সাধারণভাবে শিক্ষকবৃন্দের কথা বলেন, বা আনন্দময় সুখস্মৃতিময় সাধারণ শিক্ষার পরিবেশের কথা বলেন, একাধিক শিক্ষকের কথাও বলেন। এই সমস্ত স্মৃতি ও পূজা শিরোধার্য এবং শুদ্ধ আনন্দের। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা অন্যরকম কারণ আমি সম্ভবত সেই সুদুর্লভ হতভাগ্যদের মধ্যে পড়ি যারা কোন শিক্ষকের বিশেষ স্নেহ কোনদিন পায়নি, কোনো শিক্ষককে বেশ বিশেষ করে যাদের মনে পড়ে না বা বিশুদ্ধ ভাবে বিদ্যায়তনের শিক্ষাটুকুর স্মৃতি যাদের মনে অবিমিশ্র সুখে আনন্দে কৃতজ্ঞতায় ভাস্বর নয়। কাজেই শিক্ষা ও শিক্ষক নিয়ে আমার স্মৃতিচারণ, সাধারণ সামূহিক বিপুল শ্রদ্ধা থাকলেও, ব্যক্তিগত স্তরে খানিকটা কালাপাহাড়ের কড়চার মতনই হয়ে যেতে চায়, অবশ্য তারও হয়ত এক ধরণের মূল্য আছে।

অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সমগ্র শিক্ষকপরপম্পরার উপরে আমার শ্রদ্ধা ভক্তি বিশ্বাসে তিলমাত্র ঘাটতি নেই। শিক্ষকদের সমস্যা আর সংগ্রাম, তার মধ্যেই ফুটে-ওঠা ত্যাগ ও দান মহনীয়। শিক্ষকেরা সাধারণভাবেই অসাধারণ। তবে শিক্ষা এবং শিক্ষার পরিবেশকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। ইয়ারদোস্ত খেলাধূলা হইহই টিফিনব্যালা ইত্যাদি সুখময় স্মরণ বাদ দিয়ে শুধু শিক্ষাটুকু নিতে পারার ছাত্রের ক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে। এখানে একটা কথা অত্যন্ত পরিষ্কার করে বারবার বলে দেওয়া দরকার যে আগেও বলেছি কোন শিক্ষক আমাকে তুলে নেননি বা বেছে নেন নি, বিশেষ করে স্নেহ করেননি বা কিছু এমন ভাবে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো দাগ রেখে যাওয়ার মত জীবন গড়ে দেওয়ার মতো করে, সেটি সম্পূর্ণভাবে এবং একান্তভাবেই আমারই দোষ এবং আমারই অযোগ্যতা। অপোগন্ড ছাত্র হিসেবে আমি কোনোদিনই কোনো স্তরের শিক্ষারই আকাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছে সেই শিক্ষাকে আপন করে নিতে পারিনি, ফলে শিক্ষকদের আলোকবৃত্তেও মঞ্চাবতরণ সম্ভব হয়নি কদাপি। সাধারণত শিক্ষকরাও খোঁজেন বাধ্য শ্রদ্ধাশীল পড়াশুনায় ভালো বলিয়ে কইয়ে বুদ্ধিমান ছাত্র যাকে স্নেহ করা যায় শেখানো যায় যে মুখোজ্জ্বল করবে, অর্থাৎ সঠিক ছাত্র সঠিক পাত্র। সপ্রতিভ ভালো ছাত্র আর স্নেহময় ভালো শিক্ষকের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর সুখকর এবং লাভজনক পারস্পরিক সুসম্পর্ক লক্ষ্য করেছি।

এখানে একটি কথা বলা যায় যেটি আমার নিজের মনে হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে শিক্ষকরা অতীব শ্রদ্ধেয় কিন্তু তারাও তো মানুষ। উনারাও সহজ পথটি গ্রহণ করেন অর্থাৎ যে ছাত্র ভালো, বাধ্য সুশীল, বা উজ্জ্বল তাকেই ভালোবাসেন স্নেহ করেন মন ঢেলে শিক্ষা দেন সাহায্য করেন কিন্তু মানবিক স্বভাব অনুযায়ীই, তুলনামূলকভাবে খারাপ, দুর্বল, অবাধ্য, দুষ্টু বা মুখচোরা অপ্রতিভ ছাত্রদের শিক্ষকেরা কিছুটা বা অনেকটা অবহেলাই হয়তো করেন। শিক্ষকদের নেকনজরে না পড়ুক চোখে পড়ার জন্য বেশ কয়েকটি গুণ বা গুণের সমাহার প্রয়োজন, যেমন ভালো ছাত্র, চিরকেলে খারাপ ছাত্র, বাধ্য ছাত্র, ভদ্র ছাত্র, খেলায় দড়, কোলঘেঁষা, ফরমায়েশ খাটা, গোয়েন্দা গুপ্তচর অথবা মহা বখা। গোবেচারা মুখচোরা অপ্রতিভরা আড়ালেই থেকে যায়। মনে হয় যে শুধুই ভালো ছাত্রদের ভালোবাসা শিক্ষকতার একটি উল্লেখযোগ্য খামতি এবং সব ছাত্রকে সমদৃষ্টিতে দেখা, দুষ্টু ছাত্রকে অপছন্দ না করা এবং দুর্বল ছাত্রকে বেশী সাহায্য করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাসত্রের নানা অর্থে সংকীর্ণ দরিদ্র পরিসরে সত্যিই এটি অত্যন্ত কঠিন চ্যালেঞ্জ কিন্তু প্রকৃত মহান শিক্ষক মানবিক ভুলের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্বলকে ভালোবাসা ভুলকে সংশোধন করা দুষ্টুকে পথে আনার কর্তব্য স্বীকার করেন। কখনো ব্যক্তিত্ব দিয়ে কখনো শাসন দিয়ে কখনো জ্ঞান দিয়ে কখনো বা ভালোবাসা দিয়ে। তেমন শিক্ষক নিশ্চয়ই ছিলেন, অনেকের সৌভাগ্যে আর আমার স্বপ্নে আজো আছেন, কিন্তু আমি নিজে চোখে দেখিনি। পাজি ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু একান্ত অপ্রতিভ অযোগ্য ছাত্র ছিলাম সর্বদাই। পালিয়ে থাকতাম। সেজন্যেই হবে। যদি কোনো শিক্ষক পেতাম যিনি মুখচোরাকে প্রসন্ন মুখ দেখাতেন, তিনিই হতেন আমার সেই বটবৃক্ষ। আজকের এখানের এই উচ্চশিক্ষিত অভিজ্ঞ পরিবেশে সকলেই বোঝেন, মুখচোরা মানে বেগুন ভুষিমাল নয়, মানে হলো যে সঠিক মানসিক তরঙ্গদৈর্ঘ্য না পেলে নিজেকে খুলে দেখায় না, নিজের যোগ্যতা ক্ষমতা সম্ভাবনা বাঞ্ছা বাসনা সাধনা আরাধনা সব চেপে রাখে।

বিদ্যালয় শিক্ষার অর্থাৎ বইখাতা মাধ্যমে লেখাপড়া শিক্ষার আরেক দুর্বলতা হচ্ছে এই যে সেই শিক্ষা একটা বড় কথা বোঝেনা এবং বুঝতে শেখানোও হয় না, যে যারা বিদ্যালয়ের শিক্ষা পায়নি তাঁরাও বহু কঠিন কঠিন কাজ অনায়াসে করতে পারে, ব্যক্তিগত ক্ষমতায় বা বংশগত অভ্যাসে শিক্ষায়। নিপুণভাবে মাছ ধরা চাষ করা মূর্তি গড়া কারুকলা দারুশিল্প যন্ত্র সারাই জুতো সেলাই জামা কাপড় তৈরি করা আরো কত কত কাজ যেগুলো খুবই কঠিন এবং দক্ষতাসাধ্য, নমস্য, লেখাপড়া শিখলে বরং ওসব একেবারেই পারা যায় না। অথচ ওসব কাজে সম্মান কম অর্থ কম। আজকাল অবশ্য এটা বদলাচ্ছে কিছু কিছু। ঠিক তেমনি, বিদ্যালয়ের শুধু ভালো ছাত্রদের নয়, সব ছাত্রের মধ্যেই কিছু না কিছু থাকে,পুঁথিবিদ্যায় পরম পারঙ্গম না হলেই বা সপ্রতিভ বুদ্ধিতে শিক্ষকের ছত্রচ্ছায়ায় না এলেই দশদিশা অন্ধকার নাও হতে পারে। আবার, পড়া পারলে শিক্ষকের ভয় থাকে না, আবার শিক্ষকের ভালোবাসা পেলে পড়া পারার ইচ্ছে জাগে। এসব বৃত্তাকার ব্যাপারস্যাপার। কোনো শিক্ষক আমায় এইসব দেখালে বা শেখালে বা বললে তিনি হতেন আমার সেই চিরস্মরণীয় সদাপ্রণম্য দিশারী।

সুযোগ পেয়ে কেন কে জানে কটা বেগড়বাঁই লাগামছাড়া অসৈরণ কথা বলে ফেললাম। সঠিক যে বোঝাতে পারলাম না সেটাও বুঝলাম। কথাগুলি অবশ্য মোটামুটি ইশকুলের জন্য, তাও আবার প্রাথমিক শ্রেণীগুলির জন্যেই মূলতঃ বলা। সেটাই ভিত কিনা। এ আলোচনা অনেক জটিল। আসলে ওসব জিনিষ কোনো দিনই হিসেবে ধরিনি, হালকা চালে হেসেখেলেই পার করেছি কচিবেলা আর ভাগ্যিস কোনোদিনো পরিণত হতে পারিনি বলে, সববেলা।
প্রাগাক্ষর শৈশব থেকে বিদ্যালয় হয়ে জীবিকাবিদ্যার অঙ্গনের স্মৃতিছাপ অতিরিক্ত সংক্ষেপে এরপর বলা হচ্ছে।

উদ্বায়ী উদকের উৎসব
বাঙ্গাল রেফিউজী জীবনের সংগ্রামকালে শিশু আমি নিশিদিশি বিশাল পরিবারের হাঁড়ি-ঠেলনরতা মা’কে খুঁজেই পাই নি কোনদিন। অসুস্থ প্রায়পঙ্গু ঠাকুমাই আমাকে আশ্রয়দাতার বাড়ির লাল শানের মেঝেতে জল দিয়ে অক্ষরপরিচয় করান আর লিখতে আঁকতে শেখান। খাতা পেন্সিল দূরে থাক শ্লেট খড়ি কেনার অবস্থাও ছিল না সেকালে। আঁকার তালিম নিম্নরূপঃ
একখানা জলের ‘দ’ এঁকে, তারপর সে ‘দ” এর লেজটি আনুভূমিকভাবে বাড়িয়ে দিয়ে শেষের দিকটি ক্রমাগত একটু উঠিয়ে দিয়েঃ “দ-এর ওইলে মাথাব্যথা”, তারপর দ এর উপরদিকে একটি বিন্দু দিয়েঃ “হুইন্যে আইলে দ্যাখথে” তারপর পেটের নীচে বাংলা অক্ষরে ২২ লিখে, সব কিন্তু জল দিয়েই আঙ্গুল দিয়েই হচ্ছে,
“বাইশ জন আইলে কোবিরাজ”, “বইথে দেলে একখান ছিয়া”, “প্যাডের মোইদ্যে লারিবুরি”
“খাইতে দেলে কেস্‌সুয়া”, বলার সাথে সাথে অঙ্কণ অলঙ্করণ চলছে। তারপর দ এর মাথা থেকে এক বঙ্কিম রেখা ডানদিকে নিয়ে এসে অনেকটা মাছের মতন এক লেজসহ পাখির আকৃতি আঁকা সম্পূর্ণ করেঃ “এ্যা—–কটানে ওইয়া গ্যালে রাজার বারির ফেচ্চুয়া !!!!” রাজার বাড়ির ঐ অজানা পক্ষীর ছবি দিয়েই অঙ্কনশিক্ষার শুভারম্ভ আর তার হোত্রী আমার ঐ ঠাকুমা। ক্লাস ফোরে বৃত্তি পাওয়া সত্বেও আর না পড়তে পারা অসম্পূর্ণ বিদ্যা দিয়েই উনি গল্প বলে ছবি লিখে পঞ্জিকা পড়ে ছড়াছবির বই শুনিয়ে যা আমার ভিত বানিয়ে দিয়েছিলেন তার তুলনা নেই। সেই সময়কালে ওঁর পক্ষে ডাইনির গল্পই বলা স্বাভাবিক ছিল কিন্তু উনি আমাকে শুনিয়েছিলেন ডাইনো অর্থাৎ ডাইনোসরের গল্প। কোথায় জানলেন, সেও এক রহস্য। এছাড়া কিছু পরবর্তী কালে প্রচন্ড অভাবের সংসারেও বাবার এক আলমারি বইয়ের সংগ্রহ খেয়ে না খেয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলার ব্যাপারটি হয়ত আরেক পরোক্ষ শিক্ষক সেই আধোচেতন অবোধবেলার। “জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’/ দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!” এখানে ফুলের জায়গায় বই।

বিদ্যারম্ভ লম্ফঝম্প
আকাশে গাছে উঠে জাম্বুল খেয়ে, জমিতে তে’চাকা সাইকেল ঠেলে আর জলে নালায় তেচোখো মাছ ধরে বয়েস কিছুডা যহন ফনফনা দেলে, তহোন বারির কন্‌ফারেঞ্ছে ঠিক ওইলে পোলায় এট্টা ভ্যাবলা দামড়া ঐয়া যাইতেসে। এইবার ওডারে ইশকুলে ঢুহাইয়া না দেলে হারাডা জীবন এট্টা পাডা ঐয়া থাকফেহানে। আর য্যামন বলা অমনি কাজ। যেকোন এক দিনের সকালে, রোজকার মতন যখন আধন্যাংটা ধুলিধূসর হয়ে মহোৎসাহে গুল্লি খ্যালোন চলথেয়াসেলে, কাকা পিছন থেকে এসে নড়া ধরে নিয়ে চললেন এক ইশকুলের পানে। বেশ হিড়হিড়িয়েই টেনে নিয়ে চলেছিলেন আমায়, কিন্তু হঠাত কেন জানিনা কাকার উৎসাহ নিভে এল আর গতিবেগ ঝিমিয়ে পড়ল। কারণ বেশীক্ষণ খুঁজতে হল না, স্বকর্ণেই শুনলাম, দূরাগত আর্তনাদ আর আকূতি। কারা যেন কচি আর মাঝারি গলায় গগনভেদী হাহাকার করছে – “আ, আ, আ, আর করুম না, মাস্টামহা, আর করুম না, না না করুম না মানে করুম, করুম, পরা করুম, আ, আ,…”, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে আরেকটু কান পাতলেই সপাসপ বেতের শব্দ আর গুমাগুম কিলের শব্দ আর চটাচট চড়চাপড়ের শব্দ সব পরিষ্কার শোনা যেতে লাগল, ঠাহর করে দেখা গেল দূরে একটা টানা লম্বা বেড়াঘেরা টিনের চালার মধ্যে ঐ ঠ্যাঙ্গানি আর গোঙ্গানির উৎসব চলছে, যাকে বলা যায় মারের ধুন্ধুমার। আমার মায়ালু কাকা ততক্ষণে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন, এক্ষণে অস্ফুটে “আইজ থাউক” বলে পিছু ফিরে বাড়িপানে নির্জীব ভাবে হাঁটা দিলেন, আমি এসে আবার সেই গুল্লির আসরে লেগে পড়লাম আর আরো পুরো একটি বছর যাবত বেফিকির খেলাধূলা চালিয়ে গেলাম।

পরের বছর, আমার শক্তিশালী ছোটোকাকাকে সঠিক জল্লাদ ঠাউরে, তাঁকে দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে আমায় আবার সেই ইশকুলে পাঠিয়ে ভর্তি করা হল। আগের বার কানের ভরসায় যা শুনেছিলাম, তা হাড়কাঁপানো, এবারে চোখে যা দেখলাম তা একেবারে প্রাণজুড়ানো। শিক্ষকেরা ঘরেবাইরে যাতায়াত করে ক্লাসের ভিতর পড়ানো আর ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন বিচিত্র সব শাস্তির তত্বাবধানে নিরত আর সমগ্র বাড়িটার ভিতরে এক সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ওঠাপড়াওয়ালা বিচিত্র মিশ্রিত হাহাকার, হাসি, পড়া, শাস্তি ইত্যাদির প্রবল শব্দসাগর। তারপরেই হঠাত ট্যাংট্যাংট্যাংট্যাং ট্যাংট্যাংট্যাংট্যাং- ট্যাং- ট্যাংগাৎ করে এক ঘণ্টাধ্বনি আর তার দশ সেকেন্ডের মধ্যে সমস্ত কটা ঘর থেকে বল্গাহারা বলদের উন্মত্ত ঝাঁকের মত ছেলেরাশি বেরিয়ে গিয়ে পুরো ইশকুলবাড়িটা একেবারে মুহূর্তে নিঝুমনীরব হয়ে গেল।

আর শুনেছিলাম, যাতায়াতের পথে দাদুকে প্রণাম করতে আমাদের ইশকুলের এক শিক্ষক এসেছিলেন, দাদু তাকে স্বভাবজাত বরিশালি অসাধারণ একটি ছোট বাক্যে বলেছিলেন, আমাকে ভালো করে পড়াতে। বাক্যটি হল, “মাষ্টের ক্যাবোল পেরাণ্ডুগ রাইখ্যো”। যদি কেউ আদৌ না বুঝে থাকেন তাই বলা যাক, এর অর্থ হচ্ছে, ভালো করে পড়ানো মানে তো অবশ্যই ভালো করে পেটানো। অনুমতি ও অনুরোধ দেয়া হল, খুবই ভাল করে যেন পেটানো হয়, শুধু প্রাণটুকু যেন থাকে। আরো বেশী গভীরের বোদ্ধারা বুঝবেন, এর আরেক অর্থ হল, বেশী পিটিও না।

কালো হাতী আর কলাগাছ ছাপা সবুজ রঙের টিটাগড় পেপার মিলের খাতা আর দুএকটি বই নিয়ে ইশকুল যাওয়া শুরু করা গেল। সঙ্গে একটি পেনসিল, পায়ে হাওয়াই চটি, সাধারণ হাফপ্যান্ট আর জামা। কোনো টিফিন নিয়ে যাওয়া ইত্যাদির ধারণাই ছিল না। টিফিনে টিউকলের জল পেটপুরে খেয়ে খেলাধূলা চলত খানিক। সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল বুড়ো সুরেনদা বেয়ারা যার ঘন্টায় ক্লাস শেষ আর ছুটি হত।

ইশকুলে শাস্তির বৈচিত্র্য ছিলো চিত্তচমৎকারী আর নিত্যনব উদ্ভাবনে উদ্ভাসিত। আগেই বলা স্থিরপুঁটলি, ইঁটহাতে ইঁটলি, চলন্ত মুরগী, হাপ-চেয়ার, নীল ডাউন, জোড়বৈঠক অর্থাৎ দুজনে একে অপরের কান পাকড়ে ওঠবস, বইধরনি অর্থাৎ প্রচুর বই দুহাতে সোজা করে ধরে রোদে দাঁড়ানো, জোড়াবলদ অর্থাৎ জোড়ায় জোড়ায় অপরাধী ছাত্রদের চার হাতপায়ে জমি চাষ করার ভঙ্গীতে মাঠে চালানো। এগুলি ছিলো আউটডোর মেনু। ক্লাসঘরের মধ্যে চলত বেঞ্চিদাঁড়, জাঁতিকল অর্থাৎ দুই আঙ্গুলের মধ্যে একটা পেন্সিল দিয়ে আঙ্গু্লদুটিকে চাপ দেয়া, যাঁতাকল অর্থাৎ ঘরের কোনায় গিয়ে উবু হয়ে বসে কাল্পনিক জাঁতাকল ঘোরাতে থাকা, তালগাছ হওয়া মানে দুহাত উপর করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, উট হওয়া মানে পিঠ উঁচু আর বাঁকা করে চারহাতপায়ে চলা, মাকড়সা হওয়া মানে চারটি হাতপা চারিদিকে ছড়িয়ে মেঝেতে ওই ঢঙ্গে চলা, কাঁকড়া হওয়া মানে প্রায় একই রকম শুধু পাশের দিকে চলা, দু আঙ্গুলের বিভিন্ন আলাদা আলাদা কায়দাকৌশলে পেটের চামড়ায় রামচিমটি শ্যামচিমটি আর যদুচিমটি, জুলফি টানা, চুল টানা, নাকের ফুটোয় পেন্সিল দিয়ে টানা, গাঁট্টা, কড়মড় হ্যান্ডশেক, ডাস্টার চক বেত স্কেল বা বই ছুঁড়ে মারা, বাদুড়ঝোলা বা জানালায় দুটি পা আটকে মাথা নিচে করে ঝোলা, স্বল্প অপরাধে কাতুকুতু দেয়া, চক দিয়ে মাথায় ঠক্ ঠকা ঠক ঠোকা, কান মলা, চড়, কিল বা ঘুঁষি ইত্যাদি। আরেক অসাধারণ কনসেপ্ট ছিল এ্যাডভান্স প্যাঁদানি। পিঠতরংগ নামক এক অসাধারণ সাজা এই স্কুলের আবিষ্কার, পেটেন্ট নেয়া ছিল কিনা জানিনা তবে নেয়া উচিত ছিল। মাঝে মাঝে একেকটি বাদশাহী কিলের আওয়াজ ভয়ে নিস্তব্ধ ক্লাসরুমে যেভাবে নাদিত অনুনাদিত হত, বিশাল বিশাল বেনারস বা ফারুক্কাবাদ ঘরাণার বাঘা বাঘা তবলিয়ারা ওই ধরণের গুমগুমে গুম্মুশ আওয়াজ তাঁদের বাঁয়া থেকে শত তালিমেও বার করতে পারবেন না। জ্যামিতির ক্লাসে ঠ্যাঙ্গানি খেতে হত পালিশ করা কাঠের তৈরি বিশাল আকারের বৃত্ত আঁকার কাঁটাকম্পাস আর গোদা গোদা কাঠের চাঁদা আর ছফুট লম্বা স্কেল দিয়ে। ইনডোর সাজাগুলি আলাদা আলাদা শিক্ষকের একান্ত নিজস্ব শৈলীর আবিষ্কার ছিলো।

বয়স্ক শিক্ষক ছিলেন তিন-চারজন, জানিনা তখন অবসরের বয়েস কতো ছিল, কিন্তু হয়ত আমাদের কচি চোখে তাঁদের একটু বেশিই বয়েসী মনে হত। একজনের চশমা ছিল চায়ের দোকানের গেলাসের তলার মতন পুরু, উনি খুব ফর্সা ছিলেন, ফর্সা ধুতিপাঞ্জাবি পরতেন। গালে এক মস্ত আব ছিল। খুব লম্বা ছিলেন, ডাস্টার হাতে করে মাথার উপর যখন “হুনুমান-“ বলে ঝুঁকে দাঁড়াতেন, ওই চশমার ভিতর দিয়ে তাঁর চোখদুটোকে প্রভু জগন্নাথের চোখ মনে হত (জগন্নাথের চোখ তখনো জানিনি) আর আতঙ্কে প্রাণ সিঁটকে যেত, যদিও উনি মারতেন না খুব একটা। আরেকজন অঙ্ক না বুঝলে চক দিয়ে মাথায় ক্রমাগত ঠুকতে থাকতেন আর বলতেন –“টাক্ দ্দিয়াই মাথায় ঢুহামু বান্দর কাহিকা এগুলাইক এ্যাম্‌নে বোজফে না, জরোবরোতের বংশ”। আর তৃতীয় জনের সম্ভবতঃ একটা “স্টোক ঐসেলে” তাই চলাফেরা ধীর হয়ে গিয়েছিল, উনি মারধোরের মত পরিশ্রমসাধ্য বিনোদনের আনন্দে বঞ্চিত হয়ে পড়েছিলেন। আর চতুর্থ বৃদ্ধ ক্লাসে কোনো ছেলে অতিরিক্ত গোলমাল করলে তার ঘাড় ধরে ঠেলে ঠেলে বহু বহুদূরে নিয়ে যেতেন, সে প্রায় গেটের কাছে। আর বারবার বলতেন – “তরে মুক্তি দিয়া দিলাম যা তরে মুক্তি দিয়া দিলাম”। এই অসামান্য সব উদাহরণের ফল আমাদের পরবর্তী জীবনে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, এই “মুক্তি দেয়া আর মুক্তি নেয়া”র কার্যকরী দর্শন অবচেতনে ঢুকে গিয়ে মহা ফলপ্রসূ হয়েছিল। এছাড়া ছিলেন ইংরেজী উচ্চারণ সঠিক শেখানোর বাতিক স্যার, দেহেকন্ঠে বলিষ্ঠ এনসিসি স্যার, কিছুবা রসিক রসায়ন স্যার, যমদূতসম ইংরেজী স্যার, স্বপ্নচোখো সুদূরপরাহত বায়োলজি স্যার,আর যমসম হেডস্যার। কেউ পেতেন ভীতি কেউ ভালোছেলেদের প্রীতি কেউবা কিছু ভক্তি। এঁদের শুধু ক্লাসেই দায়িত্বরত অবস্থায় দেখেছি, নিজে পলায়নপর ছাত্র বলে এঁদের কারো মানবিক দিকটি ব্যক্তিগত ভাবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি, তাঁরাও কেউ ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ল্যাজ ধরে আমায় টেনে বার করে খতিয়ে দেখেননি। আজ পরিষ্কার বুঝি, সেই হতদরিদ্র অবস্থায় সংগ্রামের কালে, যখন নিয়মিত মাইনেই পাওয়া যেতনা, সংসারের অভাব ঘুচতো না, তখন এক পাল পঠনবিমুখ অবাধ্য দুর্দান্ত ছেলেকে পথে আনতে প্রথম উপায়ই ছিল ঠ্যাঙ্গানি, আর তার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনজ্বালার কথঞ্চিৎ ক্যাথারসিস অর্থাৎ রেচন। তাঁদের জব্বর প্যাঁদানি আর সুযোগ্য পড়ানোর যুগপৎ তাড়নায় হাজারো ছেলে আজ দিব্যি করেকম্মে খাচ্ছে, আর যতই দিন যাচ্ছে সেই শিক্ষকদের উপরে ভক্তি শ্রদ্ধা মায়াও বাড়ছে। আমরা স্কুল ছাড়তে ছাড়তে তাঁদের বেতন বাড়ায় পরবর্তীকালে তাঁরা সুখের মুখ দেখেছিলেন।

সায়েবী শিক্ষার সাময়িকী
কি না কি দৈবযোগে জানিনা, অবাক কান্ড, কলা ও বিজ্ঞানের দুরকম বিষয়গুলিতেই কিছু কিছু ছপ্পড়ফাড়া নম্বর পেয়ে যাবার ফলে, মূলতঃ দিশাহারা হয়েই, বড়রা আমায় গস্ত করে দিলেন দুই জায়গায় একইসঙ্গে – প্রেসিডেন্সীতে ইংরেজী সাম্মানিক আর সেন্ট জেভিয়ার্সে পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক। জেভিয়ার্স একটু কাছে হওয়ায় আর সেখানে আগে ক্লাস শুরু হওয়ায়, আর “ছাইঞ্ছ পড়লে চাকরি তরাতুরি পাইবে” ভাবনার প্রতারণা ও প্রতাড়নায়, এই অপদার্থ গিয়ে পদার্থবিদ্যার আঙ্গিনাতেই এক কোণে সসঙ্কোচে বসে পড়লো। প্রত্যন্ত মফস্বলের অত্যন্ত দরিদ্র রেফিউজী রুগ্ন ছোকরার বিস্মিত চোখে সে কলেজ এক রাজপ্রাসাদের মতন জেলখানা। একপাশে বসেছে চোখা চৌকস ইঙ্গভারতীয় ঝোলাকাঁধে ফ্রেঞ্চু আঁতেল স্টিভেন টমাস, সে আবার ‘জেড’ কে ‘জ্বি’ বলায় কিছুই বুঝতাম না। অন্যপাশে মাখনচাম নুদুস গোরা কোঁকড়াচুলো গোয়ানীজ পর্তুগীজ র‍্যালফ্‌ গ্যেররা। এমনিতেই কথ্য ইংরেজি বুঝিনা, তায় সে আবার তথদধ ইংরেজি বলায় প্রায় কিছুই বুঝতাম না। ভাগ্যিস ফাদার ব্রাদার টীচারদের ভয়ে ভক্তিতে কেউই প্রায় টুঁ শব্দটি করতে পারত না, কথাবার্তা বিশেষ দরকার হত না। কিন্তু তাতে তো রক্ষে নেই, নিয়মের বেড়াজালের ফাঁক দিয়ে টিফিন টাইমের রোদ্দুরটুকু যখন আসতো, সব্বাই যে চোখা ইংরেজীতে কথা কয়! এমনকি ক্যান্টিনের বিল-কাটা বাবু আর হায় মায় টিনের বাক্সে প্যাটিস আর পেটো সাইজের ভেজিটেবিল চপ-বেচা ভেন্ডারও তার ভান্ড খুলে মাল দেখিয়ে বলে কিনা “অল ফ্রেশ হোমমেড পাইপিং হট”। তখন আদৌ জানতে পারিনি, আরো কয়েকটি পাতি বা খেঁকি বঙ্গ এই কলেজের ঘনগম্ভীর নিয়মাধীন আভিজাত্য আর গরিষ্ঠ ছাত্রমহলের নাকউঁচু ট্যাঁশ পরিবেশের আড়ালে আমারি মতন গোকুলে বাড়ছে পরের বছর বিক্কলেজের খাতায় নাম লেখাবে বলে। বেড়ার ঘরের বিদ্যালয়ে শুরু করে আস্তরহীন ইঁটের ইশকুলবাড়ির নড়বড়ে বেঞ্চি হয়ে এই আলিশান মহলের সমুচ্চ ছাদের নিচে ধাপেধাপে উঠে-যাওয়া প্রেক্ষাগৃহে আড়ষ্ট হয়ে বসে মঞ্চে আসতে দেখতাম দিকপাল সব শিক্ষকদের – লাল গোরা ফাদার গ্যোরে, সমাজসেবী রক্তদানবীর ফাদার হ্যুয়ার্ট, দক্ষিণী ফাদার ম্যাথ্যু, ফিজিক্সের প্রফেসর বোস, কো-অরডিনেট জিওমেট্রির প্রফেসর দেব রয়, থারমোডাইনামিক্সের প্রফেসর ভঞ্জ, এছাড়া প্রফেসর দাশগুপ্ত, প্রফেসার সাহা, প্রফেসর রামকৃষ্ণ ঘোষ, আরও অনেকে।

তাঁদের ব্যক্তিত্বের দাপট, ইংরেজীর ঝাপট আর বিষয়ের দখল তিনটি জিনিস পাল্লা দিয়ে চলত। কিমাশ্চর্যম, এই তাসের দেশের স্বর্গেও দুচ্চার ডেভিলের অনুপ্রবেশ হয়েছিল। পরম ঐতিহ্যমন্ডিত ওই সুগম্ভীর প্রতিষ্ঠানেও, নাম ডাকার পর অনেক উঁচু সিঁড়িবেঞ্চি থেকে সাহসী বদমাশদের ধাপ্পুস ধুপ্পুস লাফিয়ে পড়ার সেই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত আওয়াজ আর তারপরেই লাগোয়া বারান্দা দিয়ে দুড়দুড় করে দৌড়ে পালানোর আওয়াজ আজও কানের পর্দায় একেবারে তাজা তাজা শুনতে পাই।

সাইন্স ছাড়াও কমার্স আর আর্টস এর অনেক প্রখ্যাত প্রফেসরের গপ্পোগাথা দালানের হাওয়ায় ভেসে বেড়াত, তার মধ্যে উপাদেয় ছিল প্রফেসর এন এন বিশ্বনাথনের ক্লাসে-ছড়ানো মণিমুক্তাগুলি। আর অপার বিস্ময়মেশা আনন্দ পেয়েছিলাম যে শিক্ষককে দেখে, তিনি ওখানকার রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারের হয় অধ্যাপক নতুবা ভারপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ঘিয়ে সিল্কের পাঞ্জাবি আর সরুপাড় ধুতি আর সোনালী চশমা পরা সেই বাঙ্গালীর বলা ইংরেজী এত অপূর্ব লেগেছিল, পরে এক এক সময় মনে হয়েছে যেন সত্যজিত রায়ের ইংরেজী বলার চেয়েও ভালো। হয়ত ছোটবেলার মনের ভুল,নাকি তা নয়। এর বহু পরে দূরদর্শনের পর্দায় অপূর্ব গান গাইতে দেখে আবার নতুন করে অবাক হয়েছিলাম জেনে যে তিনি হলেন কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের দৌহিত্র এবং অসাধারণ কন্ঠশিল্পী দিলীপকুমার রায়, যিনি মাত্র ১০৫ বছর বয়েসে সজ্ঞানে আনন্দধামে যাত্রা করেছেন এই গত ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০২২।

ডাঙরের ডিঙ্গি পেল ডাঙা
জয়েন্ট জানতাম না। কেউ বলেছিল জায়েন্ট এন্ট্রান্স। ভাগ্যচক্রে জানতে পারি। প্রস্তুতি ছিলো না। দুর্গাপুরে সিভিল আর কী যেন, বিক্কলেজে আর্কি আর কী যেন পাই। ঠাকুমার শেখানো সেই জলের আঁকা দিয়ে ঘটে বসানো পাতাবাহার খাতাবাহারে বানিয়ে ফেলে আর্কিছাঁকনির প্রথম গাঁট পার হই আর সেন্ট জেভিয়ার্সে বোকা বনার পর জেদ করে শেখা এক্টুখানি অকথ্য ইংরেজীর দৌলতে পরের লৌহকপাটটি খুলে যায়। আমার মৌখিক পরীক্ষা চলাকালীন স্বয়ং প্রণম্য অধ্যক্ষ অধ্যাপক অরুণকুমার শীল হঠাত ঢুকে একটু বসেছিলেন, অকস্মাৎ আদেশ করেন, তাঁর সেই অবিস্মরণীয় একান্ত নিজস্ব ভঙ্গী ও উচ্চারণে-“ষ্পীক ইন ইংলিষ!”“মেক্যানিকাল ইত্যাদি পাও নি কেন?”
কেঁপেকুঁপে একাকার লদোভূনু অবস্থায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “স্যার ম্যাস্যাক্যার ইন ম্যাথস”।
উনি অল্প মুচকি হাসি দিয়ে শুরু করে পরে বেশ দরাজ গলায় জোরে হেসে উঠেছিলেন মনে আছে।

জীবনে প্রথম এই স্থাপত্যের বিভাগে এসে হাঁফ ছেড়েছিলাম কারণ ভুল করে ভেবেছিলাম বিষয়টি খানিকটা সহজ তাই আমার রুগ্ন সামর্থ্যেও নড়বড় করে পার করতে পেরে যাবো। এটা বুঝিনি যে স্থাপত্য এক সুবিশাল সুকঠিন আর সাড়ম্বর সানন্দ আয়োজন, তাকে যে যেভাবে পারে আপন করে নিজ নিজ ক্ষমতায় যোগ্যতায়,অন্ধের হস্তী দর্শনের মতন, কিন্তু সে নিজে মোটেও সহজ বিষয় নয়। যাই হোক নিজের সামান্য ক্ষমতায় এই বিষয়টি পড়তে পড়তে পেয়েছিলাম এক শিক্ষককে যিনি শিক্ষকদের শিক্ষক হয়েও শিক্ষক ছিলেন না, কারিগরি সহকারি মাত্র ছিলেন। তাঁর কথা আগে এক শিক্ষক দিবসে লিখেছি। তাঁর কাছে পেয়েছি অপার অকৃত্রিম স্নেহের মাধুরী কিন্তু তাঁর গুণাবলী, অবিদ্বেষী মন,নিয়মানুবর্তিতা কিছুই নিতে পারি নি, যথারীতি। পড়াশুনার এই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে আবাসীয় সংস্থানে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের কাছে আসার জন্য হতে হয় মেস ম্যানেজার, স্বভাবে ম্যানেজার, খেলুড়ে, ছাত্রনেতা বা খুব ভালো কোলঘেঁষা ছাত্র। লম্বায় ধ্যাড়েঙ্গা হলেও এসব গুণাবলীতে ঢু-ঢু হবার কারণে আবারো সেই দূরত্ব একইভাবে শিক্ষকদের থেকে বজায় রেখে, কোনোমতে ক্লাস করে আর হাতের কাজগুলি একেবারে শেষ মুহূর্তে জমা করে এই পড়াশুনাও পার করে দেই।

আমাদের ব্যাচে পনেরটি ছাত্রের মধ্যে একটিও ছাত্রী না থাকার ব্যাপারটি বেশ লক্ষণীয় ছিল। আর আমরা সায়েবী যুগের শেষ অপস্রিয়মাণ আলোক দেখেছি, কীর্তিকার সায়েব, শ্রদ্ধেয় অবনী কুমার দে স্যারদের পেয়েছি আর আরো আগের যুগের অশেষ গুণী শিব মুখার্জী স্যারকেও একান্ত বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েছি, এঁরাই শেষ নিয়মিত টাই-বাঁধা শিক্ষক ছিলেন, এঁদের গায়েই লেগে ছিল সেই স্বপ্নযুগের গন্ধ যেথায় একদা চলেফিরে বিদ্যা বিতরণ করেছেন প্রফেসর স্টেইন, প্রফেসর স্যাক্রেস্তির মত মানুষেরা আর দেখা দিয়ে গেছেন বিশ্বখ্যাত যুগন্ধর স্থপতিরা, বাকমিন্সটার ফুলার আর রিচার্ড নিউট্রার মত স্থাপত্যের দিকবদল আর দিনবদলকারী গুণীরা। পড়াশুনো আর শিক্ষকদের থেকে পালিয়ে পালিয়ে থেকেও আমাদের কালের শিক্ষকদের হাতযশ, ধৈর্য, সহ্য,পরিশ্রম আর আশীর্বাদেই এতকাল করেকম্মে খেলাম। আজ দুঃখ হয়, যদি তাঁদের একটু কাছে যেতাম, ধরা দিতাম, ধরতে পারতাম, আরো কিছু নিতাম, নিশ্চই জীবনে আরেকটু ভালো করে পেশার মাধ্যমে সমাজসেবাটুকু করতে পারতাম। আমরা যাঁদের কাছে পড়েছি, এই অল্প পরিসরে আলাদা করে সবার কথা বলা যাবেনা তাই তাঁদের সবাইকে একইসঙ্গে এক বেদীতে প্রণাম জানালাম।

নিজেদের শিক্ষকেরা ছাড়াও বিক্কলেজের সামগ্রিক পটভূমিকায় দূর থেকে দেখেছি শুনেছি জেনেছি কিছু কিছু বুঝেছি আরো অনেক অনেক অন্য বিভাগের শিক্ষকদের চেহারা ও ভূমিকা, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, প্রত্যেককে নিয়েই এক একখানি পুস্তক লেখা যেতে পারে। তাঁদের সবার মধ্যে যোগসূত্র আর সাধারণ গুণাবলী ছিলো প্রতিভা, সারল্য, সহজ জীবন, ছাত্রদরদ আর প্রতিষ্ঠানগর্ব।

কোনো এক বিশেষ বিভাগে পড়লেও,সর্বদা চেষ্টা করেছি বিক্কলেজকে তার সমগ্রতায় সমস্ত প্রাচীন গাম্ভীর্য নিয়ে, রহস্য নিয়ে, মায়া নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে, তার ঐতিহ্য সৌকর্য সুকৃতি নিয়ে, তার ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান জল গাছ মাঠ বাড়িঘর নিয়ে সমস্ত শিক্ষক অশিক্ষক ছাত্রকে নিয়ে ভালোবাসতে, সেও ফিরে দিয়েছে এক জীবনব্যাপী ভালোবাসা যার মৃদু সুবাস ঘিরে থাকে এই জরাধরা হৃদয়ের অলিন্দ আর প্রকোষ্ঠকে, নাছোড়বান্দা স্মৃতি আর অনিঃশেষ শুভকামনায় ভরা এক আশ্রয় এই বিক্ষত পৃথিবীতে যেনবা।

The duties of a teacher are neither few nor small, but they elevate the mind and give energy to the character.     – Dorothea Dix

Sahityika Admin

Add comment